আর বাড়ির বাতাসটা কেমন ভারী হয়ে উঠছিল ক্রমে। শূন্য থেকে সাদা প্রেতের মতো একটু কুয়াশা যেন হঠাৎ নেমে এসে ঝুলে থাকল উঠোনের ওপর। কেমন ছমছম করছিল চারধার। যেন প্রেতলোকের ছায়া চারধারে। পান্না সিঁড়িতে বসেছিল চুপচাপ। বড় জ্যাঠা মরে যাচ্ছে। কেন যে মরে যাচ্ছে! আর ওই ভুতুড়ে সন্ধ্যা আর ওই আলোর করুণ ডাক আর ওই কুয়াশার পাতলা সর, সব মিলিয়ে কান্না পাচ্ছিল।
আর তখন উঠোনের উত্তর ধারে মরা আলোয় একমনে এক্কাদোক্কা খেলে যাচ্ছিল দুখুরি। কালো রোগা মেয়েটার পরনে একখানা কার যেন মস্ত ঢলঢলে ফ্রক। শোকাহত বাড়িতে আসন্ন মৃত্যুর নিস্তব্ধতার মধ্যে শুধু ওই মেয়েটা একমনে খেলে যাচ্ছে। এখন তাকে কেউ কাজে ডাকছে না, ফাইফরমাশ করছে না। এই ফাঁকটুকুতে সে আপনমনে খেলে নিচ্ছে। মৃত্যুহিম বাড়িটায় ওই একটু যেন জীবনের লক্ষণ– হৃৎপিণ্ডের মতো। লাফিয়ে লাফিয়ে খেলছে মেয়েটা।
প্রথমে শাঁখের আওয়াজ বলেই ভুল হয়েছিল। এক ঝটকায় ভুল ভাঙল। জ্যাঠাইমা কেঁদে উঠল না? ওঁওঁওঁ শব্দের একটা লম্বা টানা শব্দ। কে একজন বলে উঠল, সময়টা লিখে রাখো, লিখে রাখো, ছটা বেজে সতেরো মিনিট। আর একজন বলল ও ভটচাযমশাই, লগ্নটা কী পেল দেখুন তো, দোষ-টোষ কিছু পেল নাকি? নবীন ভটচাযের গলা পাওয়া গেল, তেমন কিছু নয়, গৌরহরিদা ভালই গেছেন।
জ্যাঠাইমার সঙ্গে গলা মিলিয়ে অনেকগুলো কান্নার আওয়াজ উঠল আর গম্ভীরমুখো ডাক্তার বেরিয়ে এসে সিঁড়ি বেয়ে উঠোনে নেমে চলে গেলেন। কান্না শুনে দুখুরি খেলা থামিয়ে মুখের ওপর থেকে ঝুরো চুল সরিয়ে পান্নার দিকে চেয়ে বলল, মরে গেছে?
মরা মানুষ দেখবে না বলে পান্না আর দাঁড়ায়নি। এক ছুটে বাড়ি। আর বাড়িতে তার জন্য অপেক্ষা করছিল ফাঁকা, অন্ধকার, হাঁ-হাঁ করা ঘর, উঠোন জোড়া অন্ধকার, আর ধোঁয়াটে অশরীরী কুয়াশার কুণ্ডলী। পান্না উঠোনে দাঁড়িয়ে, চোখ বুজে, শক্ত হয়ে প্রাণপণে চিৎকার করেছিল, বাসন্তী… বাসন্তী.. বাসন্তী…
বাসন্তী গিয়েছিল পুকুরঘাটে। বাসনের পাঁজা ফেলে রেখেই উঠে এল।
কী হয়েছে গো? চেঁচাচ্ছ কেন?
আমার ভয় করছে।
ও মা! ভরসন্ধেবেলা ভয়ের কী?
বাড়িতে কেউ নেই দেখছিস না? সব ও-বাড়িতে।
তা তুমি চলে এলে যে! গৌরকর্তার কি হয়ে গেল?
হ্যাঁ। আমার ভীষণ ভয় করছে।
সেদিন সন্ধেবেলা কারেন্ট ছিল না। বাসন্তী লণ্ঠন জ্বেলে দিয়ে বলল, আমার তো বসে থাকলে চলবে না, বাড়ি ফিরতে হবে। ছেলেটার জ্বর দেখে এসেছি। একা যদি না থাকতে পারো তা হলে ভশ্চায খুড়িমাকে ডেকে দিয়ে যাচ্ছি।
ভয়! ভয়ের কি শেষ আছে! কোথা থেকে যে হঠাৎ হঠাৎ তার ভয়েরা এসে হাজির হয় তা সে নিজেও জানে না। কিন্তু ভয় তার অমনি হয় না। তার ভয়ের পিছনে সবসময়েই গূঢ় কারণ থাকে। কিন্তু সেটা কেউ বুঝতে চায় না। ভয়ের জন্য কত বকুনি খায় সে।
মানুষ মরে যে কেন ভূত হয় কে জানে বাবা! ভটচায খুড়িমা বলল, মরার পর আত্মা দশ দিন প্রেতলোকে থাকে, শ্রাদ্ধের পর দেবলোকে চলে যায়। আর প্রেতলোকটা বেশি দূরেও নয়, আশেপাশেই।
কী যে গা ছমছম করল তার। রাতে মায়ের সঙ্গে লেগে শুয়েও ঘুম এল না। নিশুত রাতে জ্যাঠামশাইয়ের দীর্ঘশ্বাস ঘুরে বেড়াতে লাগল উঠোনে। শুকনো পাতার সড়সড় শব্দে কীসের যে সঞ্চার ঘটছিল। তাদের কুকুরটা অকারণে কেঁদে উঠেছিল একবার বারান্দায়। অকারণে নয়, পান্না জানে। ঠিক জ্যাঠামশাইকে দেখতে পেয়েছিল।
দাহকাজ শেষ করে তার বাবা রামহরি চাটুজ্যে ফিরল শেষ রাতে। আগুন ছোঁয়ানো, লোহা ছোঁয়ানো এসব করতে উঠে গেল মা। তখন পান্নার চোখ জুড়ে ঘুম এল।
বিয়ে করলে আমি বাপু, কলকাতায় করব। মেলা লোক, আলো, ভিড়ভাট্টা, অত গা ছমছম করবে না। আমার যা ভয়।
নিতু বলে, দুর! কলকাতা আমার ভাল লাগে না। তুই কী রে ভিড় ভালবাসিস! আমার ভাল লাগে পাহাড়, উপত্যকা, শীত-শীত ভাব আর খুব নির্জন, গাছগাছালি…
সেসব আমারও ভাল লাগে। কিন্তু একা থাকলে ভয়েই মরে যাব।
তোর যে কী অদ্ভুত ভয়। আর কলকাতায় বুঝি ভয় নেই। কত খুনখারাপি, অ্যাকসিডেন্ট।
তাও ভাল বাবা।
আজ বড় জ্যাঠার শ্রাদ্ধ। সকাল থেকে বাবা ও-বাড়িতে। মাও একটু আগে গেল। পান্নাকে ডেকে বলে গেল, দেরি করিসনি যেন। চানটা করেই চলে আয়। যা মাঠো মেয়ে তুই।
তা আছে একটু পান্না। মাঠোই বোধহয়। সব কাজে তার গড়িমসি। শরীরটা নড়াতে-চড়াতে ভালই লাগে না তার। তার ভাল লাগে বসে বসে ভাবতে।
শরীরের গভীর আলসেমি যেন মদের নেশার মতো। আর মাথার মধ্যে লাগামছাড়া উদ্ভট সব ভাবনা। পান্না ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুয়ে বসে গড়িয়েই কাটিয়ে দিতে পারে। আর মনে মনে সে যে কোথায় কোথায় উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে বেড়ায় তার ঠিক-ঠিকানা সে নিজেও জানে না।
আজ কোনও সাজ নেই। শ্রাদ্ধবাড়ির নেমন্তন্নে কেউ তো সাজে না। সাদামাটা একটা সাদা খোলের শাড়ি, মুখে একটু পাউডার, চুলে সামান্য চিরুনি। ব্যস হয়ে গেল। তাই আজ একটু গড়িমসি করে নিচ্ছে পান্না। মোটে সাড়ে এগারোটা বাজে। হাতে এখনও অনেক সময়। কাজের বাড়িতে আগে-ভাগে গিয়ে হাজির হলে লোকে বড্ড ফাইফরমাশ করে। এটা নিয়ে আয়, ওকে ডেকে দে, পানগুলো সেজে ফেল, আরও কত রকম। আর অত ভ্যাজর ভ্যাজর, কুটকচালি ভাল লাগে না তার।