নিঃশব্দে সে ফের দোতলায় উঠে এল। সকলের খাওয়া শেষ হয়ে গেছে। রান্নাঘরে বসে একা খাচ্ছে বাসন্তী।
বাসন্তীদি!
বাসন্তী মুখ তুলে বলে, কী বলছ?
একটা কথা সত্যি করে বলবে?
কী কথা?
তুমি সত্যিই বাবাকে দেখতে পাও?
ও মাগো! আবার ওসব কথা কেন?
পাও কিনা বলো না!
পস্ট করে দেখিনি বাবা, তবে দেখেছি।
ঠিক দেখেছ?
ঠিক দেখেছি। ভাবতে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে এখনও। দেখো না আমার গা।
তবে আমি দেখতে পাই না কেন?
তোমার বুকের পাটা আছে বাপু। ও ঘরটায় একা একা কী করে থাকো? আমি হলে তো ভয়ে মরে যেতুম। তোমার বাবা এখনও এবাড়িতে ঘুরে বেড়ায়। মায়ার টান তো।
তিথি ঘরে এসে অনেকক্ষণ ভাবল। তারা ছেলেবেলা থেকে ভূতটুত মানে না। তবে ভূতের গল্প পড়া বা শোনা-এর একটা মজার দিক আছে। তার বেশি কিছু নয়। আজ সে কী করে বিশ্বাস করবে যে, বাবা এখনও অন্য এক ধরনের অস্তিত্ব নিয়ে আছে? যদি থাকত তাহলে তিথি ভয় পেত না। বরং তার কিছু উপকার হত।
বিকেলে যে-লোকটা এল সে এল একা। এল বাসরাস্তা থেকে পায়ে হেঁটে। বয়স ত্রিশ বা তার ওপরে। খেটে-খাওয়া মানুষের মতো চেহারা। পোশাকের তেমন পারিপাট্য নেই। ধুতি পাঞ্জাবি চপ্পল। তাকে কেউ অভ্যর্থনা করেনি। ফটকের বাইরে থেকেই উঁচু গলায় জিজ্ঞেস করল, কে আছেন?
তিথিই উঠে গেল, কাকে চান?
এটা বিপ্লব দত্তের বাড়ি তো!
হ্যাঁ, এটাই।
বাড়িতে কুকুর নেই তো!
না।
আমার নাম অমিত গুহ। ভিতরে আসতে পারি?
তিথি বুঝল এ লোকটারই আসবার কথা ছিল। মামার কাছে যেন নামটাও শুনেছে। তিথি লোকটাকে দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ঘ্যাম সব লোক এসে গেছে বাড়ি কিনতে। এ তো পুঁটিমাছ। বুক্কা ঠিকই বলেছিল, এ খুব দরকষাকষি করবে। শেষ অবধি হালে পানি পাবে না।
তিথি অবহেলাভরে বলল, আপনি দোতলায় উঠে যান। ওখানে আমার মামা আছেন। তিনিই কথা বলবেন।
লোকটার গমনপথের দিকে চেয়ে একটু হাসল তিথি। নার্ভাস, অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল এবং অবশ্যই অ্যাডভেঞ্চারাস। নইলে দশ থেকে পনেরো লাখ টাকার মধ্যে ওঠানামা করছে যে বাড়ির দর, তার ডাউন পেমেন্টের কথা মাথায় রেখেও বাঙালিটা সাহস পায় কী করে?
ওপরতলাতেও তার অভ্যর্থনা তেমনতরো হল না। সোমনাথ এই প্রথম গম্ভীর মুখে একজন হবু খদ্দেরকে রিসিভ করল। বলল, আসুন।
অমিত গুহর হাবভাব নিতান্তই মধ্যবিত্ত বাঙালির মতো। মুখে সংকোচ, দ্বিধা, ভয়মিশ্রিত বিনয়ী একটু হাসি, আত্মবিশ্বাসের অভাব। আগের খদ্দেরদের যে আভিজাত্য এবং দম্ভমিশ্রিত তাচ্ছিল্য ছিল এর তা তো নেই-ই, বরং যেন অপরাধী ভাব। গরিবরা বড়োলোকদের বাড়িতে ঢুকে যেমনটা বোধ করে তেমনই সংকোচ।
সোমনাথ একটু নীচু নজরেই যুবকটিকে লক্ষ করে বলল, আপনার শীত করে না?
অপ্রতিভ অমিত গুহ একটু হেসে বলে, কলকাতায় আর তেমন শীত কই? গরম জামা আনিনি বলে বলছেন? গায়ে উলিকট আছে। বেশ গরম।
সোমনাথের একটু ভাতঘুম হয়েছে। হাই উঠছিল। বলল, বলুন। বাড়িটা সত্যিই কিনতে চান? দাম কিন্তু অনেক উঠে গেছে। আমরা অপেক্ষা করছি আরও একটু বাড়ার জন্য।
কত উঠেছে?
সোমনাথ নিঃসংকোচে মিথ্যে কথাটা বলে ফেলল, পনেরো লাখ।
ছেলেটা সোফায় বসে পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখটা মুছে বলল, এরকমই ওঠার কথা। আজকাল কিছু মানুষের পকেটে অঢেল টাকা।
বাড়িটা কি দেখবেন?
অমিত গুহ মাথা নেড়ে বলে, না না। বাড়ি দেখার দরকার নেই।
না দেখেই কিনবেন?
অমিত মাথা নেড়ে বলে, না না। তবে এবাড়ি আমার দেখা।
দেখা!
হ্যাঁ। কনস্ট্রাকশনের সময় আমি নিজে সুপারভাইজ করেছিলাম। বি সেন অ্যাসোসিয়েটস এর প্ল্যান করেছিল। প্ল্যানিং-এর ব্লু প্রিন্ট আমার এখনও মনে আছে।
বিস্মিত সোমনাথ বলে, তাই বলুন! তাহলে অবশ্য বাড়িটি আপনার অদেখা বাড়ি নয়। চা খাবেন?
খাব। তার আগে একটু জল। ঠাণ্ডা হলেই ভালো। আমি ঠাণ্ডা জল খুব ভালোবাসি।
এই শীতেও?
আজ্ঞে।
সোমনাথ বাসন্তীকে হুকুম দিয়ে এসে বসল, এ বাড়ি সম্পর্কে আপনার এস্টিমেট কী?
দর বলছেন? না কি ভ্যালুয়েশন?
দর। কত হতে পারে এ বাজারে? আপনার লিমিট?
অমিত গুহ মলিন মুখে মাথা নেড়ে বলে, ভেবে দেখিনি। তবে খারাপ হবে না। আপনাদের দলিলটা কই?
সোমনাথ মাথা নেড়ে বলে, দলিলটা বের করা হয়নি এখনও। সার্টিফায়েড কপি আছে।
ছেলেটি মাথা নত করে বলে, যতদূর জানি দলিলটা বের করেছিলেন বিপ্লববাবু।
তাহলে আছে কোথাও। দলিল নিয়ে ছোড়দির সঙ্গে কথা বলিনি। ওর কাছেই থাকবে তাহলে। সার্চিং-এর জন্য তো?
না না। সল্ট লেক-এ সার্চিং-এর দরকার হয় না সেটা আমি জানি। এখানকার জমি-বাড়ি আউটরাইট সেল করাও যায় না।
সোমনাথ বুঝদারের মতো মাথা নেড়ে বলে, এসব তো আপনার জানাই।
ট্রেতে এক গেলাস হিমশীতল জল আর চা নিয়ে বাসন্তী ঘরে এল। অমিত সাগ্রহে জলটা নিয়ে ছোটো ছোটো চুমুকে খেতে লাগল। তারপর ঢকঢক করে। চা শেষ করার আগে সে কোনো কথাই বলল না। অনেকটা সময় ভাবুক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। সে চাউনির মধ্যে একটা স্মৃতিচারণের ভাব রয়েছে। যেন অনেক কিছু মনে পড়ছে তার। অমিত গুহর চোখে কিছুক্ষণ পলক পড়ল না।
তারপর সোমনাথের দিকে চেয়ে বলল, এ বাড়িটা করার সময় বিপ্লববাবুর খুব অর্থকষ্ট যাচ্ছিল। মিলিটারি থেকে আরলি রিটায়ারমেন্ট পেয়েছিলেন, কিন্তু হাতে টাকা ছিল না। বোধহয় জানেন উনি সে-সময়ে একটা পুরোনো ছোটো কারখানা কিনেছিলেন। অভিজ্ঞতা ছিল না বলে অনেক টাকা নষ্ট হয়, জিনিসপত্র চুরি হয়ে যায়।