- বইয়ের নামঃ প্ৰজাপতির মৃত্যু ও পুনর্জন্ম
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. ভীষণ ভীষণ ঘেন্না
লোকটাকে আমি ভীষণ ভীষণ ঘেন্না করি।
কেন?
লোকটা একটা নরপশু।
ধারণাটা হল কেন?
কেন আবার! অভিজ্ঞতা থেকে জানি।
আপনার সঙ্গে ওর বিবাহিত জীবন কতদিনের?
মাত্র সাত দিনের।
মাত্ৰ সাত দিন বাদেই আপনি চলে আসেন?
বিয়ের, মানে ফুলশয্যার পরদিন সকালেই চলে আসার কথা। আসিনি। লোকলজ্জা বাধা হয়েছিল।
লোকটা আপনার ওপর ফিজিক্যাল টর্চার করেছিল কি?
মানে মারধর?
হ্যাঁ।
মারধরের চেয়ে অনেক বেশি।
আপনি কি বলতে চান লোকটার সেক্স একটু বেশি?
একটু বেশি? একটু বেশি বললে কিছুই বলা হয় না।
তা হলে খুব বেশি?
আমি আর কিছু বলতে চাই না। লজ্জার কথা এভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে লোকটা নরপশু, জেনে রাখুন।
বুঝলাম, আপনি তার দ্বারা অত্যাচারিত হয়েছেন।
হ্যাঁ। আমাকে পালিয়ে আসতে হয়েছিল।
এটা কতদিন আগেকার ঘটনা?
দেড় বছর।
এই দেড় বছরের মধ্যে আর কোনও যোগাযোগ হয়নি?
ওর সঙ্গে নয়। তবে ওর বাড়ির কেউ কেউ আমার কাছে আজও আসে, খোঁজখবর নেয়। তারা আমার জন্য দুঃখিত।
লোকটির সঙ্গে আপনার শেষ দেখা তা হলে দেড় বছর আগে?
হ্যাঁ।
আপনি ডিভোর্সের মামলা করেননি?
না।
কেন?
ডিভোর্স করেই বা কী হবে বলুন। আমি তো আর বিয়ে করতে যাচ্ছি না।
তাই বা কেন?
একবারের অভিজ্ঞতায় আমি এত আতঙ্কিত যে আর ও কথা ভাবতেও ইচ্ছে করে না।
আপনি কি ভজনবাবুর কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য পান?
হ্যাঁ পাই। ওর বাড়ির লোকেরা খারাপ নয়, তারাই একটা ব্যবস্থা করে দিয়েছে। মাসে মাসে টাকা দিয়ে যায়।
ভজনবাবু নিজেই আসেন টাকা দিতে?
না না। তার অত সাহস নেই। আসে ওর ছোটভাই পূজন।।
আপনি তো চাকরি করেন।
করি।
কোথায়?
আলফা নেটওয়ার্ক-এর মার্কেটিং ডিভিশনে।
সেটা কেমন চাকরি?
ভালই। আমি একজন একজিকিউটিভ।
তা হলে ভজনবাবুর সাহায্য না হলেও চলে?
কেন চলবে না?
আপনার বাপের বাড়ির অবস্থাও তো ভালই দেখছি।
খারাপ নয়। আমার বাবা ইঞ্জিনিয়ার, সুরেন্কা ইন্ডাস্ট্রিজের ওয়ার্কস ডিরেক্টর। আমার দাদা আমেরিকায় কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার।
ভজনবাবুর সাহায্য তবু আপনি নেন?
কেন নেব না? সে আমার জীবনটাকে নষ্ট করেছে। তার কিছু ক্ষতিপূরণ তো ওকে করতে হবে।
তা তো বটেই। এবার একটা ডেলিকেট প্রশ্ন।
বলুন।
ইজ হি ক্যাপেবল অফ মার্ডার?
তা কী করে বলব? আমার সঙ্গে পরিচয় তো সামান্য।
আপনি তো ওকে নরপশু বললেন।
তা তো বলেইছি।
আপনার কি মনে হয় লোকটা খুব হিংস্ৰ?
অন্তত একটা ব্যাপারে তো তাই।
একটা ব্যাপার থেকেও তো কিছু আন্দাজ করা যায়।
এবার আমাকে একটু মুশকিলে ফেলেছেন।
কেন বলুন তো।
লোকটাকে কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে খুব নিরীহ মনে হয়।
সেটা কেমন?
এমনিতে চুপচাপ, মাথা নিচু করে থাকে।
তাতে কি নিরীহ বলে প্ৰমাণ হয়?
না। তা হয় না।
তা হলে?
ফুলশয্যার পরদিন সকালে আমার অবস্থা দেখে ওর এক বোন সব কথা বাড়ির লোককে বলে দেয়। ওর বাড়ির লোক ওকে খুব বকাঝকা করেছিল। লোকটা খুব যেন অপরাধবোধে কাতর হয়েছিল। তবে সেটা অভিনয়ও হতে পারে।
আমার জানা দরকার লোকটা খুনটুন করার মতো যথেষ্ট ক্ষমতা রাখে কি না।
তা জানি না।
এবার একটা কথা বলি।
বলুন।
খুন সবাই করতে পারে না। খুন করার জন্য একটু আলাদা এলেম দরকার হয়। এক ধরনের মানসিকতার।
তা হবে।
এ লোকটার সেই মানসিকতা আছে কি না। আমি সেইটে জানার চেষ্টা করছি।
বলেছি তো, লোকটাকে আমি ভাল করে চিনি না।
একটা কথা।
বলুন।
আপনি একজন শিক্ষিতা মহিলা, আপনার পরিবারও বেশ কালচার্ড। আপনি ভজনবাবুর মতো একজন গ্যারেজ মালিককে বিয়ে করলেন কেন?
গ্যারেজ মালিক হলেও ভজন অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার। একসময়ে ভাল মোটর তৈরির কারখানায় কাজ করত। তারপর নিজে স্বাধীনভাবে ব্যাবসা শুরু করে। শুনেছি। ওর গ্যারেজে নতুন ডিজাইনের দু-তিনটে গাড়ি তৈরি করে চড়া দামে বিক্রি করেছে।
শুধু সেই কারণ?
আমার বাবা স্বাধীনচিত্ত পুরুষকে খুব পছন্দ করেন।
শুধু প্রফেশনের দিকটা ছাড়া আপনারা আর কিছু দেখেননি?
এটা নেগোসিয়েটেড ম্যারেজ ছিল। আমি বাবার মতে মত দিয়েছিলাম মাত্র। লোকটার যেসব বিবরণ পেয়েছিলাম তাতে খারাপ লাগেনি।
বিয়ের আগে আপনারা পরস্পরকে দেখেছিলেন?
হ্যাঁ।
আপনার পছন্দ হয়েছিল?
চেহারাটা খারাপ লাগেনি। বিনয়ী ভাবাটাও তো ভালই মনে হয়েছিল।
ওঁর বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ উঠেছে সে তো জানেন।…
হ্যাঁ।
আপনি ওঁর মোটর গ্যারেজে কখনও গেছেন?
না। যাওয়ার মতো সময় তো পাইনি। বিয়ের পরই তো চলে এলাম।
কারখানাটা কোথায় তা জানেন?
শুনেছি, কলকাতার বাইরে বারাসাতের কাছে কোথায় যেন।
হ্যাঁ। খুনের ডিটেলসটা জানেন কি?
না। শুনেছি। একটি মেয়ে খুন হয়েছে।
হ্যাঁ। তার আগে একটা প্রশ্ন।
বলুন।
আপনি শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে আসার পর পুলিশে ভজনবাবুর বিরুদ্ধে একটা ডায়েরি করেন।
হ্যাঁ, রাগের মাথায় করেছিলাম।
তাতে কি ওর সেক্সচুয়াল ব্রুটালিটির উল্লেখ ছিল?
ছিল। কিন্তু রাগে অন্ধ হয়ে ডায়েরি করেছিলাম। পরে কেলেঙ্কারির ভয়ে উইথড্র করি।
হ্যাঁ, আমরা তা জানি। পুলিশ ভজনবাবুকে ধরেও আপনার বাবার অনুরোধে এক রাত্তির পরেই ছেড়ে দেয়।
আমরা পারিবারিক দুর্নামের ভয়ে এটা করি।
এই খুনের ঘটনার পর কি আপনার শ্বশুরবাড়ি থেকে কেউ আপনার কাছে এসেছিল?
না!
খুনটা হয়েছে সাত দিন আগে। এর মধ্যে কেউ আসেনি?
পূজন মাঝে মাঝে আসে, কিন্তু ঘনঘন নয়। গত সাত দিনে কেউ আসেনি।
এবার একটা সেনসিটিভ প্রশ্ন।
বলুন।
লজ্জা পাবেন না তো!
লজ্জা পেলে জবাব দেব না।
ভেরি গুড।
প্রশ্নটা কী?
ভজনবাবু যে সেক্সচুয়াল ব্যাপারে স্যাডিস্ট গোছের মানুষ তা আপনার কথা থেকেই স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। আমার প্রশ্ন, যার সেক্সচুয়াল আর্জ এত বেশি সে তো নিশ্চয়ই প্রস কোয়ার্টারে যায়।
এ ব্যাপারে আমি কিছু জানি না।
সমস্যা হল এরকম মানুষেরা নিজেদের সামলে সংযত রাখতে পারে না।
প্রস কোয়ার্টারে গেলে হয়তো যায়। আমি কী করে জানব বলুন।
কোনও হিন্ট পাননি?
ন।
সমস্যা হল, পুলিশ এই অ্যাঙ্গেলটা ভাল করে দেখেছে, কিন্তু ওঁর প্রস কোয়ার্টারে যাওয়ার কোনও প্ৰমাণ পাওয়া যাচ্ছে না।
হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?
প্রস কোয়ার্টারে গেলে ভজনবাবুর বিরুদ্ধে কেসটা আরও শক্ত হত। উনি যে স্যাডিস্ট তা প্ৰমাণ করার সুযোগ থাকত।
আমি তো বলেইছি লোকটাকে ভাল করে চেনার কোনও সুযোগ আমার হয়নি। যে মেয়েটা খুন হয় সে কি প্রস?
না।
তা হলে এ প্রসঙ্গ কেন?
মেয়েটিকে খুন করার আগে ব্রুটালি রেপ করা হয়।
ওঃ।
ইজ ইট জাস্ট লাইক ভজনবাবু?
কী করে বলব বলুন। আমাকে তো খুন করেনি।
মারধর বা হাত মুচড়ে দেওয়া, গালাগাল করা, এসব?
আমাকে প্লিজ, এসব প্রশ্ন করবেন না। আমার পক্ষে ডিটেলস বলা সম্ভব নয়। রুচিতে বাধে।
সরি। কিন্তু এটা তো জানেন যে, এটা মার্ডার কেস।
হ্যাঁ। কিন্তু আমার পক্ষে এর বেশি বলা সম্ভব নয়।
কিন্তু কোর্টে যে আপনাকে এসব অস্বস্তিকর প্রশ্ন করা হবে।
কোর্টে! কোর্টে কেন আমি যাব?
আপনাকে পুলিশ সাক্ষী হিসেবে ডাকবে।
সে আমি পারব না।
ভয় পাচ্ছেন?
ভয় নয়। এসব বিচ্ছিরি ব্যাপার নিয়ে প্রশ্ন করা হলে আমি কিন্তু কিছু বলতে পারব না।
সে আপনার ইচ্ছে। কিন্তু আপনার সাক্ষ্যের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।
কী নির্ভর করছে?
মোটিভ অফ মার্ডার।
আমার ওপর নির্ভর করবে কেন? আমার সঙ্গে লোকটার তো কোনও সম্পর্কই নেই।
সম্পর্ক যে নেই তার কারণটাই তো আমাদের দরকার। ভজনবাবু যে একজন স্যাডিস্ট সেটা প্রমাণ করতে পারলে পুলিশের কাজ সহজ হয়ে যায়।
প্লিজ, আমাকে ছেড়ে দিন। খুন যদি ও করে থাকে তো সেটা পুলিশ প্রমাণ করুক। আমাকে নিয়ে টানাটানি কেন?
পুলিশ তার কাজ করবে। পুলিশকে সাহায্য করা আমাদের কর্তব্য। মেয়েটা কে?
ভাল প্রশ্ন। এ প্রশ্ন অনেক আগেই আপনি করতে পারতেন।
আপনি আমাকে এত প্রশ্ন করছেন যে, আমি প্রশ্ন করার সুযোগই পাচ্ছি না।
সরি ম্যাডাম। এসব ঘটনা ঘটলে লোককে বিরক্ত না করে উপায় থাকে না কিনা।
বুঝেছি। এবার বলুন মেয়েটা কে?
একজন টিনএজার। ষোলো-সতেরোর বেশি বয়স নয়। খুব চঞ্চল আর একটু ডানপিটে গোছের মেয়ে। ভজনবাবুর গ্যারেজের পর একটা খেলার মাঠ। মেয়েটার বাড়ি ওই মাঠটা পেরিয়ে। মেয়েটার নাম রিঙ্কু। খুব মড মেয়ে। তার বাবার চিংড়ি মাছের ব্যাবসা আছে। মোটামুটি পয়সাওলা লোক। মেয়েটা একটা সাইকেলে চড়ে পাড়ায় চক্কর দিয়ে বেড়াত। পোশাকও পরত। খুব উগ্র। কখনও শর্টস আর কামিজ। কখনও জিনস আর টি-শার্ট।
কেমন মেয়ে?
যেটুকু জানা যায়, বখাটে টাইপের মেয়ে। বাবা ডিভোর্সি। মা আবার কাকে বিয়ে করে বাইরে কোথাও থাকে। মেয়েটা বাবার কাছে থাকত।
একমাত্র মেয়ে?
হ্যাঁ। বোধহয় খুব আদরেরও দেখতেও খারাপ ছিল না। সাক্ষ্যপ্রমাণ বলছে, মেয়েটার বেশ অ্যাট্রাকটিভ চেহারা ছিল এবং যথারীতি পাড়া-বেপাড়ার ছেলেরা তার পিছনে ঘুরঘুর করত। রিঙ্কুর বদনাম ছিল, সে ছেলেদের সঙ্গে ফ্রিলি মেলামেশা করে। বাবার কোনও শাসন ছিল না। ভদ্রলোক নিজের কাজ নিয়ে হিমশিম খেতেন, মেয়ের দিকে নজর দেওয়ার সময় ছিল না।
বাড়িতে আর কেউ নেই?
রিঙ্কুর ঠাকুমা আর দাদু ও বাড়িতে থাকেন। তঁদের থাকা নিয়েই রিঙ্কুর মা আর বাবার মধ্যে বনিবনার অভাব দেখা দেয়। তারপর অশান্তি বেড়ে বেড়ে শেষ অবধি ডিভোর্স।
রিঙ্কুর বাবা আর বিয়ে করেননি?
না। তিনিও আপনার মতোই। বিয়ের অভিজ্ঞতা তিক্ত হয়েছিল বলে আর বিয়ে করেননি। তা বলে তার বিয়ের বয়স যায়নি। হি ইজ ওনলি ফর্টিফোর।
এবার আমার করণীয় কী বলুন। সাক্ষী দিতে হবে শুনে আমার ভীষণ ভয় করছে।
ভয় কীসের?
সাক্ষীটাক্ষি দিলে তো পাবলিসিটি হবে। পুরনো কথা উঠবে।
তা উঠবে।
সেইটেই ভয় পাচ্ছি। এ ঘটনার সঙ্গে তো আমার কোনও সম্পর্কই নেই। তবু কেন যে আপনারা আমাকে ইনভলভড করতে চাইছেন।
উপায় নেই বলে।
লোকটা কি এখন জেলে?
পুলিশ কাস্টডিতে। আপনি চাইলে ওর সঙ্গে দেখা করতে পারেন!
দেখা করব? সে কী কথা! আমি ওর সঙ্গে দেখা করব কেন?
লোকটা আপনার কাছে হয়তো কিছু বলতে পারে।
প্লিজ, আমাকে এসব কাজে জড়াবেন না। আমি ওরা ছায়াও মাড়াতে চাই না।
ম্যাডাম, কাজটা অপ্রীতিকর হলেও আমার কিছু কৌতূহল আছে।
আমি পারব না। মাপ করবেন।
আগে একটু শুনুন। দিন সাতেক আগে ঘটনাটা ঘটে। ভজনবাবুর মোটর গ্যারেজের পাশের মাঠে মেয়েটির ডেডবডি পাওয়া যায় সকালবেলা। মাঠটায় কিছু আগাছার জঙ্গল আছে, তার মধ্যে। মেয়েটি বাড়ি না ফেরায় সারা রাত লোকজন এবং পুলিশও তাকে অনেক খুঁজেছিল। পায়নি।
শুনতেই আমার খারাপ লাগছে। ডেডবডি কথাটা শুনেই আমার মনটা কেমন করে উঠল। আহা, ওইটুকু একটা মেয়েকে মারে কেউ?
মানুষের ভিতরে একটা পশু তো থাকেই। আর সেই পশুটাকে ধরার জন্যই আপনার সাহায্য প্রয়োজন।
পশুটা কি ওই ভজন?
তাই মনে হচ্ছে।
আপনাদের হাতে প্ৰমাণ নেই?
একেবারে প্রমাণ ছাড়া তো ভজনকে ধরা হয়নি।
প্ৰমাণই যদি থাকে তা হলে ওকে শাস্তি দিলেই তো হয়। আমার সাহায্যে কী দরকার?
প্ৰমাণ আছে, আবার নেইও।
সে আবার কী?
ভজনবাবুর গ্যারেজটা একটু নির্জন জায়গায়। প্ৰায় এক বিঘা জমি নিয়ে গ্যারেজ। অনেক সফিস্টিকেটেড যন্ত্রপাতি আছে। ডিজাইনার গাড়ি তৈরি করার জন্য ভজনবাবু কিছু অর্ডার পাচ্ছিলেন। দেশি-বিদেশি গাড়ির মোটর নিয়েও বোধহয় এক্সপেরিমেন্ট করছিলেন। গ্যারেজটা আরও বড় করার জন্য পাশের মাঠটা কেনারাও চেষ্টা করছিলেন।
আমি এতসব জানি না। তবে পুজন বলেছিল ওর গ্যারেজ বড় হচ্ছে।
হ্যাঁ, বেশ বড় গ্যারেজ।
ওর কি অনেক টাকা?
হ্যাঁ। আপনার সঙ্গে ওরা ছাড়াছাড়ি তো দেড় বছরের?
এক বছর আট মাস।
গত দেড় বছরের মধ্যেই ভজনবাবু অনেক টাকা করেছেন। আর বোধহয় সেই কারণেই লোকটার পিছনে ওখানকার ক্লাব এবং মস্তানেরা লেগে গিয়েছিল। তারা টাকা চাইত, উনি দিতেন না।
এসব আমার জানা ছিল না।
আপনার জানার কথা নয়। তবে মাস ছয়েক আগে ভজনববুর ওপর হামলা হয় এবং উনি কয়েকটা গুন্ডা ছেলের হাতে মার খান!
হ্যাঁ, এরকম একটা কী যেন পূজনের কাছে শুনেছিলাম। বেশি মাথা ঘামাইনি।
ভজনবাবু লোকটি খুব বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন ব্যাবসাদার নন। তা যদি হতেন তা হলে গুন্ডা মস্তানদের কিছু চান্দা দিয়ে হাতে রাখতে পারতেন। সে পথে না গিয়ে উনি কনফ্রন্টেশনের পন্থা নিয়েছিলেন। এমনিতে নিরীহ হলেও বেশ একগুয়ে আর জেদি। তাই না?
তা তো বটেই।
যাইহোক, এই ঘটনার পর গ্যারেজটা প্রায় উঠে যাওয়ার উপক্রম হয়। ভজনবাবু আপসরিফা করতে রাজি হননি, টাকাও দেননি। উনি পুলিশকেও হাত করার চেষ্টা করেননি বলে প্রোটেকশনও পাননি।
এতসব জেনে আমার কী হবে?
লোকটার চারিত্রিক আউটলাইনটা আপনার সম্পূৰ্ণ জানা নেই বলেই বলছি।
তা হলে বলুন।
লোকটা বিপদের ঝুকি নিয়েই ওখানে গ্যারেজ চালাতে লাগলেন। ভজনবাবু একটা রিভলভার কিনেছিলেন। লাইসেন্সও ছিল। আর ওঁর গ্যারেজের কর্মচারীরা–কী জানি কেন–ওঁর খুবই অনুগত। তারাও ওঁকে প্রোটেকশন দিতে লাগল। ফলে গ্যারেজের সঙ্গে লোকালিটির একটা শক্ৰতা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। গ্যারাজে। বার কয়েক বোমা পড়েছে, আগুন দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে, জনসাধারণকে খেপিয়ে তুলে অবরোধের চেষ্টাও হয়েছে, তার চেয়ে বড় কথা পলিটিক্যাল প্ৰেশারও ওর বিরুদ্ধে ছিল। জনসাধারণের অভিযোগ ওই গ্যারেজে চোলাই তৈরি হয়, সমাজবিরোধী কাজ হয় ইত্যাদি।
সত্যিই হত নাকি?
বোধহয় না।
তা হলে আপনি কী বলতে চাইছেন?
বলতে চাইছি ভজনবাবুর শত্রুর অভাব নেই।
সে তো হতেই পারে।
আর শক্ৰতা ছিল বলেই ভজনবাবু ইদানীং গ্যারেজেই থাকা শুরু করেছিলেন। গ্যারেজের ভিতরদিকে ওঁর যে অফিসঘরটা আছে সেখানে চৌকি পেতে বিছানা করে নিয়েছিলেন। রান্নাবান্নাও নিজেই করে নিতেন। ওঁর জবানবন্দি অনুসারে গ্যারেজের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ওঁর গ্যারেজে থাকাটা প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। লোকটাকে সাহসী বলতে হয়। কী বলেন?
আমি কী বলব বলুন। আপনার মনে হলে হতে পারে।
গ্যারেজে দু’জন কর্মচারী রাতে পাহারা দিত। আর ভজনবাবুতো সপ্তাহে চার-পাঁচ দিনই থাকতেন। যেদিন ঘটনােটা ঘটে সেদিনও ভজনবাবু গ্যারেজে ছিলেন।
গার্ডরাও ছিল তো!
দুঃখের বিষয় সেদিন দিবাকর নামে যে কৰ্মচারীটির গার্ড দেওয়ার কথা ছিল তার মায়ের অসুখ বলে সে আসেনি। ছিল রতন নামে দ্বিতীয় গার্ডটি।
মেয়েটির সঙ্গে কি ভজনের আলাপ ছিল?
ছিল। মেয়েটা প্রায়ই নাকি গ্যারেজে হানা দিত। সে ভজনবাবুকে গাড়ি চালানো শিখিয়ে দিতে বলত। এবং ভজনবাবু মাঝেমাঝে রিঙ্কুকে গাড়ি চালানো শেখাতেনও। শোনা যায়, রিঙ্কু ভাল গাড়ি চালাতে শিখে গিয়েছিল।
বাঃ, তা হলে আর সন্দেহ কী?
সন্দেহের অবকাশ বিশেষ নেই। কারণ ঘটনার দিন সন্ধেবেলা গ্যারেজের উলটোদিকের বাড়ির সনাতন মল্লিক দেখেছেন যে, রিঙ্কুর সাইকেলটা গ্যারেজের ফটকের কাছে দাঁড় করানো।
তা হলে তো মিলেই যাচ্ছে।
যাচ্ছে। কিন্তু ঘটনাটা সন্ধেবেলা ঘটেনি। ঘটেছে একটু বেশি রাতে। অন্তত পোস্টমর্টেম রিপোর্ট তাই বলে।
আপনি বড্ড ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথা বলেন শবরবাবু।
হ্যাঁ, ওইটে আমার দোষ। তবে আসল ঘটনা বের করার জন্য ব্যাকগ্রাউন্ডটা ভাল করে। বুঝিয়ে বলা দরকার মিসেস আচার্য।
আমাকে প্লিজ, মিসেস আচাৰ্য বলবেন না। আমার নাম বিভাবরী ভট্টাচাৰ্য।
জানি। ডিভোর্স করেননি বলে মিসেস আচাৰ্য বলে ফেলেছিলাম।
কোর্টের ডিভোর্স না হলেই কী? আমি মনে মনে তো কবেই। ওকে পরিত্যাগ করেছি।
তা বটে। ডিভোর্সের প্ল্যান আছে কি?
এসব শুনে মনে হচ্ছে, ডিভোর্সটা করে রাখলেই ভাল হত।
তা ঠিক। তবে ডিভোর্স হয়ে থাকলেও আমরা আপনাকে সাক্ষী মানতাম।
উঃ, কী যে মুশকিল!
সরি ম্যাডাম।
আপনি আমার প্রবলেমটা বুঝতে পারছেন তো শবরবাবু?
পারছি বিভাবেরী দেবী। কিন্তু প্রবলেমটা আমাদের সকলেরই। আপনি এক্সপোজারকে ভয় পাচ্ছেন, কোটিকাছারিতে যেতে অপছন্দ করছেন, কিন্তু আমাদের যে উপায় নেই।
ঠিক আছে বলুন।
রিকুর সাইকেলটা খুব দামি এবং রেসিং মডেলের। ওরকম দামি সাইকেল ওই অঞ্চলে কারও নেই। সুতরাং ওই লাল রঙের সাইকেলটা সহজেই চোখে পড়ত। বুঝতে পারছেন?
পারছি। সন্ধেবেলা গ্যারেজে সাইকেলটা দাঁড় করানো ছিল।
হ্যাঁ।
তা হলে তো প্ৰমাণই হয়ে গেল যে, রিঙ্কু ভিতরে ছিল।
আপাতদৃষ্টিতে তাই।
আবার আপাতদৃষ্টি কেন?
পুলিশের মনটা বড্ড খুঁতখুতে। এই যে ধরুন না। আমার মোটরবাইকটা এখন আপনাদের বাড়ির সামনে দাঁড় করানো আছে, আর আমি ভিতরে বসে আপনাদের সঙ্গে কথা বলছি। মোটরবাইকটা যে চেনে সে ওটা দেখে বলতেই পারে যে, শবর দাশগুপ্ত এখন বিভাবরী ভট্টাচার্যের বাড়িতে বসে আছে। কিন্তু এমন তো হতেই পারে যে, মোটরবাইকটা আর কেউ টেনে এনে রেখেছে বা আমিই ওটা রেখে দিয়ে বাসে উঠে বাড়ি চলে গেছি। সুতরাং এটাকে ফুল প্রািফ বলে ধরা যায় না।
আপনারা সোজা জিনিসটাকে প্যাচালো করতে ভালবাসেন।
তা নয়। আসলে দুনিয়ায় সহজ সরলভাবে কিছুই ঘটে না। তা যদি ঘটত তা হলে আমাদের কত পরিশ্রম বেঁচে যেত বলুন।
তা বটে। একটু চা খাবেন? অনেকক্ষণ এক নাগাড়ে কথা বলছেন।
কফি হলে হত। বেশিরভাগ বাড়িতেই চা-টা ভাল হয় না।
আপনি ভীষণ ঠোঁটকাটা তো!
খারাপ চা খাওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই ঠোঁটকাটা হতে হয়েছে।
আচ্ছা, কফিই করে আনছি।
আনুন।
বিভাবরী উঠে যাওয়ার পর শবর ঘরটা আবার দেখল। সচ্ছল পরিবারের বৈঠকখানা যেমন হয় তেমনই সাজানো। সোফাসেট, সেন্টার টেবিল, নিচু বুক কেস, দেয়ালে কিছু ওয়াল ডেকোরেশন। বুক কেসের ওপর কাঠের তৈরি বাঁকুড়ার ঘোড়া। তার পাশে দুটো স্টিল ফ্রেমের ছবি। একটা ছবি বিভাবরীর মা আর বাবার। অন্যটা বোধহয় কম বয়সে বিভাবরী আর তার দাদার।
বিভাবরী কফি এনে বলল, শুধু দুধের কফি। চলবে তো!
শবর একটা চুমুক দিয়ে বলল, বাঃ।। চিনিটা খুব পারফেক্ট হয়েছে তো। চিনিতেই গণ্ডগোলটা বেশি হয়।
বিভাবরী একটু হেসে বলল, রিঙ্কুর সাইকেলের গল্প কিন্তু এখনও শেষ হয়নি।
শবর বিভাবরীর দিকে তাকাল। মেয়েটির চেহারা খুবই ভাল। খুব লম্বা নয়, তেমন ফরাসাও বলা যায় না, কিন্তু মুখখানা খুব ঢলঢলে। চোখ দু’খানা টানা এবং দৃষ্টিটা মায়ায় মাখানো। অ্যাট্রাকটিভ। হ্যাঁ ভেরি অ্যাট্রাকটিভ।
কী দেখছেন?
ভাবছি আপনার মতো একজন সুন্দরী মহিলার ভাগ্যটা সুন্দর হল না কেন। কী যেন কথায় আছে, অতি বড় সুন্দরী না পায় বর–না। কী যেন!
বিভাবরী একটু লজ্জার হাসি হেসে বলল, আমি সুন্দরী হলে বলতে হয় আপনি সুন্দরী কথাটার মানেই জানেন না।
তা হতে পারে। তবে যা চোখের পক্ষে স্নিগ্ধকর, তাই আমার সুন্দর বলে মনে হয়। যাকগে।
হ্যাঁ, খুব আনইজি সাবজেক্ট।
যা বলছিলাম। রিঙ্কুর সাইকেল। গ্যারেজে রিঙ্কুর সাইকেলটা সন্ধে থেকেই ছিল। বা তারও আগে থেকে। অন্তত সন্ধে থেকে যে ছিলই তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
রিঙ্কুকে কেউ গ্যারেজে ঢুকতে দেখেনি?
খুব ভাল প্রশ্ন। না, আমরা এখনও পর্যন্ত কোনও প্রত্যক্ষদশীকে পাইনি যে রিঙ্কুকে গ্যারেজে ঢুকতে দেখেছে। জায়গাটা একটু নির্জন। উলটোদিকে মল্লিকবাবুর বাড়ি, আশেপাশে আর বাড়ি নেই। একাধারে ডোবা, অন্য ধারে একটা বাড়ির ভিত হয়ে পড়ে আছে। লোকজন বিশেষ চলাচল করে না। ভজনবাবুর গ্যারেজেই যা লোকের যাতায়াত। সেদিন রবিবার গ্যারেজ বন্ধ থাকায় লোকজনও ছিল না।
রতন না। কী যেন নাম–সে কী বলে?
রতন ডিউটিতে এসেছিল রাত ন’টা নাগাদ।
সে সাইকেলটা দেখেনি?
দেখেছে। তবে রিঙ্কু ভিতরে ছিল কি না সে জানে না।
কেন, তার তো খোঁজ করা উচিত ছিল।
সে যা বলেছে তা মোটামুটি এরকম, সে রাত ন’টার কিছু পরে গার্ড দিতে আসে। ফটক খোলাইছিল। একটা বাতি মাত্ৰ জ্বলছিল বলে জায়গাটায় আলো আঁধারি ছিল। সে ফটকের কাছে একটা পুরনো গাড়িতে বসে ছিল। বেশ কিছুক্ষণ বাদে হঠাৎ সাইকেলটা তার নজরে পড়ে। ওদিকে ভজনবাবুর ঘরের দরজা তখন বন্ধ। তার ধারণা হয়েছিল রিঙ্কু ভজনবাবুর ঘরে বসে গল্পটল্প করছে।
ইস লোকটা যদি তখন গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিত তা হলে বোধহয় মেয়েটা বেঁচে যেত।
ধাক্কা না দিলেও সে পা টিপে টিপে দরজার কাছে গিয়ে দাড়িয়েছিল।
ওঃ। তারপর?
সে শুনতে পায়, ভিতরে একটি মেয়ে বা মহিলার সঙ্গে ভজনবাবুর কথা হচ্ছে। কথা বা তর্কাতর্কি।
তর্কাতর্কি?
হ্যাঁ। অন্তত রতন তাই বলছে।
মেয়েটার গলা তো নিশ্চয়ই তার চেনা।
না চেনার কথা নয়। তবে সেটা যে রিঙ্কুরই গলা এটা সে হলফ করে বলতে পারছে না।
এর পরও কি কোনও সন্দেহ আছে। শবরবাবু?
না, সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু সন্দেহ তো প্ৰমাণ নয়।
সারকামস্টিয়াল এভিডেন্স বলেও তো একটা ব্যাপার আছে।
আছে। আর সেটাই আমাদের তুরুপের তাস।
রতন মেয়েটাকে দেখেনি, ভাল কথা। কিন্তু রেপ এবং খুনের পর লাশটা যখন মাঠে নিয়ে ফেলা হল, তখন তো তার চোখ বুজে থাকার কথা নয়।
বলছি ম্যাডাম। কথাটা খুবই সত্যি। রতন জানিয়েছে, রাত দশটার কিছু পরে ভজনবাবু দরজা খুলে বেরিয়ে তাকে ডাকেন। রতন খুব কাছাকাছি যাওয়ার আগেই ভজনবাবু তাকে কোকাকোলার ক্যান আনতে পাঠান। ধারে কাছে কোৰ কোলার ক্যান পাওয়া যায় না। তাকে বেশ কিছুটা দুরে যেতে হয়েছিল। প্রায় চল্লিশ মনিট পরে সে ফিরে এসে ভজনবাবুর দরজায় নক করে। ভজনবাবু দরজা খুলে ক্যানগুলো নেন। তখন ঘরে কেউ धिक्ल ना।
তার মানে কী দাঁড়াল?
দুইয়ে দুইয়ে যোগ করলে চারই হয় ম্যাডাম। ধরে নেওয়া যেতে পারে যে ওই চল্লিশ মিনিটের মধ্যে খুন এবং গুম দুটোই হয়েছিল।
উঃ মাগো! কী সাংঘাতিক লোক।
হ্যাঁ, খুবই সাংঘাতিক লোক। আর এই কথাটাই আপনাকে আদালতে দাড়িয়ে বলতে হবে।
আমাকে না হলেও তো হয়। রতনই তো সাক্ষী আছে।
রতন আমাদের খুব ইস্পার্ট্যান্ট সাক্ষী। কিন্তু তার একটা কথা গোলমেলে।
কোন কথাটা?
যে-মেয়েটার কণ্ঠস্বর সে ভজনবাবুর ঘরের ভিতর শুনতে পেয়েছিল সেটা রিঙ্কুর কি না এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত নয়।
ওটা তো সামান্য ব্যাপার। ঘরের দরজা বন্ধ ছিল, হয়তো তাই গলাটা ভাল শুনতে পায়নি।
সেটা খুব সম্ভব।
ভজনের সঙ্গে রিঙ্কুর কী কথা হচ্ছিল?
শবর একটু হেসে বলে, শুনতে চান? এসব টপ সিক্রেট কি আপনার শোনা উচিত?
উচিত না হলে বলবেন না।
আরে রাগ করছেন কেন? রতন শুনতে পায় মেয়েটা বেশ চিৎকার করেই বলছে, কেন আপনি আমাকে বিয়ে করবেন না? আপনাকে করতেই হবে। জবাবে ভজনবাবু বেশ উত্তেজিত গলায় বলছিলেন, এসব কী বলছি পাগলের মতো? তোমাকে আমি ওভাবে কখনও ভাবিইনি! তুমি বাড়ি যাও, আমাকে এভাবে বিরক্ত কোরো না। জবাবে মেয়েটা বলছিল, আপনি একটা কাপুরুষ, নপুংসক, আপনার ব্যক্তিত্ব বলে কিছু নেই, ইত্যাদি। ডিটেলস পুলিশের খাতায় লেখা আছে।
ও বাবা! রিঙ্কু আবার ওকে বিয়েও করতে চেয়েছিল?
চাইতেই পারে। ভজনবাবুর বয়স বোধহয় আঠাশ-উনত্রিশ, তাই না?
ওরকমই।
বয়সের একটু তফাত হত, কিন্তু বিয়ে হতেই পারে।
তা পারে, বিয়েই না হয় করত, মারাল কেন?
সেটাই প্রশ্ন। আপনি বলতে পারেন কেন মারল?
না। কিন্তু ভজন কী বলছে?
ওঁর মুখ থেকে খুব বেশি কথা বের করা যায়নি। উনি বলছেন, সেইদিন সন্ধেবোলা ওঁর ঘরে যে-মেয়েটি ছিল সে রিঙ্কু নয়।
তবে কে?
তা উনি বলতে রাজি নন।
বলবে কী করে? সত্যি কথা বললে তো প্ৰমাণই হয়ে গেল।
আমাদেরও সন্দেহ মেয়েটা রিঙ্কুই।
এখনও সন্দেহ?
নিরঙ্কুশভাবে প্রমাণিত না হলে সন্দেহ কথাটাই ব্যবহার করা ভাল।
সে আপনারা করুন। আমি জানি মেয়েটা রিঙ্কুই।
শবর একটু হাসল, তারপর বলল, ভজনবাবুকে ফাঁসিতে লটকানোর জন্য আপনি যে একটু বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন দেখছি।
হব না! একটা মেয়েকে রেপ করে যে খুন করেছে তার কি ফাঁসি হওয়া উচিত নয়?
ফাঁসি বা যাবজ্জীবন যাইহোক, সব সন্দেহের সম্পূর্ণ নিরসন না করতে পারলে জজ তো আর সেই হুকুম দেবেন না।
আপনি রিঙ্কুর সাইকেলের কথাটা কি ভুলে যাচ্ছেন?
না, আমি কিছুই ভুলি না, রিফুর সাইকেলটাও একটা মস্ত এভিডেন্স। কিন্তু ভজনবাবু বলছেন, সাইকেলটা যে ওখানে ছিল তা তিনি জানতেন না। সে ব্যাপারে কিছু বলতেও পারেন না।
বেশ কথা তো!
হ্যাঁ। পুলিশ কেস সাজালে ভজনবাবু যে বিপদে পড়বেন তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু কেস সাজানোর ব্যাপারে আমাদের ফুল প্রফ হওয়া দরকার।
ফুল প্রফ হওয়ার জন্য আর কী কী দরকার?
ভাল হত। একজন আই উইটনেস পেলে।
গ্যারেজের উলটোদিকে যে-লোকটা থাকে সে কিছু দেখেনি?
না। আরও একটা কথা।
কী কথা?
পুলিশের কুকুর কিন্তু ভজনবাবুর গ্যারেজের দিকে যায়নি।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ, তবে বর্ষাকাল তো এবং সেদিন রাত্রেও বৃষ্টি হয়েছিল। কাজেই গন্ধের ট্রেলটা মুছে যেতেই পারে।
সে তো পারেই। আমার যেন মনে হচ্ছে আপনি ঘটনাটা সম্পর্কে তেমন নিশ্চিত নন।
আমাকে বলতে পারেন সন্দেহা-পিচাশ।
তাই দেখছি, পুলিশ কি এইরকমই?
না। আমি এইরকম।
তা হলে আপনি ক্রিমিনালদের ধরবেন কী করে?
সবসময়ে যে ক্রিমিনালদের ধরা যায় এমন নয়, অনেক ফাঁকফোকর দিয়ে তারা রেহাই পেয়ে যায়। ওই ফাঁকফোকারগুলোই ভরাট করার চেষ্টা করছি।
আমার তো মনে হচ্ছে, ওটা ওপেন অ্যান্ড শাট কেস।
শবর মৃদু হেসে বলল, হলে তো ভালই হত। এবার একটা কথা জিজ্ঞেস করছি, একটু ভেবে জবাব দেবেন।
নিশ্চয়ই। আমি তো এতক্ষণ কো-অপারেটই করেছি।
হ্যাঁ। আপনি নার্ভাস হননি।
এবার প্রশ্ন করুন।
ফুলশয্যার রাতে ভজনবাবুর যে পরিচয় আপনি পেয়েছিলেন তা খুবই খারাপ এবং ভয়ংকর।
হ্যাঁ।
কিন্তু তারপরও আপনি আরও সাতদিন শ্বশুরবাড়িতে ছিলেন।
হ্যাঁ।
আপনি কি ভজনবাবুর ঘরেই রাতে থাকতেন? আই মিন, একসঙ্গে?
পাগল নাকি? আমি ওর ঘরে শুতাম। কিন্তু ও চলে যেত ওর ভাই পুজনের ঘরে। বাড়ির লোকেরাই এই ব্যবস্থা করে দিয়েছিল।
এই সাতদিনের কথা কিছু মনে আছে?
কেন থাকবে না? মাত্র তো দেড়-পৌনে দুই বছরের ঘটনা।
সেই অভিজ্ঞতোটা কীরকম? মানে রিগার্ডিং ভজনবাবু।
ও কিন্তু কখনও আমার কাছে ঘেঁষার চেষ্টা করেনি, এমনকী লজ্জায় চোখ তুলে তাকাতও না।
ওই সাতদিনে আপনার সঙ্গে ভজনবাবুর কথা হত কি?
না। আমার কাছাকাছি আসত না।
আপনি এই সাতদিন শ্বশুরবাড়িতে ছিলেন কেন? মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে?
না। প্রবলেমটা মানিয়ে নেওয়ার মতো ছিল না। সাতদিন ছিলাম, শ্বশুরবাড়ির লোকেদের অনুরোধে। ওর ভাই পূজন। আর বোন দেবারতি আমাকে খুবই ভালবাসত। শ্বশুরমশাই অসুস্থ মানুষ, শয্যাশায়ী ছিলেন। কিন্তু শাশুড়ি খারাপ ছিলেন না। খুব ভালমানুষ গোছের।
এই সাতদিনে ভজনবাবুর বিশেষ কোনও গুণ বা বৈশিষ্ট্য চোখে পড়েছে কি?
না।
ভাল করে ভেবে দেখুন। দেয়ার মে বি এ ভাইটাল ফ্যাক্ট।
কিছু মনে পড়ছে না তেমন। তবে
তবে কী? থামলেন কেন?
ও সকালবেলা রোজ পাড়ার কুকুরদের পাউরুটি খাওয়াত।
বাঃ, এই তো একটা কথা জানা গেল। আর কী?
নাঃ, আর কিছু নয়।
২. নমস্কার সনাতনবাবু
নমস্কার সনাতনবাবু।
আরে, আসুন, আসুন। নমস্কার, নমস্কার।
একটু বিরক্ত করতে এলাম।
বিরক্ত কীসের? আপনারা আইনের রক্ষক, আপনাদের একটু সাহায্য করব এ তো সৌভাগ্য।
শবর সনাতনবাবুর মুখোমুখি চেয়ারে বসল।
একটু চা বা কফি?
না, ধন্যবাদ।
ঠান্ডা কিছু খাবেন?
না, না, ব্যস্ত হবেন না, আই অ্যাম অলরাইট।
তারপর বলুন।
ভজনবাবুর সঙ্গে আপনার কেমন পরিচয়?
খুব একটা নয় মশাই। যৎসামান্য। বাড়ির উলটোদিকে একটা গ্যারেজ থাকায় খুবই ডিস্টার্বড হতে হয়। দিনরাত দুমদাম শব্দ হচ্ছে, কলকবজ চলছে, মিস্ত্রিদের হল্লাও আছে।
আপনি কি গ্যারেজটা তুলে দেওয়ার জন্য একটা মামলা করেছিলেন?
ঠিক মামলা নয়। আমার স্ত্রী হার্টের রুগি, জোরালো শব্দ তার পক্ষে ক্ষতিকারক। সেটা জানিয়ে পুলিশে একটা রিপোর্ট করি। ভজনবাবুকে একটা উকিলের চিঠিও দিই।
তার আগে কি ভজনবাবুর সঙ্গে আপনার কথা হয়েছিল?
হয়েছিল।
কীরকম কথা?
প্ৰথমে তো লোকটাকে ভালমানুষ বলেই মনে হয়েছিল। আমি ওঁকে মাঝে মাঝে বলতাম। লোকালিটির মধ্যে গ্যারেজ থাকায় পাড়ার লোকের অসুবিধে হচ্ছে, উনি যেন হাইওয়ের দিকে গ্যারেজটা সরিয়ে নেন।
উনি কী বলতেন?
উচ্চবাচ্য করতেন না। চুপচাপ শুনতেন।
তারপরই ঝগড়া লাগে?
ঝগড়া ঠিক ওর সঙ্গে হয়নি।
তবে কার সঙ্গে?
ভজনবাবুর একজন কর্মচারী আছে, তার নাম রাখাল।
খুব লম্বাচওড়া?
হ্যাঁ সে-ই। ও হচ্ছে ঘাটপুকুরের মস্তান।
ঝগড়া হল কেন?
একদিন দুপুরে ওরা একটা গাড়ির বডি তৈরি করছিল। সে সাংঘাতিক দুমদাম শব্দ। আমার স্ত্রী দুপুরে ঘুমোতে পারেননি, শব্দে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। আমি অফিস থেকে ফিরে ঘটনা শুনে গ্যারেজে যাই। তখন রাখালের সঙ্গে কথা হয়।
কী কথা হল?
আমি বললাম, এরকম চলবে না। রাখালও তেড়া তেড়া জবাব দিচ্ছিল। তারপর ঝগড়ার মতো হল।
তখন কি ভজনবাবু গ্যারেজে ছিলেন?
না।
ঝগড়াটা কতদূর গড়িয়েছিল?
আমরা ভদ্রলোক, ছোটলোকদের সঙ্গে কি ঝগড়ায় পারি? রাখাল আমাকে দেখে নেবে। বলে শাসিয়েছিল।
আপনি কী করলেন?
পাড়ার নাগরিক কমিটিকে জানালাম। তারা পরদিন গিয়ে ভজনবাবুকে ধরল।
ফলাফল কী হয়েছিল?
ভজনবাবু রাখালকে আমার কাছে ক্ষমা চাইতে বললেন। রাখাল ক্ষমাও চাইল। কিন্তু গ্যারেজের শব্দটার যে সমস্যা ছিল তার তো সমাধান হল না। ভজনবাবু বললেন, আপনারা একটা টাইম বেঁধে দিন, আমরা সেই সময়েই গাড়ির বডির কাজ করব, অন্য সময়ে করব। ब्न्म
তা হলে তিনি কো-অপারেট করতেই চেয়েছিলেন।
তা বলতে পারেন। তবে ওটা আই ওয়াশ। গ্যারেজে শব্দ তো সারাদিনই হত। বডির কােজই তো শুধু নয়।
আপনার একটি মেয়ে, তাই না?
হ্যাঁ। তার বিয়ে হয়ে গেছে।
আপনার জামাই কন্ট্রাক্টর তো!
সবই তো জানেন তা হলে।
জানি। জানাটাই আমাদের কাজ।
সনাতনবাবু, আপ্যায়িতের হাসি হেসে বললেন, আপনারা জানবেন না তো কে জানবো?
আপনার জামাই বিজয়বাবু চাঁপাডালির মোড়ের কাছে থাকে।
আজ্ঞে হ্যাঁ।
আপনি চান। আপনার মেয়ে-জামাই আপনার কাছাকাছি কোথাও এসে থাকুক, যাতে বিপদে আপদে তারা আপনাদের দেখাশোনা করতে পারে।
কী আশ্চর্য! হ্যাঁ, তাই। আপনি সত্যিই
দাঁড়ান, কথাটা শেষ করার পর আপনার হয়তো ততটা ভাল লাগবে না।
আরে বলুন না। ভাল না লাগার কী আছে?
আপনি মেয়ে-জামাইয়ের জন্য এ পাড়ায় একটু বড় একটা প্লট খুঁজছেন, তাই তো!
হ্যাঁ হ্যাঁ, তাই।
আপনার জামাই ভজনবাবুর গ্যারেজের জমিটাই সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেছিল। কিন্তু ভজনবাবু জমি বিক্রি করতে রাজি হননি।
আমার জামাই ওকে দুনো টাকা অফার করেছে। তাও রাজি হয়নি। এতে কোনও অপরাধ হয়নি তো!
আরে না। অপরাধ কীসের? তবে ভজনবাবুর গ্যারেজটা তুলে দিতে পারলে আপনার অনেক সুবিধে।
সনাতন চুপ।
এবার ঘটনার দিনের কথা।
বলুন না। কী বলতে হবে। পুলিশকে একদফা বলেছি।
সেদিন রাতে রিঙ্কু খুন হয়।
হ্যাঁ মশাই। কী নৃশংস ব্যাপার। ফুটফুটে মেয়েটা পাড়া দাপিয়ে বেড়াত। তাকে কেউ ওভাবে খুন করে? লোকটার ফাঁসি নয় মশাই, শূলে চড়ানো উচিত ওকে।
সে তো বুঝলাম। কিন্তু শূলে চড়াতে গেলে কিছু সাক্ষ্য-প্রমাণের দরকার।
সোজা কেস মশাই। আমরা সবাই জানি।
কী জানেন?
খুন। আর রেপ ওই ভজনই করেছে।
কীভাবে জানলেন?
রিঙ্কুর তো যাতায়াত ছিলই ওর কাছে। সেদিন সন্ধে থেকে আটকে রেখেছিল ঘরে। তারপর রেপ করার পর মেরে ফেলে।
কী করে বুঝলেন? কোনও চিৎকার শুনেছেন?
চিৎকার! না, সেরকম কিছু শুনিনি।
এ জায়গাটা খুব নির্জন। রাতে আরও নির্জন। সামান্য শব্দ হলেও শোনার কথা।
তা ঠিক। তবে আমার ঘরে অনেক রাত অবধি টিভি চলে। আমার শাশুড়ি ইনসোমানিয়ার রুগি। তিনি সন্ধেরাত্তির থেকেই টিভি ছেড়ে বসে থাকেন। টিভির শব্দে
বুঝেছি। রিঙ্কুকে আপনি সেদিন গ্যারেজে ঢুকতে দেখেছেন?
না, দেখিনি। তবে সাইকেলটা দেখেছি।
সেটা জানি। রিঙ্কু কি খুব ঘনঘন গ্যারেজে আসত?
খুব ঘনঘন। রোজই আসত।
আপনার কি ধারণা মেয়েটা ভজনবাবুর সঙ্গে ইনভলভূড ছিল?
মেয়েটা একটু ফস্টিনস্টি করার মতো ছিল। আর ভজনবাবু তো অতি বাজে লোক। শুনেছি। ওর চরিত্রদোষ আছে বলে বউয়ের সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে গেছে।
ভজনবাবুর সঙ্গে রিঙ্কুর ঘনিষ্ঠতা কীরকম ছিল জানেন?
গাড়ি চালাতে শেখাত, ঢলাঢ়লিও করত, গ্যারেজে বসে আডডা মারত। তাই নিয়ে অশান্তিও হয়েছে।
কীরকম অশান্তি?
পাড়ার ছেলেরা ভজনবাবুর ওপর কয়েকবারই চড়াও হয়েছে।
কেন?
রিঙ্কুর সঙ্গে ওর। খারাপ সম্পর্ক বলে।
রিঙ্কুর বাবা কি কখনও ভজনবাবুকে কিছু বলেছে?
শচীনন্দন? ও কি একটা মানুষ? সারাদিন তো চিংড়ির ভেড়িতেই পড়ে থাকত। সংসার ভেসে গেলেও খেয়াল করত না। একটু সাবধান হলে মেয়েটা বাঁচত।
রিঙ্কুর সাইকেলটা খুনের পরদিনও গ্যারেজে ছিল, তাই না?
হ্যাঁ।
আপনি কি আগের দিন জানতে পেরেছিলেন যে রিঙ্কুকে পাওয়া যাচ্ছে না?
না। আমার কানে আসেনি।
পাড়ার ছেলেরা যখন জানতই যে রিঙ্কু প্রায়ই ভজনবাবুর গ্যারেজে আসে তখন তারা গ্যারেজে রিঙ্কুর খোঁজ করল না কেন বলুন তো!
জানি না মশাই। ওখানেই তো আগে খোঁজা উচিত ছিল।
রিঙ্কু কি কখনও আপনার বাড়িতে আসত?
না। এ বাড়িতে তার সমবয়সি তো কেউ নেই, কেন আসবে?
ওদের পরিবারকে আপনি কতটা চেনেন?
ভালই চিনি। আমরা কয়েকজন প্রথম এ জায়গায় বাড়িঘর পত্তন করি। শচীনন্দন আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট। তবু ভালই আলাপ আছে।
যাতায়াত আছে?
কালেভদ্রে। যে যার ধান্ধায় ব্যস্ত, সময়টা কোথায়? শচী তো থাকেও না। এখানে। মাছের ভেড়িতে পড়ে থাকে।
সেই রাতে অস্বাভাবিক কোনও চিৎকার বা শব্দ শোনেননি তো!
না মশাই, মনে তো পড়ছে না।
ভাল করে ভেবে দেখুন তো, রাত দশটা থেকে বারোটার মধ্যে কোনও সময়ে খুব কুকুর ডাকছিল কি?
সনাতন মল্লিক ক্ৰ কুঁচকে একটু ভেবে সোৎসাহে বলে উঠলেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, এগারোটার পরে কিছু কুকুর খুব ডাকছিল বটে। তবে তারা কিন্তু রোজই ডাকে। সেদিন হয়তো একটু বেশি ডাকছিল।
আর কোনও অস্বাভাবিক শব্দ?
না, মনে পড়ছে না।
রিঙ্কুর কোনও বিশেষ ছেলেবন্ধু ছিল কি?
সে আমি কী করে জানিব? পাড়ার ছেলেছোঁকরাদের জিজ্ঞেস করুন। ওরা হয়তো বলতে
পারবে।
আপনার কি মনে হয় ভজনবাবু খুন করতে পারেন?
না পারার কী আছে? ও লোক সব পারে।
আপনার স্ত্রীর অসুখটা কি জটিল?
হার্ট প্রবলেম। অ্যানজাইনা।
আপনার শাশুড়ি তো সারা রাত জেগে থাকেন।
হ্যাঁ।
তিনি মধ্যরাতে কোনও শব্দ শুনেছেন কি?
না। পুলিশ তাকে অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। সেই ভয়ে তিনি মধ্যমগ্রামে তীর বড়মেয়ের বাড়িতে গিয়ে আছেন।
আপনার স্ত্রী বাড়িতে আছেন?
আছেন।
তীকে ডাকুন।
তাকেও জেরা করা হয়েছে।
জানি। আমার দু-একটা প্রশ্ন মাত্র।
ডাকছি।
সনাতনবাবু ভিতরে গিয়ে স্ত্রীকে ডেকে আনলেন। মধ্যবয়স্কা সাধারণ চেহারার ভদ্রমহিলা। মুখে বুদ্ধির ছাপ আছে।
মাপ করবেন, আপনি অসুস্থ, তবু বিরক্ত করছি।
অসুস্থতা তেমন কিছু নয়। প্রশ্ন করতে পারেন।
ভজনবাবু কেমন লোক?
ভাল নয়। গ্যারেজটার জন্য আমাদের খুব অসুবিধে হচ্ছে। ওঁকে বলছি বাড়ি বিক্রি করে অন্য জায়গায় বাড়ি করতে।
গ্যারেজের শব্দে আপনার অসুবিধে হত, সে তো বুঝলাম। ভজনবাবুকে কতটা চিনতেন?
চিনতাম একটু-আধটু। দেখতাম প্রায়ই।
দেখে কী মনে হত?
মনে আবার কী হবে। চেহারাটা ভাল। একটা মারুতি গাড়ি করে আসা-যাওয়া করত। ইদানীং তো থাকতই এখানে।
কখনও আলাপ হয়নি?
তা হবে না কেন?
কী সূত্রে আলাপ?
আমরা বছর চারেক হল এ বাড়ি করেছি। ভজনবাবু তার বছরখানেক আগে এখানে গ্যারেজ করেন। বাড়ি করার মেটেরিয়াল আমরা ওঁর গ্যারেজেই রাখতাম। তখন ওঁর ব্যাবসা বড় হয়নি।
ওর ক্লায়েন্টরা কীরকম?
ইদানীং তো দেখতাম বেশ বড়লোক মাড়োয়ারিরা আসছে। শুনেছি। ওঁর খদেররা। বেশিরভাগই বড়লোক।
ঘটনার দিনের কথা মনে আছে?
থাকবে না কেন? তবে আমরা কিছু দেখিওনি, শুনিওনি।
রিঙ্কুকে যে সন্ধেবেলা থেকে পাওয়া যাচ্ছিল না। এ খবর কি জানতেন?
না। আমাদের কেউ বলেনি। রিঙ্কুরা একটু তফাতে থাকে। মাঠের ওপাশে। পাড়াটা আলাদা।
রিকুকে তো চিনতেন!
হ্যাঁ। ছোট থেকে দেখছি। ওর মা যখন এখানে থাকত তখন কয়েকবার গেছি। ওদের বাড়িতে। ওর মা-ও আসত।
মা কেমন মহিলা?
খারাপ তো তেমন কিছু দেখিনি। দেখতে সুন্দর ছিল, আর উগ্ৰ সাজগোজ করত।
আর কিছু?
না। আর কী বলুন!
ভজনবাবু সম্পর্কে আর কিছু বলতে পারেন?
না।
রিঙ্কু মেয়েটা কেমন ছিল?
ভাল নয়। বড্ড উড়নচণ্ডী।
সে কি খুব ঘনঘন ভজনবাবুর কাছে আসত?
হ্যাঁ। রোজ। দুজনের তো খুব ভাব ছিল দেখেছি।
কীরকম ভাব?
মাখামাখি ছিল বেশ।
কোনও অস্বাভাবিক কিছু দেখেছেন?
দু’জনে গাড়ির সিটে ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে গাড়ি চালাত দেখেছি।
রিঙ্কুর অনেক ছেলেবন্ধু ছিল কি?
ও বাবা, সে অনেক ছিল।
তারা ভজনবাবুকে হিংসে করত না?
করত বোধহয়। গ্যারেজে তো কতবার বোমা পড়ল, হামলা হল। কেন হাঙ্গামা হত কে জানে বাবা!
সেই হামলার লিডারশিপ কে দিত বলতে পারেন?
না। হাঙ্গামা হলে আমরা জানালা দরজা বন্ধ করে দিই। গ্যারেজটার জন্য আমাদের খুব অশান্তি হচ্ছে।
গ্যারেজটা উঠে গেলে কি আপনাদের সুবিধে হয়?
হবে না? খুব হয়। দিন না উঠিয়ে।
ভজনবাবু কনভিকটেড হলে গ্যারেজ উঠেও যেতে পারে।
তাই হোক বাবা। ক’দিন গ্যারেজটা বন্ধ বলে খুব শান্তিতে আছি।
শচীনন্দনবাবু, আপনার শোকটা যে কতখানি তা বুঝতে পারছি। এ সময়ে আপনাকে ডিস্টার্ব করা হয়তো উচিত নয়। আপনার অস্বস্তি হলে আমি আপনাকে প্রশ্ন করবও না।
শচীনন্দনের বয়স মাত্ৰ বিয়াল্লিশ হলেও শরীরে অতিরিক্ত চর্বির জন্য বয়স্ক বলে মনে হয়। মাথায় টাকা। প্রচুর কেঁদেছেন বলে চোখ দুটো এখনও রক্তিম। মুখে গভীর শোকের ছাপ। দৃষ্টিতে শূন্যতা। মাথা নেড়ে শচীনন্দন বলল, না, কোনও অসুবিধে হবে না। কী জানতে চান বলুন।
আপনার ডিভোর্স কতদিন হয়েছে?
বছর সাত-আট।
ডিভোর্সের কারণটা কী?
আমার মেয়ের মৃত্যুর সঙ্গে এ ব্যাপারের কী সম্পর্ক?
হয়তো সম্পর্ক নেই। ইচ্ছে না হলে বলার দরকার নেই।
শচীনন্দন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, টু কাট এ লং স্টোরি শর্ট, আমার স্ত্রী শ্যামলী আর একজন লোকের প্রেমে পড়েছিল।
লোকটা কে?
শুনেছি। ওর পূর্বপ্রণয়ী। তার নাম সুজিত।
তারা এখন কোথায় থাকেন?
কানপুর।
রিঙ্কুর খবর তাঁকে দেওয়া হয়েছে কি?
হ্যাঁ। শ্যামলী তো তিন-চার দিন হল চলেও এসেছে। এই বাড়িতেই আছে।
ওঁর হাজব্যান্ডও এসেছেন কি?
না। ওর এ পক্ষের দুটো মেয়েকে নিয়ে এসেছে।
ডিভোর্সের পর উনি রিঙ্কুর কাস্টডি চাননি?
না। বোধহয় সুজিতের ইচ্ছে ছিল না।
শুনেছি আপনি রিঙ্কুর দেখাশোনা করার সময় পেতেন না।
ঠিকই শুনেছেন। আমার ব্যাবসাটা বড়। মাছের ব্যাবসা। একা মানুষ, সামাল দিতে হিমশিম খাই। তবে রিঙ্কুর দেখাশোনা আমার মা আর বাবাই করেন। ঝি-চাকরের অভাব নেই।
শ্যামলীদেবীর সঙ্গে কি আপনার বাবা-মা’র বনিবনা ছিল না?
না। আজকালকার মেয়েরা শ্বশুর-শাশুড়িকে সহ্য করতে পারে না। কিন্তু মা-বাবাকে
ডিভোর্সের কারণ সেটাই নয় তো?
সেটা অপ্রধান কারণ। আমি শ্যামলীর জন্য আর একটা বাড়ি করে দিচ্ছিলাম। জানালা দিয়ে তাকালে দেখতে পাবেন বাড়িটা খানিকটা হয়ে পড়ে আছে। বলেছিলাম, কাছাকাছি আলাদা থাকে, তা হলে খিটিমিটিও লাগবে না, সম্পর্কটাও ভাল থাকবে ও রাজি ছিল। কাজেই ডিভোর্সের কারণ আমার মা-বাবা হতে পারে না।
বুঝলাম। রিঙ্কু সম্পর্কে আপনি কতটা ওয়াকিবহাল ছিলেন?
মেয়েটা চঞ্চল ছিল। ডাকাবুকোও।
অবাধ্য ছিল কি?
একটু ছিল।
আপনাকে কেমন ভালবাসত?
খুব। বলেই শচীনন্দন দুহাতে মুখ ঢেকে রইল। কান্না চাপার চেষ্টা করতে লাগল।
শবর চুপ করে বসে রইল।
মিনিট কয়েক পরে ধাতস্থ হয়ে শচীনন্দন বলল, ওর সম্পর্কে পাড়ায় দুর্নাম শুনবেন, কিন্তু বিশ্বাস করুন, রিঙ্কু খারাপ ছিল না। আদর পেয়ে পেয়ে একটু স্বাধীনচেতা হয়ে উঠেছিল মাত্র।
এরকম হতেই পারে। আপনি কি জানেন ভজনবাবুর সঙ্গে ওর কীরকম রিলেশন ছিল?
কী করে বলব? ভজন মাঝে মাঝে আমার বাড়িতে আসত। একটু গভীর আর চুপচাপ মানুষ। আমার ওকে খারাপ লাগত না।
রিঙ্কু কি কখনও বাড়ির কাউকে জানিয়েছিল যে ও ভজনবাবুকে বিয়ে করতে চায়?
না, সেরকমভাবে কিছু জানায়নি। তবে–
তবে কী?
আমার মায়ের কাছে ও প্রায়ই ভজনবাবুর গল্প করত।
কীরকম গল্প?
ভজনকে যে ও খুব পছন্দ করে সেই কথাই বলত।
পছন্দটা হৃদয় পৰ্যন্ত পৌঁছেছিল কি না জানেন?
শচীনন্দন একটু থিতামত খেয়ে বলল, আমি মাকে ডাকছি। আপনি তাঁর সঙ্গে কথা বলুন।
শচীনন্দন গিয়ে তাঁর মাকে ডেকে আনলেন। মায়ের সঙ্গে ছেলের মুখশ্ৰীর অদ্ভুত মিল। মা অবশ্য রোগা মানুষ, বয়স মধ্য ষাট। মুখে গভীর শোক থিম ধরে আছে।
মাসিমা কিছু মনে করবেন না।
না বাবা, বিলো।
ভজনবাবুর সঙ্গে রিঙ্কুর সম্পর্ক কেমন ছিল?
কী করে বলব? খারাপ কিছু তো মনে হয়নি।
ভজনবাবুকে আপনার কেমন লোক বলে মনে হয়?
তাকেও খারাপ লাগেনি। মিশুকে ছিল না। এই যা।
রিকু কি তাকে ভালবাসত বলে মনে হয়? মানে রিঙ্কুর কথায় তেমন কিছু ধরা যেত কি?
শচীনন্দনের মা মাথা নেড়ে বললেন, বলতে পারব না বাবা। আজকালকার মেয়েদের কি অত সহজে বোঝা যায়? তা ছাড়া রিঙ্কুর বয়সটাই বা কী বলো! বুদ্ধিাশুদ্ধি তো ছিল না।
রিঙ্কু কি বোকা ছিল?
তাও নয়। লেখাপড়ায় বেশ মাথা, কথাবার্তায় চৌখস, আবার আগুপিছু না ভেবে হুটহাট এক-একটা কাজ করে বসত।
কিছু মনে করবেন না, ভজনবাবুছাড়া আর কোনও ছেলের প্রতি ওর সফটনেস ছিল কি?
ওসব জানি না বাবা। তবে ছেলেছোঁকরাদের সঙ্গে মিশত। খুব।
শচীনন্দন বলল, এসব জেনে আর কী হবে? খুনি তো ধরাই পড়ে গেছে।
সেটা ঠিক। তবে আমাদের কেস সাজাতে হলে সবরকম সম্ভাবনা খতিয়ে দেখে নিতে হবে। কোনওখানে ফাঁক থাকলে সেই রন্ধ দিয়ে দোষী পার পেয়ে যায়।
পার পেয়ে যাবে কোথায়? পুলিশ ছাড়লেও এ পাড়ার লোক ওকে পিটিয়ে মেরে ফেলবে।
মৃদু হেসে শবর বলল, হ্যাঁ, জনগণের আদালতে তো সেরকমই হয়। শচীনন্দনবাবু, ভজনবাবুর গ্যারেজে বারিকয়েক হামলা হয়েছে। কেন জানেন?
চাঁদার জন্য। ব্যাবসা করলে বেকার ভাতা না দিয়ে রেহাই নেই। সেটা নিয়েই গণ্ডগোল। ও তো মারও খেয়েছে।
কে মেরেছিল?
হাবু আর জগুর দল।
আর কারও সঙ্গে ভজনবাবুর শক্ৰতা ছিল কি?
গ্যারেজটার জন্য পাড়ার লোকেদের অসুবিধে হচ্ছিল। আরও কী কী সব যেন, অত ডিটেলসে জানি না। তবে অশান্তি ছিলই।
ভজনবাবুকি একটু মারকুট্টা একরোখা লোক?
তা বোধহয় একটু আছে।
ব্যক্তিগতভাবে আপনি কি মনে করেন যে ভজনবাবুই আপনার মেয়েকে ওরকম নৃশংসভাবে মেরেছে?
শচীনন্দন অনেকক্ষণ ভাবলা। খুব চিন্তিত। তারপর মৃদু গলায় বলল, আর কে মারবে?
সম্ভাবনার কথা বলছি।
আপনারা কি আর কাউকে সন্দেহ করছেন?
আরে না।
আমার মেয়েকে মেরে কার কী লাভ বলুন! রিঙ্কু হয়তো দুষ্ট একটু ছিল, কিন্তু এত বড় শাস্তি ওর হল কেন? মেয়েটা আমার–
শচীনন্দন হঠাৎ কান্নায় কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল।
মা এসে ছেলেকে দুহাতে ধরে বলল, ওকে এবার রেহাই দাও বাবা। গত আটদিন ধরে ওর যে কী অবস্থা।
ঠিক আছে মাসিমা।
আপনি কি তদন্তের ব্যাপারে কথা বলবেন?
শ্যামলী নামক মহিলাটির মুখে শোক ও রাগের মাখামাখি লক্ষ করল শবর। রাগটাই বেশি। বেশ সুন্দর ঢলঢলে মুখশ্ৰীতে একটু কাঠিন্যও আছে। গভীরভাবে শবরের দিকে চেয়ে বলল, আপনাদের উচিত রিঙ্কুর বাবাকেও অ্যারেস্ট করা।
কে?
কেন সেটা আবার জিজ্ঞেস করছেন? ব্যাবসা-ব্যাবসা করে স্বার্থপর লোকটা মেয়েটার দিকে একটু নজরও রাখল না! ও যদি মানুষ হত তা হলে মেয়েটার এরকম পরিণতি হত বলে ভাবেন?
আপনি একটু শান্ত হন।
শান্ত হব? কী ভেবেছেন আপনারা? খুনির ফাঁসি হোক, একশোবার হোক, কিন্তু যার অবহেলার ফলে আমার ফুলের মতো মেয়েটা মরল সে কেন রেহাই পাবে?
ঠিক কথা। সে প্রশ্ন আপনাকে আমারও করতে ইচ্ছে করছে।
তার মানে?
আপনি যখন শচীনন্দনবাবুকে ছেড়ে চলে যান। তখন রিঙ্কু মাইনর। আপনি ইচ্ছে করলেই তো মেয়েকে নিয়ে যেতে পারতেন। নেননি কেন?
নিইনি বলেই মেয়েটাকে অবহেলা করা হবে? শুধু আমারই তো মেয়ে নয়, ওরও তো!
এটা আমার প্রশ্নের জবাব হল না। আমি জানতে চাই, আপনি মেয়েকে নেননি কেন?
মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে শ্যামলী বলল, আমার অসুবিধে ছিল।
কীরকম অসুবিধে?
এ প্রশ্নের জবাব কি দিতেই হবে?
না দিলেও কিছু করার নেই। ইচ্ছে না হলে বলবেন না।
আমার সেকেন্ড হাজব্যান্ড রাজি ছিল না।
আপনি কানপুরে থাকেন?
হ্যাঁ।
অত দূর থেকে মেয়ের খবর কীভাবে নিতেন?
চিঠি লিখে।
শচীনন্দনবাবুকে চিঠি লিখতেন?
না।
তা হলে?
পাড়া-প্রতিবেশীদের লিখতাম।
পাটিকুলারলি কাকে?
সে আছে। রিঙ্কু একটু বড় হওয়ার পর ওকেই লিখতাম।
রিঙ্কু জবাব দিত?
হ্যাঁ।
সে কি আপনার জন্য ফিল করত?
নিশ্চয়ই।
আপনার ডিভোর্স কতদিন হয়েছে?
আট বছর।
রিঙ্কুকে আপনি কত বছর দেখেননি?
চার বছর আগে এসে দেখে গেছি।
চার বছর লম্বা সময়। মেয়েকে দেখতে ইচ্ছে হত না?
হবে না। সবসময়ে তো। ওর কথা ভাবতাম। কিন্তু ওখানে আমার নিজস্ব একটা ব্যাবসা আছে।
কীসের ব্যাবসা?
বাচ্চাদের ড্রেস তৈরির ব্যাবসা।
টাকা কে দিয়েছিল?
সুজিত-মানে আমার হাজব্যান্ড।
উনি কি আপনার আগের চেনা?
হ্যাঁ। ছেলেবেলা থেকে।
ওকেই আগে বিয়ে করলেন না কেন?
সেটা দিয়ে এই তদন্তে কী দরকার?
কখন কোনটা কাজে লাগে তার ঠিক কী?
বিয়ে করিনি বাধা ছিল বলে।
কীসের বাধা?
আমার বাবা রাজি ছিলেন না।
কেন, জাতের বাধা ছিল?
না।
তবে?
সুজিতকে আমার বাবা পছন্দ করতেন না।
আপনার বাবা বেঁচে আছেন?
না।
ঠিক আছে, আমি আপনার আর সময় নষ্ট করব না।
লোকটার ফাঁসি কবে হবে?
কার ফাঁসি?
ওই লোকটার। যে আমার মেয়েকে খুন করেছে!
ফাঁসি দেওয়ার মালিক আমি নই।
ওকে আমার হাতে ছেড়ে দেবেন?
কেন?
আইনের ফাঁক দিয়ে হয়তো বেরিয়ে যাবে। তার চেয়ে আমার হাতে ছেড়ে দিন।
কী করবেন?
খুন করব।
শবর হাসল, লোকটাকে কেউই পছন্দ করে না দেখছি।
পছন্দ করার কথা নাকি? রেপ আর খুন দুটোর জন্য তো আর দু’বার ফাঁসি হবে না। আমার হাতে ছেড়ে দিলে আমি আগে একটা একটা করে ওর চোখ ওপড়াব, জিব টেনে ছিঁড়ব, পুরুষাঙ্গ কাটব…
দাঁড়ান, অতি উত্তেজিত হবেন না। অপরাধ এখনও প্রমাণ হয়নি।
সেটা আপনাদের ইন এফিসিয়েন্সির জন্য হয়নি। অত বড় একটা অন্যায় করল আর আপনারা এখনও প্ৰমাণই করতে পারলেন না।
আমরা অযোগ্য হতেই পারি। কিন্তু তবু এসব ব্যাপারে তাড়াহুড়ো করা ভাল নয়।
সেইজন্যই তো বলছি, ওকে না হয় জামিনেই ছেড়ে দিন কয়েকদিনের জন্য।
ওকে মারলে আমাদের যে আপনাকে ধরতে হবে।
ধরবেন। মরতেও রাজি।
আপনি অযথা রেগে যাচ্ছেন।
অযথা? আপনার মেয়ে আছে?
থাকার কথা নয়। আমি বিয়ে করিনি।
তা হলে বুঝবেন কী করে?
মেয়ের বাবা নাই বলে কি আপনাদের দুঃখের কারণটা বুঝতে পারব না?
ওর গ্যারেজটায় আমি আগুন লাগাব।
শবর শুধু হাসল।
শ্যামলী বলল, আচ্ছা, ওর সঙ্গে লক আপ-এ গিয়ে দেখা করতে দেবেন?
দেখা করতে চান?
খুব চাই। দরকার হলে ঘুষ দেব।
ঘুষ দিতে হবে না। তবে আমি চেষ্টা করব।
সত্যি করবেন?
করব।
থ্যাঙ্ক ইউ।
৩. ছবিটা কার
ছবিটা কার মিস্টার দাশগুপ্ত?
রিঙ্কু নামে একটা মেয়ের।
ও, সেই বারাসাতের মার্ডার কেসটা না?
হ্যাঁ, ছবিটা কেমন দেখছেন?
মেয়েটা তো দেখতে স্মার্ট অ্যান্ড লাভলি।
আর কিছু? একটু দুষ্ট ছিল বোধহয়?
হ্যাঁ, তা ছিল।
আচ্ছা দাশগুপ্ত, এটা তো রাজ্য পুলিশের ব্যাপার, আপনি কেন ওদের কেসে ফেঁসে যাচ্ছেন? ইউ আর গোয়িং আউট অব ইয়োর বাউন্ডস টু হেলপ দেম, তাই না?
শবর একটু হাসল, হ্যাঁ মিস্টার ঘোষাল, ব্যাপারটা তাই।
এই এক্সট্রা দায়িত্ব নিলেন কেন? মেয়েটা কি আপনার চেনা?
না মশাই, আমি ফ্যাক খাটছি। বলতে পারেন।
কিন্তু কেন?
রজাতদার জন্য।
রজাতদা মানে? ডিআইজি রাজত গুপ্ত?
হ্যাঁ।
আপনাদের বদ্যিতে বদ্যিতে বেশ ভাব, তাই না?
শবর হাসল, ঠিকই বলেছেন। বদ্যিরা অপেক্ষাকৃত স্মল কমিউনিটি, আর একটু বোধহয় ক্ল্যানিশও।
রজতবাবু নিশ্চয়ই আপনার আত্মীয় হন?
দূর সম্পর্কের।
ওই তো, বদ্যিরা সবাই সবার আত্মীয়, আর এ মেয়েটা কি রজতবাবুর কেউ হয়?
না।
তা হলে ওঁর ইন্টারেস্ট কীসের?
ইন্টারেস্ট কেন তা আমি জানি না। আই ওয়াজ আসকড টু হেলপি।
সবই জানেন মশাই, বলবেন না।
শবর হাসল।
ছবিটা স্টাডি করছেন কেন?
ছবি অনেক সময় অনেক কথা বলে।
কেসটা কি খুব জটিল? মার্ডারারকে তো ধরেছেন।
আমি ধরিনি। লোকাল পুলিশ ধরেছে। সময়মতো না ধরলে লোকটা গণপিটুনিতেই খুন হয়ে যেত।
লোকে আজকাল বড্ড বেশি আইন হাতে নিচ্ছে।
হ্যাঁ। তার জন্য ওভার অল পরিবেশটাই দায়ী। লোকে পুলিশের ওপর আস্থা হারিয়েছে। আইনের ওপর বিশ্বাস নেই, দেশে চোর ডাকাত খুনিও তো বাড়ছে।
হুঁ। লোকটার এগেনস্টে কেস দেওয়া হয়েছে?
না, তবে কেস জোরালো। প্রমাণ হয়ে যাবে।
তা হলে আর ভাবনা কী? কেস তো সোজা।
তা ঠিক, কিন্তু লোকটার কনফেশন বের করা গেল না।
তার কি কোনও প্রয়োজন আছে?
শবর একটু আনমনা চোখে ঘোষালের দিকে চেয়ে বলল, আচ্ছা, মানুষ কতটা পেনি সহ্য করতে পারে বলুন তো! আপনি তো এ বিষয়ে স্টাডি করেছেন।
হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?
কারণ আছে।
বিভিন্ন প্ৰজাতির মানুষের বিভিন্ন সহ্যশক্তি। চিনাদের একটু বেশি সহ্যশক্তি আছে। ট্রাইবালদের মধ্যেও ফিজিক্যাল পেন সহ্য করার ক্ষমতা অনেক বেশি। কেন বলুন তো!
এই মার্ডার কেসের সাসপেক্ট ভজন আচার্য একজন ব্ৰাহ্মণ সন্তান। ব্ৰাহ্মণরা নাকি খুব বেশি ব্যথা সইতে পারে না! মহাভারতে কী একটা গল্প আছে না?
হ্যাঁ, সেই বজকীটের দংশনের গল্প তো! ব্ৰাহ্মণরা বোধহয় পেনি সহ্য করার খুব বেশি সক্ষমতা রাখে না।
এ লোকটা তা হলে একসেপশন।
তার মানে?
দিস ম্যান ওয়াজ ব্রুটালি মলড বাই দি পাবলিক দ্যাট ডে। কিন্তু হি কেপ্ট হিজ কুল কম্পোজার। ইনজুরি ছিল মারাত্মক, তবু কোনওরকম এক্সপ্রেশন ছিল না। হাবু বলে একটা গুল্ডা আছে ওখানে। সে আর লোকাল মস্তানেরাও ওকে বার দুই মেরেছে। একবার প্ৰচণ্ডভাবে, রড পাঞ্চ সবই ব্যবহার করা হয়। হাবু আমাকে বলেছে, ভজন অতি মার খেয়েও গ্যারাজের মুখে দাঁড়িয়ে তাদের আটকেছে। যেদিন ডেডবডি পাওয়া গেল সেদিনও হাটুরে মার খায় লোকটা। হাসপাতালে দিতে হয়েছিল।
হিরো নাকি?
না, হিরো বলা যায় না। তবে অদ্ভুত।
আর পুলিশের থার্ড ডিগ্রি?
হ্যাঁ, সেই কথাতেই আসছিলাম। খুনের আগের রাতে ওর গ্যারেজের ঘরে একটা মেয়ে ছিল। স্ট্রং সাসপিশন, মেয়েটা রিঙ্কু, কিন্তু ভজন আচাৰ্ষিকে দিয়ে সেটা বলানো যায়নি। গত কিছুদিনের মধ্যে লোকটাকে বার কয়েক ইনহিউম্যান টর্চার সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু লোকটার যেন ফিজিক্যাল সেন্স বলে কিছু নেই। এরকম কি হতে পারে?
কারও কারও সহ্যের ক্ষমতা খুব বেশি থাকতে পারে। কিন্তু তা দিয়ে কী প্রমাণ করতে চাইছেন?
বুঝতে পারছি না।
যতদূর শুনেছিলাম, আপনাদের হাতে প্ৰমাণ সব এসে গেছে।
হ্যাঁ। লোকটা রেহাই পাবে না। আপনি বোধহয় জানেন না, লোকটা আবার স্যাডিস্ট। অন্যকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পায়।
তাই নাকি? ইন্টারেস্টিং।
ওর স্ত্রী বলেন, লোকটার সেক্স খুব উগ্র এবং ভায়োলেন্ট, শি লেফট হিম ফর দ্যাট।
মাই গড!
রিঙ্কুকে খুন করার পিছনে এই স্যাডিজম ছাড়া আর কোনও মোটিভ পাচ্ছি না।
কেন, রেপ!
হ্যাঁ, রেপ। কিন্তু লোকটার অত সেক্স সত্ত্বেও সে প্রস কোয়ার্টারে যেত না কেন বলুন তো!
মে বি হি হ্যাড স্টেডি গার্ল ফ্রেন্ড। হাফ গোরস্তও তো আছে। তাদের তো প্রস কোয়াটারে পাওয়া যাবে না। তা ছাড়া রেড লাইট এরিয়া তো বিশাল এবং সংখ্যাও কম নয়। সব কি খুঁজে দেখা সম্ভব?
তা ঠিক, সম্ভাব্য জায়গাগুলিতেই খোঁজ করা হয়েছে।
আপনি এত ব্ৰড অ্যাঙ্গেলে ভাবছেন কেন?
শবর মাথা নেড়ে বলল, ভাববার কোনও মানে হয় না।
এবার ঘোষালও একটু হাসল, মিস্টার দাশগুপ্ত, আমি আপনাকে চিনি। আপনার কোথাও একটা খিঁচ থেকে যাচ্ছে।
না, খিঁচ নয়। একটা কথা বলবেন?
কী কথা?
ভজন রেপ করে রিঙ্কুকে মার্ডার করল। কিন্তু তারপর সে স্পটে রয়ে গেল কেন? ও তো রাতেই কলকাতায় চলে আসতে পারত।
ইজি। কলকাতায় পালিয়ে এলে ওর ওপর সন্দেহ আরও বাড়ত। হয়তো ভেবেছিল, ভালমানুষটি সেজে থাকলে লোকে সন্দেহ করবে না।
হ্যাঁ, সেটা হতে পারে। সেটাই সম্ভব।
আপনার কোনও জায়গায় গ্যাপ আছে বলে মনে হচ্ছে কি?
শবর একটু চিন্তিতভাবে বলল, না, ঠিক তা নয়। গ্যাপ কিছু নেই। কিন্তু কেসটা বড্ড সোজা আর সরল।
তা তো হতেই পারে। আমাদের দেশের ক্রিমিন্যালরা তো আর মাথা বেশি খাটায় না। তাদের বেশির ভাগ কাজই মোটা দাগের। আপনি অত ভাবছেন কেন?
শবর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ভাবছি। একটা কথা।
কী বলুন তো!
ভজন আচাৰ্ষি রোজ সকালে পাড়ার কুকুরদের ডেকে পাউরুটি খাওয়াত। কলকাতাতেও, বারাসতেও।
সো হোয়াট? হি লাভড ডগাস। এ তো হতেই পারে।
কলকাতায় একবার একটা কুকুর গাড়ি চাপা পড়ে ঠ্যাং ভাঙে। তাকে তুলে নিয়ে ট্যাক্সি করে ভেটারনারি হসপিটালে নিয়ে গিয়ে ভাল করে এনেছিলেন ভজনবাবু। উনি এসপিসিএ-র মেম্বার এবং অ্যানিমাল লাভার।
ঘোষাল একটু থমকাল, তারপর বলল, তা হলে তো ভাবতে হচ্ছে। অ্যানিমাল লাভাররা হোমিসাইড করতে পারবে না তা নয়। সপ্লিট পারসোনালিটি হতে পারে। তবে ইটস এ পয়েন্ট টু পান্ডার। কেসটা ডিটেলসে বলবেন?
শবর বলল।
রিঙ্কুর ছবিটা ভাল করে দেখে ঘোষাল বলল, হাউ ওল্ড ওয়াজ সি? সিক্সটিন?
হ্যাঁ।
ও কি ভজনবাবুকে বিয়ে করতে চেয়েছিল?
হ্যাঁ।
তা হলে একটু ভাবতে হচ্ছে। পুলিশ কি এই অ্যাঙ্গেলটা দেখেনি?
লোকাল পুলিশ এত দেখতে চাইছে না। তাদের কাছে এটা একটা ওপেন অ্যান্ড শাট কেস। ভজন আচার্যি কনভিকটেড হলে তারা বাহবা পাবে। একটা সলভড মার্ডার কেসকে কে কাঁচিয়ে দিতে চায় বলুন।
ঘোষাল একটু হেসে বলল, তা তো বটেই। আপনি কী করতে চান?
বুঝতে পারছি না।
রিঙ্কুর পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দেখেছেন?
হ্যাঁ।
স্টমাকে কিছু পাওয়া গেছে?
কী পাওয়া যাবে?
ধরুন অ্যালকোহল।
হ্যাঁ।
বয়ফ্রেন্ডদের ক্রস করেছেন?
দু’জনকে। দু’জনেরই ফুলপ্রুফ অ্যালিবাই আছে। কেউই সেই রাতে বারাসাতে ছিল না। একজন শিলিগুড়ি গিয়েছিল দু’দিন আগে। অন্য জন আগের দিন মামাবাড়ি কোন্নগর।
আর কেউ?
না।
আচ্ছা, ডাক্তারি রিপোর্টে রোপ-এর রিপোর্টটা কীরকম? সিঙ্গল রেপ না গ্যাং রেপ?
সিঙ্গেল।
ফোর্স অ্যাপ্লাই করা হয়েছিল?
অ্যাপারেন্টলি।
ওয়াজ ইট হার ফাস্ট টাইম?
হ্যাঁ, মেয়েটা উড়নচণ্ডী হলেও সেক্সটা আগে হয়নি।
আপনাকে জিজ্ঞেস করা উচিত নয়, তবু বলি, মেয়েটা নখ দিয়ে কাউকে খামচে দিয়েছিল কি না বা রেপিস্টের লালা বা লোম বা চুল কিছু পাওয়া গেছে কি না তা দেখেছেন?
হ্যাঁ। নখে দু-একটা হিউম্যান টিসু পাওয়া গেছে।
ভজনের সঙ্গে মিলেছে?
মেলানোর চেষ্টা হচ্ছে। স্টিল আন্ডার প্রসেস। তবে আমি যতদূর জানি, লোকাল পুলিশ আমাকে মুখে বললেও কাজে টিসু পরীক্ষা করা হচ্ছে না। ওরা এত ডিপে যাবেই বা কেন?
অর্থাৎ ভজনকে ওরা ঝোলাবেই?
হ্যাঁ।
দেন লেট দেম। হ্যাঙ হিম।
তাই তো দিচ্ছি মিস্টার ঘোষাল। লোকটা হয়তো সত্যিই কাণ্ডটা করেছে কিন্তু সন্দেহাতীত ভাবে ব্যাপারটা প্ৰমাণ হচ্ছে বলে আমার মনে হয় না। আমার মনে হচ্ছে জিঙ্গসটা একজন ভাঙলেও ভাঙতে পারে। কিন্তু সেই বিশেষ একজন খুবই স্টাবোর্ন।
কে লোকটা?
ওর স্ত্রী।
কীভাবে? ওঁর স্ত্রী তো ওঁকে ঘেন্না করে শুনলাম।
হ্যাঁ তা করে।
তা হলে?
ভজনবাবু তার স্ত্রীকে ঘেন্না করেন না।
তা হলে কী দাঁড়াল?
ডিফিকাল্ট ব্যাপার।
ভজনবাবুর্তার স্ত্রী সম্পর্কে কী বলেন?
তেমন কিছু নয়। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম ওঁর স্ত্রী কেন চলে গেলেন? ভজন সংক্ষেপে বলেছেন, আমার দোষে। শত চাপাচাপিতেও দোষটা অবশ্য কবুল করেননি। স্ত্রীর প্রতি অ্যাটিচুড কেমন তা জিজ্ঞেস করায় বলেছেন, ও ভাল মেয়ে, আমি খারাপ।
ব্যস?
হ্যাঁ।
তা হলে ওঁর স্ত্রী কী করবেন?
ভজনবাবুকে ঘিরে একটা রহস্য রয়েছে। ওঁর ওই চুপচাপ থাকা, জেদি মনোভাব আর মার খাওয়ার ক্ষমতা আমাকে সমস্যায় ফেলেছে।
তাই তো দেখছি।
আমি যদি বিভাবরীকে রাজি করাতে পারতাম এবং উনি যদি লোকটার সঙ্গে একটু কথা বলতেন তা হলে একটা কিছু বেরিয়ে আসতে পারত।
এটা কী করে বলছেন?
জাস্ট এ হানচ।
ও।
আরও একজন মহিলা ভজনবাবুর সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন।
তিনি কে?
রিঙ্কুর মা। শ্যামলী।
তিনি কেন দেখা করবেন?
বোধহয় ভজনবাবুকে নিজের হাতে খুন করতে চান।
আপনি রাজি হয়েছেন নাকি?
হয়েছি।
কেন?
ভজনবাবুকে শক দেওয়ার কোনও চেষ্টাই আমি ছাড়ছি না।
ও। আপনি সবসময়ে ডেনজার নিয়ে খেলা করেন।
অ্যান্ড হোয়াই নটী?
ঘোষাল হাসল, ইটস ওকে ইফ ইট পেজ। কিন্তু এসব তো পণ্ডশ্রম।
মনে হচ্ছে তাই।
বাই দি বাই, রেপ করার সময় যদি রিঙ্কু ভজনবাবুকে বাধা দিয়ে থাকে তা হলে ভজনবাবুর গালে বা গলায় বা পিঠে বা হাতে নখের দাগ থাকার কথা।
নিশ্চয়ই। তবে গণপ্ৰহারে ভজনবাবুর সারা শরীর এমনই ক্ষতবিক্ষত ছিল যে রিঙ্কুর নখের দাগের মতো সূক্ষ্ম জিনিস খোঁজা খড়ের গাদায় ছুচ খোঁজার সামিল।
তাও তো বটে।
আরও একটা কথা।
কী বলুন তো!
রিঙ্কু যদি ভজনের প্রেমেই পড়ে থাকে তা হলে সেক্সের সময় বাধা দেবে কেন?
কিন্তু আপনিই তো বললেন যে ভজন ভায়োলেন্ট লাভার।
হ্যাঁ।
সেক্ষেত্রে বাধা দিতে পারেই।
সেটা ঠিক। তবু সব দিক ভেবে দেখতে হচ্ছে।
চার্জশিট তো নিশ্চয়ই ফাইল করা হয়নি?
না।
ভজনবাবু উকিল নিয়েছেন?
হ্যাঁ। ওর পরিবার জামিন চেয়েছে।
এখন আপনার অ্যাঙ্গেল অফ থটটা কী?
মাথা নেড়ে শবর বলল, আই অ্যাম ইন কনফিউশন।
শবর দাশগুপ্তর মুখে এ কথা শুনব বলে ভাবিনি।
শবর মৃদু হেসে বলল, ঘটনাবলি নয়, আমাকে কনফিউজ করছে লোকটা। ভজন আচার্য।
লোকটাকে কি আপনার ক্রিমিন্যাল বলে মনে হচ্ছে না?
তা বলছি না। হতেই পারে।
রজাতদা আসলে কী চাইছেন বলুন তো!
রজাতদা ভেঙে কিছু বলেননি। তিনি আমাকে শুধু বলেছেন, এ কেসটািয় আমার একটা পারসোনাল ইন্টারেস্ট আছে। তুমি প্যারালেল ইনভেস্টিগেশন করো। আমি লোকাল থানাকে বলে দিচ্ছি। তোমার সঙ্গে কো-অপারেট করতে।
ওঁর ইন্টারেস্টটা কোন দিকে তা বুঝতে পেরেছেন? ভিকটিম না। সাসপেক্ট?
সম্ভবত সাসপেক্ট।
মাই গড! তাই আপনি মুশকিলে পড়েছেন।
অনেকটা তাই। ছবিটা আবার দেখুন তো দাদা।
ঘোষাল রঙিন ছবিটা তুলে নিয়ে দেখল। গায়ে একটা পোলকা ডটওলা টিলা কামিজ, পরনে নীল জিনস, একখানা সাইকেলে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো, পিছনে একটা মাঠ। মেয়েটার মুখে একটু হাসি।
কিছু মনে হয়?
না। ছবি তো স্থির জিনিস। একটা এক্সপ্রেশন মাত্র। এ থেকে কী বোঝা যাবে বলুন!
ইজ শি সেক্সি?
টিন এজাররা সবাই বয়সের গুণেই অ্যাট্রাকটিভ। যৌবনে কুক্কুরী ধন্যা।
আমি মহিলাদের ব্যাপারে একটু অনভিজ্ঞ, তাই জিজ্ঞেস করলাম।
অনভিজ্ঞ থাকার দরকারটা কী? বয়স তো বোধহয় একত্রিশ-বত্ৰিশ হল।
ওরকমই।
তা হলে টোপরটা এবেলা পরে ফেললেই তো হয়।
ঘোষালদা, নিজের কথা ভুলে যাচ্ছেন। বছর খানেক আগেও আপনি ফ্যামিলি লাইফ নিয়ে আতঙ্কিত ছিলেন।
হ্যাঁ দাশগুপ্ত, সেবার আপনি আমার পাশে না দাড়ালে মরতে হত।
ফ্যামিলি লাইফকে আমি একটু ভয় পাই।
ভয়ও আছে, ভরসাও আছে।
আমার এরকমই ভাল লাগে। সিঙ্গল, অ্যাকটিভ, ফ্রি।
দাঁড়ান। আমার বউকে আপনার পেছনে লাগাব। সে খুব ভাল ঘটকী।
সর্বনাশ! আমি ওর কাছে যাব। একটা রেপিস্ট, খুনির কাছে আমি যাব কেন শবরবাবু? আমার তো ওর সঙ্গে কোনও সম্পর্কই নেই।
জানি, সব জানি। আমি শুধু একটা জিনিস জানতে চাই।
কী সেটা?
সেদিন রাতে উনি সত্যিই রিঙ্কুর সঙ্গে কথা বলছিলেন কি না।
অবভিয়াসলি রিঙ্কু। আর কে হবে!
মানছি। কিন্তু তবু সন্দেহের কোনও অন্ধুর আমি রাখতে চাইছি না।
এটা আপনার বাড়াবাড়ি।
কোনও কিছুই বাড়াবাড়ি নয়। সত্যের শিকড়ে পৌঁছানো সবসময়েই কঠিন।
সত্যকে আপনি স্বীকার করতে চাইছেন না।
সত্য হলে অবশ্যই স্বীকার করব।
কিন্তু আমাকে টানাটানি করছেন কেন?
জেরা বা রুটিন প্রশ্ন করে ভজনবাবুর কাছ থেকে কিছুতেই কথাটা বের করা যাচ্ছে না। আপনি হয়তো জানেন না লোকটার সহ্যশক্তি অসীম। আমি কাউকে এত ফিজিক্যাল টর্চার সহ্য করার পরও এত শান্ত থাকতে দেখিনি।
তাতে কী হ’ল?
লোকটাকে ক্র্যাকডাউন করাটাই আমার স্বার্থ। কেসটার যা অবস্থা ভজনরাবুর রেহাই পাওয়ার কোনও উপায় নেই। আমি ওঁকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি না। লোকটার ফাঁসি হোক কি যাবজ্জীবন আমার কিছু যায় আসে না। কিন্তু লোকটার কাছ থেকে কথাটা বের করা यGद ब्न्मा 6दङन्म?
এটা কি আপনার জেদ বা প্রেস্টিজ ইসু?
না একেবারেই তা নয়।
মেয়েটা যে রিঙ্কুই তা আপনার মনে হচ্ছে না কেন?
মনে হচ্ছে। আবার হচ্ছেও না।
বড্ড হেঁয়ালি করেন। আপনি। আমার তো মনে হচ্ছে ভজন আপনাকে ঘুষ দিয়েছে।
শবর হাসল, মনে রাখবেন ভজনবাবু গুল্ডা বদমাশদের হাতে মার খেয়েও তাদের চাদা দেননি। ঘুষ দেওয়ার লোক নন।
আমাকে কী করতে হবে?
জাস্ট মিট হিম।
মিট করে কথাটথা বলতে হবে তো!
তা হবে।
কী বলব। তখন?
যেমন মনে হয় বলবেন! প্ৰস্পট করার বা শিখে পড়ে যাওয়ার দরকার নেই।
আমি যে ওর ওপর ভীষণ রেগেও আছি।
তা থাকুন না। কী যায় আসে তাতে?
কোন লাইনে কথা বলতে হবে তা তো বুঝতে পারছি না।
নানা ধরনের কথা হতে পারে। বুদ্ধি খাটিয়ে বলবেন। বলার চেয়েও শোনাটা বেশি জরুরি।
ও আমাকে সব বলবে কেন?
উনি কারও সঙ্গেই কথা বলছেন না বিশেষ। আপনার সঙ্গেও না বলতে পারেন। তবে আমার একটা ধারণা, উনি আপনার ওপর টর্চার করেছেন বলেই একটু অপরাধবোধ থাকতে পারে।
নরপশুদের অনুতাপ থাকে না। রিঙ্কুকে মেরে কি ও অনুতপ্ত?
এ প্রশ্নের জবাব আমার কাছে নেই। আপনি লোকটাকে দেখে বুঝতে চেষ্টা করুন।
আমার কী দরকার?
দরকারটা তো আপনার নয়, আমার।
আপনি আমাকে বড্ড মুশকিলে ফেললেন। আচ্ছা, একটা শর্তে দেখা করব।
কী শর্ত?
আমি আপনার কথা মানছি, বদলে আমাকে সাক্ষী হওয়া থেকে রেহাই দেবেন।
শর্তটা বেশ কঠিন। আমি চেষ্টা করব।
আপনি কি জানেন যে আপনি খুব নাছোড়বান্দা লোক?
জানি। আমার কাজটাই আমাকে আনপপুলার করে তোলে।
আমি কিন্তু আপনাকে ডিজলাইক করিনি। বরং আপনি হেটো মেঠো পুলিশের মতো নন বলে ফ্রিলি কথাও বলেছি।
তার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
কবে যেতে হবে?
আজ এবং এখনই।
আমার যে ভয় করছে।
ভয় কী? লোকটা শোওয়ার ঘরে নরপশু হলেও এমনিতে এ সিক ম্যান।
তবু নার্ভাস লাগছে।
আমি কাছাকাছি থাকব।
গরাদের ভিতর দিয়ে দেখা হবে তো!
শবর হেসে বলল, আপনি চাইলে তাই হবে। তবে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে যদি চিন্তিত না হন তা হলে আমার ইচ্ছে আপনাদের দেখাটা হোক পুলিশ কাস্টডির বাইরে কোথাও।
সে কী। পুলিশ ওকে ছেড়ে দেবে?
আইনত ছাড়বে না। তবে আমার আন্ডারটেকিং-এ ছাড়বে। চলুন।
ঠিক আছে। সব রিস্ক কিন্তু আপনার।
নিশ্চয়ই।
আপনার খুব আত্মবিশ্বাস, তাই না?
না মিস ভট্টাচাৰ্য, আত্মবিশ্বাস নয়। শুধু লজিক্যাল।
ঠিক আছে চলুন। আমি পোশাকটা পালটে আসছি। গাড়ি আছে?
আছে। পুলিশের জিপ।
ওতেই হবে।
শবর যখন বিভাবরীকে নিয়ে বেরোল তখন বেলা দুটো। পথে বিভাবরী তেমন কথাটথা বলল না। শবর জিজ্ঞেস করল, স্টিল ফিলিং নার্ভাস?
হ্যাঁ।
ওর প্রতি আপনার ঘেন্নার ভাবটা এখনও আছে?
থাকবে না? আমি ভুলতে পারি না।
আপনাদের দেখা হবে।
আপনি খুব রিস্ক নিচ্ছেন। কিন্তু। থানাই ভাল ছিল। আমি সেফ ফিল করতাম।
আপনি সেফটি নিয়ে ভাববেন না। ইউ উইল বি সেফ।
বিভাবরী চুপ করে রইল।
৪. বড়লোকের বাগানবাড়ি
শবর যে বাড়িটায় নিয়ে এল বিভাবরীকে, তা যে বড়লোকের বাগানবাড়ি তা দেখলেই বোঝা যায়। চারদিকে অনেকটা জমিতে ভারী সুন্দর নিবিড় গাছপালা। সামনে ফুলের বাগান। এই বর্ষাকালের শেষেও বাগানে ফুলের অভাব নেই। বাংলো প্যাটার্নের চমৎকার বাড়ির সামনে একটা মনোরম বারান্দা। তারপর ঘর টর।
এটা কার বাড়ি শবরবাবু?
একজন বড়লোকের। কেউ থাকে না। ফাঁকা পড়ে থাকে। শুধু মালি আছে।
জিপটা একেবারে বারান্দার কাছ ঘেঁষে দাঁড়াল। শবর জিপ থেকে নেমে বলল, আসুন।
কেউ নেই তো এখানে দেখছি।
আসবে। কয়েক মিনিট অপেক্ষা করতে হবে।
ভিতরে ঢুকে বিভাবরী চারদিকে চেয়ে দেখল। বৈঠকখানাটা কী সুন্দর করে যে সাজানো! বেশি আসবাব নেই। কিন্তু, রুচির পরিচয় আছে।
এখানে নয়, ভিতরের ডাইনিং হল-এ।
বিভাবরী বলল, ঠিক আছে।
ডাইনিং হলটাও দারুণ সাজানো। গ্লাস টপ মস্ত খাবার টেবিল ঘিরে গদি আঁটা চেয়ার। ভারী নরম। এয়ার কন্ডিশনার চলছে বলে ভ্যাপিসা গরম থেকে এসে ভারী আরাম বোধ করল। বিভাবরী। চারদিক নিস্তব্ধ।
কী খাবেন? চা, কফি বা কোন্ড ড্রিঙ্ক?
জল খাব। আর কিছু নয়।
একজন পরিচ্ছন্ন পরিচারক ট্রে-তে একটা টাম্বলার। আর ঝকঝকে কাচের গেলাস এনে রাখল সামনে। বিভাবরী খানিকটা জল খেয়ে বুঝল তার তেষ্টাটা নাৰ্ভাসনেসের। বারবার তেষ্টা পাবে।
শবর তাকে বসিয়ে রেখে বেরিয়ে যাওয়ার আগে বলল, আমি বা আর কেউ আর আসব। না। ঘাবড়াবেন না। জাস্ট ফেস হিমা অ্যান্ড টকা।
বিভাবরী একটু হাসবার চেষ্টা করল, পারল না।
খাওয়ার ঘরের পিছন দিককার দেয়াল জুড়ে বিশাল চওড়া চওড়া জানালা দিয়ে পিছনের সবুজ বাগান আর গাছপালার দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। শুধুই সবুজ যেন ছেয়ে আছে চারদিক ঘরে বাইরের প্রাকৃতিক আলো আসছে। আজও একটু মেঘলা বলে ঘরের আলোটার তীব্ৰতা নেই।
বিভাবরী বারবার ঘড়ি দেখছে। এক একটা মিনিট যেন এক একটা যুগ বলে মনে হচ্ছে। বিভাবরী টোক গিলছে বারবার। একটু করে জল খাচ্ছে। ভাবছে লোকটাকে যে কী বলবে। মাথাটা এত তালগোল পাকিয়ে আছে যে, সে কথা বলতে পারবে কি না সেটাই সন্দেহের ব্যাপার হয়ে দাড়াচ্ছে।
ঠিক পাঁচ মিনিটের মাথায় বৈঠকখানার দিককার ফ্লাশ ডোর খুলে দু’জন পুলিশ ঢুকল। ঢুকে দরজার দু’দিকে দাঁড়িয়ে রইল। কয়েক সেকেন্ড বাদে ক্রাচে ভর দিয়ে যে লোকটা অতি কষ্টে ঘরে ঢুকাল তাকে দেখে চেনার উপায় নেই যে, এ লোকটা সেই ভজন আচাৰ্য। মাথায় ব্যান্ডেজ, হাতে ব্যান্ডেজ, গালে স্টিকিং প্লাস্টার, পায়ে প্লাস্টার, ঠোঁট দুটো নীল হয়ে ফুলে আছে, একটা চোখ ও ব্যান্ডেজে ঢাকা। এত অবাক হল বিভাবরী যে বলার নয়।
ভজন ঘরে ঢুকতেই পুলিশ দু’জন বাইরে বেরিয়ে গিয়ে দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিল।
ভজন দরজার কাছেই খানিকক্ষণ দাড়িয়ে রইল। হাফাচ্ছে। তার পর দুটো ক্ৰাচে ভর দিয়ে অতি কষ্টে এগিয়ে এল।
বিভাবরীর হয়তো উচিত ছিল উঠে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে ওকে বসতে সাহায্য করা। কিন্তু ভজনের অবস্থা দেখে এমনই ঘাবড়ে গেছে বিভাবরী যে, সে নড়তেও পারল না।
ভজন খুব শব্দ করে শ্বাস নিচ্ছে। হাঁফাচ্ছে। এগিয়ে এসে একটা চেয়ার টেনে বসবার চেষ্টা করতে গিয়ে অ্যালুমিনিয়ামের একটা ক্ৰচ পড়ে গেল ঠনঠন করে। সেটা কুড়িয়ে নেওয়ার জন্য নিচু হওয়ার ক্ষমতাও নেই লোকটার। ভারসাম্যহীন শরীরে কোনওরকমে চেয়ারের পিছনটা ধরে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করল সে। চেয়ার নিয়ে উলটেই পড়ে যেত, কিন্তু সেটা বুকে কোনওরকমে আটকাল। তারপর অতি কষ্টে চেয়ারে বসে কিছুক্ষণ মাথাটা নুইয়ে শুধু শ্বাস নিতে লাগল। বড় বড় শ্বাস। কথা বলার মতো অবস্থাই নয়। লোকটার যে এ দশা হয়েছে তা একবারও বলেনি। শবর। কে এই অবস্থা করল? পুলিশ?
কিছুক্ষণ স্তব্ধ বিস্ময়ে লোকটার দিকে চেয়ে রইল বিভাবরী। গত তেরো-চোঁদ দিন দাড়ি কামায়নি বলে মুখটা দাড়িতে ঢাকা। গোঁফ নেমে ওপরের ঠোঁট আড়াল করেছে।
বিভাবরী খুব ধীরে উঠে গিয়ে মেঝে থেকে ক্রাচটা তুলে অন্য ক্ৰাচটার পাশে টেবিলের গায়ে হেলিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখল। তারপর নিজের চেয়ারে ফিরে এসে বসে ক্ষীণ গলায় বলল, জল খাবে?
লোকটা মৃদু মাথা নেড়ে জানাল, খাবে না।
এ দশা করল কে? পুলিশ।
ভজন একবার তার ক্লান্ত মুখখানা তুলে বিভাবরীর দিকে তাকাল। হী করা মুখে এখনও শ্বাস নিচ্ছে প্রবলভাবে। ফের মাথাটা যেন ঝুলে পড়ল আপনা থেকেই। কথা বলার মতো অবস্থায় এখনও আসেনি।
বিভাবরীর হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছিল। এ লোকটাকে সে ঘেন্না করে এসেছে এতদিন, আজ বড্ড দুঃখ হচ্ছে। মানুষের এরকম দুৰ্দশা দেখলে কারই বা না হবে। শবর কি তাকে ইচ্ছে করেই এই ঘটনার কথা বলেনি?
প্রায় দশ মিনিট নিস্তব্ধ ঘরে ভজনের শ্বাসযন্ত্রের শব্দ হল। তারপর একটু কমে এল হঁহাফধরা ভাবটা। মাথা নিচু করেই বসে রইল। ভজন।।
একটু জল খাও এবার।
ভজন ফের মাথা নাড়ল, খাবে না।
এ দশা কে করেছে তোমার?
ভজন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ভাঙা গলায় বলল, সবাই।
সবাই বলতে?
ভজন ফের চুপ করে থেকে আরও মৃদু গলায় বলল, সবাই।
এরপর ভজনের শরীরটা হঠাৎ একটু কেঁপে কেঁপে উঠল। কাঁদছে নাকি? কান্নার মানুষ তো নয়। বিস্মিত বিভাবরী পলকহীন চেয়ে রইল।
কাঁপুনিটা কমে গেল। ভজন মুখ তুলল না।
তোমাকে কি পাবলিকও মেরেছে?
ভজন মাথা নেড়ে জানাল, হ্যাঁ।
পুলিশও?
ভজন মাথা নাড়া দিয়ে জানাল, হ্যাঁ।
রিঙ্কুকে কি তুমি খুন করেছ?
ভজন অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মাত্র। জবাব দিল না।
বললেন না?
কিছুক্ষণ ঝুম হয়ে থেকে ভজন ভাঙা ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, বলে কী লাভ?
লাভ নেই?
ভজন মাথা নেড়ে না জানাল। তারপর অনেকক্ষণ বাদে মাথা নিচু অবস্থাতেই বিড়বিড় করে আপনমনে বলল, কতবার তো বলেছি। কেউ বিশ্বাস করে না।
বিভাবরী কী বলবে ভেবে পেল না। অনেকক্ষণ বাদে সে বলল, রিঙ্কু তোমার কাছে সেই রাতে এসেছিল কেন? বিয়ের প্রস্তাব দিতে?
ভজনের রি-অ্যাকশন হচ্ছে অনেক দেরিতে হয়তো মাথায় বেশ জোরালো চোট পেয়েছে, রিফ্লেক্স কাজ করছে না। সময় নিচ্ছে। অনেকক্ষণ বাদে শুধু মাথা নেড়ে জানাল, না।
রিঙ্কু নয়?
না।
তা হলে কে?
ভজন একটা হিঙ্কার মতো শব্দ করল। টেবিলের ওপর মাথাটা নামিয়ে যেন একটু ঘুমিয়ে নিতে লাগল। এই অবস্থায় কেন যে লোকটাকে এতদূর টেনে আনল শবর, কেন যে তাকে বসােল ওর মুখোমুখি। বিভাবরী উঠে। ভজনের কাছে গিয়ে পিঠে হাত রেখে বলল, তোমার কি শরীর খুব খারাপ লাগছে?
ভজন একটু কেঁপে উঠল। তারপর ধীরে ধীরে মাথাটা তুলল। রক্তজবার মতো লাল ডানচোখটা দিয়ে বিভাবরীকে এক ঝলক দেখে নিয়ে বলল, না, ঠিক আছে।
একে কি ঠিক থাকা বলে?
ভজন চুপ করে কিছুক্ষণ বসে থেকে অতি মৃদু স্বরে বলল, আরও হবে। আরও কত হবে। এ তো কিছু নয়।
আর কী হবে তোমার?
ভজন ধীরে ধীরে চোখের জল আর লালায় মাখামাখি বীভৎস মুখটা তুলল। লাল চোখে চেয়ে সেই ভাঙা ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, এখনও মরিনি যে! মারবে না?
আমি জানতে চাই তুমি সত্যিই রেপ আর খুন করেছ কি না।
ভজন ইহাফধরা গলায় শুধু বলল, কী লাভ বলে? বিশ্বাস করবে না কেউ।
আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে চাইছি। সত্যি কথাটা বলে আমাকে।
ভজন মাথা নেড়ে শুধু না জানাল। তার পর কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে থেকে হঠাৎ ধীরে ধীরে মুখ তুলে বিভাবরীর দিকে চাইল। দু’খানা কম্পিত হাত তুলে করজোড় করে রইল কিছুক্ষণ। দুটো হাত থারথার করে কাঁপছে।
ওরকম করছ কেন?
ভজন কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না। দু’চোখ বেয়ে জল পড়ছে। প্ৰায় অশ্রুত গলায় বলল, ক্ষমা… ক্ষমা…
দু’খানা ক্রাচের দিকে কম্পিত হাত বাড়িয়ে দিল ভজন। উঠবে।
বিভাবরী গিয়ে ক্রাচ দু’খানা এগিয়ে দিল। প্রায় ছ’ফুটের মতো লম্বা শক্ত সমর্থ শরীরটার ওপর দিয়ে যেন ঝড় বয়ে গেছে। থারথার করে কপিছে শরীর। তিনবারের চেষ্টায় উঠল। ভজন। দুবগলে ক্রাচ।
বিভাবরী গিয়ে দরজা খুলে সেপাইদের ডাকল।
বেরিয়ে যাওয়ার সময় যেন ভজনের কষ্ট হচ্ছিল অনেক বেশি। দু’জন সেপাই না ধরলে শুধু ক্ৰাচে ভর করে বেরতে পারত না সে।
পিছন থেকে অপলক চোখে চেয়ে ছিল বিভাবরী। এরকমভাবে কেউ কাউকে মারে? মানুষ এত নৃশংস? চোখে জল আসছিল তার, আবার একই সঙ্গে রাগে আগুন হয়ে যাচ্ছিল মাথা।
ভজন বেরিয়ে যাওয়ার পর বিভাবরী তার শরীরের কাঁপুনি আর দুর্বলতা টের পেল। ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল সে। হাফ ধরে যাচ্ছে।
দেখা হল ম্যাডাম?
বিভাবরী চোখ তুলে চেয়ে শবরকে দেখে বলল, আপনাদের নামে মামলা করা উচিত।
শবর হাসল, করুন না।
পুলিশ কেন মারবে? মারা তো বে-আইনি।
অবশ্যই। কিন্তু ভজনবাবুর বেশির ভাগ চোট পাবলিকের উপহার, পুলিশের নয়।
তাদের কেন ধরা হল না?
ক’জনকে ধরা যাবে বলুন। গোটা লোকালিটিটাই তো ইনভলভড।
ছিঃ শবরবাবু।
শবর একটু হাসল আবার। বলল, পাবলিকের হয়ে আপনার ধিক্কারটা আমি ঘাড়ে নিচ্ছি। ম্যাডাম। সরি। এক্সট্রিমলি সরি।
আপনি আমাকে ওর এই অবস্থার কথা বলেননি কেন?
শোনার চেয়ে দেখা অনেক বেশি এফেকটিভ। চলুন, আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।
বিভাবরী উঠল। শরীর ও মনের একটা বিকলতা টের পাচ্ছে সে। পা দুটো ভারী। মাথাটা একটু একটু টলছে। জিপে বসে সে বলল, আপনার কি এখন কোনও জরুরি কাজ আছে?
না তো!
তা হলে আমি ওর গ্যারেজটা দেখতে চাই।
স্বচ্ছন্দে। কিন্তু দেখে কী করবেন?
এমনি। কৌতূহল।
ঠিক আছে ম্যাডাম। এনিথিং ইউ সে।
গ্যারেজটা একটু প্রত্যন্ত জায়গায়। ছাড়া ছাড়া বাড়িঘর, ফাঁকা জমি, ঝোপজঙ্গল, পুকুর।
বাঁ ধারে বাঁশের বেড়া দেওয়া বেশ বড় একটা জায়গা। ফটকের সামনে দু’জন সেপাই গাড়ির একখানা সিট পেতে বসে আছে। তাদের দেখে উঠে দাড়াল।
এটাই ভজনবাবুর গ্যারেজ।
ভিতরে ঢোকা যাবে?
কেন নয়?
শবরের ইশারায় সেপাইরা ফটকের তালা খুলে দিল। বিকল মোটর গাড়ি, নানা যন্ত্রাংশ, তেল কালি, হাইড্রলিক প্রেস পেরিয়ে শেষ প্ৰান্তে ভজনের ঘর। সেপাইরা দরজা খুলে দিয়ে সরে দাঁড়াল।
আসুন ম্যাডাম।
ঘরে একটা সরু চৌকিতে সাধারণ বিছানা পাতা রয়েছে। একাধারে চেয়ার-টেবিল। বইয়ের র্যাকে প্রচুর টেকনিক্যাল বই, কিছু পেপারব্যাক উপন্যাস, কিছু ম্যাগাজিন। বা ধারে মেঝের ওপর একটা বায়োগ্যাসের উনুন। কিছু বাসনপত্র।
বসুন ম্যাডাম।
বিভাবরী চেয়ারে বসল। তারপর ঘরটা ভাল করে দেখল। কিছুই দেখার মতো নয়। একজন পুরুষমানুষের ঘর।
শবর বলল, সম্ভবত আপনি যে চেয়ারে বসে আছেন সেই চেয়ারেই রিঙ্কু বসে ছিল সেই রাতে।
কী করে বুঝলেন?
প্রবাবিলিটির কথা বলছি।
কিন্তু মেয়েটা যে রিঙ্কুই তা কী করে বুঝলেন?
আপনার কী মনে হয়?
ও তো বলছে রিঙ্কু নয়।
তা হলে কে হতে পারে ম্যাডাম?
কী করে বলব? আপনি বলতে পারেন না?
শবর মৃদু একটু হাসল। বলল, রিঙ্কু হতেই পারে। রিঙ্কু তো ভজনবাবুকে ভালবাসত বলেই মনে হয়।
আপনি কিছু লুকোচ্ছেন।
শবর ফের হাসল, আপাতত কিছু লুকোনোই থাক।
আচ্ছা, ভজনের সঙ্গে আমার কী কথা হল তা তো আপনি জানতে চাইলেন না।
শবর মৃদু মৃদু হাসি হাসছিল। বলল, পরে জেনে নেওয়া যাবে।
তার মানে আপনার জানার কৌতূহল মিটে গেছে?
তা নয়। ভজনবাবু এখন খুব বেশি কথা বলার মতো মুডে নেই। সেটা জানি বলেই অনুমান করছি আপনাদের মধ্যে খুব বেশি কথা হয়নি। কিন্তু
কিন্তু কী?
আপনার অমত না থাকলে কয়েক দিন পর আপনি আর একবার ওঁর সঙ্গে মিট করুন।
করবেন?
করব।
থ্যাঙ্ক ইউ। হিনিডস এ সিমপ্যাথেটিক হিয়ারিং।
তার মানে?
ওঁর মনটা অদ্ভুত। জোর করলে বা ফোর্স অ্যাপ্লাই করলে উনি ভিতরকার কপাট বন্ধ করে দেন। কোনো কনফেশনই তখন আদায় করা যায় না। কিন্তু এই কেসটার জন্ট খুলতে হলে ওঁর মুখ খোলানো দরকার। আমরা যেটা পারছি না সেটা আপনি হয়তো পারতেও পারেন।
চেষ্টা করব।
কাইন্ড অফ ইউ।
এবার কি আমরা উঠিব?
হ্যাঁ ম্যাডাম। চলুন।
ফেরার সময় বিভাবরী তেমন কথা বলছিল না। খুব ভাবছিল। আজ সে বড্ড নাড়া খেয়েছে ভজনকে দেখে। লোকটাকে তার আর ঘেন্না হচ্ছে না, কিন্তু ঘেন্না হচ্ছে তাদের যারা ওকে ওরকমভাবে মেরেছে।
শবরবাবু।
বলুন।
আমার মনে হয় না ভজন। এ কাজ করেছে।
কী করে বুঝলেন?
যেভাবে আপনিও বুঝেছেন।
আমি কী বুঝেছি?
আপনিও বুঝেছেন বা অনুমান করেন যে ও খুন বা রেপ করেনি।
কী সর্বনাশ! এ যে গোয়েন্দার ওপর গোয়েন্দাগিরি।
আমি জানি।
৫. একটু কথা আছে
রতন তোমার সঙ্গে একটু কথা আছে।
বলুন স্যার।
মার্ডারের আগের রাতে তুমি শুনেছিলে ভজনবাবু একজন মহিলার সঙ্গে কথা বলছেন।
হ্যাঁ স্যার।
তুমি কি বলতে পারো দু’জনের মধ্যে কে কাকে আপনি করে বা তুমি করে বলছিল?
স্যার, পুলিশকে তো বলেছি।
ব্যাপারটা খুব ইস্পার্ট্যান্ট। ভাল করে ভেবে বলে।
এই রে! এত খুনখারাপি মারদাঙ্গায় মাথাটাই কেমন গুলিয়ে গেছে স্যার।
সেই জন্যেই বলছি ভাল করে ভেবে বলতে। অনেক সময়ে কিছুদিন কেটে যাওয়ার পর স্মৃতিটা পরিষ্কার হয়। যখন তুমি জবানবন্দি দিয়েছিলে তখন তুমি ঘাবড়ে যাওয়া অবস্থায় ছিলো।
ঠিক স্যার।
এবার শান্ত মাথায় ভেবে বলো।
দু’মিনিট সময় দেবেন। স্যার? চোখ বুজে একটু ভাবব।
দুই পাঁচ যত মিনিট খুশি সময় নাও। তবু আসল কথাটা বলো।
রতন দু’মিনিটের বেশি ভাবল না। চোখ খুলে এক গাল হেসে বলল, মনে পড়েছে স্যার। মেয়েটা বাবুকে তুমি করে বলছিল, বাবু আপনি করে বলছিল।
আরও ভেবে বলে।
না স্যার মনে পড়ে গেছে।
তুমি কিন্তু পুলিশের কাছে উলটোটাই বলেছিলো।
তা হতেই পারে স্যার। তখন যা অবস্থা। বাবুর ফাঁসি হলে তো চাকরিটাও গেল স্যার। বাবু লোকটা খারাপ ছিলেন না।
ফাঁসি নাও হতে পারে।
একটু উজ্জ্বল হয়ে রতন বলল, তবে কি বাবু ছাড়া পাবেন?
সেটা তোমার ওপরেও খানিকটা নির্ভর করছে।
কী বলতে হবে বলুন।
সেই রাতে তুমি গ্যারেজের কাছাকাছি কোনও গাড়ি বা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলে?
হ্যাঁ স্যার। সামনে নয় ঠিক, ওই পশ্চিম দিকে একটা অ্যাম্বাসাডার দাঁড় করানো ছিল। ডার্ক কালার।
আর কিছু?
না স্যার। গ্যারেজে এসেছে কিনা ভেবে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম, কী হে, গ্যারেজে এসেছ নাকি? লোকটা বলল, না, সওয়ারি আছে।
প্রাইভেট গাড়ি?
এ মার্কা গাড়ি স্যার, ওরা ভাড়া খাটে।
গাড়িটা কখন দেখলে?
ডিউটিতে আসার সময়। তারপর যখন বাবুর জন্য কোক নিয়ে এলাম তখন গাড়িটা চলে গেছে।
বাঃ, ভেরি গুড।
আর কিছু বলতে হবে স্যার?
তুমি কি জানো তোমার বাবুকে বারাসতে গ্যারেজ খুলতে কে সাহায্য করেছে?
সেটা ভাল জানি না। তবে শুনেছি বাবুর এক বন্ধু।
তার নাম জানো?
সুবীর টুবির হবে। অত মেমরি নেই স্যার।
সুজিত হতে পারে কি?
রাখাল জানে। ও পুরনো লোক।
রিঙ্কুকে কখনও মাতাল অবস্থায় দেখেছ?
না তো স্যার।
কখনও দেখোনি? ভাল করে ভেবে বলো।
না স্যার। রিঙ্কুর বন্ধুরা হয়তো খেত।
তারা কারা?
অনেক ছিল। ইদানীং
বলেই থেমে গেল। রতন।
থামলে কেন?
বলতে ভয় পচ্ছি স্যার। কথা ফাস হলে আমার জান চলে যাবে।
ফাস হবে না। বলে।
ইদানীং রিঙ্কু হাবু জগুদের সঙ্গে ঘুরত। ওরা খুব খচ্চর।
ওদের সঙ্গে মিশত কেন?
বলতে পারব না স্যার। তবে রিঙ্কু একদিন গ্যারেজে গাড়ির বনেটে বসে কুল খেতে খেতে বলেছিল, তোমাদের গ্যারেজে আর কেউ কখনও হামলা করবে না দেখো। আমি হাবু আর জগুকে হাত করেছি।
তুমি কী বললে?
আমি বললাম, খবরদার ওদের খপ্পরে যেয়ো না! তোমাকে শেষ করে দেবে।
রিঙ্কু কী বলল?
হাসল, পাত্তা দিল না। রিঙ্কু স্যার, কারও কথা শুনত না। বাবুর সঙ্গে বিয়েটা হলে বেঁচে যেত।
বিয়ে! বিয়ের কথা উঠেছিল নাকি?
না স্যার। আমার মনে হত, দু’জনকে যেন মানায়।
কেন মনে হত?
কী জানি কেন মনে হত।
রিঙ্কু কি ভজনবাবুকে ভালবাসত বলে তোমার মনে হয়?
হ্যাঁ স্যার, খুব মনে হয়। রিঙ্কু মাঝে মাঝে বাবুর জন্য খাবার নিয়ে আসত, বই আনত, আর বাবুর কাছে এলেই খুব হাসিখুশি থাকত।
আর ভজনবাবু?
বাবু তো স্যার, সবসময়ে কাজ নিয়ে ব্যস্ত। সবসময়েই নানা চিন্তা। বাবু রিঙ্কুকে মাঝে মাঝে বকুনিও দিত।
কীরকম?
বলত, আড্ডা মেরে সময় নষ্ট করছ, কেন, পড়াশুনো করোগে যাও। কিংবা বলত, এত উড়নচণ্ডী হলে জীবনে কষ্ট পাবে। এইসব আর কী।
ভজনবাবুর কাছে আর কোনও মেয়ে আসত কি?
গাড়ি সারাতে অনেকে আসত।
তারা ছাড়া?
না। স্যার, বাবুর মেয়েছেলের দোষ তেমন ছিল না।
তোমার বাবুকি ঘন ঘন ট্যুরে যেত?
মাঝে মাঝে যেত স্যার।
ঠিক আছে।
কত বছর বয়সে আপনার বিয়ে হয় শ্যামলীদেবী?
কেন বলুন তো! এসবও কি তদন্তে দরকার হচ্ছে নাকি?
কে জানে কখন কোনটার দরকার পড়ে। বলতে না চাইলে অবশ্য—
আমার বিয়ে হয়। ষোলো বছর বয়সে।
এত কম বয়সে? দেখতে সুন্দর ছিলাম বলে আমার শ্বশুর-শাশুড়ি খুব পছন্দ করে ফেলেছিলেন। পাছে হাতছাড়া হয়ে যায়। তাই তাড়াহুড়ো করে বিয়ে হয়ে গেল। আর ওইটেই আমার জীবনের সর্বনাশের মূল।
সর্বনাশ কেন?
ষোলোতে বিয়ে, সতেরোয় মেয়ের মা, এই সুন্দর বয়সটা টেরই পেলাম না। কী বিচ্ছিরি ব্যাপার বলুন তো! সাধে কি এদের ওপর এত রাগ আমার!
সুজিতবাবুর সঙ্গে আপনার চেনা কত দিনের?
প্ৰায় জন্ম থেকে। ও আমার চেয়ে এক বছরের বড়। আমরা পাশাপাশি বাড়িতে থাকতাম।
আপনি কবে ওর প্ৰেমে পড়েন?
এসব জেনে কী হবে আপনার?
প্লীজ
আপনার কথাবার্তা পুলিশের মতো নয়, আর আপনি বেশ বুদ্ধিমান বলে মনে হয়। সেজন্য বোধহয় আপনি একজন বিপজ্জনক লোক। তবু আমি আপনাকে খুব একটা অপছন্দ করছি না। তাই বলছি, আমাদের শৈশব প্ৰেম।
আপনি সুজিতকে কখনও প্রেমের কথা জানিয়েছেন?
জানানোর কী? আমরা দু’জনে দু’জনকে ভালবেসেই বড় হয়েছি।
বিয়ের সময় কী রি-অ্যাকশন হল সুজিতবাবুর?
কী আর হবে? ও তো তখন সতেরো বছরের বাচ্চা ছেলে। সবে কলেজে ঢুকেছে। ওর পক্ষে কি আমাকে বিয়ে করা সম্ভব ছিল?
আপনি?
আমি! আমি কেঁদে বিছানা ভাসিয়েছি। কিন্তু রুখে দাড়ানোর মতো মন তখনও তৈরি হয়নি।
আপনি কি ভজনবাবুকে চেনেন?
শ্যামলী হঠাৎ স্থির চোখে চেয়ে বলল, হঠাৎ এ কথা কেন?
বলতে আপত্তি আছে কি?
ওকে কি আমার চেনার কথা?
বলা তো যায় না।
আমি আট বছর আগে চলে গেছি, ও তখন এখানে আসেনি।
সেটা জানি। যে জমিতে ভজনবাবুর গ্যারেজ তার মালিক ছিলেন সুজিতবাবুর কাকা বরুণ গুণ।
তা হতে পারে।
খবর হল, সুজিতবাবুই ভজন আচাৰ্যকে জমিটা কিনতে সাহায্য করেন।
আমি অত জানি না।
সুজিতবাবু ও ভজনবাবুর মধ্যে পুরনো বন্ধুত্ব ছিল।
আমি সেসবের খবর রাখি না।
ভজনবাবু কানপুরে আপনাদের বাড়িতে বেশ কয়েকবার গেছেন।
শ্যামলী স্তব্ধ হয়ে রইল কিছুক্ষণ।
কিছু বলবেন না?
শ্যামলী একটুও না ঘাবড়ে তার দিকে সপাটে চেয়ে বলল, যদি তাই হয় তাতেই বা কী হল?
কী থেকে যে কী হয় কে বলতে পারে?
ভজনকে আমি চিনতাম। এবার কি ফাঁসি দেবেন আমাকে?
না। ফাঁসির দড়ি ভজনবাবুর জন্যই থাক। আপনি তো ওকে নিজের হাতে খুন করতে চেয়েছিলেন।
এখনও চাই।
যদি ভজনবাবু নির্দোষ বলে প্রমাণিত হন?
তবুও–
বলেই থমকে গেল শ্যামলী। সুর পালটে বলল, তা হলে অন্য কথা। কিন্তু ও ছাড়া আর কেউ কালপ্রিট নয়।
ঠিক জানেন?
জানি।
খুনের রাতে আপনি কোথায় ছিলেন?
তার মানে?
কৌতূহল।
শ্যামলী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কলকাতায়। তিলজলায় আমাদের একটা ফ্ল্যাট আছে।
রিঙ্কুর মৃত্যুর খবর কখন কীভাবে পেলেন?
প্ৰথমে খবরের কাগজে। তারপর টেলিগ্রাম পেয়ে কানপুর থেকে সুজিতও টেলিফোন করে।
আপনি তবু দু’দিন পরে বারাসতে এলেন কেন? মেয়ের মৃত্যুর সংবাদ পেয়েও কি মা দেরি করতে পারে?
পারে, যদি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায় এবং অসুস্থ হয়ে পড়ে।
কোয়াইট পসিবল। এবং খুব সম্ভব। আপনি যে কলকাতায় আছেন তা শচীনবাবুকে জানাতে চাননি। আপনি ডিভোর্সি স্বামীর বাড়িতে উঠলেন কেন?
তাতে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়েছে?
তা নয়, তবু প্রোটোকলে আটকায় হয়তো।
বারাসতে আমার ওঠার জায়গা নেই। বাপের বাড়ি বা সুজিতের বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক নেই। তা ছাড়া এ বাড়িটা বিরাট বড়, নীচের তলার এই পোরশনটা আমার জন্য আলাদা করে করা হয়েছিল, বাড়ির অশান্তি এড়ানোর জন্য।
বুঝেছি। একটা কথা আপনাকে জানানো দরকার।
কী বলুন তো!
রিঙ্কুর পেটে অ্যালকোহল পাওয়া গেছে।
কে বলল?
পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট। একটু ডিলেইড রিপোর্ট।
তার মানে কী? কেউ ওকে মদ খাইয়ে রেপ করেছিল?
সেরকমই অনুমান।
ও।
ভজনবাবু মদ খান না।
ওতে কিছু প্ৰমাণিত হয় না।
ভজনবাবুর ফাঁসিটা দেখছি একটা পপুলার ডিমান্ড হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
কোন শালা রে? কোন শুয়োরের বাচ্চা?
পুলিশ। দরজা খোলো।
ফোট শালা পুলিশ। ফোট বাঞ্চোৎ, খানকির ছেলে।
সঙ্গে মদন নামে যে সেপাইটা ছিল সে চাপা গলায় বলল, স্যার, এ ডেনজারাস ছেলে। মদ খেলে কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। ফোর্স না নিয়ে আসা ঠিক হয়নি। চলুন, ফোর্স নিয়ে আসি।
না। মদন। গন্ধ পেলে পাখি উড়ে যাবে।
ঘর থেকে জঘন্য খিস্তি ভেসে আসছিল।
শবর কাঠের দরজাটায় একটা লাথি মারল। তাতে বোম ফাটার মতো একটা আওয়াজ করে দরজার তলার দিককার প্যানেলটা কিছু অংশ ফেটে গেল।
বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। অন্ধকার রাত। শব্দ শুনে আশপাশের বাড়ি থেকে ‘কে কে’ আওয়াজ উঠল। দু-একটা দরজা খুলে টর্চ মারল কেউ কেউ।
স্যার, এ পাড়া কিন্তু খারাপ। অ্যান্টিসোশ্যালদের ডেন। সবাই ঘিরে ফেললে বিপদ
হবে।
শবর নিম্পূহ গলায় বলল, কিছু হবে না। ভয় পেয়ো না। এই সাহস নিয়ে পুলিশে চাকরি করো কী করে?
ভিতরের খিস্তি বন্ধ হয়েছে। এবার দরজার কাছ থেকে একটা মেয়ে গলা প্রশ্ন করল, কে?
দরজাটা খুলুন।
কেন খুলব?
তা হলে সরে দাড়ান। দরজা ভাঙা হবে।
হাবু বাড়ি নেই।
শবরের দ্বিতীয় লাথিতে দরজার খিল আর ছিটিকিনি উড়ে গেল। দরজাটা পটাৎ করে। খুলে হাঁ হতেই টর্চ হাতে ভিতরে ঢুকল শবর।
সামনেই একটা মেয়ে। বয়স বেশি নয়, উনিশ-কুড়ি।
তুমি কে?
আমি শেফালি, হাবুর বোন। দাদা বাড়ি নেই।
পথ ছাড়ো।
শবর তড়িৎ পায়ে দু’খানা ঘর ডিঙিয়ে উঠোনে নামল। উঠোনের পিছনে খোলা জমি। শবর মুখ ফিরিয়ে মদনকে বলল, ঘরটা সার্চ করো। ও পালিয়েছে, কিন্তু সাবধানের মার নেই।
ঠিক আছে স্যার।
শবর তার হোমওয়ার্ক করেই এসেছে। হাবুর সবরকম ঠেক তারা জানা। জমিটা পেরিয়ে সে ডান দিকের একটা কাঁচা রাস্তায় উঠে এল। রাস্তা পেরিয়ে রেললাইন। লাইন পার হয়ে সে একটা নাবালে নেমে স্বাভাবিক পদক্ষেপে হঁটিতে লাগল।
পাঁচু হালদারের বাড়িটা একতলা। সামনে ঘাসজমি আছে। সেটা পেরিয়ে দরজার সামনে দাঁড়াল শবর।
পাঁচু এবার পার্টির নমিনেশন পেয়েছে। ভোটে দাড়াবে। ক্ষমতাশালী লোক।
ভিতরে পাঁচুর গলা পাওয়া যাচ্ছিল, তা তুই এখানে এলি কেন?
কোথায় যাব?
বৃন্দাবনের কাছে চলে যা পিছন দিয়ে। পালা।
অত হুড়ো দিচ্ছেন কেন? যাচ্ছি। পুলিশ কি আর আপনার বাড়িতে আসবে?
যত্ত সব ঝামেলা। এখন গিয়ে গা-ঢাকা দে, কাল সকালে দেখা যাবে।
ফালতু আমার ওপর হামলা করছে পাঁচুদা।
এখন যা। কাল সকালে দেখব। যা।
একটা দরজা খোলার শব্দ হল পিছন দিকে।
পিছনে আধা জংলা পতিত জমি। কয়েকটা বড় গাছ। বৃষ্টি পড়ছিল। হাবু ছুটছিল প্ৰাণপণে। মাটি পিছিল, বিপজ্জনক, পেটে মদের গ্যাঁজলা, ঠিক ব্যালান্স নেই শরীরের।
পিছন থেকে ছায়ামূর্তিটা কখন এগিয়ে এল সে বুঝতেই পারেনি। একটা মজবুত হাত তার কাঁধের কাছে জামাটা চেপে ধরল। তারপর একটা প্ৰবল ঝাঁকুনি। আপনা থেকেই প্যান্টের পকেটে হাত চলে গিয়েছিল হাবুর। রিভলভারটা ধরেও ফেলেছিল। কিন্তু বের করতে পারল না। তার আগেই একটা বিদ্যুৎগতির ঘুসি তাকে শুইয়ে দিল।
মিনিট দশেক পরে দু’জনে বৃষ্টির মধ্যেই মুখোমুখি বসা। মাটির ওপরেই। জলকাদা থিকথিক করছে। ভিজে কুম্পুস হয়ে যাচ্ছে দু’জন।
শবর শান্ত গলায় বলল, বল।
কী বলব? ও আমাদের কাছে আসত। বন্ধুত্ব করতে চাইত। আমরা কী করব?
বন্ধুত্ব করতে চাইত কেন?
ও চাইত যাতে আমরা ভজন আচাৰ্যর পিছনে না লাগি।
ওর ইন্টারেস্ট কী?
কী আবার। মহব্বত।
বুঝেছি। বলো।
ঘুরেফিরে আসছিল। বারবার আসত।
টাকা পয়সা দিত?
না।
তোমরা ওকে কিডন্যাপ করে বাপের কাছ থেকে টাকা আদায়ের কথা ভেবেছিলে?
না। ওটা আমাদের লাইন নয়।
বলো।
আমার ওকে ভাল লাগত। ওকে চাইতাম। পুরুষচাটা মেয়েছেলে তো।
বুঝেছি। আগে বাঢ়ো।
মদ খেলে আমার কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। সেই দিন বিকেলে ও গ্যারেজের কাছে আমাকে থাকতে বলেছিল।
কেন?
সেদিন ওর পাঁচুদার কাছে যাওয়ার কথা ছিল।
সেটাই বা কেন?
গ্যারেজ নিয়ে লোকালিটিতে ঝামেলা হচ্ছে তার একটা মিটমাটের জন্য।
সেটা কি ভজনবাবু জানতেন?
বোধহয় না। ভজনবাবু ত্যাঁদোড় লোক, অন্যের সাহায্য নেবে না। মেয়েটাকে পাত্তা দিত না, কিন্তু মেয়েটা ওর জন্য পাগল ছিল।
আগে বাঢ়ো।
আমি স্কুটার নিয়ে বিকেল পাঁচটা নাগাদ ওখানে ছিলাম। রিঙ্কু সাইকেলে এসে গ্যারেজে সাইকেলটা ঢুকিয়ে দিয়ে আমার স্কুটারে ওঠে।
কেউ তোমাদের দেখেনি?
বোধহয় না। গ্যারেজ ছাড়িয়ে পশ্চিম দিকে বাঁয়ে একটা জংলা জমি দেখেছেন তো। ওটা দিয়ে শর্টকাট হয়।
রিঙ্কুকে মদ খাওয়াল কে?
ও নিজেই খেতে চাইল। আমার কাছে ছিল একটা বোতল।
ও খেত নাকি মাঝে মাঝে?
হ্যাঁ। ইদানীং খেত।
কোথায় খেলে?
ওই জঙ্গলে বসে।
পাচুবাবুর বাড়িতে যাওনি?
পাঁচুদা সেদিন ছিলেন না। কলকাতায় গিয়েছিলেন।
সেটা রিঙ্কু জানত?
না। আমি ওকে খুব চাইছিলাম।
কোথায় নিয়ে গিয়েছিলে?
ওখানেই–
রিঙ্কু বাধা দেয়নি?
হ্যাঁ। খুব চেঁচিয়ে ছিল, খিমচে দিয়েছিল। কিন্তু তখন আমি পাগল।
কখন মারলে?
প্রথমে মারিনি। ওখানে বসে বসে ঘণ্টা দুই-তিন দু’জনে ড্রিঙ্ক করি। অনেক কথা হয়।
প্রেমের কথা?
ওইরকমই সব। ও আমাকে বলছিল যে ও ভজনবাবুকে ভালবাসে, তাই কিছু করার নেই। তবে আমার কথা ওর মনে থাকবে–এইসব।
আগে বাঢ়ো। কখন রেপ করেছিলে?
রাত ন’টা সাড়ে ন’টা হবে। যখন চেঁচাল তখন মুখ চাপা দিতে হয়েছিল।
আগে বাঢ়ো।
ও বলেছিল সবকিছু বলে দেবে সবাইকে। আমি ওকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু তখন শালা আমিও তো মাতাল। কী কথায় কী কথা হল মাথায় কীরকম রক্ত চড়ে গেল।
গলা টিপে?
তাই হবে মনে হয়। কী করেছি। খেয়াল নেই। ওখানে বসে আরও মদ খেলাম। রাত একটা নাগাদ বৃষ্টি নামল। তখন নিয়ে গিয়ে মাঠটায় ফেললাম।
লাশটা সরালে কেন?
মনে হয়েছিল ওখানে পুলিশের কুকুর আমার গন্ধ পাবে। মদের বোতলটাও অন্ধকারে কোথায় ছুড়ে ফেলেছিলাম। মনে হল, বোতল পেলে সর্বনাশ।
পুলিশের কাছে কনফেস করবে?
না করলে?
শোনো হাবু, কনফেস করলে তোমার সাজা হবে। যদি বাইচান্স তুমি ছাড়া পেয়ে যাও তা হলেও আমার হাত থেকে বাঁচবে না। আর কনফেস যদি না করো তা হলেও বাঁচবে না। আমি তোমাকে মারবই।
যদি সাজা হয়?
তা হলে আমার কিছু আর করার থাকবে না।
আমাকে রাতটা ভাবতে দিন।
শবর হাসল, পালাবে না পাঁচুবাবুর বাড়ি যাবে? যা-ই করো, আমার হাত থেকে রেহাই নেই। শুনে রাখো, আমার চেয়ে বড় গুন্ড এখনও জন্মায়নি। থানায় চলো।
এখনই।
হ্যাঁ। পাঁচুবাবু যদি তোমাকে ছাড়ানোর জন্য কাল সকালে থানায় আসে তা হলে তাকে বোলো, আমার হাতে র্তার নির্ঘাত মৃত্যু। কেউ ঠেকাতে পারবে না।
উনি আপনার কথা শুনে ভয় পাচ্ছিলেন।
খুব ভাল। চলো।
সময় দেবেন না একটু?
না। যা বললাম মনে রেখো।
৬. অন্যরকম দেখাচ্ছে
আপনাকে একটু অন্যরকম দেখাচ্ছে। কেন বলুন তো?
কীরকম?
স্যাড অ্যান্ড ক্রেস্টফলেন। মনে হচ্ছে কান্নাকাটিও করেছেন।
আপনি আমার এত বড় ক্ষতিটা কেন করলেন শবরবাবু?
ক্ষতি। সে কী! আমি কী করলাম?
মানুষটাকে ভুলেই গিয়েছিলাম। দিব্যি ছিলাম। কেন আপনি আমাকে ওর কাছে নিয়ে গেলেন?
ম্যাডাম, রুটিন ওয়ার্ক ছাড়া তো কিছু নয়।
ক’দিন ধরে আমি রাতে ঘুমোতে পারছি না, সবসময়ে কেমন অস্থির অস্থির লাগছে।
কেন?
ওরকম মারা-খাওয়া চেহারা, ওরকম ভেঙে-পড়া, আর হাতজোড় করে ওই ক্ষমা চাওয়া–কী করে ভুলি! কতবার ইচ্ছে হয়েছে একাই গিয়ে দেখা করি, পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করি, কিংবা কী যে সব মাথামুণ্ডু ভেবেছি।
এবং কেঁদেছেন!
হ্যাঁ।
কান্নার কী আছে?
বেশ করেছি। কেঁদেছি যে কেউ কাঁদবে।
শবর হাসল, আর কী হল বলুন। কোনও সিদ্ধান্তে এলেন?
কী সিদ্ধান্তে আসব? আপনাদের মামলা কতদূর?
শেষের দিকে।
তার মানে কী। চার্জশিট দেওয়া হয়ে গেছে?
চার্জশিট তৈরি হচ্ছে।
তা হলে ওর রেহাই নেই।
না। উনি রেহাই পেলেই বা আপনার কী?
তা ঠিক। কিন্তু–
কিন্তু কী?
আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।
তা তো হতেই পারে। কিন্তু তা বলে তো একজন ক্রিমিন্যালকে ক্ষমা করা যায় না।
ক্ষমা না হয় না-ই করলেন। অপরাধ করে থাকলে শাস্তি হোক। কিন্তু ওরকমভাবে মারে কেউ?
মানছি মারটা একটু বেশি হয়ে গেছে। অন্য কেউ হলে হয়তো মরেই যেত। ভজন আচাৰ্য খুব শক্ত ধাতুতে গড়া। হান্ড্রেড পারসন।
স্বাস্থ্য ভাল বলে বলছেন?
না। স্বাস্থ্যের চেয়েও মজবুত ওর মন। এ কারেজিয়াস ম্যান।
কী লাভ আর তাতে?
লাভ নেই। অবশ্য।
কী পানিশমেন্ট হবে ওর বলুন তো! ফাঁসি?
যাবজ্জীবনও হতে পারে।
যাবজ্জীবন তো চৌদ্দো বছর, তাই না?
হ্যাঁ। তবে ভাল বিহেভ করলে মেয়াদ কিছু কমে যায়।
কত কমবে?
চার-পাঁচ বছরও হতে পারে।
তাও তো দশ বছর। কম কী?
হ্যাঁ। জীবনের সবচেয়ে প্রসপারাস সময়টায় দশ বছর আটক থাকাটা দুঃখজনক।
ওর দোষ কি সন্দেহাতীতভাবে প্ৰমাণ হয়েছে?
কিছু ফাঁক তো থাকবেই। তবে প্রমাণ হয়ে যাবে।
আমি ঠিক করেছি, আপনারা আমাকে সাক্ষী হিসেবে ডাকলে আমি ওর বিরুদ্ধে কোনও কথা বলব না।
সে কী ম্যাডাম! আপনি যে ইম্পট্যান্ট উইটনেস।
সেজন্যই আমি উলটো কথা বলব।
কী মুশকিল। আপনার সঙ্গে ওঁর মিট করানোটাই যে ভুল হল।
মিট করালেন কেন? আমার যে কী সর্বনাশ করলেন।
লোকটাকে কি ক্রিমিনাল মনে হয়নি। আপনার?
তা বলছি না।
তা হলে কী বলছেন ম্যাডাম?
কী বলছি তা আমিও জানি না। সেই মেয়েটা কি রিঙ্কু?
কোন মেয়েটা?
রতন যার কথা শুনতে পেয়েছিল ওর ঘরে।
ডাউটফুল।
তা হলে একটা লুপ হোল তো আছে।
তা আছে। আমি জিপ নিয়ে এসেছি। আজ যাবেন?
হঠাৎ মুখখানা উজ্জ্বল হল বিভাবরীর। বলল, হ্যাঁ। আমাকে দু’মিনিট সময় দিন।
দু’মিনিট মাত্র! অত তাড়া নেই। মেয়েদের সাজতে একটু সময় লাগে জানি। টেক ইয়োর টাইম, আমি বসছি।
সাজব! সাজব কেন? জাস্ট পোশাকটা পালটে আসছি।
দু’মিনিটই লাগল। মুখে পাউডারটুকুও না ছুইয়ে বেরিয়ে এল বিভাবরী, চলুন।
জিপে শবর বলল, আপনার ভিসিবল চেঞ্জ হয়েছে।
হয়েছে, আমিও তা জানি।
দ্যাটস গুড।
ও এখন কেমন আছে?
বেটার। মাচ বেটার।
ওর যদি যাবজজীবন হয় তা হলে গ্যারেজীটার কী হবে?
আপনাদের যখন ডিভোর্স হয়নি তখন ওই গ্যারেজের ওপর আপনারও অধিকার আছে।
যাঃ।
আইন তো তাই বলে।
আমি গ্যারেজ নিয়ে কী করব? গাড়ির কিছুই জানি না।
তা হলে বেচে দিতে পারেন। অনেক খিদের আছে। ভাল দামও পাবেন।
পাগল! ও অত সাধ করে গ্যারেজ করেছিল, বেচব কেন?
সেও ঠিক কথা। তা হলে বেচবেন না।
ও কি আমার কথা কিছু বলেছে?
হ্যাঁ।
কী বলেছে?
আপনাকে এই নোংরা মোকদ্দমায় টেনে আনার জন্য ভজনবাবু আমাদের ওপর একটু অসন্তুষ্ট।
ও।
উনি হয়তো আপনাকে এখনও ভালবাসেন।
কী যে বলেন!
ভুলও বলে থাকতে পারি। আমি তো শুখা মানুষ।
আমি ভাবছি ও রিঙ্কুকে রিফিউজ করল কেন। আর রিফিউজ করে রেপই বা করবে কেন, খুনই বা করবে কেন?
আপনিই বলুন।
আপনারা ভাল করে তদন্ত করেননি।
আপনার ইন্সটিংক্ট কী বলে?
বলে এটা অসম্ভব ব্যাপার।
আজ উনি অনেকটাই সুস্থ। ওঁকে জিজ্ঞেস করে দেখবেন।
আমার কাছে বলবে কেন?
কেন তার কোনও কারণ নেই। হয়তো বলবেন।
আমি কিন্তু আদালতে কিছু বলব না ওর বিরুদ্ধে।
মুশকিল।
কিছুতেই বলব না।
তা হলে তো সাক্ষী হিসেবে আপনাকে বাদ দিতে হয়।
তা কেন দেবেন? আমারও তো বক্তব্য আছে।
আপনি যে মামলা কাঁচিয়ে দেবেন।
দেবই তো।
মিস ভট্টাচাৰ্য, আপনি কি ভজনবাবুর প্রতি সফট হয়ে পড়ছেন?
আমি সিমপ্যাথেটিক। ওকে আমার ক্রিমিন্যাল মনে হচ্ছে না।
লজিকটা কী?
ওই তো বললাম, যে ওকে বিয়ে করতে চায় তাকে ও হঠাৎ রেপ করতে যাবে কেন?
গুড লজিক। কিন্তু এমন তো হতে পারে সেই রাতের মেয়েটা রিঙ্কু ছিল না।
হতে পারে। আপনারা ঠিকমতো তদন্ত করলেন না যে!
শবর একটু হাসল।
ভজন ধীরে ধীরে তার স্নান, করুণ, ব্যথাতুর মুখখানা তুলল।
কষ্ট পেয়ো না। আমার বুদ্ধির দোষ।
তোমার দোষ? নাকি পুলিশ মিথ্যে করে সাজিয়েছে?
মিথ্যেটা তো সত্যি হয়নি।
তার মানে?
পুলিশ খুনিকে ধরেছে।
কী বলছ?
হাবু বলে ছেলেটা।
কই, আমাকে শবরবাবু কিছু বলেননি তো!
ভজন একটু হাসল, সারপ্রাইজ দিতে ভালবাসেন বোধহয়।
ভজনের দুটো হাত শক্ত করে চেপে ধরে বাঁকুনি দিয়ে বিভাবরী উত্তেজিত গলায় বলল, সত্যি বলছি? সত্যি বলছ?
হ্যাঁ, হ্যাঁ।
হঠাৎ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল বিভাবরী। টেবিলে উপুড় হয়ে পড়ে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল।
একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে রইল ভজন। কী করবে বুঝতে পারল না।
ছায়ার মতো নিঃশব্দে ঘরে ঢুকল শবর।
ম্যাডাম, দি ড্রামা ইজ ওভার।
চোখের জলে মাখামাখি মুখ তুলে তীব্র দৃষ্টি হেনে বিভাবরী বলল, আপনি কেন বলেননি। আমাকে?
আপনি একজন অ্যান্টিরোমান্টিক লোককে বিয়ে করেছেন দেখছি। এই সময়ে এর তো কিছু রোমান্টিক অ্যাডভানসেস করার সুযোগ ছিল। কিন্তু দেখুন কেমন পাথরের মতো বসে আছেন।
বিভাবরী বেঁঝে উঠে বলল, এরকমই ভাল।
ভজনবাবুরিলিজ হয়ে গেছেন। এবার চলুন মিস ভট্টাচাৰ্য।
থাক আর ইয়ারকি করতে হবে না।
কীসের ইয়ারকি?
আপনি আমাকে এখন থেকে মিসেস আচাৰ্য বলে ডাকতে পারেন।