হেমকান্তর দেশভ্রমণের নেশা নেই। বস্তুত বাইরের জগৎ সম্পর্কে তাঁর ভীতি ও অজ্ঞতা সর্বজনবিদিত। নিজের জমিদারিরও সর্বত্র তিনি যাননি। অপরিচিত পরিবেশ ও অচেনা মানুষজনের মধ্যে তিনি বড় অস্বস্তি বোধ করেন। হেমকান্তর বন্ধু হোমিয়োপ্যাথ যোগেন্দ্র সিংহ প্রায়ই বলেন, তোমার বাপু এটি একটি মানসিক রোগ। পুরুষ মানুষের ঘরকুনো স্বভাব খুব স্বাভাবিক ব্যাপার নয়।
কিন্তু হেমকান্ত ভাবেন, ঘরের বাইরে যে বিশাল পৃথিবী তার যত বৈচিত্র্যই থাকুক, নিজের গণ্ডিবদ্ধ জীবনেও যে তিনি বৈচিত্র্যের শেষ পান না। দুর্গাবাড়ির মণ্ডপের পিছনে একটি পোডড়া জমি আছে। এদিকটায় কেউই বড় একটা আসে না। এই ছাড়া-জমির একপাশে একটি শুকনো খাদে বাড়ির আবর্জনা ফেলা হয়। এই জমিটায় এক সময়ে হয়তো বাগান ছিল। এখন আগাছার নীচে মাটিতে মখমলের মতো শ্যাওলা পড়েছে। বাগানের শেষপ্রান্তে একটি ভাঙা ব্রহাম গাড়ি পড়ে আছে কবে থেকে। তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে উঠেছে লতানো গাছ। হেমকান্ত মাঝে মাঝে কামলা ডেকে কিছুটা করে পরিষ্কার করান। তাই জঙ্গল খুব ঘন হতে পারেনি। কিন্তু এই জায়গাটার বন্য ও পরিত্যক্ত ভাবটিকে কখনও নষ্টও হতে দেন না হেমকান্ত।
কেন এই জায়গাটা হেমকান্তর প্রিয় তার সুস্পষ্ট কোনও উত্তর তার নিজেরও জানা নেই। তবে এই জায়গায় পা দিলেই তার ভিতরটায় একটা সুবাতাস বয়ে যায়। প্রায় আড়াই বিঘের এই ভূমিখণ্ডটি উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। পাঁচিলের গায়ে গায়ে চিরুনির দাঁড়ার মতো রুজু রুজু ঢ্যাঙা পাম। গাছ। পৃথিবী থেকে আলাদা করে নেওয়া এই ভূমিখণ্ডে হেমকান্তর মন অবাধে বিস্তার লাভ করে। কত দার্শনিক চিন্তা আসে। বুহাম গাড়িটার একটি পাদানি ঝেড়েঝড়ে রোজ পরিষ্কার করে রেখে যায় চাকর রাখাল। হেমকান্ত বিকেলের দিকে প্রায়ই এসে সেই পাদানিতে বসেন। চারধারে কীট-পতঙ্গ পাখিদের শব্দ। বনজ একটা গন্ধ তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। কাশী বৃন্দাবন, হিমালয় বা সমূদ্র কোথাও যাওয়ার কোনও প্রয়োজন বা তাগিদ তিনি বোধ করেন না। তার মনে হয়, এই তো বেশ আছি। মানুষের মন এক অদ্ভুত চিত্রকর। চেনা পরিচিত জায়গাতেও সে কত নিপুণ হাতে তুলির একটু-আধটু টানে কত অপরিচিত দৃশ্যই না ফুটিয়ে তোলে। ব্রহাম গাড়ির পাদানিতে বসে হেমকান্ত তাঁর মনটিকে কাজ করে যেতে দেন। ধীরে ধীরে তার সামনে ফুটে ওঠে অভ্রভেদী পাহাড়, তরঙ্গক্ষুব্ধ সমুদ্র, কনখলের রাস্তা বা ইংলন্ডের মফসসল।
মনোরাগ? না, তার কোনও মনোরোগ নেই তো! তবে একটা দুঃখ আছে। খুব গোপন দুঃখ। কিংবা হয়তো তা গোপন এক সুখই আসলে। সেই দুঃখ বা সুখের কথা তিনি বড় একটা কাউকে বলেননি কখনও। শুধু সচ্চিদানন্দ জানে।
যেদিন কুয়োর বালতি হাত থেকে পড়ে গেল, সেদিন ভারী ও বিপুল বেলজিয়ামের কাচে তৈরি তিন খণ্ডের পূর্ণাবয়ব আয়নার সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়ালেন তিনি। স্ত্রী-বিয়োগের পর একবার মৃত্যু-চিন্তা এসেছিল তাঁর। সেটা স্থায়ি হয়নি। বিসর্জিত অই সেই মৃত্যু-চিন্তা ও শ্মশানবৈরাগ্যকে ধুয়ে নিয়ে গিয়েছিল। হেলে পড়া গাছ যেমন ঠেকনায় ভর দিয়ে বেঁচে থাকে, তেমনি স্ত্রী-বিয়োগের সময় তাকে ঠেকা দিয়ে রেখেছিল রঙ্গময়ি। শুধু রঙ্গময়ি বলেই পেরেছিল। নইলে তখনই হেমকান্তর সংসার ছাড়ার কথা।
বেলজিয়ামের খাঁটি ও মহান আয়না তাকে কিছুই বলল না। তিন খণ্ডে তাকে ভাগ করে বিশ্লেষণ করল, তার তিনটি প্রতিবিম্বকে কোলে নিয়ে ভাবল অনেকক্ষণ কিন্তু কিছুই বলল না। সব কথা বলতে নেই। হেমকান্ত বিষণ্ণবদনে এসে বসলেন সেই ব্রহাম গাড়ির পাদানিতে।
বিকেল হয়েছে। ফার্ন জাতীয় কিছু সুন্দর গাছ গজিয়েছে ব্রহাম গাড়িটার আশেপাশে। ভারী সুন্দর গাছগুলি। হেমকান্তর পায়ে মোজা এবং তালতলার চটি। সেই চটির ডগা দিয়ে তিনি গাছগুলিকে একটু আদর করলেন।
একটা আবছা ধোঁয়ার আস্তরণ হালকা মেঘের মতো ভেসে আছে সামনে। দুর্গাবাড়ির পিছনের অংশটা দেখা যাচ্ছে না। যে ঘাসে-ছাওয়া শ্যাওলায় পিছল আঁকাবাঁকা পায়ে-চলা পথটি ধরে রোজ তিনি বুহাম গাড়িটার কাছে আসেন সেটাও আজ ওই আবছায়ায় অর্ধেক আড়াল। সেদিকে চেয়ে তিনি ভোররাত্রির ঘটনাটা আবার তৈরি করতে লাগলেন মনে মনে। তুচ্ছ ও সামান্য একটা ঘটনা।
ইঁদারার মধ্যে একটু ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছেন হেমকান্ত। বাঁ হাতে দড়ির লাছি সতর্ক মুঠোয় ধরা, ডান হাতের আলগা মুঠির ভিতর দিয়ে পিছল সাপের শরীরের মতো নেমে যাচ্ছে পাটের মজবুত দড়ি। শীতকালে জল নেমে যায়। বালতি সেই অনন্ত গহ্বরে নামছিল তো নামছিলই। কোথাও অন্যমনস্কতার কোনও কারণ ছিল না। আর কেউ খবর রাখে না, শুধু হেমকান্তই জানেন, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কাজেও তাঁর মতো সতর্ক লোক দ্বিতীয়টি নেই। এই গুণের জন্য গোপনে একটু গর্ববোধও আছে তার। আচমকা দড়ির প্রান্তে বাঁধা বালতি জল স্পর্শ করল। শব্দ পেলেন হেমকান্ত। বহিরাগতের স্কুল স্পর্শে নিথর ঘুমন্ত জলে কুমারী-শরীরের মতো শিহরন। বাঁ হাতের শক্ত মুঠিতে ছিল দড়ির লাছি এবং শেষ গিট। ডান হাতও সতর্ক ছিল। তবু কেন তার দুটি হাতের কোনওটাই ধরে রাখল না দড়িটাকে? অসতর্কতা নয়, অন্যমনস্কতা নয়। হেমকান্তর মনে হয়, তার দুটি হাত ছেড়ে দিতে চেয়েছিল দড়িটাকে, তাই দিল। হেমকান্তর কিছু করার ছিল না।
সেই দুটি হাতের দিকে শীত অপরাহের পড়ন্ত স্নান আলোয় কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন হেমকান্ত। শ্রমের কাজ জীবনে কমই করেছেন। হাত দুটি কোমল ও লাবণ্যময় এখনও। হাতের চেটো এখনও তুলতুলে, এখনও রক্তাভাময় লম্বা ও পুরন্ত শিল্পের আঙুল। ময়লাহীন নরুনে সুন্দর করে কাটা নখ। এ দুটি হাতের কোনও আলাদা সত্তা নেই, হেমকান্ত জানেন। তবু আজ ভাঙা ব্রহাম গাড়ির পাদানিতে বসে তার মনে হল, এ দুটি হাত তাকে কিছু ইঙ্গিত করছে। বলছে, ছেড়ে দাও, পার্থিব যা কিছু আছে ছেড়ে দাও। বাঁধনে থেকো না তুমি। চলো।