আমি জানতে চাই তুমি সত্যিই রেপ আর খুন করেছ কি না।
ভজন ইহাফধরা গলায় শুধু বলল, কী লাভ বলে? বিশ্বাস করবে না কেউ।
আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে চাইছি। সত্যি কথাটা বলে আমাকে।
ভজন মাথা নেড়ে শুধু না জানাল। তার পর কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে থেকে হঠাৎ ধীরে ধীরে মুখ তুলে বিভাবরীর দিকে চাইল। দু’খানা কম্পিত হাত তুলে করজোড় করে রইল কিছুক্ষণ। দুটো হাত থারথার করে কাঁপছে।
ওরকম করছ কেন?
ভজন কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না। দু’চোখ বেয়ে জল পড়ছে। প্ৰায় অশ্রুত গলায় বলল, ক্ষমা… ক্ষমা…
দু’খানা ক্রাচের দিকে কম্পিত হাত বাড়িয়ে দিল ভজন। উঠবে।
বিভাবরী গিয়ে ক্রাচ দু’খানা এগিয়ে দিল। প্রায় ছ’ফুটের মতো লম্বা শক্ত সমর্থ শরীরটার ওপর দিয়ে যেন ঝড় বয়ে গেছে। থারথার করে কপিছে শরীর। তিনবারের চেষ্টায় উঠল। ভজন। দুবগলে ক্রাচ।
বিভাবরী গিয়ে দরজা খুলে সেপাইদের ডাকল।
বেরিয়ে যাওয়ার সময় যেন ভজনের কষ্ট হচ্ছিল অনেক বেশি। দু’জন সেপাই না ধরলে শুধু ক্ৰাচে ভর করে বেরতে পারত না সে।
পিছন থেকে অপলক চোখে চেয়ে ছিল বিভাবরী। এরকমভাবে কেউ কাউকে মারে? মানুষ এত নৃশংস? চোখে জল আসছিল তার, আবার একই সঙ্গে রাগে আগুন হয়ে যাচ্ছিল মাথা।
ভজন বেরিয়ে যাওয়ার পর বিভাবরী তার শরীরের কাঁপুনি আর দুর্বলতা টের পেল। ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল সে। হাফ ধরে যাচ্ছে।
দেখা হল ম্যাডাম?
বিভাবরী চোখ তুলে চেয়ে শবরকে দেখে বলল, আপনাদের নামে মামলা করা উচিত।
শবর হাসল, করুন না।
পুলিশ কেন মারবে? মারা তো বে-আইনি।
অবশ্যই। কিন্তু ভজনবাবুর বেশির ভাগ চোট পাবলিকের উপহার, পুলিশের নয়।
তাদের কেন ধরা হল না?
ক’জনকে ধরা যাবে বলুন। গোটা লোকালিটিটাই তো ইনভলভড।
ছিঃ শবরবাবু।
শবর একটু হাসল আবার। বলল, পাবলিকের হয়ে আপনার ধিক্কারটা আমি ঘাড়ে নিচ্ছি। ম্যাডাম। সরি। এক্সট্রিমলি সরি।
আপনি আমাকে ওর এই অবস্থার কথা বলেননি কেন?
শোনার চেয়ে দেখা অনেক বেশি এফেকটিভ। চলুন, আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।
বিভাবরী উঠল। শরীর ও মনের একটা বিকলতা টের পাচ্ছে সে। পা দুটো ভারী। মাথাটা একটু একটু টলছে। জিপে বসে সে বলল, আপনার কি এখন কোনও জরুরি কাজ আছে?
না তো!
তা হলে আমি ওর গ্যারেজটা দেখতে চাই।
স্বচ্ছন্দে। কিন্তু দেখে কী করবেন?
এমনি। কৌতূহল।
ঠিক আছে ম্যাডাম। এনিথিং ইউ সে।
গ্যারেজটা একটু প্রত্যন্ত জায়গায়। ছাড়া ছাড়া বাড়িঘর, ফাঁকা জমি, ঝোপজঙ্গল, পুকুর।
বাঁ ধারে বাঁশের বেড়া দেওয়া বেশ বড় একটা জায়গা। ফটকের সামনে দু’জন সেপাই গাড়ির একখানা সিট পেতে বসে আছে। তাদের দেখে উঠে দাড়াল।
এটাই ভজনবাবুর গ্যারেজ।
ভিতরে ঢোকা যাবে?
কেন নয়?
শবরের ইশারায় সেপাইরা ফটকের তালা খুলে দিল। বিকল মোটর গাড়ি, নানা যন্ত্রাংশ, তেল কালি, হাইড্রলিক প্রেস পেরিয়ে শেষ প্ৰান্তে ভজনের ঘর। সেপাইরা দরজা খুলে দিয়ে সরে দাঁড়াল।
আসুন ম্যাডাম।
ঘরে একটা সরু চৌকিতে সাধারণ বিছানা পাতা রয়েছে। একাধারে চেয়ার-টেবিল। বইয়ের র্যাকে প্রচুর টেকনিক্যাল বই, কিছু পেপারব্যাক উপন্যাস, কিছু ম্যাগাজিন। বা ধারে মেঝের ওপর একটা বায়োগ্যাসের উনুন। কিছু বাসনপত্র।
বসুন ম্যাডাম।
বিভাবরী চেয়ারে বসল। তারপর ঘরটা ভাল করে দেখল। কিছুই দেখার মতো নয়। একজন পুরুষমানুষের ঘর।
শবর বলল, সম্ভবত আপনি যে চেয়ারে বসে আছেন সেই চেয়ারেই রিঙ্কু বসে ছিল সেই রাতে।
কী করে বুঝলেন?
প্রবাবিলিটির কথা বলছি।
কিন্তু মেয়েটা যে রিঙ্কুই তা কী করে বুঝলেন?
আপনার কী মনে হয়?
ও তো বলছে রিঙ্কু নয়।
তা হলে কে হতে পারে ম্যাডাম?
কী করে বলব? আপনি বলতে পারেন না?
শবর মৃদু একটু হাসল। বলল, রিঙ্কু হতেই পারে। রিঙ্কু তো ভজনবাবুকে ভালবাসত বলেই মনে হয়।
আপনি কিছু লুকোচ্ছেন।
শবর ফের হাসল, আপাতত কিছু লুকোনোই থাক।
আচ্ছা, ভজনের সঙ্গে আমার কী কথা হল তা তো আপনি জানতে চাইলেন না।
শবর মৃদু মৃদু হাসি হাসছিল। বলল, পরে জেনে নেওয়া যাবে।
তার মানে আপনার জানার কৌতূহল মিটে গেছে?
তা নয়। ভজনবাবু এখন খুব বেশি কথা বলার মতো মুডে নেই। সেটা জানি বলেই অনুমান করছি আপনাদের মধ্যে খুব বেশি কথা হয়নি। কিন্তু
কিন্তু কী?
আপনার অমত না থাকলে কয়েক দিন পর আপনি আর একবার ওঁর সঙ্গে মিট করুন।
করবেন?
করব।
থ্যাঙ্ক ইউ। হিনিডস এ সিমপ্যাথেটিক হিয়ারিং।
তার মানে?
ওঁর মনটা অদ্ভুত। জোর করলে বা ফোর্স অ্যাপ্লাই করলে উনি ভিতরকার কপাট বন্ধ করে দেন। কোনো কনফেশনই তখন আদায় করা যায় না। কিন্তু এই কেসটার জন্ট খুলতে হলে ওঁর মুখ খোলানো দরকার। আমরা যেটা পারছি না সেটা আপনি হয়তো পারতেও পারেন।
চেষ্টা করব।
কাইন্ড অফ ইউ।
এবার কি আমরা উঠিব?
হ্যাঁ ম্যাডাম। চলুন।
ফেরার সময় বিভাবরী তেমন কথা বলছিল না। খুব ভাবছিল। আজ সে বড্ড নাড়া খেয়েছে ভজনকে দেখে। লোকটাকে তার আর ঘেন্না হচ্ছে না, কিন্তু ঘেন্না হচ্ছে তাদের যারা ওকে ওরকমভাবে মেরেছে।
শবরবাবু।
বলুন।
আমার মনে হয় না ভজন। এ কাজ করেছে।
কী করে বুঝলেন?
যেভাবে আপনিও বুঝেছেন।
আমি কী বুঝেছি?
আপনিও বুঝেছেন বা অনুমান করেন যে ও খুন বা রেপ করেনি।
কী সর্বনাশ! এ যে গোয়েন্দার ওপর গোয়েন্দাগিরি।
আমি জানি।
৫. একটু কথা আছে
রতন তোমার সঙ্গে একটু কথা আছে।