- বইয়ের নামঃ তিথি
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১-৪. তিথির বয়স চোদ্দো প্লাস
তিথির বয়স চোদ্দো প্লাস। বাইরে এখন ফুটফুটে ভোর। তাদের লবণহ্রদের বাড়ির বাগানে এখন অসময়ে কেন যে একটা কোকিল ডাকছে। আরে একটা বাতাস–খুব অদ্ভুত ভূতুড়ে বাতাস হু-হু করে বয়ে যাচ্ছে। ঠিক মনে হয়, বাতাসের কিছু কথা আছে, বলতে চাইছে, কিন্তু বোঝাতে পারছে না।
তিথি এই ভোরবেলাটিকে টের পাচ্ছে। শুনতে পাচ্ছে কোকিলের ডাক। বাতাসের ঝাপটায় তার ববকাট চুল উড়ছে, ঝাপটা মারছে। কিন্তু তিথির সমস্ত মনপ্রাণ নিবদ্ধ একটা প্যাডের কাগজে লেখা কয়েক লাইন চিঠিতে। ঠিক চিঠিও নয়। তার বাবা বিপ্লব দত্ত বাংলা ভালো জানত না, লিখতে গেলে অজস্র বানান ভুল করত, তাই পারতপক্ষে বাংলা ব্যবহার করত না। একটু বেশি কোনাচে অক্ষর এবং ডানদিকে খুব বেশি হেলানো একধরনের ছাঁদ ছিল তার বাবার। এই হাতের লেখা চিনতে কোনো অসুবিধেই নেই তিথির। ওপরে খুব আনুষ্ঠানিকভাবে লেখা–টু হুম ইট মে কনসার্ন। তার নীচে সেই মারাত্মক কয়েকটি লাইন–নোবডি-অ্যাবসোলিউটলি নোবডি ইজ রেসপনসিবল ফর মাই ডেথ। লাইফ ওয়াজ অল ফান, ইট ইজ ফানিয়ার টু টেক ইট অ্যাওয়ে। আই লিভড ওয়েল, কন্টেটেড। ডোন্ট বদার মাই ফ্যামিলি। বাই। বিপ্লব দত্ত। বাবার ইংরেজি সবই খুব ভালো চেনে তিথি। পরিষ্কার সই, কোনো অস্পষ্টতা নেই, ঠিক যে ধরনের মানুষ ছিল তার বাবা। স্পষ্ট মানুষ। তবু কেন যে কেউ ঠিকমতো বুঝতে পারেনি লোকটাকে।
বিপ্লব দত্ত মারা গেছে মাস দুয়েক আগে। তখন কোনো সুইসাইড নোট পাওয়া যায়নি। ফলে পুলিশ কিছু ঝামেলা পাকিয়ে তুলেছিল। সোমনাথমামা এবং তার প্রভাবশালী বন্ধুরা লালবাজারকে নাড়া দিয়ে তবেই মৃতদেহ পুলিশ হেফাজত থেকে উদ্ধার করে আনে।
তিথি ভোরের ফুটফুটে আলোয়, কোকিলের ডাক আর বাতাসের শব্দ শুনতে শুনতে তার বাবার সুইসাইড নোটটার দিকে সম্মোহিতের মতো চেয়ে রইল। কপালের ওপর চুলের ঝটকা নেমে আসছে মাঝে মাঝে। সে কি বাবার ঈষৎ ভগ্ন কিন্তু গভীর কণ্ঠস্বরও শুনতে পাচ্ছে? লাইফ ওয়াজ অল ফান, ইট ইজ ফানিয়ার টু টেক ইট অ্যাওয়ে।…বাই।
এলিয়টের ওল্ড পোসামস বুক অফ প্র্যাকটিক্যাল ক্যাটস বইটা এই ভোরে খুঁজে বের করার কোনো প্রয়োজনই ছিল না তিথির। কবিতা সে পড়েও না। দু-মাস বাদে আজই আবার ভোররাত থেকে সে শুরু করেছিল তার ফিজিক্যাল ওয়ার্ক আউট। প্রতিদিন সে অন্তত দু তিন মাইল দৌড়োয়। এক মাস বিরতির পর অবশ্য অর্ধেকও পারল না। ঊরু আর পায়ের ডিম ব্যথায় অবশ করে আনল। সঙ্গে একটা ক্লান্তি, হতাশা, ঘাম, বিরক্তি। মনে হচ্ছিল বৃথা শ্রম। বারান্দায় স্কিপিং করতে করতে মনে হচ্ছিল, বাঁদরের মতো লাফাচ্ছি কেন? কী হবে এইসব করে? ঘরে এসে পাখাটা খুলে মেঝের ওপর শুয়ে পড়েছিল তিথি। গরম লাগছিল ভীষণ তাই মেঝের ঠাণ্ডাটা বড়ো ভালো লাগছিল তার। মেঝেয় শুয়েছিল বলেই দেখতে পেল, বুক কেসের একদম নীচের তাকে একখানা বই উলটো করে রাখা। তিথি গোছানো মেয়ে, উলটোপালটা পছন্দ করে না। মেঝের ওপরই গড়িয়ে গিয়ে সে বুক কেস খুলে বইটা সোজা করে রাখতে গিয়ে দেখল একটা সাদা কাগজের কোনা উঁচু হয়ে আছে। টেনে বের করতেই তার চোখ স্থির হয়ে গেল।
এই আবিষ্কারের এখন আর কোনো মূল্য নেই। তার বাবার শরীর পঞ্চভূতে মিলিয়ে গেছে কবে। তবু তিথির যেন মনে হচ্ছিল সে তার বাবাকে স্পষ্টভাবে টের পাচ্ছে। বাবা যেন কাছেই! পাশেই!
এবাড়ির প্রায় সবাই নাস্তিক। কিংবা নাস্তিকও বলা যায় না, একটু হচপচ। ভগবান-টগবান নিয়ে কেউ কিছু ভাবে-টাবে না। ভূত-টুত ইত্যাদি নিয়েও তারা কখনো মাথা ঘামায়নি।
কিন্তু কী আশ্চর্যের বিষয়, বিপ্লব দত্ত মারা যাওয়ার পরই এই বাড়ির আবহাওয়ায় কিছু একটা সঞ্চারিত হল। কেমন থম ধরে গেল চারদিকটা! একটা ঘোর-ঘোর ভাব ঘনিয়ে উঠল কি বাড়ির ভিতরে?
প্রথম দু-চারদিন কেউ কিছু বলল না। কান্নাকাটি, শোক, আত্মীয় সমাগম ইত্যাদির পর সঞ্চারি একদিন ব্রেকফাস্টের সময় বলল, কাল রাতে আমার ভালো ঘুম হয়নি, অ্যাণ্ড আই হার্ড সামবডি ওয়াকিং অন দা রুফ।
আশ্চর্যের বিষয় কেউ এই কথার প্রতিবাদ করল না। সবাই চুপ করে রইল।
বিকেলে বুক্কা বলল, তোমাকে বলিনি মা, আই হিয়ার সামবডি কাফিং অ্যাট মিডনাইট।
তিথির মা মিলি দত্ত কেমন যেন বিবর্ণ হয়ে বলল, ওসব কিছু নয়।
এর বেশি বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা মিলি দিতে চেষ্টা করল না।
কিন্তু সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া দেখা গেল বাসন্তীর। সে এ-বাড়ির সবসময়ের কাজের লোক। সুন্দরবনের এই বাইশ-তেইশ বছর বয়সের যুবতীটি বেশ স্পষ্ট ভাষায় একদিন বলল, ও বউদি, দাদাবাবু কিন্তু এখনও আছে। কাল দেখলুম দোতলার বারান্দায় রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে কে সিগারেট খাচ্ছে যেন। তখন রাত দুটো-আড়াইটে হবে।
মিলি খুবই দুর্বল গলায় বলল, বাসন্তী, এবাড়িতে বাচ্চারা রয়েছে। ওসব কখনো বলবে না। তোমরা গাঁয়ের লোক, অনেক কিছুই বিশ্বাস করো, আমরা করি না।
বাসন্তী আর উচ্চবাচ্য করল না তখনকার মতো। কিন্তু তারপর থেকে সে অন্য কৌশল নিল। কাজ করতে করতে সে স্বগতোক্তির মতো বলে যেতে লাগল, এসব অশৈলী কান্ড…এই তো স্পষ্ট শুনলুম দুপুর বেলা দাদাবাবুর ঘর থেকে খুটখাট শব্দ আসছে…আচ্ছা, মলিন তো আর কানা নয়, সেও তো রাতে উঠে বাইরে যেতে গিয়ে দেখেছে ছাদের ওপর থেকে ঝুঁকে কে চেয়ে আছে বাগানের দিকে…অপঘাত বলে কথা…