সাহেব বললেন।
শঙ্কর ডাইনিং টেবিলে ব্রেকফাস্টের শূন্য প্লেটের দিকে চেয়ে বসে ছিল। রামু গরম টোস্টে মাখন মাখাচ্ছে।
শঙ্কর বলল, বাসুদেব মারা গেছে।
রীণা সামান্য বিস্মিত হয়ে থমকাল, কে মারা গেছে?
সেই স্কাউলেটা।
রীণা বিহুলের মতো খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বলল, কে খবর দিল?
বাংলা খবরের কাগজের শেষ পাতায় আছে। দেখে নিয়ে।
রীণার তাতে উৎসাহ দেখা দিল না। সে শঙ্করের উলটো দিকে চেয়ারে বসে দুহাতে মাথাটা চেপে একটু বসে রইল।
আর ইউ শকড?
রীণা ধীরে মুখটা তুলে বলল, আর ইউ হ্যাপি?
শঙ্কর নিজেকে সংযত করে নিয়ে প্রায় স্বগতোক্তির মতো করে বলল, আই শ্যাল নেভার বি হ্যাপি।
রামু সযত্নে মাখন মাখানো টোস্ট তার প্লেটে স্থাপন করল বটে, কিন্তু শঙ্কর সেটা ছুঁলই। রামুর দিকে চেয়ে বলল, থাক, আর দিস না। আজ আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। বরং হাফ কাপ কফি দে। একটু তাড়াতাড়ি।
রীণা প্রায় একদৃষ্টে তার দিকে চেয়ে আছে। চোখের পলকও যেন পড়ছে না। চোখের দৃষ্টি অবশ্য নিস্তেজ।
কফিতে উপর্যুপরি দুটো চুমুক দিয়ে শঙ্কর বলল, আই অ্যাম সরি ফর মাই রি অ্যাকশনস।
রীণা কিছুই বলল না। কেমন একটা বিহুল চাহনি নিয়ে বসে রইল। ঘড়িটার দিকে একবার তাকিয়েই উঠে পড়ল শঙ্কর। বলল, চলি। ব্যাপারটা ভুলতে শঙ্করের দেরি হবে না। অফিসে গিয়ে কাজে ও কথায় অন্য একটা জগতে চলে যাবে সে। বাসুদেব সেনগুপ্ত নামে একটি রাহুর কথা তার মনে থাকবে না।
শঙ্কর চলে যাওয়ার পর লিভিং রুমে গিয়ে খবরের কাগজটা দেখল রীণা। খুব সামান্য খবর হিসেবেই ছেপেছে। একটা ছবি অবধি নেই। গত ছ’বছরে বাসুদেবের চেহারার কীরকম ভাঙচুর হয়েছিল কে জানে!
শোক নয়, হাহাকার নয়। আজ রীণার বড় লজ্জা করছে। আজ তার কান্নাও এচ্ছে। বাসুদেব যে কেন এসেছিল তার জীবনে! অনেকদিন আগে তারা একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বাসুদেব ডিভোর্স করবে শিখাকে, রীণা ডিভোর্স করবে শঙ্করকে। তারপর বাসুদেব আর রীণা বিয়ে করবে। করলে আজ কী হত?
রীণা জানালার ধারে বসে রইল চুপচাপ৷
সাড়ে আটটায় অজু ফিরল। অজু মানে অজাতশত্রু। রীণার ছেলে, কিন্তু শঙ্করের ছেলে নয়। অজু বাসুদেবের ছেলে। রীণার সন্দেহ হয়, সে বা শঙ্কর অজুকে ঘটনাটা কখনও না জানালেও কোনও না কোনও ভাবে অজু সেটা জানে।
অজুর ইস্কুল-কলেজের খাতায় বাবা হিসেবে শঙ্কর বসুর নাম আছে। বাবার নাম জিজ্ঞেস করলে অজু আজও শঙ্করের নামই বলে। কিন্তু হয়তো যা বলে তা বিশ্বাস করে না। কী করে অজু জানে বা সন্দেহ করে তা রীণা বলতে পারবে না। হতে পারে, বাসুদেবই ওকে জানিয়েছে। অন্তত সম্ভাবনাটাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। দশ বছর আগে বাসুদেবের সঙ্গে যখন রীণা সম্পর্ক ছেদ করে তখন বলে কয়েই করেছিল। বাসুদেব অপমান বোধ করেছিল তাতে। আর সেই অপমানের প্রতিশোধ এভাবেই হয়তো নিয়েছে। এমনও হতে পারে, শঙ্করই জানিয়েছে ওকে। কারণ জন্মাবধি অজাতশত্রুকে শঙ্কর সহ্য করতে পারেনি কখনও। কোলে নেওয়া, আদর করা তো দূরে থাক, শিশুটির দিকে তাকাতেও শঙ্কর ঘেন্না পেত। তথাকথিত বাবার কাছ থেকে এরকম ব্যবহার পেয়ে অজাতশত্রু অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। সে কখনও শঙ্করের কাছে ঘেঁষার চেষ্টা করেনি। কিন্তু পরমার প্রতি শঙ্কর ছিল অন্যরকম। পরমা বলতে শঙ্কর অজ্ঞান। আর পরমার মুখে বাপের মুখশ্রীর অবিকল ছাপ। অজাতশত্রু সেটাও লক্ষ করেছে নিশ্চয়ই। দুই সন্তানের প্রতি এই যে দু’রকম ব্যবহার এটা থেকে অজাতশত্রু নিজেও কিছু অনুমান করে নিয়ে থাকতে পারে। সে প্রখর বুদ্ধিমান।
বলতে নেই, অজুর চেহারাটা চমৎকার, দীঘল, অ্যাথলেটের মতো শরীর। মুখখানায় রীণার মুখ যেন বসানো। কিন্তু শরীর? শরীরের গঠনে এবং শারীরিক প্রকৃতিতে সে অবিকল বাসুদেব। আঠেরো বছর বয়সেই সে বেশ নামকরা স্পোর্টসম্যান। স্কুল এবং জেলা স্তরে স্পোর্টসে গাদা গাদা প্রাইজ পেত। এখন টেনিস খেলছে মন দিয়ে। ভালই খেলে। ক্রিকেটেও চমৎকার হাত। সে ভারতের সবচেয়ে দুরন্ত ফাস্ট বোলার হওয়ার চেষ্টা করছে। হোটেল ম্যানেজমেন্ট ট্রেনি অজু অচিরেই নিজের অর্জনে দাঁড়িয়ে যাবে। রীণা সেই চেষ্টাই করেছে, যাতে অজু তাড়াতাড়ি দাঁড়ায় এবং শঙ্করের কাছ থেকে দূরে সরে যায়। শঙ্কর রীণাকে আকণ্ঠ ভালবাসত, হয়তো এখনও বাসে। কিন্তু অজুর জন্যই তাদের ভালবাসাটা শঙ্করের কাছে নিষ্কণ্টক হয়নি কখনও। অজু একটা চক্ষুশূল ছাড়া আর কিছু নয় শঙ্করের কাছে। বরাবর ছেলেকে নিজের পাখনার আড়ালে আগলে রেখেছে রীণা। অজু জারজ ঠিকই কিন্তু রীণা তো মা।
গায়ে সাদা টি-শার্ট, পরনে শর্টস, পায়ে কেডস অজু হলঘরে ঢুকে পাখার নীচে শরীর জুড়োচ্ছে। সকালে অনেকটা দৌড়োয় অজু। এবং ইচ্ছে করেই সাড়ে আটটার পর ফেরে। হিসেব করেই ফেরে, যাতে শঙ্করের সঙ্গে মুখোমুখি না হতে হয়। প্রায় বাল্যকাল থেকেই শঙ্করের সঙ্গে এই টাইমিং-এর পার্থক্য রাখতে অভ্যাস করে ফেলেছে সে। তারা একই টেবিলে বসে খায়, তবে বিভিন্ন সময়ে, তাই খাওয়ার টেবিলে দেখা হয় না। একই ঘরের বাতাসে দু’জনে কখনও একসঙ্গে খাস নেয় না। অজু কখনও এর জন্য অভিযোগ করেনি। জন্মাবধি ব্যাপারটা হয়ে আসছে বলে তার কাছে বোধহয় অস্বাভাবিকও লাগে না।