কিছু বলবেন আমাকে?
কৃষ্ণকান্ত স্মিত মুখে বললেন, এসো, ভিতরে এসো।
ধ্রুব খুব বিস্মিত পায়ে ঢুকল।
বোসো, বোসো।
ধ্রুব বসল।
কাল সকালে আমাকে একবার দিল্লি যেতে হচ্ছে!
জগাদা বলছিল।
ফিরব কবে তার ঠিক নেই। তারপর…।
ধ্রুব অপেক্ষা করতে লাগল। কৃষ্ণকান্ত বেশ কিছুক্ষণ থেমে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন, অনেক কাজ।
কাজ!—ধ্রুব প্রতিধ্বনি করল মাত্র। কৃষ্ণকান্তর কথাবার্তা তার বেশ অসংলগ্ন লাগছিল।
কৃষ্ণকান্ত স্বগতোক্তির মতো করে বললেন, ছেলে দুটো বাইরে রয়ে গেল। লতুটার কথাও ভাবা দরকার।
ধ্রুব একটু ধৈর্যহীন গলায় বলে, আমাকে কি কিছু করতে হবে?
কৃষ্ণকান্ত মাথা নেড়ে বললেন, সেইজন্যই ডাকা।
বলুন কী করতে হবে।
তোমার দাদা আর ভাইয়ের একটু খোঁজ নাও। ওদের চিঠিপত্র অনেককাল পাই না।
দাদাকে তো আপনি ত্যাজ্যপুত্র করেছেন।
আমার ত্যাজ্যপুত্র হলেও সে তোমার ত্যাজ্য ভাই তো নয়।
ঠিক আছে। খবর নেব। লতুর কথা কী বলছিলেন?
লতুর বিয়ে দেওয়া দরকার।
ও। সে ক্ষেত্রেই বা আমার করণীয় কী?
করণীয় অনেক। যদি করো।
পাত্র দেখা তো!
হ্যাঁ। উপযুক্ত ঘর বর চাই। কাজটা সহজ নয়।
দেখব। আর কিছু?
আপাতত তোমাকে নাসিক যেতে হবে না।
প্রোগ্রামটা কি ক্যানসেল হল?
হল। ভেবে দেখলাম এ সময়ে তোমাকে নাসিক পাঠালে এদিকে অসুবিধে দেখা দেবে। দিব্য এখনও ছোট। তাকে নিয়ে বউমা অত দূরে যেতে পাববে না।
এখানে থেকে আমি কী করব?
সেটা তোমার ওপর নির্ভর করছে।
তার মানে?
তুমি একটা চাকরি করছ শুনেছি। চাকরি জিনিসটা আমার পছন্দ নয়। একটু বাঁধা কাজ, একটু বাঁধা মাইনে, ওতে মানুষ ক্ষুদ্র হয়ে যায়, খণ্ডিত হয়ে যায়, জীবনের স্বাদ পায় না। আমি কেমন চাই জানো? কাজ অফুরন্ত, আয় অফুরন্ত, আয়ু অফুরন্ত। ইংরিজিতে একটা কৃপণ-কথা আছে, কাট ইয়োর কোট অ্যাকর্ডিং টু ইয়োর ক্লথ। আর ঠাকুর ঠিক উলটো করে বলতেন, কাট দি ক্লথ অ্যাকর্ডিং টু ইয়োর কোট।
আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না।
বোঝা সহজও নয়। যাক গে, সবটাই তোমার ওপর নির্ভর করে। তুমি চাইলে চাকরিই করবে, আমার সাজেশন যদি নাও তত বলব, ব্যাবসা করে। একটা কোনও প্রোডাকশনে নামো। তাতে এমপ্লয়ি না থেকে নিজেই এমপ্লয়ার হতে পারবে।
ভেবে দেখব।
দেখো। আর একটা কথা।
বলুন।
বউমা খুব কান্নাকাটি করেছে আজ।
কেন?
তোমার জন্য।
আমার জন্য?
হ্যাঁ। প্রথমে আমাকে বলতে চায়নি। কিন্তু শেষ অবধি একটু বলেছে। তোমার নাকি একটা ডেথ। উইশ হয়েছে আজকাল।
ধ্রুব চোখ নামিয়ে নীচের ঠোঁট কামড়াল। তারপর বলল, ওটা কিছু নয়।
কৃষ্ণকান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, তা হলেই মঙ্গল। বাবা হয়েছ, দায়িত্বও অনেক। মরলেই মরা যায় বটে, কিন্তু সেটা প্রকৃতির আইন নয়, জৈবিক চাহিদাও নয়। বাবা-পিতামহের কাছ থেকে পাওয়া এই জীবন যতটা সম্ভব প্রলম্বিত করাই হচ্ছে জৈবিক আকুতি। বউমা আমার কাছে কথাটা ভেঙেছে বলে তাকে আবার বোকো না, সে বড় নরম মানুষ। পাজি হলে চেপে রাখতে পারত।
আজ্ঞে।
সে তোমার অতিশয় অনুগত। নিশ্চয়ই সেটা টের পাও?
ওসব কথা থাক।
আচ্ছা থাক, যে কথাটা বলছিলাম। কাল দিল্লি যাচ্ছি বিশেষ একটা কাজে। খুব ব্যস্ত থাকব। হয়তো আমার চিঠিপত্র পাবে না। ফিরতেও দেরি হবে। সেক্ষেত্রে তোমাকে কিছু দায়িত্ব নিতে বললে অসন্তুষ্ট হবে না তো!
ধ্রুব এবার কৃষ্ণকান্তর দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা আঁচ করতে চেষ্টা করল। কৃষ্ণকান্তকে বেশ প্রশান্ত, পরিতৃপ্ত ও উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। দিল্লিতে একটা বড় রকমের অফার আছে নিশ্চয়ই। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্ব নাকি? সেটাই সম্ভব। প্রধানমন্ত্রী এবং হাই কম্যান্ডের সঙ্গে সম্ভবত একটা আঁতাত হয়েছে।
ধ্রুব বলল, অসন্তুষ্ট হব কেন?
জগা রইল, অন্য সবাই রইল। বউমা তো আছেই।
ঠিক আছে।
এখনই উঠো না। একটু বসো।
ধ্রুব অপেক্ষা করল। কৃষ্ণকান্ত তাঁর দেরাজের চাবি বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, এটা রাখো। নীচের দেরাজে আরও কিছু চাবি পাবে। আলমারি, সিন্দুক এইসবের।
এগুলো আমাকে দিচ্ছেন কেন?
যদি দরকার হয়?
আপনার সব জিনিস, আমি হাত দিতে যাব কেন?
হাত দেওয়ার কথা বলিনি। চাবি নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর কোনও মানে হয় না বলে তোমাকে দিয়ে যাচ্ছি। রাখখা।
অনিচ্ছের সঙ্গে ধ্রুব হাত পেতে চাবি নিয়ে বলে, আর কিছু বলবেন?
হ্যাঁ। এনিমি প্রপার্টির কিছু টাকা পেয়েছি। সেটা ক্যাশ করে আলমারিতে রাখা আছে। যদি কোনও ব্যাবসার কথা ভাবো তা হলে নিয়ো। আমার অনুমতি দেওয়া রইল।
সে টাকা নিয়ে আত্মীয়দের কী সব ঝামেলা চলছে না?
এখন আর নেই। ঝামেলা হলেও গ্রাহ্য কোরো না। টাকা আমার। ওবা প্রাপের অনেক বেশি আমার কাছ থেকে পেয়ে এসেছে।
ঝামেলা আমার ভাল লাগে না।
কৃষ্ণকান্ত একটু হেসে বললেন, এ ব্যাপারে আমি আর কিছু বলতে চাই না। তবে তোমার যদি ইচ্ছে করে তা হলে আত্মীয়দের ওই টাকা থেকে কিছু ভাগ দিতেও পারে। তাতে তোমার সুনামই বৃদ্ধি পাবে।
আমার সুনাম নেই।
আমারও বোধহয় নেই। তবে সৎকাজ করে গেলে একদিন না-চাইতেও সুনাম হয়ে যায়। প্রসঙ্গটা থাক। মোট কথা যা ভাল বুঝবে করবে। আমি দূরে যাচ্ছি, সেখানেই থাকতে হবে আপাতত। নিজের বুদ্ধি বিবেচনা খাটিয়ে চলো।
আচ্ছা।
এবার যাও। বিশ্রাম করো।
ধ্রুব উঠল। ঘরে আসবার পথে সে ভারী অন্যমনস্ক রইল। কৃষ্ণকান্ত কি সত্যিই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হচ্ছেন?
১০৩. বিশাখার বিবাহ
“বিশাখার বিবাহই বোধহয় আমার জীবনের শেষ শুভ কাজ। কারণ, আমার কনিষ্ঠ পুত্র কৃষ্ণকান্তর বিবাহ আমি দিয়া যাইতে পারিব বলিয়া ভরসা করি না। স্বদেশি ও সন্ন্যাসী কৃষ্ণকান্ত আপাতত ঢাকার পথে। সেখানে সে আত্মসমর্পণ করিবার পর কী হইবে তাহা ঠাকুর জানেন। ফাঁসি যদি নাও হয় যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর কি ঠেকানো যাইবে? লক্ষণ দেখিয়া বুঝিতেছি, তাহাকে বেশ কিছুদিন হাজতবাস করিতে হইবে। সে গেল এক কথা। তাহার উপর পুত্রের মতিগতি দেখিয়া বুঝিতেছি, সংসারধর্ম পালন করিবার বিন্দুমাত্র আগ্রহ তাহার নাই এবং অদূর ভবিষ্যতে হইবেও না। আমার আয়ুর বেষ্টনী দিয়া আমি আর তাহার জন্য বিশেষ কিছু করিতে পারিব বলিয়া মনে হয় না। তাই ধরিয়া লইয়াছি, বিশাখার বিবাহই আমার জীবনের শেষ শুভ কাজ। কাজটি নির্বিঘ্নে সমাধা হয়, ইহাই আমার ইচ্ছা।