- বইয়ের নামঃ দিন যায়
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. সীতাকে বহুকাল বাদে
০১.
সীতাকে বহুকাল বাদে দেখল মনোরম।
দেখল, কিন্তু দেখা-হওয়া একে বলে না। দুপুরে উপঝরণ বৃষ্টি গেছে। তারপর মেঘভাঙা রোদ উঠেছে। সমস্ত কলকাতা জলের আয়না হয়ে বেলা চারটের রোদকে ফেরত দিচ্ছে। ভবানীপুরের ট্রাম বন্ধ, চৌরঙ্গির মুখে জ্যাম। সবকিছু থেমে আছে, রোদ ঝলসাচ্ছে, ভ্যাপসা গরম। মনোরমের পেটে ঠাণ্ডা বিয়ার এখন দুর্গন্ধ ঘাম হয়ে ফুটে বেরোচ্ছে। লক্ষৌয়ের কাজ করা মোটা পাঞ্জাবি আর বিনির টেরিকটন স্ট্রাইপ বেলবটম প্যান্টের ভিতর মনোরম নিজের শরীরে কয়েকটা জলধারা টের পাচ্ছে। গরম, পচা, লালচে ঘাম তার। সীতা রাগ করত।
বিয়ারটা খাওয়াল বিশ্বাস। নতুন কারবার খুলেছে বিশ্বাস। ভারী নিরাপদে কারবার, ক্যাপিট্যাল প্রায় নিল। কলকাতার বড় কোম্পানিগুলোর ক্যাশমেমো ব্লকসুদু ছাপিয়েছে, সিরিয়াল নম্বর-টম্বর সহ। ব্যবসাদার বা কন্ট্রাক্টররা আয়কর ফাঁকি দিতে বিস্তর পারচেজ দেখায়। সেইসব ভুয়ো পারচেজের জন্য এইসব ভুয়ো রসিদ। মাল যদি না কিনে থাক তবে কন্ট্যাক্ট বিশ্বাস। হি উইল ফিক্স এভরিথিং ফর ইউ। যত টাকার পারচেজই হোক রসিদ পাবে, এন্ট্রি দেখাতে পারবে। সব বড় বড় কোম্পানির পারচেজ ভাউচার। বিশ্বাস এক পারসেন্ট কি দু পারসেন্ট নেবে। তাতেই অঢেল, যদি ক্লায়েন্ট আসে ঠিকমতো।
কিন্তু কারবারটার অসুবিধে এই যে, বিজ্ঞাপন দেওয়া যায় না। হাশ পাবলিসিটি। লোকে জানবে কী করে যে কলকাতার কোন গাড্ডায় বিশ্বাস বরাভয় উঁচিয়ে বসে আছে উদ্বিগ্ন আয়করদাতাদের জন্য? যে সব চেনা লোক কলকাতার বাজারে চালু আছে, তাদেরই বলে রাখছে সে। কমিশন দেবে।
–দিস ইজ দি জিস্ট ব্যানার্জি। বিশ্বাস বলল–এবার ইন্টারেস্টেড মক্কেলদের টিপসটা দেবেন।
মনোরম কলকাতার ঘুঘু। শুনে-টুনে মৃদু একটু হাসল, বলল–বিশ্বাস, এর চেয়ে চিট ফান্ডের ব্যবসা করুন। এটা পুরনো হয়ে গেছে। কলকাতায় অন্তত ত্রিশটা রসিদ কোম্পানিকে আমি চিনি।
বহুকাল আগে একটা ট্রেন দুর্ঘটনায় পড়েছিল মনোরম। শরীরে কাটাছেঁড়াগুলো মিলিয়ে গেছে, ভাঙা হাড় জুড়ে গেছে। কেবল জিভটাই এখনও ঠিক হয়নি। দাঁত বসে গিয়ে জিভটা অর্ধেক নেমে গিয়েছিল। জোড়া লেগেছে বটে, কিন্তু কথা বলার সময়ে থরথর করে কাঁপে। কথাগুলো একটু এড়িয়ে এড়িয়ে যায়। কিন্তু তাতে আত্মবিশ্বাস এতটুকু কমেনি মনোরমের।
বিশাল থলথলে চেহারার বিশ্বাস উত্তেজনায় চেয়ারে নড়ে বসল। মোকাঘোর মজবুত চেয়ার তাতে একটু নড়বড় করে। প্রকাণ্ড গরম শ্বাস ফেলে বিশ্বাস বুকে মুগুরের মতো দুখানা হাতের কনুই দিয়ে ভর রাখল টেবিলের ওপর। বলল ব্যানার্জি, আমার তিন মাসের ব্যবসাতে কত লাভ হয়েছে জানেন?
কত?
বিশ্বাস শুধু মুখটা গম্ভীরতর করে অবহেলায় বলে–হু।
মনোরম বলল কিন্তু কম্পিটিশন তো বাড়ছে এ কারবারেও!
ট্যাক্স পেয়ার কি কমে যাচ্ছে? জোরি কমেছে? যতদিন এদেশে প্রাইভেট সেক্টরে ব্যবসা থাকবে, ততদিন আমারও ব্যবসা থাকবে। এর মধ্যেই আমার ক্লায়েন্ট তিনশো ছাড়িয়ে গেছে, দু-আড়াই লাখ টাকার রসিদ ইস্যু হয়েছে। অ্যান্ড উইদাউট মাচ পাবলিসিটি। আপনার স্বভাব হচ্ছে সব ব্যাপারের নৈরাশ্যের দিকটা দেখা। ভেরি ব্যাড।
বিশ্বাস ঠিক বলেনি। মনোরমের এটা স্বভাব নয়। নৈরাশ্যের দিকটা সে কখনও দেখে না।
বিশ্বাস বিয়ার খায় সরাসরি বোতল থেকে। বোতলের শেষ কয়েকটা ফোঁটা গলায় ঢেলে আবার নতুন বোতলের অর্ডার দিল। তারপর তেমনি মনোরমের মুখে ঝোড়ো লুবাতাসের মতো খাস ফেলে বলল-দেন?
মনোরম কিছুক্ষণ এক ঢোঁক বিয়ার মুখে নিয়ে তিতকুটে স্বাদটায় জখম জিভটা ডুবিয়ে রাখল। মুখের ভিতরে ঠিক যেন একটা জিওল মাছ নড়ছে। গিলে ফেলল বিয়ারটা। আস্তে করে বলল–কত কমিশন?
–আমার কমিশন থেকে টুয়েন্টিফাইভ পারসেন্ট দেব।
–আর একটু উঠুন।
–কত?
ফিফটি।
বিশ্বাস ভ্রূ তুলল না, বিস্ময় বা বিরক্তি দেখাল না। একটু হাসল কেবল। বিশ্বাস পঁয়তাল্লিশ পেরিয়েছে। তবু ওর দাঁতগুলো এখনও ঝকঝকে। নতুন বোতলটা তুলে নীরবে অর্ধেক শেষ করল। তারপর নিরাসক্ত গলায় বলল-ফিফটি! অ্যাঁ?
-ফিফটি।
ব্যানার্জি, আমি যেমন প্রফিট করি তেমন রিস্কটা আমারই। ইনকাম ট্যাক্স নিয়ে গভর্নমেন্ট কী রকম হুজ্জত করে আজকাল জানেন না? যদি ধরা পড়ি তো মোটা হাতে খাওয়াতে হবে নয়তো শ্বশুরাল ঘুরিয়ে আনবে। আমার প্রফিটের পারসেন্টেজ সবাই চায়, রিস্কের পারসেন্টেজ কেউ নেয় না। এটাই মুশকিল।
বিশ্বাস তেমন ঝোড়ো বাস ছাড়ে। ওর নাকের বড় বড় লোমের গুছি বের হয়ে আসে। গালের দাড়ি অসম্ভব কড়া, তাই রোজ কামালেও গালে দাড়ির গোড়া সব গোটার মতো ফুটে আছে। ঘন জ্ব। আকাশি রঙের বুশ শার্টের বুকের কাছ দিয়ে কালো রোমশ শরীর দেখা যায়। গলায় সোনার চেন-এ সাঁইবাবার ছবিওলা ছোট্ট লকেট।
মনোরম মুখে বিয়ার নিয়ে নড়ন্ত জিভটাকে ডুবিয়ে রাখে বিয়ারে। মুখের ভিতরে একটা চুকচুক শব্দ হতে থাকে। শালার জিভটা নড়ছে অবিকল ছোট্ট মাছের মতন।
রসিদের কারবারটা মনোরমের কাছে ছেলেমানুষির মতো লাগে। সে আস্তে করে বলল আজকাল ফলস রসিদ টিকছে না। স্পটে গিয়ে এনকোয়ারি হয়, কোম্পানি নিজেদের সিরিয়াল নম্বর দেখে বলে দেয় যে, রিয়্যাল পারচেজ হয়নি। তখন মর্কেলরা ঝোলে।
বিশ্বাস উত্তেজিত হয়ে বলে-ঝুলবে কেন? আজকাল কেউ ঝোলে না। ধরা পড়লে খাওয়াবে কিছু।
মনোরম শ্বাস ছেড়ে বলে–খাওয়াবে আর খাওয়াবে। কত খাওয়াবে মশাই? এত খাওয়ালে নিজে খাবে কী? তার ওপর ফলস রসিদ ধরা পড়লে ক্রিমিনাল কেস হয়ে যায়।
বিশ্বাস ঝুঁকে বলল–আপনি আমার ইয়ে বোঝেন। আমি আরও তিনটে কোম্পানি চালাই ব্যানার্জি। সেগুলো অনেক বেশি রিস্কি। বলে উত্তেজিত বিশ্বাস ধবধবে সাদা রুমালে ঘেমো কপালটা মুছল। তারপর হঠাৎ ঠাণ্ডা হয়ে বলল–আপনার ওই একটা বড় বদ স্বভাব। পেসিমিস্টিক অ্যাটিচুড। ভেরি ব্যাড।
মনোরম নিরুৎসাহের হাসি হাসে।
বিশ্বাস বলল–একটা কথা মনে রাখবেন। না সুন্দরী বউ যার, হয় না যার শালা, তার ঘরে অলক্ষ্মী অচলা।
-মানে?
-মানে হচ্ছে ‘না’ কথাটা যার সুন্দরী বউয়ের মতো প্রিয়, ‘হয় না’ কথাটাকে যে নিজের শালার মতো খাতির-যত্ন করে, সে কখনও সাকসেসফুল হতে পারে না।
মনোরম বালকের মতো হাসে। এমন সে অনেকদিন হাসেনি।
বিশ্বাস স্মিতমুখে বলে–এক মহাপুরুষের কথা। আমি অবশ্য বাজে ব্যাপারে প্রয়োগ করলাম।
-ঠিক আছে। মনোরম বলল–আমি দেখব।
–টুয়েন্টি ফাইভ?
–টুয়েন্টি ফাইভ।
বিশ্বাস আত্মতৃপ্তিতে হাসল। বলল-এটা আমার সাইড বিজনেস। না টিকলেও ক্ষতি নেই। বন্ধুবান্ধবদের বলছি, যদি কাউকে কিছু টাকা পাইয়ে দিতে পারি। আপনার অবস্থা তো ভাল যাচ্ছে না ব্যানার্জি।
মনোরম মাথা নেড়ে বলল–না।
বিশ্বাস দুঃখিত গলায় বললস্যাট উওম্যান?
মনোরম শ্বাস ছেড়ে বলে–দ্যাট উওম্যান।
বিশ্বাস গম্ভীর চিন্তিত মুখে বলে–ব্যানার্জি, বউ বিশ্বাসী না হলে ভারী মুশকিল। আমাদের মতো বয়সে পুরুষ মানুষের বউ ছাড়া আর বিশ্বস্ত কেউ তেমন থাকে না। আমার সব কিছু বউয়ের নামে। বাড়ি, গাড়ি এভরিথিং। বউটা দজ্জালও বটে, কিন্তু ফেইথফুল।
মনোরম টাকরা দিয়ে নড়ন্ত জিভটাকে চেপে ধরে থাকে। রক্তের ঝাপটা তার মুখে লাগে। কান দুটো গরম হয়ে ওঠে।
বিশ্বাস সেটা খেয়াল করল না। বলল-দুপুরে বিজনেস পিক আওয়ার্স বলে বিয়ার বেশি খাই না। তারপর সন্ধে হলে স্কচ থেকে শুরু করে দেশি কত কী গিলব তার ঠিক নেই। রাত দশটায় যখন ফিরব বউ ফারনেস হয়ে আছে। কলিং বেল টিপে আধতলা সিঁড়ি নেমে রেলিংয়ের পাশে লুকিয়ে বসে থাকি। বউ দরজা হাট করে খুলে দেয়, তারপর উঁকিঝুঁকি না দিয়ে ভিতরে অপেক্ষা করে। আমি তখন আবার উঠে আসি। ভিতরে ঢুকি না। বাইরে থেকে এক পাটি জুতো পা থেকে খুলে ভিতরে ছুঁড়ে দিয়ে অপেক্ষা করি। যদি জুতোটা খুব জোরে ঘর থেকে ব্যাক করে আসে তবে বুঝি বউ আজ আপসে আসবে না, জোর খিচান হবে। যদি জুতো ব্যাক না করে তবে বুঝি বউ খুব খিচান করবে না, বউ বড় জোর বাপ-মা তুলে দু-একটা গালাগাল দেবে।
মনোরম এক নাগাড়ে হাসছে। গাল ব্যথা হয়ে গেল। বলল–থামুন মশাই, বিষম খাব।
ব্যাপারটা কিন্তু একজ্যাক্টলি এরকম। বাড়িয়ে বলছিনা। যেদিন খিচান হয় সেদিন বউ মারধোরও করে। চুল ধরে টানতে টানতে বাথরুমে নিয়ে যায়, তারপর দরজা বন্ধ করে…
বাথরুমে কেন?
–বাঃ, ছেলেমেয়েরা রয়েছে না! বলে বিশ্বাস সুখী গৃহস্থের মতো হাসে। বিশ্বাসের চেহারাটা যদিও মা দুর্গার পায়ের তলাকার অসুরটার মতোইকালো, প্রকাণ্ড রোমশ এবং বিপজ্জনক, তবু এখন তার মুখখানা একটা গার্হস্থ্য সুখের লাবণ্যে ভরে গেল। বলল–কিন্তু তবু আমার বউ ফেইথফুল। লাইক এ বিচ। নানারকম মেয়েলি রোগে ভুগে শরীরটা শেষ করেছে। আমি আবার একটু বেশি সেক্সি, তাই আমাকে ঠিক এন্টারটেন করতে পারে না, অ্যান্ড আই গো টু আদার গার্লস।
বউ জানে?
বিশ্বাস মৃদুস্বরে বলে–জানে মানে আন্দাজ করে। তবে চুপচাপ থাকে। ভেরি কনসিডারেট। এটা তো ঠিক যে সে শরীরটা দিতে পারে না। তাই শরীর আমি বাইরে থেকে কিনি। কিন্তু তা ছাড়া আমিও ফেইথফুল।
বিশ্বাস মৃদুস্বরে বললেও ওর ফিসফাস কথা দশ হাত দূর থেকে শোনা যায়। মনোরম আশপাশের টেবিলে একটু চেয়ে দেখে নিল। তারপর বলল–আপনি সুখী?
-খুব। আপনার কেসটা কী?
বনত না।
–কেন?
বুঝতে পারতাম না। তবে আমাদের দুজনেরই ছিল পরস্পরের প্রতি এক রকমের রিপালশান। সেটা বেঙেবেড়ে একসময়ে কানেকশন কেটে গেল।
-স্যাড।
মনোরম মৃদু একটু হাসল। বলল–আরও স্যাড যে, আমিও অন্য সকলের মতো বউয়ের নামে টাকা রাখতাম, জমি কিনেছিলাম, লকারেও কিছু ছিল। সেগুলো হাতছাড়া হয়ে গেল।
-কিছু রিয়ালাইজ করতে পারেননি?
–না। আমি প্রায় ব্যাঙ্করাপ্ট। আমার সম্বন্ধী দুদে অ্যাডভোকেট। ডিভোর্সের সময়ে মাসোহারা ও বন্দোবস্ত করে নিয়েছে। বিশ্বাস, আমার একটা ওপেনিং দরকার। যে কোনও একটা কাজ। আমি আবার দাঁড়াতে চাই।
বিশ্বাস গম্ভীর এবং সমবেদনার মুখ করে বলল–দেখব ব্যানার্জি, আমি প্রাণপণ চেষ্টা করব।
-দেখবেন।
বিয়ার শেষ করে দুজনেই উঠেছিল। বাইরে তখন বৃষ্টি থেমে গেছে। ভেজা পার্ক স্ট্রিটটাকে কুচকুচে কালো দেখাচ্ছিল। জলে ছায়া ফেলে নিথর দাঁড়িয়ে ছিল বিশ্বাসের গাড়িখানা। পুরনো মরিস। তার সাদা রংটা থেকে মেঘভাঙা বোদ পিছলে আসছে।
বিশ্বাসের গাড়িতে একটা লিফট পেতে পারত মনোরম। কিন্তু রেস্তরাঁর দরজায় বিশ্বাস তার একজন চেনা লোক পেয়ে গেল হঠাৎ।
অবিকল টেলিফোনে কথা বলার মতো বিশ্বাস চেঁচিয়ে বলল–হ্যালো! অরোরা, ইজনট ইট? বিসোয়াস হিয়ার।
দুজনে আবার ঢুকে যাচ্ছিল রেস্তরাঁয়। বিশ্বাস ঘাড় ঘুরিয়ে বলল–আচ্ছা ব্যানার্জি, বাই।
মনোরম হাতটা তুলল। তারপর পার্ক স্ট্রিট ধরে হাঁটতে লাগল পশ্চিমমুখো।
ময়দানের ধার ঘেঁষে দক্ষিণমুখো ট্রামগুলো দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি। এতক্ষণ লোকজন বৃষ্টির জন্য আটকে ছিল গাড়িবারান্দায়, দোকানঘরে, বাসস্টপের শেড-এ এখন সব সরষেদানার মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে চারধারে। ট্রাম বন্ধ, বাসে তাই লাদাই ভিড়। হাতে পায়ে চুম্বকওয়ালা কলকাত্তাই লোকেরা বাসের গায়ে সেঁটে আছে অবলীলায়। বাসের গা থেকে অন্তত তিন হাত বেরিয়ে আছে মানুষের নশ্বর শরীর।
মনোরমের ঠিক এক্ষুনি কোথাও যাওয়ার নেই। যতক্ষণ বিয়ারের গন্ধ শরীরে আছে ততক্ষণ গড়িয়াহাটার কাছে মামার কাঠগোলায় ফেরা যাবে না। বৃষ্টির পর এসপ্লানেড এখন ভারী ঝলমলে, রঙিন শো-উইনডোতে দোকানের হাজার জিনিস, রঙিন পোশাকের মানুষ, রঙিন বিজ্ঞাপন। টেকনিকালার ছবির মতো চারদিকের চেহারা এখন ধুলোটে ভাবটা ধুয়ে যাওয়ার পর। কাজ না থাকলেও এসপ্লানেডে ঘুরলে সময় কেটে যায়।
রাস্তা পার হয়ে মেট্রোর উল্টোদিকে ট্যাক্সির চাতালে তখন উঠে-যাওয়া পসাবিরা দ্রুত ফুচকার ঝুড়ি, ভেলপুরির বাক্স, ছুরি কাঁচি কিংবা মনোহারি জিনিস সাজাচ্ছে। ট্রাম টার্মিনাসে দাঁড়িয়ে আছে। ফাঁকা ট্রাম। তারই একটাতে উঠে একটুক্ষণ ঝুম হয়ে বসে থাকবে ভেবেছিল মনোরম। ফুটপাথ ছেড়ে ইট বাঁধানো চাতালটায় নামতে গিয়েও সে বাড়ানো পা টেনে নিল। সীতা না?
সীতাই। সোনা রঙের মুর্শিদাবাদি শাড়ি পরনে, ডান হাতে ধরা দু-একটা কাগজের প্যাকেট বুকে। চেপে সাবধানে হাঁটছে। বাঁ হাতে শাড়িটা একটু তুলে পা ফেলছে। মাথা নোয়ানো। পাতলা গড়ন, ছিপছিপে ছোট্ট সীতা। নরম মুখশ্রী, কাগজের মতো পাতলা ধারালো ছোট্ট নাক, লম্বাটে মুখখানা, ছোট্ট কপাল, চোখের তারা দুটি ঈষৎ তাম্ৰাভ, মাথার চুল বব করা। বেশ একটু দূরে সীতা, ওর মুখখানা সঠিক দেখতে পেল না মনোরম। কিন্তু দূর থেকে দেখেই সবটুকু সীতাকে মনে পড়ে গেল। ছয় সাত বছর ধরে সীতার সবটুকু দেখার কিছুই তো বাকি ছিল না। আশ্চর্য কার্যকারণ! একটু আগে বিয়ারের বোতল সামনে নিয়ে সে হোঁতকা বিশ্বাসটার কাছে সীতার কথা বলছিল।
একটা রগ মাথার মধ্যে ঝিনন করে চিড়িক দেয়। মনোমে গাছের মতো দাঁড়িয়ে থেকে দেখে, কী সুন্দর অপরূপ রোদে সীতা একটু ভেঙে নয়ে মহার্ঘ মানুষের মতো হেঁটে চলেছে। সব জায়গা থেকে হঠাৎ সূর্যরশ্মিগুলি থিয়েটারের আলোর মতো এসে ওকে উদ্ভাসিত করে। পিছনে মরা গাছ, মেঘলা আকাশ, এসপ্লানেড ইস্টের বাড়ির আকাশরেখা, চার দিকে ফড়ে, দালাল, দোকানির আনাগোনা। কিন্তু আবহের আলো এই ভিড়ে কেবলমাত্র সীতাকেই উদ্ভাসিত করে। সোনালি শাড়িটা আগাগোড়া সোনালি, কোথাও কোনও কাজ নেই, আঁচল নেই, সোনালি ব্লাউজ, পায়ে কালো সরু স্ট্রাপের চপ্পল সবটুকু ঝলসায় এই রোদে, কিংবা বোদই ঝলসে ওঠে ওকে পেয়ে? পেটে অঢেল বিয়ার, তাই ঠিক বুঝতে পারে না মনোরম। তলপেটটা জলে ভারী হয়ে টনটন করছে, একটা কেমন গরমি ভাপ বেরোচ্ছে শরীর থেকে, আকণ্ঠ তেষ্টা। ভিখিরি যেমন ঐশ্বর্যের দিকে তাকায়, তেমনি অপলক তাকিয়ে থাকে মনোরম। মনে হয় এই সীতাকে সে কখনও স্পর্শ করেনি।
কোথায় যাচ্ছে সীতা? কোথায় এসেছিল? বোধহয় বেহালার ট্রাম ধরতেই যাচ্ছে। ওদিকের ট্রাম চালু আছে কি? চালু থাকলেও এই ভিড়ে উঠতে পারবে তো সীতা? ভাবল একটু মনোরম।
সীতা ট্রাম লাইন বরাবর হেঁটে গেল। একটু দাঁড়াল, চেয়ে দেখল দু’ধারে। তারপর দুটো থেমে থাকা ট্রামের মাঝ দিয়ে সুন্দর পদক্ষেপের বিভঙ্গ তুলে ওপাশে চলে গেল। দৃশ্যের শেষে যেমন মঞ্চ অন্ধকার হয়ে যায়, নেমে আসে পর্দা, তেমনই হয়ে গেল চারধার। কিছু আর দেখার রইল না।
মনোরম চলল চাতালটা পেরিয়ে গোলঘরের দিকে। তীব্র অ্যামোনিয়ার গন্ধের ভিতরে দাঁড়িয়ে পেচ্ছাপ করল। এবং বেরিয়ে আসার পর টের পেল, ভীষণ একা আর ক্লান্ত লাগছে। কোথাও একটু যাওয়া দরকার এক্ষুনি। কারও সঙ্গে কথা বলে কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক থাকা দরকার। সীতাকে দেখার ধাক্কাটা সে ঠিক সামলাতে পারছে না। সে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না যে, সে সত্যিই সীতাকে দেখেছে। এমন আচমকা হঠাৎ কেন যে দেখল। দেখল, কিন্তু দেখা হওয়া একে বলে না।
আকাশ আজ খেলছে। দ্রুত গুটিয়ে নিল রোদের চাদর। বৃষ্টিটা চেপে আসবে। দু-চারটে চড়বড়ে ফোঁটা মনোরমের আশেপাশে যেন হেঁটে গেল। ততক্ষণে অবশ্য মনোরম লম্বা পা ফেলে জোহানসন অ্যান্ড রোর অফিস বাড়িটায় পৌঁছে গেছে।
পুরনো সাহেবি অফিস। বাড়িখানা সেই সাহেব আমলের গথিক ধরনের। শ্বেতপাথরের মতো সাদা রং, বৃষ্টিতে ভিজেও শুভ্রতা হারায়নি। সামনে খানিকটা সবুজ সযত্নরচিত জমি, শেকল দিয়ে ঘেরা। বাঁকা হয়ে ড্রাইভওয়ে ঢুকে গেছে। সার সার গাড়ি দাঁড়ানো। তার মধ্যে সমীরের সাদা গাড়িটা দেখল মনোরম। অফিসেই আছে।
চমৎকার কয়েকটা থামে ঘেরা পোর্টিকো পেরিয়ে রিসেপশনের মুখোমুখি হওয়ার আগে মনোরম আকাশটা দেখল। গির্জার ওপর ক্রশচিহ্ন, তার ওপাশে আকাশটা সাদা বৃষ্টির চাদরে ঢাকা। ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে। সীতা ট্রামে উঠেছে? না হলে ভিজবে। খুব ভিজবে।
রিসেপশনের বাঙালি ছেলেটা চমৎকার ইংরেজিতে বলে–সমীর রয়? অ্যাকাউন্টস আপ ফার্স্ট ফ্লোর।
মনোরম মাথা নেড়ে সিঁড়ি ভাঙতে থাকে। শ্বেতপাথরের প্রাচীন এবং রাজসিক সিঁড়ি। বহুকাল ধরে পায়ে পায়ে ক্ষয়ে গিয়ে ধাপগুলো নৌকোর খোলের মতে দেবে গেছে একটু। তবু সুন্দর দোতলার মেঝেতে পা দিলে মেজেতে পারসিক কার্পেটের সূক্ষ্ম এবং রঙিন সুতোর মতো কারুকাজ দেখা যায়। কোথাও কোথাও গট (রেছে, তবু তেলতেল করছে পরিষ্কার। মেটা দেওয়ালের মাঝখানে নিঃশব্দ করিডোর, তাতে বদ্ধ বাতাসের গন্ধ। অফিসবাড়িটায় পা দিলেই একটা ওডউইলের অলক্ষ্য অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। গুডউইল। বিশ্বস্ততা এবং সুনাম।
একটা বড় হলঘরের একধারে টিকপ্লাইয়ে ঘেরা চেম্বার। সেখানে সমীর রায় বসে। সামনে প্রকাণ্ড সেক্রেটারিয়েট টেবিল, তার ওধারে সমীর। মনোরমের ভায়রা ভাই। কিংবা ভূতপুর্ব ভায়রাভাই। লম্বা চেহারায় এখন একটু মেদ জমেছে, রংটা কালোই ছিল, এখন ইটচাপা ঘাসের মতো ফরসা হয়েছে। ভাল খায়-দাম, গাড়ি চড়ে বেড়ায়, গায়ে গলায় রোদ লাগে না। সরু টাই, চেয়ারের পিছনে কোট ঝুলছে। ঝুঁকে একটা কাগজ দেখছিল সমীর। চমৎকার একজোড়া মদরঙের ফ্রেমের চশমার ওপর ওর বড় কপাল, লালচে চুল, টিকোলো নাক, এবং গভীর খাঁজওলা থুতনিতে আভিজাত্য ফুটে আছে। সেই মুখশ্রীতে ওর চুয়াল্লিশ কি পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সটা ধরা যায় না। অনেক কম বলে মনে হয়।
মনোরমের কোনও কাজ নেই। ব্যস্ত সমীরের কাছে দু’দণ্ড বসা কি সম্ভব হবে! দু-চারটে কথা কি ও বলবে মনোরমের সাথে! একটু দ্বিধা ও অনিশ্চয়তায় ও টেবিলটার কাছাকাছি এল।
সমীর মুখ তুলে বলল-আরে, মনোরম! কী খবর?
তীক্ষ্ণ চোখে মনোরম সমীরের মুখখানা দেখে নিল। না, খুশি হয়নি। হওয়ার কথাও নয়। চোখ দুটি সামান্য বিস্ফারিত হয়েই আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল। যারা অভিজাত তাদের একটা সুশিক্ষা আছেই, মনোভাব তারা ঢেকে রাখতে পারে। বিস্ময় এবং বিরক্তিকে অনায়াসে চাপা দিয়ে সমীর হাসল।
-একটু এলাম। খুব ব্যস্ত নাকি? মনোরম বলে।
-একটু, বলে সমীর চেয়ারে হেলান দিয়ে আঙুলে মাথার চুল পাট করতে করতে বললসাড়ে চারটেয় কিক অফ। ভাবছিলাম তাড়াতাড়ি কাজটাজ চুকিয়ে একটু মাঠে যাব। বলে ঘড়ি দেখে সমীর বলে–ঠিক আছে, তুমি বোসো। খানিকক্ষণ সময় আছে।
বিয়ারটা এখনও পেটে, ঘাম বা পেচ্ছাপের সঙ্গে এখনও পুরোটা বেরিয়ে যায়নি। মনোরম চেয়ার টেনে বসে হিসেব করে নিচ্ছিল, এতবড় সেক্রেটারিয়েট টেবিলটা পার হয়ে সমীরের নাকে অ্যালকোহলের গন্ধটা যাচ্ছে কিনা। টেবিলের ওপর হেলাভরে পড়ে আছে এক প্যাকেট বেনসন আর হেজেস, ছোট্ট দেশলাই। মনোরম প্যাকেটটা টেনে সিগারেট ধরাল। সমীর লক্ষ না করার ভান করে নিচু হয়ে একটা ড্রয়ার টেনে কী একটু দেখতে লাগল কাগজপত্র।
দামি সিগারেট, কিন্তু বিয়ারের পেটে কোনও ভাল গন্ধ পাওয়া মুশকিল। মনোরম যতদূর সম্ভব স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করল-গীতাদি ভাল?
-ভালই। একটা বাচ্চা হয়েছে জানো তো! ছেলে।
না।
–সাড়ে তিন কেজি। রুমি ভাই পেয়ে খুব খুশি। দিনরাত বেড়ালের মতো থাবা গেড়ে ভাইয়ের মুখের ওপর ঝুঁকে বসে আছে।
বলে এবার সত্যিকারের খুশির হাসি হাসল সমীর। মেয়ে রুমির পর দশ বছর বাদে ওদের ছেলে হল। খুশি হওয়ারই কথা।
মনোরম যান্ত্রিক এবং অন্যমনস্ক গলায় বলে-কংগ্রাচুলেশনস।
সমীর মাথার চুলে মুদ্রাদোষবশত আঙুল চালাতে চালাতে বলে একটু বেশি বয়সে হল, ঠিকমতো মানুষ করে যেতে পারব কি না কে জানে!
সমীরের গলার স্বরটা ভারী এবং পরিষ্কার। একেই কি বা ভয়েস বলে? এত ভদ্র এবং মাজা গলা যেন মনে হয় খুব উঁচু থেকে আসছে। এত শিক্ষিত ও ভদ্র গলায় কখনও কোনও অশ্লীল কথা বলা যায় না। সমীর বোধহয় তার বউকেও কখনও কোনও অশ্লীল কথা বলেনি, যা সবাই বলে! সীতাকে অনেক অশ্লীল কথা শিখিয়েছিল মনোরম, সীতা শুনে দুহাতে মুখ ঢেকে হাসতে হাসতে বলত–মাগো! পরে দু’-একটা ওইসব খারাপ কথা সীতাও বলত। ঠিক সুরে বা উচ্চারণে বলতে পারত না। তখন মনোরম হাসত। এবং ঠিক উচ্চারণটা আর সুরটা শেখাত। সীতা শিখতে চাইত না। সমীর আর গীতা কি অন্তরঙ্গ প্রবল সব মুহূর্তে ওরকম কিছু বলে? বোধহয় না। ওদের রক্ত অনেক উঁচু জাতের।
মনোরম সমীরের নম্র এবং সুন্দর কমনীয় মুখটির দিকে চেয়ে থেকে বলল–মানুষ করবার ভার আপনার ওপর নয়। টাকার ওপর। একটা হেভি ইন্সিওরেন্স করিয়ে রাখুন।
সামান্য একটু গম্ভীর হয়ে গেল সমীর। কিন্তু কথাটা গায়ে মাখল না। ডজ করে বেরিয়ে গেল। বলল–তার অবশ্য দরকার হবে না। যা আছে…বলে একটু দ্বিধাভরে থেমে থাকল। এত ভদ্র সমীর যে, টাকার কথাটা মুখে আনতে পারল না। মনোরমেরই ভুল। সমীররা তিন পুরুষের বড়লোক। ওর এক ভাই আমেরিকার হিউসটনে আছে, বিশ-ত্রিশ হাজার টাকা মাইনে পায়, অন্য ভাই ফিলম প্রোডিউসার। সমীর নিজে বিলেতফেরত অ্যাকাউন্ট্যান্ট। সীতাদের পরিবারের উপযুক্ত জামাই। এ সব প্রায় ভুলেই গিয়েছিল মনোরম। প্রায় একবছর সীতাদের পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। তেমনি চুলে আঙুল চালিয়ে সমীর বলে-তবে ছেলেকে মানুষ হতে দেখে যাওয়াটা বাপের একটা স্যাটিসফ্যাকশন।
মুখে কোনও বিরক্তির চিহ্ন নেই, তবু সমীরের বিরক্তিটা টের পাচ্ছিল মনোরম। ওর চোখ মনোরমের লম্বা চুল, বড় জুলপি আর কাজ করা পাঞ্জাবির ওপর থেমে থেমে সরে গেল। বোধহয় মনে মনে পোশাকটাকে সমীর পছন্দ করল না। কিন্তু কারও ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে কথা বলা সমীরের স্বভাব নয়। অভিজাতদের এইসব সুশিক্ষা থাকেই।
সমীর চোরাচোখে ঘড়িটা একবার দেখে নিল, বলল–তোমার কি কিছু বলার ছিল?
মনোরম মাথা নেড়ে বলল–না। একটু বসব বলে এসেছিলাম। বাইরে যা বৃষ্টি।
-বৃষ্টি! চোখ বড় করে বলে সমীর, তারপর একটু লাজুক হাসি হেসে বলে–বাইরের রোদ বা বৃষ্টি এখানে বসে কিচ্ছু বোঝা যায় না। তারপর একটু চিন্তিতভাবে বলে–খুব বৃষ্টি?
থেমেছিল। আবার বোধহয় শুরু হয়েছে।
অন্যমনস্কভাবে সমীর বলে–খেলাটা না ওয়াশড আউট হয়ে যায়।
কার খেলা?
ছোটবাঙাল আর বড়বাঙাল। উয়াড়ি ভারসাস ইস্টবেঙ্গল। সমীর তার সরু কিন্তু সুবিন্যস্ত দাঁত আর কোমল ঠোঁট দিয়ে আকর্ষক হাসিটা হাসে, তারপর ফোনটা তুলে নিতে নিতে বলোঁড়াও, জেনে নিই।
ফোন করল। বোধহয় ক্লাবে। সমীর অনেক ক্লাবের মেম্বার। আই এফ-এ, সি-এ-বি, ওয়াই-এম-সি-এ এবং আরও কয়েকটার। বোধহয় রোটারিয়ানও। বহুকাল ধরে মেম্বার। এতদিনে দুচারটে ক্লাবের কর্মকর্তাও হয়েছে বোধহয়।
ফোনটা নামিয়ে রেখে সোজা হয়ে বললনা, খেলা হচ্ছে। বৃষ্টিটা বোধহয় থেমে গেল। লিগের যা অবস্থা আজকের খেলাটা খুব ইম্পট্যান্ট।
থুতনিই বোধহয় মানুষের মুখের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। অনেকক্ষণ সমীরকে লক্ষ করে এই সত্যটা উপলব্ধি করে মনোরম। থুতনির চমৎকার খাঁজটি সমীরের বংশগত, ওই খাঁজটিই ওর মুখটাকে এত উঁচুদরের মানুষের মুখের মতো করেছে। অনেক মানুষের মুখই সুন্দর কিন্তু সেই সৌন্দর্যে সব সময়ে ব্যক্তিত্ব থাকে না। সমীরকে দেখলেই যে সম্ভ্রান্ত এবং উঁচুদরের লোক বলে মনে হয় তা কি ওর চমৎকার খাঁজওলা ওই থুতনিটার জন্যই? মনোরম ভাবে। সমীর ঘড়ি দেখছে। বোধহয় প্রায় চারটে বাজে। ওর ওঠা দরকার। কিন্তু সে কথাটা ভদ্রতাবশত মনোরমকে বলতে পারছে না।
মনোরম সংকোচটা ঝেড়ে ফেলে বলে-সীতার কোনও খবর জানেন?
আবার মদরঙের চশমার ভিতরে চোখটা সামান্য বিস্ফারিত হল। বিস্ময়ে। একটু অস্বস্তির সঙ্গে সমীর বলে-সীতা! ভালই আছে। একদিন কি দু’দিন নার্সিং হোম-এ গিয়েছিল ওর দিদিকে দেখতে।
সে খবর নয়, অন্য কোনও খবর?
–আর কী? ওদের বাড়িতে বহুদিন যাই না, ঠিক কিছু বলতে পারব না। কীসের খবর চাও?
মনোরম টেবিলের ওপর কাঁচের ভিতরে চাপা একটা ছবি দেখল। রঙিন ফটোগ্রাফ বলে মনে হয়েছিল প্রথমে। তা নয়, হাতে আঁকা রঙিন প্রিন্ট। বনভূমিতে বেলাশেষের সিঁদুরে আলো, কয়েকটা গোরুর গাড়ি কুঁকে আছে, মাঝখানে আদিবাসী কয়েকজন নারী ও পুরুষ রান্নাবান্না করছে। পথের ওপর গেরস্থালি। ছবিটার মধ্যে একটা গল্প আছে।
সে মুখ তুলে বলল–একটু আগে আমি সীতাকে দেখলাম।
সমীর অস্বস্তিতে চেয়ারের একদিক থেকে আর একদিকে শরীরে ভর দিল। বলল–ও! কোথায়?
–এসপ্লানেডে। বোধহয় মার্কেটিংয়ে এসেছিল। ফিরে যাচ্ছিল তখন।
চুলে তেমনি আঙুল চালায় সমীর। চোখ সরিয়ে নেয় মনোরমের চোখ থেকে, তারপর একটু হালকা গলায় বলে কথাটথা বললে নাকি?
না। আমি কথা বললেও ও পাত্তা দিত না।
মনোরম ক্ষীণ একটু হাসে। সমীর চিন্তিতমুখে পার্টিশনটার দিকে চেয়ে থাকে। তারপর বড় একটা শ্বাস ফেলে লে–আর কিছু বলবে? হাতঘড়িটা দেখে নিয়ে বলে–এখনও একটু সময় আছে।
কটা বাজে?
চারটে প্রায়।
–আমার কিছু বলার ছিল।
-খুব কি জরুরি কথা?
–খুব। অন্তত আমার কাছে।
–খুব জরুরি হলে না হয় আজকের প্রোগ্রামটা…
না না। আমি…আমার খুর অল্প কথা।
সমীর একটু ঝুঁকে মুখখানা তুলে চেয়ে রইল।
মনোরম বলার আগে আর একবার বনভূমির ছবিটা দেখে নিল। মুখ থুবড়ে পড়ে আছে কয়েকটা গোরুর গাড়ি। গাছের ছায়ায় গোধূলি, আদিবাসী নারী ও পুরুষ উনুন জ্বেলেছে।
–আমি আজ সীতাকে দেখলাম।
বলেছ তো।
বলেছি। তবু বলতে ইচ্ছে করছে।
কী?
–সীতা এরপর কী করবে কিছু জানেন?
–ফ্রাঙ্কলি জানি না।
সমীর দুঃখিতভাবে তার দিকে চেয়ে থাকে। মুখে সত্যিকারের সমবেদনা। রক্তাভ সুন্দর আঙুল দিয়ে থুতনির খাঁজটা মুছে নিল অকারণ। একটা পোখরাজ একটু ঝলসে যায়। মনোরম বুঝতে পারে, সমীরের কিছু বলার নেই।
কিন্তু তবু মনোরমের ইচ্ছে হয়, আরও একটুক্ষণ এই সফল সুপুরুষ ও উঁচু ধরনের লোকটির সঙ্গে কাটায়। আর একটু দেখতে ইচ্ছে করে, কী আছে লোকটার। সীতার কথা একটু শুনতে ইচ্ছে করছিল তার।
সে একটা মিছে কথা বলল। চেয়ারটা ঠেলে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে–আমিও মাঠের দিকে যাচ্ছিলাম।
যাবে? বলে একটু বিস্মিতভাবে তাকিয়েই সেই ভদ্র আন্তরিক হাসিটি হেসে বলে–ইউ আর ওয়েলকাম। আমার সঙ্গে চলো।
টেবিলের ওপর ঝুঁকে মনোরম বলে–যাব?
যাবে না কেন?
মনোরম একটু বোকা-হাসি হেসে বলে–আমি কিন্তু একটু মদ্যপান করেছি। অবশ্য তেমন কিছু না, একটু বিয়ার…
তেমন ভদ্র হাসি হেসে সমীর উঠতে উঠতে বলে–গন্ধ পাচ্ছিলাম। তাতে কী? আমিও তো মাঝে মাঝে খাই। ইটস অল ইন দ্য গেম।
টেবিল থেকে চোখ সরিয়ে নেওয়ার আগে শেষবারের মতো মনোরম ছবিটা দেখছিল। রাঙা আলোর বনভূমিতে গো-গাড়ি থামিয়ে গেরস্থালি পেতেছে কয়েকজন আদিবাসী পুরুষ ও রমণী। কী চমৎকার বিষয়, যেন ঠিক একটা গল্প বলা আছে ছবির ভিতরে। ছবিটা দেখতে দেখতেই সমীরের শেষ বাক্যটির চমৎকার ইংরিজি কটা শব্দ শুনে সে চমকে গেল। এখনও ভাল ইংরিজি বলা লোককে তার প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে হয়। আদিবাসীদের ছবি থেকে সে চোখ সরিয়ে কলকাতায় চলে এল এক পলকে। কিছুক্ষণের জন্য যেন বা সে ওই ছবির বনভূমিতে চলে গিয়েছিল।
–আমার কার্ড নেই, লাইন দিয়ে টিকিট কাটতে হবে।
টিকিট? লোকটা পরতে পরতে আবার সেই ভদ্র হাসি, কোমল লাবণ্য, ক্ষমা, সব বিকিরণ করে সমীর বলে–আরে কার্ডফার্ড লাগবে না। আমি…বলে আবার সেই ভদ্রতাসূচক স্তব্ধতা, থেমে বলল–গভর্নিং বডির মেম্বার।
আন্দাজ করেছিল। তাই হাসল মনোরম, মনে মনে বলল–জানতাম। ঘাড় দুটো উঁচু করে স্বাগ করল। বললনা। আমি সবুজ গ্যালারিতেই যাব।
চলো তো।
নিঃশব্দ গাড়ি। ছুটল, শব্দ হল না। কথা না বলে গাড়িটার জোরালো ইঞ্জিনের টান ও গতিটুকু উপভোগ করে মনোরম। কনভার্টিবল বুইক। একটু পুরনো। তবু ভাল। যে কোনও ভাল জিনিস এমনকী একটা গাড়ির চলাও নিবিড়ভাবে উপভোগ করার আছে। মনোরম করে। মামার গাড়িটা ভাল নয়, সেই গাড়িতে সে আজকাল প্রায়ই বীরুর পিছু নেয়।
ইডেন গার্ডেনের উল্টো দিকে গাড়িটা দাঁড় করায় সমীর। বৃষ্টিটা থেমেছে। পিঁপড়ের মতো ময়দান ভেদ করে তোক চলেছে। দূরে উড়ছে একটা লাল সোনালি পতাকা। মাঠে সমীর গাড়ির কাচ বন্ধ করে দরজা লক করে বলল–এখানেই থাক। দূরে থাকাই সেফ।
হাঁটতে হাঁটতে মনোরম বলে আপনি রোজ খেলা দেখেন?
–আরে না, না। মাঝে-মধ্যে। তবে গভর্নিং বডিতে যাওয়ার পর প্রায়ই আসতে হচ্ছে। ওটা এটিকেট।
কখনও টিকিটের গ্যালারি থেকে খেলা দেখেননি?
একটু অস্বস্তি বোধ করে সমীর, দ্বিধাভরে বলে–সেই ছেলেবেলায়, দু-একবার, ঠিক মনে নেই।
-কেন যান না?
–এমনিই! যেতে তো হয় না, তা ছাড়া ওদিকের ওরা একটু হস্টাইল।
সাধারণ দর্শকের গ্যালারি থেকে যখন মানুষ জামা প্যান্ট খুলে বাতাসে ওড়ায়, চেঁচিয়ে বাপ-মা তুলে গাল দেয় খেলোয়াড়কে, যখন ঘাড়ে লাফিয়ে ওঠে, মস্তিষ্কশূন্য খ্যা-খ্যা হাসে, কনুয়ের বা হাঁটুর গুতো দেয়, তখন তার মাঝখানে এই অতি সুকুমার ও ভদ্র মানুষটিকে কেমন দেখাবে? যখন ইট ছুঁড়ে মারবে, রেফারি, লাইনসম্যান আর ক্লাবের কর্মকর্তাদের পিতৃপুরুষ উদ্ধার করবে তখন কেমন হবে ওই মুখখানার ভাব!
–ওরা হস্টাইল কেন, তা কিন্তু একবার আপনার নিজের দেখে আসা উচিত। গভর্নিং বডির মেম্বারদের দর্শক সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ জ্ঞান থাকা ভাল।
সমীর দ্বিধাভরে বলে–মন্দ বলোনি। কিন্তু এ বয়সে একটা মোটামুটি ভদ্র জীবন যাপন করে, ওই ইট-ছোঁড়া আর খারাপ কথা ভাল লাগে না। হার্শনেসটা ঠিক সহ্য হয় না আমার।
মাঠের কাছাকাছি এসে মনোরম হঠাৎ হাত বাড়িয়ে সমীরের কোমল, পরিষ্কার এবং রক্তাভ একখানা হাত ধরল–আসুন।
সমীর অবাক হয়ে বলে-কোথায়?
সবুজ গ্যালারিতে।
–আরে পাগল, টিম মাঠে নামবে, মেম্বাররা খোঁজাখুঁজি করবে।
মনোরম মিনতি করে–আসুন না। একদিন আমার সঙ্গে দেখুন। ওদের বলবেন শরীর খারাপ ছিল।
সমীর হাত টানাটানি করল না, বিরক্তি দেখাল না। কেবল সহৃদয়ভাবে হেসে বলল–আরে, আজ তুমি আমার গেস্ট। এসো এসো
লড়াইটা মর্যাদার ছিল! সবুজ গ্যালারিতে লম্বা লাইনে সমীরকে দাঁড় করাবে, গ্যালারিতে খিস্তির সমুদ্রে দাঁড় করিয়ে পাশাপাশি খেলা দেখবে–এতটা আশা করেনি মনোরম। বড়লোকেরা যে কী জিনিস দিয়ে তৈরি! টপ করে হারিয়ে দেয়। মনোরম ওই মহার্ঘ গলার স্বরের প্রভুত্বের কাছে হেরে গেল। খুবই বোকা-বোকা লাগছিল নিজেকে।
সমীর তার কাঁধটা বন্ধুর মতো ধরে বলল-চলো।
মনোরম চলল। সসম্ৰমে গেট-এর পাহারাদাররা রাস্তা ছেড়ে দেয়। মনোরম কে সে প্রশ্নই ওঠে না।
ভিতরে দু-চারজন কর্তাব্যক্তি গোছের লোক সমীরকে ঘিরে ধরে। সমীর যে বড় ‘ডোনার’ এ বিষয়ে সন্দেহ নেই, নইলে মনোরমের সন্দেহ ও কোনওকালে ফুটবলে লাথিই দেয়নি।
কথা বলতে বলতেই সমীর ব্যস্তভাবে চলে গেল টেন্ট-এর দিকে, মনোরম যে সঙ্গে আছে, খেয়ালই করল না। একা দাঁড়িয়ে থেকে মনোরম তার নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে হঠাৎ সচেতন হয়ে ওঠে। একা সে দাঁড়িয়ে, চারদিকে ব্যস্ত সমস্ত লোকজন চলে যাচ্ছে। এখন কেউ তাকে সে কে জিজ্ঞেস করলে তার তেমন কিছু বলার নেই। চলাচলের রাস্তাটা ছেড়ে সে গ্যালারির তলদেশে আবছায়ায় এসে দাঁড়ায়। টেস্ট-এর খোলা জানালা দিয়ে ভিতরের অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না। সমীর যে কোথায় গেল। বড় একা লাগে মনোরমের। আর সেই নিঃসঙ্গতায় কেবল টুক টুক করে মুখের ভিতরে নড়ে তার অসহায় জখমি জিভখানা।
ঝলসানো রঙের জার্সিপরা খেলোয়াড়রা সারিবদ্ধভাবে টেন্ট থেকে বেরিয়ে আসছে। কী চমৎকার তাদের সতেজ উরু, নোয়ানো কিন্তু গর্বিত মাথা, চারদিককে অবহেলা করে তারা পলকে গ্যালারির ভিতরকার রাস্তা দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় মাঠের দিকে। সামনে পেছনে পাশে কয়েকজন ভাল চেহারার লোকজন তাদের পাহারা দিয়ে নিয়ে গেল। মনোরম ঈর্ষার চোখে এই তাজা বয়সি খেলোয়াড়দের চলে যাওয়া দেখছিল। সে যদি খেলোয়াড় হত!
আলো থেকে চোখ সরিয়ে গ্যালারির তর আবছায়ার দিকে তাকিয়ে মনোরম নিজেকে দেখতে পাচ্ছিল। পায়ে বুট, হোস আর রনি জার্সি নোয়ানো মাথা, আত্মবিশ্বাসী সতেজ উরুদ্বয়ে মাংসল শক্তির পিচ্ছিলতা। হেঁটে যাচ্ছে মনোরম খেলার মাঠের দিকে। সেখানে হাড়ভাঙা প্রতিদ্বন্দ্বিতা। গ্যালারিতে সীতা বসে আছে, উদগ্রীব তার শুষ্ক উজ্জ্বল মুখখানা। মাঠে বাইশজনের একজন হয়ে মনোরম প্রচণ্ড শক্তিতে ফেটে পড়ে। কী খেলাই খেলছে মনোরম, কী খেলাই যে খেলছে! বাইশজনের মধ্যে ঠিক একজনকেই দেখছে সীত। মনোরমকে।
হঠাৎ মাঠে চিৎকার ফেটে পড়ে। টিম মাঠে নামছে। কল্পনাটা ভেঙে যায়।
মাঠ থেকে চিৎকার আসছে। বলে বুটে লাগাবার শব্দ। দৌড় পায়ের আওয়াজ। একজন চেঁচিয়ে উঠল-হেগো…হলদে চিনি দিয়ে খা। একা বিষয় এবং চুপচাপ দাঁড়িয়ে শোনে মনোরম। আজ বিকেলে সে সীতাকে দেখেছিল। ভুলতে পারছে না।
শেষ পর্যন্ত স্মৃতি ছাড়া মানুষের কিছুই থাকে না বুঝি! গ্যালারিতে ঝুঁকে মানুষ খেলা দেখছে, মাঠে রগ-ছেঁড়া লড়াই কত উত্তেজক, বলে পা লাগার শব্দ কী মাদকতাময় কত মানুষের কাছে। একাকী মনোরম দাঁড়িয়ে আছে গ্যালারির ছায়ায়, বিষণ্ণ, স্মৃতিতাড়িত, উদাসীন। এখনও, মানুষ পৃথিবীতে খেলা করে। ভারী আশ্চর্যের ব্যাপার সেটা। চারদিকে বৃষ্টিবিন্দুর মুক্তো আর মেঘভাঙা রোদের ভিতর দিয়ে পৃথিবীর মাটিতেই হেঁটে গেছে সীতা। কোথা থেকে এসেছিল, কোথায় চলে গেল কে জানে! প্রায় এক বছরে সীতা কত দূরের হয়ে গেছে। সীতাকে চেনার চিহ্নগুলি কি শেষ পর্যন্ত মনোরমের থাকবে। ভুলে যাবে না তো! স্মৃতি ছাড়া তার আর কিছুই নেই। প্রবল বৃষ্টিতে যেমন গাছপালার ধুলোময়লা ধুয়ে যায়। তেমনই কি সীতা মনোরমের সব স্মৃতি ধুয়ে-মুছে ফেলেছে? কিছু কি নেই?
মুখের ভিতরে জিভটা নড়ছে টুক টুক করে। চামচের মতো নড়ন্ত জিভটাই যেন তার স্মৃতিকে ঘুলিয়ে তোলে। সীতা তীব্র আশ্লেষের সময়ে কতবার তার সুন্দর দাঁতে মুখের ভিতরে মনোরমের জিভটাকে নরম করে চেপে ধরে রেখেছে। খাসবায়ুর স্বরে বলেছে ‘নোড়ো না জিভ, চুপ করো’। সীতার সুগন্ধী সুস্বাদু মুখের ভিতরে জিভটা নিথর হয়ে থাকত। এমন প্রবলভাবে সেই অনুভূতিটা আক্রমণ করে মনোরমকে যে তার চোখ বুজে আসে, মুখটা আস্তে একটু ফাঁক হয়, জিভটা। লোভে-প্রত্যাশায় বেরিয়ে আসে। মুখে স্বেদবিন্দু ফুটে ওঠে মনোরমের, গায়ে কাঁটা দেয়, খাস গাঢ় হয়ে আসে। সমস্ত শরীরটা এক অদৃশ্য সীতার বুকে-পড়া, কাছে আসা, আলিঙ্গন-আশ্লেষে বদ্ধ অস্তিত্বের স্বাদ নিতে থাকে। ইডিও-মোটর অ্যাকশন।
ঠিক এই অবস্থায় তাকে দেখল সমীর। টেন্ট-এর ভিতর থেকে বেরিয়ে আসবার মুখে দরজায় দাঁড়িয়ে সে অবাক হয়ে ব্যাপারটা দেখছিল। কাছে এসে বলল–তোমার শরীর কি খারাপ মনোরম?
না, না। লজ্জা পেয়ে মনোরম বলে।
সমীরের অবাক ভাবটা কাটেনি, বলল–চোখ বুজে, জিভ বের করে এমনভাবে কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলে যে আমি চমকে উঠেছিলাম।
কী করবে মনোরম! মনে পড়ে, বড্ড যে মনে পড়ে! কিছু একটা প্রবলভাবে মনে পড়লেই তার ইডিও-মোটর অ্যাকশন হতে থাকে। এই ইংরিজি শব্দটা সীই শিখিয়েছিল তাকে। ছুঁচে সুতো পরাচ্ছে সীতা, অখণ্ড মনোযোগে, খুব ধীর হাতে, চোখ ছোট, ঠোঁট দুটো পাখির ঠোঁটের মতো ছুঁচোলো। দেখতে দেখতে মনোরমেরও চোখ ছোট হয়ে যেত, ঠোঁট ছুঁচোলো হয়ে আসত, দুটো হাত আপনা থেকেই শুন্যে উঠে ছুঁচে সুতো পরানোর ভঙ্গিতে স্থির হয়ে থাকত, হঠাৎ চোখ তুলে দৃশ্যটা দেখেই হেসে ফেলে সীতা একদিন বলেছিল–তোমার ইডিও-মোটর অ্যাকশন আছে। না বুঝে মনোরম বলেছিল-মানে? সীতা উত্তর দিয়েছিল–ওটা সাইকোলজিকাল একটা ব্যাপার। কখনও কখনও সেই ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার কথা মনে পড়ে মনোরমের। কোনও কারণ থাকে না, হঠাৎ মনে পড়ে। সেই ভয়ঙ্কর শব্দ, অন্ধকার রাত, হঠাৎ ঘুম-ভাঙা আঘো-চেতনায় টের পেত, চারদিকে ট্রেনের কামরা ভাঙার শব্দ, কে যেন তাকে বাতাসে ছুঁড়ে দিচ্ছে। মৃত্যুর খুব কাছাকাছি চলে গিয়েছিল মনোরম। মনে পড়লেই তার হাত মুঠো পাকায়, শরীর কুঁকড়ে আসে, চোখ বুজে সে কাল্পনিক আঘাতে বিকট মুখভঙ্গি করতে থাকে। এ দৃশ্য দেখেও সীতা ওই ইংরিজি শব্দটা বলেছিল। ইডিও-মোটর অ্যাকশন। বলত– তোমার যখন ছেলে হবে, আর ছেলেকে যখন আমি ঝিনুকে দুধ খাওয়াব তখন তা দেখে ঠিক তুমিও হাঁ করবে, ঢোক গিলবে, দেখো। ইডিও-মোটর অ্যাকশন থাকলে ওরকম হয়।
দুর্ঘটনাটা এড়ানো গেছে। তাদের ছেলেপুলে হয়নি। সীতা তাই বিবাহ-বিচ্ছেদের পর অবিকল বিয়ের আগের মতো কুমারী হয়ে গেছে। কিন্তু তা কি হয়? হতে পারে? স্মৃতি থেকে যায়। শেষ পর্যন্ত স্মৃতিই থাকে। কুমারী সীতার বুকভরা বিবাহের স্মৃতি, মনোরম জানে।
এসো, বলে সমীর হাঁটতে থাকে। এবং মনোরম কেন সমীরের সঙ্গে এতক্ষণ লেগে আছে তা না-বুঝেই পিছু নেয়। গ্যালারির ফাঁক দিয়ে মাঠে রঙিন জার্সির ছোটাছুটি দেখা যায়। একটু এগোতেই মস্ত আকাশের নীচে সতেজ সবুজ মাঠ, গ্যালারিতে আনন্দিত ভিড়, সাদা উড়ন্ত বলখানা–সব মিলিয়ে সুন্দর দৃশ্যটা দেখে মনোরম। দেখে, কিন্তু তাকে কিছুই স্পর্শ করে না। বরং একটা ভোলা বাতাস এসে ঝাপটা দিতেই তার গা শিরশির করে, একটু শীত করে। সে এই খেলার কিছুই মানে বুঝতে পারে না। তবু সমীরের পিছু পিছু সে যায়। লোহার ঘেরা-বেড়ার গেট দিয়ে মাঠের সাইড লাইনের ধারে গিয়ে বসে। একটা প্রবল চিৎকার উঠতে উঠতে হঠাৎ ফেটে পড়ে উল্লাসে। গোল। দুহাতে কান ঢেকে মনোরম চোখ বুজে থাকে কিছুক্ষণ। এত কোলাহল তার সীতার হেঁটে-যাওয়ার ছবিটা ছিঁড়ে দেয় বুঝি!
সমীর গাঢ় একটা শ্বাস ফেলে সিগারেট ধরাল। মুখে হাসি। একটু ঝুঁকে বলল–বি পাল খেলছে না, আমাদের রেগুলার স্ট্রাইকার। খুব চিন্তা ছিল।
না বুঝে মনোরম হাসল, যেন বা গোলটা হওয়ায় সেও নিশ্চিন্ত। খানিকটা অসহায়ভাবেই সে মাঠের দিকে চেয়ে খেলাটা বুঝবার চেষ্টা করে। সারা মাঠ জুড়ে রঙিন জার্সির ছোটাছুটি। মাঠে চোরা জল লাথি খেয়ে হঠাৎ ছিটকে ওঠে ফোয়ারার মতো। পিছলে পড়ে বহু দূর মাটিতে ঘষটে যায় চতুর খেলোয়াড়েরা। কী সুন্দর ভঙ্গিতে হরিণের মতো লাফিয়ে ওঠে শূন্যে গোলমুখে কয়েকজন হালকা শরীরের মানুষ। বলটা বাতাসে কেমন ধনুকের মতো বাঁক নেয়। দেখতে দেখতে তার ইডিও-মোটর অ্যাকশন হতে থাকে। পা শূন্যে ওঠে, মাথাটা হঠাৎ নড়ে, দুহাত মুঠো পাকায়।
দুটো গোলের পর সমীর হাসল–গেম ইজ ইন দি পকেট। তুমি কী বলবে বলেছিলে মনোরম!
মনোরম একটু ইতস্তত করে। তারপর বলে–মানস লাহিড়িকে আপনি চেনেন?
সমীর একটু থমকায়। তারপর চিন্তা করে বলে–কোন মানস বলো তো!
-জিমন্যাস্ট ছিল। রিং থেকে পড়ে গিয়ে যার কলারবোন ভেঙেছিল এখন রেলের অফিসার, দু-চারটে ক্লাবের কোচ। চেনেন না?
সমীর মাথা নাড়ল, বলল–হ্যাঁ, চিনি।
–আমি খবর রাখি, সীতা ওকে বিয়ে করবে।
সমীর নীরবে কিছুক্ষণ খেলাটা দেখে যেতে থাকল। ভ্রু কোঁচকাল। হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে বলল মনোরম, ফ্রাঙ্কলি আমি কিছুই জানি না। কিন্তু যদি সীতা আবার বিয়ে করেই তাতেই বা কী?
মনোরম সহজ উত্তর দিল না। বলল–ডিভোর্সের পর এক বছর পূর্ণ হতে আর মাস তিনেক বাকি। তারপর আইনত সীতা বিয়ে করতে পারে। কিন্তু
কিন্তু কী?
আমার কয়েকটা কথা ছিল।
সমীরের ভ্রূ কোঁচকানোই ছিল, একটু অধৈর্যের গলায় বলে–আমাকে এ সব ব্যাপারের মধ্যে টেনো না মনোরম। আমি ইনভলভড হতে চাই না। তা ছাড়া সীতার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক তো চুকেই গেছে। আবার কেন? লিভ হার অ্যালোন।
মনোরম মাথা নাড়ল। বলল–তা হয় না। সীতা এখনও আমার কাছ থেকে মাসোহারা পায়।
–তাতে কী?
–তাতে এটুকু প্রমাণ হয় যে, সে আমার ওপর এখনও কিছুটা নির্ভরশীল। নীতিগতভাবে তার সম্বন্ধে দু-চারটে কথা আমি বললে দোষ হয় না। ২৩৪
-কিন্তু আমাকে কেন জড়াচ্ছ?
আপনাকে জড়াচ্ছি না। সীতার কোনও খবর পাওয়ার উপায় আমার নেই। আপনি ও বাড়ির জামাই, আপনি খবর পান। তাই আপনাকে ছাড়া আর উপায় কী?
তুমি বরং সীতাকে চিঠি লেখো, কিংবা টেলিফোন করো।
–টেলিফোন করলে ও ফোন রেখে দেবে। চিঠি ছিঁড়ে ফেলবে।
সমীরের ভদ্র ও সুকুমার মুখে ইতিমধ্যে অধৈর্যের ভাব ফুটে উঠেছে। মনোরম সেটা লক্ষ করে। তবু সমীর বলেকী বলতে চাও?
গোলের সামনে একজন ফরোয়ার্ড ল্যাং খেয়ে মাটিতে গড়াচ্ছে। চারদিক থেকে প্রবল একটা চিৎকার ওঠে। রেফারির বাঁশি বাজে। সমীর হঠাৎ দুহাতে মাথাটা ধরে ধরা গলায় চেঁচিয়ে বলে–গড! পেনাল্টি!
স্পটে বল বসানো হয়েছে। কিন্তু কে কিক নেবে তা নিয়ে একটু ঠেলাঠেলি হতে থাকে। কেউ এগোয় না। মাঠসুদ্ধ লোক ঝুঁকে আছে ব্যাপারটার দিকে। সমীর নিথর। কথাগুলো আটকে আছে মনোরমের গলায়। পেনাল্টি শটটা নিতে ওরা বড় দেরি করতে থাকে। মনোরমের ইচ্ছে করে, উঠে গিয়ে শটটা দিয়ে ফিরে এসে সমীরকে কথাগুলো বলে।
কালো লম্বা একটা ছেলে অবশেষে এগিয়ে যায়। কোমরে হাত দিয়ে হাত দশেক দূর থেকে বলটাকে দেখে। দৌড়োয়। ডান পায়ে কিকটা নেয়। কোমর সমান উঁচু হয়ে ভীমরুলের ডাক ডেকে বলটা গোলে ঢুকে যায়। মাঠ স্তব্ধ।
সেই স্তব্ধতার মধ্যেই মাঠের মাঝখানে বলটা চলে আসে। দুপাশে খেলোয়াড়রা দাঁড়ায় যথাযথ। সমীর অস্ফুট গলায় বলে–গড।
তারপর সিগারেট ধরায়।
মোটে আর একটা গোলের লিড থাকছে। হাফটাইম পর্যন্ত ব্যাপারটা যথেষ্ট নিরাপদ নয়। মনোরম সমীরের মুখ দেখে ব্যাপারটা আঁচ করে নিল।
চিন্তিত সমীর মনোরমের দিকে মুখ ফেরায় এবং স্বয়ংক্রিয় হাতে সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাই এগিয়ে দেয়।
কী বলছিলে যেন।
মনোরম একটা শ্বাস ফেলে বলে সীতার কথা।
–ও। হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলো।
–আসলে সীতার কথাও আমি বলতে চাইছি না।
তবে কী বলতে চাইছ?
–স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের কথা।
বলো।
-মানস লাহিড়ি আমার বন্ধু ছিল, আমাদের বাসায় আসত-টাসত। এবং নামকরা জিমন্যাস্ট বলে আমি তাকে যথেষ্ট খাতির করতাম। সে সীতার খুব প্রশংসা করত। ক্রমে সীতার ভাল লাগতে থাকে। মানস লাহিড়িকে তো আপনি জানেন, কী রকম পেটা প্রকাণ্ড শরীর, কাঁধের হাড় ভাঙা বলে বাঁ দিকটা একটু বেঁকে থাকে, তবু খুবই পুরুষালি চেহারা। অন্য দিকে সীতা একটা চড়াই পাখির মতো ছোট্ট আর নরম আর সুন্দর।
-গুডনেস। সমীর আচমকা চেঁচিয়ে ওঠে।
ও বিরক্ত হয়েছে মনে করে মনোরম থেমে যায়। কিন্তু তারপরই দেখে কর্নার ফ্লাগের কাছ পর্যন্ত গিয়ে সমীরের টিমের রাইট-আউট বলটা সেন্টার করতে পারেনি। বল লাইন পার হয়ে গেছে। গোল কিক।
কী বলছিলে যেন?
–স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের কথা।
বলো।
–কোনও অন্য পুরুষ যখন কোনও বিবাহিতা মহিলার প্রশংসা শুরু করে এবং সেই মহিলা যখন সেই প্রশংসা গ্রহণ করে খুশি হতে থাকে তখন তাদের মধ্যে একটা যৌন শ গড়ে ওঠে।
কীসের ঋণ।
–যৌন ঋণ।
–ওঃ গড!
পেনাল্টি বক্সের মাথা থেকে একজন খেলোয়াড় বলটা বাইরে মেরেছে। মনোরম গভীরভাবে সিগারেটে টান দেয়। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে থাকে।
কী বলছিলে মনোরম? কীসের ঋণ?
–যৌন ঋণ।
–সেটা কী ব্যাপার?
পরস্পরের কাছে তখন একটা না বলা দাবি-দাওয়া তৈরি হতে থাকে। অপরিশোধ্য একটা ঋণ গড়ে ওঠে। ঠিক ভালবাসা এ নয়, এটুকুর জন্য কেউ ঘরসংসার ভাঙে না, তবু এও এক ধরনের স্খলন বা পতন। পরস্পরকে যখনই ভাল লাগতে থাকে, তখনই ভিতরে ভিতরে একটা বাঁধ ভাঙার ইচ্ছে উঁকি দিতে থাকে। যেহেতু সেটা অবৈধ সেই জন্যই সেটা আরও মারাত্মক হয়ে ওঠে।
-ডিসগাস্টিং। বি পাল খেললে এরকমটা হত না।
কার কথা বলছেন?
–বি পাল। আমাদের স্ট্রাইকার। গোললাইন থেকে বলটা ব্যাক করতে পারা ছেলেখেলা ছিল, মজুমদার পারল না দেখলে?
–আমি মানস লাহিড়ির কথা বলছিলাম।
–ওঃ হ্যাঁ, বলো।
—আসলে মানস লাহিড়ির কথাও নয়।
তবে কার কথা।
—স্বামী-স্ত্রীর কথা।
বলো।
–বিয়ের ছয়-সাত বছর পর আর পরস্পরকে নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর তে উত্তেজনা থাকে না।
—বটেই তো।
-সীতার আর আমারও ছিল না।
–হুঁ, হুঁ।
–আর তখন মানস লাহিড়ি আসত।
–ঠিক।
–আর তখন আমরা যখন, অর্থাৎ আমি আর সীতা যখন শারীরিক দিক দিয়ে মিলিত হতাম, মানে বুঝতেই পারছেন
–ও-গুডনেস—
সমীরের টিম অন্য টিমের গোলপোস্ট ঘেঁকে ধরেছে। পর পর চারজন গোলে মাল। পোস্ট, বার খেলোয়াড়ের গা থেকে ফিরে এল। শেষ শটটা গোলকিপার উড়িয়ে দিল বারের ওপর দিয়ে। কর্নার।
কর্নার কিকটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে মনোরম।
কিক থেকে একটা নিষ্ফলা হেড। তারপর গোল-কিক আবার।
শ্বাস ফেলে সমীর বলল-বলো।
—যখন আমরা মিলিত হতাম–মানে শারীরিকভাবে, বুঝলেন?
–হ্যাঁ হ্যাঁ, বলো।
—তখন আমার প্রায়ই মনে হত সীতা আমার কথা ভাবছেন না।
–তবে কার কথা?
-মনে হত, সীতা চোখ বুজে আমার জায়গায় আর একজনকে ভেবে নিচ্ছে এবং তাতে তার সমস্ত শরীরে একটা বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে। মনে মনে সে তখন সেই ঋণ শোধ দিচ্ছে।
-মাই গুডনেস! সমীর চাপ তীব্র গলায় বলে।
মনোরম চমকে মাঠের দিকে তাকাল। না, মাঠে কোনও ঘটনা ঘটেনি। মাঝ-মাঠে একজন বল নিয়ে দুর্বল পায়ে দৌড়োচ্ছে। বেরোতে পারবে না।
সমীর তার দিকেই তাকিয়ে আছে। মনোরম লজ্জা পায়।
কী বলছ মনোরম।
আমার ওরকম মনে হত।
–কেন?
মনে হওয়াকে কেউ ঠকতে পারেনা।
সমীর দ্রুত সিগারেটে টান দেয়। বলে তারপর?
মনোরম দুঃখিত গলায় বলে আমার একটা দোষ, আমি বড্ড বেশি কৌতূহলী। সব ব্যাপারটা আমি জানতে চাই। তাই সীতাকে আমি জিজ্ঞেস করি। মানস লাহিড়িকেও।
-বলো কী?
মনোরম ম্লান একটু হাসল। বললদুজনেই অস্বীকার করেছিল। কিন্তু আমি জানতাম ওরা মিছে কথা বলছে। কিন্তু ব্যাপারটা আমার পক্ষে কী রকম কঠিন হয়ে দাঁড়াল ভেবে দেখুন। আমি সীতার স্বামী, তার সঙ্গে মিলিত হচ্ছি, সম্পূর্ণ বৈধ ভাবে। অথচ জানছি, আমি নই, তার বুক জুড়ে আর একজনের কাছে ঋণ। আমি সেই আর একজনের প্রতিনিধি হয়ে সেই ঋণ শোধ নিচ্ছি মাত্র। এভাবেই আমাদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ক্রমে অবৈধ হয়ে ওঠে।
সমীরের মুখের সুকুমার ভাবটুকু ভেদ করে একটা ঘেন্নার ভাব ফুটে ওঠে। সে বলল–ডিসগাস্টিং। এ সব কী বলছ মনোরম!
–আমি সীতা বা মানসের কথা বলতে চাইছি না। আমি আসলে জানতে চাইছি সব স্বামী-স্ত্রীরই কি এরকম হয়? এরকম হওয়াটাই কি স্বাভাবিক?
নিশ্চয়ই নয়।
–আপনি কখনও গীতাদিকে জিজ্ঞেস করেছেন?
কী?
–তিনি কখনও আর কাউকে…
পলকে ফণা তোলে সমীর। দুখানা চোখ ধ্বক ধ্বক করে ওঠে। মনোরম মুখ আড়াল করে উদ্যত হাতে, যেন বা মার ঠেকাবে।
রিডিকুলাস মনোরম। ভেরি রিডিকুলাস! তুমি কি পাগল?
মনোরম অবাক হয়ে টের পায়, সমীরের টিম একটা গোল দিয়েছে। ৩-১। সমস্ত মাঠ ফেটে পড়ছে উল্লাসে। সবুজ গ্যালারির ওপর শূন্যে ভাসছে ছাতা, উড়ছে জুতো, জামা। সমীর এক পলক তাকিয়ে দেখল মত্র। উত্তেজিত হল না।
মনোরম আস্তে আস্তে আমার যন্ত্রণাটা ঠিক এইভাবে শুরু হয়। অথচ কখনও সীতা বা মানস লাহিড়ি পরস্পরের দিকে এক পাও এগোয়নি। বৈঠকখানা ঘরে তারা বরাবরের মতো দুটো দূরের চেয়ারে বসে থেকেছে, হেসেছে, স্বাভাবিক কথাবার্তা বলেছে। কিন্তু আমি কেন–আমারই কেন যে শান্তি ছিল না।
সমীর হঠাৎ উঠতে উঠতে বলে-মনোরম, তুমি কি খেলাটা আর দেখবে? দেখলে দেখো৷ আমি যাচ্ছি।
না। বলে মনোরম উঠে সরে পিছু নেয়।
গ্যালারির কলরোল তখনও থামেনি। উদ্দণ্ড নাচ নাচছে লোকজন। একজন বুড়ো মোটা মানুষ একসঙ্গে তিনটে সিগারেট ধরিয়ে টানহে, তাকে ঘিরে ভিড়। গ্যালারির সরু রাস্তাটা দিয়ে তারা বেরিয়ে আসে। আগে সমীর, পিছনে মনোরম। স পার হয়ে তারা বড় রাস্তায় এসে পড়ে।
সমীর দ্রুত লম্বা পদক্ষেপে হেঁটে যাচ্ছিল, যেন বা মনোরম তার সঙ্গে নেই। হঠাৎ থমকে সমীর মুখ ফিরিয়ে বলল–পুরুষমানুষের অনেক কাজ থাকে মনোরম। শুধু বউয়ের চিন্তা নিয়ে থাকলেই তার চলে না।
মনোরম দাঁড়িয়ে গেল। সমীর পিছন ফিরে আর তাকাল না, নিজের গাড়ির দিকে চলে গেল।
বিষণ্ণ মনোরম বড় রাস্তা ছেড়ে একা মাঠের মধ্যে নামল। তারপর প্রকাণ্ড মাঠ খানা-জলকাদা ভেঙে পার হতে থাকল। প্রকাণ্ড আকাশের নীচে মাঠখানা বড় অফুরান, ক্লান্তিকর লাগছিল তার।
২. ঝরঝর করে জল
০২.
ঝরঝর করে খানিকটা জল পড়ল কাঁধে। ব্লাউজের হাতটা ভিজে গেল। সীতা মুখ তুলে দেখে, ট্রামের জানালার খাঁজে জল জমে আসছে। ময়দানের দিক সাদা করে আর এক ঝাঁক বৃষ্টি আসছে। নড়বড়ে জানালাটা বন্ধ করতে একবার চেষ্টা করল সীতা। পারল না। এক ভিড় লোক তাকে দেখছে। সকলের চোখের সামনে দ্বিতীয়বার জানালা বন্ধ করার চেষ্টা করতে তার লজ্জা করছিল। অস্বস্তিতে কাঁটা হয়ে বসে থাকে সীতা। ঝরঝর করে জল পড়তেই থাকে। সরে বসবে যে তার উপায় নেই, পাশে। মুশকোমতো এক পুরুষমানুষ বসে আছে। লোভী মুখচোখ, আড়ে আড়ে তাকিয়ে দেখছে।
কেনাকাটা করাটা সীতার একটা নেশার মতো। দরকার থাক বা না থাক, সীতা বরাবর দুপুরের দিকে প্রায়ই বেরিয়ে পড়ে। গড়িয়াহাটা বা নিউ মার্কেটে ঘুরে ঘুরে টুকটাক জিনিস কেনে, বেশি টাকার জিনিস নয়, সস্তা বাহারি চটি, হাতব্যাগ, স্টিলের ছাঁকনি বা চামচ, ডোনার কিংবা অন্য কোনও রূপটান। সংসারে কোনও জিনিস ফেলা যায় না। যখন সীতার সংসার ছিল তখন সব কিছুই কাজে লাগত। এখন তার নিজের সংসার বলে কিছু নেই। তবু নেশাটা রয়ে গেছে। দু পিস ব্লাউজের লন কাপড় কিনেছে। সে, একটা শাড়িতে লাগানোর ফল পাড়, এক কৌটো কাজল, ফাউন্ডেশন, ভাইঝির জন্য স্টিলের চেন-এ একটা ঝকমকে লকেট, এরকম আরও কিছু কাজ বা অকাজের জিনিস। এ সব তার কোলের ওপর জড়ো হয়ে আছে। তার ওপর ভ্যানিটি ব্যাগ আর ভাঁজ করা ছাতা। ব্যাগটা ছোট বলে সব জিনিস আঁটেনি। ব্লাউজপিত্রে প্যাকেটটা ভিজে যাচ্ছে। অস্বস্তিতে আবার চোখ তুলে জলের উৎসটা দেখে সীতা! বৃষ্টিও এসে গেল। ছাঁট আসছে।
পাশের লোকটা হঠাৎ ফিস ফিস করে বলে–জানালাটা বন্ধ করে দেব।
সীতা ঘাড়টা একটু নাড়ল মাত্র।
লোকটা উঠে সীতার ওপর দিয়ে ঝুঁকে জানলাটা বন্ধ করতে চেষ্টা করে। সীতা লোকটার বগলের ঘেমো গন্ধ পায়। বুক পেট গুলিয়ে ওঠে তার। লোকটা জানলা বন্ধ করতে বেশ সময় নিতে থাকে। ততক্ষণ দমবন্ধ করে বসে থাকে সীতা। এবং নির্ভুল ভাবে টের পায়, লোকটা তার নিজের বুকটা হালকাভাবে তার কপালে ছোঁয়াল। জানলাটা বন্ধ করে হাতটা টেনে নেওয়ার সময় খুব কৌশলে সেই হাতটা সীতার কাঁধ স্পর্শ করে গেল। সীতা দাঁতে নীচের ঠোঁটটা চেপে ধরে নিজেকে সামলে নেয়। মেয়েদের শরীরের প্রতি পুরুষের দাবি-দাওয়ার শেষ নেই। হাঁটু, কনুই, হাত যা দিয়ে হোক একটু ছোঁয়ানো চাই।
জানলা বন্ধ করে লোকটা চেপে বসল। সীতা লোকটার প্রকাণ্ড ভারী ঊরুর ঘন স্পর্শ পেল। নিজের উরুতে। যতদূর সম্ভব জানলা ঘেষে বসল। ঘামতে লাগল। অস্বস্তি। জানলা বন্ধ, ফলে লোকের ঘামের গন্ধ, ভ্যাপসা গরম, পাশের লোকটার উরু, এবং ক্রমে কাঁধের স্পর্শ ও সীতাকে আক্রমণ করে। লোকটা বুঝে গেছে, সীত কিছু লবে না, সে লাজুক মুখচোরা মেয়ে। তাই লোকটা ট্রাম থেমে আবার চললেই ঝাঁকুনি লাগার ভান করে ঢলে পড়ছে সামান্য। আর কেউ কিছু টের পায় না, কেবল সীতা পায়। সে ঘামে লাল হয়, আর দাঁতে ঠোঁট কামড়ায়। এ সব নতুন নয় তবু সীতার ঠিক সহ্য হয় না।
ট্রামটা থেমে গেল। রেসকোর্স পার হয়ে ব্রিজটায় উঠবার মুখে। সামনে একটা ট্রাম বোধ হয় খারাপ। সময় লাগবে। ট্রামের ভেতরটা ক্রমে ভেপে পচে ফুলে উঠছে। পচে যাচ্ছে মানুষের শরীর। চারদিক থেকে চোরাচোখের আক্রমণ। পাশের লোকটা ঘেঁষে আসে। ঘাম। গরম। চমকা বৃষ্টিটা থেমে আবার রোদ উঠেছে বাইরে। বড় উজ্জ্বল রাংতারোদ।
সীতা ছোট্ট রুমালে মুখ, গলা মুছল। আর তখনই আবার লোকটার হাতে তার কনুই লাগে। সীতা আড়ষ্ট হয়ে নিজের কোলে হাত দুখানা ফেলে রাখে। অন্যমনস্ক থাকার জন্য সে একটা কোনও চিন্তা করার চেষ্টা করে কিছুক্ষণ। কোনও সুন্দর চিন্তা এলই না।
কেবলই ভেঙে যাওয়া সংসারের কথাই মনে পড়ছিল সীতার। দুটি ঘর ছিল তাদের। মাঝখানের দরজায় একটা হালকা আকাশি রঙের সাটিনের পর্দা। সন্ধেবেলা ঝোড়ো কলকাতার হাওয়া সেই পর্দাটিকে ওড়াত বারবার। টিউবলাইটের আলোয় দুঘরের কোথাও কোনও অন্ধকার ছিল না। এ ঘরে মেঝেয় উবু হয়ে বসে যত্নে পেয়ালায় চা ছাঁকতে ছাঁকতে সে দেখতে পেত ও ঘরে ক্লান্ত মনোরম চেয়ার এলিয়ে বসে আছে। শুধু শার্ট ছেড়েছে আর জুতোজোড়া। পরনে ফুল প্যান্ট, আর স্যান্ডো গেঞ্জি। চোখ বোজা। যতখানি ক্লান্ত তার চেয়ে বেশি ভান করত, সীতার একটু আদর-সোহাগের জন্য। আদর-সোহাগের বড় কাঙাল ছিল মনোরম। রোগ-ভোগা মানুষ একটু নেই-আঁকড়ে আর মাথাভরা চিন্তা-দুশ্চিন্তার বাসা। চা করতে করতে সীতা মাঝে মাঝে তাকাত। মায়া-মমতায় ভরে উঠত বুক। সেটা ঠিক প্রেম নয়, গাঢ় মমতা। করুণাও। সে যাই হোক, একভাবে না একভাবে তাদের জোড় মিলেছিল তো! মনোরমের সেই চা আর সীতার স্পর্শের জন্য অপেক্ষারত দৃশ্যটা মনে পড়ে।
দৃশ্যটা থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিতে চেষ্টা করে সীতা। পারে না। কান্না পায়। কেবলই মনে পড়ে দুঘরের মাঝখানে পর্দা উড়ছে হাওয়ায়, ধু ধু করে জ্বলছে নীলাভ আলো। কোনওখানে অন্ধকার নেই। ও ঘরে তার ক্লান্ত কাঙাল স্বামী মনোরম। ভিতু খুঁতখুঁতে, অসম্ভব পরনির্ভরশীল।
সীতা শুনেছে এখন মনোরম বড় বড় চুল রাখে, লম্বা জুলপি, আর খুব আধুনিক পোশাক-টোশাক পরে। কেন এ সব করে মনোরম তা সীতা জানে না, কিন্তু তখন মনোরম ভাল পোশাক পরত না। সীতা কখনও ঝকমকে শার্ট বা প্যান্ট করে দিলে রাগ করত। ক্রপ করে ছোট্ট চুল রাখত মনোরম। তারা খুব অদ্ভুতভাবে শুত, মনোরমের স্বভাব ছিল সীতার বুকে মুখ গুঁজে শোওয়ার। ওই কদমছাঁট চুল খোঁচা দিত সীতার শরীরে। প্রথমে বিরক্ত হত সীতা। তারপর বুঝেছিল মানুষটা ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখে, জেগেও নানা ভয়ের উদ্বেগের চিন্তা করে। মনে মনে বড্ড একা অসহায় ছিল তার মানুষটা। তাই সীতাকে আঁকড়ে ধরত অমন। বুকে মাথা গুঁজে শুত, এবং সেই শোওয়ার মধ্যে কোনও যৌনকাতরতা ছিল না। ছিল নির্ভরশীলতা। তাই সীতা ওই কদমছাঁট চুলওলা মাথাটা বুকের মধ্যে ধরে রাখতে শিখেছিল। খোঁচা টের পেত না। এবং এমনই অভ্যাসের গুণ যে, ক্রমে ওভাবে মনোরম না শুলে তার অস্বস্তি হতে থাকত। ঘুমের মধ্যে কথা বলত মনোরম। কখনও চেঁচিয়ে উঠত ভয়ে। উঠে বসত। তারপর সীতাকে প্রাণপণে জড়িয়ে ধরে বাচ্চা ছেলের মতো আকুলিব্যাকুলি করত। সীতা ঘুম ভেঙে বলত–আহা, বাট ষাট। এই তো আমি রয়েছি, ভয় কী? ঠিক যেমন শিশুকে মা ভোলায়। গানের গলা। ছিল না মনোরমের। কিন্তু প্রায়দিনই একটা গান সে গাইত। হঠাৎ হঠাৎ বাথরুমে শোওয়ার ঘরে। কিংবা খেতে বসে গেয়ে উঠত–জয় জগদীশ হরে…। একটাই লাইন মাত্র। সীতা হাসত–মোটে আধখানা লাইন ছাড়া আর কিছু জানো না? মনোরম কেমন বিষণ্ণ হেসে একদিন বলেছিল–ছেলেবেলায় ইস্কুলে এই গানটা ছিল আমাদের প্রেয়ার। মনে আছে, ইস্কুলে খুব লম্বা সাত-আট ধাপ সিঁড়ি ছিল, সেখানে সারি দিয়ে তিনশো ছেলে দাঁড়িয়ে ওই গান গাইতাম। যন্ত্রের মতো। গানের অর্থ কিছু বুঝতাম না। একদিন কী যে হল! অনেক দিন টানা বর্ষার পর সেদিন রোদ উঠেছে। বাহান্ন দিন টাইফয়েডে ভুগে সেদিন সকালে আমার দাদা মনোরময় মারা যায়। আগের রাতে দাদার বাড়াবাড়ি হওয়ায় আমাকে প্রতিবেশীদের এক বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল। তাদের বাড়ি থেকেই সকালে খেয়েদেয়ে ইস্কুলে যাব বলে বেরিয়েছি, রাস্তায় পা দিয়েই শুনলাম, আমাদের বাড়ির দিক থেকে কান্নার রোল উঠেছে। যেই শুনলাম অমনি ইস্কুলের দিকে দৌড়োতে শুরু করলাম। দুকানে হাত চেপে দৌড়োচ্ছি, কাঁধের ঝোলানো বইয়ের ব্যাগটা টপাটপ ধাক্কা দিচ্ছে কোমরে, ঘেমে হাঁফিয়ে যাচ্ছি, তবু প্রথম মৃত্যু-অভিজ্ঞতার হাত থেকে আমি প্রাণপণে পালাতে লাগলাম। ইস্কুলে সেদিনও প্রার্থনার সারিতে দাঁড়িয়ে রোজকার মতো গাইছি–জয় জগদীশ হরে…। গাইতে গাইতে দেখি চোখ ভরে জল নেমেছে। চারদিকে আকাশ কী গভীর নীল, কত বড় সেই আকাশ। তার তলায় আমরা কতটুকু কু সব মানুষ! ছোট্ট মানুষ আমরা মস্ত আকাশের দিকে হাতজোড় করে গাইছি–জয় জগদীশ হরে… সেইদিনই যেন গানটা মনের মধ্যে গেঁথে গেল। এখনও অন্য মনে কেবলই মনে পড়ে ওই লাইন। আধখানা। সবটা মনে নেই। গাইলেই বহুকালের পুরনো একটা রোদভরা আকাশ ঝুঁকে পড়ে চোখের ওপরে, কোথা থেকে যেন একটা আনন্দের, বিষাদের গভীর ঢেউ এসে আমাকে তুলে নেয় আমি যেন তখন পৃথিবীর ধুলোময়লা থেকে ওপরে উঠে ভাসতে থাকি। তাই গাই।
এক একদিন ঘুম ভেঙে অন্ধকারে উঠে ঝুম হয়ে বসে থাকত মনোরম। সীতা ঘুমের মধ্যে বুকের ভিতরে কদমছাঁট চুলওলা মাথাটা না পেয়ে অস্বস্তি বোধ করে চোখ মেলে খুঁজতে গিয়ে দেখেছে, অন্ধকারে মনোরমের হাত মুঠো পাকানো, শরীর শক্ত, চোয়াল দৃঢ়ভাবে লেগে আছে। সীতা জানত, ওর সেই ট্রেন দুর্ঘটনার কথা মনে পড়েছে।
তখন ও এক বিদেশি ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি। ফার্স্ট ক্লাসে উড়িষ্যা-বিহার ঘুরে বেড়াত। রোগা হলেও সুন্দর মুখশ্রী আর চালাকচতুর হাবভাবের জন্য, চমৎকার ইংরিজি বলার জন্যই অত ভাল চাকরি পেয়েছিল মনোরম। প্রায় হাজার টাকা মাইনে পেত, তার ওপর টি এ ছিল অনেক। সেবার উড়িষ্যা যাওয়ার সময়ে ওই দুর্ঘটনা ঘটে মাঝরাতে। তখনও মনোরমের বিয়ে হয়নি সীতার সঙ্গে। কী হয়েছিল তা সঠিক জানত না সীতা। তবে মনোরম দীর্ঘদিন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ফিরে আসে। চাকরিটা যায়নি, তবে কোম্পানি তাকে প্রতিনিধির কাজ থেকে অফিসে নিয়ে আসে নিরাপদ একটু উঁচুদরের কেরানির চাকরিতে। মাইনে কমল না, কিন্তু টি এবন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু মনোরম ছটফট করত অন্য কারণে। ওই যে কলকাতা ছেড়ে প্রায়ই বেরিয়ে পড়া রাতের গাড়িতে, ভোরের আবছা আলোয় গাড়ির জানলা খুলে দক্ষিণ বিহার আর উড়িষ্যার টিলা, উপত্যকা, নদী, পাহাড় আর জঙ্গল দেখে এক অবিশ্বাস্য, অসহ্য আনন্দ, সেইটাই কেড়ে নেওয়া হয়েছে তার কাছ থেকে। কোম্পানির বম্বের অফিসে কিছুদিন কাজ করেছিল মনোরম। ভাল লাগল না। আবার বিহার-উড়িষ্যার শ্বাসরোধকারী প্রকৃতির মধ্যে ঘুরে বেড়াবে, সন্ধ্যার আবছায়ায় পরেশনাথ পাহাড়ের পাদদেশে উশ্রী নদীর ছোট্ট পোলের ওপর দাঁড়িয়ে থাকবে, ধারোয়ার তীরবর্তী টিলার গা বেয়ে উঠে যাবে আস্তে আস্তে, কয়লা খনির অঞ্চলগুলিতে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে গভীর রাতে লরি ড্রাইভারের পাশে বসে দেখবে অন্ধকারের দ্রুতগামী সৌন্দর্য। অফিসের চাকরি সে সহ্য করতে পারত না। একটা নতুন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি তখন আলুমিনিয়ামের তৈরি ছিটকিনি, দরজার নব, নানা রকম অ্যাঙ্গেল আর গৃহস্থালীর জিনিস তৈরি করছিল। তাদের রিপ্রেজেনটেটিভ হয়ে আবার বিহার-উড়িষ্যা ঘুরে বেড়াতে লাগল মনোরম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারল না, ট্রেন খুব জোরে চললে বা আচমকা ঝাঁকুনি লাগলে সে ঘুম ভেঙে আতঙ্কে উঠে বসত, অনেকক্ষণ বুক কাঁপত তার, ইডিও-মোটর অ্যাকশন হতে থাকত। তখন চাকরি ছেড়ে সেই কোম্পানিরই এজেন্সি নিল সে।
দেখা হয়েছিল শিমুলতলায়। পুজোর ছুটিতে। প্রবাসে বেড়াতে গেলে বাঙালিদের ভাব হয়। তেমন হয়েছিল। সীতা তার আগে কখনও প্রেমে পড়েনি। সদ্যযুবতী, তখনও কৈশোরের গন্ধ গায়ে, তখনও শরীরে সেই আশ্চর্য স্বেদগন্ধ। ফুলের পাপড়ি ঝরে গিয়ে সদ্য ফলের গুটি ধরেছে। মনোরম পিছনে বনভূমি রেখে ঢালু রাস্তা বেয়ে নেমে আসছিল, একটু আনমনা, রুণ সুন্দর চিকন মুখশ্রী, বালকের মতো স্বভাব। তারা একসঙ্গে সকলের সাথে বনভোজন করতে গিয়েছিল। ইচ্ছে করে দলছুট হয়ে হারিয়ে গিয়েছিল তারা। বিহারের তীব্র শীত সবে দেখা দিচ্ছে। একটা তিরতিরে নদী বয়ে যাচ্ছিল, স্বচ্ছ জল, জলে তাদের ছায়া। ছায়ায় বুকে মনোরম ইংরিজিতে বলেছিল–মেরিলি র্যাং দ্য বেল, অ্যান্ড দে ওয়্যার ওয়েড..কী চমৎকার টনটনে উচ্চারণ সেই ইংরিজির! নিস্তব্ধপ্রায় সেই শাল জঙ্গলের ভিতরে বয়ে-যাওয়া নদীর শব্দের সঙ্গে কবিতার শব্দগুলিকে কী করে যে মিলিয়ে দিয়েছিল মনোরম! সামনেই পাহাড় ছিল, ওপরে নীল আকাশ, পাখিও কি ছিল না, আর প্রজাপতি! কী সব যে ছিল সেখানে কে জানে! ছিল বোধ হয় কবিতার সেই ঘণ্টাধ্বনিও তাদের মনে, আর ছিল শরীরে সুন্দর গন্ধ ও রোমহর্ষ, ছিল জলে ভেঙে-যাওয়া তাদের ছায়া। এ সবই থাকে। থাকে না কি! নদীর জলে একটা পাথর ছুঁড়ে মনোরম বলল–তুমিও ছুঁড়ে দাও, ওইখানে। সীতা ছুঁড়েছিল। কী হয়েছিল তাতে? কিন্তু মনোরম হেসেছিল। সীতাও। বহু দূর থেকে বনভোজনের দলছুট মানুষজনের গলার স্বর আসছিল। পোড়া পাতার গন্ধ। তবু নিস্তব্ধতাই ছিল। তাদের কথা বলে যাচ্ছিল সেই কুলুকুলুধ্বনিময় স্বচ্ছ জলের নদী, গাছের পাতায় বাতাস, পাখির স্বর।
ভালবাসা কিনা কে জানে। তবে তারা কেউ কাউকে ছোঁয়নি, জাপটে ধরেনি, ওই নির্জনতা সত্ত্বেও। মনোরম শুধু বলেছিল–আমি এতদিন স্বপ্নের মেয়েদের সঙ্গে প্রেম করতাম।
–সে কেমন? সীতা তার তখনও না যাওয়া কৈশোরের কৌতূহল থেকে প্রশ্ন করেছিল।
ছেলেবেলা থেকেই আমার প্রেমের শখ। এত বেশি শখ যে, ছেলেবেলা থেকেই আমি কাল্পনিক মেয়েদের সঙ্গে একা একা কথা বলি। সেই সব মেয়েদের একজন ছিল রিনা। কিন্তু রিনা ঠিক কাল্পনিক ছিল না। আমার আট-দশ বছর বয়সে আমি সত্যিই এক রিনাকে দেখেছিলাম। তারও বয়স ছিল আমার মতোই। পরিচয় ছিল না, কখনও কথা হয়নি, একবারের বেশি দেখা হয়নি, তার মুখ এখন আর আমার মনেও নেই। শুধু মনে আছে, এক বিয়েবাড়ির সিঁড়ির রেলিংয়ে ঝুঁকে সে বর বউয়ের কড়িখেলা দেখছিল। পরনে লাল ফ্রক, মুখখানা ঘিরে ফ্রিলের মতো চিনেছাঁটের চুল। বয়স্কা এক মহিলার গলা তলার হলঘর থেকে তার নাম ধরে ডেকে বলেছিল রিনা নীচে আয় না, অত লজ্জা কীসের! রিনা তার সুন্দর –কুঁচকে একটু চেয়ে থেকে ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নীচের ভিড়ের মধ্যে নেমে গিয়েছিল। এতদিন আগেকার সে ঘটনা, আর আমিও এত ছোট ছিলাম যে, সেই স্মৃতি একটু সুগন্ধের মতো মাত্র অবশিষ্ট আছে। কখনও মনে হয় সে ঘটনা ঘটেইনি, আমার মাথা তা কল্পনা করে নিয়েছে, অথবা আমি কখনও স্বপ্ন দেখেছিলাম। ওই উৎসবের বাড়ি আর.ওই মেয়ের কথা আমি অনেক ভেবেছি, কখনও সত্য কখনও কাল্পনিক মনে হয়েছে। তবে সেই নামটা কী করে মনে রয়ে গেছে, মনে রয়ে গেছে যে মেয়েটি বড় সুন্দর ছিল। আর সঙ্গে আর কখনও দেখা হয়নি। কিন্তু তাতে আমার কোনও অসুবিধা হয় না। আমার মনে যে সব অচেনা মুখ ভেসে যায়, তাদের কাউকে কাউকে রিনা বলে মনে হয়। ওই নামে ডাকি, সাড়া পাই, ভালবাসা জেগে ওঠে, বিশ্বাস হয় কি?
না।
তবে তোমাকে বলি, আমার মেমবউয়ের কথা?
বউ? বলে ভীষণ উৎকণ্ঠায় তাকিয়ে থেকেছিল সীতা।
-না না, আসলে সে কেউ না। আমাদের আলমারিতে ছিল পাথরের তৈরি এক মেমসাহেব পুতুল। তার গোলাপি গা, গোলাপি গাউন, হাঁটু পর্যন্ত সেই গাউনের ঝুল, চোখের তারা নীল। ছেলেবেলায় ঠাকুমা সেই পুতুলটা দেখিয়ে বলত–তোর বউ। আশ্চর্যের কথা, এখনও মাঝে মাঝে যখন কখনও আমার কাল্পনিক বউয়ের কথা ভাবি, তখন ঠিক সেই গোলাপি গা, সোনালি ফ্রক, নীল চোখ, মধুরঙের চুলওলা পুতুলটাই চোখে ভেসে ওঠে। হায়, তার বাস্তবতা নেই, তবু সে আমার মনের মধ্যে চলা ফেরা করে, ঘরদোর গুছিয়ে রাখে, গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে আমার কাল্পনিক সভানের চুল আঁচড়ে দেয়, দিনশেষে জানলার ধারে বসে আমার অপেক্ষায় চেয়ে থাকে।
এখনও? আজও?
মিটমিট করে হেসে মনোরম বলেছিল–ছেলেবেলায় আমি খুব অদ্ভুত ছিলাম। দরজা, জানালা, দেয়ালের সঙ্গে কথা বলতাম। কত সব কথা।
মানুষের সঙ্গেই আমার কথা হত কম। কিন্তু কথা হত কানার মানুষদের সাথে। রোজ যাদের দেখতাম, তাদেরই কাউকে কাউকে মনে মনে কুড়িয়েআনতাম,কানায় খেলবলে। আমাদের মফস্বল শহরের স্টেশনে একটা নির্জন সুন্দর ওভারব্রিজ আছে। সাধারণত লোকে হেঁটেই লাইন পার হয়, ওভারব্রিজ বড় একটা ব্যবহার করে না। আমাদের ওভারব্রিজটা তাই জনশূন্য পড়ে থাকত। আমি সন্ধেবেলায় ওখানে দাঁড়িয়ে প্রায়ই দুরের দিকে চেয়ে থাকতাম। আমি যে-স্বপ্নের জগতে বাস করতাম সেখানে বাস করতে গেলে, চেনা লোক, বন্ধুবান্ধব, ঘনিষ্ঠ লোকজন এক বিষম বাধা। তাতে স্বপ্নের সুতো বারবার ছিঁড়ে যায়। আমারও তাই তেমন কেউ ছিল না, তাই আমারও অধিকাংশ বিকেল কাটত নিঃসঙ্গভাবে ওভারব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে দূরের দিকে চেয়ে স্বপ্ন দেখতে দেখতে। কল্পনার ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে যেত। সেদিন সন্ধে সাতটার শেষ ট্রেন আমাদের ছোট স্টেশন ছেড়ে গেছে। ওভারব্রিজে দাঁড়িয়ে আমি দেখলাম শূন্য প্ল্যাটফর্মে কিছু ছড়ানো মালপত্রের মাঝখানে একটি তোরঙ্গের ওপর মেয়েটি বসে আছে। উদ্বিগ্ন তার মুখচোখ। কাছাকাছি সময়ে আর ট্রেন নেই, পরের গাড়ি ভোরবেলায়।মেয়েটি যে কোথা থেকে এসেছে, কোথায় যাবে কে জানে? আমি মাত্র এইটুকু দেখেছিলাম। আর মনে হয়েছিল মেয়েটি যেন আমার আবছাভাবে চেনা। এর বেশি আর বাস্তবে কিছু ঘটেনি, ঘটেছিল বোধহয় কল্পনায়।
মনোরমের আবার সেই হাসি, শব্দহীন, অর্থময়।
বলুন না! বলে শরীরের সুগন্ধ নিয়ে কাছাকাছি এগিয়ে গিয়েছিল সীতা। উন্মুখ পানপাত্রের মতো।
তারপর তাকে আবার দেখি আমাদের ফুলবাগানে, শীতকালের ভোরবেলায়। পাড়ার বাচ্চা মেয়েরা রোজ সকালে আমাদের বাগান থেকে ফুল চুরি করে নিয়ে যায়। একদিন রাতে ঘুম হয়নি, সারারাত ভয়ঙ্কর সব কল্পনার ছবি দেখেছি। কালে তো পেল আর খোলা বাতাসের জন্য আকুল ব্যাকুল হয়ে বেরিয়ে এলাম। বাগান তখন ঘন কুয়াশায় ঝিম মেরে আছে। আমি দেখলাম, বাগানের ফটকের কাছে একটি মেয়ে ভিখিরির মতো দাঁড়িয়ে। ও কি ফুলচোর? আমি সাড়া দিইনি, চেয়েছিলাম। সেও একদৃষ্টে আমার দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে হঠাৎ মৃদু হাসল। আমি ভয়ঙ্কর চমকে উঠে চিনলাম, এ সেই মেয়ে যাকে আমি স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দেখেছিলাম এবং আরও আগে কবে থেকে যেন চেনা ছিল। সে হেসে এগিয়ে আসতে থাকেফটক পার হয়ে। আমি হিম হয়ে দাঁড়িয়ে, তার পরনে নীল শাড়ি, গলায় কাশ্মীরি স্কার্ফ জড়ানো, ঠিক যেরকম স্কার্ফ আমার মায়ের একটা আছে, নীল শাড়িটাও যেন চেনা। সে লাল সুরকির পথ দিয়ে অনেকটা এগিয়ে এসে মিহি গলায় জিগ্যেস করল–এ বাসায় তুমি থাকো? আমি মাথা নেড়ে জানালাম–হ্যাঁ। সে হাসল–তোমাকে সেদিন দেখেছিলুম স্টেশনের ওভারব্রিজের ওপর দাঁড়িয়েছিলে। বিড়বিড় করে কী বকো তুমি বলো তো? তোমার ঠোঁট নড়ছিল। আমি হেসে মাথা নেড়ে বললাম-কী জানি, হবে হয়তো। সে এবার কাছে এগিয়ে আসে, খুব কাছে। বলে–আমি সেই ছেলেবেলায় কবে তোমাকে দেখেছিলাম, আর এখন তুমি কত বড় হয়ে গেছ। তুমি কেমন মানুষ হয়েছ তা তো জানি না! কিন্তু তোমাকে দেখে মনে হয়, তুমি খুব সৎ আর তোমার মনে খুব মায়া। আমি হাসলাম কী জানি! জানি না। সে বাগানের দিকে একবার ফিরে দেখে নিল, বলল-সৎ লোকেরা কখনও সুখী হয় না। তুমিও দুঃখী বোধ হয়। আর দেখছি তুমি তেমন সবল হওনি, দৃঢ়চেতা হওনি, তাই না? আমি মাথা নাড়ি-হ্যাঁ, ঠিক তাই। সে সুন্দর সকালের রোদের মতোই ফুটফুটে হাসি হাসল–ছেলেবেলার কবেকার এই পূরনো ভুলে যাওয়া মফস্বল শহরে এতদিন পর আমি আবার কেন এসেছি জান? তোমার জন্যই। বলে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে–আসব তোমার কাছে, মাঝে মাঝে আসব। শুধু এই খুব অসময়ে দেখা হবে, যখন মানুষ ঘুমোয় কিংবা কেউ থাকে না কোথাও। অসময়ে মনে রেখো। বলতে বলতে সে পিছন ফিরল। আমাদের বাগানে গাছপালা ঘন, সারাদিন ছায়ায় অন্ধকার হয়ে থাকে। সে এইসব গাছগাছালির মায়াময় ছায়াচ্ছন্নতার ভিতরে চলে গেল। আর তাকে দেখা গেল না। আমি আবার ভোরবেলায় উঠলাম পরদিন। আমাদের কুয়াশায় আচ্ছন্ন বাগানে কেউ ছিল না। আমি সুরকির পথ ধরে বাগান থেকে বেরিয়ে এলাম রাস্তায়। ঝুম কুয়াশায় খুব ভোর-আলোর ভিতরে যতদূর চোখ যায় চেয়ে দেখলাম, সব শূন্য। সে নেই। তখনই আমি বুঝতে পারলাম যে, এ ভুল। আমি আগের দিন ভোরে বাস্তবিক কাউকেই দেখিনি। সে আমার কল্পনা। ফিকে বিষাদে আমার মন ছেয়ে গেল। তবে আমার একটা সুবিধে এই যে আমার কিছু হারায় না। আমি কল্পনায় সব পেয়ে যাই। সেখানে সেও রয়ে গেল চিরদিনের মতো। ভাবতে ভাবতে আমি ভোর, শীতল, প্রায়ান্ধকার জনশূন্য রাস্তায় রাস্তায় অনেকক্ষণ ঘুরে বেড়ালাম। স্বপ্নের সেই মেয়েটি আমাকে কথা দিয়েও ভুলে গেছে বলে কোনও ক্ষোভ রইল না।-ইচ্ছে থাকলেও আমি রোজ রাতে একই স্বপ্ন দেখতে পারি কি? তবে দুঃখ কীসের? ফিরে এসে দেখি ফটকের কাছে আমার ছোট বোন মাধবীলতার আর্চের কাছে দাঁড়িয়ে, মা বারান্দায়। শুধু আমি সামান্য বিস্ময়ের সঙ্গে দেখি, আমার বোনের পরনে চেনা নীল শাড়ি, আর মায়ের গলায় সেই কাশ্মীরি স্কার্ফ জড়ানো।
–এ তো স্বপ্ন!
–স্বপ্ন না থাকলে এই অতি সুকঠিন, বিবর্ণ বাস্তবতা নিয়ে আমি কীভাবে বেঁচে থাকব? একদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে চেয়ে দেখি, আমার মশারির এক ধার তুলে সে আমার দিকে ঝুঁকে চেয়ে আছে। আমার চেতনা জুড়ে তীব্র ভয় লাফিয়ে উঠল। বল-এর মতো লাফাতে লাগল আমার হৃৎপিণ্ড! সে মৃদু হাসল তুমি খুব দুর্বল? কেন? আমি জবাব দিলাম না। সেদিন তার পোশাক ছিল গোলাপি, তাতে জরির কাজ। সে স্নেহের একটি হাত আমার বুকের ওপর ফেলে রেখে ধীরে ধীরে বসল। আমি দেখলাম, সে সালোয়ার আর কামিজ পরে আছে। আমার স্মৃতি তার টানে আমাকে একবার অতীতের দিকে মুখ ফিরিয়ে কী যেন দেখে নিতে বলল। আমি কিছুই মনে করতে পারলাম না। সে আবার মৃদু হেসে বলল–ছেলেবেলা থেকেই তুমি দুর্বল। তোমার মাথায় স্বপ্নের বাসা, তোমার মনে একরত্তি বাস্তবতা নেই। বলতে বলতে সে আরও ঝুঁকে পড়ে সামান্য তীব্ৰস্বরে বলল–আমাকে মনে পড়ে না তোমার? একদিন আমরা বনভোজনে গিয়েছিলাম ছেলেমেয়েরা। দলছাড়া হয়ে তুমি আর আমি পালালাম নদীর ধারে। তুমি ছিলে ভিতু, আমি সব সময়ে তোমাকে সাহস দিতাম। সেই নদীর ধারে আমি তোমাকে কবিতা শুনিয়েছিলাম। তুমি ছিলে বোকা, আসলে কবিতার ভিতর দিয়েই আমি তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম যে, আমি তোমাকে…। তুমি ভয়ংকর অস্বস্তি আর অস্থিরতায় তার মানে বুঝবার চেষ্টা করেনি। তুমি বলেছিলে, পায়ে পড়ি ফিরে চলল। মনে পড়ে? আমি বললাম না। মনে পড়ে না। আবার সেই হাসি হাসল সে–দ্বিধামুক্ত, কোমল কিন্তু জীবনশক্তিতে ভরা। বলল–তুমি সব পেয়েও পেতে চাও না, কেবল পালাতে চাও স্বপ্নের ভিতরে। তাই আমাকে অনেক রাস্তা পার হতে হল। তার গলার স্বরে এবার আস্তে আস্তে আমার সামান্য সাহস ফিরে আসে। বললাম-কোথা থেকে এলে তুমি অত বাক্সবোঝা নিয়ে? রেল গাড়িতেই তুমি কি এসেছ? অনেক দূরে থাকো কি তুমি? না, ছেলেবেলার তোমাকে আমার মনে নেই। তুমি কি রিনা? কিবা আর কেউ, যাকে আমার মনে নেই? সে আমার মাথার বুটি নেড়ে দিল, বলল–তোমার সঙ্গে এই আমার শেষ দেখা। হায়! আমাকে তোমার মনে পড়ল না? অথচ কতদূর থেকে আমি এলুম শুধু তোমার জন্যই। কথা বোলো না, আমার হাত ধরে চুপ করে শুয়ে থাকো। শোনো, আমি তোমাকে একদিন আমাদের বাড়ির একটা গোপন কুঠুরির তালা খুলে ভিতরে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেই ঘরে ছিল কাঠের একটা পুরনো সিন্দুক। তার ভেতরে ছিল অনেক কাগজপত্র, রহস্যময় অনেক পুরনো দলিল, অনেক চিঠি। তুমি আর আমি আমাদের নিষেধের ছেলেবেলায় এক দুপুরে বসে অনেক চিঠি পড়েছিলুম একসঙ্গে। সেইসব চিঠি ছিল আমার মা আর বাবার মধ্যে লেখা প্রেমপত্র। না ভুল বললাম, শুধু প্রেমপত্র নয়, সেগুলো বিয়ের পরে লেখা। কিছু সাংসারিক কথাও তার মধ্যে ছিল। পড়তে পড়তে, হাসতে হাসতে আমরা এক সময়ে দুজনে দুজনের দিকে চেয়ে চুপ করে বসেছিলুম। সেই কাঠের সিন্দুকের ওপর অনেক পুরনো কাগজের গন্ধের মধ্যে। মনে পড়ে? তোমার মনে নেই, কেননা সে সবই অতি তুচ্ছ ঘটনা, খুব সামান্য, তাদের যত্ন করে আমিই মনে রেখেছি এতদিন। হায়! সে সব তুচ্ছ ঘটনা ছাড়া আমার আর কিছু নেই। তোমাকে সেইসব ফিরিয়ে দিতে এসেছি। দিয়ে গেলুম। আমি তার হাত মুঠো করে ধরে রইলুম। সে অন্ধকার ঘরের চারদিকে চাইল। বলল–এই ঘরে আর কে থাকে? ওই বিছানায় তোমার বুড়ি ঠাকুমা আর ছোট ভাই বোন, না? আর পাশের ঘরে তোমার মা বাবা, তাই না? আর এই ছোট্ট বিছানায় তুমি! সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল-সুন্দর সংসার তোমাদের। শান্ত পরিপাটি ভাল মানুষদের পরিবার। তোমাদের ঘরের আনাচে কানাচে সুন্দর সব স্বপ্নেরা ঘুরে বেড়ায়, প্রজাপতির মতো ওড়ে কল্পনা! এরকম পরিবারই আমি ভালবাসি। এতদিন হয়ে গেছে, এখন আর বলাই যায় না যে, আমি তোমাকে…! সে থেমে শুধু আমার দিকে চেয়ে রইল। ঘরে কোথাও আলো ছিল না, কিন্তু আমি তাকে দেখতে পাচ্ছিলাম। কামিজের কলারে জরি তার ঘাড়ের সুন্দর রঙের ওপর জ্বলছে। তার মেরুন ঠোঁট থেকে শিউলি ফুলের মিষ্টি গন্ধে ভরে যাচ্ছে ঘরের বাতাস। তার নরম হাত ক্রমশ গলে যাচ্ছে আমার হাতের মৃদু উত্তাপে। সে অনেকক্ষণ ওইভাবে বসে রইল। আমি তার দিকে চেয়ে রইলাম। অনেকক্ষণ বসে থাকার পর সে হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে মৃদু গলায় বলল-ঘুমোও। যতক্ষণ ঘুমিয়ে না পড়ো ততক্ষণ বসে থাকব। তৎক্ষণাৎ আমি বললাম–তা হলে ঘুমোব না। এসো, দুজনে জেগে থাকি। সে তার দুটো আঙুল আমার চোখের ওপর রাখল, সঙ্গে সঙ্গে আমার শরীর জুড়ে নেমে এল সম্মোহন, ঘুমের এক ঢল।
নিথর হয়ে গল্পটা শুনেছিল সীতা। প্রায় কিশোরী বয়সি সে অদ্ভুত একটা প্রশ্ন করেছিল–সেই বনভোজনে কী কবিতা সে শুনিয়েছিল?
মনোরম তৃপ্তির হাসি হেসে একটা নুড়ি ছুঁড়ে দিল জলে, বলল–মেরিলি র্যাং দ্য বেল, অ্যান্ড দে ওয়্যার ওয়েড…।
সীতা মুখ নিচু করে ছিল তারপর। নদীটা তট অতিক্রম করে তার বুকে উঠে এল। তারপর বুক জুড়ে বয়ে যেতে লাগল। তখন দূরে দু-একটা কণ্ঠস্বর তাদের নাম ধরে ডাকছিল। তারা কেউ উত্তর দিল না। শুনতে পেল না।
সীতা মৃদুস্বরে বলল–এ সবই গল্প।
গল্পই! তোমাকে বলি, চপলা ছাড়া কোনও অনাত্মীয়া মেয়ের গা আমি কখনও দুইনি, ছোঁয়ার মতো করে। অনাত্মীয়াই বা বলি কী করে। চপলা আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়াই ছিল। আমরা দেশের বাড়িতে যখন যেতাম, তখন বাচ্চা ছেলেমেয়েদের একটা বেশ বড় দঙ্গল এক ঢালাও বিছানায় শুতাম। তখন প্রায়ই চপলা আমার মাথার বালিশে ভাগ বসাত। আমার অসতর্ক ঠোঁটে চুমু খেত, ভয়ে আমি কাঠ হয়ে থাকতাম। সঞ্জীবচন্দ্রের একটা উপন্যাসে ছেলেবেলায় আমি একটা প্রেমের ঘটনা পড়ি। নায়িকা তেলের প্রদীপ হাতে রাত্রিবেলায় নায়ককে দেয়ালের ছবি দেখাচ্ছে ঘুরে ঘুরে। ছবি দেখতে দেখতে হঠাৎ নায়ক মুখ ফিরিয়ে বলল তোমার গায়ে কী আশ্চর্য সদগন্ধ। শুনে প্রদীপ ফেলে নায়িকা ছুটে পালিয়ে গেল। ওই কথা দীর্ঘকাল ধরে গুনগুন করে ওঠার মতো আমার মনে রয়ে গেছে, তোমার গায়ে কী আশ্চর্য সদগন্ধ। চপলার শরীরের গন্ধ মনে নেই। বোধহয় সে ঘামের তেলের, কচি ঠোঁটের মিলিত গন্ধ-কিশোরী বা বালিকার গায়ে বোধহয় ওইরকম গন্ধ থাকে। তবু এখনও যখন গভীর রাতে কল্পনায় চপলা চুপি চুপি মশারি সরিয়ে সেই ছেলেবেলার দেশের রাত্রির মতো কাছে আসে, তখন এখনও আমি ফিসফিস করে বলে উঠি–তোমার গায়ে কী আশ্চর্য সুন্দর গন্ধ! চপলা প্রদীপ ফেলে পালায়।
এটুকু বলে মনোরম প্রতীক্ষায় চেয়েছিল।
কী বলবে সীতা? তবে সে ইঙ্গিত বুঝেছিল। অবশেষে বলল–সে সব তো স্বপ্নে!
–স্বপ্নই। কিন্তু আর তো কখনও তাদের স্বপ্ন দেখব না।
–কেন?
মনোরম তীব্র হাতে আবার নুড়ি ছুঁড়ে মারল জলে, বলল–সে সব রেখে গেলাম ওইখানে। নদীতে। চপলা, রিনা, আর সব…
তবে কী থাকল?
–তুমি বলো তো?
–…
–আমি কি আর কখনও সেই আশ্চর্য গন্ধ পাব? পাব না বোধহয়, না?
কৃত্রিম দুঃখে ভরা গলায় বলেছিল মনোরম।
কী জানি।
–তুমি বলো।
.
মনোরম স্পর্শ করেছিল তাকে, কী সাহস। অনেকক্ষণ বুক ভরে টেনেছিল বাতাস, নতুন ফোঁটা ফুলের গন্ধ যেমন নেয় লোকে ঠিক তেমনি। সীতার সুন্দর গন্ধ নিয়েছিল মনোরম। বলেছিল–আমি আর স্বপ্ন চাই না।
প্রবাসে, বিদেশে ছুটিতে যায় যুবক যুবতীরা। কাছাকাছি হয়, একটু রং ছোঁড়াছুড়ি করে। কলকাতায় পা দিয়ে সব ভুলে যায়। বাইরে থেকে ঘরে এসে যেমন বাইরের ধুলো হাত-পা থেকে ধুয়ে ফেলে লোক তেমনি ধুয়ে ফেলে স্মৃতি। কিন্তু সীতা ভোলেনি। ককাতায় ফিরেও।
সীতার দেওয়া টেলিফোন নম্বরটা হারিয়ে ফেলেনি মনোরমও। টেলিফোন করেছিল।
.
আজ বহুকাল বাদে বৃষ্টিতে-ঘোয়া ময়দান পেরিয়ে, ব্রিজ পেরিয়ে, ঢালু বেয়ে যখন নেমে যাচ্ছে। ট্রামগাড়ি, তখন সীতা স্পষ্ট সেই বহুকালের পুরনো টেলিফোনটা কানে তুলে শুনছিল কাঁপা কাঁপা একটা ভিতু গলা–আমি মনোরম। তুমি কি সীতা?
গায়ে কাঁটা দেয়। এখনও।
কলকাতায় তো সেই কনভূমি নেই, স্বচ্ছ জলের নদীটিও নেই। তবু মানুষ ইচ্ছে করলে মনে মনে সেই কনভূমি আর সেই নদী সৃষ্টি করে নিতে পারে। তারা নিয়েছিল।
ভালবাসা? হবেও বা। তখন মনোরম বড় ছন্নছাড়া, চাকরি ছেড়ে এজেন্সি নেওয়ার কথা মাঝে মাঝে বলে। সীতার বাবা ব্যাপারটা আন্দাজ করে বললও ছেলে এখনও লাইন পাচ্ছে না, ওর কি কোনও কেরিয়ার তৈরি হচ্ছে?
তবু বিয়ে হয়েছিল। যেসব ছেলেরা নিজেরা যেচে মেয়েদের কাছে বিয়ের প্রস্তাব করে, তাদের কেমন যেন পছন্দ হয় না সীতার। মনোরমও করেনি। সীতা করেছিল প্রস্তাব।
তারা সুখী হয়েছিল কিনা তা ঠিক বুঝতে বা ভাবতে চেষ্টা করেনি সীতা। সে শুধু ধীরে ধীরে কদমছাঁট চুলওলা মাথাটাকে ক্রমে নিজের বুকের মধ্যে চেপে ধরে রাখতে শিখেছিল। ভালবাসা কি ওইরকমই কিছু? আর একজনের ইচ্ছাকে নিজেরও ইচ্ছা করে নেওয়া? নাকি আরও বড় বিশাল কিছু?
সীতা ভেবে পায় না। আজও বড় মনে পড়ে, দুঘরের মাঝখানে নীল পদাটা উড়ছে ঝোড়ো হাওয়ায়, দুঘর উদ্ভাসিত আলো। এ ঘরে চা ছাঁকছে সীতা, ও ঘরে ক্লান্ত মনোর বসে আছে। অপেক্ষায়। কেবলই এই দৃশ্যটা মনে পড়ে। ঘরের আনাচে কানাচে সুখ তার অকুরের ডানা মেলেছিল কিনা কে জানে। তবু দৃশ্যটা বোধহয় আজ সুখী করে সীতাকে। দুবীও করে।
ট্রামগাড়ি অনেকক্ষণ ধরে থেমে থেমে চলে। রাস্তা যেন আর ফুরোয় না। বৃষ্টি থেমে গেছে কখন। শেষ বেলার রোদ উঠেছে। খোলা জানালা দিয়ে উদাসীন চেয়েছিল সীতা। পাশে বসা পুরুষ কিংবা মানুষের লোভী চোখের আক্রমণ আর টের পাচ্ছিল না সীতা।
.
একটা মেঘের স্তরের ভেতর সূর্য ডুবে গেল। সীতা বাড়ির রাস্তায় এসে পড়ল যখন, তখন হালকা অন্ধকার ছেয়ে যাচ্ছে। একটু অন্যমনে হাঁটছিল, বাড়ির সামনের রাস্তায় দাঁড়ানো অপেক্ষারত মানুষটিকে সে প্রথমে লক্ষ করেনি। কাছাকাছি হতেই লোকটা তীব্র খাসের শব্দ করে ডাকলসীতা।
চমকে উঠে তাকিয়ে সে মজবুত কাঠামোর প্রকাণ্ড শরীরওলা মানসকে দেখতে পেল। মানস লাহিড়ি।
এক পা এগিয়ে এসে মানস বলে–এখন বাড়িতে ঢুকো না।
-কেন?
তা হলে আর বেরোতে পারবে না, আবার পারমিশানফারমিশান নিতে হবে। তার দরকার কী? চলো কেটে পড়ি, ঘুরে-টুরে একেবারে ফিরবে।
সেই জন্যই আপনি দাঁড়িয়ে আছেন রাস্তায়
–সেই জন্যই। তোমাকে মাঝপথে ধরব বলে। চলল জিনিসগুলো আমাকে দাও–নিচ্ছি। কোথায় গিয়েছিলে?
–মাঝে মধ্যে বেরিয়ে পড়ি। এমনি ঘুরে এলাম একটু।
স্ট্যাক্সি নেব?
সীতা হাসল। বলল স্ট্যাক্সি কেন? অনেক দূরের প্রোগ্রাম।
-না, না। কোনও প্রোগ্রাম নেই। যেখানে খুশি একটু যাব। কত কথা জমে আছে।
দুজনে আবার বড় রাস্তার দিকে হাঁটতে থাকে। পাশাপাশি
-খড়্গপুরে গিয়েছিলাম কদিনের জন্য। মানস বলে।
জানি তো! সীতা হাসল।
–জানো তো বটেই। কিন্তু এ কদিন তোমাকে না দেখে কীরকম কেটেছিল খঙ্গপুরে তা তো বলিনি।
সীতা মাথা নিচু করল একটু। কথা বলল না।
আমার শরীরে কোনও রোগ নেই, তবু এ কদিন আমার শরীর জ্বরজ্বর করেছে। মাথা ধরেছে। ইন্টার রেল ওয়েটলিফটিং-এ আমি ছিলাম একজন জাজ, কিন্তু জাজমেন্টও দিয়েছি আবোলতাবোল। কিছু ভাল করে লক্ষই করিনি। ভাবছি কী করে পাতিয়ালায় যাব। এইরকম তোমাকে ছেড়ে।
সীতা তেমনি মুখ নিচু করে থাকে।
-শুনছ?
হু।
–কিছু বলো।
কী বলব?
কীভাবে যাব পাতিয়ালায়? ওখানে কোচদের ট্রেনিং তো অনেক সময় নেবে আরও। বঙ্গাপুরে মাত্র ক’দিনেই যা অবস্থা হয়েছিল…!
সীতা একটা শ্বাস ফেলল। কিছু বলল না।
–কিছু বলো।
সীতা একটু সংকোচ বোধ করছিল। তবু বলল–এক বছর হতে আরও তিন মাস বাকি আছে। তারপর তো..
ঝকঝক করে ওঠে মানসের চোখ, সীতার দিকে ঝুঁকে বলে–তারপর কী?
সীতা সুন্দর দাঁতে নীচের ঠোঁট কামড়াল।
মানস মুখটা সরিয়ে নিয়ে বলেও সব কে আর মানছে? তিন মাস আমি অপেক্ষা করতে পারছি না।
–তাই কি হয়?
–কেন হয় না?
–তিনটে মাস চলে যাবে দেখতে দেখতে।
–তিনটে মাস কিছু কম সময় নয় সীতা। আমরা ইচ্ছে করলে এই তিনটে মাস গেইন করতে পারি।
–ও যদি বাধা দেয়?
–কে?
–ও। বলে মাথা নোয়ায় সীতা।
মনোরম?
হু।
-মনোরম! মনোরম কেন বাধা দেবে?
—যদি দেয়?
-কেন দেবে? ওর কোনও ইন্টারেস্ট তো আর নেই।
–নেই? ঠিক জানেন?
মানস শব্দ করে হাসে।
নেই আমি জানি। তা ছাড়া মনোরম এখন ধ্বংসস্তূপ। জাস্ট এ হিপ অফ ডেব্রিস। বাধা দেওয়ার ক্ষমতা ওর আর নেই।
সীতা চুপ করে থাকে।
–আজকাল রাস্তায় রাস্তায় ফ্যাফ্যা করে বেড়ায়।
থাকগে। আমি শুনতে চাই না। সীতা বলে। থাক। আমিও ঠিক বলতে চাইনি। তবে এক সময়ে ও আমার বন্ধু ছিল। আই ফিল ফর হিম।
সহজেই পাওয়া গেল ট্যাক্সি। বড় রাস্তার মোড়েই সওয়ারি মামাচ্ছিল ট্যাক্সিটা। মানস চলো বলে দৌড়ে গিয়ে ধরল। ড্রাইভার কোথায় যাবেন? এবং তারপর, গাড়ি খারাপ আছে দাদা বলে এড়াতে চেয়েছিল। মানস কোনও কথাই গ্রাহ্য করল না। শান্ত হাতে দরজা খুলে সীতাকে আগে উঠতে দিল, তারপর নিজে উঠল। দরজা বন্ধ করে ড্রাইভারকে বলল–গোলমাল কোরো না, যেদিকে বলছি সেদিকে যাবে, নইলে…ড্রাইভার ঘাড় ঘুড়িয়ে এক পলক দেখে নিল মানসকে, তারপর স্টার্ট দিল।
সীতা জানে, এ অবস্থায় মনোরম হলে ট্যাক্সিওয়ালাই জিতে যেত। মনোরম কিছুতেই এত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ট্যাক্সি ধরতে পারত না।
মানস একটু ঘন হয়ে বসল। ট্রামে সেই মুশকো লোকটার মতোই অবিকল। তবে সীতা এবার সরে গেল না। মানসের একটু ভাঙা চৌকো মুখ, মাথায় পাতলা চুল, চমৎকার দুখানা হরিণ চোখে এক ধরনের মারাত্মক সৌন্দর্য আছে। ওর শরীরটা যেমন কর্কশ আর প্রকাণ্ড আর জোরালো, চোখ দুখানা তেমনই মায়াবী। কাজলের মতো টানা একটা রেখা আছে ওর চোখে, জন্মগত। কথা যখন বলে তখন বড় সুন্দর শোনায় ওর গলা, ঘোষণাকারীদের মতো।
হাত বাড়িয়ে নরম জোরালো পাঞ্জায় সীতার হাত ধরল মানস। সীতা কোনও সংকোচ বোধ করে না। কেবল একটা অস্বস্তি তার হয়। সেটা হাস্যকর অস্বস্তি। মনোরম খুব সিগারেট খেত। তাই যখনই মনোরমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হত সীতা, তখনই সিগারেটের গন্ধ পেত। সিগারেটের জন্য সে কম বকেনি মনোরমকে। কিন্তু গন্ধটা তার বুকে, শিরায়, সর্বত্র ছড়িয়ে গেছে। যেন পুরুষের গায়ে ওই গন্ধ থাকবেই। ওটাই বুঝি পুরুষের গন্ধ। মানস সিগারেট খায় না। ট্যাক্সিতে এত কাছাকাছি বসেও সীতা তাই পুরুষের সেই অমোঘ গন্ধটি পাচ্ছিল না। একটা কেমন অস্বস্তি হয় তার। পুরুষের সেই অমোঘ গন্ধটির জন্য সে উন্মুখ হয় বুঝি মনে মনে।
ব্যাপারটা কিছু নয়। সকলকেই যে এক রকমের হতে হবে তার কী মানে আছে! সীতার হাতখানা নিয়ে আঙুল আঙুলে আশ্লেষে খেলা করল মানস। সীতা বাধা দিল না। একজনের সঙ্গে বউ হয়ে থাকার অভ্যাস ছেড়ে আর একজনের বউ হওয়ার অভ্যাস রপ্ত করা সহজ নয়। এই নতুন অভ্যাসকে নিজের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল সীতা।
–কোথায় যাচ্ছি আমরা?
আগে কিছু খাই। বড্ড খিদে।
–জানি। খুব খিদে পায় আপনার।
মানস হাসল। পরিতৃপ্তির সঙ্গে বলল–ঠিক ধরেছ। আমার শরীরটা যেমন প্রকাণ্ড, তেমনি আমার প্রকাণ্ড খিদে! সব রকম খিদে।
অর্থপূর্ণ হাসছিল মানস। সীতার খাটো ব্লাউজের তলায় পেট পিঠ খোলা। মানসের হাত সীতার করতল ছেড়ে উঠে এল কোমরে। নরম আঙুলে সে সীতার শরীরের মাংসে আঙুল ঢুকিয়ে দিচ্ছিল। মানস এতকাল এ সব করেনি। এখন বোধহয় ওর ধৈর্য ভেঙে যাচ্ছে। মুখের সামনে মাংস, তবু খাবে না, এ কী রকম। সীতা একটু হাসে। তার অনিচ্ছা হয় না। আর একটু ঘন হয়ে বসে মানসের শরীরের সঙ্গে। পেটের কাছে মানসের হাতটা চেপে ধরে রাখে এক হাতে। তার অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে। সে অভ্যাস করে নেবে। এই বড় চেহারার শক্ত মানুষটির কাছাকাছি বসে সে নির্ভরতা পাচ্ছিল।
মানস ফিসফিস করে বলল–আমাকে তুমি করে বলো।
বলব।
এখনই।
তুমি।
ব্যস, হয়ে গেল! বলে হাসল মানস।
সীতা কিছু বুঝতে পারেনি, আচমকা খোঁপার নীচে তার ঘাড়টা চেপে ধরে মানস। অন্য হাতে থুতনি ধরে একপলকে মুখটা ফিরিয়ে নেয় তার দিকে। চুমু খায়। ছোট্ট চুমু, কয়েক সেকেন্ডের।
সীতা ছাড়া পেয়ে বলল-ট্যাক্সিতে? ওঃ মা।
-ও দেখছে না।
সীতা খুব আস্তে বলে–ওর সামনে আয়না রয়েছে।
–দেখলেই কী? আস্তে বলে মানস।
–কী ভাববে?
–কিছু ভাববে না। কলকাতার ট্যাক্সিওয়ালাদের অভ্যাস আছে দেখে।
যাঃ! সীতা হাসল।
এবং মানস আর একবার কাণ্ডটা করল। এবার একটু এগোল মুখটা নিয়ে। তার মুখের লালাতে ঠোঁট ভিজে গেল সীতার। তবু ভালই লাগল। একটু কাঁটা হয়ে রইল সে, ট্যাক্সিওয়ালাটার জন্য। কিন্তু শরীরে এক ধরনের উত্তাপ ছড়িয়ে গেল। নতুন মানুষটিরই উত্তাপ। সীতা বুঝে যাচ্ছিল, সে পারবে। এরকম আত্মবিশ্বাসী, সাহসী, সরল ব্যবহারের মানুষ সে তো আগে দেখেনি। এর অভ্যাসকে নিজের অভ্যাস করে নেওয়া শক্ত নয়। সীতা জানে ট্যাক্সিওয়ালাটা দেখছে সবই, ভয়ে কিছু বলছে না। নিখুঁত চালিয়ে নিচ্ছে গাড়ি।
বড় রেস্তরাঁয় যাব না, কেমন? মানস বলে, স্বরে গাঢ় ভালবাসা।
যা তোমার খুশি।
বড় রেস্তরাঁয় ভিড় কথা হয় না।
সীতা মৃদু প্রশ্রয়ের হাসি হেসে বলে কথা তো হয়েই গেল।
কী কথা হল।
–এই যে, যা করলে, এটাও তো কথাই। মানস হাসল খুব। একটু অন্ধকার এখন। তাই মানসের হরিণ চোখজোড়া দেখতে পাচ্ছে না সীতা। দেখতে ইচ্ছে করছিল খুব।
গড়ের ময়দান ছেড়ে চৌরঙ্গিতে পড়তেই রাস্তার আলো অপসৃয়মাণ উজ্জ্বলতা ফেলছিল গাড়ির মধ্যে। এই আলো, সেই আলো, লাল-সবুজসাদা। সেইসব আলোতে পলকে পলকে মুখখানা পালটে যায়। মানসের মুখ খুব কাছে। ভাল দেখা যাচ্ছে না। ভালবাসায় স্নেহে ওর মাথায় হাত রাখল সীতা। ওর হরিণ:চোখ একবার আলোকে স্পষ্ট, আবার অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে। সীতা নিবিড় চোখে দেখে।
চুল উঠে যাচ্ছে বুঝি? মানসের মাথার চুল নেড়ে সীতা বলল।
–প্রায়। টাক পড়ে যাবে শিগগির। তার আগে টোপর না পরলে…
–টোপর? একটু অবাক গলায় সীতা বলে।
নয় কেন?
টোপর পরা মানে তো সামাজিক বিয়ে, তা কি হবে?
হবে না কেন? একটু অস্বস্তির গলায় মানস বলে।
সীতা হাসল একটু, বিষণ্ণ হাসিটি। বলল–তা কি হয়? কুমারী মেয়েরই সম্প্রদান হয়।
মানস হেলে পড়েছিল সীতার গায়ে, উঠে বসল।
না হয় রেজেস্ট্রিই হল। টোপর পরাটা না হয় এ জন্মে বাদ দিলাম।
সীতা হঠাৎ তার চোখভরা জল টের পেয়ে আঁচল তুলল চোখে, বলল–টোপর পরার শখ থাকলে না হয় আমি সরে যাই…
কী বলে রে মেয়েটা? এঃ মা, কাঁদছ? বলে মানস দুহাতে তাকে টেনে নেয় এবং তখন মানসের শরীরের মাখনের মতো নরম এবং লোহার মতো শক্ত দুরকম পেশির অস্তিত্ব টের পায় সীতা।
কাঁদে না, কাঁদে না। টোপরটা তো ঠাট্টার কথা, আজকাল কেউ পরতেই চায় না। মানস আকুল গলায় বলে।
না। তা কেন? বিয়েতে আলো, সানাই, টোপর-সিথিমোর, কড়িখেলা এ সবের একটা আলাদা স্বাদ। অনেকে বিয়ে বলতে এ সব ভাবে। তুমিও ভাব।
–কে বলল?
–আমি জানি।
–আমার বয়স কত জান?
কত?
–একত্রিশ। এ বয়সে যে রোমাঞ্চ-টোমাঞ্চ সব ঝরে যেতে থাকে। আমি স্বপ্ন দেখি না।
–শুভদৃষ্টির কথাও কখনও ভাব না?
–ও সব নিয়ে ভাববার সময় কোথায়?
–আর ফুলশয্যা?
তুমি ঠাট্টা করছ।
না গো।
–শোনো, আমি বড্ড ব্যস্ত মানুষ। সারা ভারতবর্ষ ঘুরে বেড়াই। তিন-চার বার ইউরোপ,ফার ইস্ট ঘুরেছি। অনেক দেখতে দেখতে আর অনেক ব্যস্ততার মধ্যে আমার ও সব সংস্কার কেটে গেছে। লক্ষ্মীটি, একদম ভেবো না। আমি সত্যি ঠাট্টা করছিলাম।
আর তখন সীতার ভাল লাগছিল খুব, মস্ত বুকে হেলান দিয়ে বসে থাকতে। সে মনে মনে হিরে করে দেখল, যদি মানসের একত্ৰিশ হয়, মনোরমের এখন ছত্রিশ এবং মানস তার চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট। সীতা কলকাতার রাস্তায় একটা বিজ্ঞাপনের হেডিং দেখেছে প্রায়ই-গেট ইওরসেলফ এ ইয়ং হাজব্যান্ড। সে কথাটা ভাবতে ভাবতে সে হঠাৎ আস্তে বললআই অ্যাম গেটি…
কী?
–এ ইয়ংগার হাজব্যান্ড। বলে হাসল সীতা, সম্মোহিতের হাসি।
মানসের সাহসী ও সরল হাত একটু ওপরে উঠেছে তখন। বুকে।
ট্যাক্সিওয়ালা পার্ক স্ট্রিটের ট্রাফিক সিগন্যাল পার হয়ে সামান্য ঘাড় ঘুরিয়ে বলল–কোথায় যাবেন?
চৌরঙ্গি মার্কেট। মানস ভেবে রেখেছিল জায়গাটা। চট করে বলল। ভাবল না। এবং যেখানে হাত ছিল সেখানেই রেখে দিল। সরাল না।
বড় অবাক করা সাহস ওর। সীতা ঠিক এরকমই চেয়েছিল।
সুরেন ব্যানার্জি রোডে ট্যাক্সি ছেড়ে ওরা ঢুকল চৌরঙ্গি মার্কেটে। ছোট্ট ছিমছাম একটা রেস্তরাঁ। খদ্দের নেই।
অনেক খাবারের অর্ডার দিল মানস। দইবড়া, চপ, ঘুগনি।
আর কী খাবে?
–আরও? চোখ কপালে তোলে সীতা।
খাও না বলেই তুমি রোগা।
সীতা মুখে রুমাল চেপে স্রোতস্বিনীর মতো হাসে-মেয়েরা অত খায় না মশাই।
কারও খাওয়া দেখলে তুমি ঘেন্না পাও না তো? অনেকে পায়।
যাঃ! যে খেতে পারে সে খাবে না কেন? ঘেন্নার কী?
আমার বাসায় তো বড় পরিবার। সেখানে অনেকে আছে যারা আমার খাওয়া দেখতে পারেনা।
–আমি পারব। ভয় নেই।
সেই তৃপ্তির হাসিটা আবার হাসে মানস। চৌকো থুতনি আর চোয়ালে হাসিটা খুব জোরালো দেখায়। ঝকঝকে সাজানো দাঁত। মুখে খুব সুন্দর একটা সুস্থতার গন্ধ পেয়েছিল সীতা, চুমুর সময়ে। হরিণ চোখ, তাতে দীর্ঘ পাতা। এত জোরালো মুখে চোখ দুটো বড় বেমানান রকমের মায়াবী। বড় পরিবার কথাটা সীতার মনের মধ্যে নড়ছিল। একটু সময় নিল সে, বলল–বিয়ের পর তোমার পরিবারের কে কী বলবে?
বললেই শুনছে কে? আমি তো গভর্নমেন্টের ফ্ল্যাট পেয়েই গেছি তারাতলায়। অগাস্টে অ্যালটমেন্ট, তুমি তো জানো।
আলাদা থাকাটাই তো সব নয়। সম্পর্ক তো থাকবেই। আর যাতায়াতও।
সব সম্পর্ক কেটে দিচ্ছি।
–কেন?
–কেটে না দিয়ে উপায় কী?
সীতা আবার সংশয়ের যন্ত্রণা ভোগ করে বলে–কেন কেটে দিচ্ছ? আমার জন্যই তো।
ঠিক তা নয়। তবে তোমাকে নিয়ে আলাদা থাকতে চাই। একদম আলাদা আর একা।
–কেন? প্রশ্ন করেই আবার সীতার ঠোঁট কেঁপে ওঠে। চোখে জল চলে আসতে থাকে। আজকাল তার এরকম হয়। ছন্নছাড়া, কারণহীন কান্না পায়। খুব কি বেশি অভিমানী হয়ে গেছে সে?
মানস তার হরিণ চোখ দুখানা সম্পূর্ণ মেলে চেয়ে থাকে। তারপর হাত বাড়িয়ে টেবিলের ওপর পড়ে থাকা সীতার একখানা হাত চেপে ধরে বলে–ও কী! সীতা!
মুখোমুখি বসে ছিল তারা। মানস উঠে সীতার পাশে এসে বসল, কাঁধের ওপর হাত রেখে বলল, কী হল হঠাৎ।
আমার জন্যই তুমি পরিবার ছাড়ছ তো!
–কে বলল?
ফলতে হয় না, টের পাওয়া যায়।
কিছু জানোনা। আমরা কি সুখী পরিবারে বাস করি? ছোট্ট বাসা, জায়গা নেই, রোজ ঝগড়াঝাঁটি, সে এক বিচ্ছিরি পরিবেশ। আমার মা বাবা নেই, শুধু দুই ভাই, তিন কাকা কাকিমা আর খুড়তুতো ভাইবোনদের সঙ্গে থাকি। পিছুটানও কিছুই না। ও সংসার তো একদিন ছাড়তে হতই। আমি অনেকদিন ধরে ঠিক করে রেখেছিলাম যে, বিয়ের পরই আলাদা হব; বিশ্বাস করো।
সীতা সামলে গেল। হাসলও একটু। বলল–আমার সব সময়ে কেন যে কান্না পায়!
-কেন কান্না পাবে? আমরা খুব সুখী হব, দেখো।
কী করে বুঝলে?
আবেগভরে মানস বলে–আমি তোমাকে সুখী করবই। প্রতিজ্ঞা।
হালকা হাসি হাসছিল সীতা, বলল–গায়ের জোরে?
সেকথার উত্তর না দিয়ে অন্য কথা বলে মানস–শুধু তোমার নামটা পালটে দেব।
-কেন?
ও নামে তোমাকে ডাকতে আমার ভাল লাগে না।
–কেন গো?
মনোরম ডাকত।
তাতে কী? মানুষের তো একটাই নাম, সবাই ডাকে।
–তাতে মজা নেই। আলাদা নামে ডাকলেই মজা।
নাম নিয়ে তুমি একটা কিছু ভেবেছ নিশ্চয়ই?
–ভেবেছি।
–কী?
–সীতা নামটার জন্যই তুমি অত দুঃখ-দুঃখী ভাব করে থাক। যেন চারধারে তোমার অশোকবন, রাক্ষসের পাহারা, যেন নির্বাসনে আছ।
অশোকবন’ কথাটায় একটা বিস্মৃতপ্রায় বনভূমির ছায়া সীতার চোখের ওপর দুলে গেল বুঝি? এক পলকের অন্যমনস্কতা কাটিয়ে সে বলল–ডেকো! যেনামে খুশি।
আমি ভেবে রেখেছি।
–কী?
মৌ।
সীতা একটু অবাক হয়ে আবার হেসে ফেলে–বেশ এক অক্ষরের নাম তো?
ভাল নয়?
তুমি যে নাম দেবে, তাই ভাল।
না। তোমার পছন্দ হয়নি?
হয়েছে। ডাকলে কেউ ভুল করে শুনবে বউ বলে ডাকছ।
আসলে তো তাই ডাকা। মৌ মানে মধু।
–জানি।
বাংলার বধূ, বুকে তার মধু, পড়নি?
–জানি। সীতা স্মিতমুখে মুখ তুলে মানসের মুখে চেয়ে থাকে।
নিঃশব্দ পায়ে হঠাৎ বেয়ারা খাবার রেখে যায়।
খাও। মানস গাঢ় চোখে তাকিয়ে বলে।
–আর কি খিদে থাকে?
কেন?
থাকে না গো। ভেতরটা আনন্দে ফেটে পড়ছে।
মানস খুব খুশি হয়। ভারী বোকার মতো হাসতেই থাকে। অকপট হাসি। একটু ঘন হয়ে আসে। সীতা ঘুগনির বাটিতে চামচ ডোবায়।
ঝাল। মানস বলল।
ঝালই তো ভাল।
–আমি ঝাল খেতে পারি না।
তবে তোমাকে রোজ শুকতুনি রেঁধে দেব।
–আমি খাই ফ্যানসুন্ধু ভাত, লাল আটার রুটি, খোসাসুদ্ধ তরকারি, কাঁচা সবজি।
–ভিটামিন?
–ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, প্রোটিন, ক্যালোরি। আমার কখনও অসুখ হয় না।
বলতে নেই।
–কী?
–অসুখ হয় না বলতে নেই।
বলব না তা হলে।
সীতা ঘুগনির সুন্দর স্বাদ জিভে নিয়ে উজ্জ্বল চোখে মানসের দিকে তাকাল। সে সুখী হবে।
আমার শুধু একটা ভয়। সীতা মুখ টিপে বলল।
–কীসের ভয়?
আমার একটা অতীত আছে।
তাতে কী?
–কোনওদিন যদি ও কিছু করে? যদি পিছু নেয়, যদি প্রতিশোধ নেয়?
ভ্রু কুঁচকে চেয়েছিল মানস। প্রবল হাতে হঠাৎ সীতার হাতটা চেপে ধরে বলল–তা হলে ও আমার হাতে শেষ হয়ে যাবে।
সীতা ততটা উদ্বেগে নয়, যতটা ঠাট্টার গলায় বলল–ভয় তোমাকেও।
-কেন?
–যদি কখনও তোমার মনে কিছু হয়?
তক্ষুনি আবেগে মানস প্রায় সীতাকে বুকে টেনে নিতে যাচ্ছিল। রেস্তোরাঁ বলে পারল না। কিন্তু তার মুখচোখ লাল হয়ে গেল উত্তেজনায়, আবেগে, ভালবাসায়। প্রায় বুজেযাওয়া গলায় বলল কোনওদিন না। তুমি এ সব কী বলছ? আমি তোমার জন্য তোমার জন্য বলতে বলতে কথা খুঁজে না পেয়ে মানস রুমাল বের করে মুখ মুছল।
পুরুষকে পাগল করার আয়ুধগুলি মেয়েদের প্রকৃতিদত্ত। এই প্রকাণ্ড মানুষটার শরীরে এখন আর হাড়গোড় নেই। একতাল পিণ্ডের মতো সীতার অভিমান, সংশয় আর ভালবাসার উত্তাপে গলে গলে যাচ্ছে। এখুনি সর্বস্ব দিয়ে দিতে প্রস্তুত। ও এখন সীতার জন্য দশদিন উপোস করতে পারে, খুন করতে পারে, যা খুশি করতে পারে।
সীতা সতর্ক হয়ে গেল। ওকে পাগল করার ইচ্ছে তার নেই। বরং গভীর মায়ায় সীতা বলল তোমার কথা আমাকে কখনও কিছু বল না।
মানস আস্তে আস্তে সহজ হয়ে বসল। রেডিয়োর ঘোষণাকারীর মতো গভীর ঘুমভাঙা সুন্দর গলায় বলল কী বলব! আমার ছেলেবেলা সুন্দর ছিল না। অল্প বয়সে বাবা মারা গেছে, আমরা দু ভাই আর মা কাকাদের কাছে ছিলাম। দুঃখে কষ্টেই। কাকারা খারাপ লোক নয়, কাকিমারাও ভাল ব্যবহার করেছে, কিন্তু মা আমাদের শাস্তি দেয়নি। স্বামী হারিয়ে মা বড় অভিমানী, খুঁতখুঁতে হয়ে গিয়েছিল। কাকিমাদের বা কাকাদের সঙ্গে একটু কিছু হলেই কাঁদত, বিলাপ করত, আমাদের দুই ভাইকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ত রাস্তায়, বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে বলে। এইভাবেই মে কাকাদের আর কাকিমাদের ধৈর্য ভেঙে গিয়েছিল। ঝগড়াঝাটি অশান্তি। তাই মাকে নিয়ে আলাদা হব বলে ছেলেবেলা থেকেই চাকরির চেষ্টা করতাম। করেছিও চাকরি। খেলাধুলোয় ভাল ছিলাম বলে স্কুলের শেষ ক্লাসে পড়ার সময় থেকেই চাকরি করেছি। আলাদা বাসা করার মতোটা পেমন, বকিছুটাকা আসত। এইভাবে বড় হয়েছি আর কী?
কখনও স্বপ্ন দেখনি তুমি?
কীসের স্বপ্ন।
–অনেকে তো অনেক রকম স্বপ্নটপ্ন দেখে।
একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেল মানস। ভেবে ভেবে বলল–স্বপ্ন ছাড়া বোধহয় মানুষ নেই। আমিও কি দেখিনি? অলিম্পিকে যাব, সেনা আনব-এ খুব স্বপ্ন দেখতাম। হল না। ন্যাশনাল মিট-এ বার থেকে পড়ে যাই, তারপর আর জিমন্যাস্টিকসে ফিরে যাওয়া হল না।
কখনও মেয়েদের কথা ভাবনি?
মান হাসে মানস,বলে–মেয়ে! তাদের চিন্তা করতে সাহসই পেতামনা। মা আর ভাইকে নিয়ে আলাদা একটা বাসা হবে, শুধু সেই চিন্তাই করতাম। মাত্র তো কয়েক বছর আগে রেলে চাকরি পেয়েছি। কিন্তু ততদিনে মা মরে গেছে ককাদের সংসারে কিছু টাকাপয়সা দিই বলে কাকারাও আর ছাড়েনি। রয়ে গেলাম। মেয়েদের চিন্তা প্রথম অহয় তোমাকে দেখে। মনোরম তো একটা ক্রিপল, ওর মনও সুস্থ নয়। ওর ঘরে তোমাকে দেখে আমার কী যে হত!
বলে আবার গাঢ় চোখে তাকায় মানস। হঠাৎ গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলে–তোমার কিছু হত না আমাকে দেখে?
সীতা অস্বস্তি বোধ করল একটু। না, হত না। মনোর বড় ভুল করেছিল ওই একটা জায়গায়। মানসকে দেখে কেন কিছু মনে হবেসীতার?তা তো সীতা সেই কদমছাঁট চুলওলা মাথাটাকে নিজের বুকের মধ্যে নিতে শিখে গিয়েছিল।
সীতা মৃদুস্বরে একটা মিথ্যে কথা বলল হত।
বলে মুখ নামিয়ে নিল টেবিলের ওপর। টেবিলে গাঢ় সবুজ রঙের কচি তাতে তার আবছা মুখচ্ছবি, ও কি নদীর জলে তার ছায়া?
কী হত?
কী জানি! অত কি বলা যায়।
বলো না। আমি বুঝে নিয়েছি।
সীতা হাসল।
চলো, কোথাও যাই।
–কোথায়?
চলো না।
রাত হয়ে যাচ্ছে।
–তাতে কী? তোমাকে কেউ কিছু বলবেনা।
সীতা চুপ করে বসে থাকে। মাথা নোয়ানো।
–ভয় পাচ্ছ? আমাকে একটা জীবন আমার সঙ্গেই তো থাকতে হবে।
সীতা একটু চমকায়। ঠিকই তো? ভয়ের কী? বাধ্য মেয়ের মতো সে উঠল।
ট্যাক্সি ধরে তারা এল মস্ত একটা ক্লব ঘরে। বহু পুরনো আমলের প্রকাণ্ড ক্লাব, সাহেবরা তৈরি করেছিল। সামনে লন, তারপর পেটিকো, রিশেপনহল। মানসসীতার হাত ধরে নিয়ে গেল, কোথাও বাধা পেল না, কেউ চেয়েও দেখলনা। রাত প্রায় সাড়েনটা। ক্লাব ঘর প্রায় ফাঁকা। দুচারজন খুব দামি পোশাক পরা লোক গেলাস হাতে বসে আছে, চোখ নিমীলিত।
তারা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠল। কেউ নেই। একটা ঘরে সারি সারি টেবিল টেনিসের টেবিল পাতা। সব বালি, কেবল একটা টেবিলে দুজন ক্লান্ত ছেলে একনাগাড়ে খেলে যাচ্ছে। খুটখাট-টিং শব্দ হচ্ছে। ঘরটা পেরিয়ে তারা আর একটা ঘরে এল। ফকা, আলো জ্বলছে। সুন্দর সাজানো ঘর।
দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে মুখ ঘোরাল মানস। আর তখনই সীতা হঠাৎ বুঝতে পারল, মানস প্রকৃতিস্থ নেই। ওর চোখ জ্বলজ্বল করছে, মুখে রওশ, ঠটিনহে। সীতার একটুও ভয় করল না।
মানস এগিয়ে এসে তার দুকাঁধ ধরে বলল-একটা কথা–
বলো।
আমার কাছে মেয়েরা রহস্যই থেকে গেছে। মানসের গলা কাপল।
–জানি।
–আমি মেয়েদের কিছু জানি না। তাদের শরীর–তুমি আমাকে এই এক্সপিরিয়েন্সটা দেবে?
নির্দ্বিধায় সীতা বলে দেব।
এখনই। দ্রুত দৌড়ে গিয়ে দরজার ছিটকিনিটা তুলে দিয়ে এল মানস।
পর মুহূর্তেই তারা পাগল হয়ে যাচ্ছিল। ডিভান না সোফা কে জানে, তার ওপর তারা ঘুর্ণি ঝড়ের মতো ওলটপালট খাছিল।
প্রথম কিন্তু সীতার এ তো প্রথম নয়। সে তো কুমারী নয়। তার রহস্য দেখেছিল প্রথম আর একজন। বনভূমি পিছনে রেখে একটা ঢাল বেয়ে নেমে এসেছিল এক কৃশ ও সুন্দর পুরুষ। বহুদিন, সে কি বহুদিন হয়ে গেল? সেই পুরুষ মনোরম না হয়ে মানস হতে পারত। হলে সে আজ কত সুখী হত।
ঝড়টা যখন তাকে ঘিরে ফেটে পড়ছে তখন সীতা আকুল শ্বাস টানছিল বার বার। কোথাও…কোথাও…কোথাও সামান্য একটু সিগারেটের গন্ধ নেই। নেই কেন? তার পিপাসায় সীতা শুকছিল মানসের মুখ, গাল, গলা, শ্বাস। না নেই। কিন্তু একটু সিগারেটের কণামাত্র গন্ধের জন্য বড় পাগল পাগল লাগছিল সীতার। সে অস্ফুট গলায় পেঁচিয়ে বলল–এ রকম নয়। না, না…
বসন খোলার মুহূর্তেই থেমে গেল মানস! একটু উদভ্রান্ত সে। কিন্তু চট করে নিজেকে সংযত করার অতুলনীয় ক্ষমতার অধিকারী। ঘোলাটে চোখে সেসীতার দিকে চেয়ে বলে–না?
সীতা কষ্টে হাসল একটু। মাথা নেড়ে জানাল, না।
-কেন?
সীতা উত্তর দিল না।
মানস একপলকে গায়ের র বেড়ে ফেলল। হাল। তা হলে থাক। আমার তাড়া নেই।
টিক টক টুং শব্দ আসছে। বলটা মেঝেতে লাফিয়ে পড়ল। গড়াল। একটা অস্পষ্ট গলা শোনা গেল–নাইন সিক্স..সাইড আউট। অবার টিক টিক শন।
যখন বেরিয়ে আসছিল তারা তখনও পাশের ঘরে সেই দুটি ক্লান্ত ছেলে ফাঁকা ঘরে একনাগাড়ে টেবিল টেনিস খেলে যাচ্ছে। টিকটক টিকটকটিক টক
আবার ট্যাক্সি। আবছা অন্ধকার। বাইরের আলো নানা রং ফেলে যাচ্ছে তাদের ওপর।
আমার তাড়া নেই।
সীতা একটু হাসল, স্নায়ুবিকালের হাসি।
মানস রাগ করেনি, একটু হতাশ হয়েছে বোধহয়। কিন্তু সে কিছু না। আবার বলল যখন নিমন্ত্রণ করে পাতপিড়ি পেড়ে খাওয়াবে, তখন খাব।
কী?
–তোমাকে।
সীতা হাসে।
–পাতিয়ালায় যাওয়ার আগে আমি বিয়ে কর সীতা।
আইন?
দূর হোক গে।
সীতা শ্বাস টানে, একটা সুন্দর সিগারেটের গন্ধ আসছে কোথা থেকে। সীতা চেয়ে দেখে, ড্রাইভারের পাশে বসা অ্যাসিস্ট্যান্ট ছেলেটা একটা সিগারেট ধরিয়েছে। বুক ভরে বাতাস টানল সীতা।
বাড়ির সামনে নেমে যাওয়ার আগে সীতা হঠাৎ জিগ্যেস করল তুমি সিগারেট খাও না?
না। কেন?
–খাও না কেন?
মানস বুঝতে না পেরে বলে আমার কোনও নেশা নেই। সিগারেট খেলে দমের ক্ষতি হয়।
-খুব ক্ষতি।
মানস হাসল, বলল–কেন, সিগারেট খাওয়া তুমি পছন্দ কর?
মাঝে মাঝে খেয়ো, যদি খুব ক্ষতি না হয়।
মানস সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়ল–খাব। আমার ঠিক সহ্য হয় না। তবে মাঝে মাঝে খাব, এবার থেকে। ঠিক আছে?
সীতা সুন্দর ভালবাসার হাসি হাসল। নেমে যেতে যেতে বলল–খেয়ো। মাঝে মাঝে।
কাল আসব যখন তোমার কাছে, তখন…
–আচ্ছা।
–যাই।
.
দাদার ঘরে তখনও মক্কেল আছে। আলো জ্বলছে। কথাবার্তা শুনতে পেল সীতা। সিঁড়িটা অন্ধকার। সীতা পা টিপে টিপে উঠে এল দোতলায়।
বারান্দায় আলো জ্বলছে। বউদি রেলিং থেকে ঝুঁকে আকাশ দেখছে। এ সময়টায় বাচ্চাকে ঘুম পাড়িয়ে বউদি রোজই সিঁড়ির মুখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে, যতক্ষণ দাদা উঠে না আসে। দ্বিতীয় পক্ষের বউ, তাই এখনও স্বামীর জন্যে আগ্রহ শেষ হয়নি।
-ঠাকুরঝি এলে?
হু।
কত রাত হল। প্রায় সাড়ে দশটা।
–একটু ঘুরে এলাম। ঘরে ভাল লাগে না।
–কোথায়?
–অনেক জায়গায়।
একা?
সীতা ভ্রূ কোঁচকাল। বউদির বয়স কম। কৌতূহল বড্ড বেশি।
সীতা বলল–না। দুজন।
–আর কে?
–তুমি চিনবে না।
–তোমার ভাই ভীষণ সাহস।
সীতা একটু বিরক্ত হয়ে বলল-বউদি, আমি সধবাও নই, কুমারীও নই, আমি হিসেবের বাইরের মানুষ। আমার জন্য কারও কিছু এসে যায় না।
তা অবশ্য ঠিক। বলে বউদি চুপ করে যায়। তারপরই হঠাৎ প্রসঙ্গটা ঝেড়ে ফেলে বলল দেখো না, বৃষ্টি এসে গেল প্রায়, তবু মক্কেলগুলো যাচ্ছে না।
এই ছেলেমানুষিটুকুর জন্যই বউদিটাকে খারাপ লাগে না সীতার। দাদার আগের পক্ষের একটা ছেলে, বিলু। দার্জিলিঙে স্কুলে পড়ে। দাদা ইচ্ছে করেই সরিয়ে দিয়েছে তাকে, যাতে সৎমায়ের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল থাকে। কিন্তু দরকার ছিল না। বিলুকে ভালই বাসে বউদি। প্রতি সপ্তাহে চিঠি দেয়। মা-মরা ছেলেটার জন্য কাঁদেও মাঝে মাঝে।
এ সময়ে বাড়িটা নিঃঝুম। বাবা তার ঘরে শুয়ে পড়েছে ন’টায়।
সীতার একটু ক্লান্তি লাগছিল। কিন্তু মনে কোনও অবসাদ নেই। সেখানে রঙিন আলো জ্বলছে।
ঘরে এসে টিউবলাইটটা জ্বালে সীতা। তার একার ঘর। ফাঁকা, নিঃঝুম চারদিক। কাপড় না-ছেড়েই বিছানায় গড়িয়ে পড়ে। একটু শুয়ে থাকে চোখ বুজে। ঝোড়ো বিকেলটার কথা মনে করার চেষ্টা করে। মাথাটা টিপটিপ করছে। অনেকদিন বাদে এত চুমুতে ঠোঁট ফুলে আছে সীতার। ভারী লাগছে, ডান গালে কামড় দিয়েছিল মানস, তার জ্বালা। চোখ বুজে একটু হাসে সীতা। গা এলিয়ে দেয়। পুরুষের মতো একটা প্রবল বাতাস আসে, ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘরে। জলকণা মেশানো বাতাস। ঠাণ্ডা। আজ রাতে কিছু খাবে না সীতা, কাপড় ছাড়বে না, ঘুমিয়ে পড়বে। ঘুমোবে? না, ঘুম আসবে না ঠিক। আজ এতদিনের মধ্যে প্রথম মানস এতটা এগোল। শরীরের কাছে শরীরের কত কথা জমে থাকে। মুখ টিপে সীতা আবার হাসে। হঠাৎ ঝড়ে একটা জানালার পাল্লা ঠাস করে শব্দ করে। একটু চমকায় সে। জানালাটা বন্ধ করে দেওয়া উচিত, কিন্তু উঠতে ইচ্ছে করছে না। ঘর ভিজে যাচ্ছে হ্যাঁচলায়, ভিজুক গে। চোখ বুজে একটা ঝিমঝিমানির মধ্যে চলে যাচ্ছিল সীতা। হঠাৎ শুনতে পেল ফাঁকা হলঘরে দুজন ক্লান্ত ছেলে টেবিল টেনিস খেলছে। টিক-টকটিক-টক…টিকস্টক…।
চমকে চোখ মেলে চায় সে। ধুধু আলো জ্বলছে ঘরে। নীল পর্দা কি ওটা? নীলই তো! পর্দাটা উড়ছে হাওয়ায়। সীতা সমস্তটা মন নিয়ে উঠে বসে। পরদার ওপাশ কী?
কিছুনা। অন্ধকার। বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে বারান্দা, তার রেলিং। অঝোর বৃষ্টি।
সীতা হাতমুখ ধুয়ে এসে বাতি নেবাল। দরজা দিয়ে শুয়ে পড়ল। নিঘুম চোখে তার মনে পড়ল, মনোরমের আর কিছুই নেই।
বিয়ের পরই চাকরি ছেড়ে সীতার নামে এজেন্সিটা নিয়েছিল মনোরম। হঠাৎ বাজারে নতুন ধরনের অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি জিনিসপত্রের চাহিদা দেখা দিয়েছিল। বড়লোক না হলেও ঢের টাকা রোজগার করেছিল সে। টাকা রাখত লকারে, আয়কর ফাঁকি দিতে সোনা কিনেছিল অনেক। জমি কিনেছিল। সবই সীতার নামে। ঠাট্টা করে বলত–আমি হচ্ছি সীতা ব্যানার্জির ম্যানেজার। সবাই তাই জানে।
সীতা কোনও খোঁজখবর রাখত না। মাঝেমধ্যে কাগজপত্র আর চেকে সই দিত, কার খুলতে তাকেই নিয়ে যেত মনোরম। ব্যাঙ্কে তারা লকার খুনবার যে কোড ব্যবহার করত তা ছিল লাভ। এখনও লকারটা সীতার নামেই আছে। মাঝে মাঝে সে যায় লকার খুলতে, এখনও। কোড বলে লাভ বলবার সময়ে কিছু কি মনে হয়?
ডিভোর্সের সময়ে সে ব্যবসাটা ছেড়ে দিতে চেয়েছিল মনোরমকে। দাদা ছাড়তে দেয়নি। বলেছে, ও পুরুষমানুষ, ভবিষ্যতে আবার দাঁড়াতে পারবে। কিন্তু তুই মেয়ে, তোর নামে কোম্পানি, ও কেউ না। এবং আইনমাফিক ম্যানেজারের চাকরি থেকে সীতা মনোরম ব্যানার্জিকে বরখাস্ত করে। তারপর থেকে দাদাই কোম্পানি দেখে, চালায়। লকারে টাকা, সোনা, যাদবপুরে সেন্ট্রাল রোড-এ জমি, সব নিয়ে সীতার কোনও ভাবনা নেই। কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হয়, এভাবে মনোরমকে নিংড়ে না নিলেও হত।
বাইরে ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টির শব্দ হতে থাকে। আধোঘুমে সীতা শুনতে পায়, ফাঁকা ঘরে দুই ক্লান্ত খেলোয়াড়ের একটানা টেবিল টেনিস খেলার শব্দ। টিকটক…টিক-টক…টিক-টক…
৩. এক্ষুনি ঘুমিয়ে পড়ব
০৩.
আমি এক্ষুনি ঘুমিয়ে পড়ব।
আমি উল্টে রেখেছি বই, আলো নিবিয়ে দিয়েছি। এখন আর কাউকেই আমার কিছু বলার নেই। আমার মাথার নীচে একটিমাত্র শক্ত বালিশ, বিছানাটা একটু স্যাঁতসেঁতে, বেডকভারটা ময়লা। তা হোক, তাতে কিছু এসে যায় না। আমি এই একটু ভেজা ভেজা বিছানায়, ময়লা চাদরে ঠিক ঘুমিয়ে পড়ব।
শুভরাত্রি হে আমার টেবিল ল্যাম্প। হাতঘড়ি, বিদায়। বিদায় সিগারেট। কাল আবার দেখা হবে। বিদায়, জেমস বন্ড। কাল আবার দেখা হবে সমুদ্রের তীরে, বিকিনি-পরা ওই মেয়েটি কী যেন নাম তার পাশে। শুভরাত্রি হে আমার দেয়ালের ক্যালেন্ডারের ছবি। শুভরাত্রি হে আমার জানলার পাশে বকুল গাছ। রাত্রির আকাশ, বিদায়। আমি মনোরম, তোমাদের মনোরম। এক্ষুনি ঘুমিয়ে পদ্ধ। না, ভুল…ভুল বললাম; ঘুমের আগে এই যে একটু সময়–যখন সমস্ত শরীরে রিমঝিম করে নেমে আসছে চেতনাহীনতা, যখন শ্রাবণ জুড়ে কেবল ঝিঁঝি পোকার ডাক–তখন এই সময়টুকুতে আমি আর মনোরমনই, তখন আমি এক শিশু ছেলে, যার ডাকনাম ছিল ঝুমু। মা আর বাবার সেই ছোট্ট কুমু! বারো মাস অসুখে ভুগে যার রক্তহীন, সাদা, রোগা ডিগডিগে চেহারা। ডান হাতে মাদুলি, গলায় কবচ। এখন
আমি সেই ছোট্ট কুমু-একটু নির্বোধ, আর একটু অসহায়!..কেউ কিছু বলছ? না, আমার আর কিছুই দরকার হবে না। মানুষ ঠিক ঘুমিয়ে পড়ে। ওই তো ঘুম আসছে ডাকপিওনের মতো। সে আমাদের গলির মুখের ল্যাম্পপোস্ট পার হয়ে এল। হাইড্রাস্টের জল উপচে রাস্তা বুঝি একাকার! সে বেড়ালের মতো লাফ দিয়ে জলময় জায়গাটুকু পার হয়। এখন সে সদরে, রাস্তার মৃদু আলো ঠিক জ্যোৎস্নার মতো পড়ল তার অস্পষ্ট মুখে। শেষ হওয়া সিগারেটের অংশটুকু ছুঁড়ে ফেলে দিল সে। উঠে আসছে নিঃশব্দে। দরজার বাইরে পাপোষে সে তার জুতোয় লেগে থাকা অন্ধকারের কণাগুলি মুছে নিচ্ছে। হাঁসের মতো গা ঝাড়া দিয়ে সেশরীর থেকে জলকণার মতো ঝেড়ে ফেলছে অন্ধকার। এখন সে ঘরের মধ্যে। বজি উলটে ঘড়ি দেখে সে বলল–ভাবনাচিন্তা করার সময় আর অল্পই আছে।
জানি, আমি তা জানি। আমার জানলার পাশে বকুলের ডালপালায় খেলছে বাতাস। কোন দূরের রাস্তায় নতুন করে চলে যাচ্ছে একজন একা রিকশাওয়ালা। কোথায় যেন ট্যাক্সির মিটার জলতরঙ্গের মতো টুংটাং ঘুরে গেল। বালিশের নীচে টিক টিক শব্দ করছে আমার হাতঘড়ি। বিদায় হে রাতের শব্দরা। হে কোমল অন্ধকার, শুভরাত্রি। শুভরাত্রি হে আমার জানালার আলো। শুভরাত্রি হে দেয়ালের অচেনা ছায়ারা। বিদায় হাতঘড়ি, বিদায় ক্যালেন্ডারের ছবি, বিদায় শেষ সিগারেট। স্বপ্ন ও বাস্তবের মতে দিনশেষে এখন আমি ঘুমিয়ে পড়ব। আসছে ঘুমের অন্ধকার তরঙ্গেরা। একের পর এক। বিদায় হে চিশতি। বিদায় বাস্তবতা। শুভরাত্রি হে স্বাবলম্বন। ওই আমার ঘুম, তার দীর্ঘ আঙুল বাড়িয়ে দিল আমার ভিতরে। সে বোতাম টিপে দিতে থাকে একে একে। আর আমার শরীরের ভিতরে যে অন্ধকার সেইখানেনীল লাল স্বপ্নের মৃদু আলোগুলি জ্বলে ওঠে। সেই আলোতে দেখা যায়, এক জনশূন্য বিশাল প্রেক্ষাগৃহ তার দেয়ালে দেয়ালে ফ্রেস্কোতে আঁকা আমার শৈশবের ছবি। পর্দার ওপাশে মঞ্চে কারা যেন আদাব টানাটানি করে দৃশ্যপট সাজাচ্ছে। পর্দা অকস্মাৎ সরে যায়। দেখা যায়, ঘাটের পৈঠার মত দীর্ঘ টানা কয়েকটা সিঁড়ি। সেই সিঁড়িতে শ-তিনেক ছেলে দাঁড়িয়ে–গাইছে–জয় জগদীশ হরে…
বাইরে কি বৃষ্টি? বৃষ্টিই। ঝড়ের বাতাস দিচ্ছে। পাশ ফিরে শুল মনোরম। তার এলানো হাত পড়ে আছে বিছানায়। বিস্তৃত হাতখানা যতদূর যায় কিছুই স্পর্শ করে না। কেউ নেই। একটু ঠাণ্ডা, স্যাঁতসেঁতে বিছানায় পড়ে আছে নিরুপায় হাতখানা। বাইরে ঝড়। কী অঝোর বৃষ্টি! মনোরম সেই বৃষ্টির শব্দ শুনতে পেল না। সে তখন তার শৈশবের স্বপ্ন দেখছিল।
কয়েকদিন বাদে মামার সঙ্গে কানোরিয়াদের বাড়িতে গিয়েছিল মনোরম। সেখানে কাঠের কাজ হচ্ছে। মনোরম কাঠ চেনে না, প্রতি সি এফটি কোনটার কত দাম তা জানে না। আসলে কাঠের ব্যবসায় তার মন নেই। এক একটা ব্যবসা আছে যার নো-হাউ জানতে বিস্তর সময় লেগে যায়। কাঠ হচ্ছে সেই ব্যবসা। পুরাতন বাড়ি ভাঙা হইতেছে–খবরের কাগজে এরকম বিজ্ঞাপন দেখলেই মামা সেখানে মনোরমকে নিয়ে যায়। কড়ি বরগা দেখেই ধরে ফেলে কোনটা কী কাঠ। সত্তর, আশি, কি একশো, দেড়শো বছরের পুরনো বাড়ির অভাব নেই কলকাতায়। বিস্তর জমি নিয়ে হাতির মতো পড়ে আছে। বড় বড় ব র পুরনো আমলের। দু-তিন তলা সব বাড়ি, এখনকার দশতলার কাছাকাছি উঁচু। সে সব ভেঙে ন ধরনের মাল্টিস্টোরিড বাড়ি উঠছে, অফিস আর ব্যাঙ্ককে ভাড়া দেওয়ার জন্য। আটটা-দশটা ফ্লোর, নতুন ধরনের ঘ গ্যাজেটস, অ্যামেনিটিস। তাই পুরনো বাড়ি আর থাকছে না কলকাতায়। পুরনো বাড়ি, বিশেষ করে সাহেববাড়ি হলে তার কাঠ হবে আসল বার্মা-টিক, বাজারে পাওয়া যায় না। সত্তর থেকে দেড়শো বছরের কাঠ, রস মরে ঝুন হয়ে গেছে। চেরাইয়ের পর পালিশ করলে রঙিন কাঁচের মতো দেখায়। মামা বিস্তর নিলাম ডেকে গোল ভর্তি করেছে সেই দুর্লভ কাঠে। কাজেই বড়লোকদের বাড়ির কাজ হেসে-খেলে পায় মামা।
ওল্ড বালিগঞ্জে একটা নির্জন রাস্তায় বাড়ি। এখনও বাড়িটা শেষ হয়নি। কানোরিয়ারা বড়লোক সে তো জানা কথা। কিন্তু কতটা তা ঠিক জানা ছিল না মনোরমের। বাড়িটা দেখে তাক লেগে গেল। বেশি বড় নয়, বড়জোর পাঁচ সোয়া পাঁচ কাঠা জুড়ে একটা কংক্রিটের স্বপ্ন। সামনে একটা লন, একধারে টেনিস কোর্ট, সেটা পেরোলে থামহীন একটা গাড়ি বারান্দা-একটা বৃত্তাকার প্রকাণ্ড সিমেন্টের চাকতি শূন্যে ঝুলে আছে। বৈঠকখানার কোনও দরজাই যেন নেই, এ দেয়াল থেকে ও দেয়াল পর্যন্ত চওড়া-চওড়ি হাঁ হয়ে আছে। দরজা নেই নয়। আছে। সে দরজা দেয়ালের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায়। চারিদিকে কাঁচ আর কাঁচ। ঘরের একদিকে মেঝেয় একটা মস্ত চৌবাচ্চার মতো ডিপ্রেশন। সেখানে কয়েক ধাপ সিঁড়ি নেমে গেছে। সেই জায়গাটায় নিখুঁত মাপে ভারী ‘কোজি’ সোফাসেট তৈরি করে বসানো হচ্ছে। ভেতরের দিকে দোতলায় উঠবার সিঁড়ি একটা প্যাঁচ খাওয়া ঢাল হয়ে উঠে গেছে, সিঁড়ির প্রতিটি ধাপ আলাদা আলাদা কংক্রিটের স্ল্যাব, জাবদা সিঁড়ি নয়। তিনতলা বাড়ির জন্য বানো হচ্ছে লিফট। ডানদিকে ঘুরে আরও একটু ভেতরে এগোলে দেখা যায়, ঘরের মধ্যেই ছোট্ট একটা মিনিয়েচার দীঘি–লিলিপুল। তার ওপরে একটা খেলাঘরের ব্রিজের মতো চমৎকার ব্রিজ। লিলিপুল-এর উপরে ছাদটা কাঁচের, প্রাকৃতিক আলো আসবার জন্য।
দেখাশুনো করছেন এক মাদ্রাজি ইঞ্জিনিয়ার, তার পরনে সাদা লুঙ্গির মতো কাপড়, সাদা জামা, কপালে তিলক, পায়ে চটি। গম্ভীর এবং শান্ত মানুষ। মুখে কথা প্রায় নেইই। মামার হেডমিস্ত্রি আজ কাজে আসেনি, তার জন্য মামা তাকে বিস্তর কৈফিয়ত দিচ্ছিল এখনও জলশূন্য লিলিপুলের ধারে দাঁড়িয়ে। ইঞ্জিনিয়ার লোকটা হাতে ব্লু-প্রিন্ট দেখেছে, সামান্য কোঁচকানো, উত্তর দিচ্ছে না। উত্তর পেতে মামার সময় লাগবে বিবেচনা করে মনোরম উঠে এল উপরে, চমৎকার সিঁড়িটা বেয়ে। কোনটা ঘর, কোনটা প্যাসেজ, কোনটা বারান্দা কিছু বোঝা যায় না। সবটাই নিস্তব্ধ স্বপ্নদৃশ্যের মতো। এমনকী কত টাকা খরচ হচ্ছে বাড়িটায়, তারও কোনও হিসেব পায় না সে। চার-পাঁচ লাখ হতে পারে, বিশ-ত্রিশ লাখও হওয়া সম্ভব। আরও বেশি হলেও আশ্চর্যের কিছু নেই। এখনও সর্বত্র মেঝেয় মার্বেল ঘষা হয়নি, দেয়ালে পলেস্তারা পড়েনি। কোণের দুটো ঘর শেষ হয়েছে, সেখানে মিস্ত্রিরা কাঠের আসবাব বানাচ্ছে। মাঝারি বড়লোকেরা, বড় জোর প্রবর্তক বা আমার থেকে আসবাব কিনে আনে। এরা বাজারি আসবাব কেনে না। ঘরের মাপজোক আর ডিজাইন অনুযায়ী আসবাব তৈরি করিয়ে নেয়। মামা মোটে তিনটে শোওয়ার ঘর আর দরজা জানলার খানিকটা কন্ট্রাক্ট পেয়েছে। সেটাও বোধহয় বিশ-ত্রিশ হাজার টাকার।
মনোরমকে দেখে মিস্ত্রিরা কাজ থেকে চোখ তুলে তাকাল। তাদের চোখে ভয়।
রাধু বলল কী হবে বাবু, হেডমিস্ত্রি আজ এল না।
মনোরম বাড়িটায় ঘুরে সব দেখে কেমন একরকমের হয়ে গিয়েছিল। একটা ছোট্ট জায়গায় এত টাকার কারবার দেখে মাথাটা গরম। একটু ঝেঝে বলল–তাতে কী? তোমরা কাজ জানো না!
জানি তো, কিন্তু সকালে আজ ইঞ্জিনিয়ার সাহেব খুব রাগ করেছে। ভয়ে আমাদের হাত চলছে না। যদি এদিক ওদিক হয়ে যায়।
মনোরম কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে বেরিয়ে এল। তিনতলায় উঠল ধীরে ধীরে। অনেক মানুষ খাটছে। কেউ বিড়ি খাচ্ছে না, গল্প করছে না। সব চুপচাপ। চারিদিকে একটা সম্ভ্রম আর ভয়-ভয় ভাব। রাজমিস্ত্রিরা কাজ করতে করতে চোরা-চোখে তাকে দেখল, যেন একটু বেশি মন দিয়ে কাজ করতে লাগল। বাড়ির মালিক কে তারা জানে না। মনোরমের পরনে স্ট্রাইপওলা বেলবটস, গুরু পাঞ্জাবি, চোখে রোদচশমা ইস্পাতের ফ্রেমে। মিস্ত্রিরা বুঝতে পারছেনা, এই লোকটা মালিকপক্ষের কেউ কিনা। মনোরম খানিকটা মালিকপক্ষের মতোই অবহেলার ভঙ্গিতে একটু ঘুরে দেখল চারদিক। এ তলায় ঘর বেশি নেই, যা আছে তার চারটে দেয়ালই ঘষা কাঁচের, মস্ত একটা রুফ গার্ডেনের প্রস্তুতি চলছে।
লিফট এখনও বসানো হয়নি। কুয়োর মতো গহরটা নেমে গেছে। চতুষ্কোণ, একটু অন্ধকার। দরজা নেই। মনোরম ফাঁকা জায়গাটায় মুখ বাড়িয়ে নীচে তাকাল। হাত-পা শিরশির করে উঠল তার। ভার্টিগো। এক পা পিছিয়ে এল। দেয়াল ধরে দাঁড়াল একটু। জিভটা নড়ছে মুখের ভিতরে। শরীরে একটা সংকোচন। একটা দুর্ঘটনার স্মৃতি কিছুক্ষণের জন্য অন্ধকার করে দিল মাথা।
মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সে তাকাল। কাঁচের ঘর এবং ছাদের বাগানের সুন্দর বিস্তারটি দেখল। মানুষ কত বড়লোক হয়। তিনতলা বাড়ির জন্য লিফট লাগায়, ছাদে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাগান তৈরি করে, ঘরের মধ্যে বানায় পদ্মসরোবর। ছোকরারা কেন বিপ্লবের কথা শহরের দেওয়াল জুড়ে লেখে, তার একটা অর্থ যেন খুঁয়ে পায় সে। ডিনামাইট সহজপ্রাপ্য হলে সেও একটা কিছু এক্ষুনি করত। পকেট হাতড়ে সে বের করল সস্তা সিগারেটের প্যাকেট। সীতা চলে যাওয়ার পর তার বাড়িভাড়া বাকি পড়েছে এ পর্যন্ত মোট পাঁচ মাসের। দুশো কুড়ি টাকার দুঘরের ফ্ল্যাট পূর্ণ দাস রোডে। পুরনো বাড়িওলা একটা আশ্রমকে বাড়িটা দান করেছে। আশ্রমের লোকেরা দুদে বাড়িওলা নয়, তার ওপর ধর্মকর্ম করে, তাই ঠিক ঘাড়ে ধাক্কা দিচ্ছে না। কিন্তু গেরুয়াপরা সন্ন্যাসীরা প্রায়ই আসে আজকাল, দেখা করে যায়, মিষ্টি হেসে তার আর্থিক অবস্থার কথা জিজ্ঞেস করে। মনোরম তাদের ধর্মকথায় টেনে নিয়ে যায়। তারা অস্বস্তি বোধ করে।
পরিপূর্ণ ফুসফুসে সিগারেটের ধোঁয়া ভরে নিল মনোরম। মাথাটা ঝিম করে ওঠে। সমস্ত শরীর একটা রহস্যময় আনন্দে ভরে যায়। আকাশ টেরিলিনের মতো মসৃণ এবং নীল। শুধু এক কোণে ময়লা। রুমালের মতো একখণ্ড বেমানান মেঘ। রুফ গার্ডেনের রেলিঙে হাত রেখে মনোরম একটু দাঁড়িয়ে থাকে। দমকা বাতাসে দ্রুত পুড়ে যাচ্ছে সিগারেট। সে একটু শ্বাস ফেলে নেমে এল।
অনেকক্ষণ চেষ্টায় মামা মাদ্রাজি ইঞ্জিনিয়ারটিকে কেবল মাথা নাড়ানোয় সফল হয়েছে। কথা ফোটেনি। দূর থেকে দৃশ্যটা দেখল মনোরম, লিফটের কুয়োর মধ্যে ছুঁড়ে দিল সিগারেট। এগোল।
–মাই নেফিউ। পরিচয় দিল মামা।
মাদ্রাজি ইঞ্জিনিয়ার এক ঝলক তাকাল মাত্র, রিকগনাইজ করল না।
–টুমরো দি হেডমিস্ত্রি উইল ডেফিনিটলি কাম। ময়মনসিংহের অ্যাকসেন্টে ইংরেজিটা বলল মামা।
ইঞ্জিনিয়ার ভদ্রলোক একটু ভ্রূ কোঁচকাল মাত্র।
–অলরাইট? মামা জিজ্ঞেস করে।
ভদ্রলোক হাতের প্ল্যানটার দিকে নীরবে তাকিয়ে একটা শ্বাস ছাড়ল।
মামা রুমালে ঘাম মুছে মনোরমের দিকে তাকাল। মনোরম মামার মুখ দেখে বুঝতে পারে, এতক্ষণ মামার খুব খাটুনি গেছে।
লন ঘেষে মামার দিশি গাড়িটা দাঁড় করানো। তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে একটা ঘন নীল রঙের জাপানি ক্রাউন গাড়ি, তার নীলাভ কাঁচের ভেতর দিয়ে ভেতরে চমৎকার মেয়ে শরীরের মতো নরম গদি দেখা যাচ্ছে। কী অ্যারিস্টোক্র্যাট তার ড্যাশবোর্ড আর হুইল। এয়ারকন্ডিশনড। মনোরম ঝুঁকে গাড়িটা একটু দেখল। ভারী পছন্দ হয়ে গেল তার।
মামা তার গাড়ির লক খুলতে খুলতে বলে-সাড়ে চারজন মানুষের জন্য এত ব্যাপার-স্যাপার।
কারা সাড়ে চারজন?
কানোরিয়ারা। বুড়োবুড়ি, ছেলে আর ছেলের বউ। আর বোধহয় একটা বাচ্চা।
–মোটে?
–তাও ছেলে আর ছেলের বউ চোদ্দোবার বিজনেস টুর আর হানিমুন করতে ইউরোপ আমেরিকা যাচ্ছে, বুড়োবুড়ির তীর্থ করাই বাই। থাকবেটা কে গুচ্ছের চাকরবাকর ছাড়া? ঝুমু, মাদ্ৰাজিরা কেমন লোক হয়?
–ভালই। জেন্টল।
–আমিও তো তাই জানি। কিন্তু এ লোকটাকে ঠিক বোঝা যায় না। বিশ মিনিট ধরে বোঝালাম, কিছু বুঝেছে কিনা কে জানে। তোকে নিয়েই হয়েছে আমার মুশকিল, ইংরিজিটা ভালই বলিস, কিন্তু বিজনেসটা একদম বুঝিস না। তোকে দিয়ে যে আমার কী লাভ হবে। ভেবেছিলাম, ইংরিজিটা তোকে দিয়ে বলিয়ে যদি ইমপ্রেস করা যায়, কিন্তু তুই বলবি কি? শুধু ইংরিজিতে কি কিছু হয়? একটু যদি বুঝতিস।
দিশি গাড়িটা চলছে। ক্রাউন গাড়িটার ছায়া এখনও মনোরমের চোখে ভাসে। দিশি গাড়িটায় বসে তার মনে হয় সে একটা ইঞ্জিন লাগানো মুড়ির টিনের মধ্যে বসে আছে।
মামার চেহারাটা লম্বা, সুভুঙ্গে, মাথা প্রায় গাড়ির ছাদে গিয়ে ঠেকেছে। একটু কুঁজো হয়ে বসে স্টিয়ারিং হুইল ধরে আছে। রোগা বলে গায়ের হাওয়াই শার্ট লটর পটর করে। প্যান্টে পাছার দিকটা টান হয় না মাংসের অভাবে। বছরখানেক আগে প্রথম স্ট্রোক হয়ে গেছে। এখন আর একা বেরোতে সাহস পায় না, মনোরমকে সঙ্গে নেয়।
কানোরিয়াদের নির্মীয়মাণ বাড়িটার কথা ভাবতে ভাবতে মনোরম হঠাৎ বলল-ওরা খুব বড়লোক।
কারা?
কানোরিয়ারা।
মামা মন দিয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে একটা গম্ভীর হু দিল।
তারপর কিছুক্ষণ চুপচাপ।
হঠাৎ মামা তিক্ত গলায় বলে বাঙালির ছেলে যে কবে ব্যবসা শিখবে।
মনোরম হাই তোলে। প্রসঙ্গটা আসছে।
–কিছুই তো পারলি না। এজেন্সি পেয়েছিলি, তা সে পরের তৈরি মাল বেচে কমিশন পেতিস। কাঠের কারবার তো তা নয়, এ হচ্ছে ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাষ্ট্রি। কিন্তু তুই শিখছিস কোথায়?
শিখছি তো। সময় লাগবে।
-নন-বেঙ্গলিরা কলকাতায় ওইসব বাড়ি হাঁকড়াচ্ছে, গাড়ি দাবড়াচ্ছে। আর তোদের কেবল আলোচনা গবেষণা আর মেয়েছেলেদের মতো ছিচকাঁদুনে সেন্টিমেন্ট।
নেতাজি এলে সব ঠিক হয়ে যাবে দেখো। বাঙালি জাগবে।
কথাটা মামার প্রাণের কথা। কিন্তু মনোরমের মুখে শুনতে ঠিক প্রস্তুত ছিল না বলে, মামা রাস্তা থেকে চোখ টপ করে সরিয়ে একবার মনোরমের মুখ দেখে নেয়। ঠাট্টা কিনা তা বুঝতে চেষ্টা করে।
ঝুমু।
মনোরম মুখখানা স্বাভাবিক রেখেই বলে-উ!
–অবিশ্বাসের কী? বিনা প্রমাণে তো এতগুলো লোক ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না!
–কিন্তু কোনজন? শৌলমারির সন্ন্যাসী, না শোপবন্ধুনগরে যাকে দেখা গিয়েছিল সেই সাধু, নাকি রাশিয়াতে চিনা ডেলিগেটদের ছবিতে যে লোকটার আইডেন্টিফিকেশন নিয়ে কথা উঠেছিল, কিংবা নেহরুর অন্তিমশয্যার পাশে যাকে দেখা গিয়েছিল। কোনজন, সেইটেই প্রবলেম।
যে-ই হোক, তিনি আছেন। মামা একটু অধৈর্যের গলায় বলে। তারপর একটু চুপ করে থেকে বলে–আর তিনি আছেন সন্ন্যাস নিয়ে।
–কী করে বুঝলে।
বার্মায় তখন তিনি খুব ব্যস্ত, সেই ব্যস্ততার মধ্যে তাঁর এক সঙ্গী তাঁর সঙ্গে বেড়াতে বেরিয়ে এক মন্দিরে নিয়ে যায়। মন্দিরে গিয়েই তিনি কাঁদতে থাকেন, তারপর মাটিতে গড়াগড়ি দিতে থাকেন, সঙ্গীকে তিনি পরে বলেছিলেন–জানোনা, মন্দির-উন্দির এখন আর আমি যাই না। হাতে অনেক কাজ, মন্দিরে গেলে আমার কাজ পড়ে থাকবে। কিছুই করতে পারব না। কাজ শেষ হোক, তারপর আমি তো সন্ন্যাস নেবই। সন্ন্যাস তাঁর রক্তে ছিল। আমার কাছে যে বই আর পত্রিকাগুলো আছে তা পড়ে দেখিস, প্রতি সপ্তাহে আমাদের একটা মিট হয়, যেতে পারিস।
–আমি অবিশ্বাস করছি না।
–তোমরা জাত-অবিশ্বাসী। তোমাদের জেনারেশন। অবিশ্বাসী বলেই তোমরা কোনও রিলেশন এস্টাব্লিশ করতে পার না। যে বয়সে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রবল ভালবাসা থাকার কথা, সে বয়সে তোমাদের বিয়ে ভেঙে যায়। দেশপ্রেম তোমাদের কাছে হাসিঠাট্টার ব্যাপার; ট্র্যাডিশন, মরালিটি এ সব তোমরা ভেবেও দেখ না। ডিসগাটিং।
মনোরম চুপ করেছিল।
একটা সিগারেটের দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড় করাল মামা। মনোরমের দিকে একটা দশ টাকার নোট এগিয়ে দিয়ে বলল–এক প্যাকেট গোডকে নিয়ে আয়।
–তোমার না সিগারেট বারণ?
–গোন্ডফ্লেক বারণ নয়। যা। তুই আমাকে অ্যাজিটেট করেছিস।
মনোরম সিগারেট কিনে এনে দেখে মামা.ড্রাইভিং সিট থেকে সরে বসেছে। মাথা এলানো, চোখ বোজা। সিগারেট প্যাকেট আর খুচরো টাকা-পয়সা হাত বাড়িয়ে নিয়ে বলল তুই চালা। আমার নার্ভ ঠিক নেই।
মনোরম ক্ষীণ একটু হেসে ড্রাইভিং সিটে বসতে বসতে বলে–কেন?
মামা তেমনি ঘাড় এলিয়ে চোখ বুজে সিগারেট খেল কিছুক্ষণ। আস্তে করে বলল–যা বুঝিস না তা নিয়ে কখনও ঠাট্টা করিস না।
মনোরম গাড়িটা চালাতে চালাতে বলে-মামা, যদি কেউ আসেই কোথাও থেকে, তবে সে এখনও আসছে না কেন? আমরা তো ঘোর বিপন্ন! যে-ই আসুক তার আসতে আর দেরি করা উচিত নয়।
-আসবে দেখিস। একদিন ভারতবর্ষ শাসন করবে সন্ন্যাসীরা।
মনোরম ভিতরে হাসল। বাইরে মুখখানা স্বাভাবিক।
মামা আবার বলে বাঙালি বাঙালি করি, কারণ গত সাতাশ বছর কলকাতায় থেকে আমি কখনও এ শহরটাকে বাঙালির শহর বলে ভাবতে পারি না। এ শহরটায় কয়েকটা বাঙালি পকেট আছে মাত্র। যে সব জায়গায় ক্যাপিটাল আর বিজনেসের খেলা, সেখানে তারা কোথায়? ভাল বাড়ি, ভাল গাড়ি, ভাল ইন্ডাষ্ট্রি, তাদের কটা? এ সব তো নেই-ই, তার ওপর নেই আদর্শবোধ। খাওয়া-পরার ধান্ধায় ঘোর ক্ষতি নেই, তার সঙ্গে সমাজ সংসার নিয়ে একটু ভাববি তো! তুই কোন ভাষায় কথা বলিস, কোন দেশে বসত করিস, এগুলো নিয়ে ভাববি না? আমি তো জানি প্রতিটি মানুষ তার নিজের, পরিবারের, দেশের এবং দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য দায়ী।
মনোরম চুপ করে থাকে। মামার বাঙালিপ্রেমটা পরিচিত মহলে বেশ বিখ্যাত ব্যাপার। দার্জিলিং যাওয়ার সময়ে একবার মামা স্টিমার পেরিয়ে মনিহারিঘাটে ট্রেনে উঠবার সময়ে পুরো একটা কম্পার্টমেন্টে কেবল বাঙালি বোঝাই করেছিল। ওই রোগা চেহারা, কিন্তু অসামান্য তেজ। দরজা জুড়ে ঠ্যাং ছড়িয়ে মূর্তিমান দাঁড়িয়ে পথ আটকে ছিল মামা। কেউ উঠতে গেলেই প্রশ্ন–আপনি বাঙালি? ‘না’ বললে হটো, ‘হ্যাঁ’ বললে ওঠো। মনোরমের মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় যে, সে যে মামার কাঠগোলায় কাজ পেয়েছে, তা ভাগ্নে বলে ততটা নয়, যতটা বাঙালি বলে।
–তোর কত টাকা বাড়িভাড়া বাকি পড়েছে বলছিলি? মামা হঠাৎ জিজ্ঞেস করে।
–পাঁচ মাস।
তাতে কত দাঁড়াচ্ছে?
—-দুশো কুড়ি টাকা মাসে।
-এগারো শো?
–ও-রকম। তবে আপাতত অর্ধেকটা দিয়ে দিলে একটা আপস করে নেওয়া যায়।
–তা তুই ওখানে আছিস কেন এখনও? আমার বাড়িতে নীচের তলায় অনেকগুলো ঘর ফাঁকা।
–কেন, ফাঁকা কেন? বাঙালি ভাড়াটে পাচ্ছ না?
–তা নয়। আগের ভাড়াটেরা এমনই গোলমাল ঝগড়াঝাঁটি পাকিয়েছিল যে সেই থেকে তোর মামির হার্ট খারাপ। ভাড়াটে বসাব না। প্রেস্টিজে না লাগলে চলে আয়।
–দেখি।
–দেখি কী? ভারী মালপত্রগুলো বেচে দে। একটা চৌকি আর দু-চারটে বাক্স হলেই তো তোর ঢের। একা মানুষ। আবার যদি কখনও সংসার-উংসার করিস তো সে তখন দেখা যাবে।
মনোরম উত্তর দেয় না।
কী হে? ইচ্ছে নেই? তোর মামি একটু কচালে মানুষ বটে, কিন্তু তোক খারাপ নয়। বড় জোর তোর বউয়ের ব্যাপারে দু-চারটে খুঁটিনাটি প্রশ্ন করবে। তার বেশি কিছু না। একটা ঘরে পড়ে থাকবি নীচের তলায়, কেউ ডিসটার্ব করবে না। ছেলেটা তো মানুষ না, মডার্ন বাঙালি। পোশাক বাজিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, বাবা মরলে গদিতে বসবে। মাথায় কোনও আদর্শ-ফাঁদর্শ নেই। খেলে বেড়ায়, জলসায় সিনেমায় যায়। তুই থাকলে তবু…
মামা চুপ করে কী একটু ভাবে। বলে–প্রেস্টিজে লাগলে গোলায় থাকতে পারিস। অফিস ঘরখানায় একজন অনায়াসে থাকতে পারে। অবাঙালিরা কত কষ্ট করে কলকাতায় থাকে। এক পশ্চিমা পানওয়ালাকে দেখেছিলাম, হ্যারিসন রোডে মোট বারো ইঞ্চি ডেপথের একটা খোঁদল ভাড়া নিতে পেরেছিল। দেয়ালের গায়ে সেই খোঁদলে কাঠফাট লাগিয়ে ওপরে দোকান, নীচে গেরস্থালি। রাতে ফুটপাথে রান্না করে খেত, শোয়ার সময়ে সেই বারো ইঞ্চি জায়গায় কাত হয়ে শুয়ে সামনে কাঠের তক্তা লাগিয়ে নিত পড়ে যাওয়ার ভয়ে। ওই ভাবে দোতলা বাড়ি করেছিল। তো তুই কেন একা মানুষ দু’ ঘরের অত ভাড়ার ফ্লাটে খামোখা থাকবি? টাকা নষ্ট। অন্য কারণেও ওই বাড়ি তোর ছাড়া উচিত।
-কেন?
–ওখানে থাকলেই পুরনো কথা মনে পড়বে, আর হা-হুঁতাশ করবি। বউমার কোনও খবর পাস?
না।
মামা একটা শ্বাস ফেলে বলে-বউ নিয়ে ভাবতে হবে, এ আমরা কখনও কল্পনাও করিনি। আমাদের ধারণা ছিল, বিয়ে হলেই বউ আত্মীয় হয়ে গেল, এক মরা ছাড়া আর কোনও ছাড়ান কাটান নেই। গায়ের চামড়ার মতো হয়ে গেল। পাত কুড়িয়ে খায়, হামলে পড়ে সংসার করে, উঙ্গে ঝগড়া করে, আবার মায়ের মতো ভালবাসে। বউ চলে যাবে, এ আবার কী কথা রে বাঙালির বাচ্চা?
দু-চার জায়গায় ঘুরে কাঠগোলায় ফিরতে বেলা গড়িয়ে গেল। মামার ছেলে বীরু বসে আছে। বাপের মতোই লম্বা তবে অতটা সুভুঙ্গে রোগা নয়। খেলাধুলো করে বলে ফিট চেহারা। মায়াদয়াহীন মুখ। মুখে হাসি নেই। গরম বলে জামা খুলে স্যান্ডো গেঞ্জি, ফুলপ্যান্ট পরে বসে কাগজপত্র নাড়াচাড়া করছে। একমাত্র বংশধর আর গম্ভীর প্রকৃতির বলে মামা ছেলেকে বড্ড ভয় পায়। ছেলেতে বাপেতে বড় একটা কথাবার্তা নেই। বীরুর নিজস্ব একটা ফিয়াট গাড়ি আছে, যেটা নিয়ে মাঝে মাঝে কয়েক দিনের জন্য হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে যায়। সে যাই করুক, ছেলেটির হিসেবি বুদ্ধি প্রখর। আর একটা প্রখর জিনিস হচ্ছে ব্যক্তিত্ব। কর্মচারীরা মামাকে ভালবাসে, শ্রদ্ধা ভক্তি করে, আবার মামার কাজে ফাঁকিও দেয়, চেয়েচিন্তে পাওনার বেশি টাকা আদায়ও করে। আর বীরুকে পায় ভয়।
মনোরমকে কী চোখে বীরু দেখে তা কে জানে! মনোরম তা নিয়ে বেশি মাথা ঘামায় না। মনোরম যে বেশিদিন মামার কাঠগোলায় আড়াইশো টাকায় অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারি করবে না, এটা বীরু বোধহয় জানে। কাজেই সে মনোরমের প্রতি মনোযোগ দেয় না। কথাবার্তা হয়ই না বলতে গেলে। তারা যে মামাতো পিসতুতো ভাই, এ সম্পর্কটা বাইরে থেকে বুঝবার উপায় নেই।
সামনের চালাঘরটাই আসলে অফিস। বুড়ো মানুষ ভূপতিচরণ ক্যাশ আগলে বসে থাকে। সামনে পিছনে কাঠ আর কাঠ। দাঁড় করানো, শোয়ানো তক্তা, বিম, টুকরো-টাকরা কাঠের দুর্ভেদ্য জঙ্গল। চালা পেরিয়ে অফিসঘর। নামে মাত্র অফিসঘর, ওটা আসলে মামার জিরোবার জায়গা। ওপরে টিন, কাঠের বেড়া। একটা মজবুত চওড়া বেঞ্চ, তাতে ডানলোপিলোর গদি পাতা, তোয়ালেস্টাকা বালিশ। প্রথম স্ট্রোকের পর এ সব ব্যবস্থা হয়েছে। পিছনে করাতকল থেকে ঘষটানো আওয়াজ আসছে। মিহিন, মিষ্টি শব্দটা মনোরমের বড় ভাল লাগে। ঘুম পেয়ে যায়!
মামা ভূপতিচরণের দিকে একবার তাকায়, ভূপতিচরণ হতাশার ভঙ্গিতে মাথাটা হেলায়। ইঙ্গিতটা মনোরম বুঝে গেছে আজকাল। তার মানে বীরু ক্যাশ থেকে আজও টাকা নিয়েছে। মামা ভিতরের ঘরে ঢুকে যাওয়ার আগে একবার মুখ ফিরিয়ে বলে-ঝুমু, তুই একটু ক্যাশ-এ বোস। ভূপতির সঙ্গে আমার একটু দরকার আছে।
মনোরমকে ক্যাশ বুঝিয়ে দিয়ে ভূপতিচরণ উঠে গেল। মনোরম বসল। মুখোমুখি বীরু। কুঁচকে ফ্ল্যাট ফাইল খুলে কাগজপত্র দেখছে। একটা চূড়ান্ত অগ্রাহ্যের ভাব তার ভঙ্গিতে। চোখ তুলে তাকাল না। ভিতরের ঘরে এখন বীরুকে নিয়েই কথাবার্তা হচ্ছে মামার আর ভূপতিচরণের মধ্যে। বীরু বোধ হয় সেটা জানে। কাগজ দেখতে দেখতেই তার মুখে একটা তাচ্ছিল্যের মৃদু হাসি ফুটে ওঠে। তেইশ-চব্বিশ বছর বয়সেই ও বুঝে গেছে, পৃথিবীটা ওর একার।
কপাল। মামার ছেলেটা এ রকম না হলে মনোরম চাকরিটা পেত না। সীতা, চলে যাওয়ার পর তখনই একটা চাকরি না হলে মনোরমের চলছিল না। ল্যাং ল্যাং করে সারা কলকাতা ঘুরে বেড়াচ্ছিল মনোরম। সেই সময়ে একদিন গ্র্যান্ড হোটেলের উল্টোদিকে পার্ক করা গাড়িগুলো আস্তে, ধীরে হেঁটে হেঁটে দেখছিল সে। গাড়ি দেখা তার একটা পাস্টাইম। জেফির, অষ্টিন, কেমব্রিজ, হিলম্যান, প্যাকার্ড কত গাড়ি! দেখে দেখে ফুরোয় না। দেখতে দেখতে প্রতিটি মেকারের গাড়ি তার চেনা হয়ে গেছে। যে কোনও ছুটন্ত গাড়ি দূর থেকেই দেখে সে বলে দিতে পারে কোন মেকারের। নতুন কোনও গাড়ি কলকাতায় এসেছে কিনা তা দেখার জন্যই সে পার্কিং লট-এ ঘুরে বেড়াচ্ছিল, ঠিক সে সময়ে একটা ভোঁতা মুখ, বৈশিষ্ট্যহীন দিশি গাড়ির ভিতর থেকে মামা ডাকল-ঝুমু।
চাকরি হয়ে গেল। আত্মীয়তা ঝরে গিয়েছিল অনেক আগেই। মা মারা গেছে বছর পনেরো, তারপর থেকে আর তেমন দেখাশুনা ছিল না। বড়লোক মামাকে এড়িয়েই চলত মনোরম বরাবর। কাজেই মামা যখন বাড়িতে নেমন্তন্ন করে খাওয়াল এক ছুটির দুপুরে, তারপর বলল–আমার কারখানায় ঢুকে পড়। কাজটাজ শেখ! তখনই মনোরম বুঝে গিয়েছিল, এটা চাকরিই। মামা বস। তার আপত্তির কিছু ছিল না। ক’দিনের মধ্যেই সে বুঝে গিয়েছিল যে, সে আসলে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার-ট্যানেজার কিছু নয়। সর্বসাকুল্যে জনা ত্রিশেক মিস্তিরি, একজন ক্যাশিয়ার আর একজন ম্যানেজার নিয়ে কাঠের কারবার। কোম্পানি মামির নামে, ম্যানেজার মামা। আর কোনও স্টাফের দরকার হয় না। তবু মনোরমকে অ্যাসিস্টান্ট ম্যানেজার করা হয়েছে কয়েকটি কারণে। প্রথমত প্রথম স্ট্রোকের পর মামা একা ঘোরাঘুরি করতে ভয় পায়। দুনম্বর, মনোরমের চোস্ত ইংরিজি বলা। আর একটা কারণ হল বীরু। মামার একমাত্র সন্তান, একটু বেশি বয়সে হয়েছিল।
মামা প্রায়ই বলে বীরুর সঙ্গে তোর এখনও বন্ধুত্ব হয়নি ঝুমু?
বন্ধুত্ব! একটু অবাক হয়ে মনোরম বলেনা তো! হওয়ার কথাও নয়।
–কেন?
–কী করে হবে? আমার ছত্রিশ, ওর বড় জোর তেইশ। তা ছাড়া…
কী?
বন্ধুত্বের দরকারই বা কী?
মামা শ্বাস ফেলে বলে-ঝুমু, তুই ওর সঙ্গে একটু কথাটথা বলিস। আমি চাই ওর সঙ্গে তোর বন্ধুত্ব হোক।
–এটাও কি চাকরির মধ্যে?
-তোর বড্ড খোঁচানো কথা। চাকরি আবার কী। মামাতো পিসতুতো ভাই তোরা, ভাবসাব থাকারই তো কথা!
-সব কিছু কি জোর করে হয়? বীরু অন্য ধরনের, আমি অন্য ধরনের।
–ও সব কোনও বাধা নয়। বন্ধুত্ব চাইলেই হয়।
–হয় না মামা।
–তুই তো খুব চালাক চতুর ছিলি বরাবর। তুই ঠিক পারবি।
মনোরম তখনই অবাক হয়েছিল। মামা স্পষ্টই চায় বীরুর সঙ্গে তার মেলামেশা হোক।
আবার একদিন মামা প্রসঙ্গটা তোলে-ঝুমু, তুই যদি আমার ব্যবসাটা বুঝে নিতিস, তবে হাঁফ ছেড়ে বাঁচতাম। তুই শিখে নিয়ে ওকেও শেখাতে পারতিস।
কার কথা বলছ?
–ওই হারামজাদা। ওকে আমি কিছু বুঝতে পারি না। কারবারটা আমার জলে যাবে।
বীরুর কথা বলছ? ও খুব চালাক, চিন্তা কোরো না।
–চিন্তা করব না! বলিস কী?
–ও শিখে নেবে।
–অত সোজা নয় ঝুমু! এত ব্যাপারে ওর ইন্টারেস্ট ছড়ানো যে ও কনসেন্ট্রেট করতেই পারবে না। তাই তোকে বলি, তুই ওর সঙ্গে একটু মেলামেশা কর। ওকে একটু বোঝ। দ্যাখ যদি ফেরাতে পারিস। আলটিমেটলি আমি ম্যানেজারিটা তোকে দেব, বীরু থাকবে প্রপাইটার। তোর মামির সঙ্গে আমার কথা হয়ে আছে।
ব্যস্ত হচ্ছ কেন? ওকে একটু সময় দাও। বয়স হলে ও ব্যবসায় মন দেবে।
ব্যস্ত হচ্ছি, আমার শরীরকে আমি ভয় পাই। একটা স্ট্রোক হয়ে গেছে, আবার কখন কী হয়ে যায়। ওর জন্য চিন্তা করে করে আমি আরও শেষ হয়ে যাচ্ছি।
–এত চিন্তার কী?
মাসে দু-তিন হাজার টাকা ওর কীসে লাগে বল তো! কোথায় যায়, কী করে কিছু জানি না। সেইজন্যই চাইছিলাম তুই একটু দ্যাখ। তোর সেন্স অফ রেসপন্সিবিলিটি আছে। বহু লোক দেখেছিস, মিশেছিস। বীরুকে বুঝতে পারবি না?
মনোরম ব্যাপারটা সেই প্রথম গায়ে মাখে। মাসে দু-তিন হাজার টাকা একজন একা খরচ করে! আর সে নিজে ব্যারাট। বীকে তখনই সে মনে মনে শ্রদ্ধা করতে শুরু করেছিল।
মাসে থোক হাতখরচ পায়, তার ওপর মামিও কিছু লুকিয়ে দেয়। তবু বীরু এসে ক্যাশ থেকে টাকা নেয়। নির্দ্বিধায় নেয়, কারও কাছে জবাবদিহি করার কথা ভাবেই না। ছেলেটার এই দ্বিধাহীন ব্যবহারেই বোধহয় মামা ওকে ভয় পায়। চোখে চোখ রাখে না।
–নিচ্ছে নিক, টাকাটা তো শেষ পর্যন্ত ওরই। এ কথা একদিন বলেছিল মনোরম মামাকে।
দ্যাখ ঝুমু, টাকা কারও নয়। যে রাখতে পারে তার লক্ষ্মী, যে ওড়ায় তার বালাই। এই বিতিকিচ্ছিরি চেহারার কাঠগোলার পেছনে কত লাখ টাকার কাজ হচ্ছে তা তো তুই বুঝিস। এত টাকা তো এমনি এমনি হয়নি। এর পেছনে আমার যেমন পরিশ্রম আছে, তেমনই আদর্শবোধও। বাঙালি ব্যবসা জানে না–এ অপবাদ আমি আমার জীবনে ঘুচিয়েছি। আর ওই হারামজাদা বাঙালি কথাটার অর্থই জানে না, ব্যবসার ব বোঝে না।
-তুমি বলো না ওকে।
বলব। আমি? ও আমাকে বাড়ির চাকরবাকরের বেশি কিছু মনে করে নাকি? আমার পারসোনালিটি নেই, আমি জানি। পারসোনালিটি ব্যাপারটা হচ্ছে স্ট্রং লাইকস অ্যান্ড ডিসলাইকস। আমি কী পছন্দ করি না, কী করি তা ওকে কোনওদিনই বোঝাতে পারিনি। ও যখন ছোট ছিল, তখন থেকেই ওর মুখের দিকে তাকালেই আমি বরাবর আত্মবিস্মৃত হয়েছি। অন্য ক্ষেত্রে আমার যাওবা একটু ব্যক্তিত্ব আছে, ওর কাছে কিছু নেই। আমারই দোষ। কিন্তু এখন কিছু আর করার নেই। যদি তুই কিছু করতে পারিস।
–কী করব?
–আমার ধারণা, ও খুব সেফ লাইফ কাটায় না। ওকে ওয়াচ করা দরকার, গার্ড করাও দরকার। কোনদিন কী বিপদ ঘটাবে।
-কী বিপদ?
কে জানে! আমি কী করে বলব? কিছুই জানি না, বলেছি তো। হঠাৎ তিন-চার দিনের জন্য না বলে উধাও হয়ে যায়। কখনও-সখনও একমাস কোনও খবর পাই না। ভেবে ভেবে আমার একটা অসহ্য আতঙ্ক তৈরি হয়ে গেছে। কেবলই মনে হয়, শিগগিরই হঠাৎ একদিন ওর বদলে ওর ডেডবডি লোকে ধরাধরি করে বয়ে এনে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যাবে…দুর্গা, দুর্গা…এ সব মনে হয় বলেই আমার স্ট্রোকটা হয়েছিল।
মনোরম বুঝতে পেরেছিল, তার দায়িত্ব বাড়ছে। একটা শ্বাস ফেলে বলল তুমি আমাকে কী করতে বলো?
–তুই ওকে মাঝে মাঝে ফলো কর।
–ফলো? মাই গু-উ-ডনেস!
কুমু, ওকে ওয়াচ করা দরকার। অন্য উপায় নেই।
–ফলো করে কী করব?
দেখবি ও কী করে। যদি বিপদে পড়ে তো সামলাস।
আমি?
নয় কেন?
আমি পারব না মামা।
–কেন?
–আমি ঠিক..ঠিক সুস্থ নই। সেই অ্যাকসিডেন্টের পর আমারও আর আত্মবিশ্বাস নেই। কী যেন একটা হারিয়ে গেছে। আমি ভয় পাই।
–তবে বীরুর কী হবে ঝুমু? আমার যে তুই-ই সবচেয়ে ভরসা ছিলি।
–ফলো-টলো করা খুব রিস্কি মামা। বীরু টের পেলে?
বীরু টের পাবে? মামা চোখ বড় বড় করল।
পাবে না?
-তুই কি ভাবিস বীরু চারপাশটাকে লক্ষ করে? করলে আমি ভাবতাম নাকি? ও যখন গাড়ি চালায় তখন উন্মাদের মতো চালায়, আগুপিছু কিছু লক্ষ করে না। কারও তোয়াক্কা নেই, লক্ষ করবে কেন? তুই আমার গাড়িটা নিয়ে সেফলি ফলো করতে পারিস, ও কখনও ঘাড় ঘুরিয়ে দেখবেই না। গাড়ির নম্বর-প্লেট তো দূরের কথা, আস্ত গাড়িটাকেই ও নজর করবে না। আমি ওকে ফলো করে দেখেছি ঝুমু।
করেছ?
করেছি। কিন্তু পারি না। অত জোরে গাড়ি চালানোর নার্ভ আমার নেই। তা ছাড়া আফটার অল আমার ছেলে, তার সব কিছু ওয়াচ করতে আমার সংকোচ হয়। তোর তো তা নয়।
মনোরমের এই প্রথম মামার জন্য কষ্ট হয়েছিল খুব। যে লোকটা মনিহারিঘাটে একবার কামরার দরজা আটকে কেবল বাঙালি তুলেছিল গাড়িতে, তার সেই তেজ-টেজ বীরুর কাছে এসে কোথায় মিলিয়ে গেছে। নব্বই পারসেন্ট বাঙালির চাকরির জন্য যে লোকটা সব লড়াই করতে প্রস্তুত তার এ কেমন ব্যক্তিগত পরাজয়!
মনোরম নিমরাজি হয়েছিল। কাঠগোলায় বসে থাকার চেয়ে বরং একটু খোলা-আলো বাতাসে একা একটা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়া, ব্যাপারটা ভাবতে ভালই।
একদিন বীরু ক্যাশ থেকে টাকা নিয়ে বেরিয়ে গেল। সামনেই দাঁড়ানো ওর ফিয়াটখানা। উঠল। গাড়িটা ছাড়তেই, মামা ভিতরঘর থেকে বেরিয়ে এসে চেঁচালকুমু, ফলো হিম! এই যে গাড়ির চাবি…মামা ছুঁড়ে দিয়েছিল চাবিটা।
মনোরম লুফে নিল। দৌড়ে গিয়ে মামার গাড়িটায় উঠে পড়ল। তখন উত্তেজনায় তার শিরা ছিঁড়ে যাচ্ছে। বুকে স্কুটারের শব্দের মতো হুড়হুড় শব্দ। মামার ভোঁতা মুখওলা দিশি গাড়িটা ছাড়ল মনোরম। এবং বুঝতে পারল এ গাড়ি নিয়ে বীরুর বিদেশি ফিয়াট গাড়িটার পিছু নেওয়া বেশ শক্ত। তার ওপর বীরু তার ফিয়াট গাড়ির ইঞ্জিন মেকানিক দিয়ে হট-আপ করিয়ে নিয়েছে। স্পিডের জন্য।
লেকের ভিতর দিয়ে সাদার্ন অ্যাভিনিউ হয়ে যাচ্ছে গাড়িখানা। ভোঁতা-মুখ দেশি গাড়িটায় বসে দাঁতে দাঁত চাপল মনোরম। জিভটা তখন ধড়াধড় ধাক্কা দিচ্ছে বন্ধ দাঁতে। ঘামছিল মনোরম। গাড়ির গতি বাড়তেই মনে পড়ল সেই দুর্ঘটনা…ছুটন্ত ট্রেন তার লাইন ছেড়ে অসহায় মাঠের মধ্যে নেমে যাচ্ছে লোভী, কাণ্ডজ্ঞানহীন, লুঠেরা মানুষেরা ফিস-প্লেট খুলে রেখেছিল, অপেক্ষা করছিল অন্ধকারে…একটা প্রলয় ঝড়ের মধ্যে ট্রেনের কামরার নিরাপদ প্রথম শ্রেণীর বার্থসুদ্ধ মনোরম হঠাৎ এরোপ্লেনের মতো উড়ে যাচ্ছিল। অন্ধকার হয়ে গেল মাথা। আবার ফিরে এল আলো। ততক্ষণে উধাও হয়ে গেছে বীরুর ফিয়াট।
ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছিল মনোরম। দাঁতে দাঁত চেপে ভেবেছিল—নো মোর স্পিড ফর মি। আমি এখন একটা স্লো-মোশান ম্যান। জোকার।
মামা হতাশ হয়নি। বলেছিল–লেগে থাক। তুই-ই পারবি।
প্রথম প্রথম কয়েকবারই ব্যর্থ হল মনোরম। অলীক ছায়াছবির মতো মিলিয়ে যায় বীরু আর তার ফিয়াট। কলকাতার ভিড়ে ঠিক জাদুকরের মতো বীরু তার অদৃশ্য রাস্তা করে নেয়। মনোরম হতাশ হয়। এক রাতে স্বপ্ন দেখল, বীরু তার গাড়ি নিয়ে আশি-নব্বই মাইল বেগে ছুটছে একটা দেয়ালের দিকে, সুইসাইড করবে। মামার দিশি গাড়িখানা ঝকাং ঝকাং করে মুড়ির টিনের শব্দ করতে করতে চলেছে। গাড়ির রেডিয়োতে মামার আকুল স্বর শোনা যাচ্ছে, ওকে বাঁচা, ঝুমু-উ। কিন্তু গাড়ি চলছে না। স্বপ্নের মধ্যেই ইডিও-মোটর অ্যাকশন হচ্ছিল মনোরমের। বীরুর গাড়িটা দেয়ালের ওপর আছড়ে পড়ছে…ঠিক এই অবস্থায় ঘুম ভেঙে দেখল মনোরম, তার হাত দুটো সামনে বাড়ানো, একটা পা তোলা। স্বপ্নের মধ্যে সে চিৎকার করেছিল, সেই চিৎকারের শব্দ এখনও তার কানে লেগে আছে। যেন বা নিজের স্বপ্নের চিৎকারেই তার ঘুম ভেঙেছে।
মামার কিছু টাকা খরচ হল। মেকানিক দিয়ে পুরনো গাড়িখানা একটু হট-আপ করাতে হল। মেকানিক বলল–দিশি মেশিন, খুব বেশি স্পিড তুলবেনা।
তারপর একদিন প্রাণপাত করল মনোরম। গাড়ি চালানোর অভ্যাস গেছে বহুদিন। গেবালদের মোটর ট্রেনিং স্কুলে শিখেছিল। আশা ছিল, নিজের গাড়ি হবে একদিন। হয়নি। কাজেই অভ্যাসে মরচে পড়ে গেছে। তার ওপর দুর্ঘটনার স্মৃতি, ইডিও-মোটর অ্যাকশন, নড়ন্ত জিভ, সীতা! এতগুলো বাধা তার সব গতি কেড়ে নিচ্ছে আস্তে আস্তে। তবু সে একদিন বীরুকে ধরল এক দুপুরে। মামাদের বাড়ির সামনে থেকেই ফিয়াটখানা ছাড়ল। দশ গজ দূরে মনোরম মামার গাড়ির হুইলের পিছনে প্রকাণ্ড গোগো চশমা পরে বসে। গাড়িটা চলেছিল সেদিন। মনোরমের বুকে স্কুটার ডেকেছিল, মনে পড়েছিল সেই দুর্ঘটনা, জিভ নড়েছিল, সীতার জন্য দুঃখিত ছিল হৃদয়। ঘেমে নেয়ে গিয়েছিল সে। বীরুর মায়াবী ফিয়াট মুহূর্তে মুহূর্তে মিলিয়ে যায়। একটু অবহেলায় কাত হয়ে বসেছে বীরু, ডান হাতে আলতো ছুঁয়ে রেখেছে হুইল, ঠোঁটে সিগারেট। চেষ্টাহীন সেই চালানো। বিদেশি মসৃণ গাড়িখানা সিল্কের অলীক রাস্তায় পিছলে বেরিয়ে যাচ্ছে। পিছনে দিশি গাড়িখানায় মনোরমের খাস গাঢ় ও দ্রুত হয়ে উঠছে তখন, ধোঁয়াচ্ছে গোঙানো ইঞ্জিন, ঘাম, স্বপ্ন ও স্মৃতির কুয়াশায় আচ্ছন্ন সম্মুখ। সে কী প্রাণপণে দিক ঠিক রেখেছিল মনোরম। ইনটুইশনের ওপর ভর করে বাঁক নিয়েছিল, কারণ বীরু হারিয়ে যাচ্ছিল প্রায়ই। এসপ্ল্যানেডেই যাচ্ছে বীরু–এই আন্দাজে চালিয়ে অবশেষে লেনিন সরণির মোড়ে ট্রাফিকে সে বীরুর গাড়ির দশখানা গাড়ির পিছনে থামল।
সেদিন বীরু খুব বেশি দূর যায়নি। সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউয়ে ঢুকে একটা চওড়া সম্ভ্রান্ত গলিতে গাড়ি দাঁড় করাল। অবহেলার ভঙ্গিতে নামল, দরজা লক না করে এবং গাড়িটার দিকে একবারও পিছু ফিরে না তাকিয়ে ঢুকে গেল একটা মস্ত দোকানে। ধীরে ধীরে দিশি গাড়িটাকে দোকানের সামনে আনল মনোরম। দেখল, রেডিয়ো আর গ্রামোফোনের খুব বড় দোকান। সামনে এপ্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত কাঁচ লাগানো দুটো শো-কেসে অজস্র রেডিয়ো, গ্রামোফোনের ডিসপ্লে। ঠিক গোয়েন্দার মতো সতর্ক চোখে তাকিয়ে রইল মনোরম। বাইরে দিনের আলো। কাঁচের গায়ে নানা রকম প্রতিবিম্ব পড়েছে। ওই সব প্রতিবিম্বের জন্য ভিতরটা ভাল দেখা যায় না। তবু প্রাণপণে লক্ষ করল মনোরম। ভিতরের মৃদু আলোয় দেখল, দোকানের ভিতরে আর একটা কাঁচের পার্টিশন আছে। সেই পার্টিশনের কাঁচের পাল্লা ঠেলে বীরুর লম্বা চেহারাটা ভিতরে ঢুকে গেল। ঝাঁয়-ঝিক ঝাঁয়-ঝিক ঝাঁয়-ঝিক করে একটা পপ মিউজিক বাজছে ভিতরে। রক্ত গরম করা বাদ্যযন্ত্র। শুনলেই হাত-পা নাচের জন্য দামাল হয়ে ওঠে। কাঁচের পাল্লাটা খুললেই গাঁক গাঁক করে শব্দটা বেরিয়ে আসছে। পাল্লাটা বন্ধ হলেই শব্দ মৃদু হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অবিরল শব্দটা হয়েই চলেছে।
মনোরম অনেকক্ষণ বসে সিগারেট পোড়াল। তারপর বীরু বেরিয়ে এল। একটা ধৈর্যহীন চাপা উত্তেজনাময় চেহারা তার, অসুখী, অতৃপ্ত। তার পিছনে কয়েকজন লোক ধরাধরি করে বয়ে নিয়ে এল একটা দামি সুন্দর স্টিরিও সিস্টেম। সেই জিনিসটা গাড়ির পিছনে তুলে আবার গাড়ি ছাড়ে বীরু। মনোরমের আবার সেই প্রাণান্তকর পিছু নেওয়া। রিচি রোডের একটা চমৎকার অ্যাপার্টমেন্ট হাউসের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে, তেমনি লক না করে, পিছু না ফিরে ঢুকে গেল ভিতরে। একটু পরে দুজন দারোয়ান-চেহারার লোক এসে দুটো বাক্সের মতো স্পিকার আর রেকর্ড প্লেয়ার সহ স্টিরিওটা নামিয়ে নিয়ে গেল। ধৈর্যশীল মনোরম ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে রইল। বীরুর গাড়িটা হিম হতে লাগল। মনোরম দুবার পেচ্ছাপ করল, প্রায় দেড় প্যাকেট সিগারেট খেয়ে ফেলল। অনেক রাতে নেমে এল বীরু। শিস দিচ্ছে, একটু ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। বোধহয় কিছুটা মদ খেয়েছে। গাড়িতে উঠে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। ঘুমের ঝিমুনি এসে গিয়েছিল মনোরমের। চটকা ভেঙে সোজা হয়ে বসল। রাত হয়ে গেছে। এত রাতে পিছু নিলে বীরু টের পাবে। ভাবল মনোরম। কিন্তু বীরু কিছু লক্ষ করেছে বলে মনে হল । একটা সিগারেট ধরিয়ে গাড়িটা ছাড়ল। তেমন স্পিড দিলনা এবার। আস্তে ধীরে বাড়ি ফিরে গেল। বীরু বাড়িতে ঢুকে যাওয়ার আধ ঘণ্টা পর মনোরম দিশি গাড়িটা গ্যারেজে তুলে মামার দারোয়ানের হাতে চাবি দিয়ে ক্লান্ত হয়ে ফিরে এল। সেই রাতে সাফল্যের আনন্দে তার ভাল ঘুম হয়।
পরদিন মামা সব শুনে জ কুঁচকে বলল–অ্যাপার্টমেন্ট হাউস? ওখানে ও করে কী?
কে জানে! চেনাশোনা কেউ থাকতে পারে।
–ভাড়া দেয়নি তো?
কে জানে।
–খোঁজ নে।
—আমি কি ডিটেকটিভ হয়ে যাচ্ছি মামা?
মামা চিন্তিত মুখ তুলে বলেছিল–তোকে এর জন্য না হয় কিছু বেশি টাকা দেব। ওকে দেখিস ঝুমু।
দেখেছে মনোরম। খোঁজ নিয়ে জেনেছে, অ্যাপার্টমেন্ট হাউসটায় আটশো টাকা ভাড়ায় একটা ফ্ল্যাট নিয়েছে বীরু। মাঝে মাঝে থাকে সেখানে। তার বেশি কিছু জানা যায়নি। মনোরম অনেক ভেবেছে, বুঝতে পারেনি, কেন বীরু নিজেদের অমন প্রকাণ্ড বাড়ি থাকতে এবং সেখানে অতগুলো খালি ঘর থাকতে একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করেছে। মামাও ভেবে পায়নি। দুজনে চিন্তিতভাবে দুজনের দিকে চেয়ে থেকেছে। মামা খাস ফেলে বলেছে ঝুমু, লক্ষ রাখিস। আমার একটাই সন্তান।
বীর কলেজের সামনেও অপেক্ষা করেছে মনোরম। বিশাল ইউনিভার্সিটি কলেজ। অনেকগুলো বিন্ডিং, করিডোর, মাঠ, ছেলেমেয়ে, ঠিক থৈ পাওয়া মুশকিল। তবু মনোরম ঘাপটি মেরে ঘুরেছে। কলেজের মাঠে, করিডোরে, দালানে। ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে গেছে, বীরু তাকে লক্ষ করেনি। এক দঙ্গল মেয়ের সাথে করিডোরে প্রায়ই আড্ডা দেয় বীরু। সকলের প্রতি সমান মনোযোগ। ক্ষতিকর কিছু নয়, একদিন শুধু কলেজ ভেঙে যাওয়ার পর মনোরম দেখেছিল, একটা ফাঁকা ক্লাশঘরের দরজার চৌকাঠে বীরু দাঁড়িয়ে। লম্বা শরীরটা ঝুঁকে আছে, দরজায় কাঠের ওপর হাত তুলে ভর রেখেছে শরীরের। ওর দীর্ঘ শরীরের আড়ালে একটা চৌখশ, সুন্দর, প্রায় কিশোরী মেয়ে মুখ তুলে দাঁড়িয়ে। মেয়েটির বয়স এত কম, মুখে এমন একটা নিষ্পাপ ভাব যে, সহজেই যে কেউ প্রেমে পড়তে পারে। মনোরম দেখছিল, বীরু কথা বলতে বলতে ডান হাতে মেয়েটির বাঁ বগলের শর্ট স্লিভসের ভিতরে আঙুল ঢুকিয়ে কাতুকুতু দিচ্ছে। মেয়েটি হেসে বলছে-যাঃ, রীতা এ কথা বলতেই পারে না।
-সত্যিই বলেছে, গৌরী প্রেগন্যান্ট।
রীতাটা মিথ্যুক।
তা হলে সত্যিটা কী? তুমি প্রেগন্যান্ট নও?
–যাঃ! বলে মেয়েটি একটুমাত্র লাজুক ভাব করে খিলখিল হাসল। বলল–একদম ফ্রি আছি বাবা। ভয় নেই।
এইটুকু শুনেছিল মনোরম, সেদিন। ধৈর্যহীন, অতৃপ্ত যুবা বীরু চট করে হাতের ভরটা তুলে মুখ ফিরিয়ে বলেছিল, চলি।
মামাকে এটা জানানো যায় না। জানায়নি সে। বীরু যে ওই মেয়েটির সঙ্গে প্রেম করছে না, সেটা বোঝা গেল আর একদিন। অপরারে ফাঁকা ক্লাশঘরে বসে সে অন্য এক মেয়ের সাথে দ্বৈত রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছিল। একটা উঁচু ডেস্কের দুধারে দুজন, ডেস্কের ওপর নামানো মাথা, থুতনিতে থুতনি ঠেকে আছে। অনুচ্চ স্বরে, আবেগভরে এবং সুন্দর গলায় দুজনে গাইছিল–অন্ধজনে দেহ আলো, মৃতজনে দেহ প্রাণ…সারাক্ষণই গানের মধ্যে তারা পরস্পরকে চুম্বন করছিল। দেখে ভারী উত্তেজিত হয়েছিল মনোরম। আগের দিনের সেই সুন্দরী মেয়েটির সঙ্গে তা হলে বীরু প্রেম করছে না? কেন করছেনা? কী সুন্দর মেয়ে, অনায়াসে মিস ক্যালকাটা জিতে যেতে পারে, অমন সুন্দর মেয়ে বীরু পাবে কোথায়! মেয়েটা ইচ্ছে করলে মনোরমকে সীতার দুঃখ ভুলিয়ে দিতে পারে, আর বীরু ওর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। হায় ঈশ্বর! প্রেম করবি না তো ওর বগলে তুই কেন হাত দিলি বীরু। কেন জিজ্ঞেস করলি, ও প্রেগন্যান্ট কিনা। ঠাট্টা নয় তো? ঠাট্টা! এরকম ঠাট্টা কোনও মেয়েকে করা যায়, আর এরকম ঠাট্টা শুনে কোনও মেয়ে হাসে, মনোরম জানত না। মাথা গরম হয়ে গেল মনোরমের। তার সামনে একটা উত্তেজক নতুন জগতের ছবি ফুটে উঠেছিল।
দক্ষিণ কলকাতার একটা নামকরা গানের স্কুল থেকে একদিন চমৎকার শরীরওলা একটি মেয়েকে গাড়িতে তুলল বীরু। মনোরমের দিশি গাড়িটা প্রায় বীরুর ফিয়াটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চালায়। ইচ্ছে করলে ওভারটেকও করতে পারে। মনোরম লক্ষ করে, মেয়েটার নিজের প্রকাণ্ড একখানা হাম্বার গাড়ি আছে। বীরুর গাড়িতে ওঠার আগে মেয়েটি নিজের গাড়ির ড্রাইভারকে গিয়ে নিচু স্বরে কী বলল গাড়িটা চলে গেল। মেয়েটা জিভ দিয়ে ওপর ঠোঁট চেটে বীরুর পাশে উঠে বসল, খোঁপা ঠিক করল। সহজ ভঙ্গি, বীরু তাকে নিয়ে এল তার অ্যাপার্টমেন্টে। দুজনে নেমে এগিয়ে গিয়েছিল, মেয়েটা হঠাৎ থেমে বলল–ওই যাঃ! ব্যাগটা ফেলে এসেছি।
–তাতে কী হয়েছে?
দাঁড়াও না, নিয়ে আসি। ব্যাগটা না থাকলে বড় হেলপলেস লাগে।
দৌড়ে গাড়ির সিট থেকে ভ্যানিটি ব্যাগটা নিয়ে মেয়েটা বীরুর সঙ্গে বাড়িটায় ঢুকে গেল। মাঝে মধ্যেই এটা হতে থাকে। মনোরম একান্তভাবে পিছু নেয়। এবং লক্ষ করে, মেয়েটার স্বভাবই হচ্ছে ব্যাগ ফেলে যাওয়া। কদিনই মেয়েটা ব্যাগ ফেলে গেল। দু-একবার মনে পড়তে ফিরে এল। অন্য কয়েকবার ব্যাগটা পড়েই রইল গাড়িতে। ওরা বাড়ি থেকে বেরোত অন্তত তিন-চার ঘণ্টা পরে। ওরা কী করে এতক্ষণ তা জলের মতো পরিষ্কার। অথচ মেয়েটা ভাড়াটে মেয়েমানুষ নয়। তার গাড়ি আছে, যে স্কুলে সে গান শেখে তা খুবই উঁচু জাতের, চেহারা বড়ঘরের মেয়ের মতো। তবে কি বীরু প্রেম করছে অবশেষে?মনোরম দিশি গাড়িটায় বসে ভাবত আর ঘামত।
সাহস বেড়েছিল মনোরমের। কৌতূহলও। মেয়েটা প্রায়ই ব্যাগ ফেলে যায়। একদিন মনোরম থাকতে না পেরে নেমে আসে। চারদিক চেয়ে দেখে। কেউ লক্ষ করে না। সোজা গিয়ে বীরুর লকনাকরা গাড়ির দরজা খুলে গাড়ির ভিতরে ঢোকে। পুঁতে রঙের ব্যাগটা পড়ে আছে অবহেলায়। সে খোলে। প্রথমে কিছু সাধারণ জিনিস পায়। আইব্রো পেনসিল, লিপস্টিক, পাউডারের কেস, ফাউন্ডেশন, ক্লিপ, রাংতার প্যাকেট মাথা ধরার বড়ি, কয়েকটা ট্রাংকুলাইজার ট্যাবলেট এবং তারপরই বেরিয়ে আসে কন্ট্রাসেপটিভ ট্যাবলেটের একটা প্রায় খালি প্যাকেট। একুশটা ট্যাবলেট থাকে। তার মধ্যে মোটে দুটো অবশিষ্ট আছে। মনোরম সভয়ে নেমে আসে। দিশি গাড়িটায় বসে ক্রমান্বয়ে সিগারেট খায়।
গত শীতে পাঁচটা টেস্ট খেলাই দেখল বীরু। বাইরের টেস্ট খেলা দেখতে প্লেনে যাতায়াত করল কানপুর, মাদ্রাজ, দিল্লি, আর বম্বে। এলাহি টাকার কারবার। কজন ভারতীয় পাঁচটা টেস্ট খেলা দেখার ঝুঁকি নিতে পারে মনোরমের হিসেবে আসে না। শেষে টেস্ট খেলা দেখে ফেরার সময়ে একটা সিন্ধ্রি টিন-এজারকে পেয়ে গেল বীরু। ভারী সুন্দর, উগ্র এবং ছটফটে মেয়েটি। এক ঝলকে মেমসাহেব বললে ভুল হয়। পিঙ্গল চুল, মিনি স্কার্ট আর খয়েরি চোখের তারা। দমদমে বীরুকে আনতে গিয়েছিল মনোরম। মেয়েটির কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছিল বীরু। মেয়েটির সঙ্গে তার বাবা ছিল। অ্যারিস্টোক্র্যাট চেহারা। বোঝা গেল মেয়েটির দানাপানির অভাব নেই। তিন-চার দিন পরেই বীরু তার অ্যাপার্টমেন্টে এনে তুলল তাকে। মেয়েটি খুব হাসছিল, মুখচোখ ঝলমল করছে খুশিতে। মনোরম বুঝতে পারে, এই মেয়েটিও জানে বীরু তাকে কোথায় নিয়ে যাবে এবং সেখানে কী হবে। জেনেও বিন্দুমাত্র ভয় নেই। মনোরম হাই তোলে। তার বিস্ময়বোধ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
কিছুদিনেই মনোরম বুঝতে পারে, বীরু তার আটশো টাকার অ্যাপার্টমেন্টের চূড়ান্ত সদ্ব্যবহার করে। এবং কোনও মেয়েই বেশ্যা নয়। বাছাই, চমৎকার মেয়ে সব। কেউই রোগা বা মোটা নয়, গরিবঘরের নয়, হাঘরে নয়, বীরুর চেয়েও ঢের বড়লোকের বাড়ির মেয়েও আছে তার মধ্যে। এবং কারও সঙ্গেই বীরুর প্রেম নেই। এক একদিন এক দঙ্গল পুরুষ আর মেয়ে বন্ধু নিয়েও ও ঢুকে যায় অ্যাপার্টমেন্টে। ক্রমশ সাহসী মনোরম দিশি গাড়ি ছেড়ে ঢুকে পড়ে বাড়িটায়। লিফটে উঠে আসে ওপরে। মোজেইক মেঝের ওপরে নিঃশব্দে হেঁটে এসে বীরুর চমৎকার অ্যাপার্টমেন্টের ফ্লাশ-ডোরে কান রেখে শোনে। ভিতরে ঝিকঝই ঝিকঝাই ইও ইও ইও ইও টিরিকিটি টিরিকিটি টিরিকিটি ঝাঁই এরকম সব অদ্ভুত শব্দে স্টিরিও বাজছে। ঝনাৎ করে পড়ে ভেঙে গেল মদের গেলাশ। উদ্দণ্ড নাচের শব্দ। হো-হো চিৎকার। কণ্টকিত হয়েছে মনোরম। হঠাৎ দরজা খুলে ঢুকে যেতে ইচ্ছে হয়েছে উদ্দাম আনন্দিত ঘরখানার মধ্যে। পাপ হবে না, কেউ দোষ দেখবে না। ঢুকবে?
তক্ষুনি নড়ন্ত জিভটাকে টের পেয়েছে সে। মনে পড়ে সেই দুর্ঘটনা। মনে পড়ে বয়স, সীতা। ইডিও-মোটর অ্যাকশন হতে থাকে। নিঃশব্দে নেমে এসেছে মনোরম। দিশি গাড়িটায় বসে সিগারেট টেনেছে।
ছেলেটার কোনও ক্লান্তি নেই। সারা শীতকাল একনাগাড়ে টেনিস খেলল একটা ক্লাবে। একটু দূর থেকে, পার্কের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মনোরম দেখে গেল টেনিস বলের এ কোর্ট থেকে ও কোর্ট যাতায়াত, আর পফ পফ শব্দ শুনল। ফার্স্ট ডিভিশন লিগে খেলে গেল ক্রিকেট। গ্রীষ্মে একটা দ্বিতীয় ডিভিশন ক্লাবে খোলা মাঠে জলে কাদায় ভূত হয়ে ফুটবল লাথিয়ে গেল। কোনও খেলাই খুব মন্দ খেলে না। কিন্তু কেমন একটু নিরাসক্ত উদাসীন ভাব। যেন কোনও কিছুতেই গা নেই।
ও কি নিরাসক্ত, সন্ন্যাসী? না কি পাষণ্ড? ইউ এস আই এস-এর সামনে ছাত্রদের একটা র্যালি ছিল, ভিয়েতনামের যুদ্ধের প্রতিবাদে। সেদিন একটা স্যান্ডলুমের পাঞ্জাবি আর পায়জামা পরে টুলের ওপর দাঁড়িয়ে মাইক্রোফোনের মাউথপিস মুখের কাছে টেনে বীরু বক্তৃতা করল। প্রথমে ধীরে ধীরে ভিয়েতনামের যুদ্ধের কারণ ব্যাখ্যা করল, মার্কিন ভূমিকার পরিকল্পনা বুঝিয়ে দিল, সিয়াটোর ভূমিকা ব্যাখ্যা করল, প্রসঙ্গত ইয়োরোপ এবং এশিয়ায় মার্কিন দুমুখো নীতির চমৎকার সমালোচনা করল, সমাজতন্ত্র কী এবং সমগ্র এশিয়ার অর্থনৈতিক মুক্তি কী ভাবে আসবে তা বলে গেল বিশুদ্ধ বাংলায়। বলতে বলতে থেমে গেল না, কিন্তু ভাবতে ভাবতে বলল, থেমে থেমে। ঝোড়ো আবেগ নেই, কিন্তু নিবেদনটি ভারী আন্তরিক। ও যে এত ভাল বাংলা জানে কে জানত তা? কিংবা রাজনীতির এত খবর রাখে, জানে ভূগোল ইতিহাস? দাঁড়াল ঠিক তরুণ এক বিদ্রোহীর মতো। এত সুন্দর ভঙ্গিটি!
সব রকমের জুয়া খেলে বীরু। সাট্টা থেকে ঘোড়দৌড়। ঘোড়দৌড়ের মাঠে একদিন মুখোমুখি পড়ে গেল মনোরম। অবিরল হারছিল বীরু। মুখে একটু বিরক্তির চিহ্ন দেখেই সেটা বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু হতাশা বা ভেঙেপড়া ভাব ছিল না। রেজাল্ট ওঠা মাত্র হাতের টিকিট দুমড়ে ফেলে দিচ্ছিল। আবার লম্বা পায়ে হেঁটে যাচ্ছিল কাউন্টারের দিকে। বীরু কিছুই দেখেনা–এই বিশ্বাসে মনোরম সেদিন তেমন আড়াল হয়নি। খোলাখুলি ঘুরে বেড়াচ্ছিল। ঘোড়াদের স্টার্টিং পয়েন্টে হাঁটিয়ে নেওয়া হচ্ছে পঞ্চম রেস-এর আগে। রেলিং ধরে বীরু দাঁড়িয়ে ঘোড়া দেখল, তারপর হঠাৎ কাউন্টারে যাবে বলে ঘুরে দাঁড়াতেই মুখোমুখি।
একটু অবাক হল বীরু, সামান্য কৌতূহল দেখা গেল চোখে। ঘাবড়ে গেল না একটুও। বরং মনোরম ঘাবড়ে যাচ্ছিল।
বীরু একটু এগিয়ে এসে বলে তুমি খেল?
খেলি।
–দেখিনে তো কখনও!
গ্র্যান্ড স্ট্যান্ডে আসি না তো!
–আমি তো দুই স্ট্যান্ডেই খেলি। বলে মিষ্টি করে হাসল। বলল কী খেলছ এটায়?
–ঠিক করিনি।
—আমি ডাকুর ওপর অনেক টাকা খেলছি, কিন্তু হবে না, দিনটা খারাপ। কুড়িটা জ্যাকপট মিলিয়ে রেখেছিলাম। সবকটা গেছে ফিফথ রেস-এর মধ্যে।
কত হেরেছিস?
–হাজারের ওপর তো বটেই। এখনও হিসেব করিনি। তুমি?
–গোটা পঞ্চাশ।
–মোটে? তুমি তো লাকি। আবার হাসল বীরু।
–আর খেলিস না।
–কেন? বীরু ভ্রূ তোলে।
খামোকা খেলবি। এক একটা দিন অনেকে কেবল হারে।
–আমি রোজ হারি! হারজিত তো আছেই। তবে এ রেসটার পর কেটে পড়ব। ভাল লাগছে না।
–আমিও।
–কোথায় যাবে?
–ঠিক নেই। মামার কাছে যেতে পারি।
–ঠিক আছে। একসঙ্গে ফিরব। আমার গাড়ি নেই, গ্যারেজে দিয়েছি, ট্যাক্সিতে ফেরা যাবে। সেটা জানত মনোরম। তাই একটু বিপদে পড়ল। তারও গাড়ি আছে। মামার দিশি গাড়িটা। বলল–আমার গাড়ি আছে।
অবাক হয়ে বীরু বলে নিজের গাড়ি?
না না, মামার গাড়িটাই। কয়েক ঘণ্টার জন্য চেয়ে এনেছি।
–বাবা দিল? কাউকে তো দেয় না।
–আমি তো বিজনেস টুর-এ আছি।
তাই বলো। নইলে দিত না।
রেস-এর পর তারা গাড়িতে এসে উঠল। বীরু গাড়িতে বসে চারদিকে চেয়ে গাড়িটা একটু দেখে বলে রদ্দি জিনিস।
-কী?
–এটা। গাড়িটা।
দিশি মাল, আর কত ভাল হবে।
তুমি তো ভালই চালাও।
অভ্যেস।
–অভ্যেস কেন? বাবা তোমাকে দিয়েই সফারের কাজ করায় নাকি?
না, তা নয়। স্ট্রোকের পর নিজে চালাতে ভরসা পায় না, আমিই চালাই।
অঃ!
একটু চুপ।
বাবা তোমাকে কত দেয়?
–দেয় কিছু। আমার চলে যায়।
–তোমার একটা বিজনেস ছিল না?
ছিল। বেহাত হয়ে গেছে।
–শুনেছি, খুব রোজগার করতে?
–হত মন্দ না।
তা হলে এখন চলে যাচ্ছে কী করে? বাবা বেশি দেওয়ার লোক নয়।
একা মানুষ তো, চলে যায়।
একা তো আমিও।
তুই একা কেন? মামা মামি কি হিসেবের মধ্যে নয়?
হলেও তারা ডিপেন্ডেন্ট তো নয়। বরং আমিই ডিপেডেন্ট। একা আমারই তো কত খরচ! গাড়িটা বাঁয়ে ঘুরিয়ে নাও, সামনের রাস্তায়।
-কেন?
–আমার একটা অ্যাপার্টমেন্ট আছে রিচি রোডে, যাব।
একটু চমকে গিয়েছিল মনোরম। ওর যে একটা অ্যাপার্টমেন্ট আছে সেটা জানতে মনোরমকে কত কষ্ট করতে হয়েছে আর সেই অত্যন্ত কষ্টসাধ্য খবরটা ও কত সহজেই দিয়ে দিচ্ছে নিজে। বিন্দুমাত্র গোপন করবার চেষ্টা নেই। একটু হতাশ হয় মনোরম।
মনোরম গাড়ি ঘোরাল।
যাবে আমার অ্যাপার্টমেন্টে?
সেখানে তুই কী করিস?
অনেক কিছু। তবে বেশিরভাগ সময়ে বসে রেস্ট নিই, আর বই পড়ি। তুমি ড্রিঙ্ক করো?
–কী বলছিস?
—-ড্রিঙ্ক করো তো?
একটু ভাবল মনোরম। বলল-করি।
–আমার ফ্ল্যাটে একটা ছোট্ট বার আছে। যাবে? রেস-এর পর তোমার টায়ার্ড লাগছে না?
লাগছে।
–তা হলে চলো। ওল্ড স্মাগলার হুইস্কি খাওয়াব।
একটু চুপ।
-মামা জানে?
কী?
–তোর যে একটা ফ্ল্যাট আছে!
–জানলে জানে। আমি তো লুকোইনি, আবার আগ বাড়িয়ে কিছু বলিওনি।
বলিসনি কেন?
–ওটা আমার একার জায়গা। আমার মেয়েবন্ধুরা আসে। ছেলেবন্ধুরা আসে। গেট-টুগেদার হয়। নাচ-গানও হয়। বাবা মা জানলে ওখানে হানা দিতে থাকবে। ফ্ল্যাট নেওয়ার উদ্দেশ্যটাই নষ্ট হবে তা হলে।
–আমাকে তবে নিচ্ছিস কেন?
বীরু হাসে, বলে–এমনিই। রেস-এর মাঠে তোমাকে দেখে খুব মায়া হল। ভারী ছন্নছাড়া দেখাচ্ছিল তোমাকে। ভাবলাম হঠাৎ বিপাকে পড়ে বাবার চাকরি করছ, নিশ্চয় তুমি খুব সুখে নেই। তাই ভাবলাম, তোমার সঙ্গে একটু ড্রিঙ্ক করি।
মনোরম একটু হেসে বলল–তুই আমার ছোট ভাই, তা জানিস?
সম্পর্কটা এখন খুঁচিয়ে তুলবে নাকি?
না, না, এমনি বললাম।
–আত্মীয়তা ব্যাপারটা আমি দু চোখে দেখতে পারি না। ওটার মধ্যে অনেক ভণ্ডামি আছে।
–কীরকম?
আত্মীয় বলেই অনেকে অনেকের কাছ থেকে কিছু সম্মান বা সুবিধে পায়, যেটা তাদের পাওনা নয়। সম্মান বা সুবিধে পাওয়ার জন্য মিনিমাম কিছু যোগ্যতা থাকা দরকার। কেবল আত্মীয়তা কখনও সেই যোগ্যতা হতে পারে না। সেইজন্য আমি গুরুজনটন মানি না।
মনোরম বুঝেছে, মাথা নাড়ল।
বীরু কী সুন্দর নরম ব্যবহার করছিল সেদিন! ভাবা যায় না। বীরু যে এত নরম এবং বিষয় স্বরে কথা বলতে পারে, তা কে জানত?
গোপনে গোয়েন্দার মতো দিনের পর দিন যে ফ্ল্যাটটার ওপর নজর রাখত মনোরম সেই ফ্ল্যাটে সেদিন সে অনায়াসে ঢুকল।
ফ্ল্যাটটা ভালই। এ সব ফ্ল্যাট যেমন হয়, তেমনি। তিনখানা ঘর, ডাইনিং স্পেসকাম-বৈঠকখানা, সবই আছে, কিন্তু আসবাবপত্র বেশি কিছু নেই। একটা বেশ বড় খাট, তাতে ফোম রবারের গদি, গদির ওপর মণিপুরি চাদরে ঢাকা বিছানা কুঁচকে আছে। চেয়ার টেবিলগুলো দামি কিন্তু যেখানে সেখানে ছড়ানো, মেঝে ভর্তি সিগারেটের শেষ টুকরো সব পড়ে আছে, টেবিলের ওপর ডাব্বাই অ্যাশ-ট্রে উপচে পড়ছে ছাই, দেশলাইয়ের কাঠি আর সিগারেটের টুকরোয়। মেঝের ওপর পড়ে আছে স্টিরিওটা। রেকর্ডের গাদা দুটো স্পিকারের ওপর রাখা। মেয়েলি হাতের স্পর্শ নেই। অজস্র বই চোখে পড়ে। সবই ইংরিজি। দর্শন, রাজনীতি থেকে ডিটেকটিভ বই পর্যন্ত। বৈঠকখানা ঘরের দেয়ালে বিল্ট-ইন ক্যাবিনেট খুলে গেলাস বের করে বীরু, আর হুইস্কির বোতল। বলে-ডাইলিউট করতে হলে ট্যাপ থেকে জল মিশিয়ে নাও। আমি নিট খাই, সোডা-ফোডার ঝামেলা নেই।
সন্ধে নাগাদ অনেকটাই মাতাল হয়ে গিয়েছিল মনোরম। কথা একটু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। পেটে পুরনো গ্যাসট্রিকের ব্যথা, খালি পেটে অ্যালকোহল পড়তে চিন চিন করে উঠছিল মাঝে মাঝে। ব্যথাটা কমাতেই বেশি খেল মনোরম।
–তোর মেয়ে বন্ধুরা এখানে আসে?
–আসবে না কেন?
একা?
একাও।
আবার কিছুক্ষণ মদ খেল দুজন।
-বীরু।
উ।
–মেয়েবন্ধুদের মধ্যে কাকে তোর ভাল লাগে সবচেয়ে?
সবাইকে। অদ্ভুত মদির হাসি হাসে বীরু, বলে-কে ভাল নয় বলো! মেয়েরা সবাই এত ভাল, এত সিমপ্যাথেটিক। আই লাভ দেম।
কাউকে বেশি ভাল লাগে না?
কাউকে অন্য কারও চেয়ে বেশি ভাল লাগতে পারে। তবে সকলেরই আলাদা রকমের ইন্টারেস্টিং পয়েন্ট আছে।
ধর, কারও সঙ্গে প্রেম করিস না?
–প্রেমই তো। শুধু আন্ডারওয়্যার পরে বসে ছিল বীরু বেতের গোল চেয়ারে। লম্বা পা দুখানা সামনে ছড়ানো। এমনভাবে প্রেমই তো বলল, যেন ভিয়েতনামে মার্কিন নীতির নিন্দে করছে।
–তোর গার্ল ফ্রেন্ডদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর কে?
–কে সুন্দর নয়! হাসল বীরু-সবাই নিজের মতো করে সুন্দর। আমি একদম হারিয়ে যাই ওদের মধ্যে। আজকাল আমার এমন হয়েছে যে রাতে শুয়ে যদি কারও কথা ভাবি তা হলে ওর চোখ ওর মুখে এসে বসে, এর ঠোঁট তার মুখে চলে যায়। বিশেষ কাউকে মনে পড়ে না। সে এক ভারী ঝামেলা। শোওয়ার সময়ে বিশেষ একজনকে ভাবতে ইচ্ছে করে, পারি না।
কাকে?
রোজ তো একজনকে নয়!
–তোর বন্ধুদের মধ্যে একজন আছে না, গৌরী! মাতাল মনোরম বলে ফেলল।
একটু স্থির হয়ে যায় বীরু, তারপর বলে, জানলে কী করে?
মনোরম মনে মনে ভয় পেয়ে যায়। কিন্তু ফেরার উপায় নেই।
খুব চালাক হওয়ার চেষ্টা করে বলল–গৌরী তো কমন নাম! আন্দাজে টোপ ফেললাম একটা।
–আন্দাজে! বলে একটু হাসে বীরু, তারপর বিষণ্ণ মুখে বলে–আন্দাজে হলেও লাগিয়েছ ঠিক। গৌরী একজন আছে।
-সে আসে?
–আসবে কী, সে এখন নার্সিং হোমে!
–কেন?
–বড্ড বোকা মেয়ে। আজকাল কেউ যে অত বোকা আছে তা জানতাম না।
মনোরম ধৈর্যভরে পান করল আর একটুক্ষণ।
কী হয়েছে?
–অ্যাকলেমশিয়া। তার ওপর ডানদিকটা পড়ে গেছে।
–সে সব তো বাচ্চাটাচ্চা হলে হয়।
তাই তো হয়েছে। প্রি-ম্যাচিওর বাচ্চা একটা।
কী করে হল?
–যেমন করে হয়। আজকাল যে এমন বোকা মেয়ে আছে, কে জানত! প্রেগন্যান্সিটা কেবলই অস্বীকার করে যেত। অথচ আমরা জানতাম। আমার মতো ওর অনেক বিশ্বস্ত এবং সৎ বন্ধু ছিল। ও স্বীকার করলে আমরা খুব সেফলি ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলতাম, কেউ জানত না। ও লজ্জায় কোনওদিন স্বীকার করেনি।
বাঁচবে?
চান্স কম। প্রচুর হেমারেজ হয়েছে। কোমায় পড়ে আছে। কথাটথা বলতে পারে না, জ্ঞানও ঠিক নেই। কাল থেকেই মনটা তাই খারাপ। মাঠ থেকেও সেজন্যই তাড়াতাড়ি চলে এলাম।
-তুই ওকে ভালবাসিস না বীরু?
বাসি। বিশেষ করে আজ তো ওকেই ভালবাসছি। কষ্ট হচ্ছে। কষ্ট হওয়া তো ভালবাসাই, না?
–ও যদি বাঁচে?
–খুব ভাল হয় তা হলে। আমি একটা পার্টি দেব।
বিয়ে করবি ওকে বীরু?
–বিয়ে? বীরু তাকায়। একটু ভাবে। তারপর বলে–ওকেই কেন করব?
বড় ভাল দেখতে মেয়েটা।
–কোথায় দেখলে? একটুও বিস্মিত না হয়ে সাধারণভাবে প্রশ্ন করে বীরু।
-দেখেছি।
-হ্যাঁ, ভালই। বিয়ে ওকেও করতে পারি। কোনও প্রেজুডিস নেই।
–কে ওকে প্রেগন্যান্ট করল?
-কে জানে। যেই হোক, গৌরীর সাবধান হওয়া উচিত ছিল। ওরই দোষ। মুঠো মুঠো ট্যাবলেট বাজারে বিক্রি হয়! কত মেয়ে নিজেরাই গিয়ে কেনে। ওরই কেবল লজ্জা আর লজ্জা।
-তুই ওকে বিয়ে করিস বীরু।
–আগে বাঁচুক তো! তুমি কি আরও খাবে? খেয়ো না। গাড়ি নিয়ে যাবে তো, না খাওয়াই ভাল। আমি আজ বাড়ি ফিরছি না। আর একটু খেয়ে পড়ে থাকব।
বাড়িতে খবর দেব?
–না না, কোনও দরকার নেই। মাঝে মাঝে আমি ফিরি না, সবাই জানে। তুমি যাও।
শূন্য গেলাস রেখে মনোরম উঠে এসেছিল।
সেই একটা সুদিন এসেছিল। তার পরদিন থেকেই বীরু আবার আলাদা মানুষ। গ্রাহ্য করে না, তাকায় না। কথা তো নেই-ই, আবার একজন অচেনা মানুষ হয়ে যায় বীরু।
খুঁজে খুঁজে নার্সিং হোমটা বের করেছিল মনোরম। মেয়েটা বেঁচে গেছে। বীরু আবার গাড়ি দাবড়াচ্ছে। মেয়েদের নিয়ে যাচ্ছে অ্যাপার্টমেন্টে। ওর ঘরে উদ্দাম বেজে যাচ্ছে স্টিরিওতে নাচের বাজনা। মনোরমের কথা কি মনে রেখেছে বীরু? না ভুলে গেছে?
ও কি উদাসীন সন্ন্যাসী? ও কি পাষণ্ড?ওকে ঠিক বুঝতে পারে না মনোরম। একেই কি জেনারেশন গ্যাপ বলে? বীরুর পিছু নিতে নিতেই মনোরম তার পোশাক পালটে ফেলল। রাখল বড় চুল, জুলফি। দিশি গাড়িটা নিয়ে সে যেমন বীরুর ফিয়াটের সঙ্গে তার দূরত্বটা কমিয়ে আনার চেষ্টা করেছে, তেমনি জেনারেশন গ্যাপটাও অতিক্রম করার চেষ্টা করেছে।
.
সেই মায়াদয়াহীন মুখখানা! বীরু বসে আছে টেবিলের উল্টোদিকে। ফাইলপত্র ঘাঁটছে। মনোরম অস্বস্তির সঙ্গে চেয়ে ছিল।
ফাইলটা বন্ধ করে বীরু মুখ তুলল। হঠাৎ আতৃঙ্কিত আনন্দে মনোরম দেখে ও হাসছে।
-তোমার বউকে কাল দেখলাম।
–কে! কার কথা বলছিস?
—তোমার বউ সীতা।
সীতা! বউ! বউদি নয়? একটু অবাক হয় মনোরম।
-কোথায়?
নিউ মার্কেটে। শি হ্যাড কোম্পানি।
–ওঃ! তোকে চিনল?
–এক-আধবারের দেখা, ঠিক চিনতে পারেনি। আমি চিনেছি। মেয়েদের মুখ আমার মনে থাকে।
–কথা-টথা বললি?
-হুঁ। সেইটেই একটা ভুল হয়ে গেল।
ভুল?
-চিনতে পেরেই হঠাৎ বউদি বলে ডেকে ফেলেছিলাম। খুব ঘাবড়ে গেল। তাই এগিয়ে গিয়ে পরিচয় দিলাম। একটু কষ্টে চিনল। দু-চারটে কথাবার্তা হল।
বউদি বলে ডাকলি?
তবে কী বলে? বউদিই তো হয়। ছাই সেটাও একটা গণ্ডগোল হয়ে গেল।
–কেন?
সঙ্গে যে লোকটা ছিল, ওয়েলবিল্ট কেম্যান, সে লোকটা আমার দিকে ভীষণভাবে চেয়ে রইল। আমি বউদির সঙ্গে কথা বলছি, আর লোকটা অপলক চেয়ে আছে, যেন খেয়ে ফেলবে। যখন চলে আসছি তখন লোকটা আমাকে ডাকল, একটু আলাদা ডেকে নিয়ে গিয়ে বলল–আপনি ওকে বউদি ডাকলেন, কিন্তু ও এখন কারও বউ নয়, জানেন? আমিও ভেবে দেখলাম কথাটা ঠিক। ক্ষমাউমা চেয়ে নিলাম। ও নিজেই বলল বরং ওকে নাম ধরে ডাকতে পারেন, কিংবা মিস সান্যাল বলে। আমি সেটাও মেনে নিলাম। চলে আসবার সময়ে তোমার এক্স বউকে ডেকে বললাম-সীতা চলি।
মনোরম কিছু শুনছিল না। শুধু বলল হু।
লোকটা রুস্তম টাইপের, আর খুব জেলাস। গায়ে অনেক মাংস, সাতটা বাঘে খেয়ে শেষ করতে পারে না।
কৌতুকভরে বীরু চেয়ে আছে মনোরমের মুখের দিকে। মনোরম মুখটা ফিরিয়ে নেয়। জিভটা সব সময়েই নড়ে, কিন্তু অভ্যাস বলে সব সময়ে মনোরম তা টের পায় না। এখন পেল। মুখের ভিতরে যেন একটা হৃৎপিণ্ড, অবিরল তার মৃদু শব্দ।
৪. মেঘ করে আসে
০৪.
দিন যায়। মাঝে মাঝে খুব মেঘ করে আসে৷ বৃষ্টি হয়। কখনও রোদ উঠে নীল জলের মতো আকাশ দেখা যায়। ঘরে ভাল লাগে না। স্পষ্টই বোঝে, বাড়িতে কুমারী-জীবনে যেমন ছিল সে, তেমনটি আর নেই। বিবাহিতা অবস্থায় যেমন ছিল, তেমনটাও নেই। দাদাই যা একটু সহজ। কিন্তু সীতার সঙ্গে দাদার দেখা হয় কতটুকু সময়। মক্কেল আর কোর্টকাছারি নিয়ে দাদা বড় ব্যস্ত।
মনোরম জামাই হিসেবে এ বাড়ির কারও পছন্দের ছিল না। তবু সবাই একরকম তাকেই হোট জামাই হিসেবে মেনে নিয়েছিল। সীতা ভুল করেছে, এ কথা সবাই বুঝত। সীতাও বুঝেছে, একটু দেরিতে।
বাবা ইদানীং কানে বড় কম শোনে। একটা যন্ত্র আছে কানে পরবার। তাতেও খুব একটা কাজ হয়নি। একটু চেঁচিয়ে বললে শোনে।
“মেয়ে, কখনও পরপুরুষের সঙ্গে একা রাস্তায় হেঁটো না।”
“মেয়ে, বাবা আর ভাই ছাড়া কোনও পুরুষের উপহার নিয়ো না।”
বিয়ের আগে এ সব কথা একটা ক্ষুদে বই থেকে বাবা তাকে মাঝে মাঝে পড়ে শোনাত। বইটার নাম ছিল, নারীর নীতি। উপদেশ দুটো সীতা মানেনি। শিমুলতলার প্রকৃতিতে কী একটা ছিল, মাদকতাময়, বাধা ছিন্ন করার নিমন্ত্রণ।
বিয়েটা পছন্দের না হোক, বাবা তবু বিয়ের পর সেই বইটা থেকেই আবার শোনাত স্ত্রী হচ্ছে পুরুষের বিশ্রামের জায়গা। যখন খেটেখুটে সে ফিরে আসবে, তখনই তাকে অভাব-অভিযোগের কথা বোলো না। তাকে সেবা দিয়ে, সুস্থ করে তুলল, তারপর মৃদু নম্র ভাবে যা বলার বলল। মনে রেখো, তুমি তাকে তোমার দিকে আকৃষ্ট করে রাখার চেষ্টা করলে সে জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আসবে। সার্থক হবে না সে। বরং তাকে আদর্শের দিকে ঠেলে দিয়ে, সে পৃথিবী জয় করবে…ইত্যাদি। বয়সে অনেক বড় ছিল মনোরম, সীতার চেয়ে প্রায় দশ বছরের বড়। বাবাকে এ ব্যাপারটা খুব খুশি করেছিল, স্বামীর সঙ্গে বয়সের বেশি তফাত থাকাই নাকি ভাল, এগুলো মনে রাখার কথা নয়। সীতা রাখেনি। উপদেশ হচ্ছে পেটেন্ট ওষুধের মতো। রোগ কী তা না জেনেই কিনে এনে খাও। সকলেরই তো একই রোগ নয়। বিশেষ অসুখের জন্য বিশেষ ওষুধ দরকার। তার জীবনে উপদেশটা ঠিক খাটেনি। তবু বিয়ের পর বহুকাল বাবা তাকে নারীর নীতি পড়ে শুনিয়েছে। মনোরমকে কোনও আদর্শের দিকেই ঠেলে দিতে পারেনি সীতা। তারা প্রেম করেছে, রতিক্রিয়া করেছে, খেয়েছে, ঘুরেছে। ঝগড়াঝাঁটি হয়েছে, আবার ভাবও। সন্দেহ এবং অবিশ্বাস এসেছে, আবার প্রেমও করেছে। এবং তারপর ক্লান্তি এসেছিল। এল নিস্পৃহতা। যত বয়স বাড়ছিল, ততই মনোরম পুরোপুরি বাধ্য পরিচারিকা তৈরি করতে চেয়েছিল সীতাকে। প্রেমের কথা, ভালবাসার স্পর্শ বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। অনেক সময়ে শরীর ঘাঁটত না একনাগাড়ে সপ্তাহভর। কেবল বুকের মাঝখানে কামগন্ধহীন মাথাটা এগিয়ে দিত। সীতা মাঝে মাঝে সে মাথাটা সন্তর্পণে বালিশে তুলে দিয়ে পাশ ফিরে শুয়েছে। মানস এসে বসত বাইরের ঘরে। একটু দূরত্ব বজায় রেখে বসত, কিন্তু তার হাসি, আন্তরিকতাময় কথাবার্তা শরীরের দূরতটুকু অতিক্রম করত অনায়াসে। কিন্তু এগুলো কারণ নয়। আসল কারণ ওই সন্দেহ। মাঝেমধ্যে একটা অস্পষ্ট যৌনঋণ-এর কথা উল্লেখ করতে থাকে মনোরম। চিৎ কদাচিৎ যখন তারা শরীরে শরীর মেলাত, তখন মনোরমের ছিল শাসকষ্টের মতো দম ফেলতে ফেলতে ওই প্রশ্ন-বলো তো, আমি কে?
–তুমি! তুমি তো তুমিই! আবার কে?
না, না, ঠিক করে বলল। ঠিক করে বলো। আমি কে?
তা হলে জানি না।
–তা হলে আমি বলি?
বলো!
রাগ করবে না?
কী এমন বলবে যে রাগ করব?
–আমি এখন-আমি বোধ হয়-মানস লাহিড়ি!
কী বলছ?
নই?
–তুমি অন্য লোক হতে যাবে কেন?
–আমি অন্য লোক নই। কিন্তু তুমি যাকে ভাব?
–ভাবব? ভাবব আবার কী? কেন ভাবব?
-আমি তো পুরনো হয়ে গেছি। আমি তো আর উত্তেজক নই! এই বয়সেই স্বামী-স্ত্রী অন্য মানুষকে ভাবতে শুরু করে।
স্তব্ধ হয়ে থেকেছে সীতা। বুকের ওপর মানুষ, কত কাছের মানুষ, তবু কী অস্বস্তিকর জটিলতা।
কোনওদিন বা সুখকর ঘনিষ্ঠতার মুহূর্তে
মানুষের মন, তার কোনও ছবি দেখা যায় না।
কী বলছ?
–মানুষ মনে যে কে কাকে ভাবে!
সীতা ঝাঁকি দিয়ে জিজ্ঞেস করেছে–স্পষ্ট করে বলো।
–আমি এখন তোমার মনের ভিতরটা দেখতে চাই।
–কেন?
—দেখতে চাই, সেখানে কে আছে!
-তুমি কি পাগল?
–কেন?
–তুমি আমাকে সন্দেহ কর?
মনোরম চুপ।
সীতা দুহাতে মনোরমের বাহু খামচে ধরে বলেছে-বলো, সন্দেহ করার মতো তুমি কী দেখেছ! কী করেছি আমি?
–কিছু দেখিনি। শুধু দেখেছি, তোমরা বাইরের ঘরের টেবিলের দুপাশে দুজন বসে আছ। তুমি উল বুনছ. মানস তোমার দিকে চেয়ে আছে। আর কিছু না।
-তবে?
–কিন্তু আমার মনে হয়েছে, তোমাদের দুজনের মাঝখানে একটা অদৃশ্য সার্কল। বিদ্যুৎ তরঙ্গের মতো কী একটা যাতায়াত করছে। একটা বলয়, সেটা শূন্য, অদৃশ্য, কিন্তু আছে। তোমরা ভালবাসার কথা বলো না। কিন্তু ও তোমাকে কমপ্লিমেন্ট দেয়, যা আমি আগে দিতাম তোমাকে, এখন আর দিতে পারি না। আমার স্টক ফুরিয়েছে। তোমাকে পেয়েছি যখন, তখনই হারিয়েছি। রহস্য শেষ হয়ে গেছে আমাদের। কিন্তু ও নতুন, বাইরে থেকে এসেছে। ওর দেওয়ার আছে অনেক। তুমিও নিচ্ছ। জমে উঠছে ঋণ। সে ঋণ কী ভাবে শোধ হবে?
সীতা কেঁদেছে, না বুঝে।
মনোরম তবু বলেছে–সেই ঋণ শোধ হয় কল্পনায়। আমার শরীরে চলে আসে মানস লাহিড়ি।
কাঁদতে কাঁদতেও সীতা রেগে গিয়ে বলেছে-কল্পনা। সে তো তোমারই! তুমি মেয়েদের নিয়ে কল্পনা করতে না?
–এখনও করি। করি বলেই ধরতে পারি।
–না, আমি তোমার মতো স্বপ্ন দেখি না। আমার অত কল্পনাশক্তি নেই। কারও ধার আমি ধারি না।
এইভাবে মাঝরাতে উঠে তাদের ঝগড়া হত। প্রচণ্ড ঝগড়া। মনোরম ভুল করেছিল তার নিজের কল্পনাশক্তিই খেয়ে ফেলেছে তাকে। নিজের দোষ সে সীতার ওপর আরোপ করতে শুরু করেছিল।
কিন্তু মানস আসত। উল বুনত সীতা। মানস বসে থাকত। না, দূরত্বটা কখনও অতিক্রম করত না মানস। তার আছে নিজেকে ধরে রাখার অমানুষিক ক্ষমতা। কিন্তু থেমে-থাকা স্টার্ট-দেওয়া মোটরগাড়ি যেমন কাঁপে, তেমনই কি কেঁপেছে মানস! বিবাহ-বিচ্ছেদের পরও সে সীতার শরীর আক্রমণ করেনি বহুদিন। অপেক্ষা করেছে। মাত্র সেদিন সে..
কিন্তু ঘুরেফিরে সেই মানসই এল। মনোরম ভুল বলেছিল বটে, তবু ভুলটাকে সত্যি করে দিল নাকি সীতা! এখন যদি মনোরম কখনও সামনে এসে দাঁড়ায়, যদি প্রশ্ন করে, তবে মূক হয়ে মাথা নত করে নেবে না কি সে?
.
বাবা সেই ক্ষুদে বইটা থেকে তাকে উপদেশ শুনিয়েছে কুমারী অবস্থায়। বিবাহিত জীবনে। কিন্তু যখন এই তৃতীয় অবস্থায় সে ফিরে এসেছে বাপের বাড়িতে, তখন আর বাবা সেই ক্ষুদে বইটা পড়ে তাকে শোনায় না। বেশির ভাগ সময়েই কানের যন্ত্রটা বাবা আজকাল খুলে রাখে।
গোপন কোনও কথা বলতে হলে দাদা বাবাকে ছাদে নিয়ে যায়। সেখানে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে। সীতা এবার এলেও দাদা ওরকমভাবে বাবাকে ছাদে নিয়ে গিয়ে ব্যাপারটা বুঝিয়েছে। বাবা সীতাকে কিছু বলেনি। কেবল তাঁর দন্তহীন মুখে বার বার ঠোঁট জোড়া গিলে ফেলেছে বাবা। চারদিকে চেয়ে কী যেন খুঁজেছে। এ সময়ে বোধহয় মৃত স্ত্রীকেই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল মানুষটার। ছেলেমেয়েদের কথা বাবা আর বুঝতে পারে না। স্ত্রী বেঁচে থাকলে একমাত্র তার কথাই মানুষটা বুঝতে পারত।
নীচে দাদার অফিসঘরে টেলিফোন আছে। ওপরের হলঘরে তার এক্সটেনশন। কল এলে দুটো ফোনই বাজে। নিয়ম হল টেলিফোনে রিং হলে নীচে দাদা ধরে, ওপরে সীতা, বাবা কিংবা বউদি। দাদার কল হলে ছেড়ে দেয়, নিজেদের কল হলে দাদা ছেড়ে দেয়।
.
সেদিন বউদি কালীঘাট গেছে, সীতা বাথরুমে। বাবা হলঘরে বসে কাগজটা খুঁটিয়ে পড়ছে। সে সময়ে টেলিফোন বাজছিল। বাবা ধরল না। সীতার গায়ে তখন সাবান। সে চেঁচিয়ে বলল–বাবা, ফোনটা ধরো। শোনার কথা নয় বাবার। বেজে বেজে টেলিফোন থেমে গেল। নীচে দাদা ধরেছে। একটু পরেই দাদা সিঁড়ির গোড়ায় এসে চেঁচিয়ে বলল-সীতা, ফোনটা ধর। তোর কল।
কোনওক্রমে গায়ে কাপড় জড়িয়ে বেরিয়ে এসছিল সীতা। ফোন কানে নিল। কোনও শব্দ হল না। হ্যালো, হ্যালো, অনেকবার করল সে।, কোনও উত্তর নেই। বোধহয় ছেড়ে দিয়েছে। ফোনটা রেখে দেওয়ার আগে তার অস্পষ্টভাবে মনে হল, ওপাশে যেন একটা দীর্ঘশ্বাসের অস্ফুট আওয়াজ হল। জ্ব কোঁচকাল সীতা। ভুলই হবে। রেখে দিল। বাবাকে বলল-ফোনটা ধবনি কেন বাবা, দেখ তো লাইনটা কেটে গেল।
বলেই লক্ষ করল, বাবার কানে যন্ত্রটা নেই। বাবার ঘর থেকে যন্ত্রটা নিয়ে এল সীতা। বাবার কানে লাগাতে লাগাতে বলল–কেন যে যন্ত্রটা পরে থাক না!
বাবা হঠাৎ মুখ তুলে আঁতকে উঠে বলে–না, না! ওটা লাগাস না।
সীতা অবাক হয়ে বলল–কেন?
বাবা সীতার ঠোঁট নড়া দেখে বলে–ওটার আর দরকার নেই।
বাঃ! তুমি যে এটা হলে শুনতে পাও না!
বাবা চোখটা সরিয়ে নিয়ে বলে অনেক শুনেছি। সারা জীবন। আর কিছু শুনতে চাই না। ঠাকুর করুন, যে কটা দিন বাঁচি, আর যেন কিছু শুনতে না হয়। এটা ফেলে দে।
এইভাবেই বাবা তার পরিপূর্ণ নিস্তব্ধতার জগতে চলে গেছে। স্বেচ্ছায় নির্বাসন। মাঝে মাঝে বাবার ঘরে যেতে ইচ্ছে করে সীতার। যায়। বাবা চোখ সরিয়ে নেয়। আর বারবার দন্তহীন মুখে নিজের ঠোঁটজোড়া গিলে ফেলতে থাকে। কচ্ছপের মুখের মতো। কথা বলে না। বলতে পারে না। বাঁধানো। দাঁতের পাটিজোড়া বাবা ছেড়ে রেখেছে, খাওয়ার সময় ছাড়া পরে না। চশমাও খুলেই রেখে দেয় বেশির ভাগ সময়। একটু বুড়োটে, আর কুঁজো হয়ে বসে থাকে ঘরে। যেন বা নকল দাঁত, নকল চোখ, নকল কান, কিছুরই আর প্রয়োজন নেই বাবার। ঠাকুর যা করেন মঙ্গলের জন্যই–এরকম বিশ্বাসে সব নির্মোক ঝেড়ে ফেলে প্রতীক্ষায় বসে আছে বাবা। কীসের? এক পরিপূর্ণতম নিস্তব্ধতার? নিচ্ছিদ্র এক অন্ধকারের? অন্তহীন ঘুমের? বাবা কিছুই শোনে না। চারধারে এক নিস্তব্ধতার ঘেরাটোপ। সীতা মাঝে মাঝে যায়। বসে থাকে। ক্ষুদে বইটা থেকে উপদেশগুলো বাবা আর কোনওদিনই শোনাবে না, বুঝতে পারে। বাবার নিস্তব্ধতার কাছে ক্ষণেক বসে থাকে সে। ঠিক সহ্য করতে পারে না। অসহ্য হয়ে উঠে আসে।
.
নতুন কেনা একটা শাড়িতে ফলস লাগাচ্ছিল সীতা। বউদি এসে একটু দাঁড়িয়ে দেখল।
নতুন শাড়ি?
–হুঁ।
–কে দিল?
–কে দেবে? নিজেই কিনলাম।
শাড়িটার অনেক দাম নিয়েছে?
–মন্দ না।
–আশি নব্বই?
–ওরকমই।
বউদি একটা খাস ছাড়ে, বলে-ঠাকুরঝি, তোমার কত টাকা! তুমি কত স্বাধীন।
-তুমি কি গরিব? পরাধীন?
–তা নয়। তবে ইচ্ছেমতো কিছু কিনে আনব, তার তো উপায় নেই! যা করব, সব অনুমতি নিয়ে করতে হবে। তুমি বেশ আছ।
–এরকম বেশ থাকতে চাও নাকি?
চাই-ই তো।
-কেন?
মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে সব সংসারটা হাটকে মাটকে দিয়ে চলে যাই। মেয়েমানুষ হওয়া একটা অভিশাপ।
ওরকম সবাই বলে। আবার এ সব নিয়েই থাকে।
তুমি তো থাকোনি।
সীতা দাঁতে ঠোঁট চাপে। আস্তে বলে–এ সব কথা থাক বউদি। তুমি ঠিক বুঝতে পারবে না। বউদি চলে গেলে অনেকক্ষণ জ কুঁচকে ফলসটার দিকে চেয়ে থাকে সীতা। ফুটপাতের দোকান থেকে কেনা ফলস মাপে অনেকটা ছোট হল, শাড়ির পুরো কুঁচিটা ঢাকা পড়বে না। খুব ঠকে সীতা। দেখেশুনে কেনে, তবু ঠিক ঠকে যায়। বরাবর। মনোরম খুব রাগ করত, বলত–মেয়েদের অভ্যাসই হচ্ছে সস্তা খোঁজা। সারা কলকাতা দুনম্বর মালে ছেয়ে গেছে, আসল-নকল চিনবার উপায়ই নেই, কেন নিজে নিজে কিনতে যাও?
ফলসটায় ঠকে গেছে বলে সীতার মনটা খারাপ হয়ে গেল খুব। এতটাই খারাপ হল যে, উঠে বিছানায় গিয়ে শুল। এবং একটু পরে কাঁদতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতে সে মনে মনে প্রাণপণে তার কান্নার গূঢ় কারণটাও বোধহয় খুঁজে দেখছিল। কারণটা খুঁজে পেল একটু পরে। বউদি একটা কথা বলেছিল–তোমার কত টাকা! তুমি কত স্বাধীন। কথাটার মধ্যে কিছু নেই। তবু আছে। মনোরমের সর্বস্ব কেড়ে না নিলেও পারত সে। বীরু সেদিন বলছিল, মনোরম তার কৃপণ মামার কাঠগোলায় চাকরি করছে। বীরু ছেলেটা মুখ-পলকা। হেসে বলেছিল আমার বাবার কাছে কাজ করা মানে কিন্তু সুখে থাকা নয়। জানো তো! না জানলেও বোঝে সীতা। সুখে নেই।
.
মানস আবার কাল চলে যাবে দিল্লি। চার-পাঁচ দিন পরে ফিরবে ফোন করল দুপুরে।
–আজ বিকেলে ফ্রি থেকো মৌ।
আমি তো সব সময়ে ফ্রি।
–একটু ঘুরব।
–আচ্ছা।
—দিল্লি যাচ্ছি।
জানি তো।
–ভাল লাগে না।
সীতা হাসল। শব্দ করে। যাতে মানস ফোনে হাসিটা শোনে।
–বেশি দিন তো নয়।
–তা নয়। দুঃখিত গলায় মানস বলে কিন্তু সারাজীবনই এরকম মাঝে মাঝে আমাকে চলে যেতে হবে। ছেড়ে থাকতে পারব তো?
সীতা শ্বাস ফেলল, এবং সেটাও শুনতে পেল মানস। আবেগের সঙ্গে বলল-মাঝে মাঝে তোমাকেও নিয়ে যাব।
-যেয়ো।
–আমি সেই ক্লাবটা থেকে ফোন করছি।
–কোন ক্লাব?
–সেই ক্লাবটা, যেখানে সেদিন..হাসিটা ফোনে শোনাল মানস।
সীতা একটু হাসল।
মানস বলল–ইচ্ছে করলে আজ আবার আমরা এখানে আসতে পারি।
সীতা উত্তর দিল না।
–রেডি থেকো। পাঁচটায়।
কথা শেষ হয়ে যায়। তবু একটু ফোন ধরে থাকে দুজন। পরস্পরের শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ শোনে।
ফোনে খাসের শব্দ শুনলে সীতার কেমন একটু অন্যমনস্কতা আসে। কদিন আগে একটা ফোন কল কেটে গিয়েছিল। কেটে গিয়েছিল? নাকি কেউ সত্যি ছিল ওপাশে? একটা অস্পষ্ট দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনেছিল সীতা। ভুল? তাই হবে। কিন্তু একটু অন্যমনস্ক হয়ে যায় সে।
ফোন রেখে দেয়।
.
ছুটন্ত ট্যাক্সিতে বার বার সিগারেট ধরাতে চেষ্টা করছিল মানস। হাওয়ায় দেশলাইয়ের কাঠি নিবে যাচ্ছে বার বার। সীতা হাসছিল।
–ওভাবে নয়। হাত দুটো কাপ করে নাও। সীতা বলে।
কাপ? সেটাই তো হচ্ছে না। আঙুলের ফাঁক দিয়ে বাতাস ঢুকছে।
–থাক, খেতে হবে না।
–খাবই! এই ড্রাইভার রোকে।
ট্যাক্সি দাঁড়ালে সিগারেটটা ধরাতে চেষ্টা করে মানস। সীতা দেশলাই কেড়ে নেয়। নিজে যত্নে ধরিয়ে দেয়। ট্যাক্সি আবার চলে।
–কেন যে ছাই লোকে খায় এটা। কী আছে সিগারেটের মধ্যে?
বোধহয় ভালবাসা। মনে মনে এই কথা বলে সীতা। মুখ টিপে হাসে। দেখে, ধোঁয়া লেগে মানসের দুই হরিণ-চোখ ভরা জল।
–আর খেয়ো না।
–কেন?
–অভ্যেস নেই। কাশবে।
–আমার মুখে কি কোনও দুর্গন্ধ আছে সীতা?
–সীতা নয়, মৌ। তুমিই নাম দিয়েছিলে।
সিগারেটের ধোঁয়ায় মাথা আবছা হয়ে গেছে। কিছু ভাবতে পারছি না। গন্ধ নেই তো?
না তো! তোমার মুখের গন্ধ সুন্দর।
তবে কেন সিগারেট খেতে বললে আমাকে?
–পুরুষেরা সিগারেট খায়, দেখতে আমার ভাল লাগে।
–শুধু দেখার জন্য একজনের না-খাওয়ার অভ্যাস নষ্ট করছ?
খেয়ো না।
–রাগ করে বলছ?
না, আমার অত সহজে রাগ হয় না।
–সিগারেট তো আমি খাচ্ছিই। অভ্যাস করে নেব।
না। মাঝে মাঝে খেয়ো। পুরুষের মুখ কাছাকাছি এলে একটুখানি সিগারেটের গন্ধ পাওয়া যায়, সেটা ভীষণ ভাল লাগে।
-আচ্ছা! মনোরম খুব খেত না?
–খেত। কিন্তু তার সঙ্গে এটার কোনও সম্পর্ক নেই।
জানি। সেদিনকার ওই লম্বা ছেলেটা কে?
বীরু। আমার মামাশ্বশুরের ছেলে।
–তোমার মামাশ্বশুর? বলে মানস চেয়ে থাকে। খুব অবাক চোখ। সীতা অবাক হওয়ার মতো কিছু খুঁজে না পেয়ে বলে কী হল?
-মামাশ্বশুরের ছেলে?
–হ্যাঁ। দেওর।
কী বলছ মৌ?
হঠাৎ খেয়াল হতে সীতা জিভ কাটে। ঠিক তো। তার আর কোনও মামাশ্বশুর নেই, দেওর নেই।
মুখ নিচু করে একটু লাজুক ভঙ্গি করল সীতা।
ভুল হয়ে গিয়েছিল।
মানসকে একটু পাঁশুটে দেখায়। সিগারেটটা আধখাওয়া করে ফেলে দিয়ে বলে–ঠিক আছে।
না, ঠিক নেই। তুমি রাগ করেছ। সীতা একটু ঘন হয়ে বসে।
–রাগ করিনি। তবে কেমন একটু লাগে। তুমি ঠিক ভুলতে পারছ না।
ভূলছি। এইমাত্র সব ভুলে গেলাম। দেখ, আর এরকম হবে না।
মানস একটু থমথমে মুখে বলে- ভুলবে কী করে, যদি কলকাতাময় মনোরমের আত্মীয়তা ছড়ানো থাকে!
–ওর বেশি আত্মীয় নেই।
–নেই?
না। ওর বুড়ো বাবা বলে তাকিয়ে একটু হাসে সীতা, বলে–দেখ, শ্বশুর বলিনি কিন্তু।
মানস হাসে।
ওর বুড়ো বাবা ওর ছোটভাইয়ের কাছে থাকে দূরের এক মফস্বল শহরে। সে বাড়িতে আমি মোটে বার দুই গেছি। ও বেশি সম্পর্কও রাখত না। মা নেই। এখানে যারা আছে, তারা সব মামা, মাসি, পিসি গোছের। সে সব সম্পর্কও আলগা হয়ে গেছে।
–তোমাকে আমি খুব দুরে নিয়ে গিয়ে থাকব।
–কেন? ওর আত্মীয়দের ভয়ে?
–হু। আমার রেলের চাকরি। ইচ্ছে করলেই বদলি হতে পারি।
আমার কলকাতা ভাল লাগে।
–কেন?
–আমার লাগে। একটা শখ আছে আমার, ঘুরে ঘুরে এ-জায়গা সে-জায়গা থেকে জিনিসপত্র কেনা। কিনতে যে কী ভীষণ ভাল লাগে! কলকাতা ছাড়া এরকম দোকান আর দোকান তো কোথাও নেই!
–আচ্ছা, তা হলে কলকাতাতেই থাকব। ফ্ল্যাট তো পেয়েছিই।
আমি কিন্তু খুব জিনিস কিনি, আর ঠকে আসি।
–কিনো।
–ঠকলে বকবে না তো?
না। মেয়েরা তো ঠকেই। কলকাতায় এই যে এত দোকান, এত ফিরিঅলা, এরা তো মেয়েদের ঠকিয়েই বেঁচে আছে।
তুমি কত মেয়ে চেনা!
একজনকে তো চিনি। তাকে চিনলেই সব চেনা হয়ে যায়।
আমি একটা গ্লাটন। সামনে আস্ত একটা মুরগির রোস্ট, নিচু হয়ে সেটার গন্ধ শুঁকে বলল মানস।
–গ্লাটন মানে কী?
–লোভী। পেটুক।
যা। তুমি কি তাই?
–নয়?
একদম নয়। তোমার শরীর আন্দাজে ওইটুকু আবার খাওয়া নাকি। একটা তো এইটুকুন মাত্র মুরগি।
আস্ত মুরগি। –
-হোকগে।
–খাওয়া কমাব, বুঝলে মৌ?
–কেন?
তুমি খাবে এইটুকুন, আমি খাব অ্যাতো, সেটা কি ভাল দেখাবে?
–মোটেই তুমি অতো খাও না।
—খাই।
-খাও তো খাও।
তবে তুমি খাওয়া বাড়াও।
–মেয়েরা বেশি খেতে পারে না।
–কে বলেছে? এসপ্ল্যানেডে বিকেলের দিকে মেয়েরা যা গপাগপ ফুচকা খায় না, দারা সিং অত তে পারবে না।
সীতা মুখে আঁচল তুলে হাসল।
–তুমি খাও না বলেই রোগা হয়ে অ্যানিমিক।
–স্লিম থাকাই তো ভাল। মোটা মেয়েরা বেশি ভোগে। আমার কোনও অসুখ নেই।
–তোমার ঠিক অ্যানিমিয়া আছে। ডাক্তারের কাছে গেলেই ধরা পড়বে।
–থাকলে আছে।
থাকবে কেন?
–থাকলে অপছন্দ নাকি? বিয়ে বাতিল করবে?
দুজনে দুপলক পরস্পরের দিকে চেয়ে থেকে হেসে ফেলে।
—আইসক্রিমটা নাড়াচাড়া করছ মৌ, খাচ্ছ না।
–ভীষণ ঠাণ্ডা, দাঁত শিরশির করে। গলা বসে যাবে।
–তবে পকৌড়া খাও।
–ভাল লাগছে না। তুমি খাও, আমি দেখি।
আস্তে ধীরে খাচ্ছিল মানস, মাঝে মাঝে তাকিয়ে হাসছিল। একদৃষ্টে চেয়েছিল সীতা। সুন্দর মেদহীন চৌকো পুরুষ মুখশ্রী। কাঁধ দুটো কতদূর ছড়ানো। মস্ত হাত। দেখতে ভাল লাগে। অনেকদিন ধরে দেখছে সীতা। তবু এ নতুন করে দেখা। এ ভাবে দেখা হয়নি। এই ডবলডেকারের মতো মানুষটার কাছে সে পাখির মতো ছোট্ট। বোধহয় মানসের মাথা কোনওদিনই বুকে নিতে হবে না সীতার। এবার উল্টো নিয়ম হবে। তাকেই পাখির মতো বুকে নিয়ে শুয়ে থাকবে লোকটা। সারা রাত।
হঠাৎ সীতা আস্তে করে বলে তুমি স্বপ্ন দেখ না?
–স্বপ্ন? একটু হাঁ করে চেয়ে থাকে মানস। তারপর অনেকক্ষণ বাদে হাসে–স্বপ্ন, মৌ? না, দেখি না। আমি খুব সাউন্ড স্লিপার। কেন?
-এমনিই। অনেকে ঘুমের মধ্যে কথা বলে।
আগে থেকে সাবধান হচ্ছ? ভয় নেই, ও সব হয় তাদের যারা স্নায়ুর রোগে ভোগে।
–তাই!
আবার চুপ। দুজনেই। সীতা সাদা আঙুলে কাঁচের টেবিলে একটা শূন্য আঁকল। তারপর মুখ তুলে হাসল।
ট্যাক্সিটা বাঁক ঘুরতেই অন্ধকারের মধ্যে স্টিমারের মতো ঝলমল করে ওঠে ক্লাব। চারধারে যেন বা কালো নদী। স্টিমার চলেছে।
গাছগাছালিতে বাতাস মর্মরধ্বনি তুলেছে। আলোকিত টেনিস লন। সাইটস্ক্রিনের আড়ালে বলে দেখা যায় না কিছু। হঠাৎ পক করে বলের শব্দ আসে।
আজও কেউ বড় একটা ফিরে তাকায় না। তারা সিঁড়ি বেয়ে ওঠে। টেবল-টেনিসের টেবিলে খুব ভিড় আজ। বহু খেলোয়াড়। চারদিকে বেয়ারাদের দ্রুত আনাগোনা।
মানস মুখ ফিরিয়ে হাসল। বলল–আজ শনিবার।
–তাতে কী?
–ভিড়।
–ও।
–শনিবারে কলকাতার মানুষ পাগল হয়ে যায়।
–আমরাও কি শনিবারের পাগল?
–না। চিরকালের।
করিডোরে একজন তোক শ্লথ পায়ে আগে আগে হাঁটছিল। কথা শুনেই বোধহয় ফিরে তাকাল। অচেনা লোক। খুব ফরসা সুন্দর চেহারা, অবিকল সাহেবদের মতো। লালচে একজোড়া গোঁফ, লালচে চুল এলোমেলো হয়ে আছে মাথায়। মুখে সামান্য ক্লান্তির ছাপ। একটু হাসল কি লোকটা?
সীতা সিটিয়ে যাচ্ছিল। তারপর হঠাৎ মনে পড়ল, সে কিছু অন্যায় করছে না। সে কোনও অপরাধ করেনি।
পিঠে মানসের আলতো হাত তাকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কিছু ভয় নেই।
ঘরটা খালিই ছিল। ঠিক আগের দিনের মতো। মানস দরজাটা আগেই বন্ধ করে দিল। ফিরে ইঙ্গিতময় হাসি হাসল একটু। ঠিক সেই মুহূর্তেই সীতার মনে পড়ে, কদিন আগে কেটে যাওয়া টেলিফোন কল। লাইনটা কি কেটে গিয়েছিল সত্যিই? না কি কেউ দীর্ঘশ্বাসই কেবল শুনিয়েছিল তাকে?
ভ্রূ আপনা থেকেই কুঁচকে গেল সীতার।
কী হল? কিছু ভাবছ? মানস প্রশ্ন করে।
সীতা উত্তর দেয় না। শুনতেই পায় না প্রশ্নটা।
ঘরের একদিকে চমৎকার একটা পুরনো আমলের ড্রেসিং টেবিল। বেলজিয়ামের মসৃণ কাঁচ বসানো। সীতা ধীর পায়ে উঠে গিয়ে একটু দাঁড়াল আয়নার সামনে। অ্যানিমিক? বোধ হয়। তাকে খুব রোগা আর ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। মিছে কথা বলেছিল সীতা মানসকে। তার আজকাল খুব অম্বল হয়, মাথা ধরে। হয়তো খুব শিগগিরই অসুখ হবে। আমার অসুখ নেই, এ কথাটা খুব ভেবে বলেনি সে। একটু পিছনে দাঁড়িয়ে আছে মানস। এতক্ষণে ওর পোশাকটা লক্ষ করেনি সীতা তেমন করে। খুব ঝকঝকে একটা চেক প্যান্ট পরনে, গায়ে সাদা স্পোর্টস গেঞ্জি। বুকের চৌকো পাটা ফুটে আছে গেঞ্জির ওপর। বাঁ কাঁধটা ভাঙা, একটু নোয়ানো। খুবই বড় শক্তিমানের চেহারা। ওর পাশে সে কি আধখানা, না সিকিভাগ?
মানস এগিয়ে আসে।
সীতা আস্তে করে বলে–তোমাদের দুজনের খুব অদ্ভুত মিল।
-কাদের দুজনের কথা বলছ?
–তোমার আর ওর।
–ও কে?
–মনোরম।
–মিল?
দুটো খুব অদ্ভুত মিল।
কী?
–তোমাদের দুজনের নামই ম দিয়ে শুরু। আর…
–আর?
–তোমাদের দুজনেরই একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল।
মানস এগিয়ে এসেছিল অনেকটা, তবু দূরত্ব ছিল একটুখানি। সেই দূরত্বটা রয়েই গেল। মানন্সের মুখটা আস্তে আস্তে একটু গম্ভীর হয়ে যায়।
বলল–মৌ, আমাকে তুমি সিগারেট খাওয়া শিখিয়েছ কেন?
এমনিই। ভাল লাগে।
না।
তবে কেন? অবাক হয়ে প্রশ্ন করে সীতা।
–মনোরমের সঙ্গে আমার আরও মিল বের করতে।
তার মানে?
তুমি কি আমার মধ্যে মনোরমকেই চাও?
সীতা মূক হয়ে গেল।
৫. বাকি বকেয়া
০৫.
ঝুমু, তুই বাসাটা ছেড়ে দে। আমার বাড়িতে চলে আয়। যা বাকি বকেয়া পড়েছে তা আমি দিয়ে দেব।
-কেন?
ওয়াচ হিম। ওয়াচ হিজ স্টেপস।
–কোনও লাভ নেই।
কেন?
–ওর ভিতরে কিছু সাহেবি ব্যাপার ঢুকে গেছে।
–সেটা কী?
–সব বুঝবার তোমার দরকার কী?
আমার ছেলে, আর আমার বুঝবার দরকার নেই?
–জেনারেশন গ্যাপ বোঝো?
বুঝব না কেন? বুঝি কিন্তু মানি না। ও সব বানানো কথা।
হবে।
ঝুমু, আমার কেবলই মনে হয় ও শিগগিরই নিজেকে শেষ করবে।
মনোরম চুপ করে থাকে।
তুই সব সময়ে আমার আর ওর কাছাকাছি থাক ঝুমু।
–মানুষ তো আমি একটা, দুজনের কাছে থাকব কী করে?
সময় ভাগ করে নে। না, বরং তুই ওর কাছে কাছেই থাক। ওরই বিপদ বেশি।
–এ কথা বলছ কেন? কীসের বিপদ?
ও তো কিছু বলে না, কিন্তু মনে হয়, ও একটা প্রবলেমের মধ্যে আছে।
–প্রবলেমের মধ্যে সবাই থাকে।
-কিন্তু বীরুর তো প্রবলেমের কোনও কারণ নেই। ভেবে পাই না, ওর প্রবলেমের কী থাকতে পারে। তাই মনে হয়, ওর বড় বিপদ।
বিপদ? না কিছুই খুঁজে পায় না, ভেবে পায় না মনোরম। ও খারাপ মেয়েমানুষের কাছে যায় না যে রোগ নিয়ে আসবে। ওর মেয়েবন্ধুরা অভিজাত পরিবারের। অবৈধ সন্তানের ভয় নেই, খোলা বাজারে বিক্রি হয় কন্ট্রাসেপটিভ। ওর প্রেমের কোনও ঝামেলা নেই, কারণ ঘুমের সময়ে ওর কারও মুখ মনে পড়ে না। জুয়ায় অনেক টাকা হেরে গেলেও ওর অনেক থাকবে।
প্রবলেমটা খুঁজে পায় না বটে মনোরম, কিন্তু খুঁজে ফেরে। দিশি গাড়িটা নিয়ে সে ক্লান্তিহীন ছোটে বীর পিছনে। বীরু মুহুর্মুহু পোশাক কেনে, কেনে গ্রামোফোনের উত্তেজক ডিস্ক, ভাল হোটেলে খায়, নাচে, খেলে বেড়ায় বড় ছোট ক্লাবে, সাঁতরায়, মেয়েদের নিয়ে যায় অ্যাপার্টমেন্টে, মনোরম সারা কলকাতা বীরুর ফিয়াটটাকে তাড়া করে ফেরে। বীরু বিতর্কসভায় বক্তৃতা করে, ভিয়েতনামে মার্কিন বোমারু বিমানের কাণ্ডকারখানার হুবহু বর্ণনা দেয়, লাইফ ম্যাগাজিনের পাতা খুলে জনসাধারণকে দেখায় নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মর্মন্তুদ ছবি। কিন্তু কোথাও থেমে নেই বীরু। চলছে। চলবে।
অনেক রাতে যখন বাসায় ফেরে মনোরম, তখন ক্লান্ত লাগে। বড় ক্লান্ত লাগে। রাতে সে প্রায় কিছুই খায় না। দুধে পাউরুটি ভিজিয়ে বিস্বাদ দলাগুলি গিলে ফেলে। দু ঘরেই জ্বেলে দেয় টিউবলাইটগুলি। তারপর সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খায়। মাঝে মাঝে ওপরের দিকে চেয়ে দেখে।
কী দেখে মনোরম? দেখে নীলচে স্বপ্নের আলো। জানালার বুটিদার পর্দাগুলি উড়ছে বাতাসে। ঠিক মনে হয়, ঘরের ভিতরে রয়েছে তার প্রিয় মেয়েমানুষটি। সে কে? রিনা? চপলা? না কি এক প্রাণহীন মেমসাহেব-পুতুল প্রাণ পেয়ে ঘুরছে তার শূন্য ঘরে? সীতা নয় তো?
রক্তমাংসময় একজনকেই পেয়েছিল মনোরম। সীতা। যতক্ষণ সিগারেট না শেষ হয়, ততক্ষণ রাস্তায় পায়চারি করে সে। কখনও দুটো-তিনটে সিগারেট ফুরিয়ে যায়। হাঁটতে হাঁটতে কথা বলে মনোরম। কাল্পনিক কথা, এক কাল্পনিক স্ত্রীর সঙ্গে। মাঝে মাঝে হাঁটতে হাঁটতে থেমে যায়। কল্পনাটা এমনই সত্যের মতো জোরালো হয়ে ওঠে যে তার ইডিও-মোটর অ্যাকশন হতে থাকে। গভীর রাতে নির্জন পূর্ণদাস রোডে কেউ তার সেই মূকাভিনয় দেখে না। দেখলে তারা দেখত, একজন প্রেমিক কেমন তার শূন্যনির্মিত নায়িকার সঙ্গে অবিকল আসল মানুষের মতো প্রেম করে।
রাত গম্ভীর হলে সে তার ছয় বাই সাত খাটে গিয়ে শোয়। মস্ত খাট। বিছানাটা একটু স্যাঁতসেঁতে। ফুটপাথ থেকে দুটাকা জমা রেখে আট আনা ভাড়ায় আনা ডিটেকটিভ বই খুলে বসে। হাই ওঠে। জল। খায়। টেবিল ল্যাম্প নেবায়। শেষ সিগারেটটাকে পিষে মারে মেঝের ওপর। তারপর ঘুমোবার জন্য চোখ বোজে।
অমনি কল্পনায় ভিন্ন পৃথিবী জেগে উঠতে থাকে। শরীরের ভিতরে নিকষ কালো অন্ধকারে জ্বলে ওঠে নীল লাল স্বপ্নের আলো। অবিকল এক জনহীন প্রেক্ষাগৃহ। আসবাব টানাটানি করে কারা পর্দার ওপাশে মঞ্চে দৃশ্যপট সাজাচ্ছে। পরদা সরে যায়। দীর্ঘ পৈঠার মতো ইস্কুলবাড়ির কয়েক ধাপ সিঁড়ি। তাতে তিনশো ছেলে দাঁড়িয়ে গায়-জয় জগদীশ হরে…
শূন্য বিছানায় তার প্রসারিত হাতখানা পড়ে থাকে। কিছুই স্পর্শ করে না।
সকাল দশটা থেকে কাঠগোলা। মাঝখানে একটু লাঞ্চ ব্রেক। মামাবাড়ি থেকে ভাত আসে। মামা-ভাগ্নে খায়। খেতে খেতে মামা বলে-ঝুমু, ওয়াচ হিম।
আজকাল বাঙালির কথা মামা ভুলে যাচ্ছে। নেতাজির কথাও। নিরুদ্দেশ সেই মানুষটির জন্য আর অপেক্ষা করতে ভয় পায় মামা। ফার্স্ট স্ট্রোক হয়ে গেছে। বীরু থেকে যাচ্ছে বিপদসঙ্কুল পৃথিবীতে।
ফিস ফিস্ করে একটা লোক কানের কাছে বলে ব্যানার্জি না?
তখন বীরু তার গাড়িটা রেখে দ্রুতবেগে ঢুকে যাচ্ছে স্টক এক্সচেঞ্জে। অনুসরণ করতে করতে বাধা পেয়ে মনোরম থেমে ফিরে তাকায়। চিনতে পারে না। মস্ত একটা কাঠামোয় নড়বড় করে দুলেদুলে মাংস আর চামড়ায়। চোখের নীচে কালি। ক্লান্ত মানুষ একটা।
টেলিফোনে যেমন শোনা যায় মানুষের গলা, তেমনি, ফিসফিসিয়ে বলে–বিসোয়াস্ হিয়ার।
–বিশ্বাস! কী হয়েছে, চেনা যায় না?
বলছি। খুব ব্যস্ত?
মনোরম মুখটা একটু বাঁকা করে হাসে–না। জাস্ট একজনকে চেজ করছিলাম।
–চেজ?
–অলমোস্ট ডিটেকশন জব। জিরো জিরো সেভেন।
কাকে?
–এক বড়লোকের লক্কা ছেলেকে।
বিশ্বাস ক্ষীণ একটু হাসল-চা খাবেন?
চা? বিশ্বাস, চায়ের কথা বলছেন? আপনাকে দেখেই একটা তেষ্টা পেয়েছিল, উবে গেল। অফ অল থিংস গরমের দুপুরে চা কেন?
–দি ওয়ার্ল্ড ইজ লস্ট ব্যানার্জি।
কী হয়েছে?
স্ট্রোক।
বিশ্বাস জোর করে চায়ের দোকানে নিয়ে গেল। বসল দুজন।
স্ট্রোক? মনোরম বলে।
স্ট্রোক।
ব্যাপারটা কী রকম হয় বিশ্বাস?
স্ট্যাবিং-এর মতো। বুকে। বিশ্বাস করবেন না। মনে হয় এতগুলো স্ট্যাবিং যদি বুকে হচ্ছেই, তবে মরছি না কেন?
হু?
–বিশ্বাস করবেন না। মৃত্যুযন্ত্রণা তবু মৃত্যু নয়। সে এক অদ্ভুত ব্যাপার। তার ওপর ডায়েবেটিসটাও ধরে ফেলল এই বয়সে। হাঁটাচলা ছিল না তো, কেবল গাড়ি দাবড়াতাম। ব্যানার্জি, আপনার সঙ্গে কথা আছে।
-শুনছি।
–আপনি একটা ওপেনিং চেয়েছিলেন। ম্যানেজারি করবেন?
ম্যানেজারি, বিশ্বাস? এ নিয়ে গোটা দুই করেছি, কোনওটাতেই সুবিধে করতে পারিনি। আপনারটা থার্ড অফার।
আমার ম্যানেজারিতে পারবেন। আমি বদ হলেও, কথা দিলে কথা রাখি।
টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন?
–জানেন তো ব্যানার্জি, আমার বিজনেস খুব ক্লিন নয়। কিছু গোস্ট মানি খেলা করে। কাজেই
কী?
–ওয়াচ ইয়োর স্টেপস।
–সেই রসিদের বিজনেসটাও কি এর মধ্যে?
এভরিথিং। আমার ব্যবসাগুলো ছোট, প্রত্যেকটার জন্য আলাদা ম্যানেজার রাখব কী করে? তবে টাকা দেব, ওভার অল প্রায় সাতশ। কিন্তু খুব সাবধানে হ্যাঁন্ডেল করবেন। কী, রাজি?
–দেখি।
–দেখি-টেখি নয়। আমি লোক খুঁজছি কতদিন ধরে। আজই কথা দিয়ে দিন।
বিশ্বাস, এখন আমি যে চাকরিটা করছি তাতে আমি টায়ার্ড, একটা অল্পবয়সি ছেলেকে দিনরাত চেজ করা, ওর মতো স্পিড আমার নেই, হাঁফিয়ে পড়ি।
–চেজ করেন কেন?
–ওয়াচ করার জন্য, যাতে সে বিপদে না পড়ে। বিপদ কিছু নেই, তবু তার বাবার ধারণা সে বিপদে পড়বেই। তাই।
–খুব ফাস্ট লাইফ লিড করে?
–খুব। আমার এমপ্লয়ারের সঙ্গে একটু কথা বলে নিই।
–আচ্ছা, কবে আসছেন?
–শিগগিরই।
–কিন্তু মনে রাখবেন, আমার ম্যানেজারি কিন্তু অন্ধকার জগতে। এভরিথিং ব্ল্যাক।
-জানি বিশ্বাস। চলি।
—শিগগিরই আসছেন?
হু।
মনোরম বিদায় নেয়।
.
আবার একদিন বীরুর পিছু নিয়ে সে এসে পড়ে সমীরের অফিসের সামনে। জোহানসন অ্যান্ড রোর সাদা সম্ভ্রান্ত অফিস বাড়িটা। বীরুকে কলকাতার ভিড়ে হারিয়ে যেতে দিয়ে মনোরম গাড়ি পার্ক করে। নামে। আঙুলে গাড়ির চাবিটা ঘোরাতে ঘোরাতে ঢুকে যায় ভিতরে।
সমীর ঠিক সেদিনের মতোই সুকুমার কোমল মুখশ্রী তুলে বলে–আরে মনোরম!
মনোরম হাসেকী খবর?
–তোমার খবর কী?
–একরকম।
–বোসো। চা খাও।
না। আমি কাজে আছি।
–বোসো, একটু কথা আছে।
কী?
–সীতার সঙ্গে আমার কিছু কথা হয়েছে।
–কীসের?
–তুমি তো জানই যে ও বিয়ে করছে।
আন্দাজ করেছিলাম। মানসকে?
–মানসকে। সীতা চাইছে তোমার বিজনেস-টিজনেস যা আছে ওর নামে, সব তোমাকে ফিরিয়ে দেয়।
–ফিরিয়ে দেবে? তবে নিল কেন?
–মানুষ তো ভুল করেই। ও বলছিল, এ সব যতদিন না ফেরত দিচ্ছে, ততদিন ও তোমাকে ভুলতে পারছে না। কাজেই তোমাকে ও অনুরোধ জানাচ্ছে, তুমি নাও। অভিমান কোরো না।
মাথাটা নিচু হয়ে আসে মনোরমের। সে কাঁচের নীচে সেই ছবিটা দেখতে পায়। নভূমি, তাতে শেষবেলার রাঙা রোদ, উপুড় হয়ে পড়ে আছে কয়েকটা গোরুর গাড়ি। আদিবাসী পুরুষ ও রমণীরা রাখছে।
সে মুখ তুলে বলল–এ সব জায়গায় আমি অনেকবার গেছি।
–কোন জায়গার কথা বলছ?
–এই যে ছবিতে। সাঁওতাল পরগনা, বিহার, উড়িষ্যায় এরকম সব অদ্ভুত বনে-জঙ্গলে আমি একসময়ে খুব ঘুরে বেড়াতাম।
সমীর করুণ চোখে চেয়ে থাকে।
-বিয়েটা কবে?
–ওরা খুব দেরি করবে না। মানস বোধহয় বদলি হয়ে যাচ্ছে আদ্রায়। বিয়ের পরেই সেখানে চলে যাবে। আমি সীতাকে কী বলব মনোরম? তুমি তো জানো, আমি কোনও ব্যাপারে নিজেকে জড়াই না। কিন্তু এ ব্যাপারটা নিয়ে সীতা এত কান্নাকাটি করেছিল যে, আমি কথা দিয়েছি তোমাকে কমিউনিকেট করব। তুমি না এলে আমিই যেতাম।
–কিছু ভাবিনি এখনও। দেখি।
–ও খুব শান্তিতে নেই।
মনোরম মনে মনে বলে যতদিন পৃথিবীতে কনভূমি থাকবে,নদীর জলে শব্দ হবে, তত দিন ভুলবে না। জ্বলবে।
বিদায় না নিয়েই একটু অন্যমনস্কভাবে বেরিয়ে এল মনোরম।
ট্রাম কোম্পানির বুথ থেকে টেলিফোন করল সীতার বাড়িতে। রিং-এর শব্দ হচ্ছে। খাসকষ্ট হতে থাকে মনোরমের। সীতা কি কথা বলবে তার সঙ্গে? এরকম ঘটনা ঘটবে কি?
মেয়েলি মিষ্টি গলায় ভেসে আসে হ্যালো।
সীতা! দম বন্ধ হয়ে আসে মনোরমের। বুকে উতরোল ঢেউ।
ধরুন, ডেকে দিচ্ছি।
একটু পরে সীতা বলল-হ্যালো।
মনোরম কিছু বলতে পারে না প্রথমে।
সীতার গলাটা হঠাৎ তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে–কে?
মনোরম চোখ বুজে, আস্তে আস্তে বলে যায়–মেরিলি র্যাং দ্য বেল, অ্যান্ড দে ওয়্যার ওয়েড…
কে? চিৎকার করে ওঠে সীতা!
মনোরম ফোন রেখে দেয়।
ডিভোর্সের পর এক বছর পূর্ণ হয়ে গেছে কবে! সময় কত তাড়াতাড়ি যায়।
.
সীতা সব ফিরিয়ে দিচ্ছে। খুশি হবারই কথা মনোরমের। মামার গাড়িটা নিয়ে বীরুকে তাড়া করতে করতে এক সময়ে ক্লান্তি লাগে তার। পিছু-নেওয়া ছেড়ে সে গাড়ি ঘুরিয়ে নেয় অন্য রাস্তায়। আপনমনে ঘুরে বেড়ায়।
ঘুরতে ঘুরতে একদিন সে এল চাঁদনি চকে। তার দোকানটা এখানেই। নেমে সে দোকানঘরে উঠে এল। মনোরমের আমলে সাকুল্যে চারজন কর্মচারী ছিল। এখন বেড়েছে। পুরনোর কেউ নেই। চমৎকার সানমাইকা লাগানো কাউন্টার, দেয়াল ডিসটেম্পার করা, ডিসপ্লে বোর্ড, কাঁচের আলমারি। সীতার দাদা ব্যবসা ভালই বোঝে। অনেকটা বড় হয়েছে দোকান। রমরম্ করে চলছে। ভাল জামাকাপড় পরা একজন অল্পবয়সি ছোকরা কাউন্টারের ওপর কনুইয়ের ভর রেখে কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মনোরমকে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললবলুন।
মনোরম গ্রাহ্য করল না। চারদিকে চেয়ে দোকানঘরটা দেখল। দোকানের নাম এখনও এস ব্যানার্জি প্রাইভেট লিমিটেড। সীতা এখনও ব্যানার্জি নামে সই করে। আপনমনে একটু হাসে মনোরম। কাউন্টারের ছেলেরা চেয়ে থাকে।
বাইরে একটা টেম্পো থেমেছে। কুলিরা মাল তুলে দিয়ে যাচ্ছে দোকানে। ছেলেটা ওপাশটায় গেল।
একা দাঁড়িয়ে থাকে মনোরম। এই দোকান-টোকান সবই সে উপহার দিয়েছিল সীতাকে। কিছু আয়কর ফাঁকি দিয়েছিল বটে, তবু তার ব্যবসাটা ছিল পরিষ্কার, দাগহীন এবং সৎ। এ সব আবার তাকে ফিরিয়ে দিলে সীতা তাকে ভুলে যেতে পারবে। পারবে কি?
কেন ভুলতে দেবে মনোরম? দেবে না। সে ফিরিয়ে নেবে না কিছুই। বিছানায় যখন মানস বুকে পড়বে সীতার ওপর, একদিন চুপি চুপি ঠিক মানসের শরীরে ভর করবে মনোরম। ভূতের মতো। থাক। মনোরম কিছুই ফিরিয়ে নেবে না। তার চেয়ে সে বিশ্বাসের অন্ধকার, বিপজ্জনক ব্যবসায় নেমে যাবে।
একটু দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর বেরিয়ে এসে গাড়ি ছাড়ে সে। মনটা হঠাৎ ভাল লাগে। আজ সে সম্পূর্ণ দাবি-দাওয়া ছেড়ে দিতে পারল।
সমীরকে ফোন করল সে।
-শুনুন, আমি বিজনেস ফেরত নেব না। কিছুই নেব না।
–কেন মনোরম?
-শুনুন, আপনি হয়তো ঠিক বুঝবেন না ব্যাপারটা। তবু বলছি। সীতা ব্যবসা কেড়ে নিয়ে আমার ক্ষতিই করতে চেয়েছিল। ম্যানেজারি থেকে বরখাস্ত করেছিল আমাকে। কিন্তু তাতে ক্ষতি কিছু হয়নি। আমি মরে যাইনি। সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটা মানুষের হয় তা টাকাপয়সার নয়, বিষয়-সম্পত্তিরও নয়। মানুষ হারায় তার সময়।
-কী বলছ, বুঝতে পারছি না।
–আমার হারিয়েছে, ক্ষতি হয়েছে কেবলমাত্র সময়ের। সীতা আমার বিজনেস ফিরিয়ে দিতে পারে, কিন্তু হারানো সময়টা কে ফিরিয়ে দেবে? এক বছরে আমার বয়স বেড়ে গেছে ঢের। কিছু শুরু করব আবার, তা হয় না। আমি পারব না। ওকে বলে দেবেন।
–তুমি আর একবার ভেবে দেখো।
–একবার কেন? আমি আরও বহুবার ভাবব, সারাজীবন ধরে। কিন্তু তাতে লাভ হবে না। আমি আমার এক বন্ধুর ব্যবসায়ে নামছি। ব্যবসা বন্ধুর, আমি সেখানে চাকরি করব। অ্যান্ড দ্যাটস অল।
ফোনটা করে খুবই শান্তি পায় মনোরম।
.
–তুই আমাকে ছেড়ে যেতে চাস ঝুমু? মামা একদিন ক্লান্ত বিষণ্ণ গলায় বলে। মামার রোগা চেহারাটা আরও একটু ভেঙে গেছে। চোখের নীচে মাকড়সার জালের মতো সূক্ষ্ম কালো রেখা সব ফুটে উঠেছে। সম্ভবত শিগগিরই আবার স্ট্রোক হবে মামার।
বীরুর সঙ্গে পাল্লা দিতে আমি কি পারি মামা? ওর কত কম বয়েস, কত স্পিড ওরা কত জায়গায় ছড়িয়ে আছে বরু! আমি কি পারি পাল্লা দিতে? আমার বয়সও হল।
কিন্তু তুই-ই বীরুকে ফেরাতে পারিস। আমি দেখেছি ও তোর সঙ্গে কথাটথা বলে, হাসে, ঠাট্টা করে। অবিশ্বাস্য। ও যে কারও সঙ্গে ভাল ব্যবহার করতে পারে তা জানতামই না। আমার বড় আশা ছিল, তুই কিছু একটা পারবি।
মনোরম একটু ভেবেচিন্তে বলে–মামা, বীরুর পিছু-নেওয়ার চাকরি একদিন তো শেষ হবেই। একদিন বীরু ঠিকই ব্যবসা-ট্যবসা বুঝে নেবে। তখন আমার চাকরিও শেষ হয়ে যাবে।
-না। তোকে আমি ম্যানেজার করব।
–কেন করবে? আমি যে কাঠের কিছুই জানি না। কিছুই শিখলাম না। বীরু মালিক হলে যে আমাকে রাখবে তারও কিছু ঠিক নেই। বয়সও হয়ে যাবে ততদিনে। পথ বন্ধ হয়ে যাবে সব। তার চেয়ে এখনই আমাকে ছেড়ে দাও।
–যেখানে যাচ্ছিস সেখানেও তো চাকরিই করবি।
–প্রথমে তাই কথা ছিল। পরে আমি কষাকষি করে আমাকে ওয়ার্কিং পার্টনার হিসেবে নিতে রাজি করিয়েছি। কমিশন পাব।
-কীরকম ব্যবসা?
–ব্ল্যাক। ভীষণ কালো। জাল-জোচ্চুরি-স্মাগলিং সবই আছে।
যাবি?
যাব না কেন? আমার এ বয়সে আর ভাল বা খারাপ কিছু হওয়ার নেই।
–যাবিই? বীরুর একটা কিছু ব্যবস্থা করে যা। ওকে ফেরা।
–কোথায় ফেরাব মামা? আমার তো ওকে কিছু শেখানোর নেই। ও আমার চেয়ে দশগুণ বেশি পড়াশুনো করেছে। অনেক বেশি বুদ্ধিমান। ভয়ংকর আত্মবিশ্বাসী। ওকে আমি কোথায় ফেরাব? ও আমাকে উড়িয়ে বেরিয়ে যাবে। বরং ও-ই আমাকে টেনে নিচ্ছে ওর দিকে। দেখো, এই বয়সে আমি লম্বা চুল আর জুলফি রাখছি, পরছি বেলবটমের সঙ্গে পাঞ্জাবি। আর কিছুদিন বীরুর পিছু নিলে আমিই বীরু হয়ে যাব।
–আর কিছুদিন থাক ঝুমু। আমার জন্যই থাক।
–আমার বাড়িভাড়াটা এখনও বাকি পড়ে আছে মামা।
–আজই নিয়ে যাস। ভূপতিকে বলে রাখছি। থাকবি? কিছুদিন?
–দেখি। বিশ্বাসকে একটা খবর দিয়ে দিতে হবে। ওরও স্ট্রোক, খুব ভেঙে পড়েছে। সময় দিতে চাইছে না।
–ওই বিপদের ব্যবসাতে কেন যাবি ঝুমু?
–কিছু তো করতেই হবে মামা। ওপনিং কোথায়? বাজার তো দেখছ! তা ছাড়া বিপদই বা কী, সবাই করছে।
মামা খুব গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আস্তে করে বলে–তোর সঙ্গে তো তেমন সম্পর্ক ছিল না আমার। আজকাল আত্মীয়তার গিট তো আলগা হয়েই যাচ্ছে। কিন্তু এ কদিনে তোর ওপর আমার মায়া পড়ে গেছে ঝুমু। তুই চলে যাবি ভাবলে বুকটা কেমন করে। আমি কেবল তোকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করলাম। তোর দিকটা ভাবিনি। ঝুমু, তোর জন্য কী করব বল তো?
কী করবে? আমার খুব অসময়ে তুমি আমার জন্য অনেক করেছ। ডোন্ট বি সেন্টিমেন্টাল।
–স্ট্রোক-ফোক হলে ওই সেন্টিমেন্টটা খুব বেড়ে যায়, জানিস? ভীষণ বেড়ে যায়। স্ট্রোক হচ্ছে গাড়ি ছাড়বার ফাস্ট ওয়ার্নিং, তখনই মানুষ গাড়ির জানালা দিয়ে ঝুঁকে পড়ে বেশি করে আত্মীয়দের মুখ দেখে নেয়।
-চুপ করো। বিরক্ত হয়ে মনোরম উঠে যায়। কাঠগোলার পিছনে একটু পরিষ্কার জায়গায় গিয়ে সিগারেট ধরায়। করাতকলের মিষ্টি ঘসটানো শব্দটা আসে।
.
বর্ষা যায়। শরৎ যায়। শীত আসি-আসি করে। বিশ্বাস ফোনে তার ফিসফিস স্বরে বলে–ব্যানার্জি, আর কত সময় নেবেন? আমি আর পারছি না।
আর কটা দিন, বিশ্বাস। মনোরম বলে–আর একটু সময় দিন।
সময় কে কাকে দেয় মশাই! সময়ের কি ট্রানজাকশন হয়? সময় ফুরোয়। ব্যানার্জি, একটা ফাইনাল কিছু বলুন। অন্য লোক নিতে ভরসা হয় না। এ ব্যবসাতে ফেইথফুল তোক না হলে..আমি আর কত অপেক্ষা করব ব্যানার্জি? টেল সামথিং।
একটু, আর একটু…
.
আজকাল প্রায় একটা জিনিস লক্ষ করে মনোরম। বীরু মাঝে মাঝে তার ফিয়াট দাঁড় করায় ওষুধের দোকানের সামনে। কী যেন কিনে আনে, তারপর আবার গাড়ি ছাড়ে। প্রায় দিনই, প্রতিদিনই বীরু আজকাল কাটা করে।
কী কেনে ও? ঘুমের ওষুধ নয় তো!
মনোরম সতর্ক হতে থাকে। একদিন বীরু ওষুধের দোকান থেকে বেরিয়ে গাড়ি ছাড়ল। মনোরম গাড়ি থেকে নেমে ঢুকল দোকানটায়।
একটু আগে যে লম্বা ছেলেটা এসেছিল, ও কিছু কিনল?
কাউন্টারের আধবুড়ো লোকটা কাগজ পড়ছিল। মুখ তুলে একটু বিস্ময়ভরে বলে।
কী?
–অনেকগুলো ট্রাংকুলাইজার, কয়েকটা ঘুমের ওষুধ, নিউরোসিসের জন্য কয়েক রকমের বড়ি।
প্রেসক্রিপশন?
–ছিল না। এ সব কিনতে আজকাল আর প্রেসক্রিপশন লাগে না। সবাই নিজের নিজের ডাক্তার।
অসুখটা কী?
লোকটা মাথা নাড়ল–কে জানে মশাই! জিজ্ঞেস করছেন কেন?
কারণ আছে। ও একটু ডিসব্যালান্সড।
লোকটা নিজের নাকটা মুঠোয় ধরে বলল–এ সব ড্রাগই আজকাল মুড়িমুড়কির মতো বিক্রি হচ্ছে। রোগটা বোধহয় পাগলামি। দেশে পাগল বাড়ছে।
মনোরম বেরিয়ে আসে। আকাশ ভরা রোদ। এখন হেমন্তকাল। কলকাতা এখন পাখির বুকের মতো কবোষ্ণ। গাড়ি চালিয়ে চালিয়ে তার কাঁধে ব্যথা, কোমর ধরে আছে, মাথা ভার। হেমন্তের সুন্দর আলোতে কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় একটু হেঁটে বেড়াতে পারলে বেশ হত। কিন্তু জগদ্দল গাড়িটা রয়েছে সঙ্গে আর সামনে উধাও বীরু।
ক্লান্তভাবে আবার গাড়িতে ওঠে সে। ছাড়ে। ক্লান্তিহীন বীরু কি ধরা পড়ল বয়সের হাতে? নাকি অসুখ? কিংবা কর্মফল? ওষুধ কিনছে। পাগলামির ওষুধ, নার্ভের ওষুধ, ঘুমের ওষুধ! বড় অবাক কাণ্ড। মনোরমের ভ্রূ কুঁচকে যায়। চিন্তিতভাবে সে চেয়ে থাকে সামনের রাস্তায়। চলন্ত গাড়িটা গিলে ফেলছে রাস্তাকে।
.
রাতে খুব জ্যোৎস্না ফুটেছে আজ। সেটা টের পাওয়ার কথা নয়। বীরুর পিছু পিছু অনেক রাত পর্যন্ত ধাওয়া করে করে অবশেষে প্রায় রাত সাড়ে বারোটায় বীরুর গাড়ি ঢুকল রিচি রোডে। তখন লোডশেডিং। সেই অন্ধকারে হঠাৎ বানডাকা জ্যোৎস্না দেখতে পেল মনোরম।
অ্যাপার্টমেন্টের সামনে বীরু গাড়ি দাঁড় করাল না আজ। একটু এগিয়ে গেল। বাঁ ধারে একটা মস্ত ফাঁকা পার্ক। হিম পড়েছে। কেউ কোথাও নেই। বীরু নামল। দুধের মতো সাদা পোশাক পরেছে বীরু। সাদা ঢিলে বুশশার্ট, সাদা প্যান্ট, সাদা জুতো। জ্যোৎস্নায় ওর লম্বা, সাদা অবয়বটা অপ্রাকৃত দেখায়।
গাড়ি ফেলে রেখে বীরু লম্বা পায়ে রেলিং ডিঙিয়ে পার্কে ঢুকল। খুব ধীরে হাঁটছে। মাঠের মাঝখানে চলে গেল। দাঁড়াল। আড়মোড়া ভাঙছে। স্লো-মোশন ছবির মতো নড়াচড়া করছে। জ্যোৎস্নায় এবং কুয়াশায় একটু আবছা। গাড়ির অন্ধকারে বসে মনোরম দেখতে থাকে। বীরু এক-পা এক-পা করে দৌড়ে ক্রিকেটের বোলারের মতো হাত ঘোরাল। ব্যাটসম্যানের মতো মারল বল। দু পায়ে একটি জটিল দ্রুত নাচ নেচেই থেমে যায়। ডিসকাস ছোঁড়ার ভঙ্গি করে। তারপর ধীরে, খুব ধীরে হাঁটে, ঠিক যেমন চাঁদের মাটিতে নীল আর্মস্ট্রং হেঁটেছিল। ঘুরে দাঁড়ায় আবার। স্পষ্ট দেখা যায় না, কিন্তু মনে হয় যেন চেয়ে আছে মনোরমের গাড়ির দিকেই। দেখছে।
মনোরম গাড়ির দরজা খুলে নামল। গরম জামা পরেনি, একটু শীত করে। রেলিংটা টপকায় মনোরম। হাঁটতে থাকে। কী জ্যোৎস্না, কী জ্যোৎস্না! নীলাভ হলুদ কুয়াশায় মাখা স্বপ্নের আলো। সেই আলোতে ভিন্ন গ্রহ থেকে আসা অপরিচিত মানুষের মতো লম্বা সাদা অবয়ব বীরুর। স্থির দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে মহাকাশের সাদা পোশাক।
বীরু।
–এসো। ভাবছিলাম, তোমাকে ডাকব।
–তুই জানিস যে আমি তোর পিছু নিই?
আগে জানতাম না। কদিন হয় জানি। জেনেও প্রথম ভেবেছিলাম অচেনা কেউ চেজ করছে। তাই একটু চমকে গিয়েছিলাম। তারপর লক্ষ করলাম, তুমি।
–আমার দোষ নেই। মামার অর্ডার।
–বাবা কিছু জানতে চায়?
চায়।
আমাকে জিজ্ঞেস করলেই বলে দিতাম। এত কষ্ট করতে হত না তোমাকে।
কষ্ট কী? এটাই আমার চাকরি।
বুঝতে পারছি। তোমার জন্য কষ্ট হয়।
মামা যেদিন তোর সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হবে, সেদিন আমার এ চাকরিটা শেষ হবে। তখন হয়তো আমি কাঠগোলার ম্যানেজারি পাব। নয়তো একটা বাজে, বিপজ্জনক অসৎ ব্যবসাতে নেমে যাব। ও দুটো চাকরির চেয়ে এটা বোধ হয় একটু বেটার ছিল। তবে ক্লান্তিকর। তুই বড্ড স্পিডি।
বীরু তেমনি ধীর ভঙ্গিতে একটু হাঁটছে এদিক ওদিক। অদ্ভুত প্রাকৃতিক আলোতে ও হাঁটছে বলে মনে হয় না। যেন একটু জমাট, লম্বাটে একটা কুয়াশায় তৈরি ভৌতিক মূর্তি দুলে দুলে যাচ্ছে।
বাবা কোনওদিনই আমার সব জানতে পারবে না।
–সেটা মামা স্বীকার করে না। কিন্তু বোঝে। তাই আমাকে লাগিয়েছে মামা। তার বিশ্বাস, আমি তোমাকে বুঝব। তোর পিছু নিয়ে নিয়ে আমি এখন পাক্কা জেমস বন্ড হয়ে গেছি।
বীরু হাসল। মসৃণ কামানো গালে জ্যোৎস্না ঝিকিয়ে ওঠে একটু।
–তুমি কী বুঝলে? শান্ত স্বরে জিগ্যেস করে বীরু।
–কিছু না।
–কী বুঝতে চাও?
–তুই ওষুধ কিনছিস কেন? ও সব ওষুধ প্রেসক্রিপশন ছাড়া খাওয়া খুব ডেঞ্জারাস।
আজকাল সব ওষুধের পোটেন্সি এত কমিয়ে দেয় ওরা যে কাজ হয় না।
ধীরে ধীরে হেঁটে বীরু একটু দুরে যায়। আবার দুলে দুলে কাছে আসে। মনোরমের ভয় হয়, বুঝি বীরু জ্যোৎস্না আর কুয়াশায় হঠাৎ মিলিয়ে যাবে।
বিয়ে করবি না বীরু?
—করব হয়তো কখনও।
–গৌরীকে করিস।
বীরু হাসল। বলল–তুমিই গৌরীর প্রেমে পড়ে গেছ।
-বোধহয়। তুই বলেছিলি কষ্ট হওয়াকেই ভালবাসা বলে। আমারও কষ্ট হয় ওই মেয়েটার জন্য।
–বিয়ে করে কী হবে?
–আমি তোর অনেক কিছু নকল করেছি বীরু। পোশাক, চুল, জুলফি, গাড়ির স্পিড। তোর পিছু নিয়ে নিয়ে তোর কাছে শিখেছি অনেক। কেবল তোর জুয়েলটিটা শিখতে পারছি না। তুই এ মেয়েটাকে ভাল না বেসে পারিস কী করে?
টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে আকাশে তাকিয়ে থাকে বীরু। প্যান্টের পকেটে দুই হাত। একটুক্ষণ স্থির থাকে।
–আমি খুব নিষ্ঠুর?
–মনে হয়।
–ইদানীং আমি খুব নেশা করছি। গাঁজা, আফিং, এল-এস-ডি, কিছু বাকি নেই। কিছু হয় না তাতে।
–কেন করছিস?
টু ফরগেট সামথিং।
–কী?
–তুমি আমাকে নিষ্ঠুর বলছ? কেন? তুমি আমার কতটুকু জানো?
–কিছুই না। বীরু, আমার মনে হচ্ছে দিনে দিনে তুই আমার আরও অচেনা হয়ে যাচ্ছিস। এখনই তোকে আমার পৃথিবীর মানুষ বলে মনে হচ্ছে না, যেন বা তুই অন্য গ্রহের লোক। আমি তোর মতো হার্টলেস হতে চাই। আমাকে শিখিয়ে দে।
বীরু হাসে। যথারীতি কোমল জ্যোৎস্নার লাবণ্য ওর কেঠো মসৃণ গালে এক ফোঁটা মোমের মত ঝরে পড়ল। বলল-কেন হার্টলেস হতে চাও?
মনোরম বলে–আমরা কোনও মেয়ের সঙ্গে প্রেম করলে পাগল হতাম। এখনও দ্যাখ, বউয়ের দুঃখ ভুলতে পারি না। তুই কত মেয়েকে ভুলে যাস, আমি একজনকেই পারি না।
–আমি একটা জিনিস ভুলতে পারছি না।
–কী?
যাদবপুর রেল স্টেশনে এক বান্ধবীকে তুলতে গিয়েছিলাম গাড়িতে, ট্রেনের দেরি ছিল, কথা বলছিলাম দুজনে। ভালবাসার কথা। নকল কথা সব। লাইক কসমেটিকস। ঘুরতে ঘুরতে স্টেশনের একদিকে শেড-এর তলায় গেছি, বান্ধবীটি হঠাৎ দুপা সরে এসে বলল-মাগো, ওটা কী? দেখলাম, একটা বাচ্চা ছেলে শুয়ে আছে ভিখিরিদের বিছানায়। এত রোগা যে ভাল করে না নজর করলে দেখাই। যায় না। ঠিক কাঁকড়ার দাঁড়ার মতো দুখানা হাত নোংরা কাঁথার তূপ থেকে শূন্যে উঠে একটু নড়ছে, অবিকল সেইরকমই দুখানা পা। এত নির্জীব যে খুব ধীরে ধীরে একটু একটু নড়ে, আবার কাঁথায় লুকোয়। তার গায়ের চামড়া আশি-নব্বই বছরের বুড়োর মতো কোঁচকানো, দুলদুল করছে। হিউম্যান ফর্ম, কিন্তু কী করে বেঁচে আছে বোঝা মুশকিল। চমকে যাই যখন দেখি, তার উরুর ফাঁকে রয়েছে। পিউবিক হেয়ার, পুরুষাঙ্গ। বাচ্চা ছেলের তো পিউবিক হেয়ার থাকার কথা নয়। একটা উলোঙ্কুলো বুড়ি বসে উকুন মারছিল, সে নিজে থেকেই ডেকে বলল–ষোলোবছর বয়স বাবু, রোগে ভুগে ওই দশা। ছেলেবেলা থেকেই বাড়ন নেই।–কিছুই না ব্যাপারটা, কিন্তু সেই থেকে ভুলতে পারি না।
–কেন বীরু?
-কী জানি! কলকাতায় ভিখিরি-টিকিরি তো কত দেখেছি! কত কুঠে, আধমরা, ডিফর্মড। কিন্তু এটা কিছুতেই ভুলতে পারি না। হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে, চমকে উঠি। পিউবিক হেয়ার সমেত একটা বাচ্চা তার কাঁকড়ার মতো হাত পা নাড়ছে। ভীষণ ভয় করে। যত দিন যাচ্ছে, তত সেঁটে বসে যাচ্ছে ছবিটা মনের মধ্যে। কী যে করি!
মনোরম কী বলবে! চুপ করে থাকে।
বীরু মহাকাশচারীর মতোই চাঁদের মাটিতে হাঁটে। ভ্রূ কুঁচকে বলে–বুদ্ধদেব যেন কী কী দেখেছিল? বার্ধক্য, রোগ, মৃত্যু আর সন্ন্যাস, না?
–বোধহয়।
–পিউবিক হেয়ার সমেত বাচ্চা ছেলের ফর্ম দেখলে বুদ্ধদেব কী করত বলো তো?
কী জানি!
–পাগল হয়ে যেত। কিন্তু আমি কী করি? কী করি বলো তো?
–কী করবি?
–ভাবছি। আস্তে আস্তে অপ্রাকৃত চাঁদের আলোয় ঘুরে বেড়ায় সাদা দীর্ঘ অবয়ব। আস্তে করে বলে–নিষ্ঠুর নই, বুঝেছ? বাড়ি যাও।
-কেন?
–আমি একটু একা থাকি।
পকেটে হাত, চিন্তিত মুখটা নোয়ানো, বীরু আস্তে আস্তে কুয়াশার শরীর নিয়ে ঘোরে। গাড়িতে স্টার্ট দেওয়ার সময়ে দূর থেকে দৃশ্যটা অস্পষ্ট দেখে মনোরম।
০৫.
ঝুমু, তুই বাসাটা ছেড়ে দে। আমার বাড়িতে চলে আয়। যা বাকি বকেয়া পড়েছে তা আমি দিয়ে দেব।
-কেন?
ওয়াচ হিম। ওয়াচ হিজ স্টেপস।
–কোনও লাভ নেই।
কেন?
–ওর ভিতরে কিছু সাহেবি ব্যাপার ঢুকে গেছে।
–সেটা কী?
–সব বুঝবার তোমার দরকার কী?
আমার ছেলে, আর আমার বুঝবার দরকার নেই?
–জেনারেশন গ্যাপ বোঝো?
বুঝব না কেন? বুঝি কিন্তু মানি না। ও সব বানানো কথা।
হবে।
ঝুমু, আমার কেবলই মনে হয় ও শিগগিরই নিজেকে শেষ করবে।
মনোরম চুপ করে থাকে।
তুই সব সময়ে আমার আর ওর কাছাকাছি থাক ঝুমু।
–মানুষ তো আমি একটা, দুজনের কাছে থাকব কী করে?
সময় ভাগ করে নে। না, বরং তুই ওর কাছে কাছেই থাক। ওরই বিপদ বেশি।
–এ কথা বলছ কেন? কীসের বিপদ?
ও তো কিছু বলে না, কিন্তু মনে হয়, ও একটা প্রবলেমের মধ্যে আছে।
–প্রবলেমের মধ্যে সবাই থাকে।
-কিন্তু বীরুর তো প্রবলেমের কোনও কারণ নেই। ভেবে পাই না, ওর প্রবলেমের কী থাকতে পারে। তাই মনে হয়, ওর বড় বিপদ।
বিপদ? না কিছুই খুঁজে পায় না, ভেবে পায় না মনোরম। ও খারাপ মেয়েমানুষের কাছে যায় না যে রোগ নিয়ে আসবে। ওর মেয়েবন্ধুরা অভিজাত পরিবারের। অবৈধ সন্তানের ভয় নেই, খোলা বাজারে বিক্রি হয় কন্ট্রাসেপটিভ। ওর প্রেমের কোনও ঝামেলা নেই, কারণ ঘুমের সময়ে ওর কারও মুখ মনে পড়ে না। জুয়ায় অনেক টাকা হেরে গেলেও ওর অনেক থাকবে।
প্রবলেমটা খুঁজে পায় না বটে মনোরম, কিন্তু খুঁজে ফেরে। দিশি গাড়িটা নিয়ে সে ক্লান্তিহীন ছোটে বীর পিছনে। বীরু মুহুর্মুহু পোশাক কেনে, কেনে গ্রামোফোনের উত্তেজক ডিস্ক, ভাল হোটেলে খায়, নাচে, খেলে বেড়ায় বড় ছোট ক্লাবে, সাঁতরায়, মেয়েদের নিয়ে যায় অ্যাপার্টমেন্টে, মনোরম সারা কলকাতা বীরুর ফিয়াটটাকে তাড়া করে ফেরে। বীরু বিতর্কসভায় বক্তৃতা করে, ভিয়েতনামে মার্কিন বোমারু বিমানের কাণ্ডকারখানার হুবহু বর্ণনা দেয়, লাইফ ম্যাগাজিনের পাতা খুলে জনসাধারণকে দেখায় নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মর্মন্তুদ ছবি। কিন্তু কোথাও থেমে নেই বীরু। চলছে। চলবে।
অনেক রাতে যখন বাসায় ফেরে মনোরম, তখন ক্লান্ত লাগে। বড় ক্লান্ত লাগে। রাতে সে প্রায় কিছুই খায় না। দুধে পাউরুটি ভিজিয়ে বিস্বাদ দলাগুলি গিলে ফেলে। দু ঘরেই জ্বেলে দেয় টিউবলাইটগুলি। তারপর সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খায়। মাঝে মাঝে ওপরের দিকে চেয়ে দেখে।
কী দেখে মনোরম? দেখে নীলচে স্বপ্নের আলো। জানালার বুটিদার পর্দাগুলি উড়ছে বাতাসে। ঠিক মনে হয়, ঘরের ভিতরে রয়েছে তার প্রিয় মেয়েমানুষটি। সে কে? রিনা? চপলা? না কি এক প্রাণহীন মেমসাহেব-পুতুল প্রাণ পেয়ে ঘুরছে তার শূন্য ঘরে? সীতা নয় তো?
রক্তমাংসময় একজনকেই পেয়েছিল মনোরম। সীতা। যতক্ষণ সিগারেট না শেষ হয়, ততক্ষণ রাস্তায় পায়চারি করে সে। কখনও দুটো-তিনটে সিগারেট ফুরিয়ে যায়। হাঁটতে হাঁটতে কথা বলে মনোরম। কাল্পনিক কথা, এক কাল্পনিক স্ত্রীর সঙ্গে। মাঝে মাঝে হাঁটতে হাঁটতে থেমে যায়। কল্পনাটা এমনই সত্যের মতো জোরালো হয়ে ওঠে যে তার ইডিও-মোটর অ্যাকশন হতে থাকে। গভীর রাতে নির্জন পূর্ণদাস রোডে কেউ তার সেই মূকাভিনয় দেখে না। দেখলে তারা দেখত, একজন প্রেমিক কেমন তার শূন্যনির্মিত নায়িকার সঙ্গে অবিকল আসল মানুষের মতো প্রেম করে।
রাত গম্ভীর হলে সে তার ছয় বাই সাত খাটে গিয়ে শোয়। মস্ত খাট। বিছানাটা একটু স্যাঁতসেঁতে। ফুটপাথ থেকে দুটাকা জমা রেখে আট আনা ভাড়ায় আনা ডিটেকটিভ বই খুলে বসে। হাই ওঠে। জল। খায়। টেবিল ল্যাম্প নেবায়। শেষ সিগারেটটাকে পিষে মারে মেঝের ওপর। তারপর ঘুমোবার জন্য চোখ বোজে।
অমনি কল্পনায় ভিন্ন পৃথিবী জেগে উঠতে থাকে। শরীরের ভিতরে নিকষ কালো অন্ধকারে জ্বলে ওঠে নীল লাল স্বপ্নের আলো। অবিকল এক জনহীন প্রেক্ষাগৃহ। আসবাব টানাটানি করে কারা পর্দার ওপাশে মঞ্চে দৃশ্যপট সাজাচ্ছে। পরদা সরে যায়। দীর্ঘ পৈঠার মতো ইস্কুলবাড়ির কয়েক ধাপ সিঁড়ি। তাতে তিনশো ছেলে দাঁড়িয়ে গায়-জয় জগদীশ হরে…
শূন্য বিছানায় তার প্রসারিত হাতখানা পড়ে থাকে। কিছুই স্পর্শ করে না।
সকাল দশটা থেকে কাঠগোলা। মাঝখানে একটু লাঞ্চ ব্রেক। মামাবাড়ি থেকে ভাত আসে। মামা-ভাগ্নে খায়। খেতে খেতে মামা বলে-ঝুমু, ওয়াচ হিম।
আজকাল বাঙালির কথা মামা ভুলে যাচ্ছে। নেতাজির কথাও। নিরুদ্দেশ সেই মানুষটির জন্য আর অপেক্ষা করতে ভয় পায় মামা। ফার্স্ট স্ট্রোক হয়ে গেছে। বীরু থেকে যাচ্ছে বিপদসঙ্কুল পৃথিবীতে।
ফিস ফিস্ করে একটা লোক কানের কাছে বলে ব্যানার্জি না?
তখন বীরু তার গাড়িটা রেখে দ্রুতবেগে ঢুকে যাচ্ছে স্টক এক্সচেঞ্জে। অনুসরণ করতে করতে বাধা পেয়ে মনোরম থেমে ফিরে তাকায়। চিনতে পারে না। মস্ত একটা কাঠামোয় নড়বড় করে দুলেদুলে মাংস আর চামড়ায়। চোখের নীচে কালি। ক্লান্ত মানুষ একটা।
টেলিফোনে যেমন শোনা যায় মানুষের গলা, তেমনি, ফিসফিসিয়ে বলে–বিসোয়াস্ হিয়ার।
–বিশ্বাস! কী হয়েছে, চেনা যায় না?
বলছি। খুব ব্যস্ত?
মনোরম মুখটা একটু বাঁকা করে হাসে–না। জাস্ট একজনকে চেজ করছিলাম।
–চেজ?
–অলমোস্ট ডিটেকশন জব। জিরো জিরো সেভেন।
কাকে?
–এক বড়লোকের লক্কা ছেলেকে।
বিশ্বাস ক্ষীণ একটু হাসল-চা খাবেন?
চা? বিশ্বাস, চায়ের কথা বলছেন? আপনাকে দেখেই একটা তেষ্টা পেয়েছিল, উবে গেল। অফ অল থিংস গরমের দুপুরে চা কেন?
–দি ওয়ার্ল্ড ইজ লস্ট ব্যানার্জি।
কী হয়েছে?
স্ট্রোক।
বিশ্বাস জোর করে চায়ের দোকানে নিয়ে গেল। বসল দুজন।
স্ট্রোক? মনোরম বলে।
স্ট্রোক।
ব্যাপারটা কী রকম হয় বিশ্বাস?
স্ট্যাবিং-এর মতো। বুকে। বিশ্বাস করবেন না। মনে হয় এতগুলো স্ট্যাবিং যদি বুকে হচ্ছেই, তবে মরছি না কেন?
হু?
–বিশ্বাস করবেন না। মৃত্যুযন্ত্রণা তবু মৃত্যু নয়। সে এক অদ্ভুত ব্যাপার। তার ওপর ডায়েবেটিসটাও ধরে ফেলল এই বয়সে। হাঁটাচলা ছিল না তো, কেবল গাড়ি দাবড়াতাম। ব্যানার্জি, আপনার সঙ্গে কথা আছে।
-শুনছি।
–আপনি একটা ওপেনিং চেয়েছিলেন। ম্যানেজারি করবেন?
ম্যানেজারি, বিশ্বাস? এ নিয়ে গোটা দুই করেছি, কোনওটাতেই সুবিধে করতে পারিনি। আপনারটা থার্ড অফার।
আমার ম্যানেজারিতে পারবেন। আমি বদ হলেও, কথা দিলে কথা রাখি।
টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন?
–জানেন তো ব্যানার্জি, আমার বিজনেস খুব ক্লিন নয়। কিছু গোস্ট মানি খেলা করে। কাজেই
কী?
–ওয়াচ ইয়োর স্টেপস।
–সেই রসিদের বিজনেসটাও কি এর মধ্যে?
এভরিথিং। আমার ব্যবসাগুলো ছোট, প্রত্যেকটার জন্য আলাদা ম্যানেজার রাখব কী করে? তবে টাকা দেব, ওভার অল প্রায় সাতশ। কিন্তু খুব সাবধানে হ্যাঁন্ডেল করবেন। কী, রাজি?
–দেখি।
–দেখি-টেখি নয়। আমি লোক খুঁজছি কতদিন ধরে। আজই কথা দিয়ে দিন।
বিশ্বাস, এখন আমি যে চাকরিটা করছি তাতে আমি টায়ার্ড, একটা অল্পবয়সি ছেলেকে দিনরাত চেজ করা, ওর মতো স্পিড আমার নেই, হাঁফিয়ে পড়ি।
–চেজ করেন কেন?
–ওয়াচ করার জন্য, যাতে সে বিপদে না পড়ে। বিপদ কিছু নেই, তবু তার বাবার ধারণা সে বিপদে পড়বেই। তাই।
–খুব ফাস্ট লাইফ লিড করে?
–খুব। আমার এমপ্লয়ারের সঙ্গে একটু কথা বলে নিই।
–আচ্ছা, কবে আসছেন?
–শিগগিরই।
–কিন্তু মনে রাখবেন, আমার ম্যানেজারি কিন্তু অন্ধকার জগতে। এভরিথিং ব্ল্যাক।
-জানি বিশ্বাস। চলি।
—শিগগিরই আসছেন?
হু।
মনোরম বিদায় নেয়।
.
আবার একদিন বীরুর পিছু নিয়ে সে এসে পড়ে সমীরের অফিসের সামনে। জোহানসন অ্যান্ড রোর সাদা সম্ভ্রান্ত অফিস বাড়িটা। বীরুকে কলকাতার ভিড়ে হারিয়ে যেতে দিয়ে মনোরম গাড়ি পার্ক করে। নামে। আঙুলে গাড়ির চাবিটা ঘোরাতে ঘোরাতে ঢুকে যায় ভিতরে।
সমীর ঠিক সেদিনের মতোই সুকুমার কোমল মুখশ্রী তুলে বলে–আরে মনোরম!
মনোরম হাসেকী খবর?
–তোমার খবর কী?
–একরকম।
–বোসো। চা খাও।
না। আমি কাজে আছি।
–বোসো, একটু কথা আছে।
কী?
–সীতার সঙ্গে আমার কিছু কথা হয়েছে।
–কীসের?
–তুমি তো জানই যে ও বিয়ে করছে।
আন্দাজ করেছিলাম। মানসকে?
–মানসকে। সীতা চাইছে তোমার বিজনেস-টিজনেস যা আছে ওর নামে, সব তোমাকে ফিরিয়ে দেয়।
–ফিরিয়ে দেবে? তবে নিল কেন?
–মানুষ তো ভুল করেই। ও বলছিল, এ সব যতদিন না ফেরত দিচ্ছে, ততদিন ও তোমাকে ভুলতে পারছে না। কাজেই তোমাকে ও অনুরোধ জানাচ্ছে, তুমি নাও। অভিমান কোরো না।
মাথাটা নিচু হয়ে আসে মনোরমের। সে কাঁচের নীচে সেই ছবিটা দেখতে পায়। নভূমি, তাতে শেষবেলার রাঙা রোদ, উপুড় হয়ে পড়ে আছে কয়েকটা গোরুর গাড়ি। আদিবাসী পুরুষ ও রমণীরা রাখছে।
সে মুখ তুলে বলল–এ সব জায়গায় আমি অনেকবার গেছি।
–কোন জায়গার কথা বলছ?
–এই যে ছবিতে। সাঁওতাল পরগনা, বিহার, উড়িষ্যায় এরকম সব অদ্ভুত বনে-জঙ্গলে আমি একসময়ে খুব ঘুরে বেড়াতাম।
সমীর করুণ চোখে চেয়ে থাকে।
-বিয়েটা কবে?
–ওরা খুব দেরি করবে না। মানস বোধহয় বদলি হয়ে যাচ্ছে আদ্রায়। বিয়ের পরেই সেখানে চলে যাবে। আমি সীতাকে কী বলব মনোরম? তুমি তো জানো, আমি কোনও ব্যাপারে নিজেকে জড়াই না। কিন্তু এ ব্যাপারটা নিয়ে সীতা এত কান্নাকাটি করেছিল যে, আমি কথা দিয়েছি তোমাকে কমিউনিকেট করব। তুমি না এলে আমিই যেতাম।
–কিছু ভাবিনি এখনও। দেখি।
–ও খুব শান্তিতে নেই।
মনোরম মনে মনে বলে যতদিন পৃথিবীতে কনভূমি থাকবে,নদীর জলে শব্দ হবে, তত দিন ভুলবে না। জ্বলবে।
বিদায় না নিয়েই একটু অন্যমনস্কভাবে বেরিয়ে এল মনোরম।
ট্রাম কোম্পানির বুথ থেকে টেলিফোন করল সীতার বাড়িতে। রিং-এর শব্দ হচ্ছে। খাসকষ্ট হতে থাকে মনোরমের। সীতা কি কথা বলবে তার সঙ্গে? এরকম ঘটনা ঘটবে কি?
মেয়েলি মিষ্টি গলায় ভেসে আসে হ্যালো।
সীতা! দম বন্ধ হয়ে আসে মনোরমের। বুকে উতরোল ঢেউ।
ধরুন, ডেকে দিচ্ছি।
একটু পরে সীতা বলল-হ্যালো।
মনোরম কিছু বলতে পারে না প্রথমে।
সীতার গলাটা হঠাৎ তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে–কে?
মনোরম চোখ বুজে, আস্তে আস্তে বলে যায়–মেরিলি র্যাং দ্য বেল, অ্যান্ড দে ওয়্যার ওয়েড…
কে? চিৎকার করে ওঠে সীতা!
মনোরম ফোন রেখে দেয়।
ডিভোর্সের পর এক বছর পূর্ণ হয়ে গেছে কবে! সময় কত তাড়াতাড়ি যায়।
.
সীতা সব ফিরিয়ে দিচ্ছে। খুশি হবারই কথা মনোরমের। মামার গাড়িটা নিয়ে বীরুকে তাড়া করতে করতে এক সময়ে ক্লান্তি লাগে তার। পিছু-নেওয়া ছেড়ে সে গাড়ি ঘুরিয়ে নেয় অন্য রাস্তায়। আপনমনে ঘুরে বেড়ায়।
ঘুরতে ঘুরতে একদিন সে এল চাঁদনি চকে। তার দোকানটা এখানেই। নেমে সে দোকানঘরে উঠে এল। মনোরমের আমলে সাকুল্যে চারজন কর্মচারী ছিল। এখন বেড়েছে। পুরনোর কেউ নেই। চমৎকার সানমাইকা লাগানো কাউন্টার, দেয়াল ডিসটেম্পার করা, ডিসপ্লে বোর্ড, কাঁচের আলমারি। সীতার দাদা ব্যবসা ভালই বোঝে। অনেকটা বড় হয়েছে দোকান। রমরম্ করে চলছে। ভাল জামাকাপড় পরা একজন অল্পবয়সি ছোকরা কাউন্টারের ওপর কনুইয়ের ভর রেখে কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মনোরমকে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললবলুন।
মনোরম গ্রাহ্য করল না। চারদিকে চেয়ে দোকানঘরটা দেখল। দোকানের নাম এখনও এস ব্যানার্জি প্রাইভেট লিমিটেড। সীতা এখনও ব্যানার্জি নামে সই করে। আপনমনে একটু হাসে মনোরম। কাউন্টারের ছেলেরা চেয়ে থাকে।
বাইরে একটা টেম্পো থেমেছে। কুলিরা মাল তুলে দিয়ে যাচ্ছে দোকানে। ছেলেটা ওপাশটায় গেল।
একা দাঁড়িয়ে থাকে মনোরম। এই দোকান-টোকান সবই সে উপহার দিয়েছিল সীতাকে। কিছু আয়কর ফাঁকি দিয়েছিল বটে, তবু তার ব্যবসাটা ছিল পরিষ্কার, দাগহীন এবং সৎ। এ সব আবার তাকে ফিরিয়ে দিলে সীতা তাকে ভুলে যেতে পারবে। পারবে কি?
কেন ভুলতে দেবে মনোরম? দেবে না। সে ফিরিয়ে নেবে না কিছুই। বিছানায় যখন মানস বুকে পড়বে সীতার ওপর, একদিন চুপি চুপি ঠিক মানসের শরীরে ভর করবে মনোরম। ভূতের মতো। থাক। মনোরম কিছুই ফিরিয়ে নেবে না। তার চেয়ে সে বিশ্বাসের অন্ধকার, বিপজ্জনক ব্যবসায় নেমে যাবে।
একটু দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর বেরিয়ে এসে গাড়ি ছাড়ে সে। মনটা হঠাৎ ভাল লাগে। আজ সে সম্পূর্ণ দাবি-দাওয়া ছেড়ে দিতে পারল।
সমীরকে ফোন করল সে।
-শুনুন, আমি বিজনেস ফেরত নেব না। কিছুই নেব না।
–কেন মনোরম?
-শুনুন, আপনি হয়তো ঠিক বুঝবেন না ব্যাপারটা। তবু বলছি। সীতা ব্যবসা কেড়ে নিয়ে আমার ক্ষতিই করতে চেয়েছিল। ম্যানেজারি থেকে বরখাস্ত করেছিল আমাকে। কিন্তু তাতে ক্ষতি কিছু হয়নি। আমি মরে যাইনি। সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটা মানুষের হয় তা টাকাপয়সার নয়, বিষয়-সম্পত্তিরও নয়। মানুষ হারায় তার সময়।
-কী বলছ, বুঝতে পারছি না।
–আমার হারিয়েছে, ক্ষতি হয়েছে কেবলমাত্র সময়ের। সীতা আমার বিজনেস ফিরিয়ে দিতে পারে, কিন্তু হারানো সময়টা কে ফিরিয়ে দেবে? এক বছরে আমার বয়স বেড়ে গেছে ঢের। কিছু শুরু করব আবার, তা হয় না। আমি পারব না। ওকে বলে দেবেন।
–তুমি আর একবার ভেবে দেখো।
–একবার কেন? আমি আরও বহুবার ভাবব, সারাজীবন ধরে। কিন্তু তাতে লাভ হবে না। আমি আমার এক বন্ধুর ব্যবসায়ে নামছি। ব্যবসা বন্ধুর, আমি সেখানে চাকরি করব। অ্যান্ড দ্যাটস অল।
ফোনটা করে খুবই শান্তি পায় মনোরম।
.
–তুই আমাকে ছেড়ে যেতে চাস ঝুমু? মামা একদিন ক্লান্ত বিষণ্ণ গলায় বলে। মামার রোগা চেহারাটা আরও একটু ভেঙে গেছে। চোখের নীচে মাকড়সার জালের মতো সূক্ষ্ম কালো রেখা সব ফুটে উঠেছে। সম্ভবত শিগগিরই আবার স্ট্রোক হবে মামার।
বীরুর সঙ্গে পাল্লা দিতে আমি কি পারি মামা? ওর কত কম বয়েস, কত স্পিড ওরা কত জায়গায় ছড়িয়ে আছে বরু! আমি কি পারি পাল্লা দিতে? আমার বয়সও হল।
কিন্তু তুই-ই বীরুকে ফেরাতে পারিস। আমি দেখেছি ও তোর সঙ্গে কথাটথা বলে, হাসে, ঠাট্টা করে। অবিশ্বাস্য। ও যে কারও সঙ্গে ভাল ব্যবহার করতে পারে তা জানতামই না। আমার বড় আশা ছিল, তুই কিছু একটা পারবি।
মনোরম একটু ভেবেচিন্তে বলে–মামা, বীরুর পিছু-নেওয়ার চাকরি একদিন তো শেষ হবেই। একদিন বীরু ঠিকই ব্যবসা-ট্যবসা বুঝে নেবে। তখন আমার চাকরিও শেষ হয়ে যাবে।
-না। তোকে আমি ম্যানেজার করব।
–কেন করবে? আমি যে কাঠের কিছুই জানি না। কিছুই শিখলাম না। বীরু মালিক হলে যে আমাকে রাখবে তারও কিছু ঠিক নেই। বয়সও হয়ে যাবে ততদিনে। পথ বন্ধ হয়ে যাবে সব। তার চেয়ে এখনই আমাকে ছেড়ে দাও।
–যেখানে যাচ্ছিস সেখানেও তো চাকরিই করবি।
–প্রথমে তাই কথা ছিল। পরে আমি কষাকষি করে আমাকে ওয়ার্কিং পার্টনার হিসেবে নিতে রাজি করিয়েছি। কমিশন পাব।
-কীরকম ব্যবসা?
–ব্ল্যাক। ভীষণ কালো। জাল-জোচ্চুরি-স্মাগলিং সবই আছে।
যাবি?
যাব না কেন? আমার এ বয়সে আর ভাল বা খারাপ কিছু হওয়ার নেই।
–যাবিই? বীরুর একটা কিছু ব্যবস্থা করে যা। ওকে ফেরা।
–কোথায় ফেরাব মামা? আমার তো ওকে কিছু শেখানোর নেই। ও আমার চেয়ে দশগুণ বেশি পড়াশুনো করেছে। অনেক বেশি বুদ্ধিমান। ভয়ংকর আত্মবিশ্বাসী। ওকে আমি কোথায় ফেরাব? ও আমাকে উড়িয়ে বেরিয়ে যাবে। বরং ও-ই আমাকে টেনে নিচ্ছে ওর দিকে। দেখো, এই বয়সে আমি লম্বা চুল আর জুলফি রাখছি, পরছি বেলবটমের সঙ্গে পাঞ্জাবি। আর কিছুদিন বীরুর পিছু নিলে আমিই বীরু হয়ে যাব।
–আর কিছুদিন থাক ঝুমু। আমার জন্যই থাক।
–আমার বাড়িভাড়াটা এখনও বাকি পড়ে আছে মামা।
–আজই নিয়ে যাস। ভূপতিকে বলে রাখছি। থাকবি? কিছুদিন?
–দেখি। বিশ্বাসকে একটা খবর দিয়ে দিতে হবে। ওরও স্ট্রোক, খুব ভেঙে পড়েছে। সময় দিতে চাইছে না।
–ওই বিপদের ব্যবসাতে কেন যাবি ঝুমু?
–কিছু তো করতেই হবে মামা। ওপনিং কোথায়? বাজার তো দেখছ! তা ছাড়া বিপদই বা কী, সবাই করছে।
মামা খুব গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আস্তে করে বলে–তোর সঙ্গে তো তেমন সম্পর্ক ছিল না আমার। আজকাল আত্মীয়তার গিট তো আলগা হয়েই যাচ্ছে। কিন্তু এ কদিনে তোর ওপর আমার মায়া পড়ে গেছে ঝুমু। তুই চলে যাবি ভাবলে বুকটা কেমন করে। আমি কেবল তোকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করলাম। তোর দিকটা ভাবিনি। ঝুমু, তোর জন্য কী করব বল তো?
কী করবে? আমার খুব অসময়ে তুমি আমার জন্য অনেক করেছ। ডোন্ট বি সেন্টিমেন্টাল।
–স্ট্রোক-ফোক হলে ওই সেন্টিমেন্টটা খুব বেড়ে যায়, জানিস? ভীষণ বেড়ে যায়। স্ট্রোক হচ্ছে গাড়ি ছাড়বার ফাস্ট ওয়ার্নিং, তখনই মানুষ গাড়ির জানালা দিয়ে ঝুঁকে পড়ে বেশি করে আত্মীয়দের মুখ দেখে নেয়।
-চুপ করো। বিরক্ত হয়ে মনোরম উঠে যায়। কাঠগোলার পিছনে একটু পরিষ্কার জায়গায় গিয়ে সিগারেট ধরায়। করাতকলের মিষ্টি ঘসটানো শব্দটা আসে।
.
বর্ষা যায়। শরৎ যায়। শীত আসি-আসি করে। বিশ্বাস ফোনে তার ফিসফিস স্বরে বলে–ব্যানার্জি, আর কত সময় নেবেন? আমি আর পারছি না।
আর কটা দিন, বিশ্বাস। মনোরম বলে–আর একটু সময় দিন।
সময় কে কাকে দেয় মশাই! সময়ের কি ট্রানজাকশন হয়? সময় ফুরোয়। ব্যানার্জি, একটা ফাইনাল কিছু বলুন। অন্য লোক নিতে ভরসা হয় না। এ ব্যবসাতে ফেইথফুল তোক না হলে..আমি আর কত অপেক্ষা করব ব্যানার্জি? টেল সামথিং।
একটু, আর একটু…
.
আজকাল প্রায় একটা জিনিস লক্ষ করে মনোরম। বীরু মাঝে মাঝে তার ফিয়াট দাঁড় করায় ওষুধের দোকানের সামনে। কী যেন কিনে আনে, তারপর আবার গাড়ি ছাড়ে। প্রায় দিনই, প্রতিদিনই বীরু আজকাল কাটা করে।
কী কেনে ও? ঘুমের ওষুধ নয় তো!
মনোরম সতর্ক হতে থাকে। একদিন বীরু ওষুধের দোকান থেকে বেরিয়ে গাড়ি ছাড়ল। মনোরম গাড়ি থেকে নেমে ঢুকল দোকানটায়।
একটু আগে যে লম্বা ছেলেটা এসেছিল, ও কিছু কিনল?
কাউন্টারের আধবুড়ো লোকটা কাগজ পড়ছিল। মুখ তুলে একটু বিস্ময়ভরে বলে।
কী?
–অনেকগুলো ট্রাংকুলাইজার, কয়েকটা ঘুমের ওষুধ, নিউরোসিসের জন্য কয়েক রকমের বড়ি।
প্রেসক্রিপশন?
–ছিল না। এ সব কিনতে আজকাল আর প্রেসক্রিপশন লাগে না। সবাই নিজের নিজের ডাক্তার।
অসুখটা কী?
লোকটা মাথা নাড়ল–কে জানে মশাই! জিজ্ঞেস করছেন কেন?
কারণ আছে। ও একটু ডিসব্যালান্সড।
লোকটা নিজের নাকটা মুঠোয় ধরে বলল–এ সব ড্রাগই আজকাল মুড়িমুড়কির মতো বিক্রি হচ্ছে। রোগটা বোধহয় পাগলামি। দেশে পাগল বাড়ছে।
মনোরম বেরিয়ে আসে। আকাশ ভরা রোদ। এখন হেমন্তকাল। কলকাতা এখন পাখির বুকের মতো কবোষ্ণ। গাড়ি চালিয়ে চালিয়ে তার কাঁধে ব্যথা, কোমর ধরে আছে, মাথা ভার। হেমন্তের সুন্দর আলোতে কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় একটু হেঁটে বেড়াতে পারলে বেশ হত। কিন্তু জগদ্দল গাড়িটা রয়েছে সঙ্গে আর সামনে উধাও বীরু।
ক্লান্তভাবে আবার গাড়িতে ওঠে সে। ছাড়ে। ক্লান্তিহীন বীরু কি ধরা পড়ল বয়সের হাতে? নাকি অসুখ? কিংবা কর্মফল? ওষুধ কিনছে। পাগলামির ওষুধ, নার্ভের ওষুধ, ঘুমের ওষুধ! বড় অবাক কাণ্ড। মনোরমের ভ্রূ কুঁচকে যায়। চিন্তিতভাবে সে চেয়ে থাকে সামনের রাস্তায়। চলন্ত গাড়িটা গিলে ফেলছে রাস্তাকে।
.
রাতে খুব জ্যোৎস্না ফুটেছে আজ। সেটা টের পাওয়ার কথা নয়। বীরুর পিছু পিছু অনেক রাত পর্যন্ত ধাওয়া করে করে অবশেষে প্রায় রাত সাড়ে বারোটায় বীরুর গাড়ি ঢুকল রিচি রোডে। তখন লোডশেডিং। সেই অন্ধকারে হঠাৎ বানডাকা জ্যোৎস্না দেখতে পেল মনোরম।
অ্যাপার্টমেন্টের সামনে বীরু গাড়ি দাঁড় করাল না আজ। একটু এগিয়ে গেল। বাঁ ধারে একটা মস্ত ফাঁকা পার্ক। হিম পড়েছে। কেউ কোথাও নেই। বীরু নামল। দুধের মতো সাদা পোশাক পরেছে বীরু। সাদা ঢিলে বুশশার্ট, সাদা প্যান্ট, সাদা জুতো। জ্যোৎস্নায় ওর লম্বা, সাদা অবয়বটা অপ্রাকৃত দেখায়।
গাড়ি ফেলে রেখে বীরু লম্বা পায়ে রেলিং ডিঙিয়ে পার্কে ঢুকল। খুব ধীরে হাঁটছে। মাঠের মাঝখানে চলে গেল। দাঁড়াল। আড়মোড়া ভাঙছে। স্লো-মোশন ছবির মতো নড়াচড়া করছে। জ্যোৎস্নায় এবং কুয়াশায় একটু আবছা। গাড়ির অন্ধকারে বসে মনোরম দেখতে থাকে। বীরু এক-পা এক-পা করে দৌড়ে ক্রিকেটের বোলারের মতো হাত ঘোরাল। ব্যাটসম্যানের মতো মারল বল। দু পায়ে একটি জটিল দ্রুত নাচ নেচেই থেমে যায়। ডিসকাস ছোঁড়ার ভঙ্গি করে। তারপর ধীরে, খুব ধীরে হাঁটে, ঠিক যেমন চাঁদের মাটিতে নীল আর্মস্ট্রং হেঁটেছিল। ঘুরে দাঁড়ায় আবার। স্পষ্ট দেখা যায় না, কিন্তু মনে হয় যেন চেয়ে আছে মনোরমের গাড়ির দিকেই। দেখছে।
মনোরম গাড়ির দরজা খুলে নামল। গরম জামা পরেনি, একটু শীত করে। রেলিংটা টপকায় মনোরম। হাঁটতে থাকে। কী জ্যোৎস্না, কী জ্যোৎস্না! নীলাভ হলুদ কুয়াশায় মাখা স্বপ্নের আলো। সেই আলোতে ভিন্ন গ্রহ থেকে আসা অপরিচিত মানুষের মতো লম্বা সাদা অবয়ব বীরুর। স্থির দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে মহাকাশের সাদা পোশাক।
বীরু।
–এসো। ভাবছিলাম, তোমাকে ডাকব।
–তুই জানিস যে আমি তোর পিছু নিই?
আগে জানতাম না। কদিন হয় জানি। জেনেও প্রথম ভেবেছিলাম অচেনা কেউ চেজ করছে। তাই একটু চমকে গিয়েছিলাম। তারপর লক্ষ করলাম, তুমি।
–আমার দোষ নেই। মামার অর্ডার।
–বাবা কিছু জানতে চায়?
চায়।
আমাকে জিজ্ঞেস করলেই বলে দিতাম। এত কষ্ট করতে হত না তোমাকে।
কষ্ট কী? এটাই আমার চাকরি।
বুঝতে পারছি। তোমার জন্য কষ্ট হয়।
মামা যেদিন তোর সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হবে, সেদিন আমার এ চাকরিটা শেষ হবে। তখন হয়তো আমি কাঠগোলার ম্যানেজারি পাব। নয়তো একটা বাজে, বিপজ্জনক অসৎ ব্যবসাতে নেমে যাব। ও দুটো চাকরির চেয়ে এটা বোধ হয় একটু বেটার ছিল। তবে ক্লান্তিকর। তুই বড্ড স্পিডি।
বীরু তেমনি ধীর ভঙ্গিতে একটু হাঁটছে এদিক ওদিক। অদ্ভুত প্রাকৃতিক আলোতে ও হাঁটছে বলে মনে হয় না। যেন একটু জমাট, লম্বাটে একটা কুয়াশায় তৈরি ভৌতিক মূর্তি দুলে দুলে যাচ্ছে।
বাবা কোনওদিনই আমার সব জানতে পারবে না।
–সেটা মামা স্বীকার করে না। কিন্তু বোঝে। তাই আমাকে লাগিয়েছে মামা। তার বিশ্বাস, আমি তোমাকে বুঝব। তোর পিছু নিয়ে নিয়ে আমি এখন পাক্কা জেমস বন্ড হয়ে গেছি।
বীরু হাসল। মসৃণ কামানো গালে জ্যোৎস্না ঝিকিয়ে ওঠে একটু।
–তুমি কী বুঝলে? শান্ত স্বরে জিগ্যেস করে বীরু।
–কিছু না।
–কী বুঝতে চাও?
–তুই ওষুধ কিনছিস কেন? ও সব ওষুধ প্রেসক্রিপশন ছাড়া খাওয়া খুব ডেঞ্জারাস।
আজকাল সব ওষুধের পোটেন্সি এত কমিয়ে দেয় ওরা যে কাজ হয় না।
ধীরে ধীরে হেঁটে বীরু একটু দুরে যায়। আবার দুলে দুলে কাছে আসে। মনোরমের ভয় হয়, বুঝি বীরু জ্যোৎস্না আর কুয়াশায় হঠাৎ মিলিয়ে যাবে।
বিয়ে করবি না বীরু?
—করব হয়তো কখনও।
–গৌরীকে করিস।
বীরু হাসল। বলল–তুমিই গৌরীর প্রেমে পড়ে গেছ।
-বোধহয়। তুই বলেছিলি কষ্ট হওয়াকেই ভালবাসা বলে। আমারও কষ্ট হয় ওই মেয়েটার জন্য।
–বিয়ে করে কী হবে?
–আমি তোর অনেক কিছু নকল করেছি বীরু। পোশাক, চুল, জুলফি, গাড়ির স্পিড। তোর পিছু নিয়ে নিয়ে তোর কাছে শিখেছি অনেক। কেবল তোর জুয়েলটিটা শিখতে পারছি না। তুই এ মেয়েটাকে ভাল না বেসে পারিস কী করে?
টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে আকাশে তাকিয়ে থাকে বীরু। প্যান্টের পকেটে দুই হাত। একটুক্ষণ স্থির থাকে।
–আমি খুব নিষ্ঠুর?
–মনে হয়।
–ইদানীং আমি খুব নেশা করছি। গাঁজা, আফিং, এল-এস-ডি, কিছু বাকি নেই। কিছু হয় না তাতে।
–কেন করছিস?
টু ফরগেট সামথিং।
–কী?
–তুমি আমাকে নিষ্ঠুর বলছ? কেন? তুমি আমার কতটুকু জানো?
–কিছুই না। বীরু, আমার মনে হচ্ছে দিনে দিনে তুই আমার আরও অচেনা হয়ে যাচ্ছিস। এখনই তোকে আমার পৃথিবীর মানুষ বলে মনে হচ্ছে না, যেন বা তুই অন্য গ্রহের লোক। আমি তোর মতো হার্টলেস হতে চাই। আমাকে শিখিয়ে দে।
বীরু হাসে। যথারীতি কোমল জ্যোৎস্নার লাবণ্য ওর কেঠো মসৃণ গালে এক ফোঁটা মোমের মত ঝরে পড়ল। বলল-কেন হার্টলেস হতে চাও?
মনোরম বলে–আমরা কোনও মেয়ের সঙ্গে প্রেম করলে পাগল হতাম। এখনও দ্যাখ, বউয়ের দুঃখ ভুলতে পারি না। তুই কত মেয়েকে ভুলে যাস, আমি একজনকেই পারি না।
–আমি একটা জিনিস ভুলতে পারছি না।
–কী?
যাদবপুর রেল স্টেশনে এক বান্ধবীকে তুলতে গিয়েছিলাম গাড়িতে, ট্রেনের দেরি ছিল, কথা বলছিলাম দুজনে। ভালবাসার কথা। নকল কথা সব। লাইক কসমেটিকস। ঘুরতে ঘুরতে স্টেশনের একদিকে শেড-এর তলায় গেছি, বান্ধবীটি হঠাৎ দুপা সরে এসে বলল-মাগো, ওটা কী? দেখলাম, একটা বাচ্চা ছেলে শুয়ে আছে ভিখিরিদের বিছানায়। এত রোগা যে ভাল করে না নজর করলে দেখাই। যায় না। ঠিক কাঁকড়ার দাঁড়ার মতো দুখানা হাত নোংরা কাঁথার তূপ থেকে শূন্যে উঠে একটু নড়ছে, অবিকল সেইরকমই দুখানা পা। এত নির্জীব যে খুব ধীরে ধীরে একটু একটু নড়ে, আবার কাঁথায় লুকোয়। তার গায়ের চামড়া আশি-নব্বই বছরের বুড়োর মতো কোঁচকানো, দুলদুল করছে। হিউম্যান ফর্ম, কিন্তু কী করে বেঁচে আছে বোঝা মুশকিল। চমকে যাই যখন দেখি, তার উরুর ফাঁকে রয়েছে। পিউবিক হেয়ার, পুরুষাঙ্গ। বাচ্চা ছেলের তো পিউবিক হেয়ার থাকার কথা নয়। একটা উলোঙ্কুলো বুড়ি বসে উকুন মারছিল, সে নিজে থেকেই ডেকে বলল–ষোলোবছর বয়স বাবু, রোগে ভুগে ওই দশা। ছেলেবেলা থেকেই বাড়ন নেই।–কিছুই না ব্যাপারটা, কিন্তু সেই থেকে ভুলতে পারি না।
–কেন বীরু?
-কী জানি! কলকাতায় ভিখিরি-টিকিরি তো কত দেখেছি! কত কুঠে, আধমরা, ডিফর্মড। কিন্তু এটা কিছুতেই ভুলতে পারি না। হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে, চমকে উঠি। পিউবিক হেয়ার সমেত একটা বাচ্চা তার কাঁকড়ার মতো হাত পা নাড়ছে। ভীষণ ভয় করে। যত দিন যাচ্ছে, তত সেঁটে বসে যাচ্ছে ছবিটা মনের মধ্যে। কী যে করি!
মনোরম কী বলবে! চুপ করে থাকে।
বীরু মহাকাশচারীর মতোই চাঁদের মাটিতে হাঁটে। ভ্রূ কুঁচকে বলে–বুদ্ধদেব যেন কী কী দেখেছিল? বার্ধক্য, রোগ, মৃত্যু আর সন্ন্যাস, না?
–বোধহয়।
–পিউবিক হেয়ার সমেত বাচ্চা ছেলের ফর্ম দেখলে বুদ্ধদেব কী করত বলো তো?
কী জানি!
–পাগল হয়ে যেত। কিন্তু আমি কী করি? কী করি বলো তো?
–কী করবি?
–ভাবছি। আস্তে আস্তে অপ্রাকৃত চাঁদের আলোয় ঘুরে বেড়ায় সাদা দীর্ঘ অবয়ব। আস্তে করে বলে–নিষ্ঠুর নই, বুঝেছ? বাড়ি যাও।
-কেন?
–আমি একটু একা থাকি।
পকেটে হাত, চিন্তিত মুখটা নোয়ানো, বীরু আস্তে আস্তে কুয়াশার শরীর নিয়ে ঘোরে। গাড়িতে স্টার্ট দেওয়ার সময়ে দূর থেকে দৃশ্যটা অস্পষ্ট দেখে মনোরম।
৬. অসুখে ভুগে উঠল সীতা
০৬.
অনেক অসুখে ভুগে উঠল সীতা। টাইফয়েড হয়েছিল, তার সঙ্গে স্নায়বিক রোগ, জ্বর সেরে যাওয়ার পরও বিছানা ছেড়ে উঠতে পারত না।
আজকাল বারান্দা পর্যন্ত যেতে পারে সে। গায়ে একটা পশমি চাদর জড়িয়ে রেলিং ধরে বসে থাকে চেয়ারে। কান দুটো ঝাঁ ঝাঁ করে দুর্বলতায়। হাতে পায়ে শীত। সারা গায়ে খড়ি উঠছে। শরীরের সমস্ত রক্ত কে যেন সিরিঞ্জ দিয়ে টেনে নিয়ে গেছে। এত সাদা দেখায় তাকে। কাগজের মত পাতলা হয়ে গেছে সে। যেন ওজন নেই।
বিয়েটা পিছিয়ে গেছে। আদ্রায় জয়েন করেছে মানস। কোয়ার্টার পেয়েছে। মাঝে মাঝে আসে। পাতিয়ালার কোচিং-এ সে যাচ্ছে না। যেতে ভয় পায়।
বলে–আমি চোখের আড়াল হলেই না জানি তুমি কী ঘটিয়ে বসবে।
-কী ঘটাব!
কী জানি! ভয় করে। তোমাকে অসুখের সময়ে দেখে মনে হত পুটুস করে মরে যাবে বুঝি! সাদা। হাতে নীল শিরা দেখা যাচ্ছে, চোখে কালি, খাস ফেলছ না-ফেলার মতো। কী যে আপসেট করে দাও।
এক এক সময়ে আদ্রার কথা ভাবতে ভালই লাগে সীতার। সেখানে বোধহয় নির্জনতা আছে। বনভূমি, একটা কলস্বরা নদী। কলকাতার মতো সেটা দোকানের শহর নয়। না হোক। তবু সেখানে ভুতুড়ে টেলিফোন যাবে না!
আবার মনে হয়, কলকাতা ছেড়ে যাবে? সারা দুপুর ঘুরে ঘুরে জিনিস কেনা, সে যে কী ভাল! কাজের জিনিস, অকাজের জিনিস, ঠকে আসবে, তারপর দাঁতে ঠোঁট কামড়াবে, আবার পরদিন বেরোবে ঠকতে, কণ্টকিত শরীরে মাঝে মাঝে শুনবে সেই গোস্ট কল। গোস্ট? হবেও বা।
সেরে উঠছে সীতা, আজকাল এ সব রোগ সহজেই সারে।
.
একটা ম্যাক্সি কিনেছিল সীতা শখ করে, বহুদিন আগে। সুটকেশ ঘাটতে গিয়ে টেনে বের করল। ফুল ভয়েলের ওপর পিঙ্ক লাল আর কালো চমৎকার নকশা, হাতে সূক্ষ্ম লেসের ফ্রিল। ম্যাক্সি পরার কথা তার নয়। পরবার জন্য বা ব্যবহার করার জন্য নয়, শখ করে কত অকাজের জিনিসই সে যে কেনে?
ম্যাক্সিটা বুকে করে সে আয়নার সামনে এল। খুব রোগা হয়ে গেছে সে। সাদা। কিন্তু তার মুখে অসুখের ফলে কোনও বুড়োটে ছাপ পড়েনি। বরং যেন বা বয়স কমে গেছে তার। বালিকার মতো দেখাচ্ছে।
দরজা বন্ধ করে আসে সীতা। শাড়ি ছেড়ে ম্যাক্সিটা পরে নেয়। পায়ের পাতা পর্যন্ত ঝুল। শরীরটা একটু আঁট বুঝি। ঘুরেফিরে আয়নায় দেখে সে নিজেকে। ওমা, সে তো আর যুবতী নেই। একদম না। ঠিক কিশোরী সীতা। পাতলা, ফরসা, ছোট্টটি। বুকটা দেখে হেসে ফেলে সে। স্তনভার নেই। বোঝাই যায় না বুকে কিছু আছে। শুধু দুধারে কুঁচির ওপর একটু একটু ঢেউ। ঠিক প্রথম যেমন হয়। আস্তে আস্তে পা ফেলে আয়না থেকে দূরে গেল সীতা। দেখল। কাছে এল। দেখল। কোনও ভুল নেই। সেইরকম অবিকল, যেমন সে ছিল। ড্রেসিং টেবিলের সামনে টুলে ভাবতে বসল সীতা। পশ্চাৎগামী রেলগাড়ির মতো সে ফিরে যাচ্ছিল সেই বয়সে নানা বয়সের স্মৃতি চলন্ত রেলগাড়ি থেকে আলোর চৌখুপি ফেলে যাচ্ছে।
.
একদিন দুপুরে টেলিফোন এল।
মিসেস লাহিড়ি আছেন?
লাহিড়ি। না তো! লাহিড়ি কেউ নেই। রং নাম্বার।
সীতা ফোন নামিয়ে রাখতে যাচ্ছিল।
ওপাশে কণ্ঠস্বরটা আঁতকে উঠে বলেনা, না, রং নাম্বার নয়! আপনি কে বলুন!
–আমি! অবাক হয়ে সীতা বলে–আমি সীতা ব্যানার্জি।
–ব্যানার্জি? কণ্ঠস্বরটা যেন বিষম খায়, বলে–মৌ, তুমি এখনও ব্যানার্জি?
–ওঃ। বলে ভয় পেয়ে চুপ করে যায় সীতা।
কী?
ভুল হয়েছিল।
অধৈর্যের গলায় মানস বলে–মৌ, ডিসগাস্টিং।
ভুল তো মানুষ করেই। আমি ভাবলাম বোধহয় এজেন্সির ব্যাপারে কেউ কিছু জানতে চাইছে। এজেন্সিটা তো ওই নামেই।
–ঠিক আছে। ক্ষমা করলাম।
–কখন এসেছ কলকাতায়?
সকালে। কিন্তু এবার দেখা হচ্ছে না, এক্ষুনি বার্নপুরে যাচ্ছি। ফোন করছি হাওড়া থেকে। অল ইন্ডিয়া মিট, ভীষণ ব্যস্ত। কেমন আছ?
–ভাল।
–আমাকে ছেড়েও ভাল?
না, না, তা বলিনি। এমনি ভালই।
–ভাল থাকো, ছেড়ে দিচ্ছি।
ম্যাক্সিটা মাঝে মাঝে বের করে পরে সীতা। বালিকা সেজে বসে থাকে। দুটো বিনুনি ঝুলিয়ে দেয়। আয়নায় তাকিয়ে হাসে। একটা পশ্চাৎগামী রেলগাড়ি তাকে তখন তুলে নিয়ে যায়, আলোর চৌখুপিগুলি নানা রং ফেলে যেতে থাকে।
সীতা আস্তে আস্তে আবার রাস্তায় বেরোয়, একা একা চলে যায় গড়িয়াহাটা, এসপ্ল্যানেড, নিউমার্কেট, হাতিবাগান। ঘুরে ঘুরে কেনে কাজের জিনিস, অকাজের জিনিস। ভাল লাগে। বড় ভাল লাগে। মাঝে মাঝে একটা চমকা ভয় বুক খামচে ধরে। চলে যেতে হবে কলকাতা ছেড়ে? সে কলকাতার বাইরে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারে না যেন। কলকাতার বাইরে গিয়ে তার কখনও ভাল লাগেনি। একবার লেগেছিল। শিমুলতলায়।
৭. আর্ত চিৎকার
০৭.
আজকাল ঘুমের মধ্যেও মনোরম একটা আর্ত চিৎকার শুনতে পায়–ফলো হিম, ঝুমু, ওয়াচ হিম।
অস্ফুট যন্ত্রণাকাতর শব্দ করে মনোরম পাশ ফেরে। নিস্তব্ধ গলায় ঘুমের মধ্যেই বলে আমি কি পারি মামা? ওর সঙ্গে আমি কি পারি?
–ও যে মরবে ঝুমু! ও যে শীগগির মরবে! একদিন ওর ডেডবডি ধরাধরি করে নিয়ে আসবে রাস্তার লোক।
–মরে যদি কে ঠেকাবে?
–তুই ঠেকাবি ঝুমু। ফল হিম।
আমার যৌবন বয়স শেষ হয়ে গেছে মামা। অত স্পিড আমি কোথায় পাব? আমি তত বড় নই যে ওকে ঢেকে রাখব, বা ওকে আড়াল করব।
দয়া কর ঝুমু, তুই পারবি। তোর মতো ওকে কেউ বোঝে না। আমিও না।
-কী বুঝেছি মামা? কখনও মনে হয় ও চাঁদের মাটির ওপর হাঁটছে, ঠিক যেমন নীল আর্মস্ট্রং হেঁটেছিল চাঁদে। কখনও মনে হয়, ও এক অন্য গ্রহ থেকে আসা মানুষ, জ্যোৎস্নামাখা হলুদ কুয়াশায় হঠাৎ মিলিয়ে যাবে। মামা, বীরু কি রিয়ালি?
-কী বলছিস ঝুমু? রিয়াল নয়?
বীরু নামে সত্যিই কেউ আছে?
–নেই! কী বলিস তুই! বীরু নেই?
–আছে হয়তো। অন্য পৃথিবীতে।
–তুই কি পাগল? অন্য পৃথিবী আবার কী?
–জানো তো টেলিফোনের একটা তার-এ হাজার ফ্রিকোয়েন্সিতে হাজার মানুষের কথা ভেসে চলে! ধরো, একটাই তার, তাতে আমি কথা বলছি বিশ্বাসের সঙ্গে, তুমি সেই মাদ্রাজি ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে। বিশ্বাসের কথা তুমি শুনতে পাচ্ছ না, আমিও শুনতে পাচ্ছি না সেই মাদ্রাজি ইঞ্জিনিয়ারের কথা। ঠিক তেমনি, এই আমরা যেখানে বাস করি, সেই পৃথিবীতেই বসবাস করে বীরু। কিন্তু ফ্রিকোয়েন্সি আলাদা, পৃথিবী আলাদা।
–তোর বড় হেঁয়ালি কথা! তবু যদি সত্যি হয়, ঝুমু, আমি তোর মাইনে বাড়িয়ে দেব, তোকে ম্যানেজার করব, তুই বীরুর ফ্রিকোয়েন্সিতে ঢুকে পড়।
–চেষ্টা করছি মামা, পারছি না। বয়স হয়ে গেছে, তা ছাড়া আমারও কি দুঃখ-টুঃখ কিছু থাকতে নেই মামা? দেখ, নড়ন্ত জিভ, একটা অ্যাকসিডেন্টের স্মৃতি, সীতা, স্বপ্নের মেয়েরা ইডিও-মোটর অ্যাকশন মিলিয়ে একটা কাল, এই জাল ছিঁড়ে সহজে কি বেরোনো যায়! চেষ্টা করছি।
-কর। তুই যা চাস তোকে আমি সব দেব।
–জানি মামা।
কী জানিস?
বীরুর জন্যই তুমি আমাকে ভালবাসো। কিন্তু এখন আমার ঘুমের সময়, তুমি আর স্বপ্নের মধ্যে আমাকে ডেকো না। আমি ঘুমোব, আমি উলটে রেখেছি বই, নিবিয়ে দিয়েছি বাতি। অন্ধকারে আমার শরীরের ভিতরে এক্ষুনি জ্বলে উঠবেনীল লাল স্বপ্নের আলোগুলি। ওই তো মোড়ের তে-মাথা পেরিয়ে সেঁটে আসছে আমার ঘুম, অবিকল মানুষের মতো, হাঁসের মতো গায়ের অন্ধকার কণাগুলি ঝেড়ে ফেলে সে আসবে কাছে। সম্মোহনের দীর্ঘ আঙুলগুলি নড়বে চোখের সামনে। তোমরা যাও…আমি ঘুমিয়ে পড়ব…
একটু স্যাঁতসেঁতে বিছানাটা। ফাঁকা। মনোলমের হাত এলিয়ে পড়ে থাকে। সেই হাত কিছুই স্পর্শ করে না।
.
ঠিক দুপুরবেলায় চোখের রোদ-চশমাটা খুলে মনোরম এসপ্ল্যানেডের ট্রামগুমটির টেলিফোন বুথ-এ ঢুকে গেল। ডায়াল করল, পয়সা ফেলল।
হ্যালো। একটা চাপা সতর্ক গলা ভেসে আসে।
–দিস ইজ জেমস বন্ড।
–কে?
–জিরো জিরো সেভেন।
–গুডনেস। ব্যানার্জি?
–ইয়াঃ।
–বিসোয়াস হিয়ার। আমাকে আর কতকাল অপেক্ষা করতে হবে ব্যানার্জি? মানুষের আয়ুর তো শেষ আছে।
ফিসফিস করে একটা ভৌতিক গলায় কথা বলে বিশ্বাস।
–জানি বিশ্বাস। আমি একটা ট্রাফিক জ্যাম-এ পড়ে গেছি। সামনে একটা ফিয়াট গাড়ি, সেটাকে পেরোতে পারছি না। সেটাকে পেরোতে পারলেই আপনার কাছে পৌঁছে যাব। আর কয়েকটা দিন।
-ফিয়াট গাড়ি? কী বলছেন ব্যানার্জি? কার গাড়ি?
সেই ছেলেটার পিছু-নেওয়া এখনও শেষ হয়নি বিশ্বাস।
এখনও তাকে চেজ করছেন?
–এখনও?
-সে মরেনি তা হলে?
–না।
–তবে বোধহয় সে আরও কিছুকাল বেঁচে থাকবে, কিন্তু আমি বোধহয় বাঁচব না ব্যানার্জি।
–কেন?
—আমার গলাটা কেমন বসে গেছে, লক্ষ করেছেন?
হু।
ক্যানসার।
যাঃ।
বায়োপসি করিয়েছি। মাসখানেকের মধ্যেই হাসপাতালে বেড নেব।
মনোরম চুপ করে থাকে।
ব্যানার্জি!
–উ।
সময় নেই। একদম না। আমার বাচ্চারা মাইনর, বউটা বুদ্ধি রাখে না। এত সব কে দেখবে? আপনাকে ছাড়া আমার চলবে না। আপনি কথা দিয়েছিলেন।
মনোরম একটা খাস ছাড়ল।
–শুনছেন ব্যানার্জি?
–শুনছি।
নতুন জবিনেস ওপেন করব ভাবছিলাম। ড্রাগ, নারকোটিকস। ম্যারিজুয়ানা থেকে হাশিস পর্যন্ত। খুব বাজার এখন। কিন্তু কী করে করব?
-দেখছি বিশ্বাস। আর কয়েকটা দিন।
–আপনাকে চাই-ই। ঠাট্টা নয় ব্যানার্জি, আপনি সত্যিকারের জিরো জিরো সেভেন হতে পারবেন। আমি একজন রিয়্যাল জিরো জিরো সেভেন চাই। হাত মেলান ভাই।
মনোরম হাসল।
হাসবেন না। হাতটা বাড়ান…বাড়িয়েছেন?
মনোরম শূন্যে তার হাতটা সত্যিই বাড়িয়ে দিয়ে বলল বাড়িয়েছি।
–আমিও বাড়িয়েছি…এইবার ধরুন হাতটা…মুঠো করুন।
করেছি।
শূন্যেই হাত মুঠো করে মনোরম, শেকহ্যান্ডের ভঙ্গিতে।
দ্যাটস দ্য বন্ড। আমরা কিন্তু হাত মিলিয়েছি ব্যানার্জি।
–ইয়াঃ।
টেলিফোনটা হুক-এ ঝুলিয়ে রাখে মনোরম।
.
এ বছর কলকাতায় খুব শীত পড়ে গেল। উত্তুরে হু-হুঁ হাওয়া দেয়। ময়দানের গাছগুলো থেকে পাতা খসে খসে পড়ে গেল সব। দেহাতিরা সেই পাতা কুড়িয়ে আগুন জ্বালে, হাত-পা সেঁকে নেয়। বেকার আর ভবঘুরেরা পার্কে পার্কে বেঞ্চে আর ঘাসে শুয়ে কবোষ্ণ রোদে ঘুমোয় সারা বেলা। এসপ্ল্যানেডের চাতালে তিব্বতি কিংবা ভুটিয়া মেয়েরা সস্তায় সোয়েটার বিক্রি করছে। তাদের ঘিরে এ বছর ভিড় বেড়েছে। শহরতলির দিকে আপ লোকাল ট্রেনগুলো ছুটির দিনে বোঝাই হয়ে যায়। শীতের পিকনিকে যাচ্ছে কলকাতার মানুষ। চিড়িয়াখানায় ভিড়, সিনেমা হল-এ লাইন। শীতের রোদ মাখাবার জন্য বাইরে বেরিয়ে পড়ে লোকজন।
একটা তিব্বতি মেয়ের কাছ থেকে তার হলদে দাঁতের হাসি সমেত একটা পুলওভার কিনল মনোরম। সাদা। বুকে আর পেটে পাশাপাশি চারটে চারটে আটটা সবুজ বরফি। পুলওভারটা পরে বেরোলে যে কেউ মনোরমকে দুবার ফিরে দেখে।
বাটা বিজ্ঞাপন দিচ্ছে–শীতকালেই তো সাজগোজ। মনোরমও তাই ভাবে। এই শীতে সে একটু সাজবে। একজোড়া চমৎকার জুতো কিনে ফেলল সে। ক্রোকোডাইল প্যাটার্নের চামড়া। হাঁটুতে পকেটওলা একটা মার্কিনি কায়দার প্যান্ট করল, যার সেলাইগুলো দূর থেকে দেখা যায়। মামা টাকা দিচ্ছে। দেওয়ার হাত একটু একটু করে আসছে মামার।
পুরনো বন্ধুদের এক-আধজনের সঙ্গে দেখা হলে তারা জিগ্যেস করে কী ব্যাপার? চিনতেই পারা যায় না যে!
মনোরম উত্তর দেয়–জেমস বন্ড হয়ে গেছি ভাই, কমপ্লিট জিরো জিরো সেভেন।
কাজকারবার?
নতুন ব্যবসা খুলছি ভাই! কর ফাঁকি দিতে চাও, কি নতুন ধরনের নেশা করতে চাও, যা চাও কন্ট্যাক্ট বিসোয়াস অ্যান্ড ব্যানার্জি। শিগগিরই স্টার্ট করব।
কিন্তু ঝোলাচ্ছে বীরুটা। আর মামা। বিশ্বাসকে কথা দেওয়া আছে। কিন্তু মামা ছাড়ে না কিছুতেই। প্রতি মাসে টাকা বাড়াচ্ছে আজকাল। বলে–আর কটা দিন একটু দ্যাখ।
এই শীতে বীরু নতুন পোশাক তেমন কিছু করল না। শীতের শুরুতে মাসখানেকের জন্য হিল্লি-দিল্লি কোথায় কোথায় ঘুরে এল। ততদিন মামা দিনরাত তাকে কাঠের তত্ত্ব বোঝাত। মনোরমের জন্য নয়। মামার ধারণা, মনোরম শিখে বীরুকে শেখাবে। যদি বীরু না-ই শেখে কোনওদিন, তবে মনোরম ম্যানেজার হয়ে চালিয়ে নেবে কারবার। বীরুর যেন কষ্ট না হয়।
.
তিন দিকে ঘেরা জালের মধ্যে বীরু দাঁড়িয়ে আছে। একটা দিক খোলা। সেই ভোলা দিক দিয়ে ছুটে আসে রক্তাক্ত বল। বীরুর হাতে ব্যাটটা চমকায়। কিন্তু বলের লাইনটা ধরতে পারে না, স্ট্যাম্প ভেঙে জালে লাফিয়ে পড়ে বল। পরের পর এরকম হতে থাকে। বীরু বলের লাইন দেখতে পাচ্ছে না। যে-ছেলেটা বল করছে সে নতুন, স্কুল ক্রিকেটার। বল তেমন কিছু ভাল করে না। তবু বারবারই বীরু বল খেলতে পারল না। নেট প্র্যাকটিসের বাঁধা সময় পার হয়ে গেলে সে বেরিয়ে এল।
মনোরম বশংবদ দাঁড়িয়ে আছে মাঠের ধারে। বীরুর ওপর সতর্ক চোখ।
বীরু তাকে দেখে একটু হাসল। তারপর তার ফিয়াটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বললবাবার চাকরিটা করে যাচ্ছ তা হলে এখনও?
করছি।
করো। কিন্তু কিছু জানার নেই। আমিই জানি না।
–এখনও ভুলতে পারছিস না বীরু?
কী?
–সেই স্টেশনে যেটা দেখেছিলি।
বীরু একটা খাস ছেড়ে মাথা নাড়ল–না।
-কেন?
–গেথে গেছে। অটো সাজেশানের মতো। মানুষের অনেক সময় হয়, খেতে বসলে সবচেয়ে ঘেন্নার কথা মনে পড়ে, একা ঘরে মনে পড়ে ভূতের গল্প। অনেকটা সেই রকমই। যত ভুলতে চাই, তত মনে পড়ে।
কী করবি?
–ভাবছি।
–তুই একটুও ভাবছিস না।
–ভাবছি। তুমি অস্থির হয়ো না। চাকরিটা করে যাও।
বীরু, মামার বড় ভয়, তুই সুইসাইডফাইড করবি না তো কখনও?
সুইসাইড। বীরু একটু থমকে দাঁড়ায়। হঠাৎ একটি বিদ্যুৎ খেলে যায় ওর চোখে, বলে–ভাবিনি তো কখনও!
মনোরম ভীষণ হতাশ হয়ে বলে-ভাবিসনি। তবে কি আমিই তোকে মনে করিয়ে দিলাম?
–দিলে। সুইসাইডের কথা ভাবতে বোধহয় মন্দ লাগে না কখনও কখনও! মাঝে মাঝে ভাবব।
–কেন ভাববি বীরু? ভাবিস না। আমি কথাটা উইথড্র করে নিচ্ছি।
ভয় পেয়ো না। সুইসাইডের চিন্তা কখনও করিনি। চিন্তাটা করতে বোধহয় ভালই লাগবে?
–যদি ওটাও অটো সাজেশানে দাঁড়িয়ে যায়?
বীরু ধীর পায়ে তার ফিয়াটের দিকে হেঁটে চলে গেল। আর ফিরে তাকাল না।
কদিনের মধ্যেই বীরু হেঁটে ফেলল লম্বা চুল, জুলফি। শুধু ছোট একটু গোঁফ রেখে দিল। এই শীতে একটা আধময়লা পাঞ্জাবি আর পাজামা পরতে লাগল। ফিয়াটটা গ্যারেজেই পড়ে থাকে। বীরু হাঁটে। এ রাস্তা থেকে ও রাস্তা। গলিখুঁজিতে চলে যায়। দিশি গাড়িটা নিয়ে বড্ড বিপদে পড়ে গেল মনোরম। এখন আর গাড়িতে বীরুকে অনুসরণ করার মানেই হয় না। সব গলিতে গাড়ি ঢোকে না, তা ছাড়া মানুষের হাঁটার গতির সমান ধীর গতিতে গাড়ি চালানো যায় না সব সময়ে। অতএব গাড়ি ছেড়ে হাঁটা ধরে মনোরম। এবং প্রথম ধাক্কাতেই ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এতদূর হাঁটার অভ্যাস ছিল না তার। তার ওপর লম্বা পায়ে বীরু জোরে হেঁটে যায়, তাল রাখতে গিয়ে দমসম হয়ে পড়ে সে। তবু তীব্র এক আকর্ষণে সে ঠিকই চলে। পিছু ছাড়ে না। বীরু টের পায়। মাঝে মাঝে পিছু ফিরে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। কখনও হাসে একটু, ম্লান হাসি। কখনও চাপা গলায় বলে-বাক আপ।
বুধবার রাতে বীরুকে তার অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে যেতে দেখেছে মনোরম। তারপর ফিরে গেছে পূর্ণদাস রোডের ফ্ল্যাটে। পরদিন সকালে আবার এসেছে অ্যাপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে থেকেছে। সারাদিন বীরু নামল না। দারোয়ানের কাছে খোঁজ নিল মনোরম। না সাহেব নামেনি। অনেক রাত পর্যন্ত ঠায় দাঁড়িয়ে রইল সে। বীরু নামল না। পরদিনও না।
তৃতীয় দিন মনোরমের বুক কাঁপছিল। দারোয়ান মাথা নেড়ে বলল–কিছু জানি না। এত বড় ফ্লট বাড়ি, কে কখন আসে যায়!
সন্ধেবেলায় চাঁদ ওঠে। মনোরম হেঁটে গেল পার্ক পর্যন্ত। কুয়াশা আছে। হলুদ জ্যোৎস্না। দু-চারজন লোক আছে পার্কে, সঙ্গে কারও কারও প্রেমিকা বা ভাড়াটে মেয়েছেলে। মনোরম পার্কটার একটা কোণে দাঁড়িয়ে অ্যাপার্টমেন্টের দিকে চেয়ে রইল। বীরুর ঘরে যথারীতি অন্ধকার। তিনদিন ধরে আলো জ্বলছে না ওর ঘরে। মনোরম যখন সিগারেট ধরাবার চেষ্টা করল তখন দেখে তার হাত থরথর করে কাঁপছে। পেট ডাকছে কলকল করে। উদ্বেগে সে অনেকক্ষণ কিছু খাওয়ার কথা মনে করেনি।
অনেক রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করল মনোরম। পার্ক ক্রমে নির্জন হয়ে গেল। সে একা। মি পড়ে তার গা ভিজছে, মাথা ভিজছে। ঠাণ্ডায় চোখে জল আসে। গলায় ব্যথা, একটু একটু কাশি। হাতে পায়ে খিল ধরা ভাব। ঝিঁঝি লেগেছে। এ কয় মাসে বীরুকে সে ভালবেসে ফেলেছিল, তা আজ বুঝতে পারল। ওই অ্যাপার্টমেন্টে কী হয়েছে তা এত রাতে জানতে যেতে সাহস হল না তার। কোত্থেকে একটা রাতচরা পুলিশ ঘেঁটে লাঠি দোলাতে দোলাতে কাছে এসে বলল-কেয়া?
মনোরম মাথা নেড়ে বলে কুছ নহি।
–তব?
মনোরম হাঁটতে থাকে। পার্কের রেলিং ডিঙিয়ে রাস্তায় পড়ে। ফিরে আসে পূর্ণদাস রোডের ফ্ল্যাটে। ঘুমোতে পারে না। স্বপ্ন দেখেনা। তার কোনও ইডিও-মোটর অ্যাকশনও হয় না আজ। রোজ কয়েকবার যে কথাটা তার মনে পড়ে সেই ট্রেন দুর্ঘটনাও মনে পড়ে না। ঘরের বাতি নিবিয়ে সে বসে থাকে জানালার পাশে। সিগারেট খায়। তার নিঃসঙ্গতায় কেবলমাত্র সঙ্গে দেয় নড়ন্ত জিভটা। টুক টুক করে নড়ছে। নড়ছেই। সে বড় মর্মান্তিকভাবে বুঝতে পারে, বীরুকে সে বড্ড ভালবেসে ফেলেছিল। বড় বেশি। বোধ হয় আর কিছু করার নেই।
খুব ভোরবেলা সে আর একবার অ্যাপার্টমেন্টের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কুয়াশায় গাঢ় আকাশে বহু দূর উঠে গেছে বাড়িটা। অন্ধকার জানালা সব। কোলাপসিবল গেট বন্ধ। বীরুর জানলায় আলো নেই।
অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আবার হাঁটতে থাকে। শীতটা কি খুবই পড়ল এবার? হাত পা সিটিয়ে যাচ্ছে। ভোর-আলোয় দুটো হাত চোখের সামনে তুলে ধরে দেখে সে। হাত দুটো রক্তহীন, সাদা, আঙুলের ডগায় চামড়া কুঁচকে আছে, অনেকক্ষণ জলে ভিজলে যেমন হয়। শরীরে একটা কাঁপুনি শীতের জন্যই? নাকি অন্তর্নিহিত গুঢ় শোক থেকে উঠে আসছে শরীর জুড়ে এক নিস্তব্ধ ক্রন্দন? নাকি ভয়? অনিশ্চয়তা? হাঁটে, কিন্তু কোনও নির্দিষ্ট লক্ষ্যে নয়। খানিকটা উদভ্রান্তের মতো।
তবু ঠিক নির্দিষ্ট সময়ে সে হাজির হয় কাঠগোলায়। বীরুর ফিয়াটটা বাইরে দাঁড়ানো। আপাদমস্তক শিউরে ওঠে মনোরম।
মামা বাইরের চালায় বসে আছে। কী গম্ভীর হয়ে চোখের কোলে কালি পড়েছে। ঘুমহীন জ্বালাভরা চোখ। কষ্টে শ্বাস টানছে।
–তিন দিন তুই দেখাই দিসনি ঝুমু। বীরুর খবর কী?
একই খবর। বীরুর গাড়িটা দেখছিসতর্ক গলায় বলে মনোরম।
গভীর ক্লান্তিতে মামা বলে–আমিই এনেছি ওটা। গ্যারেজে পড়ে আছে, মাঝে মাঝে চালু না করলে ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে যাবে। ওর ঘরে গাড়ির চাবিটা পড়ে ছিল। ভাবলাম নিয়ে বেরোই। কখন হুট করে এসে হাজির হবে, তখন গাড়ি রেডি না পেলেই তো মাথা গরম হবে। তাই ইঞ্জিনটা চালু রাখছি।
–ও।
কী করছে এখন হারামজাদা?
–মামা, এবার আমাকে ছেড়ে দাও। বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমার সেই বন্ধুর গলায় হঠাৎ ক্যান্সার ধরা পড়েছে। বেশি দিন নেই।
যাবি? বলে যেন হাতের ভর স্বলিত হয়ে যায় মামার। রোগা লম্বা শরীরটা টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে।
ঝুমু! মামা হাঁফানির খাস টেনে বলে।
–বলো মামা। মনোরম মামার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে বলে কী হয়েছে তোমার?
-শোন, ও যখনই ফিরুক, যবেই ফিরুক, ওর সব সাজানো রইল। ওর ঘর সাজানো আছে, ব্যবসাপত্র সব গুছিয়ে রাখা আছে, ওর গাড়ির ইঞ্জিন আমি চালু রাখছি। ওকে বলিস, আমার যা সাধ্য সব করে রেখেছি ওর জন্য।
বীরু তো সবই জানে মামা।
ভূপতিকে সব বুঝিয়ে গেলাম, তুইও দেখিস।
–তোমার কী হয়েছে?
ঝুমু, প্রদীপ নিবে গেলে একটা তেলপোড়া গন্ধ পাওয়া যায় জানিস তো?
–হ্যাঁ, বিচ্ছিরি গন্ধ।
–সেই গন্ধটা মানুষ যখন আর পায় না, তখনই বুঝতে হবে তার আর মরার দেরি নেই।
–তার মানে?
–ও একটা তুক। মানুষ মরার আগে নেবানো প্রদীপের সামনে বসেও সেই গন্ধটা পায় না। আমি গতকাল সন্ধের সময়ে পুজোর পর প্রদীপটা ফুঁ দিয়ে নিবিয়ে অনেকক্ষণ বসে গন্ধটা পাওয়ার চেষ্টা করলাম। পেলাম না। ঝুমু, আমারও আর দেরি নেই।
–এ সব কথার কোনও মানে হয় না মামা।
–তুই যেন কার সঙ্গে ব্যবসাতে নাবছিস?
বন্ধু।
–যাবিই ঝুমু? কথা দিয়েছি।
–তা হলে যা। ফাঁকে ফাঁকে এসে একটু বীরুকে দেখে যাস। তোর মামিকেও।
–দেখব মামা।
মনোরম কাঠগোলা থেকে বেরিয়ে আসে। মামা এখনও কিছুদিন টের পাবে না। বীরু তো এরকম কতদিন ডুব দিয়ে থেকেছে। সে রকমই কিছু ভেবে নিশ্চিন্ত থাকবে। মনোরম একটা সত্যিকারের দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
সামনেই গোল পার্কের ওপর শীতের প্রকাণ্ড আকাশ বোদভরা হয়ে ঝুঁকে আছে। হঠাৎ কলকাতা মুছে যায়। আবছা স্মৃতির কুয়াশা ভেদ করে মনোরম দেখতে পায় ঘাটের পৈঠার মতো দীর্ঘ সব সিঁড়ি। ইস্কুলবাড়ির তিনশো ছেলে সেই সিঁড়িতে সারি সারি দাঁড়িয়ে জোড়হাতে গাইছে–জয় জগদীশ হরে…
বহু দিনের পুরনো সেই আকাশ অতীত থেকে হঠাৎ আজ ঝুঁকে পড়ে মনোরমের চোখের ওপর। হাতের উল্টো পিঠে সে চোখের জল মুছে নেয়।
.
কলকাতায় এবার কি খুব শীত পড়েছে! এত বরাদুরে হাঁটে মনোরম, তবুও শরীর তার কেঁপে ওঠে। হাত দুটো সামনে সিঁটানো। হাঁটে মনোরম। শীত যায় না। গাড়ির শব্দ হয় চারপাশে, মানুষের পদশব্দ থেকে যায় পথে। মনোরম আর কারও পিছু নেয় না কখনও। রাতে সে তার ঠাণ্ডা বিছানায় এসে শোয়। একটু ওম-এর জন্য বড় খুঁতখুঁত করে তার শরীর। চোখ বুজতে না বুজতেই ফুলের পাপড়ির মতো স্বপ্নরা ঝরে পড়ে চোখে। মনে পড়ে সেই দুর্ঘটনা। চমকে উঠে বসে সে। ইডিও-মোটর অ্যাকশন হতে থাকে।
টেলিফোনে একদিন বিশ্বাসের নম্বর ডায়াল করল মনোরম অবশেষে।
গমগমে একটা গলা উত্তর দিল–হ্যালিও…
মনোরম ভাবে, তবে কি ক্যানসার সেরে গেছে বিশ্বাসের! আবার সেই রোগমুক্ত প্রকাণ্ড চেহারাটা লুবাতাসের মতো মুখের ওপর খাস ফেলে বলবে–ব্যানার্জি, বিসোয়াস হিয়ার।
–হ্যালিও….
মনোরম জিগ্যেস করে–বিশ্বাস?
ও।
-উনি তো হাসপাতালে আছেন।
–কিছু বলার ছিল?
না। ঠিক আছে।
.
বাড়িভাড়া আবার বাকি পড়ে৷ জমে উঠেছে ঋণ। মনোরম হাঁটে। ওপেনিং খোঁজে পায় না। বয়স হয়ে যাচ্ছে ক্রমে। তবু হাঁটে মনোরম। এ রাস্তা থেকে ও রাস্তা। সেই অ্যাপার্টমেন্টের সামনে কখনও যায় না। যায় না মামার কাঠগোলাতেও। বিশ্বাসকে আর কখনও ফোন করেনি মনোরম। থাক, সে কিছুই জানতে চায় না। মনোরময় যেদিন মারা যায়, সেদিন সকালে সে প্রতিবেশীর বাসা থেকে ইস্কুলে বেরিয়ে, বাড়ির দিক থেকে কান্নার রোল শুনে ছুটে পালিয়ে গিয়েছিল ইস্কুলে। প্রার্থনার সারিতে দাঁড়িয়ে কেঁদেছিল। আজও পালায়, অবিকল সেইরকম। কল্পনা করে, মামা রোজ এসে কাঠগোলায় বসছে, নিবন্ত প্রদীপের গন্ধ আবার ফিরে পেয়েছে মামা। বীরু তাকে ফাঁকি দিয়ে অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বোধহয় পালিয়ে গিয়েছিল মাঝরাতে। তারপর বোধহয় গিয়েছিল গৌরীর কাছে। ওরা দূরে কোথাও আছে, একসঙ্গে। বিশ্বাস অপারেশনের পর ভাল হয়ে আবার দাবড়াচ্ছে তার পুরনো বিদেশি গাড়ি, মদ খাচ্ছে, ফুর্তি করছে, বেশি রাতে বাড়ি ফিরে খোলা দরজা দিয়ে ভিতরে ছুঁড়ে দিচ্ছে এক পাটি জুতো…
কল্পনায় সবই থাক। সত্যি কী, তা জানতে চায় না মনোরম। এবারের শীতে কলকাতা বড় সুন্দর। এ রকমই সুন্দর থাক সব কিছু। ভাবতে ভাবতে তার ইডিও-মোটর অ্যাকশন হতে থাকে। সে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে দেখতে পায় বিশ্বাসকে, শোঁ করে গাড়িতে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে গেল-বাই… গ্র্যান্ড হোটেলের উল্টোদকে পার্কিং লট-এ থেমে থাকা ভোঁতামুখ গাড়ি থেকে মামা যেন ডাক দেয় ঝুমু! আর কখনও ভিড়ের মধ্যে সামনে লম্বা বীরু হাঁটতে থাকে। ক্রু কুঁচকে পিছু ফিরে চায়, হাসে কখনও বলেবাক আপ।
অবিকল এইভাবে একদিন সীতাকে দেখতে পায় মনোরম। তখন দুপুর। নিউ মার্কেটের ছায়ায় ছায়ায় শীত গায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল মনোরম। সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যহীন। গায়ে সাদার ওপর সবুজ বরফিওলা পুলওভার, মার্কিনি ছাঁটের প্যান্ট পরনে, পায়ে ক্রোকোডাইল মোকাসিন। ছায়া, তবু রোদ চশমাটাও ছিল চোখে, হঠাৎ দেখে, উল্টোদিক থেকে সীতা হেঁটে হেঁটে আসছে। পুরনো স্বভাব সীতার, দোকানের সাজানো জিনিস দেখছে নিচু হয়ে। এক পা এক পা করে হেঁটে আসে সীতা।
স্বপ্নই। বিভ্রম। এক্ষুনি কল্পনার সীতা মিলিয়ে যাবে। তবু যতক্ষণ তাকে দেখা যায় ততক্ষণ দেখবে বলে চোখে পিপাসা নিয়ে তাকিয়ে থাকে মনোরম। বহু দিন সীতাকে দেখেনি। সেই কতদিন আগে দেখেছিল এসপ্ল্যানেডের চাতালে, মেঘভাঙা রোদে। মহার্ঘ মানুষের মতো মাটি থেকে যেন একটু ওপরে শূন্যে পায়ের আলপনা ফেলে চলে গিয়েছিল। প্রাকৃতিক আলোগুলি রঙ্গমঞ্চের ফোকাসের মতো এসে পড়েছিল ওর গায়ে। তারপর বহুদিন বাদে আবার কল্পনায় দেখা হল। মনোরম চেয়ে থাকে।
সীতা হেঁটে আসছে। কাল্পনিক। তবু অপেক্ষা করে মনোরম। যদি তাকে না দেখে এরকমই হেঁটে আসতে থাকে, তবে সোজা এসে মনোরমের বুকে ধাক্কা খাবে। ঠিক যেমন স্থবির গাড়িতে চলন্ত ইঞ্জিন এসে লেগে যায়। সেই বিভ্রম, সেই প্রবল কাল্পনিক সংঘর্ষের জন্য দাঁড়িয়ে থাকে মনোর। সীতা অনন্ত পথ পার হয়ে আসছে। একটু একটু করে। বড় একটা দোষ ছিল ওর, যা খুশি কিনে আনত। কলকাতার দোকান ছেয়ে গেছে নকল দু নম্বর মালে। রোজ ঠকে আসত। বকত মনোরম। ঠিক সেই রকমই বালিকার মতো অপার কৌতূহলভরা চোখে দোকানের সাজানো জিনিস দেখছে আজও। মনোরমকে দেখেনি। সচেতন নয়। মনোরমের বিভ্রমের পথ ধরে আসছে সীতা, কল্পনা, স্বপ্ন।
.
মনোরম ভুল করেছিল।
সীতা তাকে দেখেছিল ঠিকই। দোকানের আয়নায় প্রতিবিম্বিত মনোরমকে। একটু চমক কি লেগেছিল? কে জানে! কিন্তু সেই মুহূর্তেই ভুল হয়ে গেল বিচ্ছেদ, অন্য এক পুরুষ, বহুকালের অদর্শন। তীব্র অভিমানে ফুলে উঠল সীতার বালিকা-মুখের দুটি ঠোঁট, জ কুঁচকে গেল।
একটুও ভাবল না সীতা, অপেক্ষা করল না, কোনও ভূমিকাও না। কিশোরীর মতো দ্রুত নৃত্য-ছন্দে কয়েক পা দৌড়ে গেল মনোরমের দিকে। বুক ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কৃশ, সাদা মুখখানা তুলে ধরে বলল আমার যে কী ভীষণ অসুখ করেছিল।
মনোরম তাকিয়েই থাকে। বিভ্রম?
সীতা তার রোগা, পাণ্ডুর ডান হাতখানা তুলে নিঃসংকোচে তাকে দেখাল, বলল–দেখো কত রোগা হয়ে গেছি!
পৃথিবীতে মানুষের আয়ু খুব বেশিদিন নয়। বনে যাচ্ছে সময়। দ্রুত, কলস্বরা। মনোরম তাই বিনা প্রশ্নে সীতার রোগা হাতখানা ছুঁল। সেই মুহূর্তেই তাদের চারধার থেকে কলকাতা মুছে যাচ্ছিল। জেগে উঠল বনভূমি। অদূরে নদীর শব্দ।