ওদের জহুরির চোখ। তাছাড়া এবাড়ি রাখবে নাকি? দেয়ার উইল বি টোটাল রিকনস্ট্রাকশন অ্যাণ্ড রিনোভেশনস। ওরা খুব ফাস্টিডিয়াস।
মিলি একটা দীর্ঘশ্বাস চাপল। দশ লাখ অনেক টাকা, তবু তার বিমর্ষতা দশ লাখে কাটছে না। কত লাখে কাটবে তা বলা কঠিন।
সোমনাথ গলাটা আরও নামিয়ে বলল, কলকাতায় ওর আরও ছ-খানা বাড়ি আছে। বাড়ি আছে প্যারিস, লণ্ডন, নিউ ইয়র্ক আর সানফ্রানসিসকোয়। এবাড়ি ফেলেই রাখবে ধরে নিতে পারিস।
ফেলে রাখবে! খুব অবাক হয়ে বলে মিলি, ফেলে রাখবে কেন?
স্বামী-স্ত্রী দু-জনেই সামান্য কয়েকটা কথা সেরে নিল নিজেদের মধ্যে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে অতিভদ্র গলায় বলল, নমস্তে জী।
শশব্যস্ত সোমনাথ ওদের এগিয়ে দিতে গেল। বোধহয় ব্যস্ত মানুষটি বেশি সময় দিলে না সোমনাথকে। সোমনাথ মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ফিরে এসে বলল, ভালো অফার। তাই না?
মিলি সোফায় বসে কিছু ভাবছিল। বলল, ওরা এ-বাড়িতে থাকবে না কেন?
ক-টা বাড়িতে থাকবে? বললুম না ছ-খানা বাড়ি আছে। বালিগঞ্জেই দুটো। নিউ আলিপুরে, পার্ক সার্কাসে, শ্যামবাজারে আর আলিপুরে আরও চারটে। এর মধ্যে অবশ্য তিনটে অ্যাপার্টমেন্ট। শুধু সল্টলেক-এ ছিল না, তাই কিনছে।
তাহলে কারা থাকবে এখানে?
কেয়ারটেকার থাকবে বোধহয়। দুটো ছেলে, দু-জনেই আমেরিকায়। স্কুলে পড়ছে।
তাহলে এক কাজ করুক না কেন, বাড়িটা কিনে নিয়ে ফের আমাদেরই থাকতে দিক। আমরাই কেয়ারটেকার হয়ে যাব।
সোমনাথ এটাকে রসিকতা হিসেবে নিয়ে হাসল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, এ ব্যাপারে ভীষণ কড়া। বলল, দশ লাখ টাকা পেমেন্ট করার সঙ্গেসঙ্গেই একদম ভ্যাকান্ট বাড়ি চাই। টাকা যখন চাই তখনই দিতে রাজি, কিন্তু বাড়ি ভ্যাকেন্ট করতে হবে সঙ্গেসঙ্গে।
বা:, টাকাটা পেয়ে তবে তো আমরা একটা ফ্ল্যাট-ট্যাট কিনব, তার আগে যাব কোথায়? এত জিনিসপত্রেরই বা কী হবে? ওরা সময় দেবে না একটু?
সোমনাথ মাথা নেড়ে বলে, একটুও না। ওটাই ভদ্রলোকের একমাত্র কণ্ডিশন।
তুই বুঝিয়ে বললি না?
বলেছি। কিন্তু ভদ্রলোক ওই একটা ব্যাপারে ভীষণ রিজিড।
মিলি চুপ করে রইল। তারপর বলল, বাড়িটা কি সত্যিই ভেঙে ফেলবে বলল?
সবটা ভাঙবে না। তবে ভাঙচুর কিছু হবেই।
এত সুন্দর বাড়িটা ভাঙবে?
হয়তো আরও সুন্দর হবে। তুই ভাবছিস কেন? বাড়ি ছেড়ে দিলে এটা তো আর তোর বাড়ি থাকবে না।
মিলি অবাক হয়ে ভাইয়ের দিকে চেয়ে থেকে হঠাৎ ঝাঁঝের গলায় বলে, এটা বরাবরই আমার বাড়িই থাকবে। হাতবদল হলেও।
৫-৮. দ্বিতীয় খদ্দের এল
দ্বিতীয় খদ্দের এল পরের রবিবার সকালে। মিলি আগেভাগেই সোমনাথকে বলে রেখেছিল, আমি বাড়ি দেখাতে পারব না। তুই-ই দেখাস। ভদ্রতা যেটুকু করার করব।
প্রথমটায় মিলি তাই মুখোমুখিই হল না খদ্দেরের।
তবে তিন ভাই-বোন যথারীতি হাজির তাদের বাবার ঘরে। তারা লক্ষ করছিল কে আসে বাড়ি কিনতে। বুক্কাই প্রথম দেখে চাপা গলায় বলল, আ গিয়া, হালুওয়ালা আ গিয়া।
দুই বোন বুক্কার কাঁধের ওপর দিয়ে ঝুঁকে দেখতে পেল, একখানা কনটেসা গাড়ি থেকে তিনজন নামল। সঙ্গে এক পেল্লায় সাইজের কুকুর। কুকুরটার অবশ্য শেষ অবধি নেমে পড়া হল না। একটা মেয়ে-গলার ধমক খেয়ে ফের গাড়িতে উঠে গেল। কুকুরটা উঠে যাওয়ার পর নামল চতুর্থ জন। পুরুষ।
চারজনের দু-জন মেয়ে, সঞ্চারির বয়সি। আর তাদের প্রৌঢ় মা বাবা। চারজনই দেখার মতো সুন্দর। টকটক করছে ফরসা রং, বেশ লম্বা এবং মেদহীন চেহারা।
সঞ্চারি মুগ্ধ হয়ে চেয়েছিল, বলল, মেয়ে দুটো নিশ্চয়ই নাচে। কী ফিগার!
বুক্কা নাক কুঁচকে বলে, স্টিংকিং রিচ। নিশ্চয়ই আবুধাবি বা কুয়েত থেকে এদের ইনকাম হয়।
সঞ্চারি বলে, আমেরিকাও হতে পারে।
মামা বলছিল ইণ্ডাষ্ট্রিয়ালিস্ট। আমাদের সেকটরে ওদের অনেক আত্মীয়স্বজন থাকে। সবাই কাছাকাছি থাকবে বলে বাড়ি কিনতে চাইছে। নইলে আগের পার্টির মতো এদেরও কলকাতায় কয়েকটা বাড়ি আছে।
তিথি কোনো কথা বলল না। দাঁতে দাঁত চেপে সামান্য শক্ত হয়ে এক বিদ্রোহী চোখে কনটেসা গাড়িটার দিকে চেয়েছিল। গাড়ির ভিতরে থেকে অভিজাত কুকুরটা গম্ভীর গলায় একবার ধমকে উঠল–হাউপ।
চারজন ওপরের ঘরে ঢুকতেই চারজনের সৌন্দর্যে ঘর যেন আলো হয়ে গেল। পোশাকে ছড়ানো বিদেশি সুবাসে ম-ম ম-ম করতে লাগল বাতাস। আজও খুব শীত। দীর্ঘকায় প্রৌঢ়ের গায়ে উটের রঙের একখানা পুলওভার। চুল কাঁচায়-পাকায়। কিন্তু শক্ত কাঠামোর পোক্ত চেহারা। মহিলা এদেশি না-বিদেশি তা বোঝা যায় না। চুল কালো, চোখের তারা কালো, তবু যেন ভারতীয় ভাবটা নেই। পরনে শাড়ি, গায়ে একখানা কাশ্মীরি গরম-কোট। মেয়ে দু-জনের বয়স আঠারো-উনিশ এবং পিঠোপিঠি। দু-জনেই লম্বা এবং চমৎকার জোরালো চেহারা। মেয়ে দু-জনের চোখে একটু অবাক চাউনি, চারদিক ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঘরের সাজসজ্জা দেখছে। মহিলা একটু অহংকারী মুখ নিয়ে তাচ্ছিল্যের চাউনি হানল এদিক-ওদিক। লোকটি খুব ভাবুক মুখে বসে রইল সোফায়। আড়াল থেকে সবই দেখল মিলি। পর্দার সামান্য ফাঁক দিয়ে। চট করে সামনে এল না।
সোমনাথ গদগদ হয়ে বলল, একটু কফি?
সকলেই প্রায় একযোগে মাথা নেড়ে মানা করল। লোকটি পরিষ্কার বাংলায় বলল, ওসব দরকার নেই।