- বইয়ের নামঃ মারীচ
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. আপনি তো বাহাদুর লোক দেখছি
আপনি তো বাহাদুর লোক দেখছি।
কেমন করে দেখলেন?
আপনার বায়োডাটা বলছে আপনি এক সময়ে বোম্বের ফিমে কিছুদিন স্টান্টম্যানের কাজ করেছিলেন।
ওটা বাহাদুরির ব্যাপার নয়। পেটের দায়।
কী ধরনের স্টান্টম্যান ছিলেন আপনি?
মোটরবাইক আর কিছু লাফ ঝাঁপ। টাকার জন্য করতে হত, তবে টাকাও তেমন কিছু রোজগার করতে পারিনি। কিন্তু আমার তো বায়োডাটা নেই। ছিল না, আপনি পেলেন কী করে?
বায়োডাটাটি তৈরি করেছে পুলিশ। বিস্তর খোঁজখবর করে।
তার কি কোনও প্রয়োজন ছিল? আই অ্যাম নট এ ক্রিমিন্যাল।
ক্রিমিন্যাল কিনা সেটা তদন্তের পর বোঝা যাবে। আপনি বোম্বে থেকে পাড়ি দিয়েছিলেন আমেরিকা। এবং সেটা বোধহয় আইনকে ফাঁকি দিয়েই।
না। আইনকে ফাঁকি দিয়ে নয়। আমি বোম্বেতে থাকার সময় একটা জাহাজের চাকরি পেয়ে যাই। খালাসির কাজ। সেটা আইনসম্মতই ছিল।
কিন্তু আমেরিকার নিউ ইয়র্কে যখন জাহাজটা প্রায় বছরখানেক পরে ভিড়েছিল তখন বোধহয় খুব আইনসম্মত পদ্ধতিতে আপনি জাহাজ থেকে পালাননি।
সেটা বৈধ ছিল না বটে। তাই ওয়াজ এ ডেজার্টার। আমার বহুঁকালের ইচ্ছে ছিল আমেরিকায় গিয়ে সেক্স করব।
আপনি আমেরিকায় বেশ কিছুদিন বড় বড় ট্রাক চালাতেন। তাই না?
হ্যাঁ, আমেরিকায় গিয়ে কিছুদিন গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে হয়েছিল। তখন খুব কষ্ট গেছে। নানারকম উঞ্ছবৃত্তি করতে হয়েছিল। শেষে একটা গ্যারাজে জুটে গিয়েছিলাম হেলপার হিসেবে। সেখানেই ওইসব সুপার ট্রাক চালানো শিখে যাই।
অ্যামনেস্টির সুবাদে আপনি মার্কিন নাগরিকত্বও পেয়ে গিয়েছিলেন, তাই না?
হ্যাঁ। আমার জীবন খুব বিচিত্র।
তাই দেখছি। আমেরিকায় আপনার ক্রিমিন্যাল রেকর্ড ছিল কি?
না।
ঠিক বলছেন?
হ্যাঁ।
সুব্রত বকশি আমাদের জানিয়েছেন আপনি সেখানে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলেন। এবং আপনার বিরুদ্ধে মার্ডার চার্জ ছিল।
চার্জ ছিল ঠিকই, কিন্তু সেটা স্রেফ আমাকে প্যাঁচে ফেলা ছাড়া কিছু নয়।
যে মেয়েটি খুন হয়েছিল তার নাম কি জুলি?
হ্যাঁ, জুলিয়া।
আপনার স্ত্রী না গার্লফ্রেন্ড?
স্ত্রী নয়, আমি বিয়ে করিনি।
তা হলে গার্লফ্রেন্ড?
বলতে পারেন। তাকে খুন করেছিল একটা একস্ট্রিমিস্ট গ্রুপ। জুলি এক সময়ে ওই গ্রুপের একজন মেম্বার ছিল। তখন বোধহয় টাকাপয়সা নিয়ে কোনও প্রবলেম হয়েছিল।
যাকগে, আমি ওই পয়েন্টে স্টিক করতে চাইছি না।
ধন্যবাদ।
আপনি বছরখানেক আগে দেশে ফিরে এসেছেন। তাই তো?
হ্যাঁ, এক বছর এক মাস।
কেন বলুন তো? আপনার তো ওখানেই সেক্স করার ইচ্ছে ছিল। এখনও আপনার মার্কিন নাগরিকত্ব বহাল রয়েছে।
সত্যি কথা বললে বলতে হয়, আমেরিকার মোহ আর আমার নেই।
বাঃ, চমৎকার। কিন্তু মোহটা হঠাৎ কেটে গেল কেন?
শুধু টাকা রোজগার করাটা কারও জীবনের লক্ষ হতে পারে না, হওয়া উচিত নয়।
আপনি কি একজন দার্শনিক?
আজ্ঞে না। আমি দর্শনশাস্ত্র পড়িনি। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতাই আমাকে খানিকটা দার্শনিক করেছে।
বাঃ বেশ। কিন্তু এটাও কি সত্যি যে আমেরিকায় আপনি বিশেষ সুবিধে করতে পারেননি!
এটা কোন সূত্রে জানলেন?
আমাদের মার্কিন সোর্স জানিয়েছেন যে, দীর্ঘদিন ট্রাক চালানো এবং ফিলাডেলফিয়ায় একটা দোকান করার চেষ্টা, এনসাইক্লোপিডিয়া বিক্রি এসব করে আপনাকে পেট চালাতে হয়েছে।
আমি এসব করেছি ঠিকই। তবে অর্ডারটা উলটোপালটা হয়ে গেছে। এনসাইক্লোপিডিয়া বিক্রি ছিল আমার প্রথম দিককার চেষ্টা। তারপর দোকানঘর। তারপর ট্রাক চালানো।
আর কিছু?
হ্যাঁ, আমি মিউজিক গ্রুপে ইনস্ট্রমেন্ট বাজিয়েছি, হোটেলে আসার-এর চাকরি করেছি। শেষ অবধি আমি একটা ব্যাবসা শুরু করি।
সেটা কি একটা জাপানি কোম্পানির সঙ্গে?
আপনি তো সবই জানেন। হ্যাঁ, একটা জাপানি কোম্পানি আমাকে একটা ফ্রানচাইজি দিয়েছিল। সুব্রত বকশির সঙ্গে আমার সেই সূত্রেই ভাব হয়।
তারপর?
আপনি যখন সবই জানেন তখন আর নতুন করে কী বলব?
মানুষ যত কথা বলে ততই আমাদের কাজের সুবিধে হয়।
তা হয়তো হয়। কিন্তু আমাকে ঝুটমুট হয়রান করছেন। সুব্রত বকশি আমাকে পছন্দ করেন না বলেই তিনি আপনাদের নানারকম ইনফর্মেশন দিয়েছেন হয়তো।
সুব্রত বকশির সঙ্গে কি আপনার এক সময়ে খুব বন্ধুত্ব ছিল?
আজ্ঞে হ্যাঁ। উনি ওই জাপানি কোম্পানির একজন কর্তাব্যক্তি ছিলেন।
তা হলে উনি তো আপনার উপকারই করেছেন।
আজ্ঞে হ্যাঁ। উনি আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন।
তারপর কী হল? আপনি ওর সুন্দরী স্ত্রীর প্রেমে পড়ে গেলেন। নয় কি? ব্যা
পারটা ওরকমভাবে বললে আমাকে লম্পট বলে ধরে নিতে কি আপনার সুবিধে হয়?
আপনি কি লম্পট নন বলে দাবি করছেন?
আমি স্বভাবগতভাবে অবশ্যই লম্পট নই।
তা হলে মিসেস অরুণিমা বকশির সঙ্গে আপনার সম্পর্কটা কীরকম ছিল? প্লেটোনিক?
সম্পর্কটার জন্য আমাকে দায়ী করা অন্যায় হবে।
খুলে বলুন।
অরুণিমা বকশি সুন্দরী হলেও তরুণী নন। আমার পক্ষে মেয়েদের বয়স অনুমান করা কঠিন। তবে মনে হয় চল্লিশের কাছাকাছি।
সো হোয়াট?
আপনাকে এ সম্পর্কটা মনে রাখতে বলছি।
বলতে হবে না। অরুণিমা বকশির ডেট অফ বার্থ আমরা জানি। তার বয়স উনচল্লিশ। আপনার বয়স ত্রিশ। ঠিক তো?
হ্যাঁ।
আপনি কি মনে করেন যে, ত্রিশ বছরের এক যুবকের সঙ্গে উনচল্লিশ বছরের এক মহিলার প্রেম হওয়া সম্ভব নয়?
তা হতেই পারে। আজকাল নানারকম রিলেশন তৈরি হচ্ছে।
আপনার ক্ষেত্রে কী হয়েছিল?
সুব্রত বকশি আমাকে বিজনেসের ব্যাপারে সাহায্য করেছিলেন। নিউ ইয়র্কে তিনি আমার অফিসেরও ব্যবস্থা করে দেন। তিনি থাকতেন কুইনসে। আমাকে প্রায়ই বাড়িতে নেমন্তন্ন করতেন। মিসেস বকশিও আমাকে বেশ পছন্দ করতেন।
কী ধরনের পছন্দ?
আমি গেলে খুশি হতেন, লক্ষ করেছি।
তারপর?
দু-তিন মাসের মাথায় তিনি আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে থাকেন।
সেটা কীরকম ঘনিষ্ঠতা? ফিজিক্যাল?
হ্যাঁ।
আপনিও রাজি হয়ে গেলেন?
আমার উপায় ছিল না। মিসেস বকশিই আসলে কোম্পানি চালাতেন। তার ইচ্ছেতেই সব হত। সুব্রতবাবু ছিলেন ফ্রন্ট মাত্র।
তার মানে আপনি মিসেস বকশিকে খুশি করার জন্যই তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েন?
আমেরিকায় ফিজিক্যাল রিলেশনটা জলভাত। মিসেস বকশি বাঙালি হলেও ওঁরা দুই পুরুষের আমেরিকান। উনি মার্কিন মেইনস্ট্রিমের মানুষ। বাংলা ভাল বলতেও পারতেন না। কোনও সংস্কারও মানতেন না।
এ ব্যাখ্যা তো আপনার।
আপনি তো আমার ব্যাখ্যাই শুনতে চাইছেন।
ঠিক কথা। বলুন। আপনার ভার্সানটাই শোনা যাক।
আমি আমার ভার্সানটাই বলতে পারি, তা থেকে ডিডাকশন যা করার তা আপনি করবেন। আমার মনে হয় মিসেস বকশি সেই সময়ে সুব্রতবাবুর ওপর আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছিলেন। আমাকে উনি একসঙ্গে থাকার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন।
লিভিং টুগেদার?
হ্যাঁ, আমি রাজি হইনি।
রাজি না হওয়ার কারণটা কী?
আমি ওঁর প্রতি আসক্ত ছিলাম না। জীবিকার প্রয়োজনেই ওঁকে খুশি করার চেষ্টা করতাম মাত্র।
আপনাকে তো মোটেই ভাল লোক বলে মনে হচ্ছে না মশাই।
আমি ভাল লোক বলে দাবি করছি না। তবে আমি ভীষণ রকমের খারাপ লোকও নই। প্র্যাকটিক্যাল। জীবন সংগ্রাম করতে গিয়ে আমাকে নানারকম আপসরফা করতে হয়েছে।
তাই দেখছি। তা হলে আপনার ব্যাবসা মিসেস বকশির কল্যাণে বেশ ভালই চলছিল?
মোটামুটি। মিসেস বকশি আমাকে ব্যবহার করতেন বটে, তা বলে উনি খুব দরাজ হাতের মহিলা ছিলেন না। খুব হিসেবিই ছিলেন।
তাতে তো আপনার ক্ষতি হয়নি। কারণ আপনি তো আর ওঁদের কর্মচারী ছিলেন না, কোলাবরেটর ছিলেন মাত্র। মিসেস বকশি কৃপণ হলেই বা আপনার ক্ষতি কী?
ঠিক কথা। আপাত দৃষ্টিতে আমার ওপর ওঁর কোনও ফিনানসিয়াল কন্ট্রোল থাকার কথা নয়। কিন্তু মিসেস বকশিকে চিনলে আপনার ধারণা পালটে যেত। উনি আমার কাছ থেকে নিয়মিত নির্দিষ্ট হারে কমিশন নিতেন।
আমেরিকায় ওসব হয় নাকি?
কেন হবে না? সেটা তো আর সাধুর দেশ নয়।
মিসেস বকশি কি সুন্দরী ছিলেন বলে আপনার মনে হয়?
না। তবে নিয়মিত ব্যায়াম ট্যায়াম করে নিজেকে ট্রিম রাখতেন।
মিসেস বকশির সঙ্গে তার হাজব্যান্ডের রিলেশন কীরকম ছিল?
ঝামেলাহীন। দু’জনেই বেশ কুল কাস্টমার। ওঁদের বাড়িতে বা র্যানচে যখন গেছি তখন দু’জনকে বেশ ইন্টিমেট বলেই ধারণা হত। ঝগড়া-টগড়া শুনিনি। সুব্রতবাবু তার স্ত্রীর অনুগত ছিলেন বলেই মনে হত।
সুব্রতবাবুর কি এক্সট্রা ম্যারিটাল কোনও রিলেশন ছিল?
থাকলেও আমি জানি না। আমি নিজের কাজকারবার নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম।
মিসেস বকশির সঙ্গে আপনার রিলেশনটা সুব্রতবাবু কি টের পাননি?
টের না পাওয়ার কথা নয়। আমার ধারণা সুব্রতবাবু সবই জানতেন।
কীভাবে বুঝলেন?
অন্তত দু’বার উনি আমাকে ওঁর বাড়িতে খুবই অদ্ভুত সময়ে দেখতে পান। তা ছাড়া মিসেস বকশির সঙ্গে উইক এন্ড কাটাতেও আমি কয়েকবার বাইরে গেছি। সুব্রতদার তখন হয়তো কোনও টুর থাকত। কিন্তু টের না পাওয়ার কথা নয়। ওসব উইক এন্ডেও ওঁদের মধ্যে টেলিফোনে কথা হত।
তা হলে ব্যাপারটা খোলাখুলিই হত বলছেন?
হ্যাঁ, অন্তত আমার তাই ধারণা।
আপনি বেশ ফ্র্যাঙ্ক লোক, তাই না। কোনও লুকোছাপা নেই।
আমার জীবনটাই যে ওরকম। লজ্জাশরমের বালাই নেই।
ভাল কথা। আপনি একসময়ে আমেরিকার জীবনে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন, তাই তো।
হ্যাঁ, আমার আর ভাল লাগছিল না।
এই ভাল না লাগার কারণ কি মিসেস বকশি?
উনিও।
নাকি জনা?
জনা আর আমাকে নিয়ে যা রটনা হয়েছে তার অর্ধেক সত্য।
অর্ধ সত্য নয় তো!
অর্ধ সত্য মানে হাফ টুথ। না, তা নয়।
খুলে বলুন।
জনা সুব্রতদার ছোট বোন। বয়স কুড়ি টুড়ি হবে। সে পড়াশুনো করতে আমেরিকা গিয়েছিল।
এবং গিয়েই আপনার প্রেমে পড়ে গেল তো!
ঠিক তাই।
আপনি মেয়েদের কি খুব সহজেই অ্যাট্রাক্ট করেন?
আমি কিন্তু করি না। আমার কী করার আছে বলুন ইফ দে ফল ফর মি।
ঠিক কথা, আপনার চেহারাটা অবশ্য খুবই ভাল, বেশ হি-ম্যানের মতো। জনার সঙ্গেও কি আপনার ফিজিক্যাল
না-না, ছিঃ, ও কথা বলবেন না।
তা হলে?
জনা রোমান্টিক মেয়ে। সেক্সি টাইপের নয়।
আপনারা তা হলে প্রেমে পড়ে গেলেন?
ওই তো বললাম, অর্ধেকটা সত্য। জনা প্রেমে পড়ল, কিন্তু আমার তো এত ভাবাবেগ নেই। আমি পোড়-খাওয়া, কাঠখোট্টা মানুষ। জীবনে মহিলা সঙ্গিনীর অভাব কখনও ঘটেনি। চেহারাটাই সেইজন্য খানিকটা দায়ী। প্রেমে পড়ার মতো মনটাই আর আমার নেই। কিন্তু জনা পড়েছিল, স্বীকার করছি।
তাই নিয়েই কি অশান্তি?
হ্যাঁ। মিসেস বকশি জনাকে অপছন্দ করতে শুরু করেন। এবং আমার ওপরেও আধিপত্য বাড়িয়ে দেন।
সেটা কীরকম?
আমাকে খুবই চোখে চোখে রাখতেন এবং থ্রেট করতেন।
জনা কতদূর এগিয়েছিল?
ফোন করত। রোম্যান্টিক কথাবার্তা বলত, প্রেমে পড়লে যেমনটা বলে আর কী?
আপনি কি প্রশ্রয় দিতেন?
দিতাম। মেয়েদের আমি সহজে চটাই না।
আপনি বেশ বুদ্ধিমান মানুষ।
বুদ্ধি না হলে কি আমার চলে?
এবার মিসেস বকশির খুনের ঘটনায় আসি।
আমার যা বলার তো বলেছি।
আবার বলুন।
খুনের দিন সকালে আমি মিসেস বকশির সঙ্গে ওঁর আয়রন সাইড রোডের বাড়িতে দেখা করি। উনিই ডেকে পাঠিয়েছিলেন। শনিবার ছিল।
কী কথাবার্তা হয়েছিল?
উনি আমার উপর ভীষণ রেগে ছিলেন।
রাগের কারণ?
সেটাও বলেছি, হঠাৎ আমেরিকা থেকে চলে আসা এবং ওঁদের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করা হল একটা কারণ। আরও একটা কারণ হল জনা। আমি চলে আসায় জনাও নাকি আমেরিকা থেকে দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাকে নিরস্ত করা হয়।
খুনটা হয়েছিল দুপুরে।
খবরের কাগজে তাই তো পড়েছি।
খুনটা আপনি করেননি?
কেন করব সেটা তো বলবেন! মিসেস বকশির সঙ্গে আর আমার বিজনেস রিলেশন
ছিল না। দেশে ফিরে আসি। একে-একে তিনটে ট্রেলার কিনি এবং গত আট মাসে আমার ব্যাবসা মোটামুটি দাঁড়িয়ে গেছে। মিসেস বকশির প্রতি আমার কোনও সেন্টিমেন্টও নেই। খুন করতে যাব কেন?
মিসেস বকশি কি আপনাকে ব্ল্যাকমেল করতে চেষ্টা করেছিলেন?
ব্ল্যাকমেল করার ব্যাপারটা আপনাদের মাথায় কে ঢোকাল কে জানে! আমি তো খোলামেলা মানুষ। যা করেছি তা স্বীকার করি। লুকোনোর তো কিছু নেই আমার। আমাকে ব্ল্যাকমেল করার মতো গুপ্ত কিছুই থাকতে পারে না।
কিন্তু ভাইস ভার্সা। আপনি ওঁকে ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করেননি তো!
আজ্ঞে, সেটাও পুলিশ বলছে। কিন্তু তারা এখনও কোনও সূত্র পাচ্ছে না। আমি বলি কী, একটু স্ট্রং হান ছাড়া আমাকে নিয়ে টানা-হ্যাঁচড়া করাটা কিন্তু হাস্যকর হয়ে যাচ্ছে।
আপনার পক্ষে মিসেস বকশির গুপ্ত খবর জানা কি অসম্ভব?
মিসেস বকশি স্ট্রং মাইন্ডেড মহিলা। ওঁর গুপ্ত ব্যাপার বলতে আমার সঙ্গে ফিজিক্যাল রিলেশন। তিনি সেটা গোপন করতে যাবেন কোন দুঃখে? সুব্রতদাকে তো ওঁর কোনও ভয় ছিল না। বরং সুব্রতদাই ওঁকে ভয় পেতেন।
আপনার অ্যালিবাই স্ট্রং নয়।
জানি। কিন্তু সেটাই তো কোনও প্রমাণ হতে পারে না।
মিহিরবাবু, আপনি কিন্তু পুলিশকে যথেষ্ট হেল্প করছেন না।
হেলপ করার দায় কী বলুন। আপনার পুলিশের লোক যদি আমাকে অকারণে হ্যারাস আর থ্রেট না করত তা হলে আমি নিশ্চয়ই হেল্প করতাম। ইন্সপেক্টর নাগ একজন অভদ্র লোক। তিনি আমাকে প্রথম ইন্টেবোগেশনের সময়ে একটা থাপ্পড় মেরেছেন। আর কুৎসিত গালাগালের তো হিসেব নেই। ওঁরা ধরেই নিয়েছেন খুনটা আমিই করেছি, এখন কনফেস করে ফেললেই হয়।
মিস্টার নাগের হয়ে আমি ক্ষমা চাইছি।
কেন, নাগসাহেবের হয়ে আপনি ক্ষমা চাইবেন কেন? আর ক্ষমা চাওয়াটাও অর্থহীন। লোকটাকে দেখেই মনে হয় রাফিয়ান টাইপ। দরকার হলেই ফের চড়-থাপ্পড় মেরে বসবে। আপনি কাজ উদ্ধারের জন্য ক্ষমা চাইছেন বটে, কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমার আর বিশেষ কিছু বলার নেই।
জনাদেবী সম্পর্কে যদি কিছু জিজ্ঞেস করি?
জনা সম্পর্কে যা বলার তো বলেইছি।
আপনি বলেছেন জনাদেবী সম্পর্কে আপনি ইন্টারেস্টেড নন।
হ্যাঁ, এবং সেটা সত্যি কথা। মেয়েদের নিয়ে রোমান্টিক চিন্তা করার সময় আমার হাতে নেই।
জনাদেবী কি এখনও আপনার প্রতি দুর্বল?
তা জানি না। তবে মাঝে মাঝে চিঠি দেয়, ফোনও করে।
আপনি চিঠির জবাব দেন না?
দিই, দেব না কেন? তবে তাতে ভালবাসার কথা থাকে না।
জনাদেবীর চিঠিতে কি ভালবাসার কথা থাকে?
খুব থাকে। তবে সেসব হচ্ছে শ্যাম্পেনের ফেনার মতো, ওর মধ্যে বস্তু বিশেষ থাকে।
আপনি তো দেখছি নর-নারীর প্রেমে বিশ্বাসী নন।
আপনাকে তো বলেছি, আমি খাটিয়ে পিটিয়ে মানুষ। দেশে ফিরে আসার পর আমাকে নতুন করে আবার জীবন সংগ্রাম করতে হচ্ছে। নেপাল, ভুটান, আসাম, পাঞ্জাব জুড়ে নেটওয়ার্ক তৈরি করা তো চাট্টিখানি কথা নয়।
আপনার ফ্যামিলি সম্পর্কে যদি কিছু জানতে চাই?
স্বচ্ছন্দে।
আপনার মা-বাবা? বাবা রিটায়ার্ড পোস্টমাস্টার, সামান্য পেনশন পান। মা বরাবর হাউস ওয়াইফ, দু’জনেই নানারকম অসুখে ভুগছেন। আমার দুই দাদা আছেন। একজন কমার্শিয়াল আর্টিস্ট–তাঁর প্রচুর পয়সা। তিনি আলাদা হয়ে গেছেন। মেজ দাদাও আলাদা। তিনি চাকরি করেন দিল্লির একটি ইংরেজি পত্রিকায়। মোটামুটি এই হচ্ছে আমার ফ্যামিলি।
মা বাবাকে কে দেখে?
কেউ দেখে না। মা-বাবা দুজনেই এখনও পরস্পরের দেখাশোনা করেন। আমেরিকা থেকে ফিরে আসার পর আমি তাঁদের কাছেই থাকি বটে, কিন্তু কাজের চাপে তাদের ওপর বিশেষ নজর দিতে পারি না। কিন্তু এসব জানতে চাইছেন কেন? এগুলো তো আপনার কেসে ইরালেভ্যান্ট।
আমি আসলে আপনাকে অফ গার্ড ধরতে চাইছি। অসতর্ক মনে যদি হঠাৎ কিছু রিল্যাভেন্ট বলে ফেলেন।
মিহির একটু হেসে বলে, আপনার কি এখনও ধারণা যে, আমি সত্য গোপন করছি?
অফ কোর্স! আপনার চোখে-মুখে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে আপনি সত্যি কথা বলছেন। অন্তত সব সময়ে নয়।
কী যে বলেন শবরবাবু! গোপন করার মতো কিছুই নেই আমার।
এমনও হতে পারে যে, আপনি ইচ্ছে করে গোপন করছেন না। হয়তো যেটা সামান্য কোনও ঘটনা যা হয়তো কোনও একটা কথা বা আচরণ, যেটাকে আপনি গুরুত্ব দিচ্ছেন না, অথচ সেটা তদন্তের পক্ষে খুবই গুরুতর হয়ে দাঁড়াতে পারে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিহির বলে, আমি থ্রিলার পড়ি, এক সময়ে আমেরিকায় লং ডিসট্যান্স ড্রাইভের পর মোটেলে সময় কাটানোর জন্য পড়তাম। কাজেই আপনি যা বলছেন তা বুঝতে আমার অসুবিধে হচ্ছে না। কিন্তু আপাতত কিছুই তেমন মনে পড়ছে না আমার। পড়লে জানাব।
ধন্যবাদ, বাই দি বাই, জনাদেবী দেখতে কেমন তা বলবেন?
অবাক হয়ে মিহির বলে, হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?
এমনি, কৌতূহল মাত্র।
মৃদু হেসে মিহির বলল, এ যাবৎ যে কজন পুলিশের লোক দেখেছি তার মধ্যে আপনাকেই ইন্টেলিজেন্ট বলে মনে হয়েছে। ফালতু প্রশ্ন করার লোক আপনি নন। তবে মেয়েদের রূপের ব্যাপারে আমার মতামতকে গুরুত্ব দেবেন না। আমার সৌন্দর্য বিচারের চোখ নেই। আমার একটা খুড়তুতো বোন আছে, তার সঙ্গে আমার খুব ভাব। সে বলে, দুখুদা, তুই কিন্তু তোর পাত্রী দেখতে যাস না, তা হলে একেবারে কেলোর কীর্তি হবে।
শবর মৃদু হেসে বলল, তা হোক। তবু আপনার জাজমেন্টটাই আমি জানতে আগ্রহী।
জনা হল গুঁড়ি গুডি টাইপ। শুনেছি খুব ভাল ছাত্রী। যাদবপুর থেকে এম টেক-এ ফাস্ট ক্লাস পেয়েছিল। ভাল ছাত্রীরা যেমন দেখতে হয় জনা ঠিক তেমনি চোখে ভারী চশমা, মুখ গম্ভীর, হাসিঠাট্টা নেই, কথাবার্তা কম, রং একটু ফ্যাকাশে, স্বাস্থ্য রোগা এবং মুখটা রসকষহীন।
বাঃ, এই তো চমৎকার বিবরণ দিলেন। কে বলল আপনার বিচারকের চোখ নেই?
কমপ্লিমেন্ট দিচ্ছেন? থ্যাঙ্ক ইউ।
এবার বলি, জনা কেমন টাইপের মেয়ে? ডেসপারেট? রাগী? টেম্পারমেন্টাল? মুডি? না কি ঠান্ডা ভালমানুষ?
বোঝা মুশকিল। ওর এক্সপ্রেশন নেই তেমন। তা ছাড়া আমি ওকে স্টাডি করিনি কখনও। কথাটথা বলতাম ঠিকই, তবে মনোযোগ দিইনি।
সুব্রত বকশি কি তার বোনেরই মতো?
না-না, সুব্রতদা অন্যরকম। দারুণ স্মার্ট, আড্ডাবাজ, বুদ্ধিমান, ডাউন টু আর্থ ম্যান। বেশ ভাল স্কলারও বটে। শুধু ওঁর দাম্পত্য সম্পর্কটাই গোলমেলে।
কীরকম গোলমাল?
সেটাও তো বলেছি আপনাকে।
আবারও না হয় বলুন।
উনি ওঁর স্ত্রীকে খুব তোয়াজ করতেন, খুবই খাতির করতেন, কিন্তু আমার কেন যেন মনে হত স্ত্রীকে উনি মোটেই ভালবাসেন না।
বিশেষ কোনও লক্ষণ দেখেছেন কি?
ঠিক সেভাবে বলা যায় না। তবে অরুণিমা বকশি যে আমার সঙ্গে ইনভলভড এটা জেনেও ওঁর কোনও ভাবান্তর ছিল না। স্ত্রী ব্যভিচারিণী হলে স্বামীর তো স্বাভাবিকভাবেই রি-অ্যাক্ট করা উচিত, তাই না?
উনি নপুংসক নন তো!
মিহির হেসে ফেলে বলল, তা তো আমার জানা নেই।
মিসেস বকশি তার স্বামীর সম্পর্কে কোনও মন্তব্য আপনার কাছে করেননি?
না। ওই ব্যাপারে উনি খুব রিজার্ভড ছিলেন। ওঁর স্বামী ইমপোটেন্ট কিনা তা আমাকে বলবার লোক উনি নন। আমাদের ইন্টিম্যাসিটা শুধু ফিজিক্যাল লেভেলেই ছিল, হৃদয়ঘটিত নয়।
তা হলে উনি জনাকে হিংসে করতেন কেন?
ফিজিক্যাল পজেশনও তো একটা পজেশন। উনি ওটাও ছাড়তে চাননি।
ঠিক আছে, এ প্রসঙ্গটা থাক। এবার মিসেস বকশির মৃত্যুর প্রসঙ্গে আসি। উনি মারা যাওয়ায় আপনি কি দুঃখ পেয়েছেন?
যে কারও মৃত্যুই দুঃখজনক।
আপনি আপনার কথা বলুন।
হ্যাঁ, আই ফেল্ট স্যাড।
কে ওঁকে খুন করতে পারে বলে মনে হয়?
নো আইডিয়া। পুলিশ যে কতবার কতভাবে এ প্রশ্ন করেছে তার হিসেব নেই।
জানি, পুলিশকে একই প্রশ্ন বারবার করতেই হয়।
উইথ থার্ড ডিগ্রি?
শবর দাশগুপ্ত ম্লান একটু হেসে বলল, পুলিশের কাজ তো ভাল কাজ নয়। অপরাধী আর অপরাধ যে কত জটিল আর কুটিল তা যদি জানতেন তা হলে রাগ করতেন না।
পুলিশের কাজ কীরকম এবং কাদের নিয়ে তা আমি খানিকটা জানি। কিন্তু ইন্টেলিজেন্ট হতে পুলিশের বাধা কোথায় বলুন তো! আপনাদের ওই মিস্টার নাগের কথাই ধরুন, কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ উনি ঠাস করে একটা চড় মেরে বসলেন! যেন মারের চোটেই আমি স্বীকারোক্তিটা করে ফেলব। আমি ওঁকে উলটে মারলে কী হত জানেন?
জানি। আপনি ফিজিক্যালি একজন স্ট্রং ম্যান। হয়তো ক্যারাটে জানেন।
ক্যারাটে জানি বলেই রক্ষে। আমরা ক্যারাটের সঙ্গে ধৈর্য ও স্থৈর্যও শিখেছি। কাজেই চরম প্রয়োজন ছাড়া কাউকে মারি না। মার্শাল আর্ট তো মারপিট নয়, ওটা একটা ধরন।
জানি। তবে আমি তো নাগ নই, আপনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহারও করিনি।
আপনার কথা আলাদা। আপনি শুধু ভাল ব্যবহারই করেননি, অকারণ হাজতবাসের হাত থেকেও মুক্তি দিয়েছেন। সেজন্য আমি কৃতজ্ঞ।
ধন্যবাদ, আশা করি আপনি কো-অপারেট করবেন।
করব। আপনার মোডাস অপারেন্ডি খুবই বাস্তবসম্মত এবং লজিক্যাল। মিসেস বকশির খুনিকে ধরতে যদি পারেন তা হলে আমি খুশিই হব। কিন্তু মুশকিল হল আমার কাছে তেমন কোনও তথ্য নেই যা আপনার সাহায্যে আসতে পারে।
ধন্যবাদ। মিসেস বকশি কীভাবে খুন হন তা তো আপনি জানেনই।
হ্যাঁ, গলা টিপে ওঁকে খুন করা হয়েছিল।
ওঁর বাড়িতে আপনি গিয়েছিলেন সকাল আটটা বেজে পনেরো মিনিটে। ঠিক তো?
দু’-এক মিনিট এদিক-সেদিক হতে পারে। তবে মোটামুটি সোয়া আটটাই ধরে নিতে পারেন।
বাড়িতে গিয়ে কী দেখলেন?
বিশাল বাড়ি, বিরাট কম্পাউন্ডও, মিসেস বকশিদের ফ্যামিলি বনেদি বড়লোক। আয়রন সাইড রোডের মতো ঘ্যাম জায়গায় ওরকম বাড়ির দাম কয়েক কোটি টাকা।
সে তো বটেই।
বাড়ি দেখেই আমি ট্যারা হয়ে গিয়েছিলাম। শুনেছি, একজন দারোয়ান আর একটা চাকর সেই বাড়ি মেনটেন করে।
ঠিকই শুনেছেন। তারপর বলুন, সকাল সোয়া আটটায় পৌঁছে আপনি কী দেখেছিলেন?
নাথিং অফ এনি ইমপর্টেন্স। ফটক দিয়ে ঢোকার সময় দারোয়ান আটকাল। তার কাছে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুক থাকে। সেটা দেখে ছেড়ে দিল। আমি দু’-এক মিনিট দাঁড়িয়ে বাগানটা দেখলাম। তারপর বৈঠকখানায় ঢুকলাম। একজন চাকর এসে স্লিপ লিখিয়ে নিয়ে ভিতরে গেল। দু’-তিন মিনিটের মধ্যেই মিসেস বকশি এসে ঘরে ঢুকলেন।
ডিসক্রাইব হার। ওঁকে কীরকম মুড আর পোশাকে দেখলেন?
গায়ে একটা কিমোনো ছিল। গাঢ় বেগুনি রঙের ওপর একটা ড্রাগন আঁকা। মনে হল খটি জাপানি জিনিস। এ তো গেল পোশাক। আর মুড একটু অফ ছিল। আমাকে দেখেই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলেন।
চাকরবাকরদের সামনেই?
চাকরটা বোধহয় তখন বেরিয়ে গিয়েছিল। ঠিক লক্ষ করিনি। তবে কে দেখল না-দেখল উনি তার পরোয়া করতেন না।
আপনার কি মনে হয় না যে উনি আপনার প্রতি ইমোশনালি অ্যাটাচড ছিলেন।
সেদিনই প্রথম মনে হল, মে বি শি ইজ সিরিয়াসলি ইন লাভ উইথ মি।
আগে মনে হয়নি?
ইমোশনের চেয়ে ওঁর বোধহয় সেক্সয়াল আর্জটাই বেশি ছিল বলে মনে হত।
উনি আপনাকে চিঠিপত্র লিখতেন না?
হ্যাঁ, মাঝেমধ্যে লিখতেন।
লাভ লেটার?
ঠিক লাভ লেটার বলা যায় না। আমি হঠাৎ আমেরিকার কারবার গুটিয়ে চলে আসায় উনি ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। ওঁর ধারণা ছিল আমি ওঁকে বিট্রে করেছি।
আপনি হঠাৎ চলে এলেন কেন?
হঠাৎ করে আসিনি। মাস দুই ধরে ধীরে ধীরে কাজকারবার গুটিয়ে তৈরি হয়েই এসেছি। তবে ব্যাপারটা সুব্রতদা বা তার স্ত্রীকে জানাইনি।
জানাননি কেন?
আমার বিশ্বাস ওঁরা বাগড়া দিতেন। বিশেষ করে মিসেস বকশি।
ওঁদের তো সন্তান নেই, না?
না। হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?
এমনি, হঠাৎ মনে হল।
ওঁরা অবশ্য অ্যাডপ্ট করার কথা ভাবছিলেন।
অ্যাডপ্ট কি শেষপর্যন্ত করেছেন?
যতদূর জানি, না।
সুব্রতবাবুর বয়স এখন কত? আপনারা তো তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন, আপনারাই তো সেটা জানবেন।
আমি এই কেসটা সদ্য হাতে নিয়েছি। সুব্রতবাবু তার আগেই আমেরিকায় ফিরে গেছেন। ওঁর বায়োডাটা এখনও আমার স্টাডি করা হয়নি।
পঁয়তাল্লিশ-ছেচল্লিশ হবে।
বিয়ে করার বয়স আছে বলছেন।
নিশ্চয়ই। ও দেশে এখনও অনেকে এই বয়সে প্রথম বিয়ে করে।
আপনি কি সত্যিই জানেন না সুব্রতবাবুর কোনও প্রেমিকা বা বান্ধবী আছে কিনা।
সত্যিই জানি না।
থাকা কি সম্ভব?
থাকতেই পারে। কোয়াইট নরমাল।
হ্যাঁ, তারপর অরুণিমা বকশির সঙ্গে আপনার দেখা হওয়ার ঘটনাটা বলুন।
উনি আমাকে এমব্রেস করলেন, বলেছি তো।
হ্যাঁ।
কিছুক্ষণ একটু ইমোশনাল কথাবার্তাও বললেন, তার মধ্যে প্রেমের কথাই ছিল, ওঃ আই লাভ ইউ সো মাচ! আই মিস ইউ সো মাচ! ওঃ ডিয়ারেস্ট, ওঃ ডার্লিং, ওঃ সুইটহার্ট! এইসব আর কী।
আপনার রিঅ্যাকশন কী হল?
খুব একটা কিছু নয়। বরং বছরখানেক বাদে ফের এইসব আমার খারাপই লাগছিল। ভদ্রমহিলার জন্য একটু দুঃখও হচ্ছিল।
এনি সেক্স?
বি সেনসিবল মিস্টার দাশগুপ্ত। ইট ওয়াজ আর্লি ইন দি মর্নিং এবং আমাদের আগের রিলেশনটাও তখন ছিল না, অন্তত আমি এখন একদম আলাদা মানুষ।
ওকে, ওকে। ঝগড়া হল কেন?
ঝগড়া। না ঝগড়া হয়নি। ঝগড়া হতে দুটো পক্ষ লাগে। আমি সম্পূর্ণ প্যাসিভ ছিলাম। উনি একটু উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন।
উত্তেজিত হলেন কেন?
উনি পুরনো কথা তুলে আবার আমাদের আগের সম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তাব দেন, আমেরিকায় ফিরে যাওয়ার জন্য ঝোলাঝুলি করতে থাকেন, এমনকী সুব্রতদাকে ডিভোর্স করে আমাকে বিয়ে করার প্রস্তাবও দিয়ে ফেলেছিলেন। দেখলাম ভদ্রমহিলা আমার জন্য বেশ পাগল হয়ে উঠেছেন। খুব ডেসপারেট, অথচ আমি ওঁকে কুল ক্যালকুলেটিং অ্যান্ড ক্রুয়েল টাইপের বলে জানতাম। বেহিসেবি হওয়ার মতো মহিলা উনি ছিলেন না।
আপনি ওঁর প্রস্তাবে সায় দেননি বোধহয়?
দেওয়া সম্ভব ছিল না। আমার জীবনের ধারা পালটে গেছে। তা ছাড়া, আপনাকে তো বলেইছি আমি ওঁর প্রতি কখনও অ্যাট্রাকটেড ছিলাম না, উনি আমাকে ব্যবহার করেছেন, আমিও নিজেকে ব্যবহৃত হতে দিয়েছি লাইক এ গিগোলো, তার বেশি কিছু নয়।
সেদিন কি ওঁর প্রস্তাবে আপনি রেগে গিয়েছিলেন?
একটুও না। বলেছি তো, ভদ্রমহিলার জন্য আমার করুণা হচ্ছিল, আমি খুব শান্তভাবে ওঁকে বোঝনোর চেষ্টা করছিলাম, লজিক্যালি, কিন্তু উনি ক্রমশ রেগে উঠছিলেন, ধৈর্য হারিয়ে ফেলছিলেন।
রেগে গিয়ে উনি কী করলেন?
চেঁচামেচি করলেন, কাঁদলেন, আমাকে যা খুশি বলে অপমান করলেন, আমি কিছুই গায়ে মাখিনি।
বাড়িতে কজন ঝি-চাকর ছিল বলে আপনার অনুমান?
খুব বেশি নয়। দারোয়ান আর একজন চাকরকেই আমি দেখেছি।
কোনও মহিলা?
না, কারও কোথাও সাড়াশব্দও পাইনি।
বাই দি বাই, আপনি সেদিন কীসে করে ওঁর বাড়িতে গিয়েছিলেন?
আমার একটা গাড়ি আছে।
নিজে চালান?
তা তো বটেই।
কী গাড়ি আপনার?
হুন্ডাই।
মিসেস বকশি কি আপনাকে মারধর করেছিলেন?
উত্তেজনার বশে উনি আমাকে একটা চড় মারেন এবং গালে খিমচে দেন। পুলিশ সেই দাগ থেকে ধারণা করে নেয় যে, আমি যখন ওঁকে গলা টিপে মারছিলাম তখন নাকি উনি আত্মরক্ষার জন্য আমাকে খিমচে দিয়েছিলেন, পুলিশ খুব সরল পথে চলতে চায়, তাই না?
ব্যাপারটাকে আপনিই বা জটিল ভাবছেন কেন?
আমি জটিল ভাবছি না, আপনারা যত সরল সিদ্ধান্তে আসছেন আমার পক্ষে পরিস্থিতি ততই জটিল হয়ে উঠছে। এই যে আপনি আমাকে তলব করে লালবাজারে টেনে এনেছেন তাতে আমার কত জরুরি কাজ পণ্ড হচ্ছে তা কি জানেন?
কেসটা খুনের, তাই আমাদের একটু সিরিয়াস হতে হয়েছে। তার ওপর সুব্রত বকশির কিছু পাওয়ারফুল কানেকশান আছে বলে আমাদের ওপর প্রেশার আসছে। যদিও আপনার একটু হ্যারাসমেন্ট হচ্ছে তবু একটু বিয়ার করুন, আপনাকে হয়তো আরও ইন্টারোগেট করা হবে। আপনি ওঁর সঙ্গে কতক্ষণ ছিলেন?
খুব বেশি হলে ঘণ্টা খানেক।
তার বেশি নয়?
না, বরং দু’-চার মিনিট কমই হবে।
যখন আপনি চলে আসেন তখন কি মিসেস বকশি শান্ত ছিলেন? মানে প্যাসিফয়েড হয়েছিলেন কি?
না। উই পার্টেড উইথ এ বিটার নোট। শি ওয়াজ আপসেট।
আর আপনি?
আমি খুবই হেলপলেস ফিল করেছিলাম। মিসেস বকশির মতো কঠিন মানুষ যে এতটা ইমোশনাল হতে পারেন সে ধারণা আমার ছিল না। এ যেন মিসেস বকশি নয়, অন্য কেউ। যেন বয়ঃসন্ধির কিশোরী। সাধারণত কম বয়সে প্রথম প্রেমে দাগা খেয়ে মেয়েরা ওরকম ভেঙে পড়তে পারে। কিন্তু মিসেস বকশির মতো প্র্যাকটিক্যাল ডাউন টু আর্থ সেনসিবল মহিলাদের এরকম হওয়ার কথা নয়।
আপনার কি মনে হয় উনি অভিনয় করছিলেন?
না, একেবারেই না। অভিনয় করবেন কেন?
আপনাকে ইমপ্রেস করার জন্য।
না-না মিস্টার দাশগুপ্ত, অভিনয় হতেই পারে না, অভিনয় হলে ঠিকই ধরতে পারতাম।
তা হলে এই নতুন রূপের মিসেস বকশিকে দেখে আপনি ইমপ্রেসড?
তা এক রকম বলতে পারেন।
আপনি কি একটুও সফট হয়ে পড়েননি?
সফট কথাটার যদি বাঁকা অর্থ না ধরেন তবে বলতে পারি, হ্যাঁ, ওঁর প্রতি সহানুভূতিও হচ্ছিল। কিন্তু আমি একজন ওয়েদারবিটুন ম্যান, বয়স ত্রিশ হলেও অভিজ্ঞতায় পোড় খাওয়া মানুষ। সহানুভূতি হয়েছিল বটে, কিন্তু সেটা কোনও দুর্বলতা নয়। ওঁকে আর প্রশ্রয় দেওয়া বা ওঁর কুক্ষিগত হয়ে পড়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
খুনটা কখন হয় তা কি আপনি জানেন?
আপনাদের কাছ থেকেই জেনেছি। দুপুর দুটো-আড়াইটে নাগাদ।
সে সময়ে আপনি কোথায় ছিলেন?
সেও পুলিশকে বলেছি, তারা আমার কথা বিশ্বাস করছে না।
তবু আর একবার বলুন। আমি হয়তো বিশ্বাস করতেও পারি।
দুপুর একটা-দেড়টা থেকে বিকেল চারটে অবধি আমি আমার একটা ট্রাকের মধ্যে শুয়ে ঘুমোচ্ছিলাম।
কোথায়?
বেলতলায় আমার ট্রলারগুলো রাখার জন্য আমি একটা জমি লিজ নিয়েছি। ছোটখাটো সারাইয়ের কাজও হয়। সেদিন আমি নিজেই আমার ট্রাকের একটা জখম চাকা মেরামত করছিলাম। খুব পরিশ্রান্ত হওয়ায় ড্রাইভারের কেবিনে উঠে শুয়ে পড়ি।
কোনও সাক্ষী আছে?
না।
আপনার গ্যারেজ পাহারা দেয় কে?
ওয়াচম্যান আছে।
ওয়াচম্যান আপনাকে দেখেনি?
সেদিন ওয়াচম্যান ছুটি নিয়েছিল। ভোররাতে তার মা মারা যায়। ফলে কেউ ছিল না। ওয়াচম্যানকে পুলিশ জেরাও করেছে।
জানি। মিসেস বকশির বাড়ি থেকে বেরিয়ে আপনি কোথায় গেলেন?
ডোভার লেনে আমার অফিসে। সেদিন আমার দম ফেলার সময় ছিল না। সেখান থেকে বেরিয়ে বেলতলায় যাই।
আপনার অ্যালিবাই কিন্তু দুর্বল।
কান্ট হেলপ ইট। এবার কি আমি যেতে পারি?
পারেন। আসুন।
২. এই বাড়ির কাজের লোক
তুমি এই বাড়ির কাজের লোক ভিখু?
‘আজ্ঞে হ্যাঁ।
কতদিন হল এ বাড়িতে কাজ করছ?
প্রায় দশ বছর।
বাড়ি কোথায়?
ছাপরা জেলা।
এ বাড়িতে কীভাবে কাজে ঢুকলে?
আমার কাকা এ-বাড়িতে কাজ করত। কাকা এখন দোকান করে। আমাকে কাকা চাকরিতে ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে।
তুমি তো বেশ ভাল বাংলা বলো!
আমি তো জন্ম থেকেই কলকাতায় আছি। এখানেই মানুষ।
এ বাড়িতে তোমার কাজ কী?
এ বাড়িতে তো কেউ থাকে না। আমার কাজ ঘরদোর বিছানা-টিছানা সব পরিষ্কার রাখা। বছরে একবার মেমসাহেব আসেন, তখন তাঁর দেখভাল করতে হয়।
মেমসাহেবের বাপের বাড়ির লোকেরা কোথায়?
মেমসাহেবের তো কেউ নেই। বড় মালিক আর মালকিনও এখানে থাকতেন না। আমেরিকায় থাকতেন। সেখানেই একটা অ্যাক্সিডেন্টে দু’জনেই মারা যান। এ বাড়িও বিক্রির চেষ্টা চলছে।
তোমাকে কত মাইনে দেওয়া হয়?
আড়াই হাজার টাকা।
বাড়ির কাজের লোকের পক্ষে মাইনেটা তো ভালই, কী বলো?
না সাহেব, এ টাকায় সংসার চালানো মুশকিল।
তোমার সংসারে কে আছে?
আমার বউ আর চার ছেলেমেয়ে। দুই বেটা, দুই বেটি।
এ বাড়িতেই থাকো?
না সাহেব। ফ্যামিলি নিয়ে এ বাড়িতে থাকার হুকুম নেই। আমার পরিবার থাকে তিলজলায়, একটা বস্তিতে।
তোমার চলে কী করে?
আমার বউও কাজ করে। বাড়ির কাজ।
ফ্যামিলি নিয়ে এখানে থাকার হুকুম নেই কেন? এ বাড়িতে তো আউট হাউস আছে এবং সেগুলো ফাঁকাই পড়ে থাকে।
বাচ্চাকাচ্চা থাকলে বাড়ি নোংরা করবে, বাগানের গাছপালা ছিড়বে বলেই হুকুম নেই। তা ছাড়া অনেকে বাড়ি দখল-টখল করে নেয়।
এ বাড়িতে তো অনেক দামি জিনিস রয়েছে দেখছি। তোমাকে কি মেমসাহেব খুব বিশ্বাস করতেন?
তা জানি না। তবে থানায় আমার নাম ঠিকানা ফটো সব রেকর্ড করা আছে। কোনও জিনিস চুরি গেলে পুলিশ তো আমাদেরই ধরবে।
এবার ঘটনার দিনের কথা বলো।
ঘটনার দিন সকালে মেমসাহেব আমাকে ডেকে বলে দিলেন, একজন বাবু দেখা করতে আসবেন, ঘরদোর যেন ফিটফাট থাকে।
ঘরদোর তো ফিটফাটই আছে দেখছি।
হা সাহেব। এ বাড়ি সবসময়ে ফিটফাট থাকে। তবু মেমসাহেব বললেন বলে আমি আরও একটু ঝাড়পোঁছ করলাম।
মেমসাহেব কীরকম লোক ছিলেন বলে তোমার মনে হয়?
ভাল লোক ছিলেন।
কীরকম ভাল?
ঝুট ঝামেলা কিছু করতেন না। চুপচাপ থাকতেন।
রাগী মানুষ ছিলেন কি?
বেয়াদবি বরদাস্ত করতেন না। আমাদের খুব ফিটফাট থাকতে হত, নোংরা দেখলে রেগে যেতেন।
কাজে খুশি হলে বখশিশ দিতেন নাকি?
না। বখশিশ দিতেন না।
উনি কি কৃপণ ছিলেন?
না সাহেব। কিন্তু বখশিশ দিতেন না।
তোমাদের মাসের মাইনে কে দিত?
সতুবাবু। মেমসাহেবে সম্পর্কে দাদা। নিউ আলিপুরে থাকেন।
সতুবাবু কি প্রতি মাসে নিজে এসে টাকা দিয়ে যেতেন?
না। আমরা গিয়ে নিয়ে আসতাম।
সতুবাবুই কি এ বাড়ির দেখাশোনা করতেন?
হ্যাঁ। তবে উনি খুব একটা আসতেন না। ইদানীং এক পোমোটার বাবুকে নিয়ে মাঝে মাঝে এসে মাপ জোক করাতেন।
প্রোমোটারকে চেনো?
ঘোষবাবু। শুনেছি বড় প্রোমোটার।
তাঁর সঙ্গে তোমাদের কোনও কথাবার্তা হয়েছে?
না সাহেব। উনি আমাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলবেন কেন?
এবার ঘটনার দিনের কথা বলো। সেই বাবুটি কখন এলেন?
আটটার পর।
চেহারা কেমন?
লম্বা-চওড়া চেহারা। হিরোর মতো।
দেখে কীরকম মনে হল?
আমি ভেবেছিলাম ফিল্মস্টার হবেন বোধহয়।
মেমসাহেবের সঙ্গে তাঁর কী কথাবার্তা হল জানো?
না সাহেব।
মেমসাহেব কি গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন?
তা হতে পারে সাহেব। আমি ওসব দেখিনি।
উনি কতক্ষণ ছিলেন?
এক ঘন্টার মতো হবে। একটু কমও হতে পারে।
তুমি কি কফি বা চা দিয়েছিলে?
মেমসাহেব বলেছিলেন যেন কথাবার্তার সময় ওঁদের ডিস্টার্ব না করি। তাই আমি দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। আর ভিতরে যাইনি। তবে দরজার কাছেই ছিলাম, যদি ডাকেন তা হলে যেন শুনতে পাই।
ভিতরে কী কথাবার্তা হয়েছিল তা শুনতে পেয়েছিলে?
মেমসাহেব রাগারাগি করছিলেন, তবে আমি ইংরেজি জানি না বলে কথা কিছু বুঝতে পারিনি।
মেমসাহেব কি কান্নাকাটিও করেছিলেন?
হ্যাঁ। বাবুটি চলে যাওয়ার পর মেমসাহেব খুব আপসেট ছিলেন।
তুমি কি একেবারেই ইংরিজি জানো না? এই যে বললে আপসেট।
দুটো-একটা শব্দ জানি সাহেব।
সেরকম কোনও শব্দ মনে করতে পারো?
মেমসাহেব একবার বাস্টার্ড বলে গাল দিয়েছিলেন, মনে আছে।
ব্যস?
হ্যাঁ। আর কিছু মনে নেই।
বাবুটি যখন বেরিয়ে যায় তখন তাকে দেখেছ?
না সাহেব, আমি ভিতর দিকের দরজার পাশে ছিলাম। বাবু সামনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন।
তুমি জানো যে মেমসাহেব বাবুটিকে চড় মারেন?
জানি সাহেব, শব্দ শুনেছি।
আর কিছু?
দারোয়ান বলরাম বলেছিল বাবুর বাঁ-গাল থেকে রক্ত পড়ছিল। বাবু রুমাল দিয়ে গাল চেপে গিয়ে গাড়িতে ওঠেন।
মেমসাহেবকে তারপর কেমন দেখলে?
উনি খুব আপসেট ছিলেন। ইংরিজিতে কী সব বলতে বলতে দোতলায় উঠে গেলেন।
উনি সেদিন দুপুরে লাঞ্চ করেছিলেন কি?
না সাহেব আমি বেলা সাড়ে বারোটায় ওঁর দরজায় নক করি।
উনি সাড়া দেননি?
হ্যাঁ, দরজা খুলে দিয়ে বললেন, আমি কিছু খাব না। দুধ থাকলে এক গেলাস ঠান্ডা দুধ দিতে বললেন।
দুধটা খেয়েছিলেন কি?
হ্যাঁ সাহেব।
তারপর কী করলেন?
ঘরে চুপচাপ শুয়েছিলেন বলে মনে হয়।
খুনটা ক’টার সময় হয় তুমি তো জানো।
হ্যাঁ সাহেব, পুলিশের কাছে শুনেছি। বেলা দুটো থেকে আড়াইটের মধ্যে।
তুমি তখন কোথায় ছিলে এবং কেন তা পরিষ্কার করে বলো। পু
লিশকে সব বলেছি সাহেব। কিছু লুকোইনি। বেলা দেড়টা নাগাদ একটা ফোন আসে।
ফোন কি মেমসাহেব ধরতেন না?
না। মেমসাহেব ফোন ধরতেন না। কোনও জরুরি ফোন থাকলে আমি কর্ডলেস ফোনটা নিয়ে ওঁকে দিতাম।
সব ফোন তুমিই ধরো?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
এবার বলো।
ফোনে একটা লোক আমাকে বলল, ভিখুচাচা তোমার ছেলে অ্যাক্সিডেন্টে জখম হয়েছে। খুব গহেরা জখম। আমরা তাকে পি জি হাসপাতালে নিয়ে এসেছি। তুমি এখনই চলে এসো।
গলাটা কার তা চিনতে পেরেছিলে?
না।
জিগ্যেস করোনি?
হ্যাঁ। বলল, আরে আমি তোমার পাড়ার ছেলে রামু। তাড়াতাড়ি চলে এসো। বহুত ইমার্জেন্সি। আমার মাথার ঠিক ছিল না সাহেব। আমি দৌড়ে গিয়ে মেমসাহেবকে বললাম। উনি ছুটি দিয়ে দিলেন। আমি পাগলের মতো হাসপাতালে ছুটলাম। গিয়ে দেখি ওখানে আমার ছেলের নামে কাউকে ভরতি করা হয়নি। তখন ছুটলাম বাড়িতে। গিয়ে দেখি আমার বউ ঘুমোচ্ছ। তাকে ডেকে তুলে সব বললাম। তারপর ছুটলাম ছেলের ইস্কুলে। গিয়ে দেখি, ছেলে ঠিক আছে, কিছু হয়নি।
কখন ফিরলে?
বেলা চারটে হবে।
এসে কী দেখলে?
চারটের সময় মেমসাহেবকে রোজ কফি দিই। সোজা রান্নাঘরে গিয়ে কফি করে দোতলায় উঠে দরজা নক করতে গিয়ে দেখি দরজা খোলা রয়েছে। বাইরে থেকে বললাম, কফি এনেছি। মেমসাহেব সাড়া দিলেন না। ভাবলাম ঘুমোচ্ছন। পরদা সরিয়ে উঁকি মেরে দেখি মেমসাহেবের বডি অর্ধেকটা বিছানায় আর অর্ধেকটা নীচের দিকে ঝুলে রয়েছে। মাথা নীচের দিকে।
ঠিক আছে। বাকিটা আমরা জানি। পুলিশ তোমাকে কী বলেছে?
সাহেব, পুলিশ আমাদের খুব হয়রান করেছে। চড় থাপ্পড় মেরেছে। কিন্তু আমি বা বলরাম আমরা মেমসাহেবকে খুন করতে যাব কেন বলুন! আমরাই তো তা হলে ভাতে মরব।
ঘর থেকে কিছু চুরি গিয়েছিল বলে মনে হয়?
ঘরের জিনিসপত্র সবই আমি চিনি। সেসব কিছু চুরি যায়নি। তবে মেমসাহেবের ব্যাগ বা সুটকেস থেকে কিছু চুরি গিয়ে থাকলে তা বলতে পারব না। মেমসাহেবের জিনিস তো আমি ধরতাম না।
এবার যা জিগ্যেস করব খুব ভেবেচিন্তে তার জবাব দেবে।
বলুন সাহেব।
মাসখানেক আগে মেমসাহেব যখন এলেন তখন কি একাই এসেছিলেন?
হ্যাঁ সাহেব। মেমসাহেবের ফ্লাইট দেরিতে এসেছিল। আমার ওপর হুকুম ছিল সব রেডি রাখতে।
উনি কখন আসেন?
সন্ধেবেলা। সতুবাবু ওঁকে এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে আসেন।
সতুবাবু ছাড়া আর কেউ ছিল না?
না সাহেব।
সুব্রতবাবু কবে আসেন?
ছোটসাহেব তো মেমসাহেব মারা যাওয়ার পরে আসেন, খবর পেয়ে।
এসে উনি কী করলেন?
উনি এ বাড়িতে ওঠেননি। কলকাতায় ওঁর বাড়ি আছে, সেখানে উঠেছিলেন।
সুব্রতবাবু কি কখনও এ বাড়িতে উঠতেন না?
বেশিরভাগ সময়ে মেমসাহেব একাই আসতেন। ছোট সাহেবকে আমি খুব একটা দেখিনি।
ঠিক আছে। তুমি যেতে পারো। গিয়ে পাঁচ মিনিট পর বলরামকে পাঠিয়ে দাও।
ভিখু চলে যাওয়ার পর টেপ রেকর্ডারটা বন্ধ করে শবর উঠল। এটাই ছিল মিসেস বকশির শোওয়ার ঘর! খাঁটি আবলুশ কাঠের বিশাল একটা খাট, যার মাথার দিকটা সিংহাসনের মতো কাজ করা। দেরাজ আলমারি সবই একই কাঠের এবং ঝকমক করছে। তাদের পালিশ।
আসবাবগুলো সেকেলে, ভারী এবং অতিশয় মূল্যবান। ঘরে ওয়াল-টু-ওয়াল কার্পেটটাও পুরনো বটে, কিন্তু বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। বাড়ির স্থাপত্যও আধুনিক নয়। পুরনো ব্রিটিশ আমলের প্যালেসের আদলে তৈরি। ঘরটা বিশাল, লাগোয়া দক্ষিণের বারান্দাটিও চমৎকার সোফাসেট দিয়ে সাজানো। আধুনিক জিনিস বলতে শুধু এয়ারকুলার লাগানো আছে ঘরে। শোওয়ার ঘরের একপাশে নিচু ক্যাবিনেটের ওপর দুটো বড় সুটকেস। আমেরিকায় তৈরি। সন্ট লাগেজ। কালচে রঙের সুটকেস দুটোই আটকে সিল করে দিয়ে গেছে পুলিশ। সুটকেস দুটো খোলার অধিকার আছে শবরের, কিন্তু সে খুলল না।
আসব স্যার?
এসো।
মধ্যবয়সি মজবুত চেহারার বলরাম শঙ্কিত মুখে ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়াল।
তুমিই তো দারোয়ান?
হ্যাঁ স্যার।
কতদিন কাজ করছ এ বাড়িতে?
কুড়ি বছর।
বাড়ির মালিককে তো তা হলে ভালই চেনো।
মাথা নেড়ে বলরাম বলে, না স্যার। মালিকরা কেউ তো এখানে থাকতেন না। ওঁরা অনেক বছর আমেরিকায়, দিদিমণির জন্মও তো হয়েছে ওখানেই। আমি ফাঁকা বাড়ি সামলে রাখতাম।
তোমার কাজ তা হলে কী?
কাজ বলতে কিছুই নেই। শুধু বসে থাকা।
কত মাইনে পাও?
আড়াই হাজার।
মাইনে তো ভালই।
যে আজ্ঞে, আমি একা লোক, চলে যায়।
একা কেন, পরিবার কোথায়?
আমি বিয়ে করিনি স্যার। মা বাবা মারা গেছেন। কেউ বিশেষ নেইও।
তুমি এ বাড়িতেই থাকো? হ্যাঁ
স্যার। গেট-এর পাশেই আমার ঘর। চব্বিশ ঘণ্টা ডিউটি।
খুনের দিন সকালবেলা যে ভদ্রলোক এসেছিল তাকে মনে আছে?
হ্যাঁ স্যার। ওঁর অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল।
দিদিমণির কি অনেক অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকত?
না। বাড়িতে বেশি লোক আসত না।
লোকটা এসে কী করল?
নাম বলল, আমি খাতা খুলে মিলিয়ে নিয়ে ছেড়ে দিলাম। এক ঘণ্টা পর উনি চলে যান।
তখন তুমি কী লক্ষ করেছিলে?
বাবুর বাঁ-গাল কেটে গিয়েছিল। রুমাল চাপা দিয়ে রেখেছিলেন।
তোমার কী মনে হল তখন?
কিছু ঝামেলা হয়ে থাকবে। ভিখুকে জিগ্যেস করেছিলাম। ভিখু বলল দু’জনে ঝগড়া হয়েছিল, দিদিমণি বাবুকে খিমচে দেন।
সুব্রতবাবু কি এ-বাড়িতে আসত না?
খুব কম স্যার। দিদিমণির বিয়ে হয়েছে ষোলো-সতেরো বছর। দু-তিনবারের বেশি জামাইবাবুকে দেখিনি ভাল করে।
দিদিমণি কি প্রতি বছর নিয়ম করে দেশে আসতেন?
না স্যার। এক-দুই বছর বাদও যেত। শুনছিলাম এ বাড়ি বিক্রি করে দিদিমণি এবার আমেরিকাতেই থাকবেন, দেশের পাট চুকিয়ে। এখন যে কী হবে তা বুঝতে পারছি না। চাকরিটা তো যাবেই। বুড়ো বয়সে খুব অসুবিধেয় পড়তে হবে।
টাকাপয়সা জমাওনি?
কিছু জমিয়েছি স্যার, পোস্টঅফিসে আছে। কিন্তু সেই সামান্য টাকায় কি জীবন কাটবে? টাকার দাম তত কমে যাচ্ছে, কতদিন বাঁচব তার ঠিক কী?
তোমার শরীর তো মজবুত, এখনও খাটতে পারো।
যে আজ্ঞে। কিন্তু লোকে কাজই দিতে চায় না।
চেষ্টা করছ নাকি?
সতুবাবু কয়েকমাস আগেই বলে দিয়েছেন যে, বাড়ি বিক্রির চেষ্টা হচ্ছে, আমি যেন অন্য ব্যবস্থা দেখে নিই। তাই একটু-আধটু চেষ্টা করেছি।
খুনের সময়ে তুমি কোথায় ছিলে?
থানায়। ঝুটমুট আমাকে হয়রান করা হল স্যার। বেলা একটা হবে তখন। একজন সার্জেন্ট মোটরবাইক চেপে এসে বলল, থানার বড়বাবু নাকি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছে, এখনই যেতে হবে।
কেন ডেকেছে তা বলেনি?
বলল, কেন ডেকেছে জানি না, তবে বলে দিয়েছে যেতে না চাইলে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যেতে। বলেই চলে গেল। আমি তাড়াতাড়ি গিয়ে দিদিমণিকে বললাম। দিদিমণি তখন বিছানায় শোয়া। হাত নেড়ে বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে, যাও।
দিদিমণি কি তখন কাঁদছিলেন?
ঠিক বুঝতে পারিনি। হতেও পারে। গলাটা ভারী লাগছিল।
তারপর বলো।
থানায় গেলাম, তা সেপাই আটকাল। কিছুতেই বড়বাবুর কাছে যেতে দেবে না। তখন বললাম বড়বাবুই ডেকে পাঠিয়েছেন। অনেক তত্ত্ব তালাসের পর বড়বাবুর ঘর দেখিয়ে দিল। গিয়ে যখন নামটাম বললাম বড়বাবু কিছুই বুঝতে পারেন না। যখন বললাম সার্জেন্ট গিয়ে এত্তেলা দিয়েছে তখন বড়বাবু বললেন, তা হলে সিরিয়াস কেসই হবে। আর একজন অফিসারকে ডেকে বললেন, এর একটা স্টেটমেন্ট নিন তো, মনে হচ্ছে সিরিয়াস কেস৷ তা সেই অফিসার আমাকে আর-একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করে বলল, ধুস, একটা মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে বোধহয়। বলে নামধাম নিয়ে ছেড়ে দিল।
তখন কটা বাজে?
তা তিনটে-সাড়ে তিনটে হবে।
গেট ততক্ষণ খোলা ছিল?
তালা ছিল না। তবে ফটকে আগল দিয়ে গিয়েছিলাম।
দিদিমণি যে খুন হয়েছে তা কখন বুঝলে?
সাড়ে চারটে নাগাদ ভিখু এসে বলল।
কী করলে তখন?
খুব ভয় পেয়ে গেলাম। আমরা গরিব মানুষ স্যার, বিশেষ লেখাপড়াও জানি না, কী থেকে কী হয় ভেবে আমরা সহজেই ভয় পাই। একবার তো ভেবেছিলাম পালিয়ে যাব। তারপর মনে হল হিতে বিপরীত হবে। তাই পুলিশে খবর দিই। পুলিশ স্যার, আমাদেরই ধরে নিয়ে গেল। তারপর অনেক জল ঘোলা হওয়ার পর সতুবাবু গিয়ে ছাড়িয়ে আনেন।
দিদিমণি কীভাবে খুন হয়েছেন জানো?
কেউ গলা টিপে খুন করে গেছে। যে গলা টিপেছে তার হাতে নাকি দস্তানা ছিল।
ঠিক কথা। আর কিছু বলতে পারো?
কী বলব স্যার?
তোমার কি কাউকে সন্দেহ হয়?
না স্যার, কাকে সন্দেহ করব?
দিদিমণি খুন হওয়ার আগে এ-বাড়ির সামনে দিয়ে কোনও একজন বা দু’জন লোককে বারবার যাতায়াত করতে দেখেছ? কিংবা কোনও অচেনা লোক কি গায়ে পড়ে তোমার সঙ্গে আলাপ জমাতে চেয়েছে?
এ তো বড়লোকদের পাড়া স্যার। লোকের যাতায়াত কম, তবে আমি বেকার বসে থাকি বলে আশপাশের বাড়ির চাকর দারোয়ানরা মাঝে মাঝে এসে গল্পটল্প করে যায়।
অচেনা কেউ?
না স্যার, মনে পড়ছে না। গেটের কাছে টুলে বসে থাকলে অবশ্য অনেকে বাড়ির হদিশ চায়, এত নম্বর বাড়িটা কোনদিকে হবে এইসব।
ঠিক আছে, তুমি যেতে পারো। সতুবাবু একটু বাদেই আসবেন। তিনি এলেই সোজা আমার কাছে নিয়ে এসো।
ঠিক আছে স্যার। ভিখুকে কি আপনার জন্য চা করতে বলব স্যার?
বলতে পারো।
বলরাম চলে যাওয়ার পর শবর ঘুরে ঘুরে বাড়ির দোতলাটা দেখছিল। ইটালিয়ান মার্বেলের মেঝে। দারুণ সুন্দর সব রঙের কম্বিনেশন। বাথরুমে খুব আধুনিক ফিটিংস লাগানো। প্রতি ঘরেই নানারকম সাবেকি আসবাব। দুই আলমারি বোঝাই বিলিতি আর জাপানি পুতুল। পিয়ানো, অর্গান ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র রাখা প্রকাণ্ড হলঘরে। বিশাল বিশাল ঝাড়বাতি। অথচ এ বাড়িতে থাকার লোকই নেই। অন্তত বিগত চল্লিশ বছর ধরে বাড়ি ফাঁকা পড়ে আছে।
বিকেল পাঁচটা নাগাদ সতুবাবু বিশাল গাড়ি করে এলেন। বছর পঁয়তাল্লিশ-ছেচল্লিশের ফরসা নাদুশনুদুশ মানুষ। মোটা গোঁফ আছে। পরনে প্যান্ট আর হাওয়াই শার্ট।
নমস্কার মিস্টার দাশগুপ্ত।
আসুন।
আপনার তদন্ত কতদূর?
চলছে।
আমার কাছে কী জানতে চান বলুন।
এবাড়ির ওয়ারিশান কে?
বাড়ির ওয়ারিশান এখন সুব্রত। স্বাভাবিক আইনে।
এবাড়ি কি বিক্রি হওয়ার কথা চলছিল?
হ্যাঁ, অরুর তো সেরকমই ইচ্ছে ছিল। কলকাতার পাট তুলে দেবে বলেছিল।
সুব্রতবাবুরও কি তাই ইচ্ছে?
সুব্রতর বোধহয় একটু অমত আছে।অরুণিমা বলছিল সুব্রত এরকম প্রস্তাবে খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছে না।
কোনও কারণ আছে?
তা জানি না।
সুব্রতবাবুদের এখানকার বাড়ির অবস্থা কেমন?
মুখটা একটু বিকৃত করে সতুবাবু বললেন, অবস্থা আবার কেমন হবে? ছিল তো বনগাঁর রিফিউজি ক্যাম্পে। তারপর বিধানপল্লিতে কোনওরকমে টিনের ঘর করে থাকত। এখন অবশ্য পাকা ঘর হয়েছে শুনেছি, তা তারও অনেক ভাগীদার। ওর কাকা-জ্যাঠাদেরও নাকি ও বাড়ির শেয়ার আছে। সুব্রতর বাবা তো চিরকালের ভ্যাগাবন্ড। কোন একটা কো অপারেটিভে সামান্য বেতনের চাকরি করত। ভাগ্য ভাল ছেলেটা হল ব্রিলিয়ান্ট। সেই জোরেই আমেরিকা গেল। এই তো ওদের হিস্ট্রি। এখন বুঝে নিন।
অরুণিমা দেবী আর সুব্রতবাবুর কি লাভ ম্যারেজ?
হ্যাঁ মশাই, নইলে মনাকাকা কখনও এই পরিবারে মেয়ের বিয়ে দেয়? তবে সুব্রত ব্রিলিয়ান্ট ছেলে বলে কাকা আপত্তি করেননি।
ওদের দাম্পত্য সম্পর্ক কেমন ছিল জানেন?
আগে তো ভালই ছিল। ইদানীং অরু কিছু অনুযোগ করছিল।
কীরকম অনুযোগ?
এমনিতে কংক্রিট কিছু নয়। অরু চাপা স্বভাবের মেয়ে ছিল। তবে নানা কথায় দু’-একটা মন্তব্য করে ফেলত।
ওঁদের সন্তানহীনতাই কি তার জন্য দায়ী?
না মশাই, সন্তানের জন্য দুঃখ সে তো থাকতেই পারে। তাতে কি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হয়?
হয়। সন্তান একটা মস্ত বড় ফ্যাক্টর।
মানছি। কিন্তু ওদের সম্পর্কটা খারাপ হয়ে থাকলে হয়েছে অন্য কারণে।
সেই কারণটা কী?
জানি না।
মিসেস বকশি আপনার খুড়তুতো বোন?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
আপনার কাকার অবস্থা তো খুবই ভাল ছিল দেখছি।
আমরা ব্যবসায়ী পরিবার। মনাকাকার তো জাহাজ ছিল। সেসব অনেক ব্যাপার।
এ বাড়িটা কি আপনার মনাকাকাই করেছিলেন?
না। আমার দাদুর তৈরি বাড়ি। চার ছেলের জন্য চার জায়গায় উনি বাড়ি করে রেখে গেছেন।
সবকটা বাড়িই এরকম ভাল?
বড়কাকার আলিপুরের বাড়িটা আরও ভাল।
এ বাড়ি কি বিক্রি ঠিক হয়ে গেছে?
সবই তো পাকা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন আবার সব কেঁচে যাবে বলে মনে হয়। এখন তো অরু নেই, সুব্রত মালিক। সে রাজি না হলে বিক্রি আটকে যাবে।
উনি কি বিক্রি করতে রাজি নন?
আমার সঙ্গে কথা হয়নি। কিন্তু অরুর কাছে যা শুনেছি তাতে মনে হয় সুব্রত রাজি হবে না।
দারোয়ান আর চাকর দু’জনেই বলেছে যে, সুব্রতবাবু নাকি এ বাড়িতে আসতেন না।
ঠিকই বলেছে। কলকাতায় এলে সুব্রত ওদের কলোনির বাড়িতেই থাকত। অরুণিমা থাকত এ বাড়িতে। তবে ওরা কেউই এখানে এসে বেশিদিন থাকত না। বড়জোর পনেরো কুড়ি দিন।
অরুণিমা দেবীর জন্ম তো আমেরিকায়। আপনাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন কী করে?
আমাদের পরিবারের অনেকেই বিদেশে আছে। আমি নিজে বেশ কয়েক বছর আমেরিকায় ছিলাম। তখন অরু ছোট। আমি ওর নিজের দাদার চেয়েও বেশি ছিলাম।
খুনের খবরটা আপনি কখন পান?
সেইদিনই বিকেলে। ভিখু ফোন করে আমায় জানায়।
আপনার নিজের কোনও ডিডাকশন আছে কি?
মাথা নেড়ে সতুবাবু বললেন, না মশাই, এ একেবারে বিনা মেঘে বজ্রপাত। অরুকে কে কেন খুন করবে তা আমি আজ অবধি বুঝে উঠতে পারিনি। মিহির বলে ছোরাটারই বা কী স্বার্থ ওকে খুন করার তাও জানি না।
মিহিরের সঙ্গে অরুণিমা দেবীর সম্পর্কটা কীরকম ছিল, জানেন?
একেবারে জানি না বললে ভুল হবে। ঘাসে মুখ দিয়ে তো চলি না। অরুণিমা ওর প্রতি সট ছিল।
আপনার কাছে অরুণিমা কিছু বলেছেন কি?
খুব পরিষ্কার করে নয়।
উনি কি সুব্রতবাবুকে ডিভোর্স করার কথা ভাবছিলেন?
আমাকে খুলে কিন্তু বলেনি। তবে অরুর হাবভাব দেখে মনে হয় সুব্রতর প্রতি ওর আর তেমন টান নেই।
তার জন্য মিহিরবাবুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাই কি দায়ী?
তাও জানি না মশাই।
সুব্রতবাবুকে আপনার কেমন লোক বলে মনে হয়? সতুবাবুর মুখটা ফের বিকৃত হল। তারপর একটু হেসে বলল, কিছু মনে করবেন না মশাই, নিজের মুখেই বলছি উই আর ভেরি রিচ পিপল। বনেদি বড়লোক। সুব্রতরা হল এ ক্লাস অ্যাপার্ট, সুব্রত নিজের যোগ্যতায় ওপরে উঠেছে বটে, কিন্তু ওদের কালচার আর রুচি তো সেই নিম্নমধ্যবিত্তই রয়ে গেছে। ওদের টাকা হলে লোক দেখানো বড়লোকি করতে থাকে। বনেদি পরিবার অন্যরকম হয়। সুব্রতকে অরুর সঙ্গে আমার মিসফিট বলেই মনে হয়েছে।
তা তো বুঝলাম। কিন্তু সুব্রতবাবু লোকটি কেমন?
মাপ করবেন, আমি জানি না। দু-চারবার দেখা হয়েছে, হেসে দু-চারটে কথাও কয়েছে, কিন্তু ওকে স্টাডি করিনি কখনও।
অরুণিমা দেবীও কি ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রী ছিলেন?
হ্যাঁ, ওদেশে স্কুলে কলেজে ওর স্কোর দুর্দান্ত। যে জাপানি কোম্পানিতে ওরা দু’জনে কাজ করে তাতে অরুর পজিশনই বেটার।
দু’জনের মধ্যে কি প্রফেশনাল জেলাসি ছিল?
কী জানি, অত জানি না।
সুব্রতবাবুর এক বোন এখন আমেরিকায় আছে, জানেন?
জানি মশাই, জনা, শুটকি মেয়েটার বোধহয় এখানে বর জুটছিল না তাই সুব্রত ওকে নিয়ে গিয়েছে। মার্কিন গন্ধ মাখিয়ে পাত্রস্থ করবে।
শুনেছি মেয়েটা লেখাপড়ায় ভাল।
তা হতে পারে। অরু তো ওকে দু’চক্ষে দেখতে পারত না।
কেন?
বলত খুব ন্যাকা টাইপের মেয়ে, ভাবুক ভাবুক ভাব করে থাকে। আসলে ভিজে বেড়াল।
আপনি নিম্নমধ্যবিত্তদের খুব ঘেন্না করেন, না?
এবার সতুবাবু তটস্থ হয়ে হেসে ফেললেন, আরে না মশাই, ঘেন্না করব কেন? সমাজের নানা স্তর তো থাকবেই, নইলে সমাজ বলেছে কেন? আসলে কালচার ক্রস হলেই প্রবলেম দেখা দেয়। অরুর ক্ষেত্রে যা ঘটেছে। মানুষকে তো ঘেন্না করার কিছু নেই।
শুনে স্বস্তি পেলাম।
৩. ইউ হেট উইমেন
ইউ হেট উইমেন।
দ্যাটস নট ট্রু।
আই নো, ইউ হেট গার্লস। অল গার্লস।
তা নয়। বলতে পারেন আমি নিস্পৃহ।
ইউ মিন প্যাসিভ।
অনেকটা তাই। আমি খেটে-খাওয়া মানুষ, নন-রোমান্টিক।
খেটে-খাওয়া মানুষেরা বুঝি রোমান্টিক হতে পারে না?
তা পারে। কিন্তু আমি বোধহয় মনের দিক দিয়ে শুষ্ক।
আসল কথাটা স্বীকার করলেই তো হয়, ইউ আর অ্যান্টি ফেমিনিন।
অতবড় কথাটা স্বীকার করি কী করে?
কখনও প্রেমে পড়েছেন?
প্রেমে পড়তে দিল কই মেয়েরা? তার আগেই যে মেয়েরা আমাকে ব্যবহার করে ফেলল। ব্যবহৃত হয়ে হয়ে প্রেমটাই গেল হারিয়ে।
ব্যবহার মানে? সেজুয়ালি?
তা ছাড়া আর কী?
আপনি একটু শেমলেস, খোলাখুলি কেউ ওসব বলে?
ট্রুথফুল হতে গেলে বোধহয় একটু শেমলেস হতেই হয়। না?
আপনি বাজে লোক।
অনেকে তাই বলে বটে।
আপনার নিজের কী ধারণা?
বোধহয় খুব ভাল লোক নই।
এটা বিনয় নয় তো?
না-না, আমার ডিফেক্টগুলো সম্পর্কে আমি ওয়াকিবহাল।
আর কী কী ডিফেক্ট আছে আপনার?
লম্বা লিস্ট হয়ে যাবে ম্যাডাম। দোষগুলো না দেখলেই হয়।
এই তো বললেন আপনি ট্রুথফুল, কীরকম সততা আপনার?
অন্তত ডিজঅনেস্ট নই। কিন্তু ম্যাডাম, এই যে রোজ রাত বারোটায় আপনি আমাকে ফোন করে এসব খবর নেন এর পিছনে মতলবটা কী?
অ্যাসেস করা।
নিজের পরিচয়টাও আজ অবধি দেননি।
একটা নাম তো! যা হোক একটা ভেবে নিন না।
আপনি তা হলে কিছুতেই নিজের নাম পরিচয় দেবেন না?
ওটা ইররেলেভ্যান্ট।
আপনি পুলিশের লোক নন তো!
হলেই বা ক্ষতি কী?
না, ক্ষতি আর কী? যা ক্ষতি হওয়ার তো হয়েই গেছে।
কী ক্ষতি হয়েছে শুনি?
পুলিশ আমাকে মারধর করেছে, অপমানজনক গালাগাল দিয়েছে, তার ওপর মার্ডারের চার্জ চাপিয়ে দিয়েছে।
আপনি কি বলতে চান মিসেস বকশিকে আপনি খুন করেননি?
বললেই বা বিশ্বাস করছে কে বলুন।
কেউ না করলে জামিন পেলেন কী করে?
শবর দাশগুপ্ত নামে এক ভদ্রগোছের গোয়েন্দার দাক্ষিণ্যে। শেষ রক্ষা হবে কিনা জানি না। জামিন তো আর অ্যাকুইটাল নয়।
শবর দাশগুপ্ত খুব ইন্টেলিজেন্ট গোয়েন্দা।
হলেই বা। শবর দাশগুপ্ত একা কী করবে? গোটা পুলিশ ফোর্স তো আমার বিরুদ্ধে।
মিসেস বকশি কি আপনাকে ভালবাসতেন?
উনি তো সেরকমই বলতেন।
তার মানে আপনি ওঁর ভালবাসাকে বিশ্বাস করতেন না?
না।
ওমা! কেন? ভালবাসাকে কি বিশ্বাস না করা যায়?
ভালবাসা অনেক সময়েই কতগুলো আবেগ বা স্বার্থকে নিয়ে তৈরি হয়। স্বার্থ আহত হলে বা আবেগ উবে গেলে ভালবাসাও হাওয়া। বুঝলেন ম্যাডাম?
আপনি ভীষণ বাজে লোক। বোধহয় একটু পাষণ্ডও, তাই না?
কী জানি ম্যাডাম। নিজের সম্পর্কে আমার ভাল ধারণা নেই। বেঁচে থাকার জন্য আমাকে নানা কাজ করতে হয়। কাজ নিয়েই সময় কেটে যায়। নিজেকে নিয়ে খুব একটা ভাবি না।
কাজ আমাদের সবাইকেই করতে হয়।
তা তো বটেই।
বারবার নিজেকে অত কাজের লোক বলে জাহির করছেন কেন?
খেটে খাই তো, সে কথাটাই বোঝাতে চাইছি।
দুনিয়ায় সবাই খেটে খায়, কেউ মাথা খাটিয়ে, কেউ শরীর খাটিয়ে।
আজ্ঞে হ্যাঁ।
তা হলে আপনি তো আর পাঁচজনের চেয়ে আলাদা কিছু নন।
না, তা নই বটে।
যারা খেটে খায় বা জীবন সংগ্রাম করে তাদের তো হৃদয়বৃত্তি মরে যায় না।
আমি কি বলেছি, যে আমার হৃদয়বৃত্তি মরে গেছে?
সেরকমই তো বোঝাতে চাইছেন। যেন এত কাজ যে প্রেম পর্যন্ত শুকিয়ে গেছে।
ম্যাডাম, আমি তা বলতে চাইনি। আমি তো বলেছি মেয়েরা আমাকে বড্ড বেশি স্থূলভাবে ব্যবহার করেছে।
আপনি ব্যবহৃত হলেন কেন?
বললে আপনি চটে যাবেন।
তবু বলুন।
বায়োলজিক্যাল প্রয়োজন তো আমারও আছে।
ইস আপনি ভীষণ অসভ্য।
এই তো চটে গেলেন। এসব আপনার না শোনাই ভাল।
আর এ বিষয়ে একটাই প্রশ্ন।
বলুন।
জনা কে?
সুব্রত বকশির বোন।
কেমন মেয়ে?
ভাল মেয়ে।
সুন্দর?
সুন্দরও নয়, কুৎসিতও নয়। ওই একরকম। খুব গম্ভীর।
জনা নাকি আপনার প্রেমে হাবুডুবু?
আপনি তো সবই জানেন দেখছি।
জানি।
তা হলে আর জিজ্ঞেস করছেন কেন?
আপনার মুখ থেকে শোনার জন্য।
কী আর শুনবেন ম্যাডাম। চেষ্টা করেও জনার প্রেমে পড়তে পারিনি।
আপনার কি একজন মার্কিন স্ত্রী ছিল?
না। স্ত্রী আমার ছিল না। মেয়েটি ছিল লিভ ইন গার্লফ্রেন্ড।
এমাঃ। আপনি তো জঘন্য লোক।
ম্যাডাম, এটাই তো অর্ডার অফ দ্য ওয়ার্ল্ড।
মোটেই নয়। সুবিধেবাদীরা ওসব কথা বলে।
আমি যে সুবিধেবাদী তাতে অবশ্য সন্দেহ নেই।
সেই মেয়েটি কি খুন হয়েছিল?
মাই গড, আপনার নেটওয়ার্ক তো দারুণ।
খুন হয়েছিল, না?
হ্যাঁ।
তাকে খুন করলেন কেন আপনি?
ম্যাডাম আমার যে দু-একটা গুণকে আমি নিজেই অ্যাপ্রিসিয়েট করি তা হল আমি খুনখারাপি করতে অক্ষম।
তার মানে কী?
ওই একটা জিনিস আমি বোধহয় পারি না। আজ অবধি পারিনি।
সত্যি বলছেন? বিশ্বাস করা বা না করা আপনার হাতে।
দু-দুটো মেয়ে আপনার সংস্পর্শে আসার পর খুন হল, এটা কি কাকতালীয় বলতে চান?
আমি কিছুই বলতে চাই না। শুধু বলি, দুশ্চরিত্র হলেও আমি খুনি নই।
দুশ্চরিত্র কথাটা কিন্তু আমি বলিনি।
না। আপনি বেশ ভদ্র। বললেও কিছু মনে করতাম না।
আচ্ছা আপনি দুশ্চরিত্রই বা কেন?
ম্যাডাম, ওখানেও গণ্ডগোল আছে। আমি লম্পট হিসেবে কারও কারও কাছে চিহ্নিত বটে, কিন্তু সেটাও আমার চারিত্রিক তারল্যের ব্যাপার নয়। বরং বলতে পারেন ভিকটিম অফ সারকামস্ট্যান্সেস।
অর্থাৎ আপনি সাধুপুরুষ, মেয়েরাই আপনাকে নষ্ট করেছে, এই তো?
আকাড়া সত্যি কথা বলতে গেলে তাই বলতে হয়।
দেখুন মশাই, আপনার মধ্যে নষ্ট হওয়ার ইচ্ছে না থাকলে কোনও মেয়ে কি আপনাকে নষ্ট করতে পারত?
আপনি বেশ পিউরিটান আছেন। ব্যাপারটাকে নষ্ট হওয়া বলছেন কেন বলুন তো? বিদেশে ফিজিক্যাল নিডটাকে ওরা টয়লেটে যাওয়ার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয় না। তবে মরালিটি বা পিউরিটানিজমকে আমি অশ্রদ্ধা করি না। ওরও দাম আছে।
দামটা কি আপনি দেন?
দিই ম্যাডাম, দিই।
তবে নিজে ঠিক থাকেন না কেন?
ওই যে বললাম, আমি কেবল খেলার পুতুল হিসেবে কাজ করেছি।
এদেশে এসে ক’জন মেয়ের সর্বনাশ করেছেন?
গত এক বছরে আমার জীবনে নারীসঙ্গ বলতে কিছু নেই তেমন। মিথ্যে বলব না, দু চারটে কেস হয়ে গেছে।
রোমান্টিক ইনভলভমেন্ট না ফিজিক্যাল?
ফিজিক্যাল।
তারা কারা?
শুনবেন?
শুনিই না।
একজন এয়ার হোস্টেস, একজন বড়লোকের বয়স্কা স্ত্রী, একজন বয়স্কা অ্যাকট্রেস এবং একজন মধ্যবয়স্কা বিধবা।
সবাই বয়স্কা?
কপালে আমার দেখছি বয়স্কাই জোটে।
আপনি সত্যিই ভীষণ খারাপ।
তা তো বলাই যায়। কিন্তু এর প্রত্যেকটারই প্রয়োজন ছিল, তা কি জানেন?
না। আপনার প্রফেশনাল প্রয়োজন?
হ্যাঁ। ট্রেড লাইসেন্স, কন্ট্রাক্ট, পুলিশের ঝামেলা এইসব নানা স্বার্থে আমাকে আপনার ভাষায় নষ্ট হতে হয়েছে।
নষ্ট হতে তো আপনি ভালই বাসেন দেখছি।
তা ম্যাডাম, খারাপও কিছু লাগে না।
আবার মরালিটিকেও পছন্দ করেন।
তাও করি। আমি নিজে বিশুদ্ধ নই বলে বিশুদ্ধতাকে অস্বীকার করব কেন?
বিশুদ্ধ হতে ইচ্ছে করে না?
কোনও ফল পচতে শুরু করলে আর কি বাঁচানো যায়?
ফলে ইচ্ছাশক্তি নেই, মানুষের তো তা আছে।
ভাল বলেছেন। তবে ফের ওই কথা বলতে হয়, আমি নিমিত্ত মাত্র।
ওটা অজুহাত। আসলে আপনি একজন প্লেবয়। প্লে
বয় হতে যোগ্যতা লাগে। আমার সোশ্যাল স্ট্যান্ডিং কই? সুন্দরী তরুণীদের সঙ্গে আমার দেখা সাক্ষাৎ হওয়ার স্কোপ কম। বিশেষ করে হাই সোসাইটির। আমাকে যারা ব্যবহার করে তাদের অধিকাংশই হল বয়স্কা, সেক্স স্টাভার্ড, ফ্রাস্ট্রেটেড বা সিনিক মহিলা। ওরা আমাকে কাজে লাগায়, আমি ওদের কাজে লাগাই।
ছিঃ ছিঃ, আপনি একটা কী বলুন তো?
বলেছি তো, নিজেকে নিয়ে আমার গৌরব হয় না।
নিজেকে ঘেন্না হয় না?
না ম্যাডাম, তাও হয় না। কারণ মস্তিষ্কহীন হওয়ার ফলে আমার কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনার বালাই নেই। আর আমি তো রেপিস্ট নয়।
রেপিস্টের চেয়ে ভালও কিছু নন।
ভাল কথা রেপিস্ট শব্দটা আমার মতে একটা ভুল শব্দ। ওটা হওয়া উচিত রেপার।
ওমা। তা কেন?
যে অর্থে কমিউনিস্ট, লিরিসিস্ট, আইডিয়ালিস্ট সেই অর্থে তো রেপিস্ট হওয়া উচিত নয়। কমিউনিজম, আইডিয়ালিজম, লিরিসিজমের মতো তো রেপিজম বলে কিছু নেই। আছে কি?
না।
তা হলে রেপিস্ট হয় কী করে?
সেটা একটা প্রশ্ন বটে।
আপনি কি ইংরেজির ছাত্রী?
নিজের সম্পর্কে আমি আপনাকে কোনও কথাই বলব না।
আপনি শুধু একটি কণ্ঠস্বর হয়েই থাকতে চান?
মন্দ কী?
রহস্যময়ী হয়ে থাকতেই কি আপনি পছন্দ করেন?
হ্যাঁ।
আপনি কি জানেন যে আমি ইচ্ছে করলেই আপনার নম্বর ট্রেস করতে পারি?
নিশ্চয়ই পারেন। কিন্তু কষ্ট করে যে নম্বরটা আপনি খুঁজে পাবেন সেটা একটা পাবলিক কল বুথ।
আপনি কি বলতে চান এত রাতে আপনি একটা পাবলিক কল বুথে এসে ফোন করছেন?
তা তো বলিনি? আমি আমার বাড়ি থেকেই ফোন করছি, তবে সরাসরি নয়। একটা কল বুথের থ্রু দিয়ে। আর ওই বুথ কিছুতেই আপনাকে আমার নম্বর দেবে না।
আচ্ছা মানুষ আপনি। এত গোপনীয়তা আর সাবধানতার কী দরকার ছিল?
ছিল। আমি চাই না আপনি আমাকে ট্রেস করুন।
আপনি কি আমাকে ভয় পান না কি ঘেন্না করেন?
কোনওটাই না।
নিছক কৌতূহল?
যা হোক একটা কিছু হবে।
একজন অচেনা মহিলা আমাকে রাত বারোটায় কেন ফোন করেন তার কারণটা কি আমার জানা উচিত নয় বলে মনে করেন?
আপনার কি খারাপ লাগছে? তা হলে বলুন ছেড়ে দিই।
আরে না, ইনফ্যাক্ট আপনার গলার স্বরটা এত ভাল যে আই ফিল অ্যাট্রাক্টেড টু ইট। আর আপনি বেশ ইন্টেলিজেন্টও বটে। সেইজন্য আমি আজকাল আপনার ফোনের জন্য অপেক্ষাই করি।
আপনার কি মনে হয় আমি আপনার বিবেকের ভূমিকা নিচ্ছি?
তা একটু মনে হয়। তবে সেটা খারাপই বা কী বলুন! আমার বিবেক জাগ্রত নেই। তাই আর কেউ বিবেকের বিকল্প হতে চাইলে তা ভালই।
আপনার ঘুম পাচ্ছে না তো।
না। আমি সারাদিনে কাজের ফাঁকে ফাঁকে দু-পাঁচ মিনিট করে ঘুমিয়ে নিই। আমার অনেক কালের অভ্যেস। ওভাবেই আমার চার-পাঁচ ঘণ্টা ঘুম হয়ে যায়। অ্যান্ড দ্যাট ইজ এনাফ।
যাক, তা হলে বিরক্ত হচ্ছেন না?
না, বরং বেশ ভাল লাগছে। আপনি কি রবীন্দ্রসংগীত বা ওরকম কিছু গান নাকি?
কেন বলুন তো?
বেশ মিউজিক্যাল ভয়েস।
গাইলেই কি বলব নাকি?
ও, আপনি তো আবার পণ করেছেন নিজের সম্পর্কে কিছু আমাকে বলবেন না।
না। এবার বলুন তো, মিসেস বকশি আপনাকে কেন ডেকেছিলেন?
এমনি। পুরনো চেনার সূত্রে।
এড়িয়ে যাচ্ছেন তো?
কথাটা কি আগে হয়নি?
হয়েছে, কিন্তু আপনি ভাঙছেন না।
আসলে ভসভসে আবেগ ভালবাসার কথাই বলছিলেন তিনি সেদিন। আমাকে বিয়ে করারও প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
রাজি হননি বলেই কি রেগে গিয়েছিলেন?
হ্যাঁ।
আপনাকে কি উনি কোনও লোভ দেখাননি?
তাও দেখিয়েছিলেন। কী করে জানলেন আপনি?
সিম্পল লজিক।
আপনি খুব বুদ্ধিমতী।
বলুন না।
হ্যাঁ, উনি আমাকে সেদিন অনেক টাকা অফার করেছিলেন। টাকাটা নিলে তিনটে ট্রেলার কেনার সব ব্যাঙ্ক লোন আমার শোধ হয়ে যেত।
কত টাকা?
ওঁর যা অফার ছিল তা দু-আড়াই কোটি টাকা তো হবেই।
আপনি রিফিউজ করলেন। বোকা নাকি?
ম্যাডাম, একজন ভদ্রলোককে এক জায়গায় তো থামতেই হয়। লাইন অফ কন্ট্রোল। তা নইলে যে নিজের মুখ আয়নায়ও দেখা যাবে না।
হঠাৎ মরালিটি জেগে উঠল নাকি আপনার?
তাও বলতে পারেন। আমার মনে হল এই ভদ্রমহিলাকে যদি এখনই আমি সত্যি কথাটা বলে না দিই তা হলে পৃথিবীর আহ্নিক গতি থেমে যাবে।
যাঃ। আপনি তো আর গঙ্গাজলে ধোয়া তুলসীপাতা নন মশাই।
না, তা নই। তবু আই কনফেসড।
কী বললেন ভদ্রমহিলাকে?
আপনার প্রশ্নগুলো ঠিক পুলিশের মতোই।
হয়তো আমি পুলিশেরই লোক। বলতে আপত্তি আছে?
আরে না। আমি হলাম খোলা বই। আপত্তির কী আছে? আমি খুব বিনয়ের সঙ্গেই বললাম, আমার টাকাপয়সা রোজগার করতে ভাল লাগে ঠিকই, কিন্তু অযথা অর্থপ্রাপ্তিতে আমার আনন্দ হয় না। দ্বিতীয়ত, খুব বেশি টাকাও আমাকে আনন্দ দেয় না এবং আত্মবিক্রয় করার মধ্যেও আর আমি এন্টারটেনমেন্ট খুঁজে পাই না।
বাঃ বেশ বলেছেন তো! লাইক এ কারেজিয়াস ম্যান? লাইক এ ম্যান অফ স্ট্রং ক্যারেক্টার।
ঠাট্টা করছেন? তা করতেই পারেন। আমার রেকর্ড তো ভাল নয়।
ঠাট্টা করলাম বুঝি?
তা হলে?
কমপ্লিমেন্টই দিলাম তো?
তা হলে অন্যরকম শোনাল কেন? একে ব্যাজস্তুতি বলে না?
আমি অত বাংলা জানি না। ভদ্রমহিলা কী করলেন?
শি ওয়াজ অন হার নিজ। হাঁটু গেড়ে বসা যাকে বলে।
এতটা? শুনেছিলাম উনি বেশ ব্যক্তিত্বওয়ালা মানুষ।
তাই ছিলেন। ক্ষুরধার বুদ্ধি, চমৎকার মেধা, স্ট্রং লাইকস অ্যান্ড ডিসলাইকস। কিন্তু কোনও কারণে আমার ওপর অবসেশনটা একটা অপটিমামে পৌঁছেছিল। দেখলাম উনি প্রায় পাগলামি করছেন।
কেন যে অ্যাকসেপ্ট করলেন না?
সেটা যে মিথ্যাচার হত ম্যাডাম। ওঁর সঙ্গে আমার শরীরের সম্পর্ক ছিল ঠিকই, মনের সম্পর্ক কখনও নয়। আর একটা কথা হল, ওঁর এই ম্যাডনেস দীর্ঘস্থায়ী ব্যাপার নয়। ওঁর প্যাশনটা ছিল অস্থির এবং উৎকেন্দ্রিক।
আপনি খুব শক্ত শক্ত বাংলা বলেন, তাই না?
না ম্যাডাম, বাংলা কী করে জানব? আমি ঘোর অশিক্ষিত।
অশিক্ষিত কেন?
মাধ্যমিক পাশ করার পরই সার্কাস দলে চলে যাই বাড়ি থেকে পালিয়ে। তারপর কসরত করে করেই তো সময় পার হয়ে গেল। এখন মনে হয়, পড়াশোনা করলে বোধহয় জীবনটা অন্যরকম হত।
কেন, এই জীবনটা কি আপনার ভাল লাগে না?
ব্যাবসা মানেই হচ্ছে প্রতিদিন অসতের সঙ্গে আপস করে চলা। তিনটে বিশাল ট্রেলার আছে আমার। এগুলোকে খাটিয়ে পয়সা রোজগার করতে এদেশে কালঘাম ছুটে যায়। কত দেবতার যে প্রণামী দিতে হয় ভাবতে পারবেন না। পুলিশ, প্রশাসন, ইন্টারন্যাশনাল বর্ডার সিকিউরিটি থেকে গুন্ডা, মস্তান–কে কার চেয়ে কম যায় বলুন। তা ছাড়া রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো তো আছেই, অ্যাক্সিডেন্ট, ডাকাতি, চুরি। ব্যাবসা মানেই হল কনস্ট্যান্ট হেডেক অ্যান্ড টেনশন।
অন্য ব্যাবসা করুন না। যেখানে এত টেনশন নেই?
আমি যেটা ধরি সেটার শেষ অবধি দেখতে চেষ্টা করি। এটা ফেল করলে অন্য রাস্তা ধরতে হবে।
ফেল করছে কি?
না না, তা বলিনি। আয় মোটামুটি ভালই হয়।
আমি তো শুনেছি আপনি বেশ পয়সাওয়ালা লোক।
তা বললে বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। পয়সা আসে যায়। আমার দুঃখ কিছু নেই অবশ্য। বেশি বড়লোক হতে আমি কখনও চাইনি।
মদ খান না?
শরীর সচেতন ছিলাম তো, তাই নেশাটেশা করতাম না। অভ্যাসটা তাই হয়ে ওঠেনি। তবে পার্টিটার্টিতে ভদ্রতার খাতিরে এক-আধ সিপ খেয়েছি, প্রেজুডিস নেই। কিন্তু এসব প্রশ্ন কেন? মদ্যপান আজকাল ভাইসের মধ্যে পড়ে না। সবাই খায়।
আপনি খুব শক্তপোক্ত লোক, তাই না? গায়ে ভীষণ জোর?
গায়ের জোর ফালতু জিনিস। ও দিয়ে কিছু হয় না।
আপনি কি একটু গুন্ডা গোছের লোক?
বরং ঠিক উলটো। আমি ভীষণ ঠান্ডা মাথার লোক। রাগ নেই। শুনলে অবাক হবেন, আমি মারপিট করিনি কখনও। ঝগড়াঝাটির উপক্রম দেখলে পালিয়ে আসি।
তার মানে কি কুল কাস্টমার?
তা বলতে পারেন। আমার সম্পর্কে আপনার সোর্স অফ ইনফর্মেশনটা কে বলুন তো?
সেসব কিছুই বলা যাবে না।
আপনিও একজন কুল কাস্টমার, তাই না?
হ্যাঁ। মিসেস বকশিকে কে খুন করেছে বলে আপনার মনে হয়?
নো আইডিয়া।
বাড়িতে তো লোকজন আছে। দুপুরবেলা কী করে খুনটা করল বলুন তো?
সেটা নিয়ে পুলিশ তো ভাবছেই।
আপনার সিক্সথ সেন্স কী বলে?
ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলে আমার কিছু নেই। খুনটা নিয়ে আমাকে প্রচণ্ড হ্যারাস করেছে পুলিশ। হাতজবাসও করতে হয়েছে। শবর দাশগুপ্ত এসে না পড়লে কী যে হত কে জানে।
আপনার অ্যালিবাই নেই?
একেবারে নেই যে তা নয়, কিন্তু খুব দুর্বল অ্যালিবাই, পুলিশ বিশ্বাসই করছে না।
শবর দাশগুপ্ত কি আপনাকে বিশ্বাস করে?
বিশ্বাস? হাসালেন ম্যাডাম। শবর দাশগুপ্তর চোখ দেখেছেন? বাঘের চোখ, বিশ্বাস করার ধাত নয়। তবে মনে যা-ই থাক, লোকটা মুখে ভদ্র এবং লজিক্যাল। হয়তো আমাকে বেনিফিট অফ ডাউট দিয়েছে।
আপনার জামিন কে দিলেন?
আমার উকিল সদাশিব মজুমদার।
খুনি যদি ধরা না পড়ে তা হলে কি আপনাকে আবার ধরে নিয়ে যাবে?
সেটাই তো স্বাভাবিক।
আপনি ভয় পাচ্ছেন না?
ভয় না হলেও উদ্বেগ তো আছেই। তবে আমার তো কেউ নেই। বুড়ো বাবা আর মা। তবে তারা একটা জীবন আমার জন্য এত উদ্বেগ পুইয়েছেন যে, তাঁদের গা-সওয়া হয়ে গেছে।
আপনার ব্যাবসার কী হবে?
উড়ে-পুড়ে যাবে। হিসেব করে দেখেছি, চোদ্দো বছর হাজতবাস করলে যখন বেরোব। তখন আমার বয়স হবে চুয়াল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ। জীবন ফের শুরু করা যাবে। আর যদি ফাঁসিতে লটকে দেয় তো ল্যাটা চুকেই গেল।
ফাঁসি।
তাও হতে পারে, এদেশে মৃত্যুদণ্ড এখনও বহাল আছে। আমি অবশ্য আইনকানুন তেমন জানি না।
খুনটা আপনি কি করেননি?
কেন করব বলুন তো! মিসেস বকশিকে মেরে আমার কী লাভ? কোনও প্রতিশোধস্পৃহা নেই, ওঁর সম্পত্তি পাব না, জেলাসি নেই। খুনটা তবে করব কেন?
মোটিভ? সে তো কতরকমের থাকে। আপনি হয়তো সাইকোপ্যাথ।
আপনি যা খুশি ডিডাকশন করতেই পারেন। তার ওপর তো আমার হাত নেই।
আপনার উচিত পুলিশের কাজে খুশি না থেকে নিজেও একটু তদন্ত করা।
ও বাবা! আপনি তো ডোবাবেন দেখছি।
কেন? নিজের স্বার্থেই তো আপনার একটু উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
পাগল নাকি? পুলিশ আমার ওপর চব্বিশ ঘণ্টা নজর রাখছে। থানায় রেগুলার হাজিরা দিয়ে আসতে হয়। একটু বেচাল দেখলেই ফের খপ করে নিয়ে যাবে।
আহা, আমি বলছি আপনি বসে বসে তো একটু ডিডাকশনও করতে পারেন। কে মারতে পারে তা আন্দাজ করা আপনার পক্ষেই সবচেয়ে সহজ। কারণ, আপনি ভদ্রমহিলাকে চিনতেন, তার স্বভাব-চরিত্র এবং দুর্বলতা সবই আপনার জানা। এখানে ওঁর পরিচিত কারা আছেন তাও আপনার জানা থাকার কথা।
সব মানছি। চিন্তা যে করিনি তাও নয়। আমার ডিডাকশন করার ক্ষমতা খুব সীমাবদ্ধ। আমার কেন যেন মনে হয় এটা প্রফেশনালদের কাজ।
তার মানে?
মানে খুব সোজা। কেউ চুরি বা ডাকাতি করার মতলবে ঢোকে। মিসেস বকশি বাধা দেওয়ায় খুন করে রেখে যায়।
ডাকাতি কি কিছু হয়েছে?
পুলিশ বলতে পারছে না।
আলমারি বা সুটকেস কি ভাঙা ছিল?
না ম্যাডাম, ভাঙার তো দরকার ছিল না। মিসেস বকশিকে খুন করে ওরা ওঁর চাবি দিয়েই সবকিছু খুলেছে। কাজ সেরে ফের চাবি দিয়ে বন্ধ করে দিয়ে গেছে।
বড্ড সরল ডিডাকশন।
আমার মাথায় এর চেয়ে বেশি কোনও সম্ভাবনার কথা আসেনি যে!
আরও ভাবুন।
ভেবে মাথা ভারাক্রান্ত করা কি ঠিক হবে? বরং আমার শবর দাশগুপ্তকে খুব এফিশিয়েন্ট বলে মনে হয়। উনি হয়তো কিনারা করে ফেলতেও পারেন।
ওঁর ওপর খুব ভরসা আপনার!
হ্যাঁ, ভরসা একটু আছে। খুব স্ট্রং ভরসা নয়, তবে সামান্য একটু নির্ভর করতে পারছি। ভদ্রলোক ফেল করলে আমার কপালে কষ্ট আছে। তবে ভাগ্য ভাল যে, বিয়েটিয়ে করিনি। আমার একার ওপর দিয়ে যাবে।
মা-বাবাও তো কষ্ট পাবেন।
তা পাবে। তবে দেয়ার ডে’জ আর নাম্বারড। আমার মা-বাবা জীবনে সুখে থাকেনি। আমি যৌবনকালে কষ্ট দিয়েছি, এখন আমার দাদারা দেয়।
আপনি তো এখনও কষ্ট দিচ্ছেন।
না ম্যাডাম, এই খুনজনিত ঝামেলা আমার ইচ্ছাকৃত নয়। আমি বিদেশ থেকে ফিরে এসে মা-বাবার অর্থকষ্টজনিত সমস্যা নির্মূল করেছি। কাজের লোক রেখে দিয়েছি। মাবাবা এখন আরামেই আছে। শ্রীঘরে যেতে না হলে আমি তাদের ছেড়ে যে আর কোথাও যাব না তাও তাদের কাছে শপথ করেছি।
ওরা হয়তো আপনাকে সংসারী দেখলেই বেশি খুশি হতেন।
তা আর বলতে! মা তো বিয়ে বিয়ে করে পাগল করে তুলেছে আমায়। গোটা দশেক পাত্রী দেখেও ফেলেছে। দেখার জন্য আমাকেও টানাহ্যাঁচড়া কম করা হয়নি। খুনের কেসটায় ব্যাপারটা ধামাচাপা পড়েছে।
আপনি কি বিবাহবিরোধী?
তা কেন? আসলে ওসব নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করে না। আর দাদাদের তো দেখছি। মা বাবার খোঁজ অবধি নেয় না।
সেটা কি তাদের বউদের দোষ?
তা জানি না। তবে বিয়ের পরেই তাদের মানসিক পরিবর্তন হয়েছে।
সেইজন্য বউরা দায়ী হবে কেন? আপনার দাদারাই দায়ী।
ঠিকই বলেছেন। বউদিদের দায়ী করা আমার ঠিক হয়নি।
আজকাল মা-বাবার সঙ্গে থাকলে খটাখটি, অশান্তি বেশি হয়।
আমি সংসার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নই। তবে আপনি যা বলছেন তা হতেও পারে।
হ্যাঁ মশাই, ছেলেরা বউ নিয়ে আলাদা থাকাই ভাল।
তা হলে আর আমার বিয়ে করা হবে না।
ওমা! কেন?
আমি বুড়ো মা-বাবাকে ছাড়তে পারব না। একটা জীবন অনেক কষ্ট দিয়েছি। দু-তিন বছর নাপাত্তা ছিলাম। ভেবে ভেবে আমার মায়ের হার্টের অসুখ হয়েছে।
তা হলে বোবা-কালা মেয়ে বিয়ে করুন। না হলে গাঁ-গঞ্জের একটু হাবাগোবা মেয়ে।
আমার তো বউয়ের দরকারই নেই।
ও! তা হলে সেই ফুলে ফুলে মধু খেয়ে বেড়ানো!
বলেছি তো, ওটাও আমার হাতে নেই। ফুলেরা মধু বিতরণ করতে চাইলে বেচারি মৌমাছির দোষটা কোথায়?
আপনি ভীষণ খারাপ লোক।
তা তো আগেও বলেছেন।
আবার বলছি।
বেশ তো, মেনেও নিচ্ছি। আমি খারাপ লোক।
.
ফোন ছেড়ে দিলেন নাকি?
.
ম্যাডাম, তা হলে কি গুড নাইট?
ফোন ছাড়িনি মশাই।
তা হলে চুপ করে ছিলেন কেন?
আপনার ওপর রাগ হচ্ছিল।
সে তো বুঝতেই পারছি। আমাকে অনেকেই পছন্দ করে না।
আচ্ছা, যদি সেরকম মেয়ে পান তা হলে বিয়ে করবেন।
আপনাকে তো আমার মায়ের মতোই বিয়েতে পেয়েছে দেখছি।
আহা বলুন না।
কীরকম মেয়ের কথা বলছেন।
যে আপনার মা-বাবার যত্নআত্তি করবে?
সে কি আর পাওয়া যাবে? আমার মা-বাবা তো তোর মা-বাবা নয়। সে কি আর আমার চোখ দিয়ে আমার বাবা-মাকে দেখবে? ওসব শরৎচন্দ্রের নভেলে হয়।
কেন হবে না?
এখনকার মেয়েরা তাদের অন্যরকম আইডেন্টিটি খুঁজে পেয়েছে। তারা কেন শ্বশুর শাশুড়ি নিয়ে পড়ে থাকবে?
তা থাকতে হবে কেন? আপনি তো তাদের জন্য লোক রেখে দিয়েছেন। বউ একটু দেখাশোনা করবে, ভাল ব্যবহার করবে।
সেটা তো দুরাশা। হয়তো আমার মাকে বা বাবাকে সে পছন্দ করতে পারবে না। তারা তো আর পারফেক্ট হিউম্যানবিয়িং নয়। না ম্যাডাম, ওসব আমার দ্বারা হবে না।
তা হলে মা কি খুশি হবেন?
তা হবে না। তবু বিয়ে না করা লেসার ইভিল।
আপনার ঘুম পাচ্ছে না তো!
না ম্যাডাম, আমার ইচ্ছা-ঘুম।
এখন কটা বাজে জানেন?
রাত একটা।
আপনার কথা বলতে খারাপ লাগছে না তো?
আরে না ম্যাডাম, সারাদিন তো আড্ডা মারার সময়ও পাই না, মানুষও পাই না। এখন যাহোক একটু আড্ডা দেওয়ার সুযোগ হচ্ছে।
আমি মোটেই আড্ডা দিচ্ছি না।
তা হলে কী করছেন?
আমি আপনাকে অ্যাসেস করছি।
ওঃ হ্যাঁ, তা তো বটে।
ইয়ারকি হচ্ছে?
না তো! তবে অ্যাসেস করে কী লাভ? আমি সামান্য মানুষ।
একটা মার্ডার কেসে আপনি প্রাইম সাসপেক্ট। খবরের কাগজে আপনার নাম উঠেছিল, মনে নেই?
হ্যাঁ, তা বটে। আমি কুখ্যাত লোক।
যা বলেছি তা মনে থাকবে?
অনেক কথাই তো বলেছেন। কোনটা বিশেষ করে মনে রাখতে হবে?
মার্ডারটা নিয়ে ভাবুন।
ভাবছি তো।
ওরকম এলোমেলো ভাবনা নয়।
তা হলে?
সেদিন মিসেস বকশির সঙ্গে আপনার যা যা কথা হয়েছিল সেগুলোর ওপর কনসেনট্রেট করুন।
সেগুলোও তো মাঝে মাঝে ভাবি।
আপনি ভীষণ ক্যালাস লোক।
তা হয়তো হবে।
সেদিন মিসেস বকশিত্র কোনও কথার কোনও আলাদা অর্থ হয় কি না ভেবে দেখুন। খুব ডিপলি ভাবুন। আমি কাল আবার রাত বারোটায় ফোন করব।
ধন্যবাদ ম্যাডাম। আপনি আমার জন্য ভাবছেন বলে ধন্যবাদ।
আপনার জন্য ভাবছি কে বলল?
তা হলে?
জাস্ট একটা নাগরিক কর্তব্য হিসেবে পরামর্শ দিচ্ছি।
সেটাই বা কে দেয় বলুন?
এখন ইয়ারকি ছেড়ে ভাবুন তো। এক্ষুনি ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোতে হবে না। রাতে–বিশেষ করে গভীর রাতে ভাবনাচিন্তা খুব শার্প হয়। এখন বসে বসে কিছুক্ষণ মাথাটাকে খাটান তো! আমিও ভাবছি।
আপনার ঘুম পায়নি তো।
না। বিবেক কি ঘুমোয়? ছাড়ছি।
আচ্ছা ম্যাডাম। কাল আবার
টুক করে ফোনটা কেটে গেল।
মহিলা যে কে তা কিছুই বুঝতে পারছে না মিহির, দিন-চারেক আগে প্রথম ফোনটা আসে৷ রহস্যময় কথাবার্তা, কিছুতেই পরিচয় না দেওয়া। তারপর প্রতি রাতেই ফোন। মেয়েটা কে হতে পারে তা কিছুতেই ভেবে পাচ্ছে না সে। এদেশের খুব বেশি মেয়েকে চেনেও না মিহির। গলার স্বর থেকে অনুমান হয়, বয়স কম। আঠেরো, উনিশ, কুড়ি হতে পারে। মিহির সম্পর্কে মেয়েটির দুর্বার কৌতূহল এবং বোধহয় হৃদয়ের একটু দ্রব ভাব। কিন্তু এসব কী করে হয়? মিহির একটু হি-ম্যান গোছের আছে ঠিকই। বেশ লম্বাচওড়া এবং সুপুরুষ, কিন্তু তা বলে সব মেয়েই ঢলে পড়বে এমন নয়।
কোনও চিন্তাই বেশিক্ষণ মাথায় থাকে না মিহিরের। ঘুম আসছিল না। সারাদিন আসুরিক খাটুনির পর ঘুম। আধো তন্দ্রার মধ্যে হঠাৎ সে চমকে উঠল। না, তেমন কনসেনট্রেট না করেও হঠাৎ তার মনে পড়ল, অরুণিমা সেদিন হঠাৎ এক সময়ে খুব অন্যমনস্ক ভাবে বলেছিল, আমি মরে গেলে ও সব পাবে। আমি একদম তা চাই না, একদম না। আমি চাই এসব তোমার হোক। কত টাকার সম্পত্তি আমার জানো! ভাবতেই পারবে না।
এটা কি ইম্পর্ট্যান্ট কথা? কে জানে।
মিহির ঘুমিয়ে পড়ল।
৪. লোকটিকে কি আপনারা ছেড়ে দিলেন
মিস্টার দাশগুপ্ত, লোকটিকে কি আপনারা ছেড়ে দিলেন?
না। মিহিরবাবু বেল পেয়েছেন।
বেলই বা পায় কী করে? হি ইজ দি প্রাইম সাসপেক্ট।
সেটা আদালত জানে। আমাদের কিছু করার নেই।
পাবলিক প্রসিকিউটর কি বেল-এর বিরোধিতা করেননি?
বলতে পারব না। আমি আদালতে ছিলাম না। কিন্তু মিহিরবাবুর বেল নিয়ে আপনি অত ভাবছেন কেন? প্রয়োজন হলে তাকে আবার অ্যারেস্ট করা যাবে।
ওকে আপনারা চেনেন না মিস্টার দাশগুপ্ত। যে-কোনও সময়ে ও হাওয়া হয়ে যেতে পারে। এ ব্যাপারে ওর প্রতিভা সাংঘাতিক।
সেক্ষেত্রে কী আর করা যাবে বলুন? পুলিশ তো সর্বশক্তিমান নয়। আদালতের বিরুদ্ধাচরণ তো করতে পারি না।
ব্যাপারটা কিন্তু মোটেই ভাল হল না। খুনটা যে মিহিরই করেছে সে বিষয়ে তো কোনও সন্দেহই নেই!
কে বলল নেই? সন্দেহ অবশ্যই আছে।
সে কী?
পুলিশের হাতে ভদ্রলোককে কনডেম করার মতো যথেষ্ট তথ্য নেই।
এদেশের পুলিশ কি এতই অপদার্থ?
এদেশের পুলিশ এদেশের মতোই। কী আর করা যাবে বলুন?
ডিসগাস্টিং! ভেরি ডিসগাস্টিং।
দুঃখিত মিস্টার বকশি। আপনাকে খুশি করতে পারছি না। বাই দি বাই আপনি কবে এলেন?
কাল রাতে।
আপনি তো মোটে মাসখানেক আগেই আমেরিকায় ফিরে গেলেন!
দেড় মাস। আসতে হল জরুরি প্রয়োজনে। আমার সম্বন্ধী সত্যব্রত আয়রন সাইড রোডের বাড়িটা প্রমোটারকে বিক্রি করার তোড়জোড় শুরু করেছে। ওর কাছে নাকি আমার স্ত্রীর দেওয়া পাওয়ার অফ অ্যাটর্নিও আছে। খবর পেয়ে আসতেই হল।
বাড়িটা বোধহয় আপনি বিক্রি করতে রাজি নন?
পাগল নাকি? বাড়ি বিক্রি করব কেন? সত্যব্রতর সঙ্গে এই নিয়ে ঝামেলা চলছে বলেই আমাকে আসতে হয়েছে।
আমি যতদুর খবর রাখি আপনার স্ত্রীর আরও গোটা দুই বাড়ি আছে এবং ব্যাঙ্কে ক্যাশ এবং অন্যান্য বন্ডে আছে প্রচুর টাকা।
হ্যাঁ। ওদের অবস্থা তো ভালই ছিল।
আপনিই এখন এসবের মালিক তো।
ন্যাচারালি। জিজ্ঞেস করছেন কেন?
না, ভাবছিলাম অন্য কোনও ওয়ারিশান আছে কিনা।
কে থাকবে?
উনি কোনও উইলটুইল করেছিলেন কিনা জানেন?
লুক ম্যান, অরুণিমা ওয়াজ জাস্ট আভার ফটি। এই বয়সে কেউ উইল করতে যায়?
ভাল করে খুঁজে দেখেছেন?
খোঁজার প্রয়োজন মনে করিনি। কিন্তু একথা বলছেন কেন?
প্রিয়ব্রত মজুমদার নামে একজন বিখ্যাত অ্যাটর্নি আছেন, জানেন কি?
না তো!
আমি তার ফোন নম্বর আপনাকে দিচ্ছি। একটু কথা বলে দেখুন।
হোয়াট ডু ইউ মিন? হঠাৎ আমি উটকো একটা লোকের সঙ্গে কথা বলতে যাব কেন?
উনি অরুণিমা দেবীর অ্যাপয়েন্টেড অ্যাটর্নি।
অরুণিমার অ্যাটর্নি! কই জানতাম না তো!
আপনি আপনার স্ত্রীর অনেক কিছুই হয়তো জানতেন না!
তার মানে?
স্ত্রীয়াশ্চরিত্রম।
আপনি ননসেন্স টক করছেন।
আপনি উত্তেজিত হয়ে পড়ছেন কেন? আমি তো জাস্ট আপনাকে একজনের সঙ্গে একটু কথা বলতে বলেছি। এতে মেজাজ খারাপ করার মতো কিছু তো নেই।
আর ইউ হিন্টিং সামথিং?
আরে মশাই, কথা বলেই দেখুন না। প্রিয়ব্রতবাবু ইজ এ রিনাউন্ড ম্যান ইন দি ফিল্ড অফ ল। আজেবাজে লোক নন।
তিনি আমাকে কী বলবেন?
যা বলবেন তা হয়তো আপনার পছন্দ হবে না। কিন্তু ট্রুথ ইজ অলওয়েজ লাইক দ্যাট। নট প্যালেটেবল।
ঠিক আছে, নম্বরটা দিন।
নোট করে নিন। এখন দশটা বাজে, ঘণ্টাখানেক পরে ওঁকে ওঁর চেম্বারে এই নম্বরে পাবেন।
অরুণিমা কি গোপনে কোনও ডিল করেছিল?
আমার মুখ থেকে শুনবেন কেন? প্রপার অথরিটির কাছ থেকে জেনে নিন।
আপনি আমাকে টেনশনে ফেলে দিলেন।
তা হয়তো দিলাম। কিন্তু সবটা জেনে এবং বুঝেই এগোনো ভাল।
ফোনটা কেটে গেল।
কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল শবর। কলকাতার ক্ষণস্থায়ী শীত বিদায় নিচ্ছে। বাইরে রোদের তেজ বাড়ছে। ফেব্রুয়ারির শেষে কলকাতায় আজকাল রোদের বেশ তাপ, হাঁটলেই ঘাম হয়। বেরোতে ইচ্ছে করছিল না শবরের। কিন্তু একটা মোবাইল নম্বরে বারবার ফোন করেও মিহিরকে ধরা যাচ্ছে না। ফোন সুইচ অফ করা আছে।
শবর অগত্যা উঠল। ফোনটা বেজে উঠতেই ভ্রু কুঁচকে তাকাল যন্ত্রটার দিকে। তারপর তুলে নিল।
শবর দাশগুপ্ত বলছি।
শাহেনশাকে ধরা গেছে স্যার। চালান দেব কি?
আরে না না, চালানফালান নয়। বসিয়ে রাখুন। কয়েকটা প্রশ্ন করেই ছেড়ে দেব।
ওর নাকি ড্রাগ নেওয়ার সময় হয়েছে। খুব রেস্টলেস।
ওকে ড্রাগ নিতে দিন।
আপনি পারমিশন দিচ্ছেন তো?
হ্যাঁ। আমি ওকে নরমাল অবস্থায় চাই।
ঠিক আছে। আপনি কি আসছেন?
হ্যাঁ। আমি এখনই রওনা দিচ্ছি। আধ ঘণ্টায় পৌঁছে যাব।
আধঘণ্টা পর দক্ষিণ কলকাতার একটা ফাঁড়িতে শবর দাশগুপ্ত শাহেনশার মুখোমুখি হতেই সুপুরুষ, দীর্ঘকায় বছর পঁয়ত্রিশ বয়সের শাহেনশা উঠে দাঁড়িয়ে একটা সেলাম করল। শাহেনশার দাড়ি এবং গোঁফ খুব যত্ন করে ট্রিম করা। পরনের পোশাক অবশ্য এলোমেলো। ময়লা জিনসের প্যান্ট আর গায়ে ইস্তিরিহীন সবুজ পাঞ্জাবি।
ভাল আছেন তো সাহেব?
ভাল। তুমি কেমন?
সব ঠিক হ্যায়। কুছ মুসিবত হল নাকি সাহেব?
সাউথ ক্যালকাটার আয়রন সাইড রোডে অরুণিমা বকশি মার্ডার হয়েছিল জানো তো!
জানি সাহেব।
কে জানো?
না সাহেব।
তোমাকে না জানিয়ে কে কাজ করবে এখানে? তুমি না ডন?
আজকাল বহুত মস্তান উঠছে সাহেব। আপনি তো সব জানেন।
উঠতি মস্তান?
হা সাহেব।
এরকম ছক কষে কি ওরা কাজ করবে? মনে হয় না।
খোঁজ নিয়ে বলব সাহেব।
তোমার তো কখনও ভয়ডর বা জানের পরোয়া ছিল না।
ও বাত তো ঠিক সাহেব।
কিন্তু তোমার চোখ দেখে মনে হচ্ছে আজকাল তোমার ভয়ডর হয়েছে।
শাহেনশা মাথাটা নিচু করে বলল, দিনকাল খারাপ আছে সাহেব। বহুত কম্পিটিশন, বহুত পলিটিক্স, বহুত টেনশন।
সেটা আমি জানি তোমার চেলা মিল্টন কি আলাদা হয়ে গেছে?
জি সাহেব। মিল্টন তিলজলায় ডেরা করেছে।
তোমার দলে কে আছে এখন?
বাচ্চু, ঘিয়া, পাগলু। সব নতুন আছে সাহেব।
তুমি কেস করো না?
না সাহেব। বখরা পাই।
অরুণিমা বকশিকে যে খুন করেছে সে পুরনো লোক।
আমার লোক করেনি সাহেব।
সেটা আমি জানি। কিন্তু কে করেছে সেটা তোমার না জানার কথা নয়।
জানি না সাহেব।
তুমি ভয় পাচ্ছ শাহেনশা!
শাহেনশা পায়ে পায়ে একটু ঘষাঘষি করল। মুখটা একটু বিবর্ণ।
কন্ট্রাক্ট মার্ডার, বুঝলে?
হ সাহেব।
খুনটা হয়েছে তোমার এলাকায়। তোমাকে সেলামি না দিয়ে কাজটা কি কেউ করতে পারে?
সাহেব, আজকাল এলাকা কেউ মানে না। পয়সার লালচ বাড়ছে তো। পুরানা জমানা তো আর নেই।
সেটা আমার চেয়ে ভাল কেউ জানে না। লোকটাকে আমার চাই শাহেনশা।
খবর নিয়ে জানাব সাহেব।
আজ বিকেলে?
আর একটু টাইম লাগবে।
টাইম লাগার কথা নয় শাহেনশা, তুমি আসলে ভয় পাচ্ছ। ড্রাগ ধরার পর কি এসব হচ্ছে?
না সাহেব। সিচুয়েশন বদল হয়ে গেছে।
কাকে ভয় পাও?
কাউকে না। টাইমটাকে ভয় পাই সাহেব। আজকাল সব উলটোপালটা ব্যাপার হয়।
ঝেড়ে কাশো শাহেনশা, চুপ করে থাকার জন্য কত টাকা পেয়েছ?
শাহেনশা মাথা নিচু করে চুপ করে থাকে।
তোমার বিরুদ্ধে তো কোনও কেস দিচ্ছি না, তোমাকে ধরাও হবে না, শুধু একটা ইনফর্মেশন চাইছি। মনে পড়ে তোমাকে আমি এর আগে তিনবার বাঁচিয়ে দিয়েছি?
বহুত মেহেরবানি। সাহেব, আমি ভুলিনি।
তা হলে আমার ঋণ একটু শোধ করো।
ছোকরা অ্যারেস্ট হয়ে গেলে বহুত হুজ্জত হবে সাহেব। রায়ট হয়ে যাবে। আমি খতম হয়ে যাব।
অ্যারেস্ট করব না। যে খুনটা করে সে-ই তো আর আসল খুনি নয়, যে খুনটা করায় সে-ই আসল খুনি। আমি তাকে ধরতে চাইছি।
কথা দিচ্ছেন স্যার?
হ্যাঁ। তবে আমি জানতে চাই পেমেন্ট কে করেছে।
বকশি মেমসাহেবকে খুন করেছে লম্বুর দল। খাটো আর সেলিম ছিল অপারেশনে।
পেমেন্ট কে করেছে?
এজেন্সি।
কোন এজেন্সি?
সার্ভিস টু দি পিপল।
খাটো কি কলকাতায়?
না সাহেব। অপারেশনের পর সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওটাই নিয়ম।
জানি। এজেন্সির মালিক জনি, তাই না?
জি সাহেব। জনি ইনফর্মেশন পায় টেলিফোনে। টাকা ওর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা হয়ে যায়।
তার মানে খুনটা কে করিয়েছে তা জনি জানে না?
না সাহেব।
কাকে সন্দেহ হয় শাহেনশা?
আমরা কাউকে সন্দেহ করি না। টাকা পাই, কাজ করি।
বুঝলাম। টাকার অ্যামাউন্ট জানো?
না সাহেব। আমি দশ হাজার পেয়েছি।
সেটা কত পারসেন্ট?
জানি না সাহেব। নিট দশ হাজার। নো বারগেন।
ঠকে গেছ। আমার হিসেবে পাঁচ থেকে দশ লাখের মধ্যে কন্ট্রাক্ট হয়েছে। তার কম নয়।
হতে পারে সাহেব। আমার কাছে তো এটা ফালতু টাকা। তাই আমি আর খোঁজখবর নিইনি।
ঠিক আছে শাহেনশা, তুমি যেতে পারো।
জি সাহেব।
লম্বুর মোবাইল নম্বর জানো?
জানি সাহেব।
দাও।
নম্বরটা ডায়াল করতেই ওপাশ থেকে কেউ বলল, বোলো।
শবর গম্ভীর গলায় বলল, ফোনটা লম্বুকে দাও।
তুমি কে?
তোর বাপ। লম্বুকে দে।
ওপাশটা কিছুক্ষণ চুপ। তারপর একটা গমগমে গলা বলে উঠল, কৌন হ্যায় বে?
বলেছি তো তোর বাপ। আমি শবর দাশগুপ্ত।
আরে স্যার, আপনি! নমস্কার স্যার। আমি লম্বু।
শোন, কথা আছে।
বলুন স্যার।
আয়রন সাইড রোডের অরুণিমা বকশিকে খুন করানোর কন্ট্রাক্ট তোমাকে কে দিয়েছিল জানো?
স্যার, এসব কী বলছেন!
আকাশ থেকে পড়লে যে! অ্যাকটিং ছাড়ো। তুমিও সেয়ানা, আমিও সেয়ানা।
সে কথা তো ঠিক, কিন্তু স্যার, পার্টিকে তো চিনি না।
খবর নিতে পারবে?
জনি কাজটা দিয়েছিল। জনিও জানে না।
কত টাকার কন্ট্রাক্ট?
পাঁচ।
জনি কোথায়?
এখানে আছে স্যার। আমি জনির এজেন্সি থেকেই বলছি।
ভারী মিষ্টি মোলায়েম একটা গলা বলল, নমস্কার স্যার। আমি জনি।
কন্ট্রাক্টটা কত টাকার ছিল জনি?
ছয়।
কে তোমাকে ফোন করেছিল?
নাম বলেনি।
পুরুষ না মহিলা?
মহিলা।
শিয়োর?
হ্যাঁ স্যার। শিয়োর।
বয়স কীরকম হবে?
বেশি নয় স্যার। ছুকরির গলা।
তোমার অ্যাকাউন্ট নম্বর জেনে নিয়েছিল?
হ্যাঁ স্যার। অনেকে তো নিজে কন্ট্রাক্ট করে না। ভয় পায়।
ক’বার ফোন করেছিল?
দু’বার।
গলা চিনতে পারবে?
পারব। আমার ভয়েস মেমারি ভাল।
হয়তো দরকার হবে না। শোনো। এখন কয়েকদিন তোমার ফোন এলে ধরবে না। অ্যানসারিং মেশিনে রেকর্ড করে রাখবে। তোমাকে যেন মোবাইলে ফোন করে।
স্যার, আপনি কি আমাদের ওপর অ্যাকশন নেবেন?
আপাতত নয়। কিন্তু এ লাইনটা ছাড়ো। যেদিন ধরব সেদিন ঝুলিয়ে দেব। পার পাবে না।
জানি স্যার। কিন্তু এটা তো প্রফেশন, নাথিং এলস।
ফিলজফি ঝেড়ো না।
দোষ ধরবেন না স্যার, পুলিশের বখরাও দিয়েছি।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটা নামিয়ে রাখল শবর।
আরও চল্লিশ মিনিট বাদে মিহিরের গ্যারাজে হাজির হয়ে গেল শবর।
মিহির তার ট্রাকের ইঞ্জিনে কাজ করছিল। কালিঝুলি মাখা অবস্থায় নেমে এল।
আরে আপনি?
মোবাইলটা তো সুইচ অফ করে রেখেছেন, তাই আসতে হল।
কাজ করছিলাম বলে ফোন অফ রেখেছি। বলুন কী খবর।
অ্যাটর্নি প্রিয়ব্রত মজুমদারকে চেনেন?
না। কে তিনি?
আপনাকে ফোনটোন করেননি?
আজ্ঞে না।
অরুণিমা বকশি আপনাকে কত টাকা অফার করেছিল?
ওঃ সে অনেক টাকা। কোয়াইট এ ফরচুন। অ্যামাউন্ট বলেনি।
আপনি কি জানেন যে তিনি একটা উইল করে রেখে গেছেন?
উইল! না, আমি জানব কোত্থেকে?
ইন কোর্স অফ টাইম আপনি জানতে পারবেন।
কী জানব?
জানবেন যে উনি ওঁর কলকাতার বিষয়সম্পত্তি আপনার নামে ট্রান্সফার করতে নির্দেশ দিয়েছেন।
আমার নামে! হোয়াই মি?
বোধহয় ওঁর ভালবাসার নিদর্শন।
পাগল নাকি? ভালবাসা নয়, ওটা ছিল ওর ইগোজনিত পাগলামি। আমাকে উনি দখল করতে চেয়েছিলেন, লাইক এ ট্রফি।
আপনি তো এখন বিপুল সম্পত্তির মালিক হতে যাচ্ছেন।
শবরবাবু, আমাকে আপনি কী ভাবেন বলুন তো!
কী আবার ভাবব?
আমি কি লোভী! নাকি ল্যালা! আমাকে মিসেস বকশি যদি সব দিয়ে গিয়েও থাকেন ওঁর এক পয়সাও আমি ছোঁব না।
আপনার ইগোও তো কম নয়।
এটা আত্মমর্যাদার প্রশ্ন। ইগো নয়। আমার টাকার কোনও অভাব নেই এবং খুব বেশি বড়লোক হওয়ারও ইচ্ছে নেই। মধ্য পন্থাই আমার ভাল লাগে।
তা হলে কী করবেন?
কিছুই করব না। উইলটা ছিঁড়ে ফেলে দেব।
শুধু উইল নয়, উনি অলরেডি আপনার নামে সবকিছু ট্রান্সফার করেছেন।
তাতেও কিছু নয়। আবার ট্রান্সফার করে দেব।
কাকে?
ওঁর হাজব্যান্ডকে।
এত টাকা ছেড়ে দেবেন?
ধরার যখন প্রশ্নই নেই।
আপনি চান বা না চান, অরুণিমা বকশি আপনাকে তার সবকিছু দিয়ে গেছেন। সেই সঙ্গে আপনাকে একটু বিপদেও ফেলে গেছেন।
বিষয়সম্পত্তি মানেই তো বিপদ।
ঠিক কথা। কিন্তু আপনি যে অর্থে বলছেন তা ছাড়াও বিপদ আছে।
সেটা কীরকম?
মরটাল ডেনজার।
তার মানে কী?
আপনি খুন হয়ে যেতে পারেন।
মাই গড! কেন?
কারণ আছে বলেই।
কিন্তু আমি তো ওসব চাইছি না।
সেটা সবাই বুঝবে না।
আমাকে কে খুন করবে?
ভাড়াটে খুনি।
সর্বনাশ!
আপনি তো বাহাদুর লোক, ভয় পাচ্ছেন কেন?
ভয়ের কথাই বলছেন যে!
আরে, নার্ভাস হলে চলবে কেন?
নার্ভাস নই মশাই, আমি ঝুটঝামেলা পছন্দ করি না।
পিসফুল লাইফ চান তো!
হ্যাঁ।
তা হলে কো-অপারেট করুন।
করছি তো।
করছেন না। সেদিন অরুণিমা বকশি আপনাকে আরও কিছু বলেছিলেন যা আপনি আমার কাছে চেপে গেছেন।
আমার যা মনে পড়েছে বলেছি।
উনি সুব্রত বকশির একজন বান্ধবীর কথাও বলেছিলেন।
মাথা নেড়ে মিহির বলে, না, বলেননি। বিশ্বাস করুন।
সুব্রত বকশির কি কোনও বান্ধবী নেই?
থাকলেও আমি জানি না। সুব্রতদার সঙ্গে আমার বিজনেস রিলেশন ছিল, ইন্টিমেসি ছিল না। মিসেস বকশি সুব্রতদাকে এতই তাচ্ছিল্যের চোখে দেখতেন যে ওঁকে নিয়ে ওঁর মাথাব্যথাই ছিল না।
শবরের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ল একটু। সামান্য চুপ করে থেকে বলল, সত্যি কথা বলছেন?
হ্যাঁ, সত্যি কথা বলছি।
তা হলে তো জটিলতা বাড়ল।
কিন্তু তার জন্য তো আমি দায়ী নই।
প্যাটার্নটা ঠিকঠাক মিলছে না। সুব্রত বকশির একজন বাঙালি বান্ধবী থাকা উচিত। তা হলে প্যাটার্নটা মেলে। নইলে আবার নতুন করে ভাবতে হবে। আপনি কি বলতে পারেন সুব্রতবাবু সম্পর্কে অরুণিমার এত রিপালশনের কারণ কী?
রিপালশন নয়। রিপালশনও একরকমের রি-অ্যাকশন। অরুণিমা সুব্রতদাকে ঘেন্না করতেন বলে মনে হয় না। তেমন কোনও রাগেরও প্রকাশ দেখিনি। জাস্ট ইগনোর করতেন।
সুব্রত বকশি কি ওঁর আজ্ঞাবহের মধ্যে ছিলেন?
পুরোপুরি তাও নয়। কাজের সুত্রে ওঁদের কো-অপারেশন ছিল। দু’জনেই পরিশ্রমী। পরস্পরের মধ্যে কাজ নিয়ে শলাপরামর্শও হত। গুড কলিগস। কিন্তু স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বোধহয় ক্লোজ ছিলেন না। ভেরি স্ট্রেঞ্জ রিলেশন।
সুব্রত বকশির অ্যাটিটিউড কীরকম ছিল?
সেও আপনাকে বলেছি। উনি স্ত্রীকে তোয়াজ করতেন। ডার্লিং, ডিয়ার, সুইটহার্ট বলতেন সবসময়। কিন্তু সেগুলো মিথ্যে।
হু। ভাবিয়ে তুললেন মিহিরবাবু।
৫. ঘুম ভাঙালুম বুঝি
ওমা! ঘুম ভাঙালুম বুঝি?
না ম্যাডাম, ঘুমোইনি। চিন্তা করছি।
আপনাকে আমি যা চিন্তা করতে বলেছি তা করছেন তো?
না ম্যাডাম, তার চেয়েও ইম্পর্ট্যান্ট চিন্তা করতে হচ্ছে।
সে আবার কীসের চিন্তা?
শবরবাবু নতুন দুশ্চিন্তা ঢুকিয়ে দিয়ে গেছেন মাথায়।
কীরকম দুশ্চিন্তা?
ওঁর ধারণা হয়েছে আমাকে কেউ খুন করবে।
আঁ!
হ্যাঁ ম্যাডাম।
উদ্বিগ্ন নারীকণ্ঠটি থেকে রহস্য খসে পড়ল, একটু আর্তনাদের মতো কণ্ঠস্বরটি বলে উঠল, কেন? কে খুন করতে চাইছে?
তা তো উনি বলেননি। তবে সাবধান থাকতে বলেছেন।
কী আশ্চর্য! আপনার ওপর কার রাগ থাকতে পারে?
তা তো জানি না। তবে আপনাকে তো বলেইছি, আমি লোক ভাল নই। কারও হয়তো খার আছে।
প্লিজ, একটু ডিটেলসে বলুন।
ডিটেলস তো আমিও জানি না ম্যাডাম। তবে পুলিশসাহেব আজ আমার গ্যারাজে হানা দিয়েছিলেন। ঘটনার ক্রম দেখে বা কোনও সূত্রে উনি এরকমই একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন।
তা হলে আপনি কোথাও চলে যান। কাল সকালেই চলে যান।
না ম্যাডাম, আমি ভিতু হলেও ততটা কাপুরুষ নই।
নারীকণ্ঠ ঝেঁঝে উঠল, যাক, অত বীরত্ব দেখাতে হবে না। এ শহরে ভীষণ বিচ্ছিরিভাবে খুনটুন হয়। দিনে দুপুরে। প্লিজ, অকারণে বেশি সাহস দেখাবেন না।
আপনি কি আমার জন্য উদ্বিগ্ন?
যদি বলি হ্যাঁ।
তা হলে তো বলতে হয় অচেনা একজন মানুষের জন্য আপনার যথেষ্ট সিমপ্যাথি আছে।
দেখুন, এসব সিরিয়াস সিচুয়েশনে ইয়ারকি ভাল লাগছে না। আপনি তো বলেছিলেন দিল্লিতে আপনার দাদা থাকেন।
হ্যাঁ।
তার কাছে চলে যান না।
তার কাছে গিয়ে তো অনন্তকাল থাকা যাবে না। কলকাতায় বুড়ো মাবাবা, কাজকারবার সব ফেলে চলে গেলেই তো হবে না। আর দাদার সঙ্গে আমার সম্ভাবও নেই।
অন্য কোথাও গিয়ে থাকার মতো টাকা কি আপনার নেই? খুব পারবেন প্লিজ!
ম্যাডাম, গেলেই তো হবে না। একদিন ফিরতেই তো হবে।
সে তখন পরে দেখা যাবে।
আমার এখন অনেক টাকা, জানেন?
কীসের টাকা?
শুনছি অরুণিমা বকশি নাকি মারা যাওয়ার আগে তার বিষয়সম্পত্তি আমার নামে ট্রান্সফার করে গেছে।
সত্যি?
হ্যাঁ।
এত টাকা নিয়ে কী করবেন?
কিছুই করব না ম্যাডাম। একটা পয়সাও ছোঁব না।
কেন?
নেব কেন বলুন তো? কোন অধিকারে?
সত্যি নেবেন না?
প্রশ্নই ওঠে না। শুনে বরং আমার প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল।
ওমা! কেন?
এটা হয়তো ঘুষ, হয়তো করুণা, হয়তো ক্রয়মূল্য। কিন্তু কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাই?
থ্যাঙ্ক ইউ।
হঠাৎ থ্যাঙ্ক ইউ দিলেন কেন?
হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।
তাই বা কেন?
সে আপনি বুঝবেন না।
আপনি বেশ অদ্ভুত লোক ম্যাডাম।
মোটেই অদ্ভুত নই। মেয়েদের আপনি একটুও চেনেন না।
মেয়েরা কি সব একরকম যে চিনব? এক-একজন এক-একরকম। কে যে কী চায় তা একদম বুঝতে পারি না। তাই নারীচিন্তা করিই না। পারতপক্ষে। হাসলেন নাকি?
হ্যাঁ।
কেন হাসলেন?
আপনার অসহায় অবস্থা দেখে। এত মেয়ের সঙ্গে মেলামেশা করেও মেয়েদের চিনতে পারলেন না?
ম্যাডাম, আপনি আমার প্রকৃত অবস্থাটা জানেন না। মেয়েদের আমি বরাবরই এড়িয়ে চলতাম। আজও চলি। সার্কাসে যখন কাজ করতাম তখনই দেখেছি, কোনও কোনও মেয়ে আমার ওপর ইন্টারেস্ট নিচ্ছে। ঠেকানোর চেষ্টা যে করিনি তা নয়। তবু মেলামেশা হয়ে গেল। ফিজিক্যাল রিলেশন, তার বেশি কিছু নয়। সেই থেকে শুরু আজও শরীর ছাড়া আর কোনও রিলেশন মেয়েদের সঙ্গে আমার হয়নি। বলুন ম্যাডাম, তার জন্য কি আমি দায়ী? আমাকে ব্যবহার করা হয়েছে মাত্র, তার বেশি কিছু নয়। অরুণিমা বকশি যে পাগলামি করলেন তারও কোনও গভীরতা নেই কিন্তু। ওঁর মন বলে বস্তুই ছিল না। আমি ছিলাম ওঁর জাস্ট একটা টয়। খেলা ফুরোলেই ফেলে দিলেন।
বুঝেছি। আপনি ভাল লোক, মেয়েরা খারাপ।
তা বলিনি। বলছি আই ইজিলি অ্যাট্রাক্ট দি ব্যাড পিপল।
তাই বুঝি?
আমি ব্যাড তো, তাই ব্যাডদেরই আমাকে পছন্দ হয়।
আপনি খুব খারাপ, কিন্তু চিকিৎসার অতীত নন।
বলছেন?
হ্যাঁ।
তা হলে আমারও আশা আছে?
খুব আছে। তবে একটা শর্ত।
কী সেটা?
আর কখনও মেয়েদের ওভাবে ব্যবহার করবেন না।
ফিজিক্যালি তো?
হ্যাঁ।
ম্যাডাম, আপনি বুঝতে পারছেন না কেন? আমি ব্যবহার করি না, ব্যবহৃত হই।
দয়া করে আর ব্যবহৃত হবেন না। কথা দিন।
কথা দেব? কেন ম্যাডাম? আপনি তো আমার কাছে একজন অজ্ঞাতপরিচয় মহিলা মাত্র। আপনাকে এত বড় একটা কথা দেব কেন?
তার মানে ফুলে ফুলে মধু খেয়ে বেড়ানোটাই আপনার পছন্দ?
তা নয়। কিন্তু আপনাকে কথা দেব কেন? যে মহিলা বিশ্বাস করে নিজের নামটাও আজ অবধি আমাকে বলেনি তাকে কথা দেওয়ার কী দায়?
পরিচয় দিয়েই বা কী লাভ বলুন? আপনি তো মেয়েদের একটাই ব্যবহার জানেন। সেটা হল শরীর। আপনি নিজেই বলেছেন মেয়েদের ব্যাপারে কৌতূহলও নেই আপনার।
তা ঠিক। তবে আপনার ব্যাপারে একটা কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে।
আমার ভাগ্যি।
আমি কিন্তু কথা বলতে জানি না। অনেক সময়ে উলটোপালটা বলে ফেলি কিছু মনে করলেন না তো!
না, মনে করার মতো কিছু তো বলেননি। তবে কথা দিলেন না বলে দুঃখ পেলাম।
আগে বলুন, আপনি কে?
জেনে কোনও লাভ নেই আপনার।
আমার কী মনে হয় জানেন?
কী?
আপনি বোধহয় খুব অচেনা নন। বাঃ, তা হলে তো ভালই। মাথা খাটিয়ে বের করুন তো আমি কে?
একটু সময় লাগবে। মাথাটা তো এখন নানা চিন্তায় এনগেজড।
তাড়া নেই। ভাবুন।
নিজে থেকে কিছুতেই বলবেন না তো।
না। একটু কষ্ট করুন। বরাবর তো সব মেয়েদের অনায়াসেই পেয়ে গেছেন।
ভুল বললেন। আমি কোনও মেয়েকেই পাইনি। আমার চেহারাটা ভাল। দুর্ভাগ্য হল, মেয়েরা, অর্থাৎ যারা একটু ফিজিক্যাল তারাই আমার শরীরটাই কেবল চেয়েছে। ওটাকে পাওয়া বলে না।
ওটাকেই তো সবাই পাওয়া বলে মনে করে।
আমি মনে করি না।
আপনি তা হলে কীভাবে পেতে চান?
সেটা ঠিক বুঝতে পারি না। তবে ফিজিক্যাল পাওয়ার চেয়ে অনেক বেশি কিছু।
টোটাল সারেন্ডার তো। সব পুরুষই মেয়েদের কাছে তাই চায়।
দেখুন, ভালবাসার মধ্যে সারেন্ডারও কিন্তু একটু থাকে।
আপনিও আসলে ক্রীতদাসী চাইছেন।
দোষ কী? আমিও যদি তার ক্রীতদাস হই?
ছেলেরা কখনও ক্রীতদাস হতে পারে না। তারা নিতে জানে, দিতে নয়।
ছেলেদের সম্পর্কে আপনার অভিজ্ঞতা হয়তো সুখকর নয়। ছেলেদের সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা বেশি নেই, কিন্তু পুরুষদের মোটামুটি বুঝতে পারি।
কিচ্ছু বুঝতে পারেননি। আপনি আমাকে দেখেননি।
কে বললে দেখিনি?
কবে দেখলেন? কোথায় দেখলেন?
তা বলব কেন?
বাজে কথা, আপমি মোটেই দেখেননি। বলুন তো আমার বাঁ গালে যে আঁচিলটা আছে সেটা লালচে না খয়েরি?
আপনার বাঁ গালে কোনও আঁচিল নেই।
বলুন তো আমার নাকটা থ্যাবড়া না চোখা?
থ্যাবড়া নয়, তবে একটু চাপা। মনে হয় কখনও নাকটা ভেঙে গিয়েছিল।
ঠিক বলেছেন তো! সার্কাসে চাকরি যখন করি তখন প্র্যাকটিসের সময় আমি ট্র্যাপিজ থেকে পড়ে গিয়েছিলাম। নীচে নেট ছিল, আমি নেটের বাইরে ছিটকে গিয়েছিলাম। নাঃ, স্বীকার করতেই হচ্ছে আপনি আমাকে দেখেছেন।
দেখেছি।
ভাবিয়ে তুললেন ম্যাডাম।
কেন ভাবনার কী হল?
এ যে ওয়ান ওয়ে গ্লাস। আপনি দেখেছেন, আমি দেখিনি।
কোনওদিন দেখা হতেও পারে।
৬. আমি জনি স্যার
আমি জনি স্যার।
হ্যাঁ জনি, বলো।
আপনি যেরকম বলেছিলেন সেরকমই করেছি। অ্যানসারিং মেশিন চালু রেখেছিলাম, একটা ভয়েস রেকর্ড করা আছে। কিন্তু ভদ্রমহিলা আমাকে মোবাইলে ফোন করেননি।
কী রেকর্ড করতে পেরেছ?
শুধু একটা কথা, জনি আছে? তারপর সাইলেন্স।
নম্বরটা দাও। আর টাইমটা।
জনি নম্বরটা দিল। এবং আধ ঘণ্টার মধ্যে শবর হানা দিল বালিগঞ্জের একটা এসটিডি বুথে।
আমি পুলিশের লোক। কাল রাত আটটার পর সাড়ে আটটার মধ্যে এই বুথ থেকে এক ভদ্রমহিলা কাউকে ফোন করেছিলেন। খুব কম সময়ের জন্য। সেই ভদ্রমহিলাকে কি মনে আছে?
বুথের ছোকরাটা ঘাবড়ানো মুখে বলে, না স্যার। মনে পড়ছে না।
ভয় পেয়ো না, ঠান্ডা মাথায় ভাবো। খবরটা জরুরি।
ছেলেটা একটু ভেবে বলল, হ্যাঁ স্যার।
তাকে চেনো?
এ পাড়ারই মানুষ। তবে নাম ঠিকানা জানি না।
তোমার বুথ থেকে প্রায়ই ফোন করেন কি?
খুব কম!
চেহারাটা কেমন বলতে পারো?
লম্বাচওড়া চেহারা স্যার, খুব ফরসা।
কোন দিক থেকে এসেছিলেন?
ওই পাশের গলিটা দিয়ে, ফোন করে গলিতে ঢুকে গেলেন।
উনি ছাড়া আর কোনও মেয়ে এসেছিল?
না স্যার। এখন চারদিকে অনেক বুথ খুলে গেছে, কাস্টমার নেই।
ঠিক আছে।
আরও চল্লিশ মিনিট ধরে গলির বিভিন্ন দোকান আর বাড়িতে হানা দিল শবর। শেষে সোমা রায়ের নামটা জানা গেল। ঠিকানাও।
কলিং বেল টিপতেই একজন বাচ্চা মেয়ে দরজা খুলে বলল, কী চাই?
সোমা রায়।
এখন দেখা হবে না।
কেন?
বাথরুমে আছেন।
শবর দরজাটা ঠেলে ভিতরে ঢুকে বলল, ওকে বলো পুলিশের লোক এসেছে। জরুরি দরকার।
মেয়েটা ভয় পেয়ে ছুটে গেল ভিতরে। শবর চারদিকে চেয়ে দেখল, বেশ সাজানো গোছানো রুচিশীল বৈঠকখানা। পয়সাওয়ালা মহিলা বলে মনে হয়।
একটু অপেক্ষা করতে হল। তারপর মুখে এক রাশ বিরক্তি আর থমথমে রাগ নিয়ে ফরসা, লম্বা, স্বাস্থ্যবতী এবং বেশ সুন্দরী ভদ্রমহিলা ঘরে ঢুকেই বেশ উঁচু গলায় বললেন, কে বলুন তো আপনি? কী চাই?
কয়েকটা কথা জানতে চাই।
কী কথা? শুনলাম আপনি পুলিশের লোক। পুলিশের কী দরকার আমাকে?
ঠান্ডা হয়ে বসুন ম্যাডাম। অত উত্তেজিত হবেন না। আমি তো আপনাকে অপমান করিনি।
আমার সময় নেই। এখনই বেরোব।
সেক্ষেত্রে আপনাকে অ্যারেস্ট করে থানায় নিয়ে গিয়ে জেরা করা হবে। সেটা কি সুবিধাজনক হবে বলে আপনার মনে হয়?
দাঁতে ঠোঁট চেপে কিছুক্ষণ রাগটাকে সামলে নিয়ে সোমা বলল, কিন্তু আমার অপরাধ কী?
আপনার টেলিফোন আছে?
আছে। কেন?
ফোনটা কি ডেড?
না।
তা হলে কাল রাতে আপনি জনিকে ফোন করার জন্য কষ্ট করে টেলিফোন বুথে গিয়েছিলেন কেন?
পলকে ফ্যাকাশে হয়ে গেল সোমার মুখ।
কে বলল আমি বুথে গিয়েছিলাম?
বুথের ছেলেটা আপনাকে দেখলেই চিনতে পারবে।
বাজে কথা।
জনির সঙ্গে আপনার কীসের দরকার?
জনি নামে আমি কাউকে চিনি না।
সুব্রত বকশি নামে কাউকে চেনেন কি? নাকি তাও না।
এসব কী হচ্ছে বলুন তো? রঙ্গ-তামাশা নাকি?
না, বরং খুব সিরিয়াস ব্যাপার।
আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই না।
ঠিক আছে ম্যাডাম। আমি থানায় জানিয়ে দিচ্ছি যাতে তারা আপনাকে হাতকড়া পরিয়ে প্রকাশ্যে টেনে নিয়ে যায়। থানায় কাঠের বেঞ্চে বসে কথা বলতে বোধহয় আপনার সুবিধে হবে।
সোমার মুখে আচমকা রক্তোচ্ছ্বাস দেখা গেল। সিঁটিয়ে গিয়ে বলল, কেন এসব করছেন?
স্পিল দা বিন। সুব্রত বকশিকে চেনেন?
সোমা দাঁতে ঠোঁট কামড়াল। তারপর হঠাৎ দু’হাতে মুখ ঢেকে কাঁপতে লাগল।
আমি কিচ্ছু জানি না… আমি কিচ্ছু জানি না।
আপনার পাসপোর্টটা নিয়ে আসুন।
সোমার অনেকক্ষণ সময় লাগল সামলাতে। তারপর গিয়ে পাসপোর্ট নিয়ে এল।
বছরে আপনি ক’বার আমেরিকা যান?
বিজনেস পারপাসে ঘনঘন যেতে হয়।
বুঝলাম।
সুব্রতর সঙ্গে আমার একটা জয়েন্ট বিজনেস আছে।
হ্যান্ডিক্র্যাফটস?
হ্যাঁ। আর শাড়ি।
অরুণিমা বকশি কি আপনাকে চিনতেন?
হ্যাঁ।
কীরকম রিলেশান ছিল?
ভালই তো।
তা হলে তাকে মারতে হল কেন?
সোমা চুপ।
ডিভোর্স করলে অরুণিমার সম্পত্তি সুব্রতর হাতছাড়া হত বলে?
আমাকে ওসব জিজ্ঞেস করবেন না প্লিজ!
নয় কেন? আপনি একজন অ্যাকসেনসরি টু মার্ডার। একটা নয়, দুটো মার্ডার। মিহিরকে খুন করার জন্য আপনি জনিকে ফের ফোন করেছিলেন। অ্যানসারিং মেশিনে ওর মোবাইলে ফোন করতে বলায় আপনি ভয় পেয়ে ফোন কেটে দেন, কারণ মোবাইলে কলার-এর নম্বর উঠে যায় তাই না?
প্লিজ!
কী লাভ হল বলুন? অরুণিমা তার সব সম্পত্তি মিহিরের নামে ট্রান্সফার করে গেছে।
আমি কিছু জানি না। আমাকে ছেড়ে দিন।
সুব্রত আর আপনি দু’জনেই জেল খাটবেন, যদি ফাঁসি নাও হয়, কী লাভ হবে বলুন। সুব্রতবাবুর পাসপোর্টও এতক্ষণে পুলিশ বাজেয়াপ্ত করেছে। আমি আপনারটা করছি। ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট।
৭. মিহিরবাবু, কেমন আছেন
মিহিরবাবু, কেমন আছেন?
ও শবরবাবু। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। ফাঁসির দড়ি থেকে যে আমি বেঁচে যাব তা ভাবিনি। আপনি এসে না পড়লে কপালে কষ্ট ছিল।
তা ছিল। সুব্রতবাবু স্টেটমেন্ট দিয়েছেন।
ওঁর কি ফাঁসি হবে শবরবাবু?
বোধহয় না। চৌদ্দো বছর মেয়াদ হতে পারে। প্যারোলট্যানোল বাদ দিয়ে বড়জোর দশ বছর ঘানি টানবেন। তবে আমেরিকান সিটিজেন বলে কিছু কনসিডারেশন হতে পারে। ওসব আইনকানুন আমার জানা নেই। আপনি কি সত্যিই অরুণিমা বকশির বিষয়সম্পত্তি কিছুই নেবেন না?
পাগল নাকি? ওসব আমি ছোঁবও না।
তা হলে সম্পত্তির গতি কী হবে?
যা খুশি হোক।
আপনি অদ্ভুত লোক কিন্তু।
না শবরবাবু, আমি ভিতু লোক। অনার্জিত সম্পদকে খুব ভয় পাই।
আচ্ছা, গুডবাই। ভাল থাকুন।
ধন্যবাদ।
.
আমি বলছি।
সব খবর পেয়েছেন?
খবরের কাগজে দেখেছি।
আপনার কি সন্দেহ ছিল খুনটা আমি করেও থাকতে পারি?
না, কখনও নয়। সন্দেহ থাকলে কি এত কথা বলি?
আমি লম্পট বলে প্রতীয়মান হলেও তা নই কিন্তু।
আপনি ভীষণ খারাপ।
কী করে আপনার কাছে ভাল লোক হওয়া যায় বলবেন?
শুধু আমার কাছে কেন, সকলের কাছে নয়?
আপাতত আমার একজনের জন্যই মাথাব্যথা। হাসছেন।
এত পাগল হওয়ার কী আছে?
আপনি যে আমাকে ভীষণ জ্বালাচ্ছেন।
ওঃ! তা হলে আর ফোন করব না।
কেন?
তাই তো বললেন!
তাই বললাম বুঝি! এই বুদ্ধি! আপনাকে আমি বুদ্ধিমতী ভেবেছিলাম।
ঝগড়া করার জন্য গলা চুলকোচ্ছেন, না?
আপনিও তো ঝগড়ুটে। এক বুঝতে আর এক বোঝেন।
বেশ তা হলে কথা না বললেই তো হয়।
না না, বরং ঝগড়াই হোক।
ঝগড়া হবে! ওমা, কেন?
এরকম ঝগড়া বেশ ভাল, মন ভাল হয়ে যায়।
তা হলে তো সারাজীবন ঝগড়াই করতে হবে আপনার সঙ্গে।
রাজি। হাসছেন কেন?
একটা পাগলের পাল্লায় পড়েছি বলে।
আমিও তো একটা পাগলির পাল্লায় পড়েছি। পাগলিকে এখন আমার ভীষণ দরকার।
কেন?
বোঝেন না? না বুঝে থাকলে আর বুঝে কাজ নেই। আমি পাগলির কাছে বসে এই জীবনটাকে বুঝে নিতে চাই। আপনার পাঠশালায় আমাকে ভরতি করে নেবেন?
ভেবে দেখি।
না, ভাবলে সব গুলিয়ে যাবে। নিন না ভরতি করে। নেবেন?
একটা দীর্ঘশ্বাস শোনা গেল। তারপর মেয়েটি বলল, না নিয়ে উপায় কী?