- বইয়ের নামঃ চক্র
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১-৫. ঘুমের সময়
০১.
ওই এল তার ঘুমের সময়। বাতাসে শীতের শিস, তার দীর্ঘ শরীরে ঘুমের রিমঝিম। আর সময় নেই। শরীরে ভরে নিতে হবে যথাসাধ্য রসদ। তারপর মাটির নীচে কবোষ্ণ অন্ধকারে ঢুকে পড়বে সে। ঘুম আর ঘুম। নেমে আসবে ঘুমের ভারী পর্দা। তার মন নেই, বিবেক নেই, সে কে বা কেমন তাও জানা নেই। তার আছে কেবল শরীর। আছে সন্ধানী চোখ, বিদ্যুতের মতো গতি, আর ক্ষুধা, আর ভয়।
নবীন ভটচাযের লাকড়িঘরের পিছনে শ্যাওলা ধরা একটা ইটের খাঁজে ব্যাঙটাকে পেয়ে গেল সে। বিশাল হলদেটে ব্যাঙ। তাকে দেখে ব্যাঙটা প্রাণভয়ে একটা লাফও দিয়েছিল। দ্বিতীয় লাফটা দেওয়ার মুখে প্রায় শূন্য থেকে তাকে সে লুফে নিল মুখে। খাদ্যগ্রহণ তার কাছে সুখপ্রদ নয়। তার জিহ্বা আস্বাদহীন। কম্পিউটারে ভরে দেওয়া তথ্যের মতোই সে শুধু জানে কোনটা খাদ্য, আর কোনটা নয়। আর খাদ্যগ্রহণও কি কম কষ্টের? ধীরে, অতি ধীরে বিশাল গরাসটাকে গিলতে হয় তার। চোয়াল ছিঁড়ে যেতে চায়, গলা আটকে আসে, বঁড়শির মতো দাঁতে আটকানো ব্যাঙটা বারবার ঝটকা মারে আর কাঁপে আর কঁ-অঁ-ক, কঁ-অঁ-ক করে প্রাণভয়ে অন্তিম আর্তনাদ করতে থাকে। আস্তে আস্তে তিল তিল করে তাকে আত্মসাৎ করতে হয় জীয়ন্ত গরাস। বড় কষ্ট তার। ঘুমিয়ে পড়ার আগে খেয়ে নিতে হবে আরও খাবার। আরও কষ্ট, আরও অধ্যবসায়।
অনেকক্ষণ সময় লাগল তার। আতাগাছের চিকড়ি-মিকড়ি ছায়ার ফাঁকে ফাঁকে রোদের বল্লম এসে বেঁধে তার চোখে। বাতাসে শীতের নির্ভুল সংকেত, হাওয়া ঘুরছে, ঘুরে যাচ্ছে উত্তরে। সূর্য হেলে যাচ্ছে দক্ষিণে। তার শরীরে সব খবর পৌঁছে যায়।
শত্রুর অভাব নেই তার। ছোট্ট বিচরণভূমি ভরে আছে প্রতিপক্ষে। তাই ঘাসে, ঝোপে, মাটির খাঁজে, গর্তে কেবলই আত্মগোপন করে থাকা। অন্তরালই একমাত্র বাঁচিয়ে রাখে তাকে।
গলার কাছ বরাবর শ্বাসরুদ্ধ করে আটকে আছে ব্যাঙটা। প্রবল পরিশ্রমে শরীর নিথর। মাটিতে সামান্য কম্পন, চোখে একটা ছায়া পড়ল, একটু নড়াচড়া। সে জানে এখন সে বড় অসহায়। অবসন্ন শরীরে সেই বিদ্যুতের গতি নেই, আক্রমণও নেই। সে ভয় পাচ্ছে। সে একবার প্রতিপক্ষকে দেখে নিল। তারপর শরীরের ভার টানতে শুরু করল। প্রতি মুহূর্তেই তাকে আত্মগোপন করতে হয়।
তার দীর্ঘশ্বাসে বাতাস কেঁপে উঠল। পিঙ্গল শরীরটাকে বইয়ে দিল সে। কিন্তু বড় কষ্ট। শরীর জুড়ে যেন ব্যথার মৃদঙ্গ বেজে যাচ্ছে।
.
পেচ্ছাপের বেগটা ছেড়ে দিয়েই ধীরেন কাষ্ঠ বুঝতে পারল কাজটা ঠিক হয়নি। উঁচু ঢিবিমতো জায়গা দেখে বসে পড়েছিল, চারদিকটা খেয়াল করেনি। ব্যাঙটার প্রাণঘাতী আর্তনাদ শুনে তার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল। দু চোখেই ছানি বলে নজর ঘষাকাচের মতো। সামনে শুকনো পাতার ডাঁই, গাছের ছায়া। প্রথমে নজরে পড়ল না। ঠাহর করে দেখতে পেল, হাত দেড়েক দূরে পাকা গোখরোটা ব্যাঙটাকে ধরেছে আর তার পেচ্ছাপের ধারাটি ছড়ছড় শব্দ তুলে তেড়েফুড়ে ওই দিকেই যাচ্ছে। অতি বিপজ্জনক পরিস্থিতি। চমকে গেলে পেচ্ছাপ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু ধীরেন কাষ্ঠর কপালটাই খারাপ। বয়সকালে এখন পেচ্ছাপ পেলে বেগ চেপে রাখতে পারে না। শরীরের যন্ত্রপাতি ক্রমেই কেলিয়ে পড়ছে। পেচ্ছাপ তার নিজের মনেই হয়ে যাচ্ছে, ধীরেনের সাধ্যই নেই এখন বন্ধ করে। তা হলে কাপড়ে-চোপড়ে হয়ে যাবে। পারবে না জেনেও একটা চেষ্টা করল ধীরেন, মুখ ফসকে একটা কোঁতানির শব্দও বেরোল। কিন্তু আটকানো গেল না। খাওয়ার সময় সাপটা বিরক্ত হচ্ছে। যদি রেগেমেগে তেড়ে আসে তাহলেই হয়ে গেল। না, কাজটা ঠিক হচ্ছে না, ঠিক হচ্ছে না। আজকাল তার এইসব ছোটখাটো কাজে বড় মাপের সময় লাগে। বয়সকালে লাগত না। অসহায় ধীরেন কাষ্ঠ তাই তার বিশ্বাঘাতক পেচ্ছাপের ধারাটাকে নজরে রাখছিল। হ্যাঁ, ওই আঁকাবাঁকা হয়ে ব্যাটা ঠিক গিয়ে সাপটার পেটের তলায় ঢুকে পড়ল। ভয়ে চোখ বুজে ফেলল ধীরেন। শরীরটা শক্ত হয়ে এল আতঙ্কে। ভরসার কথা এই, মুখে ব্যাঙটা ধরে থাকায় চট করে ছোবল দিতে পারবে না। তবে সাপকে বিশ্বাসই বা কী?
ঠিক এই সময়ে সাপটা ফসস করে একটা বিচ্ছিরি শব্দ করায় ধীরেন বা প রে বলে চেঁচিয়ে উঠে পড়ল। পেচ্ছাপ তখনও হয়ে যাচ্ছে।
ধীরেনের চাপা চিৎকার শুনতে পেল পান্না। ডান হাতের দুটো আঙুল–মধ্যমা আর তর্জনী চোখের সামনে তুলে ধরে সে তখন লটারি করছে–গলায় দড়ি না গায়ে আগুন? গায়ে আগুন না গলায় দড়ি? কদিন হল তার এই চলছে। মনটাকে স্থির করতে পারছে না। তবে করবে সে ঠিকই। কিন্তু কোনটা বাছবে তা ঠিক করতে দেয়ালঘড়ির দোলকটার মতো দোল খাচ্ছে। কখনও মনে হয় গায়ে আগুন, কখনও মনে হয় গলায় দড়ি। উনিশের ভরা যুবতী সে, এই বয়সেই তো মরতে সাধ হয় সবচেয়ে বেশি। মনে একটু টুসকি লাগলেই মনে হয়, মরি। আকাশে রাঙা চাঁদ উঠলে কি একটু ভালবাসা না পেলে, কি শীতের দুপুরে মন হু হু করলেই হল, মরণ মুচকি হেসে শ্যামের বাঁশি বাজাতে থাকে।
সে মরলে কী কী হবে ভাবতেই আনন্দে গায়ে কাঁটা দেয় তার। লুটোপুটি খেয়ে কাঁদবে মা, ও পান্না, ফিরে আয়। বেশ হবে। যত অবিচার করেছে মা তা শোধ হবে চোখের জলে। আর কখনও বলবে না, গতরখাকী মর না। আর বাবা? বাবা এমন স্তম্ভিত হয়ে যাবে যে কাঁদতেও পারবে না। মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকবে দাওয়ায় আর অবিশ্বাসভরে মাথা নাড়বে, এ হয় না, এ হয় না। আর হীরা, হীরার কথা কিছু বলা যায় না। হিংসুটিটা কে জানে বাবা খুশিও হতে পারে। আবার হয়তো দিদির শোকে লুটোপুটি খেয়ে কাঁদতেও পারে। মনে হয় কাঁদবেই। কাঁদলে খুব কাঁদবে। আর সে? সে কী করবে তা জানে না পান্না। তবে খুব বিষণ্ণ আর আনমনা হয়ে যাবে। হু-হু করবে বুক, চোখ ভিজে যাবে বারবার। এ কী করলে পান্না, আমাকে একা রেখে গেলে নির্বান্ধব পৃথিবীতে? এই সেটা যে কে তা আজও জানে না পান্না। সে-র সঙ্গে তার চেনাই হয়নি। সে যে কেমন তাও ঠিক করে ভাবেনি সে। আবছা আবছা একটা মুখ কল্পনা করে নেয়। আবার মুখটা কেমন বদলেও যায়।
মরার কথা ভাবতে ভাবতে দুপুরের নিরালা যখন একরকম সুখে ভরে উঠছিল তখনই চিৎকারটা শুনতে পেল সে। বুড়ো মানুষের গলায় বাপ রে! শোওয়া অবস্থাতেই শরীরটা গড়িয়ে উপুড় হয়ে জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে সে দেখতে পায়, ধীরেন কাষ্ঠ দাঁড়িয়ে। হাতে ধরা ধুতির খুঁট, ছড়ছড় করে ধুতি ভিজিয়ে পেচ্ছাপ পড়ে যাচ্ছে পায়ের লালচে রঙের ক্যাম্বিসের জুতোর ওপর। এঃ মা!
লজ্জায় মুখটা সরিয়ে নিয়ে পান্না বলে, কী হয়েছে জ্যাঠামশাই?
সাপ।
কামড়েছে নাকি?
না, আর একটু হলেই কামড়াত।
কোথায় সাপটা?
ধীরেন কাষ্ঠ হাত তুলে লাকড়িঘরের দিকে দেখিয়ে বলল, ওইখানে।
.
ঘোষবাড়ির সুপুরিগাছের ডগায় উঠে মরণ নানা দৃশ্য দেখছিল। আফ্রিকার ম্যাপের মতো দেখতে একটা বড় মেঘ একটা শ্রীলংকার মতো ছোট মেঘকে আস্তে আস্তে গিলে ফেলল আর তারপর দুটিতে মিলে হয়ে গেল অস্ট্রেলিয়া। আর দেখল, নয়নদের বাড়ির উঠোনে শীতের লেপকাঁথা বের করে চাটাই পেতে রোদে দেওয়া হয়েছে। আর চাটুজ্যেবাড়ির গৌরহরিদাদুর শ্রাদ্ধের সাদা ম্যারাপ ফুলে ফুলে উঠছে হাওয়ায়। আর সন্ধ্যাদির বাড়ির দোতলার গ্রিল দেওয়া বারান্দায় আজও সেই ফুটফুটে মেয়েটা উদাসভাবে দাঁড়িয়ে আছে। আর সন্ধ্যাদির উদুখলের ধুপ ধুপ ধুপ ধুপ শব্দটা পৃথিবীর হৃৎপিণ্ডের শব্দের মতো উঠে আসছে। গাছের ঘষটানিতে বুকের নুনছাল উঠে গিয়ে জ্বালা করছে। ঘোষ জ্যাঠাইমা তাড়া দিচ্ছে, ও মরণ, তোর হল? তাড়াতাড়ি কর বাবা। সুপুরিগুলো গোছ করে রেখে শ্রাদ্ধবাড়িতে যাব যে!
মাঝে মাঝে এত আনমনা হয়ে যায় বলেই তার বিপদ। একবার আমগাছ থেকে পড়ে বাঁ হাত ভেঙেছিল তার। তবু ওই আনমনা হওয়া তাকে ছাড়ে না। পেকে ওঠা সুপুরির গোছ মাত্র দুটো কেটে ফেলেছে, তারপর কেমন সব ভুলে বিস্ময় ভরা চোখে দেখছে তো দেখছেই। আর নানা কথার ভুড়ভুড়ি উঠছে মনের মধ্যে।
হঠাৎ সাপে ধরা ব্যাঙের ডাকটা কানে এল তার। কী করুণ আতাঁরব! কঁ-অক, কঁ-অ-ক। হাতের দা-টা ঠাঙাৎ করে নীচে ফেলে দিল সে। দু পায়ে দড়ির ফাঁস ছিল, নাড়া দিয়ে সেটাও ফেলে দিয়ে তাড়াতাড়ি নামতে লাগল সে।
ও মরণ, নামছিস যে! পাড়বি না?
দাঁড়ান জ্যাঠাইমা, আগে সাপটাকে মারি।
সাপ মারবি কী রে? কোথায় সাপ?
আছে।
সে জানে মানুষ বিপদে পড়লে যে বিপদসংকেত পাঠায় তাকে বলে এস ও এস। সেভ আওয়ার সোল। আমাদের প্রাণরক্ষা করো। ব্যাঙটাও সেই বার্তা পাঠাচ্ছে চারদিকে। জলে জঙ্গলে, ঘাটে আঘাটায় এমনই সব তুচ্ছ নানা ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, মানুষ টেরই পায় না। কিন্তু ব্যাঙটা কার কাছে পাঠায় ওই বিপদসংকেত? ওর কি ভগবান আছে? নাকি আছে কোনও কমিউনিটি? অন্য ব্যাঙেরা কি এসে বাঁচাবে ওকে কখনও? তবে ও কাকে ডাকে? মরণ জানে সাপের মুখ থেকে ব্যাঙটাকে ছাড়িয়ে নিলেও বাঁচবে না। কিন্তু সাপটাকে যে তার মারতেই হবে।
শেফালী বউদি বলে, তুই কেমনধারা ছেলে রে? প্রজাপতির পাখা ছিঁড়ে দিস, চড়াইপাখির বাসা ভাঙিস, ফড়িং-এর পায়ে সুতো বেঁধে ওড়াস, সাপ মারিস! এমন পাষাণ কেন রে তুই?
সে ভাল ছেলে নয়, সে জানে।
গাছ থেকে নেমে দুটো ইটের ঢেলা কুড়িয়ে নিয়ে ছুটছিল মরণ। ভটচাযবাড়ির লাকড়িঘরের সামনে ধীরেন জ্যাঠার মুখোমুখি।
ধীরেন কাষ্ঠ বলল, দেখ বাবা কী কাণ্ড। শ্রাদ্ধবাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে যাচ্ছি, পথে এই বিপত্তি।
এঃ জ্যাঠামশাই, আপনি যে পেচ্ছাপ করে ফেলেছেন।
বুড়ো বয়সে কিছুই কি আর বশে থাকে রে বাবা। আর সাপটাও এমন ফোঁস করে উঠল যে, পালাতে গিয়ে কাপড়ে-চোপড়ে হয়ে গেল। দিবি বাবা একটু টিউবওয়েলটা পাম্প করে? এখানেই একটু ধুয়ে টুয়ে নিই। গায়ে গায়ে শুকিয়ে যাবে। কাপড় পালটাতে হলে আবার মাইলটাক হেঁটে যাওয়া। যা খাড়া রোদ।
আসুন জ্যাঠামশাই, পাম্প করে দিচ্ছি।
রাস্তার কলে ধুতিটা ধুতে ধুতে ধীরেন কাষ্ঠ বলছিল, আজকাল আর কেউ ডাকখোঁজ করেও না তেমন। গৌরহরিদার পরিবার তবু তো ডেকেছে।
সাপটা এ যাত্রায় বেঁচে গেল। বিশাল গরাসটা কণ্ঠায় আটকে আছে তার। ধীরে সে একটা পরিত্যক্ত জমি আর ভাঙা বাড়ি পার হল। তারপর বেগুনক্ষেত। বাঁশের বেড়া। আগাছার জঙ্গল। ধীরে ধীরে পিছল গতিতে পার হয়ে যাচ্ছে সে। তার শীতল রক্তে শীতের পদধ্বনি। আর সময় নেই।
.
ঝিরঝিরে চঞ্চল নিমের ছায়ায় বসে একমনে সর্ষে গুঁড়ো করছে সন্ধ্যা। মস্ত এলো খোঁপা ভেঙে পড়েছে পিঠে। দামাল বাতাসের দিন আজ। মাঝে মাঝে দমকা বাতাস এসে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে শুকনো পাতা আর উড়ছে তার চুল।
উদুখলের ডান্ডাটা রেখে যখন খোঁপা ফের বেঁধে নিচ্ছিল সন্ধ্যা তখন সাপটাকে দেখতে পেল। ঘন জঙ্গল থেকে উঠে উঠোনের কানা দিয়ে দীর্ঘ শরীরটা খুব আস্তে টেনে নিয়ে খড়ের মাচানের নীচে তার অন্ধকার জগতে ঢুকে যাচ্ছে। গলার কাছটায় একটা ঢিবি। ব্যাঙ বা ইঁদুর গিলে এসেছে এইমাত্র।
মাই গড! ইটস এ বিগ কোবরা!
সন্ধ্যা মুখ তুলে বুডঢাকে দেখল।
বুডঢা বলল, দেখতে পাওনি? জাস্ট বিলো দি হে স্ট্যাক।
দেখব না কেন? চোখের সামনে দিয়েই তো গেল।
লাঠি-ফাঠি কিছু নেই বাড়িতে?
থাকবে না কেন? লাঠি দিয়ে কী করবে?
বাঃ, মারতে হবে না সাপটাকে?
ওটা বাস্তুসাপ মারতে নেই।
হোয়াট ডু ইউ মিন বাই বাস্তুসাপ? এ স্নেক ইজ এ স্নেক। ইট মে বাইট এনিবডি এনিটাইম।
খুব ক্ষতি না করলে কামড়ায় না। তিনটে আছে, আজ অবধি কাউকে কামড়ায়নি।
গড! ও মাই গড! ক্যান এ স্নেক বি ওয়ান অফ দি ফ্যামিলি!
কদিন যাবৎ ইংরিজিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছে সন্ধ্যা। মায়ে মেয়েতে ছেলেতে মিলে দিনরাত ইংরিজিতে কথা কইছে, তার এক বর্ণও সন্ধ্যা বোঝে না। তবে এটা বুঝতে পারে, ওরা তিনজনে মিলে এবাড়ির লোকেদের নিয়ে ঠাট্টাইয়ার্কি করে। ভাল কথা যে বলে না তা মুচকি হাসি, বাঁকা চাউনি আর ঠোঁট ওলটানো দেখে টের পাওয়া যায়। বড্ড অপমান লাগে, কান-টান ঝাঁ ঝাঁ করে। কিন্তু কিছু করারও তো নেই।
বুডঢা ওপর দিকে চেয়ে চেঁচিয়ে বলে, ডিড ইউ সি ইট দিদি? এ বিগ কোবরা।
ইয়াঃ, আই স ইট। মে বি এ ক্রাইট।
নো, ইট ওয়াজ এ কোবরা। দিস ফুলিশ উওম্যান সেজ ইটস এ রেসিডেনশিয়াল স্নেক। এ মহাত্মা। ডাজ নট বাইট।
শি ইজ এ মোরোন।
সন্ধ্যা বুঝতে পারছে, তাকে নিয়ে কথা কইছে ওরা। খারাপ কথা। সে ভারী ডান্ডাটা তুলে নিল। শক্ত চোয়ালে অপমানটা গিলে ফেলতে চেষ্টা করল। আর সব আক্রোশ নিয়ে দুম দুম করে গুঁড়ো করতে লাগল সর্ষে। ঝাঁঝ আসছে নাকে, সর্ষের গুঁড়া ছিটকে যাচ্ছে চারদিকে। ঠোঁট নড়ছে সন্ধ্যার, কী কেলেঙ্কারি করে এসেছ তোমরা সে কি আর জানি না! পাঁচকান তো করতে পারি না। হাটে হাঁড়ি ভাঙলে টের পেতে বাপু। দিনরাত মায়ে মেয়েতে যে ইংরিজিতে ঝগড়া করছ সে কি এমনি এমনি? আমরা কথাগুলো বুঝতে না পারি, ঝগড়া যে হচ্ছে তা তো বুঝতে বাকি নেই। ছিটেফোঁটা বুদ্ধি আমাদেরও আছে বাপু। কলকাতা ছেড়ে গাঁয়ের বাড়িতে এসে ঘাপটি মেরে আছ সে তো সোহাগ করতে নয়, গা-ঢাকা দিতে। সোহাগ-সুন্দরী, তোমার মুখখানা সুন্দর হলে কী হবে, মনে বিষ।
সোহাগ ওপর থেকে অনুচ্চ স্বরে বলল, শি হেটস মি।
বুডঢা নীচে থেকে বলল, শি হেটস মি টু। অ্যান্ড আই লাইক দ্যাট।
সর্ষে গুঁড়ো করতে করতে সন্ধ্যা বিড়বিড় করতে থাকে, কেমন ইংরিজি বলিস তোরা জানি। বাবা তো কালকেই বলছিল, ওরা যতই ফটাফট ইংরিজি বলুক না কেন, গ্রামারে ভুল আছে। নিমাই মাস্টারের ছেলে অঞ্জনকে নিয়ে এসে সামনে দাঁড় করিয়ে দিলে তো চুপসে যাবি তোরা। ইংরিজিতে সে আশি নব্বই নম্বর পায়…
অনেকক্ষণ ধরেই সোহাগ সাপটাকে দেখছিল। বাঁ ধারে জঙ্গুলে মাঠটার মাঝখানে একটা ছাগল বাঁধা। সেটাই কেমন যেন হঠাৎ ম্যা ম্যা করে ছুটে পালাবার চেষ্টা করছিল। সোহাগের আজকাল কোনও কৌতূহল নেই। কোনও ব্যাপারেই নেই। সে উদাসভাবেই চেয়ে দেখছিল। ঘাস খেতে খেতে শান্ত ছাগলটা হঠাৎ ভয় পেল কেন? ছুটতে গিয়ে পায়ে দড়ি জড়িয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল, ডাকতে লাগল। তখনই লম্বা শরীরটা ধীরে আঁকাবাঁকা হয়ে চলে আসছে। ছাগলটার কাছ ঘেঁষেই এল। তারপর তকতকে উঠোনের কোণ দিয়ে ধীরে ধীরে খড়ের মাচানের নীচে চলে যেতে লাগল। সোহাগ উদাস চোখে সাপটাকে দেখল শুধু। সাপ দেখলে কেউ ভয় পায়, কারও গা ঘিনঘিন করে। তারও ওরকম হয়। এখন হল না। ধীরে ধীরে সে ভেজিটেবল হয়ে যাবে। সে জানে।
সোহাগ, ভিতরে এসো। তোমার খাবার দেওয়া হয়েছে।
মা ডাকছে। সোহাগ উদাস মুখটা ফিরিয়ে বলল, এখন খাব না। খিদে নেই।
তুমি তো চাওমিন খেতে চাইলে। তাই করা হয়েছে।
রেখে দাও। পরে খাব।
পরে গরম করবে কে? এখানে তো মাইক্রোওয়েভ নেই। নুডলস জোগাড় করতেই কমলদাকে বর্ধমান যেতে হয়েছিল। এখানে এসব ফ্যান্সি ফুড অ্যারেঞ্জ করা মুশকিল।
গরম করতে হবে না। ঠান্ডাই খাব।
এসব ভাল হচ্ছে না সোহাগ। তুমি কোনও রুটিন ফলো করছ না।
আই হ্যাভ নো অ্যাপেটাইট। প্লিজ।
তার মানে ইউ উইল স্কিপ দি লাঞ্চ। ব্রেকফাস্টে মোটে একটা বয়েলড ডিম খেয়েছ। এখন বেলা বারোটা বেজে গেছে।
বেলা বারোটা ইজ নট টু লেট।
রাগ করে না খেয়ে থাকাটা প্রিমিটিভনেস। ইট উইল নট হেলপ।
না খেয়ে থাকব কেন? খাচ্ছি তো।
মোটেই খাচ্ছ না। ইউ আর লুজিং ওয়েট। তোমার স্কিন ড্রাই হয়ে যাচ্ছে।
আমি বেশ ভাল আছি। ডোন্ট বদার।
আজ তোমার বাবা আসছেন। তাকে সব বলব।
বোলো। হি ইজ নট এ মেসায়া।
তিনি তোমার বাবা।
সো হোয়াট?
ডোন্ট ডিগ সোহাগ। ডিগিং উইল নট হেলপ। বলছি খেয়ে নাও।
খাব না বলিনি তো। পরে খাব।
ইউ আর ইমপসিবল।
ও কথা কেন বলছ? আই অ্যাম ডুয়িং হোয়াট এভার আই অ্যাম টোল্ড টু ডু। যদি হুকুম করো তা হলে ছাদে উঠে নীচে লাফিয়েও পড়তে পারি। কিন্তু খিদে না থাকলে কিছুতেই খাওয়া যায় না।
খিদে নেই তো সবসময়েই বলছ। এক্সারসাইজ করছ না, মেডিটেশন করছ না, শুধু ঘরে বসে আছ, খিদে না পাওয়ার তো দোষ নেই।
আমার ওসব ভাল লাগছে না।
এই যে বললে ইউ আর ডুয়িং হোয়াটএভার ইউ আর টোল্ড টু ডু?
তুমি কি আমাকে এক্সারসাইজ করতে বলছ?
বলছি। শরীরের জন্য করতে দোষ কী?
আমার ইচ্ছে করে না। মানুষ তো শুধু শরীর নয়।
অন্তত ইউ মে টেক এ ওয়াক।
আমার ভাল লাগে না। লোকেরা তাকায়।
সে তো কলকাতাতেও তাকায়। তাকায় না?
এমন হাঁ করে তাকায় না। আমার হাঁটতে ভাল লাগে না।
সোহাগ, আর ইউ ট্রায়িং টু কিল ইওরসেলফ?
আমার এত কথা বলতে ভাল লাগছে না মা, আমি নীচে যাচ্ছি।
.
পারুল আজ সকাল থেকে পথ চেয়ে আছে। এক বুক তেষ্টা কেন তার আজও? না, এ বোধহয় তেষ্টা নয়, আকাঙ্ক্ষা নয়, এ এক গভীর কৌতূহল। বাঁধা পড়ে গেছে কবেই পারুল। এখন সংসারে জেবড়ে আছে। আর অমলদাও তো কী ভীষণ ব্যস্ত মানুষ।
পারুল চ্যাটার্জি আর অমল রায়ের গভীর প্রেমের ঘটনা মোটেই চাপা থাকেনি। বিশ বাইশ বছর আগে এই ঘটনায় সারা গাঁ তোলপাড় হয়ে গিয়েছিল। পথেঘাটে মজলিশে আলোচনা হত। বিয়েতেও কোনও বাধা ছিল না। সবর্ণ, পালটি ঘর। কিন্তু ঘটনা সবসময়ে সোজা পথে ঘটতে চায় না।
অমল রায় মাধ্যমিকে স্ট্যান্ড করেছিল। এই গাঁয়ের মুষ্টিমেয় কৃতী ছেলেদের মধ্যে সে একজন। হয়তো সর্বশ্রেষ্ঠ। মাধ্যমিকের পরও দুরন্ত অমল অনেক বেড়া টপকাল। যা চায় তাই পায় অবস্থা। পারুলকেও পেয়ে গিয়েছিল অনায়াসে। প্রায় কৈশোরকাল থেকে।
ঘটনাটা ঘটেছিল যে সময়ে সে সময়ে আই আই টি-র শেষ পরীক্ষা দিয়ে অমল গাঁয়ে ফিরেছে। দুজনের দেখাসাক্ষাৎ ছিল পরস্পরের বাড়িতে। যাতায়াতের তেমন কোনও বাধা ছিল না। কিন্তু সেই সময়ে অমলের চোখেমুখে একটা ঘোর পরিবর্তন দেখতে পায় পারুল। কেমন খিদে ফুটে থাকে মুখে, চোখের দৃষ্টি সরু হয়ে আসে। কামুক পুরুষের দৃষ্টি চিনতে মেয়েদের কোনও অভিজ্ঞতার দরকার হয় না। তারা ও ক্ষমতা নিয়েই জন্মায়। পারুল নির্ভুল বুঝতে পেরেছিল, অমল যে কোনও দিন তাকে চাইবে। আর তখনই একটু ভয় হয়েছিল তার।
একদিন এক প্রচণ্ড গরমের দুপুরে অমল উদভ্রান্তের মতো এসে হাজির। পারুল তার দোতলার পড়ার ঘরে নিরিবিলি বসে পরীক্ষার পড়া করছিল। অমলের চেহারা দেখে সে শিউরে উঠেছিল। মাথায় বড় বড় চুল উড়ছে, মুখখানা রোদে পুড়ে লাল, আর দুখানা চোখে ধক ধক করছে এমন একটা দৃষ্টি যা বুঝতে কোনও মানে-বইয়ের দরকার হয় না।
অমলদা, কী হয়েছে?
অমল হাঁফাচ্ছিল। এত জোরে হেঁটে এসেছে, এত উদভ্রান্ত, এতই দেহতাড়িত যে সে আর স্বাভাবিক নেই। চাপা গলায় সে বলল, পারুল আমি আর পারছি না।
পারুল প্রবল আতঙ্কে সিঁটিয়ে গিয়ে বলে, কী বলছ আমি বুঝতে পারছি না।
বুঝতে হবে না, শুধু চুপ করে থেকো।
প্রবল এক পুরুষ শরীর, সেই শরীরের ঘাম, উত্তাপ, আবেগ, আশ্লেষ আচমকা আক্রমণ করেছিল তাকে। সে শুধু চাপা চিৎকার করেছিল, না না না না
দরজাটা বন্ধ করতেও ভুলে গিয়েছিল অমল। তখন সে উন্মাদ, কাণ্ডজ্ঞানহীন। কাম ছাড়া তখন আর তার কোনও অনুভূতিই কাজ করছে না।
সে এক তুমুল লড়াই হয়েছিল দুজনের মধ্যে। আক্রমণ আর প্রতিরোধ। আর তার ভিতর থেকেই পারুলের মনে জন্ম নিচ্ছিল ঘৃণা।
বিধ্বস্ত পারুলকে ফেলে পালিয়ে গিয়েছিল অমল। অনুতাপ হয়েছিল পরে।
পারুল তবু ক্ষমা করে দিতে পারত অমলকে। নিশ্চয়ই পারত। ভালবাসলে ওটুকু পারাই যায়। জোর একটা ধাক্কা খেয়ে হয়তো মানুষটা সম্পর্কে তার ধারণা একটু খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তখন তার সতেরো বছর বয়স, ও বয়সের আবেগ অনেক কিছুকে উপেক্ষা করতে পারে। তার ওপর সেই দুপুরের দুর্ঘটনায় সে যদি মা হয়ে পড়ত তাহলে অমলকে ক্ষমা করা ছাড়া তার উপায়ও থাকত না।
পরদিন সকালে শান্ত ভদ্র অমল লাজুক মুখে এসে হাজির।
ইস। কাল কী কাণ্ডই না করে ফেললাম পারুল।
পারুল সারা রাত কেঁদেছিল, ঘুমোয়নি, রাতে খায়ওনি। শরীর ভীষণ খারাপ লাগছিল সকালে। ফুঁপিয়ে উঠে বলল, কেন করলে এরকম? বিয়ের আগে কেউ ওসব করে? ছিঃ ছিঃ, এখন কী যে হবে।
ভয় পেও না।
ভয় পাব না? তুমি পুরুষমানুষ বলে কত সহজে কথাটা বলে ফেললে। মেয়ে হলে পারতে না। সব দায় তো মেয়েদেরই বইতে হয়। তাদের নামেই নিন্দে হয়, তাদেরই জীবনভর কলঙ্ক থেকে যায়। বাচ্চা নষ্ট করতে গিয়ে তারাই তো মরে।
ওভাবে ভাবছ কেন? প্রেগন্যান্সির লক্ষণ দেখলে বোলো, বিয়ের ব্যবস্থা করব।
সেটাই বুঝি খুব সহজ সমাধান? সবাই ঘাসে মুখ দিয়ে চলে না। প্রেগন্যান্সি হলে বাড়ির সবাই টের পাবে। ফিসফাস হবে, লোক জানাজানি হবে। অমলদা, তুমি আমার খুব ক্ষতি করলে। তোমার কথা ভাবলেই আমার ভিতরে একটা আলো জ্বলে উঠত। সেই আলোটা নিবে গেছে। আর জ্বলবে না।
কী করব পারুল, তোমার পায়ে ধরে ক্ষমা চাইব?
না, ক্ষমা চাইবে কেন? ক্ষমা চাইতে হয় কেন তোমাকে? একটু ধৈর্য ধরে রাখতে পারলে না কেন?
অপরাধী মুখ নিচু করে কিছুক্ষণ বসে রইল অমল। তারপর বলল, আমি মাঝে মাঝে বড্ড বেসামাল হয়ে পড়ি। কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। অনেক চেষ্টা করেছি নিজেকে সামলাতে। পারিনি। এমন পাগল হয়ে যাই তখন যে মাথায় খুন চেপে যায়। এ ব্যাপারে আমি এত হেলপলেস। ভাবছি ডাক্তার দেখাব। এ বোধহয় কোনও ডিজিজ।
তুমি যদি আমাকে ভালই বাসো তা হলে রেপ করো কী করে? এরকম কি কেউ করে?
যা হয়েছে হয়েই তো গেছে। কিছুতেই তো আর সেটাকে মুছে ফেলা যাবে না। বরং পজিটিভ কিছু ভাবি এসো।
না অমলদা, আমার মাথার ঠিক নেই। ভয়ে আতঙ্কে আমি মরে যাচ্ছি। আমি কিছু ভাবতে পারছি না। এ বাড়িতে এরকম ঘটনা আর কারও ঘটেনি। বিয়ের আগে– এ মা।
অমল মিনমিন করে ফের বলল, আমাদের বিয়ে তো হবেই। তখন তো আর এসব দুশ্চিন্তা থাকবে না।
থাকবে। তোমাকে নিয়ে আমার ভয় থাকবে। তোমার সংযম নেই, তুমি বেহাল হয়ে যাও, মেয়েরা তাদের পুরুষকে ওরকম দেখতে ভালবাসে না।
আমার মনে হয় এটা আমার একটা অসুখ। চিকিৎসা করালে নিশ্চয়ই সেরে যাবে।
এসব কথায় বুকের জ্বালাপোড়া একটুও কমল না পারুলের। তার ভিতরটাই যেন হঠাৎ মরে গেছে। ভালবাসা যেন খোঁটা উপড়ে পালিয়ে গেছে কোথায়। শুধু এক জৈব ভয় তাকে দিনরাত নখে দাঁতে ছিঁড়ে খাচ্ছে। শরীর যে তাদের মধ্যে এমন দেওয়াল তুলে দেবে কে জানত।
কুড়ি দিন দম বন্ধ করা টেনশন। পারুল ঘর থেকে বেরোত না। শুধু কাঁদত, মন খারাপ করে বসে থাকত, সারা রাত ভয়ে তার ঘুম হত না। আর ঠাকুর-দেবতাদের ডাকত। নিজের পেটে হাত রেখে অনুভব করার চেষ্টা করত সেখানে কোনও সম্ভাবনার জন্ম হচ্ছে কিনা। ওই কুড়িটা দিন তার জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময়। দুঃস্বপ্নের মতো। একুশ দিনের দিন রজোদর্শন করে সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। সে আর কুমারী নেই বটে, কিন্তু লোকলজ্জা থেকে বেঁচে গেল এ যাত্রা। বেঁচে গেল তার পরিবারও।
তাদের ঠিকে ঝি হেনার মা একদিন রান্নাঘরে মশলা পিষতে পিষতে পারুলের মায়ের সঙ্গে কথা কইছিল। পারুল সেটা শুনে ফেলে।
ওই ছেলের সঙ্গেই কি বিয়ে দেবে নাকি গো মা?
হ্যাঁ, সেরকমই তো কথা চলছে। ছেলে তো রত্ন। কপালে আছে কি না দেখি।
রত্ন কিনা জানি না বাপু, তবে বলে রাখছি ছেলের কিন্তু আলুর দোষ আছে।
কীসের দোষ?
আলুর দোষ গো। স্বভাব ভাল নয়।
কেন কী করেছে?
খড়্গপুরে যখন পড়ত রোজ বেশ্যাবাড়ি যেত।
অ্যাঁ!
আমার বর তো আই আই টি-তেই ঠিকাদারের কাছে কাজ করে। সে বলেছে। একটু ভেবেচিন্তে এগিয়ো বাপু।
সেদিন মায়ের ব্লাড প্রেশার বেড়ে শয্যা নেওয়ার জোগাড়। কিন্তু পারুল একটুও অবাক হল না। যে অত অসংযমী তার পক্ষে এটাই তো স্বাভাবিক। সঙ্গে সঙ্গে পারুলের আর একটা ভয় হল। বেশ্যাবাড়ি যখন যায় তখন আবার খারাপ রোগ-টোগ হয়নি তো! সেই রোগ যদি পারুলের শরীরেও ঢুকে থাকে!
এইভাবেই গাঁয়ের উজ্জ্বল যুবকটির প্রতি তার দুরন্ত প্রেমের অবসান ঘটে গেল একদিন। এমনকী আই আই টি-র পরীক্ষায় অমলের ফার্স্ট ক্লাস পাওয়ার খবরেও বিন্দুমাত্র উত্তেজিত হল না সে।
ওদের বাড়ি আর যেত না পারুল। অমল কিন্তু প্রায়ই আসত। পাসের খবর নিয়েও হাসিমুখে অমল এসেছিল। তখনও পারুলকে বিয়ে করার কথা ভাবছে। বসে বসে অনেক ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা বলছিল সেদিন।
বিদেশে তো আমাকে যেতেই হবে। ভাবছি তোমার পাসপোর্ট এখনই করিয়ে রাখলে হয়।
কেন?
তোমাকে নিয়েই যেতে চাই।
কেন, ওদেশে কি প্রস কোয়ার্টার নেই?
স্তম্ভিত অমল তার দিকে হাঁ করে চেয়ে থেকে বলল, কী বলছ?
কথাটা বলে লজ্জা পেয়েছিল পারুল। কাউকে সে চট করে অপমান করতে পারে না। মাথা নিচু করে বলল, কিছু না।
কিছুক্ষণ ম্লানমুখে চুপ করে বসে রইল অমল। তারপর দুখানা করুণ চোখে তার দিকে চেয়ে বলল, কে তোমাকে এসব বলেছে জানি না। তুমি কি এসব বিশ্বাস করো?
বিশ্বাস করব কিনা তা বুঝতে পারছি না। আমার মন ভাল নেই।
ভাবলাম আমার ভাল রেজাল্টের খবর পেয়ে তুমি খুশি হবে।
খুশি হইনি কে বলল? তবে নতুন কিছু তো নয়, তুমি বরাবরই ভাল ছেলে।
আবার কিছুক্ষণ মনোকষ্টে বসে থেকে ম্লান মুখে অমল বলল, তুমি আমার ভাবী স্ত্রী। ব্যাপারটা তুমি এভাবে দেখো। ধরো আমি একজন মনোরুগি, আমার রুচি এবং শালীনতাবোধ দিয়েও আমি আমার ভয়ংকর প্যাশনকে ঠেকাতে পারছি না। তুমি যদি সাহায্য কর তো পারব।
তুমি কি স্বীকার করছ তুমি প্রস কোয়ার্টারে যাও?
অনেকেই যায়। অনেক ভাল লোকে, গণ্যমান্য মানুষও যায়।
তুমি যাও কিনা সেটা নিয়েই আমার দুশ্চিন্তা।
যাই পারুল। আমাকে নিশিতে পায়। কিন্তু বিয়ের পর এভরিথিং উইল চেঞ্জ।
পারুল মাথা নিচু করে বলল, আমার মন ভাল নেই অমলদা। আমার মাথায় কিছু আসছে না।
আমি তোমাকে বড্ড ভালবাসি যে পারুল। সবসময়ে আমি তোমাকে চিন্তা করি। তোমাকে ছাড়া বেঁচে থাকা যে আমার পক্ষে অসম্ভব।
তাই তো জানতাম।
তুমি কত নরম-সরম মেয়ে ছিলে, আমাকে দেখলেই তোমার মুখে খুশির ঝাপটা লাগত, কত লজ্জা পেতে আমাকে। এখন তুমি কেমন শক্ত হয়ে গেছ, কেমন মনমরা। ওই একটা শরীরের ঘটনা কি আমার এত বড় অপরাধ? কত ছেলেমেয়েই তো বিয়ের আগে
ওসব বোলা না অমলদা, পায় পড়ি।
আচ্ছা পারুল, বলব না। তবে এটুকু বলে যাই, আজকের দুনিয়ায় ওসব কেউ গায়ে মাখে না। ওটা খুব তুচ্ছ ব্যাপার।
অনেকের কাছে হয়তো তাই।
হতাশায় মাথা নেড়ে বিষণ্ণ অমল বলল, না পারুল, তোমার চোখ বলছে তুমি আমাকে আর চাও না। কিন্তু আমার জীবনটা যে তাহলে বড় একার হয়ে যাবে। তোমাকে ছাড়া যে পারব না আমি। কিছুতেই পারব না। আমাকে কি তাহলে আত্মহত্যা করতে হবে?
ওসব বোলো না অমলদা। আমি এখনও তো তোমাকে কিছু বলিনি। আমাকে ভাবতে দাও। বড় মনে কষ্ট দিয়েছ আমায়। আমাকে এখন ভাবতে হবে।
ভেবে লাভ নেই পারুল। তোমার মনের কথা আমি বুঝতে পেরেছি। একটা ভুল করে ফেলেছি। কী আর করব।
একটু মায়া কি অবশিষ্ট ছিল না পারুলের মনে? ছিল। খুব ছিল। অমল রায় যে তাকে গভীর ভালবাসে তাও সে বোঝে। কিন্তু অমল রায়ের দিকে নিজেকে এগিয়ে দিতে কিছুতেই সে পারছে না। বাধা হচ্ছে।
অমল বোম্বেতে চাকরি পেয়ে চলে গেল। যাওয়ার আগে দেখা করে বলল, যদি ক্ষমা করতে পার তবে করো পারুল। চাকরি পেয়েছি। মাস দুয়েকের ভিতরে বিদেশেও চলে যেতে পারি। আমার খুব ইচ্ছে তোমাকে নিয়ে যাই। আমার কথা একটু নরম মন নিয়ে ভেবো পারুল।
পারুল ডাকের সুন্দরী। সারা তল্লাটে তার পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ ছিল না। বিজু বলত, তুই মিস ইন্ডিয়া হতে চাইলে ইজিলি পারবি ছোড়দি। কথাটা মিথ্যেও হয়তো নয়। নানা জায়গা থেকে তার বহু ভাল বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। অমল রায়ের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার কথা জানাজানি হয়ে যাওয়ার পর আর বিশেষ প্রস্তাব আসত না।
অমল রায় বোম্বে চলে যাওয়ার পরই একদিন পারুল তার মাকে বলল, তোমরা যদি আমার বিয়ে দিতে চাও তাহলে আর দেরি কোরো না।
মা ভ্রূ তুলে বলল, অমলকে?
না মা, তোমরা পছন্দ করে দেখো।
মা একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলল, বাঁচালি মা। ও ছেলে সম্পর্কে যা সব কানে আসছে আমার বুকটা কেমন দুরদুর করে। তোর জন্য তো পাত্রের অভাব হবে না।
হয়ওনি। পাত্রের গাদি লেগে গিয়েছিল। সুন্দরী মেয়েদের জন্য যা বরাবরই হয়। বিলেত আমেরিকা বা প্রবাসী বাঙালি সরিয়ে রেখে একজন ভালমানুষ, কর্মঠ, স্বনির্ভর লোককে বেছে নেওয়া হয়েছিল। পারুলের আপত্তি হয়নি। মানুষটি খুব সুপুরুষ নয়, কিন্তু তার চোখে একটা যোগীচক্ষুর ভাব ছিল। কষ্ট করে ওপরে উঠেছে। জামশেদপুরে তার নিজস্ব কারখানা। ছোট যন্ত্রাংশ তৈরি করে। সবচেয়ে বড় কথা, কর্মচারীরা তাকে ভীষণ পছন্দ করে।
বিয়ে হয়ে গেল। কাজটা অমল রায়ের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা হল কি না তা ভেবে পেল না পারুল। কিন্তু মনটা মেঘমুক্ত হয়ে গেল, সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল এবং লোকটাকে হঠাৎ ভালও বেসে ফেলল। স্বামী জ্যোতিপ্রকাশ গাঙ্গুলি তাকে স্পোকেন ইংলিশ শেখাল, সেক্রেটারিয়েটশিপ প্রশিক্ষণ নেওয়াল, এবং ঘরে বসিয়ে না রেখে ব্যবসার সঙ্গী করে নিল। কী সাংঘাতিক পরিশ্রমী মানুষটা! আর ভীষণ সৎ। কথার নড়চড় করে না কখনও। রাগ বলে কিছু নেই। একবারও ভালবাসার সাজানো বানানো মিথ্যে কথাগুলো বলেনি তাকে, কিন্তু পরম বিশ্বাসে নির্ভর করেছে পারুলের ওপর। এরকম সংবর্ধনা কটা স্বামী দিতে পারে তার স্ত্রীকে!
পারুল আজ অপেক্ষা করছে অমল রায়ের জন্য। এতদিন পর কেমন লাগবে মানুষটাকে? হয়তো তার জন্য কেঁদেছে লোকটা, মন খারাপ করেছে। কে জানে কী। এই কৌতূহল নিশ্চয়ই ক্ষমার যোগ্য। তারা বদলে গেছে।
গৌরহরি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রাদ্ধে আজ আসবে অমল রায়। মস্ত প্যান্ডেলের নীচে লোক জড়ো হচ্ছে ধীরে ধীরে। বহু লোক আসবে। পারুলের আজ ব্যস্ত থাকার কথা। তবু পারুল এক ফাঁকে আজ এসেছে বাগানে। একা। আজ সেই কিশোরীবেলার পারুলকে খুব মনে পড়ছে তার। কী ছেলেমানুষ ছিল সেই পারুল! কী বোকা।
হঠাৎ একটু শক্ত হয়ে গেল পারুল। মাত্র দু হাত দূর দিয়ে একটা লম্বা, প্রকাণ্ড গোখরো সাপ চলে যাচ্ছে। গলায় একটা ঢিবি। যেতে যেতে তাকে একবার পাশ-চোখে দেখে নিল কি? পারুল নড়ল না। পলকহীন চোখে চেয়ে রইল সাপটার দিকে। উচ্চাবচ ভূমি আর গাছ আর পাতার আড়ালে মিলিয়ে যাচ্ছে সাপটা।
বিড় বিড় করে পারুল বলল, আস্তিক মুনি, আস্তিক মুনি, আস্তিক মুনি।
.
০২.
সন্ধেবেলার ঝুঁঝকো আঁধারে হঠাৎ তাকে দেখে খুব অবাক আর খুশি হয়ে সন্ধ্যা বলে উঠল, পারুলদি না কি? ও মা, আয় আয় পারুলদি! কতদিন পর!
যারা কাজ করে, যারা বেঁচে থাকার জন্য ক্রমাগত লড়াই করতে থাকে তাদের সৌন্দর্য বুঝতে পারে পারুল। ভাবালু মানুষ বা কামুক কখনও এই সৌন্দর্য খুঁজে পায় না। তাদের চোখে সন্ধ্যা কালো, বেঁটে, একটু মোটা, ছোটো ছোটো চোখ এবং লাবণ্যহীন মুখ। বয়সও হল সন্ধ্যার। হিসেবমতো তেত্রিশ বা চৌত্রিশ।
সন্ধ্যা যখন আবেগবশে তাকে জড়িয়ে ধরল তখন তার গা থেকে ঘাম আর নানা মশলার একটা ঝাঁঝালো গন্ধ পেয়েছিল পারুল। সেন্ট, পাউডার, রূপটানের কোনও গন্ধ নয়।
এসবই পরশু দিনের কথা। এ-বাড়িতে গত কুড়ি বছর আসেনি পারুল। বাপের বাড়িতে এলেও এ বাড়িতে কখনও নয়। কিন্তু পরশুদিন নিশিতে পেয়েছিল তাকে, যখন শুনল, অমল রায়ের বউ আর ছেলেমেয়ে গাঁয়ের বাড়িতে এসে কয়েকদিন ধরে রয়েছে। অবাক হওয়ার মতোই খবর। পারুলের বিয়ের এক বছরের মধ্যেই অমল রায় বিয়ে করে। হয়তো পারুলের ওপর ওটা একটা নিষ্ফল প্রতিশোধ। তারপরই জার্মানিতে চলে যায়। বছর পনেরো বাইরে বাইরে কাটিয়ে বছর পাঁচেক হল কলকাতায় ফিরে বড় চাকরি করছে। গাঁয়ে আসবে কখন তারা? সবাই যে ভীষণ ব্যস্ত। আর আসবেই বা কেন? বুড়ো বাপ আজও বেঁচে আছে বলে অমল মাঝে মাঝে আসে। খুব দায় না ঠেকলে ওর বউ ছেলেমেয়েরা কখনও নয়।
আয়, ঘরে আয় পারুলদি। তোকে একটু দেখি।
সন্ধ্যার ঘরের মধ্যেও সেই ঝাঁঝালো মিষ্টি টকচা নানারকম গন্ধের রেণু উড়ছে। সারাদিন ও কাসুন্দি, আচার, ডালের বড়ি, আমসত্ত্ব, আমলকীর মুখশুদ্ধি, জোয়ানের হজমি, পাঁপড় এই সব তৈরি করছে। ঘরে উদুখল থেকে শুরু করে প্রকাণ্ড শিল-নোড়া, মশলা গুঁড়ো করার যন্ত্র আর শিশি বোতলের ছড়াছড়ি। ভোল্টেজ কম থাকে বলে ইলেকট্রিকের বাতিতে ঘর আলো হয় না। তাই একটা কেরোসিনের টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে। একটা মোটা মোমবাতির আগুনে দুটো অল্পবয়সি মেয়ে মেঝেতে বসে প্লাস্টিকের প্যাকেটের মুখ জুড়ছে।
ভারী ভাল লাগল পারুলের। একটুও ভাবালুতা নেই সন্ধ্যার। সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে ও জীবনের একটা হারা লড়াই অন্যভাবে জেতার চেষ্টা করছে।
কত কালো কুচ্ছিত মেয়েরও কত ভাল বিয়ে হয়ে যায়, সুখেই ঘরকন্না করে তারা। সন্ধ্যার কপালটা তত ভাল নয়। তার জন্য পাত্র খুঁজে খুঁজে হয়রান মহিমকাকা অবশেষে দুর্গাপুরের এক পাত্র পেয়ে লটারি জেতার মতো মুখ করে ফিরলেন। পারুল শুনেছে, পাত্রপক্ষের খাঁই ছিল। পঁচিশ হাজার নগদ এবং গয়না আর জিনিসপত্রের বহর বড় কম ছিল না। বিয়ের দু মাসের মাথায় সন্ধ্যা ফেরত হল। কী, না এ পাত্রীকে বরের পছন্দ হচ্ছে না। এমনই অপছন্দ যে, পাত্র বিয়ের পর দুবার বিবাগী হয়ে গিয়েছিল। না, সে সন্ধ্যাকে মারধর করেনি, অত্যাচারও নয়। এর টেকনিক ছিল অন্যরকম। সে নাকি কান্নাকাটি করে সন্ধ্যার কাছ থেকে মুক্তি চাইত। এমনকী পায়ে অবধি ধরতে বাকি রাখেনি। এমন নারাজ পুরুষের সঙ্গে থাকেই বা কী করে সন্ধ্যা? তবু সে তার বরকে বলেছিল, আমি কুচ্ছিত হতে পারি, কিন্তু খেটেপিটে সব পুষিয়ে দেবো। তোমার এমন যত্ন করব যা কেউ কখনও করেনি। একদিন দেখবে আমার চেহারাটার কথা তোমার আর মনেই থাকবে না। আমাকে ফিরিয়ে দিও না, তা হলে আমি লজ্জায় মুখ দেখাতে পারব না। গলায় দড়ি দিতে হবে আমাকে। এ কথা শুনে তার বর ভেউ ভেউ করে কেঁদেছিল।
সেটা অভিনয় কিনা বোঝা যায়নি। অত বুদ্ধি সন্ধ্যার নেই। কান্নার জবাবে সেও কেঁদে ফেলেছিল। তার বর অনুনয় বিনয় করে বলেছিল, তুমি মোরো না। মরলে আমার বড় কষ্ট হবে। তুমি মরলে আমাকেও মরতে হবে।
কেউ মরেনি শেষ অবধি। বরের সঙ্গে সন্ধ্যার আইনমাফিক ডিভোর্সও হয়নি। বর বলেছিল, ডিভোর্স করলে অনেক হাঙ্গামা। তুমি ব্যাপারটা মেনে নাও। আমি জানি তুমি ভাল মেয়ে, কিন্তু আমার যে কোনও উপায় নেই।
সন্ধ্যা চলে এল। বর তাকে বর্ধমান স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে বাসেও তুলে দিয়ে গেল। চোখের জল ফেলতে ফেলতেই বিদায় নিল। নিজের বর সম্পর্কে একটা ধাঁধা তাই আজও আছে সন্ধ্যার। ফেরত হওয়ার পরও তার আশা ছিল মানুষটা হয়তো ভালই। একদিন ভুল বুঝতে পেরে তাকে ফের নিয়ে যাবে।
তা অবশ্য হয়নি। লোকটা বছরখানেক বাদেই আর একটা মেয়েকে বিয়ে করে ফেলে। সন্ধ্যা খবরটা পেয়েও মামলা মোকদ্দমা করতে যায়নি। কী হবে হাঙ্গামা করে? গাঁয়ে তাদের পরিবারের একটা সম্মান তো আছে। আশ্চর্যের বিষয় তার দাদারাও কেউ তার হয়ে লড়তে যায়নি, কোনও ব্যবস্থাও করেনি খোরপোশ আদায়ের। শুধু তার বাবা মহিম রায় গিয়ে জামাইয়ের সঙ্গে দেখা করেন। জামাই তাঁরও পায়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে “আমাকে জুতো মারুন, আমাকে ফাঁসি দিন” বলে অনেক বিলাপ করে। মহিম রায় অপ্রস্তুত হয়ে ফিরে আসেন।
মনের বিষণ্ণতা এবং ঘটনার আকস্মিকতা কাটতে এবং চোখের জল শুকোতে একটু সময় লাগল সন্ধ্যার। বছর দুয়েক। তার মধ্যেই সে বুঝে গেল সংসারে তার অবস্থান গলগ্রহের মতো। কোনও সম্মান নেই, কেউ গুরুত্ব দেয় না, বাঁকা কথা কানে আসে, পাড়া প্রতিবেশীরাও টিটকিরি দিতে ছাড়ে না।
এই অপমান ভুলতেই একদিন সে কাজে নেমে পড়ল। কাজে তার কখনও কোনও আলস্য ছিল না। বরাবরই তার শরীর খুব মজবুত। প্রথমে আচার নিয়ে পড়ল সন্ধ্যা। তারপর কাসুন্দি। অনভিজ্ঞতার ফলে দাম হয়ে গেল বেশি। নগেন হালদার নামে একটা ফড়ে ধরনের লোক এসে একদিন বলল, ওভাবে কি হয় দিদি? দামের ঘাট বাঁধা আছে। খরচ কমাও, নইলে পরতায় আসবে না। ব্র্যান্ডের মালের চেয়ে কম দামে না দিলে লোকে নেবে কেন? তা নগেন হালদারই তাকে খুব সাহায্য করল। এমনকী তার তৈরি জিনিস শহরের দোকানে দোকানে পৌঁছে দেওয়া অবধি। একটু একটু করে পয়সা আসতে লাগল। গত সাত আট বছর ধরে সন্ধ্যার যে-পরিশ্রম তার ফল আজ সে পায়। ব্যবসা তার বিরাট বড় কিছু নয়, কিন্তু তার জিনিস চলছে শহরে গাঁয়ে, চাহিদা বেড়েছে। এখন মাসে তার কম করেও তিন চার হাজার টাকা রোজগার।
পারুল এ সবই জানে। তিন রকম আলোয় সন্ধ্যার মুখশ্রীতে সে যে সৌন্দর্য আজ দেখতে পেল তা সে আগে দেখেনি।
সন্ধ্যা তাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে নিজে একটা টুলে মুখোমুখি বসে দুঃখের গলায় বলল, হরিজ্যাঠা মারা যাওয়ায় এত খারাপ লেগেছিল যে কী বলব। মনে হল আপনজনই কেউ চলে গেল। আপনজনই তো, না কী বল পারুলদি! হরি জ্যাঠা মরে যাওয়াতে বাবাও খুব ভেঙে পড়েছে। কেবল বলছে, এই হরিদা চলে গেল, এবার আমার পালা।
পারুল বলল তা কেন, মহিমকাকা তো বাবার চেয়ে অনেক ছোট।
অনেক নয়। বাবা তো বলে পাঁচ ছয় বছরের তফাত। আজকাল কারও মরার খবর পেলেই বাবা কেমন ধড়ফড় করে।
এই বয়সে হয়।
বাবার ঊনআশি চলছে। আমাদের সকলেরই কেমন বয়স হয়ে যাচ্ছে, না রে পারুলদি?
তোর আবার বয়স হল কোথায়? বেশ তো আছিস। তোকে দেখে আমার বড্ড ভাল লাগছে। বেশ নিজের চেষ্টায় দাঁড়িয়ে গেছিস।
সলজ্জ হেসে সন্ধ্যা বলে, দাঁড়ানো মানে আর কী? আমার তো ছোট ব্যবসা। কষ্টেসৃষ্টে চলে যায়।
পাড়াগাঁয়ে থেকে যা করেছিস ঢের করেছিস। তোর রোখ আছে, আর এইজন্যই তোকে ভাল লাগে।
এইটুকুর জন্যই বেঁচে গেছি পারুলদি। নইলে এ-বাড়িতে ঝি-গিরি করে খেতে হত।
সেই লোকটা আর খোঁজখবর করেনি, না?
না। খোঁজখবর করবেই বা কেন? সুখে সংসার করছে।
তোরা কাজটা ভাল করিসনি সন্ধ্যা। লোকটাকে ছেড়ে দিলি কেন? একটু শিক্ষা দেওয়া উচিত ছিল।
ধরতেই তো পারলুম না, ছেড়ে দেওয়ার কথা বলছিস কেন? ওসব আর ভাবিই না। আমার কপালের দোষ। তোর মতো সুন্দর হয়ে জন্মালে কি আর সে আমাকে ছাড়ত?
পারুলের খুব দুঃখ হল কথাটা শুনে। একটু ভেবে বলল, তুই যে কত সুন্দর তা দেখার মতো চোখ কটা পুরুষের আছে? এই যে দিনরাত হাড়মাস নিংড়ে কাজ করছিস, এই যে স্নো-পাউডার মাখিস না, সাজিস না, এই যে লড়াই করছিস এর জন্যই তো তুই সুন্দর।
সে তো তোর চোখে। পাঁচজনের চোখে তো নয়।
বউ সুন্দর হলেই বা। স্বামীর চোখে সেই সৌন্দর্যের আয়ু কতটুকু? কিছুদিন পর তো আর হাঁ করে তাকিয়ে বউয়ের সুন্দর মুখ দেখে এলিয়ে পড়বে না। তখন অন্য সব পয়েন্ট প্রমিনেন্ট হবে, কাজের মেয়ে কি না, বুদ্ধিমতী কি না, যত্নআত্তি করে কি না।
সে তো ঠিক কথাই পারুলদি। কিন্তু সে কথা ওই মেনিমুখোকে বোঝাতে পারলুম কই? আমি কাছে গেলেই ওর বোধহয় মনে হত একটা ভালুক আসছে।
পারুল হেসে ফেলল।
সন্ধ্যাও একটু হেসে বলে, তোর ব্যবসার কথা বল পারুলদি। তোর বর নাকি মস্ত ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট।
দুর বোকা, বড় ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট হওয়া কি সোজা? আদিত্যপুর ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেটে আমাদের কারখানা। ছোট ছোট পার্টস তৈরি হয়। তেলের লাইনের জয়েন্ট, আরও সব ছোটখাটো জিনিস। টাটা স্টিল, টাটা অটোমোবাইল, রেল এরাই নেয়। কিন্তু এই একরত্তি একটা জিনিস তৈরি করতেও কতরকম ড্রয়িং, কত মাপজোখ, আর আটটা নটা অপারেশন দরকার হয়। তাই ভাবি বড় বড় কলকারখানায় আরও কত কমপ্লিকেটেড বাপার। ভাবলে মাথা ঘুরে যায়।
তুই আগের চেয়েও সুন্দর হয়েছিস। একটুও মোটা হসনি। পারুলদি, তুই যে কেন মেজদাকে বিয়ে করলি না! তা হলে আজ হাঁফ ছেড়ে বাঁচতুম।
কেন রে? অমলদার বউকে কি তোর পছন্দ নয়?
এতক্ষণ সন্ধ্যার মুখে যে নির্লিপ্ত, হাসিখুশি, আলগা ভাবটা ছিল সেটা তীব্র ভ্রূকুটিতে মুখোশের মতো খসে পড়ে গেল। চাপা গলায় বলল, পছন্দ! ওরকম একটা বিচ্ছিরি স্বভাবের মেয়েমানুষকে আবার পছন্দ!
পারুল অবাক হয়ে বলে, কেন, কী করলেন উনি? ঝগড়া নাকি?
সে করলেও ভাল ছিল। ঝগড়ায় অনেক সময়ে সম্পর্ক পরিষ্কার হয়ে যায়। এ তো সে রকম নয়। মনের ভিতরে চক্কর। এ-বাড়ির কাউকে মানুষ বলেই মনে করে না। কিন্তু খুব মিষ্টি করে হেসে আর হাবেভাবে সেটা বুঝিয়ে দেবে, গলা তুলবে না, চেঁচাবে না।
তাই বুঝি?
এখন খুব মনে হয়, তোর সঙ্গে যদি মেজদার বিয়ে হত কী ভাল হত তবে। হ্যাঁ রে পারুলদি, তুই নাকি ভাল ইংরিজি বলতে পারিস?
পারুল হেসে বলে, পারব না কেন? আমার বরের পাল্লায় পড়ে শিখতে হয়েছে। কত অবাঙালি বা সাহেবসুবোকে নিয়ে ডিল করতে হয়, না শিখে উপায় আছে!
ওদের একটু ইংরিজি শুনিয়ে দিয়ে আয় না!
পারুল অবাক হয়ে বলে, ইংরিজি শোনাব কী রে? কেন?
ওরা বুঝুক গাঁয়ের মেয়েরাও ইংরিজি বলতে পারে।
পারুল হেসে বলে, তাতে কী লাভ হবে বল তো! ওরা খুব ইংরিজি বলে নাকি?
দিনরাত মায়েতে আর ছেলেমেয়েতে কেবল ইংরিজিতে কথা হচ্ছে। আমাদের নিয়ে খারাপ খারাপ কথা বলে। ঠিক বুঝতে পারি না, হাবেভাবে টের পাই। চল না পারুলদি, গিয়ে মুখের ওপর ইংরিজি বলে আসবি।
পারুল স্মিত মুখে বলে, সেটা ঠিক হবে না। ওদের সঙ্গে আমার পরিচয় নেই, পরিচয় করার ইচ্ছেও নেই। আর ইংরিজি বলাটাও কোনও ক্রেডিট নয়। কিন্তু তুই ওদের ওপর রেগে আছিস কেন?
সন্ধ্যার মুখে আবার একটা শান্ত বিষণ্ণতা দেখা দিল। বলল, দেখ পারুলদি, তুই তো আমার কত প্রশংসা করলি। কিন্তু আমি ভিতরে ভিতরে নিজেকে নিয়ে লজ্জায় মরে থাকি। দেখতে কালো কুচ্ছিত, স্বামী নেয় না, তার ওপর তেমন লেখাপড়াটাও হয়নি। অমল রায়ের মায়ের পেটের বোন বলে কি আমাকে চেনা যায় বল? তার ওপর দিনরাত কামিনের মতো খাটি, তাতেই ওরা বোধহয় আমাকে লেবার ক্লাসের লোক বলে মনে করে। ছেলেমেয়ে দুটো কখনও আমাকে পিসি বলে ডাকে না। দ্যাট উওম্যান বলে কী সব যেন নিজেদের মধ্যে বলে। তাই ভাবি, তুই মেজদাকে বিয়ে করলে কত ভাল হত। কেন হলি না রে পারুলদি? মেজদার কোনও দোষ ছিল?
দোষ কার মধ্যে নেই? ওসব কথা থাক।
তুই মেজদার কথা আর ভাবিস না, না রে?
ও মা! ভাবব না কেন? সকলের কথাই ভাবি।
তোদের মধ্যে কত ভালবাসা ছিল।
পারুল একটু হেসে বলল, আজকাল ভালবাসা কথাটা শুনলেই আমার যে কী বিচ্ছিরি লাগে। টি ভি খুললেই ভালবাসা, বই খুললেই ভালবাসা, সিনেমায় গেলেই ভালবাসা। যত ভালবাসার বাদ্যি বাজছে তত ভালবাসা জিনিসটাই উবে যাচ্ছে।
তা হলে তোদের মধ্যে কী ছিল?
যা ছিল তা ওই সিনেমা টিভি উপন্যাসের মতোই, বিজ্ঞাপনের মতো ব্যাপার। আসলে ছিল কি না পরীক্ষাই হয়নি। আর ও বয়সটাও তো বুঝবার মতো বয়স নয়।
কী জানি বাবা, সেই ছেলেবেলা থেকেই তো জেনে এসেছি তুই আমার মেজো বউদি হবি। কিন্তু শেষ অবধি হল একটা–
পারুল হাসছিল। বলল, থামলি কেন?
একটা খারাপ কথা মুখে আসছিল, সেটা আটকালুম।
ভাল করেছিস। হ্যাঁ রে, অমলদার বউকে আড়াল থেকে একবার দেখিয়ে দিস তো!
আড়াল থেকে কেন? আলাপ করলেই তো হয়।
না, আলাপ করব না।
কেন রে?
আমার কেন যেন ইচ্ছে করছে না। শুধু দেখলেই হবে।
সন্ধ্যা মৃদু হেসে বলে, তোর কিন্তু এখনও একটু হিংসে আছে। ভয় নেই, সে তোর কড়ে আঙুলের নখেরও যুগ্যি নয়। দেখবি? আয় তবে। এখন ওরা নিজেদের ঘরে বসে কথা কইছে। ঝগড়াই হয় বেশির ভাগ।
ঝগড়া?
হ্যাঁ, মা আর মেয়েতে।
কী নিয়ে ঝগড়া?
সে কি আর বুঝতে পারি? ইংরিজিতে ঝগড়া। সন্দেহ হয় মেয়েটা কোনও কেলেঙ্কারি করে এসেছে। নইলে এ সময়ে হঠাৎ গাঁয়ে এসে বসে আছে কেন? পুজোর ছুটিও শুরু হয়নি, স্কুল কলেজ সব খোলা।
মেয়েটার বয়স কত?
ষোলো সতেরো তো হবেই।
পারুল একটু আনমনা হয়ে গেল। তারও তখন সতেরো বছর বয়স। মেয়েদের যৌবন মানেই চার দিকে পুরুষদের মধ্যে গুনগুন করে বার্তা পৌঁছে গেল, মেয়েটা সোমত্ত হল, ডাগর হল হে। কামগন্ধ উড়ল বাতাসে। আপনা মাসে হরিণা বৈরী। এই বয়সেই বাঘে খেয়েছিল তাকে। প্রেমিকের মতো নয়, লুঠেরার মতো তার কুসুম ছিন্ন করেছিল অমল। কিন্তু তাদের আমল আর নেই। এখন যৌবনের কেলেঙ্কারিকে অত কি আমল দেয় মা বাপেরা? যুগ কত পালটে গেছে। তার ওপর এরা বিদেশেও ছিল, যেখানে শরীর হল জলভাত।
যাবি ওপরে পারুলদি?
গিয়ে?
মেজদার বউকে দেখবি বললি যে!
ও হ্যাঁ। কিন্তু আড়াল থেকে।
হ্যাঁ, আমি তো আড়াল থেকেই দেখি। মায়ের ঘরের দরজায় একটা ফাঁক আছে। ঘরের আলো নিবিয়ে–
অমলের বউকে দেখার ইচ্ছেটা হঠাৎ কেন যেন উধাও হল পারুলের। তবু সে উঠল।
সন্ধ্যার মা মারা গেছে বছর দশেক। এ-ঘরে এখন আর কেউ থাকে না। মহিম রায় সিঁড়ি ভাঙতে অপারগ বলে আজকাল একতলায় থাকেন। দু ঘরের মাঝখানে বন্ধ দরজার ফাটলে চোখ রেখে সন্ধ্যা আগে দেখে নিল। তারপর চাপা গলায় বলল, মেয়েটা নেই। মায়ে পোয়ে বসে আছে। দেখ।
পারুল দেখল। কোন কোনও মহিলা আছে যাদের রূপ যেন পুরুষের দিকে তেড়ে আসে। সব কিছুই যেন বড় বেশি উগ্র। অমলের বউকে সুন্দরী বলতেই হবে। তবে সেটা বড় উচ্চগ্রামে বাঁধা। অতি ফর্সা, নাক অতি টিকোলো, চোখ অতি টানা, ঠোঁটে নিষ্ঠুর ক্ষীণতা। শরীরটা কাঠ-কাঠ। মেয়েলি ভাব একটু যেন কম। আর বয়সটাও একটু বেশি, অমলের কাছাকাছি।
বেশ সুন্দরীই তো রে।
আহা, ওকে সুন্দর বলে নাকি?
মেমসাহেব-মেমসাহেব দেখতে।
স্বভাবও মেমসাহেবদের মতোই। এঁটোকাঁটা মানে না, বাঁ হাতে জল খায়।
মুখটায় একটু টেনশন আছে।
বলেছি না, দিনরাত ঝগড়া হচ্ছে। মুখে মেচেতা আছে, দেখেছিস?
ছেলেটা এদিকে পিছু ফিরে ছিল। একবার মুখ ঘোরাতেই বোঝা গেল, ছেলের মুখ তার মায়ের মতো।
মেয়েটা কোথায় গেল?
হাঁটাহাঁটি করতে গেছে বোধহয়। দিনরাত তো তিনজনে ঘরবন্দি হয়ে থাকে।
তোদের সঙ্গে কথা বলে না?
না। শুধু বড়দার সঙ্গে। তাও কাজের কথা। এটা ওটা আনতে ফরমাশ করে।
সরু সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় মেয়েটার সঙ্গে মুখোমুখি দেখা। মেয়েটা দু-তিন সিঁড়ি উঠে এসেছিল, তাদের পাশ দেওয়ার জন্য নেমে দাঁড়াল। সিঁড়ির মাথায় টিমটিমে ডুমের আলোয় মেয়েটাকে দেখল পারুল। ফুটফুটে সুন্দর ডল পুতুলের মতো মেয়ে। মায়ের মতো কাঠ-কাঠ ভাব নেই শরীরে। একেবারেই মেয়েলি মেয়ে। মুখে হয়তোবা অমলের আদল আছে। তবে অমল সুপুরুষ ছিল না। মুখে বাপের আদল থাকলেও মেয়েটা কিন্তু খুব সুন্দর।
মেয়েটা তাকে দেখছিল। একটু অবাক হয়েই দেখছিল। উঠোনের ওপাশে সন্ধ্যার ঘরের দরজায় উঠে ফিরে দেখল পারুল, মেয়েটা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে আছে।
সন্ধ্যার ঘরে আরও প্রায় আধঘণ্টা বসে কথা কইল পারুল। সবই পুরনো কথা, ছেলেবেলার কথা।
যে মেয়ে দুটো বসে কাজ করছিল তারা চলে যাওয়ার পর হঠাৎ লাজুক মুখে সন্ধ্যা বলল, দেখ পারুলদি, তোকে একটা কথা বলব?
বল না। কী কথা রে?
একটা ছেলে–হি হি–একটা ছেলে আমাকে বিয়ে করতে চাইছে।
পারুল অবাক হল না। এরকম তো হতেই পারে। বলল, কে রে?
তুমি চিনবে না। যারা আমার জিনিস নিয়ে দোকানে দোকানে সাপ্লাই করে তাদেরই একজন। বামুনের ছেলে।
প্রেমে পড়েছে নাকি? তুই পড়লি, না ও পড়ল?
দুর! সেসব নয়। আসলে আমাদের ওসব করার সময় নেই, প্রেম আবার কীসের? ও বলে বিয়ে করলে ব্যবসাটা বাড়ানো সহজ হবে। দুজনে মিলে একটা পার্টনারশিপের মতো হয় তা হলে।
পারুল একটু ভেবে বলল, খারাপ কী? মহিমকাকাকে বলেছিস?
না। কেউ জানে না। আমরা তো আর ঢলাঢলি করি না। তোমাকেই প্রথম বললুম।
তোর এখন কিছু টাকা হয়েছে সন্ধ্যা, আর সেইটেই ভয়। টাকার লোভে যদি বিয়ে করতে চেয়ে থাকে তা হলে সাবধান হওয়া ভাল।
আমিও অনেক ভাবছি। হিসেব-নিকেশ করছি। বাড়ির লোকেই বা কী ভাববে বল! আমি তাই এখনও মত দিইনি।
খুব ঝোলাঝুলি করছে নাকি?
না না, সেসব নয়। অত আঠা নেই আমাদের। শুধু বলেছে বিয়ে করলে পরস্পরকে বিশ্বাস করতে সুবিধে হবে।
তোকে কিন্তু খুশি-খুশি দেখাচ্ছে।
মা কালীর দিব্যি, খুশি-টুশি নয় রে, বরং ভয়ে বুক শুকিয়ে আছে। নেড়া আবার বেলতলায় যাওয়ার আগে একটু ভয় পাবে না, বল?
ছেলেটা যদি ভাল হয় তবে বিয়ে করে ফেল সন্ধ্যা। নইলে যখন বয়স হবে তখন দেখবি এককাঁড়ি টাকা ছাড়া আর তোর কিছু নেই।
কিন্তু কী জানিস পারুলদি, ওই লোকটার জন্য আমার আজও একটু কেমনধারা মায়া আছে। বাজে লোক, খুব পাজি লোক, তবু কেমন যেন মনে হয়, বিয়ে করলে একটা বুঝি পাপ-টাপ কিছু হবে। এটা বোধহয় কুসংস্কার, না রে?
পারুল মাথা নেড়ে বলে, আমার তা মনে হয় না। কুসংস্কার কেন হবে! লোকটা পাজি হোক, শয়তান হোক, তুই হয়তো তবু ভালবেসেছিলি। তুই তো বোকা। আর বোকারাই অন্ধের মতো ভালবাসতে পারে। চালাকরা পিছল প্রাণী।
তাই ভাবছি।
তা হলে আরও ভাবতে থাক। যা করবি ভেবে করিস।
আমার কথা তুইও একটু ভাবিস পারুলদি। ভেবে একটা বুদ্ধি দিস। আমার একদম বুদ্ধি নেই।
ভাবতে ভাবতে অন্ধকার উঠোনটা পার হচ্ছিল পারুল। অমল রায়ের বউকে দেখার জন্য এত কৌতূহল কেন তার? এতদিন বাদে সে কি নিজের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে চেয়েছিল ওকে? ওই জায়গাটা তারই বাঁধা ছিল বলে তার কি আজও একটু দুঃখ আছে? না তো! নিজের মনকে সে খুব ভাল চেনে না বটে, কিন্তু এতদিনের বিবাহিত জীবনে অমল রায়ের জন্য তার কোনও দুঃখবোধ ছিল না তো! পড়তি বয়সে তাহলে এসব কী হচ্ছে? কেন হচ্ছে? অমল তো তার নাকচ করা পুরুষ।
এক তুমুল বর্ষার রাতে ভিতরে চেপে রাখা গোপন কথার কীটদংশন সইতে না পেরে সে তার স্বামী জ্যোতিপ্রকাশকে সবই বলে দিয়েছিল। তার মনে হয়েছিল, সব প্রকাশ না করলে জ্যোতিপ্রকাশের সঙ্গে তার জীবনটা সম্পূর্ণ হবে না। খাদ থেকে যাবে। ভারমুক্ত হতে পারবে না সে।
শান্ত মানুষ জ্যোতিপ্রকাশ মন দিয়ে সব শুনল। তারপর বলল, শরীরের তো পাপ নেই, পাপ মনে। মনে যদি শিকড়বাকড় না থাকে তবে আর ভয় কী?
না, আমার মনে কোনও দুর্বলতা নেই।
তাহলে সব ঠিক আছে পারুল। মেয়েদের মনে একাধিক পুরুষের ছাপ থাকলে তার সন্তান অস্থিরমতি হয়।
কী করে জানলে?
জানি। যে মেয়ের মন একমুখী, কোনও কারণে তার দেহ অশুচি হলেও খুব ক্ষতি হয় না। তার সন্তান ভালই হওয়ার কথা।
তুমি শুধু সন্তানের কথা ভেবে বলছ?
বিয়ের উদ্দেশ্যই তো সন্তান। তার জন্যই শরীর লাগে, মনও লাগে। কোনওটাই তুচ্ছ নয়। সন্তান মানে সমতান। একদিন আমাদের জৈব প্রয়োজন শেষ হয়, আয়ু ফুরোয়, তখন ওই সন্তানের ভিতর দিয়ে আবার আমরাই বেঁচে থাকি।
জ্যোতিপ্রকাশ একটু প্রাচীনপন্থী, একটু গোঁড়াও হয়তো। আর কেন যেন সেই কারণেই লোকটার ওপর নির্ভর করতে ভরসা পায় পারুল।
নিজের রূপ নিয়ে বিয়ের পরও ঝামেলা কিছু কম হয়নি। জান সিং এক মস্ত খদ্দের তাদের। লম্বা-চওড়া আখাম্বা চেহারার রূপবান পুরুষ। কিছু তরলমতি এবং ফুর্তিবাজ। লোকটা জান-কবুল প্রেমে পড়ে গিয়েছিল পারুলের। কাণ্ডজ্ঞানরহিত অবস্থায় সে একদিন অফিসঘরে একলা পেয়ে পারুলের হাত চেপে ধরে বলল, আমার অনেক টাকা আছে। দিল্লি আর হরিয়ানায় আমার অনেক সম্পত্তি। চলো আমার সঙ্গে।
পারুল সেই শক্তিমান পুরুষটির দিকে চেয়ে ফের অমল রায়কেই দেখতে পেয়েছিল। সে খাদ্য, পুরুষেরা খাদক। সে মিষ্টি ও কঠিন করে বলেছিল, আমি আমার স্বামীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করি একটা কিছু গড়ে তোলার জন্য। মানুষ সবসময়েই কিছু গড়ে তুলতে চায়। আবহমানকাল ধরে মানুষের সেই চেষ্টা। তুমি সব ভেঙে দিতে চাও? ছক উলটে দেবে? মিসমার হয়ে যাবে সব? তুমি আমাদের মস্ত ক্লায়েন্ট সিং সাহেব, কিন্তু তোমাকে ছাড়াও আমাদের চলে যাবে।
জান সিং বার্তা পেয়ে গেল। কিন্তু হাত ছেড়ে দিয়ে সে বলেছিল, দেয়ার ইজ সামথিং উই কল লাভ। আই অ্যাম ইন লাভ উইথ ইউ। সেই প্রেমটাকে একটা সম্মান তো দেবে?
আমার ভালবাসা শুধু পুরুষমানুষ নিয়ে তো নয়। আমি এবং আমার স্বামী উই শেয়ার বেড, বিজনেস, বিয়ারিংস। আমাদের ভালবাসা হুট করে হয়নি, ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছে। হুট করে তা ভেঙেও যাবে না। আমি দমকা প্রেমে বিশ্বাস করি না।
ডু ইউ অ্যাডোর মি?
না সিং সাহেব, আই ডোন্ট অ্যাডোর ইউ। ইউ আর এ বিগ অ্যান্ড উইক ম্যান।
একটা মেয়েই জানে কতরকম লড়াই একটা মেয়েকে গোপনে এবং একা করে যেতে হয়। প্রত্যাখ্যানের পর প্রতিশোধের পালাও শুরু হয় কখনও কখনও। বদনাম ছড়ানো, মুখে অ্যাসিড মারা, খুন অবধি। জান সিং বহু টাকার অর্ডার ক্যানসেল করল, গুণ্ডা লাগিয়ে কারখানায় গোলমাল পাকাল। খুব অশান্তি গিয়েছিল কয়েক দিন।
জান সিং একাই তো নয়। কেউ গভীরভাবে তার প্রেমে পড়েছে, কেউ হালকা ফুর্তি লুটে নিয়ে যেতে চেয়েছে, কেউ নানা সুবিধে করে দেওয়ার টোপ ফেলেছে, কেউ নিজেকে ময়ূরের মতো সাজিয়ে জাহির করেছে। আর ট্রেনে বাসে গায়ে অঙ্গ স্পর্শ করানো তো আছেই। খদ্দের সবাই। প্রায় সবাই। সারি সারি মুখ মনে পড়ে যায় তার। নির্লিপ্ত মানুষও কি নেই? ঢের আছে। তাই সব পুরুষকে সে ঘেন্না করে না, বেছে বেছে করে। মুখচোখ দেখেই তার মেয়েলি অ্যান্টেনায় পুরুষের তরঙ্গ ঠিক ধরা পড়ে।
তবু অমল রায়ের প্রতি তার কেন কৌতূহল? কেন এখনও? নিজেকে এই প্রশ্নের ছোবলে ছোবলে অস্থির করে তুলে সে খুব আনমনে টর্চের আলো ফেলে ফেলে বড় উঠোনটা পার হচ্ছিল।
পিছন থেকে সন্ধ্যা বলল, আবার আসিস পারুলদি।
পারুল কথাটা শুনতেই পেল না। উঠোন পেরিয়ে সরু কাঁচা রাস্তা, দুধারে গাছপালার ডালপাতা গায়ে লাগছিল তার। আচমকাই কামিনী ঝোপটার পাশে টর্চের আলোয় মেয়েটাকে দেখতে পেল সে।
পরনে হলুদ রঙের কুর্তা সালোয়ার।
থমকে দাঁড়াল পারুল। মেয়েটা এখানে কী করছে?
পারুল হয়তো কথা না বলেই পাশ কাটিয়ে চলে যেত। কিন্তু মেয়েটাই হঠাৎ পরিষ্কার বাংলায় বলল, আপনি পারুল না?
“পারুল” শুনে ভ্রূ কোঁচকাল পারুল। পিসি বা মাসি বা দিদি নয়, শুধু পারুল! অবশ্য ওরা বিদেশে ছিল, সেখানে এরকমই রেওয়াজ।
পারুল রাগ না করে স্নিগ্ধ গলাতেই বলল, হ্যাঁ। তুমি আমাকে চিনলে কী করে?
আমি সোহাগ, অমল রায়ের মেয়ে। আমাদের অ্যালবামে আপনার একটা ছবি আছে।
আমার ছবি! আশ্চর্য!
মাই ড্যাড অ্যাডোর্স ইউ।
ঝম করে লজ্জার একটা ঝাপটা লাগল তার মুখে। পারুল বলল, তাই নাকি? হতে পারে। আমরা তো এক গাঁয়েরই মানুষ।
আপনার যে ছবিটা আমাদের অ্যালবামে আছে সেটা অনেক কম বয়সের। বোধ হয় সতেরো আঠেরো।
উদাস গলায় পারুল বলে, তা হবে।
ইউ আর এ ভেরি বিউটিফুল উওম্যান।
তুমিও তো সুন্দর।
মে বি। কিন্তু বাবা বলে আপনার মতো নাকি বাবা আর কাউকে দেখেনি।
অমলদা এসব বলেছে বুঝি তোমাদের।
হ্যাঁ। আমাদের মধ্যে খুব ফ্র্যাঙ্ক আর ট্রুথফুল কথা হয়।
তাই বুঝি!
আপনার যে বয়সের ছবিটা আমাদের অ্যালবামে আছে বোধহয় সেই বয়সেই ইউ ওয়্যার ডি-ফ্লাওয়ারড বাই মাই ড্যাড।
পারুলের শরীর সিঁটিয়ে গেল লজ্জায়। বুকের ভিতরটা ঝমঝম করছে রাগে। তারপর ফণা তুলল।
তোমরা বুঝি এতটাই ফ্র্যাঙ্ক?
অ্যান্ড হোয়াই নট?
তোমার বাবা একটা শিক্ষিত গাধা। একে ফ্র্যাঙ্কনেস বলে না, একে বলে ফুলিশনেস।
মেয়েটা সঙ্গে সঙ্গে একমত হয়ে বলে, হি ইজ অফকোর্স অ্যান ইডিয়ট।
রাগে ফুঁসছিল পারুল। মেয়েটাকে একটা থাপ্পড় মারার প্রবল ইচ্ছে যে কী করে সে দমন করল কে জানে।
আর ইউ ক্রস উইথ মি পারুল?
ইয়েস আই অ্যাম ক্রস উইথ ইউ।
হোয়াই কান্ট ইউ টেক এ ট্রুথ অ্যাজ এ ট্রুথ? তা ছাড়া বাবা প্রথম কথাটা আমাদের কাছে বলে ফেলে আফটার এ ফিউ রাউন্ডস অফ হুইস্কি। আমি আর মা বসে অ্যালবামটা দেখছিলাম, তখন। পরে যখন আমরা বাবাকে চেপে ধরি তখন সোবার অবস্থাতে বাবা স্বীকার করেছিল। নো হার্ড ফিলিং পারুল। আই অ্যাম সরি।
পারুল তখনও ফুঁসছিল। কিন্তু সে বোকা বা অবিবেচক নয়। সে হয়তো জানে না, দুনিয়াটা তার অজান্তে কত পালটে যাচ্ছে দ্রুত। বিশাল প্রজন্মের ব্যবধান। এইসব ছেলেমেয়ে হয়তো তাদের কাছে মঙ্গলগ্রহের জীবের মতোই অচেনা। সে মাথা নেড়ে বলে, তুমি আমার আজকের দিনটা খুব তেতো করে দিলে।
মেয়েটা একটু যেন অবাক হয়ে বলে, ইজনট ইট এ ট্রুথ? টেক ইট ইজি ডিয়ার। আমি কিছু ভেবে বলিনি। ওরকম তো কত হয়।
পারুলের মনে পড়ল, কুড়ি বছর আগে অমল রায়ও এই কথাটা বলেছিল। এরকমই নাকি আকছার হয়, এতে মনে করার কিছু নেই, আজকালকার ছেলেমেয়েরা ওসব মাইন্ড করে না। ইত্যাদি।
পারুল টর্চটা নিবিয়ে ফেলেছিল। ফের জ্বেলে বলল, এরকম হওয়া উচিত নয়। ইট ইজ এ শেম।
ফের অবাক সোহাগ বলে, কেন পারুল? হোয়াই ইট ইজ এ শেম?
সেটা তুমি হয়তো এখনই বুঝবে না। হয়তো কোনওদিনই বুঝবে না। তোমার পরিবার তোমাকে অন্যরকম শিখিয়েছে।
ও কে পারুল, আই ডিড সামথিং রং। কিন্তু আমি আপনার সঙ্গে আলাপ করতেই চেয়েছিলাম। আপনার ছবিটা আমাকে পাগল করে দিত। কী সুন্দর। ইউ আর স্টিল ভেরি বিউটিফুল।
কমপ্লিমেন্টটা পারুলের গায়ে ছ্যাঁকা দিচ্ছিল। বিরক্ত হয়ে সে বলল, বারবার ওকথা বলছ কেন? আমি জানি আমি সুন্দর। কিন্তু তাতে এখন আর আমার কিছু এসে যায় না।
মেয়েটা বোধহয় এবার অপমানিত বোধ করল। বলল, আপনি কি একজন নান? এ পিওর উওম্যান?
নিজেকে আমি তাই মনে করি। তুমি একটি অসভ্য মেয়ে।
মেয়েটা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, উই হ্যাভ আওয়ার ওন অবসেশনস।
পারুল মেয়েটার পাশ কাটিয়ে খানিকটা চলে এসেছিল।
মেয়েটা হঠাৎ ডাকল, পারুল!
পারুল অনিচ্ছের সঙ্গে দাঁড়াল।
আই হ্যাভ টু টেল ইউ সামথিং।
দৌড়ে এসে হাঁপাচ্ছিল মেয়েটা।
পারুল ঠান্ডা গলায় বলল, আবার কী বলবে?
আমি বলতে চাই, ইন আওয়ার ফ্যামিলি এভরিবডি হেটস এভরিবডি। মাই ড্যাড অ্যান্ড মম হেটস ইচ আদার, আই হেট মাই ড্যাড অ্যান্ড মম অ্যান্ড দে হেটস মি। ইভন মাই ব্রাদার হেটস ড্যাড অ্যান্ড ড্যাড হেটস হিম। কিন্তু তার মধ্যেই দেখতে পাই, আমার বাবা অ্যালবাম খুলে আপনার ছবিটা যখন দেখে তখন তার মুখটা কেমন সফট আর পেনসিভ হয়ে যায়। ছবিটা আমিও মাঝে মাঝে দেখি। দেখতে দেখতে আমারও কেমন যেন হয়। মোনালিসার ছবিতে যেমন ম্যাজিক আছে তেমনই কিছু। বুডঢাও কথাটা আমাকে অনেকবার বলেছে। আমার মন খারাপ লাগলেই আমি ছবিটা দেখি আর মন ভাল হয়ে যায়। ইউ হ্যাভ বিকাম এ কাল্ট ফিগার অ্যান্ড ইভন এ গডেস টু আস। অ্যান্ড ইটস এ ট্রুথ।
এত অবাক হয়েছিল পারুল যে মুখে প্রথমে বাক্যই সরল না। তারপর বলল, এসব তো তোমার কল্পনা। আমি সামান্য মেয়ে, দেবী-টেবী নই।
উই হ্যাভ আওয়ার ইলিউশনস, আই নো৷ তবু আপনাকে দেখার খুব ইচ্ছে ছিল। মে বি ইউ আর নট এ গডেস, বাট মাস্ট বি সামওয়ান ভেরি স্পেশাল।
তুমি ভুল ভাবছ সোহাগ। ওরকম ভেবো না।
আমি একটু বেশি কথা বলে ফেলেছি আজ, কিছু মনে করবেন না। বাই।
মেয়েটা চলে যাচ্ছিল। পারুল টর্চটা জ্বেলে ওর পথের ওপর আলো ফেলে বলল, শোনো সোহাগ, এটা গ্রামদেশ। অন্ধকারে হুটহাট বেরিয়ে পোড়ো না, সাপ-খোপ আছে কিন্তু।
অন্ধকারে সোহাগের হাসি শোনা গেল, আই লাভ স্নেকস। স্নেকস আর অলওয়েজ ওয়েলকাম।
এসবই পরশুদিনের কথা। আজ তার বাবা গৌরহরি চাটুজ্জের শ্রাদ্ধের দিনে বৃহৎ লোকসমাগম থেকে একটু সরে এসে বাগানের নিরিবিলিতে দাঁড়িয়ে পারুল ভাবছিল মেয়েটা কি একটু পাগল? সাপটা সামনে দিয়ে চলে যাওয়ার পরই মেয়েটার কথা মনে পড়ল তার। সুন্দর, তবে মুখটায় একটু বিষণ্ণতা মাখানো ছিল।
অমল রায় তার ছবির দিকে চেয়ে আজও কি পুরনো ভালবাসার কথা ভাবে? নাকি তার বিশ্বাসঘাতকতার কথা মনে করে মনে মনে তেতো হয়ে যায়?
কে যেন পারুলকে ডাকছে চেঁচিয়ে। পারুল ফিরে আসছিল। উঠোনে পা দিতেই সামনে বুড়ো মানুষটা এসে পড়ল।
হ্যাঁ মা, তা খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা কি ছাদে করা হয়েছে?
হ্যাঁ ধীরেনখুড়ো। আপনি ভাল আছেন তো!
ভাল আর কী, গৌরহরিদা গেলেন, আমরাও সব পা বাড়িয়ে আছি।
একটা পেচ্ছাপের গন্ধ পাচ্ছিল পারুল। এসব গন্ধ সে একদম সইতে পারে না। নাকে আঁচল চাপা দিয়ে বলল, ইস, কী বিচ্ছিরি গন্ধ! কেন যে এরা ব্লিচিং পাউডার বা ফিনাইল ছড়ায় না!
ধীরেন কাষ্ঠ তাড়াতাড়ি দু পা পিছিয়ে গিয়ে বলে, খাওয়া-দাওয়া কি শুরু হয়ে গেছে মা? আমার আবার অনেকটা পথ– এই রোদ্দুরে–
যান না খুড়ো, ওপরে চলে যান। বোধহয় শুরু হয়েছে।
.
০৩.
গত দশদিন যাবৎ বড় জ্যাঠামশাইয়ের ভূত চারদিকে আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছে। চটির শব্দ শোনা যায়, গলাখাঁকারির শব্দ পাওয়া যায়, নিশুত রাতে দীর্ঘশ্বাস অবধি ভেসে বেড়ায়। দশ দিন আগে বড় জ্যাঠামশাই যখন মারা যান তখন ভরসন্ধেবেলা। চারদিকে ধোঁয়াটে আবছা অন্ধকার নেমে আসছে। সন্ধেবেলাটা হল সবচেয়ে মন খারাপ করার সময়। কালিঝুলিমাখা এক ডাইনি বুড়ি যেন এসে হাজির হলেন। প্রত্যেক দিন এই সময় তার খুব মরার কথা মনে হয়।
এক ছুটের রাস্তা। অবস্থা খারাপ শুনে তারা সব গিয়েছিল দেখতে। কয়েকজন মুরুব্বিগোছের পাড়াপ্রতিবেশী, বর্ধমান থেকে গাড়ি-চেপে-আসা গম্ভীরমুখো ডাক্তার আর আত্মীয়স্বজনে বারান্দা আর ঘর ভর্তি। তাদের জ্যাঠার ঘরে ঢুকতেই দেওয়া হয়নি। নিঃশব্দ ঘরে জ্যাঠা একা একা মারা যাচ্ছিল যখন, সেই সময়ে দুটো-তিনটে বাড়ি থেকে শাঁখের আওয়াজ এল, জ্যাঠামশাইয়ের গোয়ালঘর থেকে একটা গোরু গাঁ গাঁ করে ডাকছিল। সে বোধহয় আলো। সাদা ধবধবে আলো বড় জ্যাঠামশাইয়ের এমন বাধুক যে, জ্যাঠা গায়ে হাত রেখে পাশে না দাঁড়ালে সে দুধ ছাড়ে না, আটকে রাখে। আলো কি কিছু টের পেয়েছিল? অবোলা জীবরা বোধহয় ঠিক বুঝতে পারে। জাম্বো কুকুরটা যেমন। জ্যাঠার বারান্দার এক কোণে কেমন ঝুম হয়ে বসা। সামনের দু পায়ের ফাঁকে মাথাটা রাখা। নড়ছে না, চড়ছে না। এত লোক দেখেও একটা ঘেউ পর্যন্ত দিল না।
আর বাড়ির বাতাসটা কেমন ভারী হয়ে উঠছিল ক্রমে। শূন্য থেকে সাদা প্রেতের মতো একটু কুয়াশা যেন হঠাৎ নেমে এসে ঝুলে থাকল উঠোনের ওপর। কেমন ছমছম করছিল চারধার। যেন প্রেতলোকের ছায়া চারধারে। পান্না সিঁড়িতে বসেছিল চুপচাপ। বড় জ্যাঠা মরে যাচ্ছে। কেন যে মরে যাচ্ছে! আর ওই ভুতুড়ে সন্ধ্যা আর ওই আলোর করুণ ডাক আর ওই কুয়াশার পাতলা সর, সব মিলিয়ে কান্না পাচ্ছিল।
আর তখন উঠোনের উত্তর ধারে মরা আলোয় একমনে এক্কাদোক্কা খেলে যাচ্ছিল দুখুরি। কালো রোগা মেয়েটার পরনে একখানা কার যেন মস্ত ঢলঢলে ফ্রক। শোকাহত বাড়িতে আসন্ন মৃত্যুর নিস্তব্ধতার মধ্যে শুধু ওই মেয়েটা একমনে খেলে যাচ্ছে। এখন তাকে কেউ কাজে ডাকছে না, ফাইফরমাশ করছে না। এই ফাঁকটুকুতে সে আপনমনে খেলে নিচ্ছে। মৃত্যুহিম বাড়িটায় ওই একটু যেন জীবনের লক্ষণ– হৃৎপিণ্ডের মতো। লাফিয়ে লাফিয়ে খেলছে মেয়েটা।
প্রথমে শাঁখের আওয়াজ বলেই ভুল হয়েছিল। এক ঝটকায় ভুল ভাঙল। জ্যাঠাইমা কেঁদে উঠল না? ওঁওঁওঁ শব্দের একটা লম্বা টানা শব্দ। কে একজন বলে উঠল, সময়টা লিখে রাখো, লিখে রাখো, ছটা বেজে সতেরো মিনিট। আর একজন বলল ও ভটচাযমশাই, লগ্নটা কী পেল দেখুন তো, দোষ-টোষ কিছু পেল নাকি? নবীন ভটচাযের গলা পাওয়া গেল, তেমন কিছু নয়, গৌরহরিদা ভালই গেছেন।
জ্যাঠাইমার সঙ্গে গলা মিলিয়ে অনেকগুলো কান্নার আওয়াজ উঠল আর গম্ভীরমুখো ডাক্তার বেরিয়ে এসে সিঁড়ি বেয়ে উঠোনে নেমে চলে গেলেন। কান্না শুনে দুখুরি খেলা থামিয়ে মুখের ওপর থেকে ঝুরো চুল সরিয়ে পান্নার দিকে চেয়ে বলল, মরে গেছে?
মরা মানুষ দেখবে না বলে পান্না আর দাঁড়ায়নি। এক ছুটে বাড়ি। আর বাড়িতে তার জন্য অপেক্ষা করছিল ফাঁকা, অন্ধকার, হাঁ-হাঁ করা ঘর, উঠোন জোড়া অন্ধকার, আর ধোঁয়াটে অশরীরী কুয়াশার কুণ্ডলী। পান্না উঠোনে দাঁড়িয়ে, চোখ বুজে, শক্ত হয়ে প্রাণপণে চিৎকার করেছিল, বাসন্তী… বাসন্তী.. বাসন্তী…
বাসন্তী গিয়েছিল পুকুরঘাটে। বাসনের পাঁজা ফেলে রেখেই উঠে এল।
কী হয়েছে গো? চেঁচাচ্ছ কেন?
আমার ভয় করছে।
ও মা! ভরসন্ধেবেলা ভয়ের কী?
বাড়িতে কেউ নেই দেখছিস না? সব ও-বাড়িতে।
তা তুমি চলে এলে যে! গৌরকর্তার কি হয়ে গেল?
হ্যাঁ। আমার ভীষণ ভয় করছে।
সেদিন সন্ধেবেলা কারেন্ট ছিল না। বাসন্তী লণ্ঠন জ্বেলে দিয়ে বলল, আমার তো বসে থাকলে চলবে না, বাড়ি ফিরতে হবে। ছেলেটার জ্বর দেখে এসেছি। একা যদি না থাকতে পারো তা হলে ভশ্চায খুড়িমাকে ডেকে দিয়ে যাচ্ছি।
ভয়! ভয়ের কি শেষ আছে! কোথা থেকে যে হঠাৎ হঠাৎ তার ভয়েরা এসে হাজির হয় তা সে নিজেও জানে না। কিন্তু ভয় তার অমনি হয় না। তার ভয়ের পিছনে সবসময়েই গূঢ় কারণ থাকে। কিন্তু সেটা কেউ বুঝতে চায় না। ভয়ের জন্য কত বকুনি খায় সে।
মানুষ মরে যে কেন ভূত হয় কে জানে বাবা! ভটচায খুড়িমা বলল, মরার পর আত্মা দশ দিন প্রেতলোকে থাকে, শ্রাদ্ধের পর দেবলোকে চলে যায়। আর প্রেতলোকটা বেশি দূরেও নয়, আশেপাশেই।
কী যে গা ছমছম করল তার। রাতে মায়ের সঙ্গে লেগে শুয়েও ঘুম এল না। নিশুত রাতে জ্যাঠামশাইয়ের দীর্ঘশ্বাস ঘুরে বেড়াতে লাগল উঠোনে। শুকনো পাতার সড়সড় শব্দে কীসের যে সঞ্চার ঘটছিল। তাদের কুকুরটা অকারণে কেঁদে উঠেছিল একবার বারান্দায়। অকারণে নয়, পান্না জানে। ঠিক জ্যাঠামশাইকে দেখতে পেয়েছিল।
দাহকাজ শেষ করে তার বাবা রামহরি চাটুজ্যে ফিরল শেষ রাতে। আগুন ছোঁয়ানো, লোহা ছোঁয়ানো এসব করতে উঠে গেল মা। তখন পান্নার চোখ জুড়ে ঘুম এল।
বিয়ে করলে আমি বাপু, কলকাতায় করব। মেলা লোক, আলো, ভিড়ভাট্টা, অত গা ছমছম করবে না। আমার যা ভয়।
নিতু বলে, দুর! কলকাতা আমার ভাল লাগে না। তুই কী রে ভিড় ভালবাসিস! আমার ভাল লাগে পাহাড়, উপত্যকা, শীত-শীত ভাব আর খুব নির্জন, গাছগাছালি…
সেসব আমারও ভাল লাগে। কিন্তু একা থাকলে ভয়েই মরে যাব।
তোর যে কী অদ্ভুত ভয়। আর কলকাতায় বুঝি ভয় নেই। কত খুনখারাপি, অ্যাকসিডেন্ট।
তাও ভাল বাবা।
আজ বড় জ্যাঠার শ্রাদ্ধ। সকাল থেকে বাবা ও-বাড়িতে। মাও একটু আগে গেল। পান্নাকে ডেকে বলে গেল, দেরি করিসনি যেন। চানটা করেই চলে আয়। যা মাঠো মেয়ে তুই।
তা আছে একটু পান্না। মাঠোই বোধহয়। সব কাজে তার গড়িমসি। শরীরটা নড়াতে-চড়াতে ভালই লাগে না তার। তার ভাল লাগে বসে বসে ভাবতে।
শরীরের গভীর আলসেমি যেন মদের নেশার মতো। আর মাথার মধ্যে লাগামছাড়া উদ্ভট সব ভাবনা। পান্না ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুয়ে বসে গড়িয়েই কাটিয়ে দিতে পারে। আর মনে মনে সে যে কোথায় কোথায় উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে বেড়ায় তার ঠিক-ঠিকানা সে নিজেও জানে না।
আজ কোনও সাজ নেই। শ্রাদ্ধবাড়ির নেমন্তন্নে কেউ তো সাজে না। সাদামাটা একটা সাদা খোলের শাড়ি, মুখে একটু পাউডার, চুলে সামান্য চিরুনি। ব্যস হয়ে গেল। তাই আজ একটু গড়িমসি করে নিচ্ছে পান্না। মোটে সাড়ে এগারোটা বাজে। হাতে এখনও অনেক সময়। কাজের বাড়িতে আগে-ভাগে গিয়ে হাজির হলে লোকে বড্ড ফাইফরমাশ করে। এটা নিয়ে আয়, ওকে ডেকে দে, পানগুলো সেজে ফেল, আরও কত রকম। আর অত ভ্যাজর ভ্যাজর, কুটকচালি ভাল লাগে না তার।
গনগনে পুরুষের মতো দুপুর, নির্জন বাড়ি, আর অন্যরকম এক দামাল হাওয়া। আজ তার খুব ‘সে’র কথা মনে হচ্ছে। এই ফাঁকা বাড়িতে পান্না এখন একা, এ সময়ে যদি সে এসে সামনে দাঁড়ায়। মাগো, ভাবতেই গা সিরসির করে, রোঁয়া দাঁড়িয়ে যায়। কেমন হবে সে? আজও স্পষ্ট কোনও চেহারা মনে পড়ল না পান্নার। না বাবা, কার্তিক ঠাকুরটার মতো সুন্দর চেহারা চাই না। তবে পুরুষমানুষের মতো। একটু অগোছালো, একটু আনমনা, ভুলো মন, একটু পাগলাটে হোক না তাতেও ক্ষতি নেই। খুব সুন্দর ঝকঝকে মসৃণ দাঁত আর হাসিটা হবে খুব সুন্দর। হাসলে যেন মাড়ি না বেরিয়ে পড়ে বাবা। পান্নাকে খুব ভালবাসবে, কিন্তু বউ-মুখো যেন না হয়।
বউ-মুখো একদম দেখতে পারে না পান্না। শেফালী বউদি তো বরকে নিয়ে ওইজন্যই ভাজা-ভাজা হল। বরুণদা যা মাগী-মার্কা পুরুষ, বউয়ের মাথা টিপে দেয়, কুটনো কুটে দেয়। গন্ধ শুঁকে শুঁকে ঘোরে। শেফালী বউদি মাঝে মাঝে ধৈর্য হারিয়ে বলেই ফেলে, ও বাবা, এ যেন একটা মেয়েমানুষকেই বিয়ে করেছি রে!
পান্না বলে, তা কেন বউদি, বরুণদা তোমাকে কত ভালবাসে, মাথা টিপে দেয় জ্বর হলে।
দেয় কেন? মাথা টিপে না দিলে কি মরে যাব?
অত ভালবাসা তোমার বুঝি সয় না?
তোরও সইবে না। পুরুষমানুষ যদি সবসময়ে গায়ে গায়ে লেগে থাকে মেনি বেড়ালের মতো, যদি সংসারের সব ব্যাপারে নাক গলায় তা হলে কি ভাল লাগে বল? ঘেন্নায় মরে যাই ভাই, কী সুন্দর রিপু করতে পারে, উল বুনতে পারে, কুরুশকাঠিতেও দিব্যি হাত।
বলে হেসে গড়িয়ে পড়ে শেফালী বউদি।
আর মনে মনে পান্না বলে, হে ঠাকুর, আমার পুরুষমানুষটা যেন কিছুতেই বরুণদার মতো না হয়।
নয়না শিবেনদার সঙ্গে ছুঁকছুঁক করছে, পায়েল তার মাস্টারমশাই জিতু সমাদ্দারের সঙ্গে লাইন দিচ্ছে, শুধু পান্নারই গাল উঠল না। এ নয়, ও নয়, সে নয়। তার ‘সে’ এদের কারও মতো নয়। অন্যরকম। এই অন্যরকমটা রোজ রোজ বদলে যায়।
হীরা বলে, অত খুঁতখুঁত হলে তোর কেউ জুটবে না শেষ অবধি, দেখিস। তোর জন্য কি বর কলে তৈরি হবে? মেড টু অর্ডার?
তাও বটে।
কিন্তু এই নির্জন দুপুরে সেই আবছা পুরুষের কথা খুব মনে আসে পান্নার। তার বান্ধবীরা খুব সেক্স নিয়ে কথা বলে। পান্নার ও ব্যাপারটা ভাবতে ভাল লাগে না। শরীরের গ্যাদগ্যাদে ব্যাপারটা তো আছেই বাবা। কিন্তু ওটাই সব নয়। সে চায় ভাবের পুরুষ, শরীরের পুরুষ নয়।
ইলাবতী আর সোমেশ্বর প্রেমে পড়েছিল। ইলাবতীর পনেরো, সোমেশ্বরের কুড়ি। জানাজানি হওয়ার পর ইলাবতীকে তার মা বাবা খুব মেরেধরে বেঁধে রাখল ঘরে আর সোমেশ্বর রাস্তায় রাস্তায় পাগলের মতো ঘুরতে লাগল। তারপর একদিন ফাঁক পেয়ে দুজনেই পালাল। শ্মশানের ধারে দুজনকে পাওয়া গেল পরদিন। জড়াজড়ি করে মরে পড়ে আছে।
কী যে কেঁদেছিল পান্না। হ্যাঁ, ভালবাসা হবে ওইরকম। কেমন মরে গেল দুজনে। আর তারপর দুজনেই তুচ্ছ শরীর ছেড়ে ফেলে হাত ধরাধরি করে ঘুরে বেড়াত মনের আনন্দে। কত লোক তাদের দেখেছে। নদীর ধারে বা হাট মুকুন্দপুরের জঙ্গলে, নিশুত রাতে অলকেশ স্মৃতি সংঘের ফুটবল খেলার মাঠে। পান্না দেখেনি, কিন্তু পান্না তাদের ফিসফাস মধ্যরাতে কতদিন শুনেছে। স্বর নেই, শুধু শ্বাসের শব্দে কথা। গায়ে কাঁটা দেয়।
হ্যালো! এনিবডি হিয়ার।
ঝিমঝিম দুপুরে তন্দ্রাচ্ছন্ন তন্তুজাল ছিঁড়ে সপাটে উঠে বসল পান্না। বুকটা ধক ধক করছে। মেয়ে গলায় ইংরিজি বলছে কে? এরকম তো হওয়ার কথা নয়! কণ্ঠা পর্যন্ত আতঙ্ক উঠে এল তার।
উঠোনের জানালাটা দিয়ে উঁকি দিতেই সে সোহাগকে দেখতে পেল। অমল রায়ের মেয়ে। খুব দেমাক, ইংরিজি ছাড়া কথাই বলে না। সন্ধ্যাদি আরও বলেছে, কলকাতায় নাকি কেলেঙ্কারি করে এসেছে। সন্ধ্যাদি পান্নাকে খুব ধরেছিল, যা না, গিয়ে ওদের ইংরিজিতে দুটো কথা শুনিয়ে দিয়ে আয়। বুঝবে আমরাও মুখ্যু নই। পান্না রাজি হয়নি। সে ইংরিজি বলবে কি, ভয়েই মরে যাবে। কথাই ফুটবে না।
অবাক হয়ে বারান্দায় বেরিয়ে এল পান্না, কিছু বলছ?
মেয়েটার তেমন সাজগোজ নেই, পরনে একটা লম্বা ঝুলের ফ্ৰকমতো ম্যাদাটে পোশাক, চুল উড়োখুড়ো। তার দিকে চেয়ে বলল, সরি, আমি ভুল করে তোমাদের কোর্ট ইয়ার্ডে ঢুকে পড়েছি বোধহয়। এখানে কোনটা রাস্তা আর কোনটা নয় তা বোঝা মুশকিল। এখান দিয়ে কি রাস্তায় যাওয়া যাবে?
যাবে। তুমি কোথায় যাচ্ছ?
মেয়েটা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, এনি হোয়ার। নাথিং ম্যাটারস।
তুমি তো সোহাগ। অমল রায়ের মেয়ে।
হ্যাঁ। আর তুমি?
আমি পান্না চট্টোপাধ্যায়। আমাদের বাড়িতে একটু বসবে?
মেয়েটা ঠোঁট উলটে বলল, বসতে পারি, ইফ ইউ আর নট ডিস্টার্বড।
পান্না মাথা নেড়ে বলল, না না, ডিস্টার্বড হব কেন? এসো। মে
য়েটা বারান্দায় উঠে এসে পেতে রাখা কাঠের চেয়ারে বসল।
খুব সাহস হয়ে যাচ্ছে পান্নার। এই ইংরিজি বলা বিলেত ফেরত মেয়েটার সঙ্গে টক্কর দেওয়া তার কর্ম নয়। তবু কী জানি সুন্দর মেয়েটার এমন মলিন চেহারা দেখে তার মায়া হচ্ছিল।
কোথায় যাচ্ছিলে ভাই?
কোথাও না। বাড়ির বাইরে বেরোতে ইচ্ছে করছিল।
এক গেলাস জল দেব? খাবে?
মেয়েটা অবাক হয়ে বলে, জল খাব কেন? আমার তেষ্টা পায়নি তো!
তুমি তো বেশ বাংলা বলতে পার। আমি ভেবেছিলাম তুমি বোধহয় বাংলা জানোই না।
মেয়েটা হাসল, বলতে পারি, পড়তে পারি, লিখতেও পারি একটু একটু।
বিদেশে যারা থাকে তাদের ওরকম হয়।
মেয়েটা একটু হাসল। হাসলে এত সুন্দর দেখায় ওকে।
দু চোখে তৃষিতের মতো মেয়েটাকে দেখে নিচ্ছিল পান্না। যেন এক পরি এসে আলগোছে বসেছে তাদের বাড়িতে। একটু পরেই উড়ে যাবে।
তোমরা কি বেড়াতে এসেছ?
মেয়েটা ভ্রূ কুঁচকে বলল, বেড়াতে! তাও বলতে পার, সর্ট অফ এ চেঞ্জ। কলকাতার পলিউশনে আমার অ্যালার্জি হয়। অ্যাজমার মতো। ডাক্তার বলেছে মাঝে মাঝে বাইরে গিয়ে থাকতে হবে।
কিছুদিন থাকবে তো?
না। আই হ্যাভ মাই স্টাডিজ। আজ বাবা আসবে। তারপর আমরা হয়তো ফিরে যাব।
এ-জায়গাটা তোমার ভাল লাগছে না?
ভাল, কিন্তু একটু হ্যাপহ্যাজার্ড। কোনও প্যাটার্ন নেই। আর নেই বলেই আমি ভুল করে তোমাদের বাড়িতে ঢুকে পড়েছি।
ভাগ্যিস নেই। থাকলে তোমার সঙ্গে ভাবই হত না। তুমি কিছু খাবে?
না তো! আই অ্যাম নট হাংরি।
মুখ দেখে পান্নার মনে হল মেয়েটা মিথ্যে কথা বলছে। মুখটা শুকনো, খিদের ছাপ আছে।
তোমরা কি ভাত ডাল খাও?
কেন খাব না? তবে আই প্রেফার চাইনিজ।
উঃ, চাইনিজ আমারও ভীষণ ভাল লাগে। কলকাতায় গেলেই আমি চাইনিজ খাই। তবে অনেকে বলে কলকাতার চাইনিজ নাকি আসল চিনে খাবার নয়।
হ্যাঁ। অন্যরকম।
আমাদের বাড়িতে অনেক রকম আচার আছে। খাবে?
মেয়েটার চোখদুটো একটু উজ্জ্বল হল। মুখে একটু হাসি। বলল, ইউ আর এ রিয়েল চার্মার।
খাবে?
মেয়েটা এক গাল হেসে ঘাড় কাত করে বলল, খাব।
তা হলে এসো, কোন আচারটা খাবে পছন্দ করে দাও।
মেয়েটা লক্ষ্মীর মতো উঠে তার সঙ্গে এল। সহবত জানে। ঘরে ঢোকার সময় চটিজোড়া বাইরে ছেড়ে রাখল।
পান্না যখন তাক থেকে আচারের বয়ম নামাচ্ছে তখন সোহাগ ঘরের চারধারটা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল। পান্নারা গরিব নয়। তবে ঠাঁটবাটও তেমন কিছু নেই। সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরদোর।
ওয়া! সোনি টু থাউজ্যান্ড মিউজিক সিস্টেম! বিগ সাউন্ড।
পান্না একটু হাসল, হ্যাঁ, বড্ড আওয়াজ ওটার।
ক্যাসেটের কেসটা দেখতে দেখতে সোহাগ বলল, রক মিউজিক, জ্যাজ এসব তুমি শোনো বুঝি?
না বাবা, ওসব আমার দাদা শোনে। আমাকেও জোর করে বসিয়ে শোনায়। আগে কিছু বুঝতাম না, শুনতে শুনতে এখন একটু-আধটু বুঝতে পারি।
তোমার দাদা কোথায়?
ও তো কলকাতায়। যাদবপুরে ইলেকট্রিক্যাল ইনজিনিয়ারিং পড়ে। আচ্ছা, আচার খেলে তোমার আবার অ্যাজমা বাড়বে না তো!
না। আমার অ্যালার্জিটা পলিউশন থেকে হয়। ডাস্ট, স্মোক এইসব থেকে।
পাঁচরকম আচার প্লেটে সাজিয়ে দিয়ে পান্না ভাবল এই ফুলপরিকে আর কী দেওয়া যায়। তার আরও কিছু সাজিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে যে!
এই সোহাগ, তুমি শুধু আচার কী করে খাবে?
সোহাগ অবাক হয়ে বলল, আচারটাই তো খাবার।
পান্তাভাত আছে। খাবে?
সোহাগ হেসে ফেলল, তুমি ভারী সুইট মেয়ে তো!
খেয়েছ কখনও? লেবুপাতা দিয়ে মেখে খেতে বেশ লাগে। খাও না।
সোহাগ লক্ষ্মী মেয়ের মতো ঘাড় কাত করে বলল, দাও।
পান্না এক ছুটে রান্নাঘরে গিয়ে পান্তাভাত একটা চিনেমাটির বাটিতে করে নিয়ে এল। সঙ্গে লেবুপাতা, নুন।
মাখতে পারবে? না মেখে দেব?
মৃদু হেসে সোহাগ বলে, তুমিই মেখে দাও।
ঘেন্না পেও না কিন্তু। আমার হাত পরিষ্কার। তবু সাবান দিয়ে ধুয়ে আসছি।
যখন সোহাগ খাচ্ছিল তখন খাওয়ার ধরন থেকে তার খিদেটা বুঝতে পারল পান্না। সামান্য পান্তাভাত কত যত্ন করে খাচ্ছে।
একটা ডিম ভেজে দেব তোমাকে? এক মিনিট লাগবে।
সোহাগ মিষ্টি করে হেসে বলে, এর সঙ্গে ডিম ম্যাচ করবে না। ইটস ভেরি টেস্টফুল। তোমার হাতের গুণ আছে।
আমার হাতের কোনও গুণ নেই। পান্তাভাত দিতে হল বলে লজ্জা করছে।
কেন, লজ্জা কীসের? আমরা বিদেশেও পান্তাভাত খেয়েছি। বাবা খুব ভালবাসে কি না। আচ্ছা, তোমার বাড়ির লোকেরা সব কোথায় বলো তো! কাউকে দেখছি না।
আমার জ্যাঠামশাই গৌরহরি চট্টোপাধ্যায় মারা গেছেন তো, আজই তাঁর শ্রাদ্ধ। সব সেই বাড়িতে।
ইউ মিন পারুলের বাড়ি!
অবাক হয়ে পান্না বলে, তুমি চেনো নাকি?
সোহাগ একটু হাসল, চিনি। শি লুকস লাইক এ গডেস।
হ্যাঁ। আমাদের বংশে ওরকম সুন্দরী আর কেউ নেই। তারপর একটু লজ্জা-লজ্জা মুখ করে রাঙা হয়ে পান্না বলে, জান তো একসময়ে তোমার বাবার সঙ্গে পারুলদির বিয়ে হওয়ারও কথা হয়েছিল। সেসব অবশ্য আমার জন্মেরও আগেকার ঘটনা। বিয়েটা হলে আজ তুমি আমার বোনঝি হতে, জানো? আমি হতুম তোমার মাসি।
খুব হাসল সোহাগ, মাসি? তোমার বয়স কত বলো তো!
সতেরো চলছে।
সতেরো প্লাস?
না, ষোলো প্লাস।
আমার সতেরো প্লাস। তোমার চেয়ে আমি বড়। ভেরি ইয়ং মাসি।
ভারী ভালই তো মেয়েটা। একটুও তো দেমাক দেখাচ্ছে না। সন্ধ্যাদিটা যে কী আজেবাজে বলে! তবে মেয়েটার এঁটোকাঁটার বিচার নেই। ভাত খেতে খেতে কতবার যে চুলে হাত দিয়ে পাট করল, কোলের ওপর বাটিটা রাখল। তা হোক, ওরা কি অত সব শিখেছে তাদের মতো?
মাঝে মাঝে একটু উদাস হয়ে যায় মেয়েটা। মুখে একটা বিষণ্ণতা ফুটে ওঠে। ভাত খেয়ে মেয়েটা কিছুক্ষণ চুপ করে বসে কুলুঙ্গিতে গণেশের মূর্তিটার দিকে চেয়ে রইল। হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে তার দিকে চেয়ে বলল, দে ওয়্যার ইন লাভ, বাট দে ডিড নট ওয়েড। পারুলের মেয়ে হলে আমি অন্যরকম হতাম। তাই না? কী অদ্ভুত!
পান্না কথাটা ভাল বুঝতে পারল না। আবছা মনে হল, পারুলের মেয়ে হয়ে জন্মায়নি বলে ওর একটু বুঝি দুঃখ আছে।
মেয়েটা ফের যেন, পান্নাকে নয়, আকাশ বাতাসকে বলল, ইউ ক্যান্ট চুজ ইওর পেরেন্টস। ক্যান ইউ?
এ কথাটাও পান্না বুঝল না। মেয়েটার মনে বোধহয় একটা কষ্ট আছে। কিন্তু পান্না কী বলবে! মুখখানা হাসি-হাসি করে বসে রইল, যদিও কথাটা মোটেই হাসির নয়।
বাটিটা রেখে মেয়েটা উঠল। বলল, থ্যাংক ইউ ফর এভরিথিং।
আবার আসবে না?
হাসি মুখে সোহাগ বলে, আসব। ইউ আর সিম্পলি চার্মিং। তুমিও চলে আসতে পার। তবে ইউ মে নট লাইক আওয়ার লট। আমরা একটা আনহ্যাপি ফ্যামিলি।
পান্না জানে, এখন কৌতূহল প্রকাশ করা উচিত নয়। তাই সে বলল, তোমাকে আমার খুব ভাল লেগেছে।
থ্যাংক ইউ।
তোমাকে পথ দেখিয়ে দেব? নইলে ফের রাস্তা গুলিয়ে ফেলে অন্য কারও উঠোনে গিয়ে উঠবে হয়তো।
সোহাগ হেসে ফেলল, না না, পারব।
মানুষ চলে গেলেও তার একটা রেশ থেকে যায়। কিছুক্ষণ রেশটা বাতাসে অনুভব করল পান্না। দু একটা কথা যেন গুনগুন করে উড়ে বেড়াতে লাগল তার চারপাশে।
কালো কলকা পাড়ের সাদা খোলের শাড়িটা পরে নিতে নিতে সে দেয়ালঘড়ির দিকে চাইল। একটা পাঁচ। আজ মায়ের বকুনি খেতে হবে। বড্ড দেরি করে ফেলেছে সে।
ফুল ফুটলেই যেমন মৌমাছি এসে জোটে তেমনই যেন পারুলদিকে ঘিরে মেয়েপুরুষের একটা ছোট্ট ভিড়। একে সুন্দরী তায় বড়লোকের বউ। বাবার কাছে শুনেছে ওদের নাকি বছরে দশ বারো কোটি টাকার টার্নওভার। টার্নওভার কথাটার মানেই জানে না পান্না। ব্যবসাবাণিজ্যের কথা সে কী বুঝবে? তবে ওদের যে অনেক টাকা সেটা আঁচ করতে পারে।
এই, কাছে আয় তো! বাঃ, দিব্যি মিষ্টি হয়েছিস তো দেখতে।
যাঃ, তোমার কাছে আমি! কী যে বলো!
বেশি সুন্দরী হওয়া কি ভাল? এরকমই ভাল। রোগা কেন রে!
পান্না লজ্জা পেয়ে বলে, এমনি। আমার গায়ে মাংস লাগতেই চায় না।
শেষবার যখন তোকে দেখেছিলুম তখনও ফ্রক পরতিস।
এখনও পরি।
পরিস? তোর মতো বয়সে আমিও পরতুম। কিছুতেই বড় হতে ইচ্ছে হত না। কিন্তু বয়স কি আটকানো যায় বল! চোরাপথে ঠিক বয়স বেড়ে যায়।
কিন্তু পারুলদি, তোমার তো একটুও বয়স বাড়েনি।
তোর চেয়ে আমি কুড়ি বছরের বড় তা জানিস? তুই যদি যুবতী তো আমি থুত্থুড়ি।
হি হি করে হেসে ফেলে পান্না। কী মিষ্টি গন্ধ আসছে পারুলদির গা থেকে। আজ সাজেনি একদম, তবু চারদিকে যেন রূপের ঢেউ ভেঙে পড়ছে। চারদিকে মুগ্ধ দৃষ্টির ভিড়।
পান্না সরে এল। এটুকুই ভাল। এর চেয়ে বেশি ভাল নয়। পারুলদি ঈশ্বরীর মতো। সাঁইত্রিশেও ব্যালেরিনার মতো শরীর, গজদন্তের মতো রং, ভগবানের অনেক পরিশ্রমে তৈরি মুখের ওই কারুকার্য। এত সুন্দরীর নাকি সুখী হওয়ার কথা নয়। কিন্তু কপাল। স্বামীর সোহাগ যে মেয়েদের মুখে ফুটে থাকে। তাকে কি লুকোনো যায়। দূর থেকে ওই সোহাগের আলো স্পষ্ট দেখতে পেল পান্না পারুলের মুখে। ওর মেয়ে হয়ে জন্মায়নি বলে সোহাগের কি খুব দুঃখ?
বড় জ্যাঠামশাইয়ের আত্মা আজ প্রেতলোক ছেড়ে দেবলোকে চলে গেল। ভিড়ে ভিড়াক্কার মণ্ডপ। লুচি ভাজার গন্ধে গা গুলিয়ে উঠল পান্নার।
এই, তুই কোথায় ছিলি রে এতক্ষণ! খুঁজে খুঁজে মরছি।
এক দঙ্গল মেয়ে ধেয়ে এল। পনেরো ষোলো সতেরো আঠেরোর পায়েল, নয়না, ঝুমুর, রুমকি, পুকু। তারপর হা-হা, হু-হু, হি-হি। দমকা বাতাসে মনের সব ধুলোময়লা উড়ে গেল। তারপর একসঙ্গে বসে খাওয়া আর খেতে না পারা।
তারও পর একসময় নির্জন আর একা হয়ে যেতে হয়। সন্ধ্যা নামে। শাঁখ বাজে। প্রেতলোকের অন্ধকার থেকে ধোঁয়াটে ভূতেরা নেমে এসে ঝুলে থাকে একটু ওপরে। তখন কান্না পায়। তখন রোজ মরতে ইচ্ছে করে। তখনই মন কু-ডাক ডাকতে থাকে, গায়ে আগুন, না গলায় দড়ি? গলায় দড়ি, না গায়ে আগুন?
দশ দিন গান-টান গাওয়া নিষেধ ছিল অশৌচ বলে। আজ হারমোনিয়াম নিয়ে বসল একটু। অমনি মা এসে হাজির।
এখন আবার হারমোনিয়ম নিয়ে বসলি কেন? সামনে পরীক্ষা না?
মনটা খারাপ লাগছে মা।
রোজই মন খারাপ, রোজই শরীর খারাপ, এ কেমনধারা কথা? গতর বসিয়ে রাখলে যে শুঁয়োপাকা ধরবেই।
মা তাকে দু চোখে দেখতে পারে না। মা সবচেয়ে বেশি ভালবাসে দাদাকে, তারপর হীরাকে। পান্না তার দু চোখের বিষ, যেন সৎ মেয়ে। আজ কেন যে কান্না পেল খুব। হারমোনিয়াম তুলে রেখে পড়ার টেবিলে বসে সে বই খুলে চেয়ে চোখের জলে বুক ভাসাতে লাগল। মরবে, সে একদিন মরে সবাইকে ঠিক এইরকম কাঁদিয়ে ছাড়বে।
কান্না থেকে ঢুলুনি, ঢুলুনি থেকে ঘুম।
মাস ছয়েক আগে এরকমই এক সন্ধেবেলা সাঁঝঘুম থেকে তাকে ঠেলে তুলেছিল মা। বকাঝকা নয়, বরং খুব আহ্লাদের গলায় বলেছিল, ওরে ওঠ, ওঠ, দেখ কারা এসেছে।
অবাক হয়ে বলল, কারা এসেছে মা?
ওরে তারা মস্ত মানুষ, বিরাট গাড়ি নিয়ে এসেছে। তাড়াতাড়ি চোখে মুখে জল দিয়ে আয় দেখি।
কিচ্ছু বুঝতে পারেনি সে। চোখে জল দিয়ে আসতেই মা বলল, ওই শাড়ি বের করে রেখেছি। চুল টুল আঁচড়ে একটা টিপ পরো, শাড়িটা ঠিকমতো পরবে কিন্তু, কুঁচি-টুচিগুলো লক্ষ রেখো। মুখে একটু পাউডার দিয়ে নিয়ে বাইরের ঘরে এসো। হড়বড়িয়ে এসো না, ধীরে সুস্থে।
কিচ্ছু বুঝতে পারেনি পান্না। ঘুমচোখে সাজতে কারও ভাল লাগে।
হীরা এসে উত্তেজিত চোখমুখে বলল, ইস, কী বিরাট গাড়ি রে দিদি, একেবারে ঝকমক করছে। উর্দিপরা ড্রাইভার।
ওরা কারা?
তোকে দেখতে এসেছে।
দেখতে এসেছে! দেখতে এসেছে কেন?
এ মা, তোর বিয়ের কথা হচ্ছে না?
মাথায় বজ্রাঘাত হলে বোধহয় এরকমই অবশ হয়ে যায় মানুষ। ছয় মাস আগে যে সবে ষোলো পেরিয়েছে, এর মধ্যেই বিয়ে? সে বিছানায় বসে পড়ে খাটের বাজুতে মাথা রেখে ঝিম ধরে রইল। বুকে ধড়ফড়ানি তো ছিলই, তার ওপর বমি বমি ভাব হতে লাগল। তখনও মনে হয়েছিল, মরি।
কী সুন্দর সুন্দর সব চেহারা ওদের। ফর্সা টকটক করছে। গিন্নিমার গা ভর্তি গয়না। সেজে আয় না একটু।
একটুও নড়েনি পান্না। ঝিম ধরে বসেই ছিল। মাথা ঘুরছিল তখন।
মা এসে বলল, এ কী! শরীর খারাপ করল নাকি? সর্বনাশ। ওঁরা যে বেশিক্ষণ বসবেন না। ওঠ ওঠ, লক্ষ্মী মা আমার। অমন করতে নেই। ব্যস্ত মানুষ ওঁরা, সময় করতে পারেন না বলে অসময়ে এসেছেন। এই রাতেই ফের বর্ধমানে ফিরে যাবেন। উঠে পড় মা।
কেমন বোধহীন, যন্ত্রচালিত পুতুলের মতো সে উঠল, সাজল এবং বৈঠকখানায় গেল।
বৈঠকখানা আলো করেই কর্তা-গিনি, দুজন যুবক যুবতী এবং একজন বয়স্ক মানুষ বসা। চা খাবার দেওয়া হয়েছিল, ছোঁয়ওনি। তবে তাকে দেখেছিল ড্যাব ড্যাব করে।
বাবা বলে উঠল, গান জানে, লেখাপড়াতেও ভাল।
কর্তা বোধহয় তার নাম জিজ্ঞেস করেছিল, গিন্নি জিজ্ঞেস করেছিল তার বয়স কত। খালি গলায় একটা গানও শোনাতে হয়েছিল, মনে আছে। অমন শুকনো গলায় প্রাণান্তকর গান সে জীবনে গায়নি।
তারা বাবাকে জানিয়ে গিয়েছিল, এই মেয়ে তাদের খুব পছন্দ হয়েছে। এখন কোষ্ঠী মিললেই হয়।
বাবার সেই রাত্রে কী আস্ফালন, বড়দা ভেবেছে তার মেয়ের মতো পাত্র আর কারও জুটবে না? অ্যাঁ! এই যে পাত্রপক্ষ দেখে গেল এরা দশটা জ্যোতিপ্রকাশ গাঙ্গুলিকে কিনতে পারে।
কিছুদিন বাবাকে ওই পাগলামি পেয়ে বসেছিল। গৌরহরি চাটুজ্যে দুই ভাইকে টাকা দিয়ে পৈতৃক বাড়ির দুটো অংশ কিনে নেন। সেখানে কোনও গোলমাল ছিল না। দুই ভাই নরহরি আর রামহরি কাছাকাছি নিজেদের বাড়ি করে ফেলেছিল। গোলমাল বেঁধেছিল জিনিসপত্র, বাসন-কোসন এবং গয়নাগাঁটি ভাগাভাগি নিয়ে। গৌরহরি চাটুজ্জে তিন ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে বিত্তশালী এবং প্রবল ব্যক্তিত্বওলা লোক। তার ওপর দুঁদে উকিল। মামলা মোকদ্দমা না হলেও সালিশির বিচারে দুই ভাই হেরে গেল। রামহরির সেই থেকে হঠাৎ হীনম্মন্যতা দেখা দেয়। তার হঠাৎ মনে হয়েছিল বড়দা যেন বড্ড উঁচুতে উঠে গেছে। এর একটা বিহিত করতেই হবে। নানাভাবে রামহরি গৌরহরিকে টপকানোর একটা অক্ষম চেষ্টা করেছিল কিছুদিন। তার মধ্যে একটা ছিল বড়লোক হওয়ার চেষ্টা। লটারির টিকিট কেনা, পলিটিক্সে নাম, ঠিকাদারি, পতিত জমি কিনে চাষ আবাদ। তাতে রামহরি কোনওটায় সফল, কোনওটায় বিফল হলেও গৌরহরিকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। গৌরহরির মেয়ের বিয়েটাও তার চক্ষুশূল হয়েছিল। জামাই ছোটখাটো শিল্পপতিই শুধু নয়, অতিশয় সজ্জনও। রামহরি জামাই-ধরা প্রতিযোগিতায় বড়দাকে হারিয়ে দিতে কিছুদিন মরিয়া হয়ে নাবালিকা মেয়ের জন্য বড় বড় পাত্র ধরতে লেগে গিয়েছিল।
ভাগ্যিস এই পাগলামি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। হলে এতদিনে পান্না কোনও বড়লোকের বাড়ির বউ হয়ে নির্বাসনে যেত। কে জানে বাবা। জীবনের রহস্যময় নানা আনন্দের শিহরন কোথায় হারিয়ে যেত। একদিন বিবেচক গৌরহরিই এসে রামহরিকে ঠান্ডা মাথায় কথা বলে শান্ত করলেন। বললেন, ভাগজোখ যদি তোর অন্যায্য বলেই মনে হয়ে থাকে তবে আমাকে এসে বলিস না কেন? যা চাস পাবি। পরিবারটাকে বিপদে ফেলিস না।
ভাব হয়ে যাওয়ায় তারা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিল।
এই মুখপুড়ি, সন্ধেবেলায় ঘুমুচ্ছিস যে!
মুখে জোরালো টর্চের আলো পড়তেই ধড়মড় করে উঠে বসে পান্না।
ও মা! পারুলদি!
কাল চলে যাচ্ছি, তাই দেখা করতে এলাম।
এ সময়ে ভোল্টেজ কম থাকে বলে ঘরের টিমটিমে আলোয় ভাল করে কিছু দেখাই যায় না। তবু এই ম্লান আলোতেও যেন জ্যোতির্ময়ীর মতো দেখাচ্ছে পারুলদিকে।
তুমি যে কী করে এত সুন্দর থাকো কিছুতেই বুঝতে পারি না।
দুর বোকা, সুন্দর আর কোথায়! মা বলছিল রং নাকি অনেক কালো হয়ে গেছে। বয়সও কি কম হল? সাঁইত্রিশ। ও বাবা, সাঁইত্রিশ মানে তো বুড়ি।
তোমার একটুও বয়স হয়নি পারুলদি।
হয়েছে হয়েছে। অনেক কষ্ট করে ফিট রাখতে হয়। এক চুল এদিক ওদিক হলেই ওজন চট করে বেড়ে যেতে চায় আজকাল।
একটা মেয়ের সঙ্গে আজ ভাব হল, জানো! তার নাকি খুব ইচ্ছে ছিল তোমার মেয়ে হয়ে জন্মায়।
পারুল অবাক হয়ে বলে, সে কী রে! কে সেই মেয়েটা?
অমলদার মেয়ে সোহাগ।
পারুল একটু গম্ভীর হয়ে বলে, মেয়েটি এঁচোড়ে পাকা। ওর সঙ্গে বেশি মিশিস না।
মিশব কী? আজ পথ ভুল করে এসে পড়েছিল বলে আলাপ হয়ে গেল। অমলদা আজ আসবে, কালপরশুই চলে যাবে ওরা।
অমল রায় আসেনি। ওদের মধ্যে একটু গণ্ডগোল চলছে বোধহয়। তুই বেশি মাখামাখি করতে যাস না। ওরা অন্যরকম। মাথা গুলিয়ে দেবে।
কিন্তু পারুলদি, মেয়েটাকে যে আমার ভীষণ ভাল লাগল। সে বলছিল, তুমি নাকি একজন গডেস।
পারুল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে বসে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, গডেস হওয়া কি অত সোজা? মেয়েমানুষ হয়ে জন্মালে কত পাপ চারদিক থেকে ফণা তোলে। গডেস হয়ে থাকতে দেয় কই?
একটু আনমনা হয়ে গেল পারুলদি। হাতের বড় টর্চটা কয়েকবার ছেলেমানুষের মত জ্বালাল, নেবাল।
তোর কত বয়স হল রে পান্না?
সতেরো।
সতেরো! বলে একটু ভাবল পারুলদি। ওই সতেরো শব্দটাই যেন পারুলদিকে একটু দূরে নিয়ে গেল। বোধহয় সতেরোয় ফিরে যাচ্ছিল সে।
তখনও জন্মায়নি পান্না। কুড়ি বছর আগে পারুলদির সঙ্গে প্রেম হয়েছিল অমল রায়ের। কীরকম প্রেম ছিল ওদের কে জানে। বিয়ে হয়নি। তাতে ভালই হয়েছে। বিয়ে হলে হয়তো প্রেমটা গ্যাদগ্যাদে হয়ে যেত।
তার খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হল, পারুলদি এখনও অমল রায়ের কথা ভেবে মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিনা। ট্র্যাজেডি বড় ভাল লাগে পান্নার। ট্র্যাজেডির মতো এমন রোমহর্ষ আর কীসে আছে?
.
০৪.
মাঘ মাসের রাত দশটায় হঠাৎ বাই চাপল রুইমাছের কালিয়া খাব। খাবেন তো খাবেনই। হ্যারিকেন নিয়ে বড় ছেলে গৌরাঙ্গ আর চাকর শিবু গিয়ে পুকুরে জাল ফেলল। উঠল দশসেরী পেল্লায় এক রুই। কেটেকুটে রান্না করতে করতে রাত বারোটা। তৃপ্তি করে খেয়ে উঠে গৌরহরি গিয়ে শুয়ে পড়লেন। কোনও দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। কালিয়া খেতে চেয়েছিলেন, খাওয়া হয়েছে, ব্যাস আর কী। ওদিকে বাড়ির গিন্নিকে ওই রাতে পাহাড়প্রমাণ সেই মাছ সাঁতলাতে হল। পেটের খিদে পেটেই মরে গেল। যখন এক গেলাস জল খেয়ে শুতে গেলেন তখন ভোর হতে আর বাকি নেই। পরদিন সেই বিপুল মাছ পাড়াপ্রতিবেশীদের বিলি করা হয়েছিল, মাছের সঙ্গে সঙ্গে কালিয়ার গল্পও বিলি হল। বৃত্তান্ত শুনে এসে হাজির হয়েছিল মহিম রায়।
এসব কী হরিদা, বাড়ির পাঁচজনের সুখসুবিধের কথা যে একটুও ভাবেন না। এ কি ভাল?
গৌরহরি অতীব সুপুরুষ, গৌরবর্ণ, লম্বাচওড়া হাড়েমাসে চেহারা। মুখে একটু বিদ্রূপের হাসি, তুই খুব ভাবিস বুঝি? সেইজন্যই তোকে কেউ মানে না।
কথাটা পাথুরে সত্যি। একটা লোক কীভাবে আধিপত্য করে, কোন মন্ত্রবলে মান্যগণ্য হয়ে ওঠে এ তত্ত্বটা আজও বোঝা হল না মহিমের।
একটা মামলার রায় বেরোল বিকেলে। সতেরো জন ফৌজদারি মামলার আসামি। খালাস হতে হতে সন্ধে পেরিয়ে গেল যখন, তখন আর তাদের বাড়ি ফেরার বাস নেই। ট্যাঁকেও নেই পয়সা। গৌরহরি বিন্দুমাত্র চিন্তা না করে বর্ধমান থেকে তাদের সোজা নিজের বাড়িতে এনে তুললেন। সতেরোটা উপোসি ষণ্ডামার্কা গেঁয়ো লোক। এমনিতেই তারা ভাতের পাহাড় এক চোপাটে উড়িয়ে দেয়। সেদিন তারা দুনো খিদে নিয়ে যে পরিমাণ ভাত খেল তা টিকিট কেটে দেখার মতো দৃশ্য। সতেরোটা মুখের ভাত ডাল জোগাতে বাড়ির গিন্নির কী হাল হল তা ফিরেও দেখেননি গৌরহরি। ওটা দেখা যেন তার কাজ বা কর্তব্য নয়।
তিন ভাইয়ের পৈতৃক বাড়ি। দালানকোঠা জমি নিয়ে বিরাট সম্পত্তি। হঠাৎ গৌরহরির খেয়াল হল দুই ভাইয়ের অংশ কিনে নিতে হবে। প্রস্তাব উঠতেই রামহরি আর নরহরি গাঁইগুঁই করতে লাগল। পৈতৃক ভিটে ছাড়বে না। গৌরহরি তখন দাম বাড়াতে লাগলেন। শেষমেশ সেই দাম এত অবিশ্বাস্য রকমের উঁচুতে তুলে দিলেন যা দিয়ে গোটা বাড়িটাই দুবার কেনা যায়। তখন আর ভাইরা আপত্তি করল না, আপত্তি করাটা হাস্যকর হয়ে দাঁড়াত। কিন্তু আপত্তি তুলতে পারত বাড়ির লোকেরাই। দুই উপযুক্ত ছেলে, গিন্নি। তারা বুঝিয়ে বলতে পারত, এরকম আকাশছোঁয়া দাম দিয়ে দুটো অংশ কেনা আহাম্মকি হচ্ছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, কেউ শ্বাসটুকুও ফেলেনি।
কিন্তু মহিম রায় বলেছিল, দাদা, এ যে হাতির দামে নেংটি ইঁদুর কেনা হল!
গৌরহরির প্রতিক্রিয়া হল সামান্যই। ভ্রূ দুটো একটু উঁচুতে তুলে বললেন, দামের তুই জানিস কী? সারা জীবন চার আনা আট আনার হিসেব কষে মরলি, দাম কাকে বলে তা শিখলি কই?
মহিম আর পারেনি। বলে ফেলেছিল, আপনি যেন শরৎ চাটুজ্জের নবেলের ক্যারেক্টার, রক্তমাংসের মানুষ নন।
গৌরহরির ঠোঁটে বাঁকা বিদ্রূপের হাসিটি বদলাল না। ঠান্ডা গলায় বললেন, তুই বড্ড গেরস্ত। অত গেরস্ত হোস না, কষ্ট পাবি।
যে সুরে চাকর-বাকরকে হুকুম করতেন সেই একই সুরে নিজের দুই ছেলেকেও হুকুম করতেন। ছেলে দুটো দিশেহারা হয়ে বাপের হুকুম তামিল করতে ছুটত। ফুলের মতো সুন্দর দুটো মেয়েও কদাচিৎ আসকারা পেত তাঁর কাছে। ছেলেপুলেদের নাড়াঘাঁটাও করতেন না বড় একটা।
সেই মেজাজি, অহংকারী, দাপুটে এবং খানিকটা আত্মসর্বস্ব ও অত্যাচারী পুরুষটি যখন মারা যাচ্ছিলেন তখন মহিম রায় সেখানে আগাগোড়া উপস্থিত। ডাক্তার নাড়ি দেখছেন, আর পুরো পরিবারটা একাগ্র হয়ে ঝুঁকে আছে তাঁর ওপর। চোখ পলকহীন। শ্বাস পড়ছে না কারও। শিয়রে পাথরপ্রতিমার মতো বউঠান। ডাক্তারের একটা নেতিবাচক মাথা নাড়ার পরই একটা দীর্ঘ হাহাকারে ভরা আর্তনাদ করে বউঠান অজ্ঞান হয়ে সোজা মেঝেতে পড়ে গেলেন। দুই ছেলে আছড়ে পড়ল বাবার বুকে। দুটি পুত্রবধূ দুই পা আঁকড়ে ধরে সে কী কান্না!
সারাটা জীবন যে পরিবারটিকে নাজেহাল করে ছেড়েছেন গৌরহরি, যাঁর মর্জি সামলাতে পরিবারের লোকজনকে ধিন ধা নাচতে হয়েছে, তাঁর মৃত্যুতে তো পরিবারটার হাঁফ ছাড়ার কথা। কিন্তু সেরকম হল না তো! বরং মনে হল, গৌরহরির সঙ্গে সঙ্গে যেন এ বাড়ির সূর্যাস্ত হয়ে গেল।
জ্ঞান ফেরার পর বউঠান কেবল বলছিলেন, আমি ওঁর সঙ্গে যাব, কিছুতেই আমি আর বেঁচে থাকতে পারব না।
মহিম রায় মুগ্ধ চোখে চেয়ে দেখছিল, মুগ্ধ কানে শুনছিল। এ সে শুনছে কী? একজন স্বাধিকারপ্রমত্ত অত্যাচারী স্বামীর নির্যাতিতা স্ত্রী বলছে এ কথা? এও কি সম্ভব?
মেলে না, মেলে না, হিসেব কিছু মিলতে চায় না। এই ঊনআশি বছর বয়সে জীবনের অঙ্কে ভুল ধরা পড়ে সে যেন মনে মনে কানমলা খায়। হরিদার কাছে সে অনেক ব্যাপারেই হেরে-যাওয়া মানুষ, কিন্তু মরার ভিতর দিয়ে সেই পরাজয়ের বিপুলতা যেন আরও উদঘাটিত করে দিয়ে গেছে লোকটা।
যে ছেলেটিকে বাপের খেয়াল মেটাতে মার্চ মাসের হাড়কাঁপানো শীতের রাতে পুকুরে জাল ফেলে মাছ তুলতে হয়েছিল, ফিজিক্সের কৃতী অধ্যাপক সেই ছেলে ঝন্টু বাপের বুক থেকে হঠাৎ মুখ তুলে ছোট ভাইকে ব্যস্তসমস্ত হয়ে বলে উঠল, এই মন্টু, দেখ দেখ, বাবার বুকে যেন হার্টবিট পাচ্ছি! কেমন শব্দ হচ্ছে বুকের মধ্যে। বাবা নিশ্চয়ই মরেনি! ফকিরবাবার জল-পড়া খাইয়েছি, মরতে পারেই না।
কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার ছোট ছেলে মন্টু ভ্যাবলার মতো বাবার বুকে কান পেতে কী শুনছিল কে জানে। কিন্তু মহিমের মনে হচ্ছিল, ফকিরবাবার জল-পড়ার গুণ নয় বাবারা, বেঁচে উঠলে হরিদা তোমাদের পিতৃভক্তির জোরেই বেঁচে উঠত। ঘোর কলিকাল বাবারা, নইলে এত ভালবাসা বৃথা যেত না।
দুটি ছেলে সারাজীবন বাপের সঙ্গে কথা বলার সময় দাঁড়িয়ে কথা বলেছে, কখনও বসেনি। বউমারা এই আধুনিক যুগের মেয়ে হয়েও শ্বশুরের সামনে ঘোমটা ছাড়া আসেনি। শোকের বাড়ি যখন মুহ্যমান, চারদিকে কান্নার রোল, তখন মহিম মৃতের ঘরে আনন্দে অভিভূত হয়ে বসে আছে। তার চারদিকে যেন সত্যযুগের হাওয়া বইছে।
শরীর ভাল নয়, সবাই বারণও করেছিল, তবু মহিম রায় গৌরহরির মৃতদেহের অনুগমন করেছিল। তখন গভীর রাত, তিন মাইল রাস্তা ভেঙে যেতে যেতে মনে মনে বলেছিল, কায়দাটা শিখিয়ে দিয়ে গেলেন না হরিদা! বহুকাল ধরে চেলাগিরি করলুম তবু শিখতে পারলুম কই? না কি এসব শেখার বা শেখাবার জিনিসই নয়, এসব কেউ কেউ নিয়ে আসে।
না, মহিম রায় কখনও গৌরহরি চাটুজ্জের মতো ছিল না। সে বরাবর তার পরিবারের প্রতি অত্যধিক স্নেহশীল। পাঁচজনের দুঃখকষ্টের কথা ভেবে সর্বদাই নিজেকে আরাম আয়েস থেকে গুটিয়ে রেখেছে, এক গেলাস জল কাউকে গড়িয়ে দিতে বলতেও ছিল ভারী কুণ্ঠা। ছেলেদের সঙ্গে এক সারিতে খেতে বসেছে, বড় মাছের টুকরোগুলো ছেলেদের পাতেই দিয়েছে দেবিকা–তার বউ। কখনও তাতে কিছু মনে করেনি মহিম। ভুলটাও কি সেখানেই? তখন থেকেই কি সংসারে সে উদ্বৃত্তের খাতে?
যখন মেজো ছেলে অমল ক্লাসে কাঁড়ি কাঁড়ি নম্বর পেয়ে ফাস্ট হওয়া শুরু করল তখন হল আরও চিত্তির। প্রথমে আনন্দ এবং বিস্ময়। পুত্ৰগৌরবে বুক তিন ইঞ্চি বেড়ে গেল। মাধ্যমিকে স্ট্যান্ড করে যখন সেই ছেলে হইচই ফেলে দিল তখন এল ভয়। ছেলেকে সেই থেকে সমীহ করতে শুরু করেছিল সে। বাপকে কোনওদিনই ছেলেরা সমীহ করত না। অমলের তাচ্ছিল্যটা ছিল আরও প্রকট। কৃতী ছেলেদের বোধহয় সেই অধিকার জন্মায়–এই ভেবে মহিম মেনেও নিল ব্যাপারটা। দেবিকা মাঝে মাঝেই বলত, অমল! অমল তো মানুষ নয়, ভগবান।
জিন থেকেই সব হয়-টয় বলে শুনেছে মহিম। বংশধারার কোন গাঁটে কোন জিন যে ঘাপটি মেরে থাকে আর তা থেকে কী করে যে এক একজন এরকম দলছুট জন্মায় কে জানে! নইলে তার মতো অ্যাভারেজ সাদামাটা মানুষের ঘরে অন্য সব সাদামাটা ছেলেমেয়ের মধ্যে একটা কী করে অমন মাথাওলা বেরোল!
ঠোঁটকাটা, বদরসিক রসময় একবার বলেছিল, ওরে, এ যে কাকের ঘরে কোকিলের ছা। তোর হাতে আর কেউ তামাক খেয়ে গেল না তো!
এ কথায় প্রায় হাতাহাতি হওয়ার উপক্রম। ঠাট্টাই হবে, তবু অমন ঠাট্টা কেউ করে? আজ অবশ্য কথাটা ভাবলে রাগ হয় না। অমল কি সত্যিই তার ছেলে? সে কি ওর নির্মাতা? ওর চোখ, কান, মুখ, মন, মেধা এসব তো মহিমের তৈরি নয় হে বাপু। সে জন্মদাতা হতে পারে, সৃষ্টিকর্তা তো নয়।
অমলের সঙ্গে ভাবভালবাসা হয়েছিল গৌরহরিদার ছোট মেয়ে পারুলের। সেটা মহিমের কাছে আনন্দের ব্যাপারই ছিল। হরিদার সঙ্গে একটা আত্মীয়তার সম্পর্ক তার আকাঙ্ক্ষারই বস্তু। তা ছাড়া ও বংশের মেয়ে ভালই হওয়ার কথা। যে মেয়ে নিজের বাবার সেবা করে বড় হয়েছে সে স্বামীর ঘরে এসেও সবাইকেই সুখী করে।
কিন্তু আচমকাই পারুলের অন্য পাত্রের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়ে গেল।
মহিম রায় দৌড়ে গিয়েছিল গৌরহরির কাছে।
হরিদা, এ কী শুনছি!
গৌরহরি বৈঠকখানায় বসে দলিলপত্র দেখছিলেন। তলচক্ষুতে তাকে একটু দেখে নিয়ে বললেন, কখনও প্রেমে-ট্রেমে পড়েছিস?
আমি! কী যে বলেন! আমাদের সুযোগ ছিল কোথায়?
তাহলে বুঝবি কী করে? ও-বস্তু আমারও তো হয়নি। পঁচিশ বছর বয়সে একটা দশ বছর বয়সি মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিল বাবা। সে প্রেম করবে কী, ভয়েই মরে। তাই বলছি এসব আমাদের বোঝবার কথা নয়।
কিন্তু ওদের যে ভালবাসা ছিল, বিয়ের কথা হয়ে আছে।
তাই তো বলছি। তুই কি ভাবছিস আমি জোর করে পারুলের বিয়ে অন্য জায়গায় দিচ্ছি? সেসব ভাবিসনি। অমল ভাল ছেলে, আমাদের সকলেরই পছন্দ। কিন্তু বিয়েটা হচ্ছে পারুলের ইচ্ছেতেই।
কেন এরকম হল হরিদা?
বললুম যে, তুই আর আমি দুজনেই পুরনো আমলের মানুষ, এসব আমাদের বোঝার কথা নয়। তবে এসব প্রেম-ট্রেম হল কাঁচা মাটির কাজ। জলে বৃষ্টিতে গলে ধুয়ে যায়। সংসারের আঁচে না পড়লে কি এসব পাকাপোক্ত হয়? ওদের প্রেম কেঁচে গেছে।
মনটা বড় দমে গেল মহিমের।
গণ্ডগোলটা কোথায় হল হরিদা?
গৌরহরি মাথা নেড়ে বলেছিলেন, সবটাই গণ্ডগোল, আগাপাশতলাই গণ্ডগোল। মন খারাপ না করে বাড়ি যা। অমলের একটা ভাল দেখে বিয়ে দে।
দেবিকা ফুঁসেছিল খুব, হুঁ, অমন সুন্দরী কত আমার অমলের পায়ে গড়াগড়ি যাবে। কত বড় ঘরের মেয়ে যেচে আসবে। দেখে নিও।
দেখা ছাড়া মহিমের কিছু করারও ছিল না। সংসারের প্রায় কোনও ব্যাপারেই তার মতামতের তোয়াক্কা কেউ করত না কখনও। পারুলের বিয়ের মাসখানেকের মধ্যেই অমল আর তার মায়ে মিলে বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেলল। সেই বিয়েতে মহিমের ভূমিকা বরকর্তার মতো ছিল না, ছিল আমন্ত্রিত একজন অতিথির মতোই। বড় ঘরেরই মেয়ে, সুন্দরীও। কিন্তু মহিমের তেমন কোনও আহ্লাদ হল না। বিয়ের পরই ছেলে-বউ উধাও হয়ে গেল বোম্বেতে। তারপর বিদেশে। মুছেই গেল জীবন থেকে। যেমনটা হয়ে থাকে।
আজ তৃষিত চোখে বসে গৌরহরিদার দুই ছেলের পিতৃতর্পণ মন দিয়ে আগাগোড়া দেখছিল মহিম। দুটো ছেলেই নিষ্ঠার সঙ্গে হবিষ্যি করেছে, ন্যাড়া হয়েছে, নাবালক দুটি অনাথের মতো বসে বাবার স্বর্গের পথ পরিষ্কার করার চেষ্টা করছে। প্রচুর দানসামগ্রী, বিরাট আয়োজন। কোথাও কিছু অভাব রাখেনি। দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। স্বর্গের পথ পরিষ্কার না হোক এত ভালবাসার কি দাম নেই নাকি? মহিম মরলে তার ছেলেরাও হয়তো নেড়া হবে। কিন্তু হবে বিরক্তির সঙ্গে। শ্রাদ্ধও কি করবে না? করবে, তবে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে। মনে মনে বলবে, বাপটা মরে বড্ড ফাঁসিয়ে দিয়ে গেছে।
কাকা, অমন চুপটি করে বসে আছেন যে!
চোখ তুলে চোখ দুটো জুড়িয়ে গেল মহিমের। পারুল।
ক্লিষ্ট হেসে বলল, এই বসে বসে দেখছি।
ওসব আপনাকে দেখতে হবে না। বরং ঘরে এসে মায়ের সঙ্গে বসে গল্প করুন।
বুদ্ধিমতী মেয়ে। হয়তো ভেবেছে, বুড়ো মানুষের এই বসে বসে অন্যের শ্রাদ্ধ দেখাটা বোধহয় ভাল হচ্ছে না।
মহিমের চোখে জল আসছিল। বলল, মরার কথা মনে হচ্ছে না মা, ভালবাসার কথা মনে হচ্ছে। হরিদা বড় ভাগ্যবান।
না কাকা, ওসব ভাবতে হবে না। ঘরে চলুন, এখানে যজ্ঞের ধোঁয়া লাগছে আপনার। মুখটাও তো শুকিয়ে গেছে! ডাবের জল খাবেন?
না মা, ওসব দরকার নেই।
তাহলে বরং আপনাকে এক কাপ চা দিই।
হাতে চায়ের কাপ নিয়ে অভিভূতের মতো বসে রইল মহিম। এইটুকু সমাদরও যেন অনেক। অমলের সঙ্গে পারুলের বিয়েটা হয়নি বলে আজ বিশ বছর বাদে নতুন করে বুকটা ব্যথিয়ে উঠছিল তার। চায়ে চুমুক দেওয়া হল না। হাতে ধরা চায়ের কাপ ঠান্ডা হয়ে গেল, বুকের ভিতরটা হল না। একটা চাপা-পড়া আগুন বহুকাল বাদে ধীইয়ে উঠল।
সারাদিন আজ শ্রাদ্ধবাড়িতেই কেটে গেল মহিম রায়ের। গৌরহরিদা নেই, না থেকেও বাড়ির সর্বত্র ছড়িয়ে আছেন। মরে যাওয়ার পরও এক একটা মানুষ বহুকাল থেকে যায়। ধ্যানে, শোকে, মনে পড়ায়, শূন্যতায় সে বারবার জীয়ন্ত হয়ে ওঠে। কারও কারও মরার পরেও মরে যেতে অনেক সময় লাগে।
সন্ধের পর ফিরছিল মহিম। বেলা ছোট হয়ে গেছে, টক করে বড্ড অন্ধকার হয়ে যায়। টর্চটাও আনেনি সঙ্গে। চোখের তেমন জোর নেই আজকাল। বেগুনক্ষেতের পাশ দিয়ে মেটে রাস্তা ধরে আনমনে ধীর পায়ে হেঁটে ফিরছে মহিম। বিষণ্ণতায় সামান্য নুয়ে-পড়া শরীর।
হঠাৎ আবছা আঁধারে একটা সাদা ছায়ামতো ঝোপঝাড় থেকে বেরিয়ে এসে আবার অন্ধকারে দ্রুত মিলিয়ে গেল। থমকাল মহিম। কে ওটা? আবার সাদা ছায়ামতো কী যেন দুলে উঠল সামনে। লহমায় মিলিয়ে গেল।
কে? কে রে?
কেউ জবাব দিল না। সামনে বুক সমান ফণীমনসার আড়াল। তার ওপাশে ফটিক কাঞ্জিলালের পতিত জমি। ফটিক বাড়ি করবে বলে জমিটা কিনে ভিতপুজো অবধি করেছিল। তারপর বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে আমগাছে ফাঁসি দিয়ে মরে। বাড়িটা আর হয়নি। জমিটা আগাছায় ভরা। মাঝখানে অভিশপ্ত আমগাছটা ঝুপসি হয়ে দাঁড়িয়ে। সাপ-খোপের আড্ডা। লোকে অশরীরীর ভয়ও পেত আগে। ফটিক নাকি ওখানেই গেড়ে বসে আছে, জ্যান্ত লোকদের মরার জন্য ডাকাডাকি করে।
মহিমের ভূতের ভয় নেই। কিন্তু সাদাটে ছায়াটা কীসের তা বুঝতে পারল না। এ সময়ে কুয়াশা একটু হয় বটে, কিন্তু কুয়াশা তো ছুটে বেড়াবে না। চোখেরই ভুল হল কি?
মহিম রায় গুটি গুটি আরও কয়েক পা এগোল। না, চোখের ভুল নয়। ফটিকের পতিত জমিতে বাস্তবিক একটা সাদা মূর্তি দু হাত দুদিকে পাখির ডানার মতো ছড়িয়ে দিয়ে ধীরে ঘুরে ঘুরে ঢেউ হয়ে নেচে বেড়াচ্ছে। শিউরে উঠল মহিম। কত ইট কাঠ পড়ে আছে জমিতে, কত আগাছার দুর্ভেদ্য জঙ্গল। সাপ খোপ এবং হীন দংশক প্রাণীদের আড্ডা। কোনও মানুষ এই সন্ধেবেলা ওখানে যায় পাগল না হলে?
কে? কে রে ওখানে?
মূর্তিটা যে মেয়েছেলের তাতে সন্দেহ নেই। মহিম স্তম্ভিতের মতো দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখতে লাগল। মেয়েটা ঢেউয়ের মতো শরীর বইয়ে দিচ্ছে, নানা বিভঙ্গে হেলে যাচ্ছে ডাইনে বাঁয়ে পিছনে। ঝুঁঝকো আঁধারে বোঝা যাচ্ছে গলা থেকে গোড়ালি অবধি একটা সাদা পোশাক পরে আছে মেয়েটা।
হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল এরকম একটা পোশাক কয়েকদিন আগে সোহাগকে পরতে দেখেছিল মহিম। পোশাকটার ওপর জরির বুটি আছে। নিজের নাতনি, কিন্তু ওর সঙ্গে ভাল করে পরিচয়ই নেই মহিমের। ওরা কথাটথা বিশেষ বলতে চায় না কারও সঙ্গে। একটা কঠিন, নীরব দূরত্ব বজায় রাখে। কিছুদিন আগে অমল হঠাৎ একদিন এসে ওদের পৌঁছে দিয়ে গেল। বলে গেল, ওরা এখন কিছুদিন এখানেই থাকবে। মেয়ের নাকি একটু চেঞ্জ দরকার। খরচের টাকাপয়সাও দিয়ে গেল দাদা কমলের হাতে।
একটু অবাকই হয়েছিল মহিম। ওরা কস্মিনকালেও কেউ এখানে আসে না। দু মাস চার মাস পরে হয়তো কখনও অমল এসে হাজির হয়, এক বেলা থেকেই চলে যায়। হয়তো চেনা দিয়ে যায়, সৌজন্য বজায় রাখে। অমল এলেও পরিবার কখনও আনে না। তাই ওদের সঙ্গে ভাব বা ভালবাসা কিছুই হল না। আত্মীয়তা বা রক্তের সম্পর্ক ইত্যাদি ব্যাপারগুলো ক্রমেই বস্তাপচা বর্জ্য ধারণা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। একদিন হয়তো বাপ-ছেলের সম্পর্কও ঘুচে যাবে। যাবে কেন, যাচ্ছেও ক্রমে ক্রমে। শ্বশুর, ভাসুর, দেওর, ননদ এসব শব্দ থাকবে শুধু ডিকশনারিতে। সেটা মহিম এই জীবনেই টের পেয়ে যাচ্ছে।
বউমাটি এসে প্রথম দিন তাকে একটা প্রণাম করেছিল। খুব ভক্তিভরে নয়, পা দুটো ভাল করে ছোঁয়ওনি, একটু ভান করেছিল মাত্র। ব্যস, তারপর সেই যে আলগোছ হল, তারপর আর মুখোমুখিই হল না একই বাড়িতে থেকেও। নিজেরা নিজেরা থাকে, নিজেদের মধ্যেই ইংরিজিতে কথা কয়, ঝগড়া টগড়ার শব্দও কানে আসে।
মহিমাদীপ্ত রায় নামে যে ছেলেটি একসময়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরিজিতে এম এ পাস করেছিল তাকে আজকের মহিম রায় বলে চেনা মুশকিল। না, দুটো লোক এক নয়। মহিমাদীপ্তর দীপ্তি আর মহিমা দুটোই অস্তাচলে গেছে। এখন এই যে মহিম রায় নামে লোকটি এ এক গেঁয়ো ভিতু মানুষ, দেখলে মুখ্যু বলেই ধরে নেবে মানুষ। মুখ্যু ছাড়া আর কী? কবে দু পাতা অংবং ইংরিজি পড়েছিল তার জোরে কি আর বিদ্বান বলে পরিচয় দেওয়া যায়। লোকে ভুলে গেছে, মহিম রায় নিজেও ভুলে গেছে। কোন তোরঙ্গের অন্ধকারে লজ্জায় মুখ লুকিয়ে পড়ে আছে সার্টিফিকেটখানা।
তবে ওই ডিগ্রির জোরে রেলে চাকরি পেয়েছিল মহিম রায়। শিয়ালদার ক্রু ইন চার্জ। কিন্তু বেশিদিন চাকরিটা করে উঠতে পারেনি। বদলির চাকরি, ঘুরে ঘুরে কয়েক জায়গায় বদলি হওয়ার পর শরীর খারাপ হতে লাগল, পেটে জাপ্পো আমাশা। বাবা বলল, চাকরির দরকার নেই, জোতজমি যথেষ্ট আছে, গাঁয়ের হাই স্কুলে ইংরিজির মাস্টারও দরকার। এলেই হয়।
সেই চলে আসা। কিছুদিন হাই স্কুলে ইংরিজি পড়িয়েছিল। তারপর বিদ্যাচর্চা সেই যে থেমে গেল আর চালু হয়নি।
ভুলেই গিয়েছিল সবাই, হঠাৎ বুঝি একদিন সন্ধ্যার মনে পড়ে গেল যে, তার বাবা ইংরিজিতে এম এ পাস। একদিন সন্ধেবেলা সে এসে হামলে পড়ল, ও বাবা, তুমি কী গো!
কেন, হলটা কী রে?
ওরা যে অত কটর কটর করে ইংরিজি বলে আমাদের দিনরাত জব্দ করছে, আর তুমি চুপ করে বসে আছ! তুমি না ইংরিজিতে এম এ পাস!
তাতে কী হল?
মুখের ওপর দুটো ইংরিজি কথা শুনিয়ে দিতে পারো না ওদের?
অবাক হয়ে মহিম বলল, কেন রে, ওরা ইংরিজি বলছে বলে আমি কেন ইংরিজি বলতে যাব?
কেন বলবে না শুনি? ওরাও দেখুক, আমরা ওদের চেয়ে কিছু কম নেই।
মায়াভরে একটু হেসেছিল মহিম। তার এই মেয়েটির লেখাপড়ার মাথা ছিল না। ক্লাস সিক্স অবধি উঠতেই গলদঘর্ম হয়ে ইস্তফা দিল। হয়তো সেইজন্য মনে মনে নিজেকে ছোট ভেবে কষ্ট পায়, হিংসেতে জ্বলেও হয়তো একটু।
মহিম রায় স্নিগ্ধ গলায় বলেছিল, তুই কি ভাবিস ওরা ইংরিজি শুনে জব্দ হয়ে যাবে? ব্যাপারটা তা নয় রে।
না বাবা, দিনরাত বড় অপমান লাগছে আমার। ইংরিজিতে আমাদের নিয়ে খারাপ খারাপ কথা বলে, ঠাট্টাইয়ার্কি করে। অন্তত আমরা যে ওদের কথা বুঝতে পারছি সেটা ওদের জানিয়ে দেওয়া দরকার। তাহলে সাবধান হবে, আর বলবে না। যখনই ওরা কেউ উঠোনে নেমে আসবে তখনই এই জানালা দিয়ে তুমি ওদের লক্ষ করে খুব ইংরিজি বলে দিও। দু-চারবার বললেই দেখবে কাজ হচ্ছে।
মহিম রায় কী বলবে ভেবে পেল না। মুখ্যু-সুখ্যু মেয়েটার জীবনে অনেক দুঃখ। তার ওপর এই ইংরিজি না-জানার দুঃখটা চেপে বসায় মাথাটা গরম হয়েছে। জানালা দিয়ে খামোখা ইংরিজি আউড়ে যাওয়ার হাস্যকরতা ও বুঝতেই পারছে না।
সন্ধ্যা বুঝবে না, ইংরিজি কোনও বাধা নয়। ওদের সঙ্গে তাদের দূরত্ব শুধু ইংরিজিই তো রচনা করেনি। করেছে মনোভাব। সেটা সন্ধ্যা বুঝবে না।
মহিম রায় দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল।
সন্ধ্যা ফিস ফিস করে বলল, অত দেমাক দেখাচ্ছে, জানো তো মেয়েটা কলকাতায় একটা কিছু কেলেঙ্কারি করে এসেছে।
কেলেঙ্কারি! কী করেছে?
কিছু একটা হবে। যখন মায়ে মেয়েতে ঝগড়া হয় তখন বুঝতে পারি।
মহিম ক্লান্ত বোধ করে। সন্ধ্যা ওদের পছন্দ করে না বলেই বানিয়ে বলছে বোধহয়। বড় জ্বলুনি হচ্ছে মেয়েটার। কিন্তু এসবের নিদান তো তার জানা নেই।
ঘরে বসে অবশ্য লক্ষ করে মহিম। ছেলেটা, মেয়েটা, বউমা মাঝে মাঝে আলাদা আলাদা উঠোনে নেমে আসে। জানালা দিয়ে দেখে ওদের মহিম। আপনজন বলে মনে হয় না। বহু দূরের মানুষ বলে মনে হয়। ওরা ভাল না খারাপ তা জানে না মহিম। জেনে হবেটাই বা কী? এ-ঘরে কখনও উঁকিও দেয় না তারা। একটা হ্যাগার্ড বুড়ো এক কোণে পড়ে থাকে, উঁকি মারার আছেটাই বা কী?
এই সন্ধেবেলা মেয়েটাকে ফটিকের পতিত জমিতে নেচে বেড়াতে দেখে প্রমাদ গুনল মহিম। সাপে কামড়ালে মরবে যে। এ সময়ে সাপ-খোপ বেরোয়।
কে রে? সোহাগ নাকি তুমি! অ্যাঁ।
কোনও জবাব নেই। নৃত্যের কোনও বিরতিও পড়ল না। যেন শুনতেই পায়নি। উপেক্ষা করছে কি?
শোনো সোহাগ, ওখানে সাপ-খোপ আছে, চলে এসো।
জবাব নেই।
কথা বলছ না কেন? আমি দাদু। ওখান থেকে চলে এসো। ও-জায়গাটা ভাল নয়। মেলা কাঁটাগাছ আছে, কাচের টুকরো আছে, ইট আছে। পড়ে যাবে যে!
মেয়েটা তেমনই বিভোর হয়ে হালকা পরির মতো ঘুরে ঘুরে নেচে বেড়াতে লাগল। মহিম শুনতে পেল, মেয়েটা গুন গুন করে কী যেন বলছেও। গান কি? না, গান নয়, অনেকটা স্তোত্রের মতো কিছু। ভাল শোনা যাচ্ছে না।
মহিম ব্যাপারটার অস্বাভাবিকতা হঠাৎ টের পেল। হয়তো মাথার গণ্ডগোল আছে বা আর কিছু। এভাবে মেয়েটাকে রেখে তো চলে যাওয়া যায় না। অন্ধকার ক্রমশ গাঢ় হচ্ছে। মেয়েটা নিজের বিপদ বুঝতে পারছে না। নিরস্ত্র, টর্চহীন মহিম রায় রাস্তা ছেড়ে ছোট শুখা নালাটা পার হয়ে জমিতে ঢুকল।
সোহাগ! সোহাগ! আমি দাদু। এই যে–বলতে বলতে এগিয়ে গিয়ে হঠাৎ খপ করে নৃত্যপর মেয়েটার একটা হাত চেপে ধরল সে। সঙ্গে সঙ্গে একটা অস্ফুট আর্তনাদ করে মেয়েটা আছড়ে পড়ে গেল মাটিতে। ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গেল মহিম। এ আবার কী হল? মূর্ছা গেল নাকি?
হাঁটু গেড়ে পাশে বসে মেয়েটাকে একটু নাড়া দিয়ে সে ডাকছিল, সোহাগ! দিদিভাই! কী হয়েছে তোমার?
মেয়েটার গায়ে জবজব করছে ঘাম। গায়ের পোশাক ভিজে সপসপ করছে। শরীরে একটা কাঁপুনিও উঠে আসছে। হঠাৎ অস্ফুট বিড়বিড় করে স্তোত্রপাঠের মতো কী যেন বলে যেতে লাগল মেয়েটা। কিছু বোঝা গেল না।
কী করবে মহিম? ভয়ে তার শরীর হিম হয়ে গেল। এই তল্লাটে লোকজনের যাতায়াত নেই, বাড়িঘরগুলোও একটু দূরে দূরে। উলটোদিকে নির্জন আমবাগান। দৌড়ে গিয়ে লোকজন ডেকে আনা যায় বটে, কিন্তু ততক্ষণ এই নিরালায় মেয়েটা অরক্ষিত থাকবে। কাজটা ঠিক হবে না।
একা নিয়ে যেতে পারবে সে? ঊনআশি বছর বয়সের শরীরে কি আর সেই ক্ষমতা আছে? মেয়েটাও তেমন রোগাপটকা নয়। কিন্তু চেষ্টা তো করতেই হবে। কিছুতেই তো ফেলে যাওয়া যায় না।
দু হাতে পাঁজাকোলা করে যখন সোহাগকে তুলতে যাচ্ছিল মহিম তখনই হঠাৎ এক অলৌকিক ঘটনা ঘটল। অলৌকিক! সম্পূর্ণ অলৌকিক! যখন মেয়েটাকে প্রাণপণে তুলতে চেষ্টা করছে তখনই হঠাৎ তার নিজের ভিতরেই ঘটে গেল সেই অলৌকিক।
হঠাৎ যেমন জলভারনম্র মেঘ থেকে অঝোর বৃষ্টি নেমে আসে ঠিক তেমনই বুকের ভিতরে এক রক্তের কলরোল উঠল। সমস্ত শরীর ভেসে গেল মায়ায়। এ তো তারই প্রাণ থেকে প্রাণ পেয়ে জন্মানো মেয়ে, এ যে তারই রেতঃবাহী, শোণিতবাহী একজন! ওরা মানে না। জানে না বলে মানে না। না মানুক, আজ এই সন্ধ্যায় পরম্পরার এক সূত্রপথ উদঘাটিত করে দিল ওই অলৌকিক অনুভূতি। এ সোহাগ, এ তো সে নিজেই, মহিমাদীপ্ত রায়।
শরীর ভেঙে আসছিল মেয়েটাকে তুলতে। ঊনআশি বছরের শরীর তবু হার মানেনি। ধীরে ধীরে পাঁজাকোলে তুলে নিয়ে একটু টলোমলো পায়ে বন্ধুর জমিটা পা চেপে চেপে পার হয়ে মেটে পথে উঠে এল মহিম। হাঁফ ধরে যাচ্ছে, হাত ভেরে আসছে। পারবে কি?
পারত না। পথে উঠে সোহাগের এলানো শরীরটাকে একটু দাঁড় করাল সে, তারপর নিচু হয়ে ডান কাঁধে পাটকরা চাদরের মতো তুলে নিল সে। তাতে একটু সহজ হল ব্যাপারটা। কিন্তু তবু শরীর দিচ্ছে না। বহুকাল পর গায়ত্রী জপ করতে লাগল মহিম। আর কোনও মন্ত্র তো জানা নেই। গায়ত্রীতে কাজ হবে কি না জানা নেই। অন্তত কিছু একটা চলতে থাকুক ভিতরে। কুলি মজুররাও তো শক্ত কাজের সময় হেঁইও-হেঁইও করে। সেরকমই একটা কিছু ধরা যাক।
পথটুকু পার হতে ঘেমে গেল মহিম। বুকটা যেন ফেটে যেতে চাইছে। এই পরিশ্রম শরীর হয়তো সইবে না। হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হয়ে যেতে পারে। হলে হোক। সারা জীবন কার কোন উপকারে লেগেছে মহিম। আজ এই বাচ্চাটাকে উদ্ধার করে আনতে গিয়ে যদি মরতে হয় তো দুঃখের কিছু নেই।
সন্ধ্যার এক সাপ্লায়ার ছোকরা তার সাইকেলের হ্যান্ডেলে ক্যাম্বিসের ব্যাগে মাল বোঝাই করছিল। মহিম উঠোনে পা দিতেই সে চেঁচিয়ে উঠল, কী হয়েছে জ্যাঠামশাই? দাঁড়ান, দাঁড়ান, আমি ধরছি।
সাইকেল রেখে ছুটে এসেছিল ছেলেটা।
কিন্তু মহিম রায় বারণ করলেন, তুমি ছুঁয়ো না বাছা। এতদূর এনেছি, বাকিটুকুও পারব। তুমি বরং ওর মাকে ডেকে দাও।
নিজের ঘরে এনে বিছানায় সোহাগকে শুইয়ে দিল মহিম। তারপর, চেয়ারে বসে কলকল করে ঘামতে আর কুকুরের মতো হাঁফাতে লাগল। হার্টফেল হওয়ারই কথা। তবু হচ্ছে না এখনও। শরীরটা যন্ত্রণায় অবশ।
খবর পেয়ে দৌড়ে এল মোনা। মোনালিসা না কী যেন নাম বউমার। অমল মোনা বলেই ডাকে। ঘরে ঢুকেই মেয়ের দিকে চেয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল মোনা। দুটো শ্বাস ফেলার সময়টুকু ফাঁক দিয়ে বলল, কী হয়েছে?
পরে শুনো। এখন ওর চোখেমুখে জল দাও। ওই ঘটিতে জল আছে।
মোনার মুখে কোনও উদ্বেগ দেখা দিল না। দেখা দিল চাপা রাগ। চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে গেল, কপালে ভ্রূকুটি, ফর্সা মুখটায় লাল আভা। ঘটিটা তুলে নিয়ে তীব্র আক্রোশে কয়েকটা জলের ঝাপটা মেরে রাগে গনগনে গলায় বলতে লাগল, ইউ আর ডুয়িং দি ভুডু এগেইন, ইউ বিচ… ইউ বিচ… বিচ…
বুকটা শান্ত হচ্ছিল না মহিমের। মস্ত হাঁ করে শ্বাস নিচ্ছিল।
সন্ধ্যা ঘরে ঢুকে এসে তাড়াতাড়ি বাবাকে ধরল, কেমন লাগছে বাবা? ডাক্তার ডাকব?
মহিম মাথা নেড়ে বলল, না। ঠিক হয়ে যাবে।
সন্ধ্যা হঠাৎ এবার মোনার দিকে ফিরে বলল, ওভাবে জল ছিটোচ্ছ কেন মেজো বউদি? বিছানাটা যে ভিজে যাচ্ছে!
মোনা তীব্র বেগে ঘুরে দাঁড়িয়ে ধমকে উঠল, তা নিয়ে তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না। গেট আউট ফ্রম হিয়ার…
সন্ধ্যা ফুঁসে উঠে বলল, অত মেজাজ দেখাচ্ছ কেন? বিছানাটা ভিজে যাচ্ছে, তাই বলেছি। খারাপ কথা বলেছি কিছু?
মোনা তেমনই বিষাক্ত গলায় বলে, মেয়েটার চেয়ে বিছানাটা বেশি হল? ক্রাঙ্ক হেড কোথাকার?
সন্ধ্যা ছাড়বার পাত্রী নয়, সমানে গলা তুলে বলল, বাঃ বেশ তো! আমার বুড়ো বাবা তোমার ন্যাকা মেয়েকে ঘাড়ে করে বয়ে নিয়ে এল, আর এখন একেবারে দরদ উথলে উঠছে! একটু আগে তো মেয়েকেই গালাগাল করছিলে।
বেশ করেছি। তুমি তোমার কাজে যাও।
আমি কোথায় যাব সেটা আমি বুঝব। এটা আমার বাবার ঘর। আমাকে যদি সইতে না পার তাহলে তুমি নিজের ঘরে যাও। আমাকে যেতে বলার তুমি কে?
ঝগড়া থামানোর জন্য যে দুজনের মাঝখানে পড়ে সামাল দেবে সেই শক্তিও নেই মহিমের। অসহায়ভাবে সে দেখছিল, যেন দুটো বনবেড়াল কথা দিয়ে আঁচড়াআঁচড়ি কামড়াকামড়ি করছে। সে একবার হাতটা তুলল। দুর্বল হাতটা পড়ে গেল ধপাস করে।
.
০৫.
হরিহরপাড়ার কাঁচা রাস্তা পেরিয়ে, গাছগাছালির আড়াল-আবডালে ঢাকা পড়তে পড়তে এবং ফের প্রকাশ পেতে পেতে যেন একটা চিরুনির ভিতর দিয়ে ওই আসছে রসিক বাঙাল। পরনে কালচে পাতলুন, তাতে হলদে জামাটা গোঁজা, হাতে অ্যাটাচি কেস।
চৌধুরীদের পুকুরে আজ টিকিট কেটে মাছ-ধরার কম্পিটিশন। কাতারে লোক হুইল ছিপ নিয়ে বসে গেছে। মেলা লোক জুটেছে মাছ ধরা দেখতে। ভিড়ে ভিড়াক্কার। সকাল থেকেই জায়গাটায় থানা গেড়ে ছিল মরণ। খানিকক্ষণ মাছ ধরা দেখে সঙ্গীসাথীদের সঙ্গে একটু বল খেলল। খিদে চাগাড় দেওয়াতে বাড়ি-মুখোই ফিরছিল সে। তখনই দূর থেকে দেখল রসিক বাঙাল আসছে। আজ বুধবার, বাঙালের আজ আসার কথা নয়। তার মানে কলকাতায় ঝগড়া হয়েছে। ঝগড়া করে এলে রসিক বাঙালের মেজাজ বড্ড তিড়িক্কি থাকে।
সুতরাং মরণ ছুট লাগাল। বাড়িতে গিয়ে মাকে আগাম জানান দেওয়া দরকার। আর জিজিবুড়িকেও তাড়াতে হবে। বেরোবার সময়ে দেখে এসেছে, জিজিবুড়ি উঠোনে বসে হাপড়হাটি বকে মরছে। জিজিবুড়ির হল অভাবের সাতকাহন। সব সময়ে এটা চাই, সেটা চাই। রসিক বাঙাল জিজিবুড়িকে দু চোখে দেখতে পারে না।
মরণ অঙ্কে চল্লিশের বেশি পায় না বটে, কিন্তু দৌড়ে বরাবর ফার্স্ট হয়। ক্লাবঘরের খেলার মাঠ পেরিয়ে সে চোখের পলকে চাটুজ্যে বাড়ির উঠোন দিয়ে শর্টকাট মেরে নিজেদের বাড়ির উঠোনে ঢুকেই চেঁচাল, বাঙাল আসছে! বাঙাল আসছে!
জিজিবুড়ি পানের বাটা কোলে নিয়ে রোদে বসে ছিল। মুখে দোক্তা দেওয়ার পর জিজিবুড়ির চোখে যেন আরামের তন্দ্রা চলে আসে। চেঁচানি শুনে জিজিবুড়ি চমকে উঠে বলে, আ মোলো! আজ আবার বাঙাল এল কেন?
পালাও জিজিবুড়ি, এসে পড়ল বলে।
তড়িঘড়ি উঠতে গিয়ে কোলের পানের বাটা ঠনাৎ করে পড়ে গেল উঠোনে। খোলা কৌটো থেকে সুপুরির টুকরো ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে, চুন লেপটাল, দোক্তা ছিটিয়ে গেল।
দ্যাখ দিকিনি কাণ্ড! অমন চেঁচাতে আছে! এখন এসব তোলে কে?
তুলতে হবে না জিজিবুড়ি, পালাও শিগগির।
যাচ্ছি বাপু, যাচ্ছি। দোক্তাগুলো একটু কুড়িয়ে দিবি ভাই? যতীনকে কত বলে বলে তবে আনাতে হয়। দামও কি কম? এই দোক্তাটুকুর জন্যই বেঁচে আছি, প্রাণটা এখনও ওই জন্যই ধুকপুক করে।
তুমি বড্ড বকো জিজিবুড়ি। বাড়ি যাও না, মুক্তাদি কুড়িয়ে তোমাকে দিয়ে আসবেখন।
মাজায় ব্যথা, জিজিবুড়ি তাই একটু বাঁকা হয়ে উঠোনের পিছনভাগে এগোতে এগোতে বলে, দিস কিন্তু পাঠিয়ে ভাই।
দোতলার বারান্দায় এসে মা বলল, কী হল রে? কে আসছে বললি?
বাঙাল আসছে।
মায়ের মুখ শুকোল। বলল, তবে বড়গিন্নির সঙ্গে অশান্তি হয়েছে ঠিক। যা যা পড়তে বস গে। আলায়-বালায় ঘুরিস, টের পেলে আস্ত রাখবে না।
সেটা খুব জানে মরণ। জিজিবুড়িকে রওনা করে দিয়ে সে এক লাফে ঘরে ঢুকে পড়তে বসে গেল। অসময়ে, অ-দিনে বাঙাল আসা মানেই গণ্ডগোল। বই খুলে কান খাড়া করেই বসে রইল সে। পরবর্তী দৃশ্য ও ঘটনাগুলি তার খুব জানা। বাঙাল আসবে, এসে ওপাশের একতলার কোণের ঘরে ঢুকে সোজা গিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়বে। কারও সঙ্গে একটিও কথা কইবে না। একদম পাথরের মতো চুপ। ওই সময়ে কেউ কাছে যাওয়ার সাহস পায় না। অন্তত আধঘণ্টা মা পর্যন্ত চৌকাঠ ডিঙোয় না। আধঘণ্টা বাদে মা এক কাপ গরম চা নিয়ে গিয়ে টেবিলে রাখবে। তারপর খুব মোলায়েম গলায় বলবে, চা এনেছি।
তার পরেও কিছুক্ষণ শুয়ে থাকবে বাঙাল। মা খুব সন্তর্পণে বিছানার এক পাশে বসে পায়ের ওপর একটু হাত বোলাবে। বাঙাল তখন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলবে। তারপর হু-উ-উম করে একটা অদ্ভুত শব্দ করবে। তারপর উঠে বসবে। তখনও কোনও কথা নেই। বসে বসে কিছুক্ষণ সুড়ুৎ সুড়ুৎ করে চা খাবে। গরম চা যত পেটে যাবে তত মেজাজ শীতল হয়ে আসবে।
মরণের একটা হামা-দেওয়া বোন আছে। সেটা একেবারে নরম তুলতুলে, গোবরের নাদা। মরণ তাকে কোলে-টোলে নিতে পারে না কখনও। সেই বোনটাকে নিয়ে এসে মুক্তা এর পর বাঙালের কোলে ফেলে দেবে। বাঙাল তখন হুঁ-হুঁ-হুঁ-হুঁ করে অদ্ভুত শব্দ করতে করতে মেয়েটাকে খুব আদর করবে। মরণের বোনটাও কে জানে কেন বাঙালের ভীষণ ভক্ত। সে তখন বাঙালের নাক কামড়ে দেবে, কান ধরে টানাটানি করবে। মরণ যখন ছোট্টোটি ছিল তখনও নাকি বাঙালের মেজাজ বিগড়োলে তাকে এনে বাঙালের কোলে ফেলে দেওয়া হত আর বাঙাল ঠিক ওইরকম করে আদর করত তাকে। আর মেজাজ আরও শীতল হয়ে যেত।
সবাই বলে বাঙালের মেজাজটা একটু টং বটে, কিন্তু সে লোক ভাল। কিন্তু মরণ জানে বাবারা কখনও ভাল লোক হয় না। এই যে বাঙাল ফি শনিবার আগেভাগে তার পোস্তার দোকান বন্ধ করে এখানে বিকেল-বিকেল এসে পৌঁছোয় তখন মরণকে তৈরি থাকতে হয়। বাড়িতে পা দিয়েই বাঙাল তার খোঁজ করবে, বান্দরটা গেল কই?
সে ভয়ে ভয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই বাঙাল তার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে হঠাৎ বলবে, এইটার মাথাডা যে কাউয়ার বাসা হইয়া আছে দ্যাখে না কেউ? এই হারামজাদা, মাথা খাউজ্যায় না তর? খাউজ্যায়? এঃ উকুনও হইছে মনে হয়। কাইলকাই নাইপত্যা ডাকাইয়া মাথাটা লাউড়া কইরা দিতে হইব।
রসিক বাঙালের এসব কথা জলের মতো বুঝতে পারে মরণ। যদিও এ তাদের ভাষা নয়, কিন্তু জ্ঞান হওয়া অবধি শুনে শুনে সে বুঝতেও পারে, বলতেও পারে অনেকটাই। রসিক বাঙালের পাল্লায় পড়ে তাকে বার দুই ন্যাড়াও হতে হয়েছে। বাঙালের গোঁ, যেই কথা সেই কাজ।
কখনও বা হাতের নখ দেখে বলে, এ, এইটার তো দেখি, পিচাশের মতো নখ হইছে। ইস রে, নখের মইধ্যে কালা কালা মাটি।
নেল কাটার দিয়ে রসিক বাঙাল ডাব্বিয়ে তার নখ কেটে দেয়। এমন মুড়িয়ে কাটে যে কয়েকদিন তার আঙুলের ডগা টনটন করে।
আর সবচেয়ে দুঃখের কথা, শনি রবি দুদিনই তাকে দুবেলা রীতিমতো পড়তে হয়। টো-টো করে ঘুরে বেড়ানো বন্ধ। শ্বাসটাও ফেলতে হয় হিসেব করে। আর বাঙালের সঙ্গে বাগানের কাজে সাহায্য করতে হয়, ফাইফরমাশ খাটতে হয়।
আর সবচেয়ে যেটা লজ্জার কথা, এই বছর দশ-এগারো বয়সে সে তো বেশ বড়টিই হয়েছে, তবু রসিক বাঙাল মাঝে মাঝেই তাকে কলতলায় নিয়ে গিয়ে ন্যাংটো করে সাবান মাখিয়ে ছোবড়া দিয়ে ঘসে ঘসে চান করিয়ে দেয়। একে ন্যাংটো হওয়ার লজ্জা, তার ওপর ছোবড়ার ঘষটানিতে গায়ের জ্বালা। কিন্তু বাঙালের সঙ্গে এ নিয়ে কথা কইবে কে? না, রসিক বাঙালকে তার মোটেই পছন্দ হয় না। সোমবার সকালে ভাতে ভাত খেয়ে বাঙাল কলকাতার বড়বাজারে তার দোকান খুলতে রওনা হয়ে গেলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে মরণ। মনে হয়, এক সপ্তাহ ছুটি।
রসিক বাঙালকে নিয়ে ঠাট্টা-রসিকতারও প্রচলন আছে। তারাপদদা তাকে ইংরিজি পড়ায়। মাঝে মাঝে বলে, ও হল তোর উইক এন্ড ড্যাডি। আর বন্ধুরা বলে, রসিক বাঙাল হল তার ফিফটি পারসেন্ট বাবা।
কথাগুলো আজকাল বোঝে মরণ। একটু লজ্জা করে, রাগও হয়।
জানালা দিয়ে সাবধানে পাশ-চোখে মরণ দেখল, বাঙাল আগড় ঠেলে উঠোনে ঢুকছে। মাথার লম্বা চুল হাওয়ায় উড়োখুড়ো, মুখখানা চোয়াড়ে বটে, তবে গম্ভীর নয় যেন। হাড়ে মাসে কেঠো চেহারা। এইরকম পাকানো চেহারার লোকগুলোই রাগী হয়।
না, আজ বাঙাল রাগ করে আসেনি। উঠোনে ঢুকেই উঁচু গলায় হাঁক মারল, কই গো, কই গেলা?
মা ওপরে দম বন্ধ করে ছিল বোধহয় এতক্ষণ। বাঙালের হাঁক শুনে বলল, এই যে যাচ্ছি!
হাসিমুখে নেমে এসে বলল, আজ এলে যে!
বাঙাল বারান্দায় বসে পাশে অ্যাটাচি কেসটা রেখে বলে, আর কইও না, সুধীর মণ্ডল খবর পাঠাইছে খালপাড়ের জমিটা বেচব। তাই আর দেরি করলাম না। আইজই রেজিস্টারি।
যাক বাবা, ওই জমিটার ওপর তোমার কত কালের শখ।
অখনই বাইর হইতে হইবো, কখন ফিরুম ঠিক নাই। আইজ আর কইলকাতায় ফিরন যাইব না।
এখনই বেরোবে কি? না খেয়ে বুঝি? চান-টান করো, আমি ভাত বেড়ে দিচ্ছি।
বাঙাল তেমন আপত্তি করল না। বলল, তা হইলে লুঙ্গি গামছা দেও। গরম লাগত্যাছে।
মরণ প্রমাদ গুনল। বাঙাল তাহলে আজ থাকছে। দিনটাই মাটি। ডানধারের জানালা দিয়ে জিজিবুড়ির ভাঙাচোরা মুখ উঁকি মারল, ও ভাই মরণ, দোক্তাগুলো তুলেছিস?
সময় পেলুম কোথায়? বাঙাল এসে পড়ল যে।
ও আমার কপাল, না তুললে যে কে কখন মাড়িয়ে দেবে, কাক এসে মুখ দেবে।
হি হি করে হেসে মরণ বলে, কাক বুঝি দোক্তা খায়?
না খেলেও ছিষ্টি ছড়াবে ভাই, গু-মুত-খাওয়া ঠোঁটে ঠোকরাবে–সে বড় নিঘিন্নে ব্যাপার।
বাঙাল বারান্দায় বসে আছে যে!
চোখ কপালে তুলে জিজিবুড়ি বলে, বসে আছে বুঝি! গোঁসাঘরে যায়নি এখনও?
না গো জিজিবুড়ি, বাঙাল আজ ঝগড়া করে আসেনি।
তবে কী মতলবে?
কী যেন জমিজমা কেনার কথা শুনছি!
বাঙাল ওই করেই শেষ হবে। জমি-জমি করে এমন পাগল আর কাউকে দেখিনি। থাকবে নাকি আজ?
তাই তো শুনছি।
তাহলে গেল আমার অতগুলো দোক্তা।
তুমি এখন যাও জিজিবুড়ি, মুক্তাদি তোমার দোক্তা কুড়িয়ে দিয়ে আসবেখন।
আর দিয়েছে। ও আমার ভূতভুজ্যিতেই গেল। বাঙাল কার জমি কিনছে কিছু শুনলি?
সুধীর মণ্ডলের।
জমি কিনেই শেষ হবে বাঙালটা।
তুমি এখন যাও জিজিবুড়ি, বাঙাল দেখতে পেলে কুরুক্ষেত্র করবে।
যাচ্ছি বাবা যাচ্ছি। তা বলি বাঙালের নয় মাথার দোষ, পাগলের মতো জমি কিনছে, কিন্তু আমার মেয়েটাই বা অমন মেনিমুখো কেন? দুটো উচিত কথা মুখের ওপর কি বলতে নেই। কী দিয়ে যে বশ করে রেখেছে কে জানে বাবা। স্বামী তো নয়, যেন গুরুঠাকুরটি এলেন। সব সময় হ্যাঁ-হুজুর জো-হুজুর করে যাচ্ছে। জন্মে এমন দেখিনি বাবা। কই, বড় বউ কি ছেড়ে কথা কয় বাঙালকে? দিচ্ছে তো গুষ্টির পিণ্ডি চটকে থোঁতা মুখ ভোঁতা করে। তখন তো ল্যাজ গুটিয়ে এখানে এসে গোঁসাঘরে টান টান হয়ে শুয়ে থাকে, পারে কিছু বলতে গিয়ে তাকে? আমার মেয়েটাই হল গে মেনিমুখো।
কথাটা ঠিক নয়। তার মায়ের সঙ্গে রসিক বাঙালের কখনও-সখনও ঝগড়া হয়। তবে সেটা বেশি দূর গড়ায় না। মা পায়ে-টায়ে ধরে মিটিয়ে ফেলে। মরণের আগে মনে হত, মা রসিক বাঙালকে খুব ভয় পায়। আর শুধু ভয়ই পায়। আজকাল বুঝতে পারে, মা বাঙালকে ভালও বাসে খুব। এইটে মাঝে মাঝে মরণের তেমন পছন্দ হয় না।
বাঙাল উঠোনে দাঁড়িয়েই লুঙ্গি গলিয়ে প্যান্ট, জাঙ্গিয়া ছাড়ল, জামা গেঞ্জি খুলে ফেলল। মা সেগুলো নিয়ে উঠোনের তারে মেলে দিল ঘাম শুকোনোর জন্য। বাঙাল গেল টিউবওয়েলে চান করতে।
বাঙালদের জমির নেশা থাকে বলে শুনেছে মরণ। সেই নেশাতেই একদিন জ্ঞাতিভাই মাখন দত্তের সূত্রে এখানে এসে জমিজিরেত কিনেছিল বাঙাল। ইচ্ছে ছিল এখানেই থাকবে, ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে কলকাতার ব্যবসা বজায় রাখবে। কিন্তু বাঙালের বউ শেষ অবধি গাঁয়ে এসে টিকতে পারেনি৷ রসিক তখন ফাঁপড়ে। কে এই জমিজমা, বাড়িঘর দেখে! ভাড়া করা লোক দিয়ে তো আর সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ হয় না। বেচে দিয়ে চলে যাওয়ার পরামর্শই লোকে দিয়েছিল, কিন্তু বাঙালের গোঁ যাবে কোথায়! সে বলল, বেচুম ক্যান? জমির লগ্নির মাইর নাই।
বাঙালের সেইসব গল্প আজও লোকের মুখে মুখে ফেরে। নিজের মায়ের কাছে খানিক, আর খামচা খামচা নানা জনের মুখে শুনেছে মরণ। সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সবচেয়ে বিশ্বস্ত লোক হল বউ। তাই বাঙাল একদিন ঠিক করে ফেলল, এখানে আর একটা বিয়ে করবে। খুঁজে খুঁজে স্বজাতি স্বঘর গরিবের একটা মেয়েকে পছন্দও করে ফেলল সে। আর তখনই গাঁয়ে বিরাট শোরগোল উঠল। বাঙাল দেশ থেকে এসে একটা লোক গাঁয়ে নষ্টামি করছে। বাঙালকে মারধর করারও চেষ্টা হল। পুলিশ ডাকা হল। সে অনেক ঘটনা।
বাঙাল তখন গিয়ে ধরে পড়ল গৌরহরি চাটুজ্যেকে। মস্ত উকিল, মান্যগণ্য বিচক্ষণ মানুষ। গৌরহরি চাটুজ্যে তলচক্ষুতে খানিকক্ষণ বাঙালকে দেখে নিয়ে নাকি বলেছিল, বুকের পাটা আছে হে!
বুকের পাটা আর টাকা এ দুটো যার থাকে তাকে জব্দ করা কঠিন। গৌরহরি চাটুজ্যে একদিন মিটিং ডেকে সবাইকে বলল, রসিক সাহা একটা মেয়েকে বিয়ে করতে চাইছে বলে তোমরা আপত্তি করছ শুনলাম। আপত্তি ওঠারই কথা। তবে বাপু, রসিক বিয়ে না করে যদি চারটে মেয়েমানুষ রাখত তাহলে তোমরা কী করতে? বড় জোর আড়ালে-আবডালে ফিসফাস গুজগুজ বা নিন্দেমন্দ। তার বেশি কিছু নয়। আমি বলি কী, এ লোক তো বুকের পাটা আছে বলেই বিয়ে করছে। বাইগ্যামির চার্জে যদি ওর বউ ওকে জেলে পাঠায় তো পাঠাবে। সে দায় ওর। তবে বাসন্তী যাতে ফাঁকে না পড়ে তার জন্য রসিক সাহা বাসন্তীর নামে সম্পত্তি লিখে দিতে রাজি আছে। সে ভার আমিই নিচ্ছি।
একজন মাতব্বর বলেছিল, দাদা, আপনি জেনেশুনে এই বে-আইনি কাজকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন?
গৌরহরি বললেন, মানুষের প্রয়োজন বুঝেই বরাবর আইন তৈরি হয়েছে, সেরকমই হওয়া উচিত। মানুষের প্রয়োজনে কাজে না এলে আইন বোঁদা জিনিস। রসিক ফুর্তি করার জন্য তো আর একটা বিয়ে করছে না। তার সম্পত্তি দেখাশোনার জন্যই দ্বিতীয় স্ত্রীর প্রয়োজন। প্রাচীন কালে সামাজিক প্রয়োজনেই মানুষকে এরকম বিয়ে করতে হয়েছে। উদ্দেশ্য খারাপ না হলে আমি অন্তত দোষ দেখছি না।
অনেক গণ্ডগোলের ভিতর দিয়ে বিয়েটা অবশ্য হয়ে গেল। কিন্তু খবরটা কলকাতায় রসিক বাঙালের বাড়িতে পৌঁছোনোর পর হয়েছিল আরও সাংঘাতিক কাণ্ড। বাঙালের বউ দুবার গলায় দড়ি দিতে গেল, থানা-পুলিশ হল, বাঙালকে ধরে নিয়ে গিয়ে ফাটকেও পুরল পুলিশ।
কিন্তু তারপর ধীরে ধীরে কালের নিয়মে উত্তেজনা প্রশমিত হল, রাগের পারদ নেমে গেল। বাঙাল তার দুই সংসারের মধ্যে ভাগ হয়ে দিব্যি চলতে শিখল।
কলকাতার মা বা বড়মা কেমন তা অবশ্য জানে না মরণ। তার একটা দাদা আর একটা দিদিও আছে। তাদের কখনও দেখেনি সে। কিন্তু সে মাঝে মাঝে খুব ঝুম হয়ে বসে তাদের কথা ভাবতে চেষ্টা করে। দেখা হলে তারা কি মরণকে দুর-দুর ছাই-ছাই করবে? করবে বোধহয়। কিন্তু মরণের মনে হয়, তারা বোধহয় তার খুব পর-মানুষ নয়। বাঙাল কাঠখোট্টা লোক, কলকাতার বাড়ির কথা বিশেষ তার মুখে শোনা যায় না। তবে মাঝে মাঝে যে ও বাড়িতে খুব ঝগড়া হয় তা টের পায় তারা, যখন বাঙাল মুখ গোমড়া করে অসময়ে এসে হাজির হয়।
মায়ের ওপর রাগ করে মরণ কখনও কখনও বলে, আমি একদিন বড়মার কাছে, দাদা দিদির কাছে চলে যাব।
মা বলে, যা না, তা-ই যা, গিয়ে বুঝবি কত ধানে কত চাল। গালভরে আবার বড়মা বলা হচ্ছে। গিয়ে বুঝবি পেটে ধরা মা আর ডাকের মায়ের তফাত কী।
তফাত বোঝার মতো বয়স হয়নি মরণের। কিন্তু কলকাতার বাড়ি, বড়মা, দাদা বা দিদি সম্পর্কে তার একটা রূপকথার মতো কুহক আছে। তারা হয়তো খুব সুন্দর মানুষ, বাড়িটা হয়তো রাজপ্রাসাদের মতো। তারা হয়তো দুরছাই করবে না তাকে।
বাঙাল বারান্দায় বসে ভাত খেল। তারপর জামা-প্যান্ট পরে রওনা হওয়ার সময় বলল, তা হইলে আসি গিয়া।
এসো। তাড়াতাড়ি ফিরবে কিন্তু?
হ। দুর্গা দুর্গা।
দুর্গা দুর্গা।
বাঙাল চলে গেল। মরণ ঘর থেকে বেরিয়ে লাফ দিয়ে উঠোনে নেমে হোঃ হোঃ করে দু হাত ওপরে তুলে দু চক্কর নেচে নিল।
মা ভ্রূ কুঁচকে বলে, ও মা! অমন করছিস কেন?
মায়ের সামনে বাবাকে বাঙাল বললে মা রাগ করে। তাই সে ভয়ে ভয়ে বলে, এমনি।
মা শুধু বলল, ওরকম করতে নেই।
নিকোনো উঠোন থেকে জিজিবুড়ির পড়ে যাওয়া দোক্তা বাঁ হাতের তেলোতে তুলে জড়ো করতে করতে মরণ বলল, বাবা আসছে শুনে জিজিবুড়ি এমন ভয় পেল যে দোক্তা ফেলে পালিয়েছে।
মা বাঙালের ভেজা লুঙ্গি তারে মেলতে মেলতে বলল, মায়ের যেমন কাণ্ড! ভয় পাওয়ার আর দোষ কী? কম লেগেছিল লোকটার পিছনে? এখন মুখোমুখি হলে লজ্জায় মাথা কাটা যায়।
ঘটনাটা জানে মরণ। মায়ের সঙ্গে বাঙালের বিয়ে দিতে গিয়ে এককাঁড়ি টাকা আদায় করেছিল জিজিবুড়ি। বিয়ের পরেও নানা অভাবের কথা বলে টাকা নিত। নিজের দুই পাষণ্ড ছেলে কানাই আর বলাইকে লাগিয়েছিল বাঙালের চাষ আবাদে। তারা ধান-চালের হরির লুট ফেলে দিয়েছিল। বাঙালের গোলায় ফসল আর উঠতই না। মতলব ছিল বাঙালকে তাড়িয়ে সম্পত্তি দখল করার। কারণ সম্পত্তি সবটাই প্রায় মেয়ের নামে। তা সেটা প্রায় ঘটেও গিয়েছিল। কলকাতার সংসারে যখন অশান্তি লাগে তখন বাঙালের যাতায়াত গিয়েছিল কমে। সেই ডামাডোলে বাঙাল যখন প্রায় নেই হয়ে গেছে সেসময় দুই ভাই এসে বোনকে নানা কানমন্তর দিত। বাঙাল যে খারাপ লোক, সে যে ঘুরে ঘুরে বিয়ে করে বেড়ায় এবং তার যে আরও নানা দোষ আছে সেসব কথা। সেই দুর্দিনে মায়েরও খুব মনের কষ্ট গেছে। পেটে তখন মরণের বড় বোনটা, যেটা বাঁচেনি। বাঁচার কথাও নয়। সেই সময়ে মন খারাপের চোটে মূৰ্ছা রোগ হয়েছিল। কয়েকবার মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে মেয়েটা পেটের মধ্যে মরে গেল।
বাঙাল যখন ফিরে এল বিষয়ী মানুষের চোখে তখন পরিস্থিতি বুঝে নিতে দেরি হয়নি। দুই শালাকে তাড়িয়ে নিজের বউকে আগলে যখন সে রুখে দাঁড়াল তখনই জিজিবুড়ি আর তার ছেলেদের সঙ্গে সম্পর্কটা বিষ হয়ে গেল। মারাত্মক ঘটনাটা ঘটল তার পরেই। কানাই আর বলাই দুটো গুণ্ডা ভাড়া করে লাগাল বাঙালকে নিকেশ করতে। সেটা হলে বোনের সম্পত্তির দখল নিতে আর বাধা হত না। দুটো গুণ্ডা বাঙালকে কুপিয়েও দিয়েছিল বাসরাস্তার কাছে বাঁশবনে। কিন্তু বাঙাল একটাকে পেড়ে ফেলেছিল। ধরা পড়ে দুজনেই কবুল করেছিল তারা কানাই বলাইয়ের টাকা খেয়ে এ কাজ করেছে।
মোকদ্দমা হতে দেয়নি বাসন্তী। বাঙালের হাতেপায়ে ধরে ভাইদের বাঁচিয়ে দিয়েছিল। কেলেঙ্কারির ভয়ে বাঙালও বেশি কিছু করেনি। কিন্তু সেই থেকে বাঙাল এলে ও বাড়ির কেউ ভয়ে আর এবাড়িতে আসে না। কিন্তু বাঙাল না থাকলে তারা এখনও এসে টাকাটা সিকেটা ধানটা চালটা মেগে-পেতে নিয়ে যায়।
এসব ঘটনার পর মরণ হয়েছিল। ওপরের বোন মারা যাওয়ায় তার নাম রাখা হয়েছিল মরণকুমার। যমকে খুশি করতেই রাখা।
জিজিবুড়ি বলছিল, জমি কিনে কিনেই বাঙাল একদিন শেষ হয়ে যাবে।
জমি কিনে শেষ হবে কেন? জমি রাখতে জানলে জমির মতো জিনিস নেই। আর শোনো, তুমি এখন বড় হয়েছ, এখন আর বাবাকে তাঁর আড়ালেও বাঙাল বলবে না।
সবাই বলে যে, তাই মুখে এসে যায়।
অন্যের কাছে উনি যা, তোমার কাছেও কি তাই? একটা মান্যিগন্যি নেই?
আছে বাবা, খুব আছে। মরণ তার বাপকে যমের মতো ভয় খায়। আর ভয় খায় বলেই আড়ালে বাঙাল ডেকে সেই ভয়টার সঙ্গে লড়াই করে।
বাঙালের লুঙ্গিটা টান টান করে খুব যত্নের সঙ্গে মেলে দিয়ে ক্লিপ আটকাচ্ছে মা, অনেক সময় নিয়ে। এমন আদুরে ভাব, যেন লুঙ্গিটাই বাঙাল। তেমনি যত্ন করে গামছাটা মেলতে মেলতে মা আপনমনে বলল, তোমার বাবা ভাল লোক।
জিজিবুড়ি ঠিক উলটো কথা বলে, ও হল বাঙাল দেশের লোক, ওদের জাতজন্মের ঠিক নেই। তেলি সাউ না শুঁড়ি সাউ কে জানে বাবা, ভোল পালটে সব আসে। আর কথারই বা কী ছিরি। উর্দু বলছে না পার্সি বলছে বোঝার জো নেই। মুড়িকে বলে হালুম, কাদাকে বলে প্যাক। ছিছিক্কার যাই বাবা। তার ওপর ঊর্ধ্ববায়ু, রগচটা মুষল। ওরা কি সব ভাল লোক? ভাল লোকেরা কি লুকোছাপা বিয়ে করে বাপ? আরও কটা করে বসে আছে তার খোঁজ নেয় কে? কপালটাই আমার অমন, লোভ দেখিয়ে মেয়েটার সব্বোনাশ করল।
তাই যদি হবে তাহলে বাঙাল এলে মায়ের চেহারায় একটা ভেজা ভেজা স্নিগ্ধ ভাব কেন ফুটে ওঠে? চোখ দুখানা কেন অমন নরম হয়ে যায়? বাঙালের লুঙ্গি আর গামছাখানা কেমন টান টান করে মেলে দিল মা, আর কারও জামাকাপড় অত যত্ন করে মেলে না তো! হাঁ করে দেখছিল মরণ। বাঙাল ভাল লোক না খারাপ লোক এই অঙ্কটা তার মিলতে চায় না কিছুতেই।
জিজিবুড়ি পিছনের দিকের খিড়কি দরজায় কচুপাতার আড়াল থেকে উদয় হয়ে সাবধানে মুখ বাড়িয়ে বলল, বাঙালটা বিদেয় হয়েছে?
কথাটা শুনে মায়ের ভ্রূ কোঁচকাল।
জিজিবুড়ি উঠোনে ঢুকতে ঢুকতে বলল, দিন নেই ক্ষণ নেই এসে উদয় হলেই হল। এমন আঁতকে উঠলুম যে পানের বাটাখানা পড়ে সব ছয়ছত্রখান। পিলে চমকানো লোক বাপু। দিলি ভাই তুলে দোক্তাটুকু? সুপুরিও পড়ে আছে দেখ কয়েক কুচি।
বাসন্তী একটু ঝাঁঝের গলায় বলে, সবসময় অমন ঠেস মেরে বাঙাল-বাঙাল বলো কেন বলো তো! শুনে শুনে বাচ্চারাও শিখছে। তোমার যে কবে আক্কেল হবে!
ও মা! বাঙালকে বাঙাল বলব না তো কী? নবদ্বীপের গোসাঁই তো নয় রে বাপু। ওসব মনিষ্যি আমাদের মতো তো আর নয়।
ওসব কী কথা মা! এতকাল বলে এসেছ, শুনেছি। কিন্তু এখন একটু মুখটা সামলাবে তো। ছেলেপুলেরা বড় হচ্ছে না? ভক্তিছেদ্দা শিখবে কিছু ওসব শুনলে?
ও মা! বাঙাল লোকদের আবার ভক্তিছেদ্দা কীসের রে? ওসব ডাকাত লুঠেরা লোক। দেখলি না গাঁয়ে এসেই কেমন রসালো জমিগুলো গাপ করে নিল। যারা দুটো-চারটে করে বিয়ে বসে তারা আবার ভাল লোক! রাঁঢ় পুষলেও না হয় কথা ছিল, বিয়ে বসে কোন আক্কেলে রে?
তুমি দোক্তা কুড়িয়ে নিয়ে বিদেয় হও তো! বেশি কথা কয়ো না। আমার বাঙাল বরই ভাল। জন্মে জন্মে যেন আমার অমন বাঙাল বরই হয়।
বলিস কী লো মুখপুড়ি? এ যে নিজে কুড়িয়ে অভিসম্পাত নিলি! মাথাটা তোর খেয়েছে দেখছি।
যখন দশটি হাজার টাকা নিয়ে নিজের মেয়েকে ওই বাঙালের কাছে বেচে দিয়েছিলে তখন এত শাস্ত্রজ্ঞান কোথায় ছিল? তখন তো বাঙাল বলে ঠোঁট বাঁকাওনি, হাতও গুটিয়ে নাওনি!
ও মা! তখন কি বুঝেছিলুম রে বাপু! এমন সোনাহারা মুখ করে এসে দাঁড়িয়েছিল যেন ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না। ওরা সব কামিখ্যের ডাকিনী বিদ্যে জানে, এক এক সময়ে এক এক রূপ ধরে। বুঝতে পারলে কি আর গুখেকোর মতো কাজ করি! একটা বাঙাল মরলে দুটো গোখরো সাপ জন্মায়।
খুব হয়েছে মা, তোমার আর বেশি বুঝে কাজ নেই। এতই যদি সে খারাপ তবে তার বাড়িতে এসে রাজ থানা গেড়ে বসে থাকো কেন, তার চাল ডাল টাকা হাত পেতে নিয়ে যাও কোন লজ্জায়?
বাঙালের জিনিস হলে নিতুম নাকি রে পোড়ারমুখি? তোর জিনিস বলে নিই। না দিস তো না-ই দিবি, অত কথা কীসের? তবে এও বলি বাপু, বাঙাল তোকে ওষুধ করে রেখেছে। ঘোর কাটলে টের পাবি।
এ যেন একটা টেপ রেকর্ডারে একই ক্যাসেট ঘুরে ফিরে বাজছে। জ্ঞান হয়ে অবধি মা আর জিজিবুড়ির এইসব চাপানউতোর শুনে আসছে মরণ। দুজনে লাগলেই মরণ মনে মনে নারদ মুনিকে ডাকতে লাগে। মা যত রাগবে সেদিন ততই মায়ের হাতের রান্না খোলতাই হবে। এর কখনও নড়চড় হয়নি। রেগে গেলে মায়ের হাত যেন অন্নপূর্ণার হাত। আজ আবার বাঙাল এসেছে, দু-চারটে ভালমন্দ হবে।
তোমরা কত ভাল তা জানা আছে। মানুষটাকে খুন অবধি করতে চেয়েছিল তোমার হিরের টুকরো ছেলেরা। আজও লোকটার কাঁধে আর পিঠে ভোজালির দাগ দগদগে হয়ে আছে।
ওসব বাজে কথা। বাঙাল রটাল আর তুইও বিশ্বাস করলি। কার সঙ্গে কোথায় গণ্ডগোল করে রেখেছিল তারা খুনোখুনি করতে লোক লাগায়। সত্যিই যদি হবে তাহলে বাঙাল মামলা করল না কেন শুনি!
সে আমি হাতেপায়ে ধরেছিলুম বলে। সবাই জানে মা, আর গুণধর ছেলেদের সারতে চেয়ো না। খুব তো ছেলেদের হয়ে টানছ, তা সেই গুণধর ছেলেরা এখন দেখছে তোমায়? লাথি ঝাঁটা মুখনাড়া খেয়ে তো পড়ে আছ, আর রোজ এসে এ বাড়িতে একখানা ঘর দেওয়ার জন্য ঘ্যান ঘ্যান করছ।
ছেলেদের দোষ কী? বউগুলো খচ্চড়।
তোমার হাতের পাতের টাকাকড়িগুলো তো আর বউরা কেড়ে নেয়নি, গয়নাগুলোও তারা গাপ করেনি। করেছে তোমার অকালকুষ্মাণ্ড ছেলেরা। আর কত মিছে কথা কইবে মা!
জিজিবুড়ি একটু দম ধরে বসে রইল উঠোনে। তারপর হঠাৎ গলাটা মিহিন করে বলল, তা বাঙালের মেজাজটা ঠান্ডা হলে একবার কথাটা তুলিস। বেশি কিছু তো নয়, ওই পশ্চিমের দালানের নীচেরতলায় কোণের ঘরটা যদি দেয়। আর দুবেলা দুমুটো ভাত। এটুকু কি আর তার গায়ে লাগবে? দোহাত্তা তো কামাচ্ছে বাবা।
ওসব মতলব ছাড়ো মা। সে রাজি থাকলেও আমি রাজি নই। কিছুতেই সেরকম বন্দোবস্ত হবে না।
পেটের শত্তুরের মতো শত্রুর নেই, বুঝলি?
গজর গজর করতে করতে জিজিবুড়ি পাছদুয়ার দিয়ে বিদেয় হল।
মা কিছুক্ষণ বারান্দার সিঁড়িতে চুপ করে বসে রইল ঝুম হয়ে। দুটো চোখ ধীরে ধীরে টস টস করতে লাগল জলে। চোখে আঁচল চাপা দিয়ে নীরবে কাঁদছে মা। কেন কাঁদে মরণ তা বুঝতে পারে। এখন সে বড় হয়েছে। মা বাঙালের কথা ভেবে কাঁদে। মা বাঙালকে বড্ড ভালবাসে। বাঙালকে কেন যে মরণ অত ভালবাসতে পারল না কে জানে।
সে কাছে গিয়ে ডাকল, মা!
হাত বাড়িয়ে মা তাকে ধরে পাশে বসিয়ে ধরা গলায় বলল, চুপটি করে বসে থাক। কথা বলিস না। আমার মনটা ভাল নেই।
একটু উশখুশ লাগছিল বটে, তবু মরণ চুপ করেই বসে রইল। মা আঁচল সরিয়ে কিছুক্ষণ উদাস চোখে সামনের দিকে চেয়ে রইল। সামনে ফর্সা উঠোন, চাটাইয়ে সর্ষে শুকোচ্ছে আর পুরনো তেঁতুল। একটা দুটো কাক ঘুরে ঘুরে উঠোনে নেমে আসছে। মা কাকগুলোকে হুড়ো অবধি দিল না। মায়ের মন আজ সত্যিই খারাপ।
বেশ কিছুক্ষণ বাদে মা হঠাৎ বলল, বড় ভয় করছে বাবা, শুনছি নাকি সুমন আসবে।
সুমন! সে কে মা?
বড়গিন্নির ছেলে।
ধম করে উঠল মরণের বুক। উত্তেজিত গলায় বলল, দাদা?
হ্যাঁ বাবা। তোর বাবা আজ খেতে বসে বলছিল, ছেলের নাকি খুব ইচ্ছে হয়েছে গাঁয়ের বাড়ি দেখে যেতে।
তাতে ভয় কী মা?
ভয় বলে ভয়। কী মনে করে আসছে তা তো জানি না। আমি তো তাদের শত্তুর।
কেন মা?
সংসার ভাঙিনি আমি? একটা সংসার দু টুকরো হল তো আমার জন্যই। ছেলে কি ভাল মন নিয়ে আসবে?
কথাটা ভাববার মতো। মরণেরও ভয় হচ্ছে একটু, আনন্দ হচ্ছে খুব। শহরের দাদা বা দিদির কথা সে কত ভাবে কত স্বপ্ন দেখে তাদের নিয়ে। বড়মার কথাও খুব ভাববার চেষ্টা করে সে।
সত্যিই আসবে মা?
তোর বাবা তো বলল।
কবে?
তার কোনও ঠিক নেই। হয়তো আসছে সপ্তাহে, বা তার পরে কোনওদিন। বড়গিন্নি তো তাদের কানে বিষ ঢালতে ছাড়েনি। তাই বড় ভয় হচ্ছে। কী জানি বিষয়সম্পত্তি নিয়ে দাবি তুলবে কিনা।
তাহলে কী হবে মা?
কে জানে কী হবে। সম্পত্তি তো তোর বাবার, আমার নামে দলিলটুকুই যা। তাই ভয় হচ্ছে।
মরণ চুপ করে বসে রইল। ভিতরে যে আনন্দের আলোটা জ্বলে উঠেছিল সেটা ফের নিবে গেল। মরণ ভাবছে। মরণ বড় হচ্ছে।
০৬-১০. বিকেল যখন ঘনিয়ে আসে
০৬.
বিকেল যখন ঘনিয়ে আসে তখন মাঠের ওধারে জড়ামরি গাছপালার ফাঁকে যে কী তুলকালাম একটা কাণ্ড ঘটে যায় রোজ তা কেউ তাকিয়েই দেখে না ভাল করে। আকাশ থেকে আলোর চাকাটা তখন নামতে থাকে আর সেই সময়ে কোথাও কিছু না হঠাৎ একটা ভুতুড়ে মেঘ এসে তিন-চার খণ্ড হয়ে ভাসতে থাকে। আর গাছপালার কালচে রঙের ছায়া থেকে অশরীরীর মতো ভেসে উঠতে থাকে ঘোর ঘোর কুয়াশার মতো, ধোঁয়ার মতো, প্রেতের মতো সব জিনিস। পশ্চিমের আকাশে তখন লাল সাদা কালো মেঘের তুলির টান। দিগন্ত দ্রুত তার আলোর গালিচা গুটিয়ে নিতে থাকে। প্রথমে দীর্ঘ ছায়া দীর্ঘতর হতে থাকে, আর অন্ধকার বুনে চলে কালো এক মাকড়সা। প্রতিদিন এইভাবে দিন যায়, দিন আসে। কেউ ঘটনাটা গ্রাহ্যও করে না তেমন। বাসরাস্তায় ব্যস্ত দোকানপাট অন্ধকার নামতেই দিল না কখনও। পটাপট জ্বলে উঠল আলো। ঝাঁই ঝাঁই করে বেজে যায় কালীপদর ক্যাসেটের দোকানের গান। অষ্টধাতুর আংটি বিক্রি করতে বসা লোকটা একঘেয়ে গলায় তার আংটির গুণের কথা বলে, বিফলে মূল্য ফেরতের ভরসা দিয়ে যাচ্ছে। সেই কবে থেকে। তেলেভাজার গন্ধ ছড়িয়ে দেয় হরিপদ দাস। মাঠের ওধারে নানা দৃশ্য অবতারণার পর আলোর চাকা ডুবে গেল হায় হায় করে। কেউ দেখল না। টেরই পেল না ভাল করে। ধুলো উড়িয়ে দুখানা বাস গেল পরপর। লোক নেমেছে মেলা। বাস-আড্ডায় এখন মেলা লোক, বিস্তর বিকিকিনি। এ সময়টায় তার যে খিদেটা পায় সেটা হল বিস্কুটের খিদে।
মানুষের বুদ্ধিরও বলিহারি যেতে হয়। মাথা খাটিয়ে যে কোন জিনিসে কী প্যাঁচ বের করে তার ঠিকঠিকানা পাওয়া মুশকিল। এই যে নিতাইয়ের দোকানের নিমকি বিস্কুট–শুনতে সোজা হলে কী হয়, বিস্কুটখানা বিস্তর প্যাঁচালো। সে গুণে দেখেছে বিস্কুটখানায় অন্তত আটখানা থাক। পরতে পরতে জুড়ে কী করে যে বানিয়েছে মাথা খাটিয়ে, কে জানে বাবা! যেমন মুচমুচে তেমনই গালভরা স্বাদ। জিব যেন জুড়িয়ে যায়। মাঝে মাঝে এক-আধটা কালোজিরে দাঁতে পড়লে ভারী চমৎকার লাগে। গোটাগুটি কামড়ে খায় না সে। খবরের কাগজের ঠোঙায় বিস্কুটখানা নিয়ে প্রথম কিছুক্ষণ চুপ করে অনুভব করে। ছোঁয়ার মধ্যেও একটা উপভোগ হয় না কি? তার তো হয়। তারপর বিস্কুটখানা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ দেখে। এই দেখাটাও খাওয়ারই একটা অঙ্গ। গানের আগে যেমন হারমোনিয়মের প্যাঁ পোঁ আর তবলা বাঁধার ঠুকঠাক। খুব সাবধানে বিস্কুটের ওপরের পরতটা দু আঙুলে ধরে ছাড়িয়ে নেয় সে। পাতলা ফিনফিনে চমৎকার লম্বাটে জিনিসটি টুক করে দাঁতে কামড়ে একটুখানি মুখে নেয় সে। অনেকক্ষণ ধরে চিবোয়। সঙ্গে সুড়ুত করে এক চুমুক চা। কী যে ভাল লাগে তখন! একটা পরত শেষ হলে আর একটা পরত, তারপর আর একটা। মোট আটখানা খেতে খেতে চা কখন শেষ হয়ে যায়। শেষ পরতখানা খাওয়ার সময় মনটা খারাপ লাগে। শেষ হলেই তো শেষ। আরও একখানা যে খাওয়া যায় না তা নয়, তবে সেটা বড্ড বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। এক একখানা বিস্কুট এক এক টাকা।
খাওয়া শেষ হওয়ার পর খাওয়ার রেশটা অনেকক্ষণ মুখের মধ্যে থেকে যায়। তখন চুপটি করে বসে সেটা উপভোগ করতে হয়। গোরু যেমন জাবর কাটে অনেকটা তেমনই। খাওয়াটা ফুরিয়ে গিয়েও যেন ফুরোয় না, তার স্বাদ জিবকে জড়িয়ে ধরে থাকে অনেকক্ষণ। বিস্কুট আর চায়ের স্মৃতি তাকে কিছুক্ষণ আচ্ছন্ন করে রাখে।
মাথাটা কিছু ভুলভুম্বুল হয়েছে আজকাল। কাছেপিঠের কথাই ভুল হয় বেশি। এই যদি হঠাৎ করে আদিগন্ত সব কথাই আচমকা ভুল পড়ে যায় তা হলেও খারাপ কিছু তো নয়। বাড়িঘর, ঠিকানা, বউ, ছেলেপুলে সব ভুলে পাকার হয়ে এই বাস-আড্ডার বেঞ্চে বসে হাঁ করে চেয়ে থাকা সেও কি খারাপ রে বাপু! বেশ জায়গা এটা। আলো-টালো আছে, গান বাজছে, বিকিকিনি হচ্ছে, বাস আসছে যাচ্ছে, মানুষের সঙ্গে বসে মানুষ সুখদুঃখের দুটো কথা কইছে, লোকের গ্যাঞ্জাম। এখানে বসেই কত কী দেখে দেখে সময় কেটে যায়। উত্তর দিকে কখন থেকে একটা মাল-বোঝাই ট্রাক খারাপ হয়ে পড়ে আছে। এখন হ্যাজাক জ্বেলে একটা খালাসি জ্যাক লাগিয়ে হ্যান্ডেল মেরে মেরে সেটা তুলছে। দেখার মতোই দৃশ্য। মানুষের বুদ্ধির কোনও কূলকিনারাই করে ওঠা মুশকিল। কী বুদ্ধি! কী বুদ্ধি! একরত্তি একটা যন্ত্র লাগিয়ে একটা মাত্র রোগাভোগা খালাসি ওই গন্ধমাদন ট্রাকটাকে কেমন তুলে ফেলছে দেখ! ট্রাকটা উঠছে একটু কেতরে। কুকুরে যেমন পিছনের ঠ্যাং তুলে পেচ্ছাপ করে ঠিক তেমনই। যত দেখে তত মুগ্ধ হয় সে। মুগ্ধ হয়, আর ভাবে। ভেবে ভেবে কূলকিনারা পায় না। বুদ্ধি খাটিয়ে খাটিয়ে মানুষ কত কী বানিয়েছে! রেলগাড়ি, হাওড়ার পোল, মনুমেন্ট। এইসব বসে বসে ভাবে সে। আর খুশি হয়। আর ফিচিক ফিচিক হাসে আপনমনে। তার মেজো ছেলের বউ কুসুম সেদিন তার শাশুড়িকে বলছিল বটে, বাবার একটু মাথার দোষ হয়েছে মনে হয়, একলা একলা বসে কেমন বিড়বিড় করে কথা কইছে আর হাসছে গো। দরমার বেড়ার ওপাশ থেকে কথাটা কানে এসেছিল। মাথার দোষ একটু হয়েও থাকতে পারে তার। ভুলভুম্বুল ভাবটা যেন একটু বেড়েই পড়েছে। গোটাগুটি সব ভুলে মেরে দিলে মন্দ হবে না তখন।
কিছু চাষিবাসি লোক ক্ষেতের কাজ সেরে ঘরমুখো ফেরার পথে এইখানে চায়ের দোকানে বসেছে বেঞ্চ জুড়ে। তাদের হাতে চায়ের গেলাস আর কোয়ার্টার পাঁউরুটি। তাদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী লোকটি বলছিল, সেবার জাজপুরে যাত্রার আসর বসেছিল, বুঝলি। হই হই রই রই কাণ্ড। রামের বনবাস পালা হচ্ছে। খোদ লালমুখো সাহেব ম্যাজিস্ট্রেট যাত্রা দেখতে এসেছে। আসরের পাশেই চেয়ারে বসা। তা পালা তো শুরু হল। কিন্তু রামের বনবাসে যাওয়া নিয়ে ঘ্যানঘ্যানানি, প্যানপ্যানানি, কান্নাকাটি সাহেবের তেমন পছন্দ হচ্ছিল না। ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসছে মাঝে মাঝে ভেড়ুয়াদের কান্নাকাটি দেখে। এমন সময় আসরে নামল বীর হনুমান। হনুমান দেখে সাহেব ভারী খুশি। হ্যাঁ, এতক্ষণে একটা জম্পেস ব্যাপার হল। সাহেব সঙ্গে সঙ্গে হনুমানের গায়ে একখানা দশ টাকার নোট ছুঁড়ে দিয়ে বলে উঠল, মোর হনু। মানে বুঝলি? মানে হল, আরও হনুমান চাই। অধিকারী তো তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে আর একজনকে হনুমান সাজিয়ে আসরে নামিয়ে দিল। উপায় তো নেই, সাহেবের মর্জি, সাহেব ফের দশ টাকা বখশিস দিয়ে হেঁকে উঠল, মোর হনুমান। অধিকারীমশাই ফের ছুটে গিয়ে আর একজনকে হনুমান সাজিয়ে নামিয়ে দিল। ফের দশ টাকা। সঙ্গে সঙ্গে হুকুম, মোর হনু। সে আমলের দশ টাকা তো কম নয়। টাকার ছড়াছড়ি দেখে তখন রাম সীতা লক্ষ্মণ সবাই গিয়ে হনুমান সেজে এসে আসরে নেমে পড়ল। রামের বনবাস চুলোয় গেল, আসর জুড়ে শুধু হনুমানদের হুপহাপ ধুপধাপ। তা আমাদের অবস্থাও হয়েছে। তাই। যার রামচন্দ্র হওয়ার কথা ছিল, যার সতীলক্ষ্মী সীতা হওয়ার কথা ছিল, যার ভ্রাতৃভক্ত লক্ষ্মণ হওয়ার কথা ছিল সবাই নিজের নিজের পাঠ শিকেয় তুলে হনুমান হয়ে নেমে পড়েছে। দেশ জুড়ে এখন শুধু হনুমানদের দাপাদাপি। তাই বলছিলুম, গান্ধীবাবা আর সুভাষ বোস মিলে যে সাহেবদের তাড়াল তাতে লাভটা কী হল বল তো! এক পয়সার পাঁউরুটি দেড় টাকায় ঠেলে উঠেছে।
বিড়ি ধরানোর গন্ধটা বড্ড ভাল লাগল তার। গন্ধেরও কত রকমারি আছে। মিষ্টি ঝাঁঝালো গন্ধে মনটা চনমনে হয়ে যায়। জ্ঞানী লোকটা বিড়ি ধরিয়ে নিয়ে বলল, বুড়োশিবতলার জলায় এক সাহেবের মোটরগাড়ি কাদায় বসে গিয়ে হাঁসফাঁস অবস্থা। কিছুতেই তোলা যায় না। তখন কাশীনাথ আর শিবনাথ দুই ভাই ক্ষেতের কাজ সেরে ফিরছিল। কাঁধে হাল, হাতে বলদের দড়ি। অবস্থা দেখে দু ভাই নেমে পড়ল কাদায়। দড়ি বেঁধে বলদ দিয়ে টেনে গাড়ি তুলে দিল। তারপর ঠেলে নিয়ে পোঁছে দিল দু মাইল দূরের ডাকবাংলোয়। সাহেব খুশি হয়ে দুই ভাইকে একশো টাকা করে বখশিস দিলেন। তখনকার একশো টাকা বাবা! তার অনেক দাম। দুই ভাই টাকা পেয়ে জমিজিরেত কিনে ফেলল। চাষবাস করে অবস্থা ফিরিয়ে ফেলল লহমায়। গাঁয়ে পুকুর কেটে দিল, শিবমন্দির গড়ে দিল। গায়ে সেন্ট মেখে জুতো মসমসিয়ে যখন রাঁড়ের বাড়ি যেত তখন রাস্তার দুধার থেকে লোকে সেলাম ঠুকত। তাই বলছিলুম, গান্ধীবাবা আর সুভাষ বোস মিলে সাহেব তাড়িয়ে কাজটা ভাল করেননি মোটে। সাহেবরা মাথার ওপর ছিল, সে একরকম। এখন যে কে কখন মাথায় চড়ে বসছে নগেনের পোষা বাঁদরটার মতো কে জানে বাবা! যিনি যখন চড়েন তখন তিনিই আমাদের জো-হুজুর।
ট্রাকটা তেমনই কেতরে কুকুরের মতো ঠ্যাং তুলে আছে। খালাসিটা একখানা চাকা খুলে ফেলে আর একখানা লাগাচ্ছে। তার ওপাশে ঝুপসি গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে আলোর চৌহদ্দির বাইরে থেকে ঠেলে উঠছে চাপ বাঁধা অন্ধকার। ফিনফিনে কুয়াশার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে চায়ের উনুনের ধোঁয়া আর বাসের চাকায় ওড়া ধুলো। উত্তরে বাতাসে শীতের চোরা টান টের পাওয়া যায়।
মানুষের একটা ফেরা থাকে। কোথা থেকে যে আসে, কোথায় যে ফিরে যায় তার মীমাংসা আজও হল না। দিনশেষে সে বাড়ি ফেরে বটে, কিন্তু এটা ঠিক ফেরা নয়। আর একটা আসল ফেরা আছে তার। সেইটে একটু একটু ভাবিয়ে তোলে তাকে আজকাল।
ধীরেন কাষ্ঠ উঠে পড়ল। পেচ্ছাপের বেগটা আর সামলানো যাচ্ছে না। চাপতে গেলে আজকাল হয়ে পড়ে।
শিশুগাছের তলায় বসে বেগটা ছেড়ে দিয়ে ধীরেন কাষ্ঠ একটা ভারী আরাম পেল। এইসব ছোটোখাটো প্রাকৃতিক কাজের মধ্যেও মাঝে মাঝে একটা ভারী আনন্দ হয় তার। পেচ্ছাপ করার আরামটা কি সবাই টের পায়? কে জানে বাবা! ধীরেন কাষ্ঠ পায়।
ব্যাপারটা যাচাই করার জন্যই সে ভালমানুষের মতো গিরীশ মুহুরিকে জিজ্ঞেস করেছিল, মুতে কেমন আরাম পাও হে গিরীশ?
গিরীশ তখন মাচা থেকে কচি লাউডগা কাটছিল। সুতোয় বেঁধে ভাতে দিয়ে সর্ষের তেল মেখে খেতে চমৎকার। প্রথমে কথাটা বুঝতে পারেনি। তারপর বুঝতে পেরে ভারী চটে উঠে বলল, ও তোমার কেমন কথা ধীরেনদা! মাথাটাই গেছে দেখছি! বলি সব ছেড়ে মুতের খতেন নিতে লেগেছ কেন?
কথাটা আরও দু-চারজনের কাছে যাচাই করার ইচ্ছে ছিল ধীরেনের। কিন্তু আর সাহস পায়নি। আজকাল লোকে বড় খপ করে চটে যায়। অথচ কত কী যে জানতে ইচ্ছে করে, জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে লোককে।
ফ্যান্সি স্টোর্সের সামনে দাঁড়িয়ে শো-কেসে সাজানো জিনিসপত্র ভারী অবাক চোখে দেখছিল ধীরেন। যত দিন যাচ্ছে কত কী নতুন নতুন জিনিস আসছে। মানুষের যে কত কী লাগে আজকাল! ধীরেনের লাগে না বটে, কিন্তু জিনিসগুলি সম্পর্কে তার অপার কৌতূহল। এই যেমন শ্যাম্পু বা কর্নফ্লেক বা বোতলের কড়াইশুঁটি কি দাড়ি কামানোর ফোম–যত দেখে তত ভাল লাগে তার।
দোকানি স্বপন একটু ঝুঁকে বলল, টর্চ নেবেন বলেছিলেন, নিলেন না তো জ্যাঠা!
ধীরেন একটু তটস্থ হয়ে বলে, নেব বাবা। বড্ড দাম।
চল্লিশ-পঞ্চাশের নীচে ভাল জিনিস নেই যে। দশ-পনেরো টাকার মালে গ্যারান্টি নেই, আলোও হয় না তেমন।
দেখি। আর দু-চারদিন যাক।
আগে টর্চ লাগত না, আজকাল মনে হয় একটা হলে হত। অন্ধকারে সাপ-খোপের ভয় আছে ঠিকই, কিন্তু তার চেয়েও বেশি আজকাল কেমন যেন গা ছমছম করে। দিন দিন গা ছমছমে ভাবটা বাড়ছে আর বরুণ মিদ্দার যেন আজকাল কাছেপিঠেই ঘোরাঘুরি করে, তক্কে তক্কে থাকে। ধীরেন আজকাল এসব টের পায় খুব। গত পঁয়তাল্লিশ বছর বরুণ মিদ্দারের চিহ্নও ছিল না, এখন কেন যে ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছে কে জানে বাবা।
কথাটা পাঁচকান করার মতো নয়। পঁয়তাল্লিশ বছর আগে ধীরেন কাষ্ঠ নামে বাইশ-তেইশ বছরের যে তরতাজা জোয়ান দাপিয়ে বেড়াত তার সঙ্গে এখনকার এই ধীরেন কাষ্ঠর সম্পর্কটাই বুঝতে কষ্ট হয়। কালোর মধ্যেও ভারী নাকি সুন্দর চেহারা ছিল সেই ধীরেন কাষ্ঠর। আর ছিল নানা দিকে মন। ম্যাট্রিক পাসটা করেছিল কোনওক্রমে, তারপর আর পড়া হল না। তবে হাতের কাজে ঝোঁক ছিল খুব। ভাল লাটাই তৈরি করতে পারত, পুতুল গড়ত, মূর্তি তৈরি করতে পারত, কাঠের কাজেও ছিল ভাল হাত। কিন্তু পাঁচ রকম জিনিসে মন দিতে গেলে কোনওটাই তেমন হয়ে ওঠে না। বাবা চরণ কাষ্ঠ তাড়না করত খুব। টাকা আয় না করলে ঘরছাড়া করার হুমকি দিত।
সেই সময়ে পাশের গাঁ শূলপুরে বরুণ মিদ্দারের কাছে গিয়ে জুটল সে। গুণী মানুষ, ঘরে বসে মৃদঙ্গ, খোল, দোতারা এইসব তৈরি করত। বিক্রিবাটা কিছু খারাপ হত না। তবে হাঁফি রুগি বলে সারা বছর কাজ তুলতে পারত না। ধীরেনকে পেয়ে তার সুবিধে হল। ধীরেন চিৎপুর থেকে কাঁচা মাল কিনে আনত, খদ্দের ধরে আনত আর বাকি সময়টা কাজ শিখত।
কিন্তু জীবনটা তো সবসময় সোজা পথে চলে না। হঠাৎ হঠাৎ বাঁক ফেরে। আর তখনই ভাঙন লাগে।
মিদ্দারের ঘরে ছিল কালনাগিনী। যেমন তার লকলকে চেহারা, তেমনই তার ঠাটঠমক। চোখের ভিতর থেকে যেন ইলেকট্রিক ঠিকরে আসত। বাপ রে! প্রথম প্রথম দেখে তো ভয়ই খেয়ে যেত ধীরেন। এই ফুটন্ত যুবতী বউকে সামলায় কী করে রোগাভোগা বরুণ মিদ্দার!
কারণে অকারণে তাদের কাজের ঘরে এসে উদয় হত বাতাসী। দু হাত তুলে খোঁপা ঠিক করত– তাতে বুকখান ঠেলে উঁচু হয়ে উঠত বেশ, অকাজের কথা বলে বলে ভাব করত ধীরেনের সঙ্গে। বরুণ মিদ্দার কিছু বলত না। তবে মুখ দেখে মনে হত বউ নিয়ে তার স্বস্তি নেই।
কিছুদিনের মধ্যেই ইশারা ইঙ্গিত শুরু করে দিল বাতাসী। সুরেলা গলায় উঠোন থেকে হয়তো একটু রসের গান গেয়ে উঠল, বা ছাগলছানাটাকে কোলে নিয়ে এমন সব কথা বলে আদর করত যা ছাগলছানাকে বলার কথা নয়।
সেই বয়সে তখনও ধীরেনের মেয়েমানুষের বউনি হয়নি। বাধোবাধো ভাব তো ছিলই, ভয়ও ছিল বেশ। কীসে পাপ লেগে যায় কে জানে বাবা! কিন্তু ওই দামাল বয়সে বাঁধ রাখাও কঠিন কাজ।
মুশকিল হল বরুণ মিদ্দার ঘর থেকে বেরোত না মোটে। রোগাভোগা মানুষ বলেও বটে আর তার কাজটাও ঘরে বসা কাজ বলেও বটে। ফলে বাতাসীর বিশেষ সুবিধে হচ্ছিল না। ধীরেনও নিজেকে খুব সংযত রাখত। ইশারা ইঙ্গিত পেয়েও চোখ তুলে তাকাত না।
কিন্তু সুযোগসন্ধানীদের কখনও সুযোগের অভাব হয়নি। ভগবানই কি পাপীদের জন্য নানা ফাঁকফোকর তৈরি করে দেন? তাই যদি না হবে তবে হঠাৎ সেদিন সন্ধেবেলা ঘটকবাড়ি থেকে বরুণ মিদ্দারের ডাক আসবে কেন? ঘটকরা বড় মানুষ, ডাকলে না গিয়ে উপায় নেই। মেয়ের স্কেল চেঞ্জার হারমোনিয়ম খারাপ হয়েছে, ফলে তাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে, আজই গিয়ে হারমোনিয়ম সারিয়ে দিয়ে আসতে হবে।
বরুণ মিদ্দার যখন শশব্যস্তে যন্ত্রপাতির ব্যাগ নিয়ে রওনা হচ্ছিল তখন ভালমানুষের মতো ধীরেন বলেছিল, চলুন আমিও সঙ্গে যাই। কাজটা শেখাও হবে।
কথাটা শুনে ঘাড়ও কাত করেছিল মিদ্দার। তারপরই দোনোমোনোতে পড়ে গেল। নিয়তি কেন বাধ্যতে। যে খোলটার কাজ চলছিল সেটা সত্যকিশোর দাসের। মস্ত কীর্তনীয়া। কাজটাও জরুরি। কাল সকালেই সত্যকিশোরের লোক আসবে খোল নিতে। নগদ টাকার কারবার। তাই মিদ্দার একটু ভেবে বলল, হারমোনিয়ম সারাতে সময় লাগবে। তুই বরং খোলটা এগিয়ে রাখ, আমি এসে বাকিটুকু করব।
নিয়তি! নিয়তি ছাড়া আর কী? মিদ্দার কুকুরের মুখের কাছে রসালো মাংসের টুকরো রেখে চলে গেল। আহাম্মক আর কাকে বলে!
বোধহয় পাশের শোওয়ার ঘরে দম বন্ধ করে অপেক্ষায় ছিল বাতাসী। তাকেই কি দোষ দিতে পারে ধীরেন? না, আজও দোষ দিয়ে উঠতে পারে না। উপোসি শরীর, তীব্র অতৃপ্ত কাম কামনা, মনের জ্বালা মানুষের মাথা ঠিক রাখতে দেয় নাকি?
মিদ্দার বাড়ির চৌহদ্দি ডিঙোতে না ডিঙোতেই বাতাসী যেন বাজপাখির মতো উড়ে এল।
অ্যাই!
ধীরেন ধুকপুক করা বুকে নিচু মাথা উপরে তুলেই দেখল দুটো চোখ জ্বল জ্বল করে জ্বলছে। শরীরের ছিলা টান টান।
ধীরেন ভালমানুষের মতো বলল, কী?
যেন ভারী অবাক হয়ে বড় বড় চোখ করে বাতাসী বলল, কী? কী?
তারপরই ছুটে এসে তার ঝাঁকড়া চুল দু হাতে খামচে ধরে ঝাঁকানি দিতে দিতে পাগলের মতো বলতে লাগল, কী? কী? তুমি জানো না কী? তুমি জানো না? ন্যাকা কোথাকার…।
গায়ে কী জোর রে বাবা! ধীরেনের মতো জোয়ান লোককে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে ফেলল পাশের ঘরের বিছানায়। উন্মাদিনীর মতো তাকে খাবলাচ্ছে, খিমচোচ্ছে আর বলছে, জানো না কী? জানো না? বদমাশ! শয়তান! জানো না?
ধীরেনের বাঁধ ভেঙেছিল আগেই। এবার ভেসে গেল।
কতটা পাপ হল তা ধীরেন জানে না। কিন্তু কোনওদিন যদি ভগবান তাকে এ নিয়ে জিজ্ঞেস করেন তা হলে ধীরেনও সপাটে বলবে, আমি কি ইচ্ছে করে করেছি কিছু? আপনিই তো ঠাকুর, ঘটকবাড়ির হারমোনিয়ম খারাপ করে রেখেছিলেন। তাও ভর সন্ধেবেলা। তার ওপর আবার পরদিন ঘটকবাড়ির মেয়েকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসছে বলে তাদের তর সয় না। এই এতগুলো যোগাযোগ এই ত্র্যহস্পর্শ ঠাকুর, আপনি ছাড়া আর কে ঘটাতে পারে? আমি তো সঙ্গেই যেতুম, কিন্তু সত্যকিশোরের খোল বাদ সাধল যে!
পাপবোধটা বড্ড খোঁচা দিচ্ছিল, যখন একটু বেশি রাতের দিকে বরুণ ফিরে এল। তখন ধীরেন নতুন খোল ছাওয়ার কাজটা অনেক এগিয়ে রেখেছে। বরুণ তার মুখখানা ভাল করে দেখল। তারপর মুখটা একটু তেতো করে বলল, রাত হয়েছে বাড়ি যা।
মিদ্দার বোকা লোক নয় যে, টের পাবে না। এসব বাতাসেই টের পাওয়া যায়, টের পেতে চাইলে। খুব দুশ্চিন্তা নিয়ে, দুরুদুরু বুকেই অত রাতে দু মাইল পথ হেঁটে বাড়ি ফিরেছিল ধীরেন। দুশ্চিন্তায় আর ভয়ে রাতে ভাল ঘুম হয়নি। তার মধ্যেও মনস্তাপে বারবার চমকে ঘুম ভেঙে গেছে।
পরদিন অপরাধী মুখ নিয়ে সে যখন গিয়ে মিদ্দারের বাড়িতে হাজির হল তখন কোনও বৈলক্ষণ চোখে পড়ল না। মিদ্দার তার কাজের ঘরে বসে কাজ করছে, বাতাসী ঘরকন্নার কাজ করছে। তাকে দেখে একটু হাসল। খুব মিষ্টি আর মানেওয়ালা হাসি।
একবার হলে পাপ আবার হতে চায়। একবার পর্দাটা সরে গেলে আর ঢাকা-চাপা দেওয়া যায় না কি না।
কিন্তু বরুণ মিদ্দার তো আর নিত্যি নিত্যি সন্ধেবেলা ঘটকবাড়ি হারমোনিয়ম সারাতে যায় না। সুতরাং বাতাসী অন্য পন্থা নিল। রান্নায় মিশিয়ে কী যেন একটা খাইয়ে দিল মিদ্দারকে। সেই খেয়ে মিদ্দারের ছুটল হাগা। একে রোগাভোগা মানুষ, চার-পাঁচবার দাস্ত করেই নির্জীব হয়ে নেতিয়ে পড়ল বিছানায়। গাঁয়েগঞ্জে ডাক্তারের ব্যবস্থা নেই। গ্যাঁদাল থানকুনি ছেঁচে বাতাসীই খাওয়াল তাকে। দুর্বল মানুষটা যখন ঘুমিয়ে পড়ল তখন ফের ব্যাপারটা হল। কী শরীর! কী শরীর বাতাসীর!
তবে ষড়যন্ত্রটা মোটেই ভাল লাগল না ধীরেনের। সে বলল, তুমি খুব পাষণ্ড আছ বাপু। মিদ্দারকে ওষুধ খাওয়ালে, মরেটরে যেত যদি?
যেত তো যেত। মরলে বাঁচি। সারাজীবন ওই নপুংসককে গলায় ঝুলিয়ে বেঁচে থাকব নাকি?
কাজটা ভাল করোনি। এরকম করলে আমি কিন্তু আর আসব না।
ইস্! না এসে পারবে?
পারবে না, সে ধীরেনও জানে। তার তখন নেশা ধরেছে।
বাতাসী একদিন প্রস্তাব দিল, আমাকে নিয়ে পালাবে?
এ প্রস্তাবে আকাশ থেকে পড়ল ধীরেন। বিয়ে করার মতো অবস্থাই তার নয়। বাপ এমনিতেই রোজ চাকরি-বাকরি করার জন্য হুড়ো লাগাচ্ছে। মাও মুখনাড়া দিয়ে তবে দুটি ভাত দেয়। তার ওপর অন্যের বউ ফুসলিয়ে বাড়ি নিয়ে তুললে তো চিত্তির। বাড়িতে কাকচিল বসতে পারবে না। তার ওপর বাতাসীর মতো মেয়েছেলে। এ তো দিনকে রাত করতে পারে। একে বিশ্বাস কী?
সে মিন মিন করে বলল, কাজটা ঠিক হবে না।
কেন হবে না শুনি? তোমার আপত্তি কীসের?
শত হলেও বরুণদাদা আমার গুরু, তার কাছে কাজ শিখছি। তার সঙ্গে নেমকরাহামি করব কী করে?
আহা, সাধুপুরুষ রে! নিমকহারামি যা করার তো করেই ফেলেছ। আমার পেটে তোমার ছেলে। নিমকহারামির আর বাকি আছে কিছু?
খবরটা শুনে ধীরেন অগাধ জলে পড়ল। ঘটনাটা সত্যি হয়ে থাকলে তো জল অনেক দূর গড়িয়েছে। ভয় খেয়ে ধীরেন বলল, আমার চালচুলো নেই বাতাসী, তোমাকে নিয়ে ঘর বাঁধার মতো অবস্থাও নয়।
বাতাসী বলল, তা হলে মিদ্দারকে সরাও। সরিয়ে দুজনে বেশ এখানেই থাকব।
ধীরেন অবাক হয়ে বলে, সরাব? সরাব কোথায়?
আহা, সরানো মানে বুঝলে না? দুনিয়া থেকে সরাও।
ধীরেনের মাথায় বজ্রাঘাত। মেয়েটা বলে কী? এ যে মিদ্দারকে খুন করাতে চাইছে! ভীষণ ভয় খেয়ে সে বলল, ছিঃ, ওসব বোলো না। বলতে নেই। শুনলেও পাপ হয়।
মশা মাছি মারলে যা পাপ হয় ভগবানের দুনিয়ায় মানুষ মারলে তার বেশি হয় না। বুঝলে? যদি পাপের ভয়ে পিছিয়ে যাও তা হলে তুমি বোকা। ভগবানের কাছে মশা, মাছি, পোকা, মানুষ সব সমান।
ধীরেন মাথা নেড়ে বলল, ওসব মরে গেলেও আমি পারব না।
তা হলে কাজটা আমিই করব। তুমি সাহায্য কোরো, তাহলেই হবে।
ধীরেন এ কথায় এত ভয় পেয়েছিল যে বলার নয়।
যে সময়ে তাদের কথা হচ্ছিল সে সময়ে মিদ্দার হাটে গিয়েছিল। ফিরে এসে উঠোনে দাঁড়িয়ে তাদের কথা বলতে দেখে গম্ভীর মুখ করে নিজের কাজের ঘরে গিয়ে ঢুকল। ভারী অপরাধবোধ হচ্ছিল ধীরেনের। একটু আগেই দুপুরবেলা মিদ্দারের বিছানাতেই জড়ামড়ি করে শুয়ে থেকেছে সে আর বাতাসী। দুপুর তুফানের মতো উড়ে গেছে। এখন বড় অবসাদ, বড় পাপবোধ। মিদ্দার বোধহয় সবই টের পায়, তবে কেন ফুঁসে ওঠে না? কেন তাড়িয়ে দেয় না ধীরেনকে? কেন ঝাঁটাপেটা করে না বাতাসীকে?
ধীরেন বড় টানাপোড়েনের মধ্যে পড়ে গেল। কী যে অবস্থা গেছে কদিন তা বলার নয়। কিন্তু আশ্চর্যের কথা এসব কাণ্ড যখন চলছে তখনও কিন্তু বরুণ মিদ্দার শান্ত, চুপচাপ। আপনমনে নিজের কাজ করে যায়। তার ঘর থেকে নানা বাদ্যযন্ত্র পরীক্ষার নানা সুরেলা শব্দ ওঠে। আর কোনওদিকেই যেন মন নেই মিদ্দারের।
তখন ঘোর বর্ষাকাল। এক তুমুল বৃষ্টির রাতে বরুণ মিদ্দার বলল, আজ কি আর যেতে পারবি?
ধীরেন বলল, পারব। বর্ষাবাদলায় আমার অসুবিধে হয় না।
বরুণ মিদ্দার বলল, কাজ কী ফিরে? চাট্টি ভাত খেয়ে এখানেই শুয়ে থাক।
ধীরেন আপত্তি করল না। রাতে বাতাসী খিচুড়ি বেঁধেছিল। তাই খেয়ে বাদ্যযন্ত্রের ঘরে মাদুরে শুয়ে রইল ধীরেন। তুমুল বৃষ্টি আর প্রলয় বাতাসে ঘরদোর ভেঙে পড়ার অবস্থা। পাশের ঘরে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কী হচ্ছে তা ভাবতে ভাবতে একটু ভয়-ভয় ভাব নিয়েই ধীরেন ঘুমিয়ে পড়েছিল।
অচেনা যে-ভয়টা তার মনের মধ্যে ছিল সেই ভয়টা যে কেন তা হঠাৎ করে তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল যখন নিশুত রাতে হঠাৎ একটা উন্মাদিনী মেয়েমানুষের শরীর তাকে সাপের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল।
ধীরেন সেই আলিঙ্গন ছাড়াতে ছাড়াতে চাপা গলায় বলল, করো কী? বরুণদা টের পাবে যে!
ভয় নেই, ওকে ঘুমের ওষুধ দিয়েছি।
কী ওষুধ?
ও তুমি বুঝবে না।
বিষ দাওনি তো?
না গো না, ঘুমের ওষুধ। ভয় পেও না।
মনে একটা ধন্দ থেকেই গিয়েছিল তবু ধীরেনের। এ পাগলি কী করে এল মিদ্দারকে ফাঁকি দিয়ে কে জানে! বাতাসীকে প্রত্যাখ্যান করা সম্ভব ছিল না। সে তার পাওনাগণ্ডা আদায় করে যেমন এসেছিল তেমনই চলে গেল হঠাৎ। বৃষ্টির তেজ আরও বাড়ল। হাওয়ায় তখন ঝড়ের গর্জন। ধীরেন অশান্ত মনে খানিকক্ষণ এপাশ ওপাশ করে ঘুমিয়ে পড়ল।
ম্যাদাটে আলোয় ভোরবেলা উঠে ধীরেন দেখল, ঝোড়ো বাতাস থামলেও বৃষ্টি পড়েই চলেছে। উঠোনে এক হাঁটু জল। ঘরের ভিটে ডুবে যেতে আর খুব বাকি নেই। কেঁচো, কেন্নো, উইচিংড়েরা বারান্দা ভরে ফেলেছে। আর উঠোন, বাগান, সব জলে একাকার। কোথাও ডাঙাজমি দেখা যাচ্ছে না। ঘটির জলে চোখমুখ ধুয়ে সে কিছুক্ষণ চারদিকের অবস্থা দেখল দাঁড়িয়ে। এই অবস্থায় বাড়ি ফেরা শক্ত হবে। কিন্তু ফেরাটাও দরকার। কাল রাতে যা হল তাতে তার আর এ বাড়িতে থাকতে সাহস হচ্ছে না। বরুণ মিদ্দার কিছু টের পেয়ে থাকলে বড় লজ্জার কথা।
ও-ঘর থেকে অবশ্য কোনও সাড়াশব্দ আসছিল না। আকাশের আলো দেখে ধীরেন অনুমান করল, সকাল ছটা-সাড়ে ছটা হবে। এত বেলা অবধি ওদের ঘুমোনোর কথা নয়।
ধীরেন ঘরে এসে মাদুরে চুপচাপ বসে রইল। মনে বড় দুশ্চিন্তা।
আরও কিছুক্ষণ বাদে দরজা খোলার শব্দ হল। ও-ঘর থেকে বরুণ মিদ্দার এসে মাদুরে বসল। তাকে দেখে খুশিই হল ধীরেন। যাক, বাতাসী তাহলে লোকটাকে বিষ-টিষ দেয়নি। কিন্তু মিদ্দারের অবস্থা ভাল নয়। বর্ষার ঠান্ডা আর জোলো বাতাসে তার হাঁফের টান উঠেছে, গলায় শ্লেষ্মার শব্দ হচ্ছে, চোখ দুটো লাল আর টসটসে। গলা আর মাথায় কম্ফর্টার জড়ানো। গায়ে চাদর।
এঃ, শরীরটা যে খারাপ দেখছি বরুণদাদা?
বরুণ মিদ্দার কথাই কইতে পারল না। কিছুক্ষণ হাঁফাল, বারান্দায় গিয়ে অনেকটা শ্লেষ্মা ফেলে এসে ফের কিছুক্ষণ কাহিল শরীরে বসে হাঁফ ছাড়ার জন্য হাঁসফাঁস করল। আবার গিয়ে শ্লেষ্মা ফেলল।
বার কয়েক শ্লেষ্মা উগড়ে একটু ধাতস্থ হয়ে বরুণ মিদ্দার হঠাৎ তাকে বলল, তোর তো গায়ে বেশ জোর-টোর আছে। একটা ভারী জিনিস তুলতে পারবি?
ধীরেন অবাক হয়ে বলল, কী তুলতে হবে বরুণদাদা?
একটা লাশ। মেয়েমানুষের লাশ।
ধীরেন এত স্তম্ভিত হয়ে গেল যে, মুখ দিয়ে বাক্য সরল না। বড় বড় চোখে চেয়ে রইল।
পারবি না?
ধীরেন স্খলিত কণ্ঠে শুধু বলল, অ্যাঁ!
বরুণ মিদ্দার হঠাৎ একটা হাত বাড়িয়ে তার ডান হাতের কবজিটা শক্ত করে ধরে ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, আয়।
ধীরেনের আজও মনে আছে, সে যেন একটা ঘোরের মধ্যে মিদ্দারের সঙ্গে সঙ্গে পাশের ঘরে গিয়ে ঢুকল। শরীরে একরত্তি শক্তি নেই, পা দুটো ভেঙে আসছে ভয়ে, মাথাটা বড্ড ধোঁয়াটে।
দরজা জানালা বন্ধ বলে ঘরটা এখনও অন্ধকার। আবছা দেখা যাচ্ছিল, বাতাসী বিছানায় আড়াআড়িভাবে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। দুটো পা বেরিয়ে আছে চৌকির বাইরে।
ধীরেন হাঁ করে চেয়ে রইল।
বরুণ মিদ্দার বলল, এতকাল লুকিয়ে-চুরিয়ে নষ্টামি করছিল, টের পেয়েও কিছু বলিনি। আমি কি বুঝি না যে, ওরও একটা পুরুষমানুষ দরকার! টের পেয়েও না-পাওয়ার ভান করতুম। কিন্তু কাল রাতে যা করল তা কি সহ্য করা যায় বল তো! হাঁফানির টান বেড়েছে বলে ঘুমোতে পারছি না। এপাশ ওপাশ করছি। জেগে আছি জেনেও দিব্যি উঠে চলে এল এ-ঘরে। আমি গলাখাঁকারি দিয়ে জানান দিলুম যে জেগে আছি। তবু গ্রাহ্য করল না। যেন আমি কেউ না, কিছু না। চলে এল, আর আমি তখন বসে বসে ভাবলুম যা করার আজই করতে হবে। এ জিনিস আর সহ্য করা যায় না।
ধীরেন তখনও হাঁ করে পলকহীন চোখে চেয়ে আছে মিদ্দারের দিকে। বরুণ মিদ্দার তার চাদরের তলা থেকে তার হাতটা বের করল। হাতে একটা তারের ফাঁস। বাদ্যযন্ত্রের সরু স্টিলের শক্ত তার দিয়ে তৈরি। একপ্রান্তে কাঠের হাতল লাগিয়ে নিয়েছে, যাতে টান মারতে সুবিধে হয়। এ অস্ত্র যে ভয়ংকর তা ধীরেন জানে, একটা হ্যাঁচকা টান মারলেই গলার মাংস কেটে বসে যাবে। আধখানা গলা নেমে যাবে লহমায়। দড়ির ফাঁসের চেয়ে বহুগুণ ভয়ংকর।
বরুণ মিদ্দার বলল, একটা শব্দ করারও সময় পায়নি। হাসি-হাসি মুখ করে তোর ঘর থেকে এসে দিব্যি আমার পাশে শুয়ে পড়ল। এমনকী আমি জেগে আছি জেনেও নির্লজ্জের মতো বলল, একটু সরে শোও তো, গরম লাগছে। যেন কিছুই হয়নি। গায়ে জ্বালা করে না, বল তো! কিন্তু আমি হড়বড় পছন্দ করি না। ঠান্ডা মাথায় কাজ করতে পছন্দ করি। চমকে দেওয়ার জন্য বললুম, হ্যারিকেনটা একটু উসকে দেখ তো, ঘরে বোধহয় সাপ ঢুকেছে। সাপ শুনে টক করে উঠে বসে বলল, কোথায় সাপ? ব্যস, ওইটাই শেষ কথা। তৈরিই ছিলুম, ও উঠে বসতেই গলায় ফাঁসটা গলিয়ে টেনে দিলুম।
ধীরেন ভয়ে থরথর করে কাঁপছিল। শুধু ভাঙা গলায় বলল, সর্বনাশ!
একটু হাত লাগাতে হবে যে রে। লাশটা ইট বেঁধে পিছনের ডোবায় ফেলতে হবে।
ধীরেন আতঙ্কিত গলায় বলল, আমি পারব না।
বরুণ মিদ্দার হাসল, পারব না বললে কি হয়! ফুর্তি লুটবে আর দায় সারবে না তাই কি হয়?
পায়ে ধরছি বরুণদা, ও আমি পারব না।
পারত না ধীরেন। তার হাত-পা ভয়ে অবশ। দৌড়ে পালাবে ভেবেছিল, কিন্তু শরীরে তখন একরত্তি ক্ষমতা নেই।
আচমকাই বরুণ মিদ্দার হাতের ফাঁসটা তার গলায় গলিয়ে হালকা একটা টানে সেঁটে দিয়েছিল ফাঁস। ওই একটু টানেই ধারালো তার বসে গেল গলায়, দম আটকে এল তার। টপটপ করে গরম রক্ত ঝরে পড়ছিল গলা থেকে বুকে।
ফাঁসটা আলগা করে বরুণ মিদ্দার বলল, এই। ওকে কাঁধে নে। গড়বড় করলে কিন্তু বাঁচবি না।
ধীরেনের বাঁচার কথাই ছিল না সেদিন। বরুণ মিদ্দার রোগাভোগা মানুষ হলেও রাগে আর প্রতিহিংসায় সেদিন তার শরীর লোহার মতো শক্ত। আর ধীরেন সেদিন ভয়ে আতঙ্কে কেঁচো। গলায় তারের ফাঁস, তার হাতলটা মিদ্দারের শক্ত মুঠোয় ধরা। সেই অবস্থাতেই বাতাসীর ঠান্ডা শক্ত শরীরটা যে কীভাবে কাঁধে তুলেছিল ধীরেন তা আজও রহস্য। প্রাণের ভয়ে মানুষ কী না পারে! বাতাসীর গলা অর্ধেক নেমে গিয়েছিল, রক্তে ভেসে যাচ্ছিল বিছানা। বরুণ মিদ্দার ফাঁসের হাতল ধরে থেকেই দরজা খুলল, বলল, নাম।
উঠোনে হাঁটু জল, এঁটেল পিছল মাটি, কাঁধে বাতাসী। সে যে কী অবস্থা তার! সে যদি হঠাৎ পা পিছলে পড়ে যায় তাহলে মিদ্দারের হাতে ধরা ফাঁস ঘ্যাঁস করে গলায় বসে যাবে। আর মিদ্দার যদি পা পিছলে পড়ে তাহলেও একই পরিণতি। ধীরেনের তখন দু চোখে জলের ধারা। এরকম বিপদে সে কখনও পড়েনি। মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছিল। চারদিক অন্ধকার। লোকজনের চিহ্ন নেই। উঠোন পেরোনোই হয়ে দাঁড়িয়েছিল শক্ত কাজ। পা টিপে টিপে সেটা পেরোনোর পর পিছনে ডোবার ঢল। ঢালু দিয়ে এই লাশ কাঁধে নিয়ে নামা তো সোজা নয়। একটু এদিক ওদিক হলেই তার গলায় ফাঁস বসে যাবে।
সজনেগাছের তলায় কিছু ভাঙা ইটের স্তূপ ছিল। সেখানে এসে মিদ্দার বলল, ওকে নামিয়ে ওর পেট-কোঁচড়ে ইটের টুকরোগুলো ভাল করে বাঁধ। তাড়াতাড়ি কর, সময় নেই।
সেই জলের মধ্যে বাতাসীকে নামাতে হল। তারপর ইটের টুকরো জড়ো করে আঁচলে বেঁধে তা কোমরে জড়িয়ে গিঁট দেওয়া–ওই প্রবল বৃষ্টির মধ্যে কাজটা তো সোজা নয়। তার ওপর ধীরেনের হাত-পা তখন বশে নেই। তবু সে অসম্ভবকে সম্ভব করার জন্য প্রাণের তাড়নায় জন্তুর মতো মিদ্দার যেমন বলছিল–করে যাচ্ছিল। কাজটা যে খুব সুষ্ঠু হল তাও নয়। আঁচল কোমরে জড়িয়ে বাঁধতে গিয়ে বারবার বাতাসীর মুখের দিকে চাইতে হচ্ছিল তাকে আর চোখ বুজে ফেলছিল সে।
এবার সাবধানে ডোবার ঘাটে নাম।
নাবব? পড়ে যাব যে! আর পড়লেই–
বৃষ্টিতে ভিজে এখন বরুণ মিদ্দারের অবস্থাও ভাল নয়। হাঁফের টান চৌগুণে উঠেছে। তবু গর্জন করল, নাম বলছি। মরলে দুজনেই মরব। মরতে ভয় কী রে শালা? ফুর্তি লোটার সময় মনে ছিল না?
ডোবার নাবালে ওই লাশ নিয়ে নামতে গিয়েই ধীরেন বুঝল, আজ মৃত্যু নির্ঘাৎ। এত পেছল মাটি যে দাঁড়ানোই যাচ্ছে না। এক ধাপের পর দ্বিতীয় ধাপেই হঠাৎ পা হড়কে চিত হয়ে পড়ে গেল ধীরেন। বাতাসীর লাশ পড়ল তার ওপর। চোখের পলকে তার গলায় ফাঁসটা টাইট হয়ে গিয়েছিল বটে, কিন্তু হঠাৎ সেটা ফের আলগাও হয়ে গেল।
হাঁচোড়-পাঁচোড় করে মাথা তুলেই ধীরেন দেখল, বরুণ মিদ্দারও পড়ে গেছে জলে। হাতে ফাঁসের হাতলটা নেই। সাদা মুখ, বড় বড় চোখ, হাঁ করে শ্বাস টানতে টানতে উঠতে চেষ্টা করছে। ধীরেন দেখল, এই সুযোগ। এক মুহূর্ত দেরি না করে সে বরুণ মিদ্দারের মাথাটা ধরে চেপে দিল জলের তলায়। হাত পা ছুঁড়েছিল বটে মিদ্দার। আঁকুপাঁকু করেছিল। কিন্তু এক মিনিটও নয়। জলের তলায় স্থির হয়ে গিয়েছিল সে। গলার ফাঁসটা খুলতে ভুলে গিয়েই ধীরেন জল ভেঙে ছুটতে শুরু করেছিল।
.
০৭.
ভোররাতের নির্জনতায় একটা অ্যালার্ম ঘড়ি বেজে উঠল। কুক-কুক-কুক-কুক।
নিস্তব্ধতার ওপর শব্দের ছুরি বসে যাচ্ছে উপর্যুপরি। সেই শব্দে তন্দ্রা ভেঙে নিরর্থক খানিকক্ষণ প্রথমে ভুক ভুক, তার পর ভৌ ভৌ করে চেঁচাল কেলো নামে কুকুরটা। তার কোনও বীরত্ব নেই, সে জানে। মাঝে মাঝে তবু তাকে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে হয়। মহিম রায়ের বারান্দা থেকে উঠোনে নেমে সে খানিকক্ষণ ঊর্ধ্বমুখ হয়ে ঘড়িটাকে বকাঝকা করল। অ্যালার্ম থামল না। কোয়ার্টজ ঘড়ির অ্যালার্ম সহজে থামেও না। তীক্ষ্ণ শব্দটা বারবার চারদিকের নির্জনতায় ছুরির মতো ঢুকে যাচ্ছে।
কেলোর চিৎকারেই ধড়মড় করে উঠে বসেছিল সন্ধ্যা। চোর এল নাকি? চোরেদের খবর থাকে। কাল রাতেই ছ হাজার সাতশো টাকা পেমেন্ট দিয়ে গেছে রাতুল নস্কর। টাকাটা এখনও তার বালিশের তলায়। কাল রাতে আলমারিতে তুলে রাখার সময় পায়নি। বালিশের নীচে হাত ঢুকিয়ে সে তাড়াতাড়ি বান্ডিলটা দেখল। অনেক কষ্টের রোজগার তার। টাকাও কি সহজে আদায় হয়েছে এতকাল? দোকানদাররা টাকা দিতে কত গড়িমসি করে। কতবার ঘোরায়। বেশি তাগাদা দিলে মাল তুলতে চায় না। আজকাল আদায় উশুল খানিকটা সহজ হয়েছে। টর্চ জ্বেলে চারদিকটা দেখে নিল সন্ধ্যা। না, কেউ ঢোকেনি ঘরে। ওপাশের আর একটা চৌকিতে সীমন্তিনী নামে কাজের মেয়েটা ঘুমোচ্ছ। গাঢ় ঘুম। সারাদিন যা অসুরের মতো খাটুনি যায় তাতে সন্ধ্যারও ঘুম গাঢ় হওয়ার কথা। কিন্তু হয় না। মাঝে মাঝে নিশুতরাতে অকারণে ঘুম ভেঙে যায়। না, ঠিক অকারণে নয়। ঘরে নগদ টাকা থাকে তার। সব সময়ে ব্যাঙ্কে গিয়ে দিয়ে আসার সময় হয় না। চোরছ্যাঁচড়ের ভয়েতেই বোধহয় আজকাল ঘুম খুব সজাগ হয়েছে তার। পঞ্জিকা থেকে চোরের মন্তর শিখে নিয়েছে সে। রোজ সেইসব মন্তর বিড়বিড় করে আওড়ায়। তারপর শোয়। কিন্তু মন্তরের ভরসায় আর কে নিশ্চিন্তে ঘুমোয় বাবা! ঘুম ভাঙার আরও একটা কারণ হল, তার এই জীবনটা। এ যে কোথায় গিয়ে কেমনভাবে শেষ হবে কে জানে! মাঝে মাঝে একজন তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় বটে, কিন্তু বড্ড বাধো বাধো ঠেকে। বাবা বা দাদারা শুনলে কী বলবে। বাবা হয়তো শয্যাই নিয়ে নেবে। ওসব ভাবতে কেন যেন সাহস হয় না তার, আবার ইচ্ছেও করে। স্বামীটার কথাও সারা দিনে না হলেও এই নিশুতি রাতে ঠিক মনে পড়বেই। হাড়েবজ্জাত লোকটার ওপর তার রাগ হয় বটে, কিন্তু কেন যেন মায়াও হয়। পুরুষ জাতটা তো ভালবাসতে জানে না। ভালবাসে মেয়েরাই। আর সেই জন্যই মরে।
কেলোর চিৎকার ছাপিয়ে ঘড়ির অ্যালার্মটা হঠাৎ শুনতে পেল সন্ধ্যা। মুরগি যেমন উঠোনে দানা খুঁটতে খুঁটতে আদুরে শব্দ করে ঠিক তেমনই শব্দ। কুককুক কুককুক। দোতলা থেকে আসছে। টর্চ জ্বেলে দেয়ালঘড়িটা দেখল সন্ধ্যা। ভোর পৌনে চারটে বাজে। মেমসাহেব এত সকালে তো ওঠে না। বেলা আটটা বাজলে বারান্দায় এসে নাইটি-পরা অবস্থায় ভাসুর-শ্বশুরের চোখের সামনে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজে। তখন সন্ধ্যার ইচ্ছে করে একটা ঢেলা তুলে ছুঁড়ে মারতে। কিন্তু মেয়েটা একটু কিম্ভূত আছে। সন্ধ্যা ওঠে ভোর পাঁচটায় বা তারও একটু আগে। উঠে প্রায় সময়েই দেখতে পায়, মেয়েটা ভূতের মতো বারান্দার এক কোণে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। কেন ওরকম দাঁড়িয়ে থাকে কে জানে বাপু!
সন্ধ্যার সন্দেহ ক্রমে ঘনীভূত হচ্ছে। ছেলেটা কলকাতায় যাতায়াত করে বটে, কিন্তু মা আর মেয়েতে পনেরো-ষোলোদিন ধরে কেন যে থানা গেড়ে আছে সেটাই সন্দেহের বিষয়। মেজদা কিছুতেই ওদের নিয়ে যাচ্ছে না। শুধু মেয়েটার অ্যালার্জি সারাতেই এখানে রয়েছে, এটা গুয়ে হাত দিয়ে বললেও কেউ বিশ্বাস করবে না। কেলেঙ্কারির গন্ধটা খুব পাচ্ছে সন্ধ্যা, কিন্তু সেটা কতদূর খারাপ সেটাই ধরতে পারছে না। কথা বললে পাছে মুখ ফসকে দু-একটা কথা বেরিয়ে পড়ে সেই ভয়েই বাড়ির কারও সঙ্গে কথাই বলে না ওরা। এমনকী ওদের খাবার পর্যন্ত ঝি সাবিত্রীকে দিয়ে ঘরে পৌঁছে দিতে হয়।
আমলকীটা খুব চলছে। বিটনুন দিয়ে জারিয়ে রোদে শুকিয়ে প্যাকেট করে ছেড়েছে সন্ধ্যা। খুব চলে। গত শীতে এক কুইন্টাল আমলকী কিনেছিল, তার কয়েক কেজি মাত্র পড়ে আছে। ঘরে রাখলে ছাতা ধরে যায় বলে মাঝে মাঝে রোদে দিতে হয়। পরশু দিন উঠোনে চাটাই পেতে যখন আমলকীগুলোকে রোদ খাওয়াচ্ছিল সে তখন মেয়েটা হঠাৎ দোতলা থেকে নেমে এল। একটু এদিক ওদিক পায়চারি করে কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। সন্ধ্যা আড়চোখে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। পাত্তা দেয়নি।
মেয়েটাই আচমকা বলল, এগুলো কি আমলকী?
সন্ধ্যা একটু অবাক হল। তার সঙ্গে সরাসরি কথা বলবে, এতটা ভাবেনি। ভদ্রতার খাতিরেই সন্ধ্যা বলেছিল, হ্যাঁ।
তাকে আরও অবাক করে দিয়ে মেয়েটা বলল, একটু টেস্ট করে দেখতে পারি?
ভারী অবাক হল সন্ধ্যা, একটু খুশিও হল কি? একটু কথা বলার ভিতর দিয়ে যে কত মেঘ কেটে যায়। সন্ধ্যা বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, খাও না, খাও।
সোহাগ নিচু হয়ে দু-তিনটে আমলকী তুলে মুখে দিয়ে তার দিকে চেয়ে ছেলেমানুষের মতো বলল, এগুলো কি চিবিয়ে খেতে হয়?
সন্ধ্যা একটু হেসে বলে, না না। শুকনো আমলকি চিবিয়ে খাওয়া যায় না। গালে রেখে দাও। ভিজে নরম হয়ে গেলে তখন চিবোবে।
সোহাগ খানিকক্ষণ মুখের আমলকী এ-গাল ও-গাল করে বলল, বেশ লাগে তো খেতে।
সন্ধ্যা খুশি হয়ে বলল, আরও নাও না। নিয়ে গিয়ে ঘরে রেখে দাও। যখন ইচ্ছে হবে খেও।
তার দরকার নেই। খেতে ইচ্ছে হলে আপনার কাছে এসে খেয়ে যাব।
সন্ধ্যা এটুকুতেই যেন গলে গেল। বলল, আমি পিসি হই। আমাকে আপনি-আজ্ঞে করতে নেই।
সোহাগ হঠাৎ উদাস হয়ে গেল যেন। শুধু বলল, আচ্ছা।
তারপর মুখ ফিরিয়ে খানিক আনমনে উঠোনের এদিকে সেদিকে একটু হেঁটে বেড়াল। যখন প্রথম এসেছিল তখন যেমন ঢলঢলে দেখতে ছিল এখন আর তেমন নেই। একটু যেন রোগা হয়েছে, একটু রুক্ষ। সন্ধ্যা লক্ষ করেছে মেয়েটা একদম সাজে না, চুলটা পর্যন্ত আঁচড়ায় না ভাল করে, সন্ধ্যা মনে মনে খুব চাইছিল মেয়েটা তার সঙ্গে আরও একটু কথা বলুক, একটু ভাব করুক।
না, আর কোনও কথা বলেনি সোহাগ। কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে যেমন এসেছিল তেমনই আবার ওপরে চলে গেল। গতকাল কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকে কয়েকবার সোহাগকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে সন্ধ্যা। কিন্তু তার দিকে তাকায়নি সোহাগ। আমলকী খেতেও আসেনি। কিন্তু সন্ধ্যা খুব অপেক্ষা করেছিল। যদি আসে!
সন্ধেবেলা কাসুন্দি আর আচারের শিশি ভর্তি করে লেবেল লাগাতে খুব ব্যস্ত ছিল সন্ধ্যা। তিনটে মেয়ে মেঝেতে বসে মন দিয়ে লেবেল লাগিয়ে যাচ্ছে। মাটির মালসায় আঠা, ডাঁই করা লেবেল, স্তূপাকার ঝুড়িভর্তি শিশি-বোতল। সকালেই মাল নিতে আসবে চার-পাঁচজন। আজ অনেক রাত অবধি জাগতে হবে সন্ধ্যাকে।
ঠিক এমন সময়ে খোলা দরজার ওপাশ থেকে মিষ্টি মিহি গলা পাওয়া গেল, আমি একটু ভিতরে আসতে পারি?
তেমনই অবিন্যস্ত চুল, তেমনই ঝ্যালঝালে একটা মেটে রঙের ঢলঢলে কামিজ আর বিবর্ণ একটা প্যান্ট-পরা সোহাগ চৌকাঠে দাঁড়িয়ে। দেখে এত ব্যস্ততার মধ্যেও সন্ধ্যা হঠাৎ উদ্ভাসিত হয়ে গেল। বলল, এসো এসো।
মেয়েটা ঘরে ঢুকতেই সন্ধ্যা চেয়ারটা ঠেলে দিয়ে বলল, বোসো।
সোহাগ চেয়ারে বসল না, মেঝেতে মেয়েগুলোর পাশেই ঝুপ করে আসন-পিঁড়ি হয়ে বসে পড়ল।
সন্ধ্যা মোলায়েম গলায় বলল, মেঝেতে বসলে ঠান্ডা লাগবে। এখন শীত পড়ছে।
সোহাগের কানে কথাটা গেলই না। সে খুব মন দিয়ে মেয়েদের কাজ দেখল কিছুক্ষণ। তারপর হঠাৎ সন্ধ্যার দিকে চেয়ে বলল, আমি কি কিছু করতে পারি?
সন্ধ্যা অবাক হয়ে বলে, ওমা! তুমি আবার কী করবে? এসব কি তোমার কাজ?
কাজের মেয়েগুলো কাজ থামিয়ে মাঝে মাঝে অবাক হয়ে সোহাগকে দেখছিল। তাদের চোখে বিস্ময় আর কৌতুক।
সন্ধ্যার সব কাজেই খুব যত্ন। পরিষ্কার চকচকে মস্ত মেটে হাঁড়ি থেকে বড় হাতায় কাসুন্দি তুলে ফানেল দিয়ে শিশিতে ভরছিল সে। ছিপি লাগানোর একটা ছোট হাতযন্ত্র কিনেছে সে, দুটো মেয়ে সেই যন্ত্রে পটাপট ছিপি আটকে দিচ্ছে। যাতে কেউ নকল করতে না পারে তার জন্য পিলফার প্রুফ করার ব্যবস্থা। ব্যবস্থাটা অবশ্য খুবই দুর্বল, কিন্তু খদ্দেররা আজকাল এসব চায়।
সোহাগ উঠে এসে সন্ধ্যার কাছে দাঁড়িয়ে কাণ্ডটা দেখছিল। ওর গা থেকে একটা মৃদু সুঘ্রাণ আসছে। বিদেশি সেন্ট।
সন্ধ্যা একটু লাজুক মুখে বলল, এইসব নিয়েই বেঁচে আছি, বুঝলে? আমি তো লেখাপড়া শিখিনি।
সারাদিন তুমি খুব কাজ করো, না?
তাকে শেষ অবধি সোহাগ তুমি বলছে দেখে ভারী খুশি হল সন্ধ্যা। বুক থেকে যেন একটা ভার নেমে গেল। গতকাল অবধি মেয়েটাকে কী ঘেন্নাই করত। এখন বড্ড মায়া হচ্ছে। আর মায়াবশে অন্যমনস্ক ছিল বলে হাতের শিশি ভরে একটু কাসুন্দি উপচে পড়ল। হেসে সন্ধ্যা একটা ন্যাকড়ায় হাত মুছে নিয়ে বলল, হ্যাঁ। গতরে খাটুনির কাজ। আর তো কিছু জানি না।
সোহাগ খুব কৌতূহল নিয়ে ছিপি আটকানোর যন্ত্রটা দেখছিল। বলল, ওই যন্ত্রটা তো খুব মজার।
ওটা দিয়ে ছিপি আটকায়। এসব তো আধুনিক কল নয়, শস্তার জিনিস।
এ-ঘরটায় কেমন সুন্দর একটা গন্ধ!
তোমার ভাল লাগছে বুঝি? এসব হচ্ছে মশলার গন্ধ। বোসো না, গল্প করি। তোমাদের সঙ্গে তো ভাল করে আলাপই হল না। ওই মোড়াটা টেনে বোসো।
সোহাগ লক্ষ্মী মেয়ের মতো বসল।
আমলকী খেতে এলে না তো আজ!
আমলকীর একটা ল্যাটিন নাম আছে বোধহয়। জানো?
সন্ধ্যা হেসে ফেলে, না। এসব ল্যাটিন-ট্যাটিন কি আমি শিখেছি?
আমিও জানি না।
এক প্যাকেট নিয়ে গিয়ে কাছে রেখো। শুনেছি আমলকীর অনেক উপকার।
আমি কি রোজ তোমার কাজে একটু হেলপ করতে পারি?
সন্ধ্যা ফের হাসে, শোনো কথা! এসব মৈষালি কাজ, এসব কি তুমি পারো?
ওই যে তুমি একটা কাঠের জিনিসে মশলা গুঁড়ো করো ওটা আমি পারব।
না গো মেয়ে, ওসব তোমাকে করতে হবে না। তোমার মা রাগ করবে।
মা তো সব ব্যাপারেই রাগ করে। তাতে আমার কিছু যায় আসে না।
তুমি মাঝে মাঝে এসে গল্প কোরো, তাহলেই হবে।
কিন্তু আমার কিছু করতে ইচ্ছে করছে। আই ওয়ান্ট টু কিপ মাইসেলফ বিজি।
সন্ধ্যা মায়াভরে মেয়েটার দিকে একটু চেয়ে থেকে বলল, একটু একঘেয়ে তো লাগবেই। এসব গাঁগঞ্জ জায়গা তো, তাই তোমার বোধহয় ভাল লাগে না।
একটা ঝটকা মেরে মাথা নাড়া দিয়ে মেয়েটা বলে, না না, শহর আমার একদম সহ্য হয় না। আমি তো গ্রামই ভালবাসি। তার চেয়েও ভালবাসি জঙ্গল।
ও হ্যাঁ, শুনেছিলুম শহরে থাকলে তোমার নাকি শরীর খারাপ করে। কীরকম অসুখ হয় তোমার?
ওটা একটা অ্যালার্জি। পলিউশন থেকে হয়।
তা হলে তো মুশকিল। পড়াশুনো করতে তো শহরেই থাকতে হবে।
পড়াশুনো করতে আমার ভাল লাগে না।
ওমা! সে কী? শুনেছি তুমি খুব ভাল ছাত্রী!
না তো! আমি একদম ভাল ছাত্রী নই। আমার ভাল লাগে শুধু হিস্টরি আর ন্যাচারাল সায়েন্স। ক্লাসের পড়া হিসেবে নয়।
সন্ধ্যা কী বলবে ভেবে পেল না। পড়াশুনোর কথা উঠলেই সে জব্দ। তবু সে বলল, তা হলে তুমি কী করবে?
মেয়েটা কাঁধ ঝাঁকিয়ে একটা অসহায় ভঙ্গি করল। তারপর মৃদু স্বরে বলে, আমি যা করতে চাই তা তো আমাকে কেউ করতে দেয় না।
কী করতে চাও তুমি?
মৃদু একটা দুষ্টু হাসি খেলে গেল সোহাগের মুখে। তারপর বলল, বলব?
বলোই না!
আমার ইচ্ছে করে খুব গভীর জঙ্গলে গিয়ে সব পোশাক খুলে ফেলে ঘুরে বেড়াই।
এ কথা শুনে কাজের মেয়েরা খিলখিল করে হেসে উঠল।
সন্ধ্যা একটা ধমক দিল, অ্যাই চুপ। মানুষের তো কতরকম ইচ্ছেই হয়। হাসতে আছে? জানিস আমার ভাইঝি বিলেত আমেরিকা ঘুরে এসেছে?
বাণী নামে একটা মেয়ে বলল, আমারও কিন্তু অমন ইচ্ছে যায়।
তোর আবার কী ইচ্ছে?
ওই যে গো, যেখানে কেউই থাকবে না তেমন জায়গায় গিয়ে সব খুলে ফেলে রোদে হাওয়ায় এলোচুলে বসে থাকি।
সোহাগ রাগ করল না। হাসল। তারপর হঠাৎ মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। খুব মৃদু স্বরে বলল, আমার খুব হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে।
সন্ধ্যা মায়াভরে বলে, ষাট, ষাট, হারিয়ে যাবে কেন? মানুষ হারিয়ে গেলে বড় কষ্ট।
কেন, ও কথা বলছ কেন? ওয়ার্ল্ড ইজ এ বিগ প্লেস।
সন্ধ্যা একটু আনমনা হল। তারপর বলল, হারিয়ে যেতে নেই। কদিনই বা বাঁচে বলো মানুষ, তার মধ্যেই কত শোকতাপ, কত দুঃখদুর্দশা! আমার জীবন থেকেও তো একটা লোক হারিয়ে গেল বলে–
সন্ধ্যা আর বলল না। ভাইঝির কাছে হয়তো বলতে নেই।
তুমি কি তোমার হাজব্যান্ডের কথা বলছ?
সন্ধ্যা চুপ করে থাকে।
সোহাগ বলে, আই নো অ্যাবাউট ইউ। ইউ আর এ কনজুগাল ডিসকার্ড। সো হোয়াট? ইউ স্টিল হ্যাভ ইওর লাইফ।
সন্ধ্যা একটু হেসে বলে, আমি কি অত ইংরিজি বুঝি?
সোহাগ একটু লজ্জা পেয়ে বলে, সরি।
সন্ধ্যা তার এই একটু ছিটিয়াল, একটু সরল ভাইঝির দিকে চেয়ে বলে, তোমার আর কী ইচ্ছে করে?
সোহাগ একটু লজ্জার হাসি হেসে বলে, আমার বয়সের ছেলেমেয়েরা যা করে, মানে পড়াশুনো, ক্যারিয়ার, কম্পিউটার আমার একদম ভাল লাগে না। তুমিই না বললে কদিনই বা বাঁচে মানুষ! ঠিক তাই। আমাদের লনজিভিটি তো খুব বেশি নয়, এত পড়াশুনো, ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবাভাবি, কত সময় চলে যায় বলো! তা হলে বাঁচব কখন? কদিন? আয়ুর নাইনটি পারসেন্টই তো চলে যাবে বাবা!
ওমাঃ ঠিক বলেছ তো! আমারও মাঝে মাঝে মনে হয়, এত খাটাখাটনিতে কত সময় চলে যাচ্ছে, দুনিয়াটাকে টেরই পাচ্ছি না।
সোহাগ স্মিত মুখে বলে, কিন্তু তোমার কাজটা আমার বেশ ভাল লাগছে।
কেন বলো তো? একাজ আবার কীসের ভাল?
ইউ আর উইথ নেচার। ডুয়িং এ জব অফ ইওর ওন।
বাংলা করে বলো। বুঝতে পারি না যে! তোমার সব কথা আমার বুঝতে ইচ্ছে করছে।
মনে হয় তুমি তোমার কাজটাকে প্যাশোনেটলি ভালবাসো। তাই না?
সন্ধ্যা এবার এক গাল হাসে, কথাটা ভুল বলোনি। করতে করতে কাজটা এখন খারাপ লাগে না।
ওটাই তো আসল কথা। আমরা যে কাজ করতে ভালবাসি তা আমাদের করতে দেওয়া হয় না। ক্যারিয়ার আমাদের সব নষ্ট করে দেয়। নো লাভ ফর লাইফ, নাথিং।
দোতলা থেকে মোনার গলা পাওয়া যাচ্ছিল, সোহাগ! সোহাগ, আর ইউ হিয়ার সামহোয়ার? প্লিজ কাম আপস্টেয়ার্স। ডিনার ইজ রেডি।
সন্ধ্যা বলল, যাও, তোমার মা ডাকছে।
সোহাগ উঠে পড়ল, যাই পিসি৷
সন্ধ্যার কান জুড়িয়ে গেল পিসি ডাক শুনে। মনটা হালকা লাগল, খুশির বাতাস লাগল বুকটায়। পিসি বলে ডেকেছে এতদিনে। পিপাসাটা তার বুকের ভিতরে লুকিয়ে ছিল এতদিন।
নীলিমা বলল, তোমার ভাইঝিটা পাগলি আছে দিদি।
সন্ধ্যা মাথা নেড়ে বলে, ও তুই বুঝবি না। কত ভাল কথা বলে গেল। ওইটুকু তো বয়স, এক রত্তি মাথায় কত চিন্তা করেছে দেখলি! বড় ভাল মেয়ে।
.
কুক কুক করে ঘড়িতে অ্যালার্ম বাজছে। মৃদু কিন্তু খর শব্দ। এ-শব্দ গভীর ঘুমের ভিতর ঠিক ঢুকে যেতে পারে। ঘুম না ভাঙিয়ে ছাড়ে না।
আগে এসব অ্যালার্ম ছিল না। মহিমকে তার বাবা একখানা ঘড়ি কিনে দিয়েছিল, রোজ দম দিতে হত কটর কটর করে চাবি ঘুরিয়ে। তার অ্যালার্ম ছিল ঝনঝনে। সাইকেলের বেলের মতো বেজে থেমে যেত, তাতে ঘুম ভাঙলে ভাল, না ভাঙলে ঘড়ির কিছু করার নেই। আজকাল এসব কোয়ার্টজ ঘড়ির আওয়াজ অন্যরকম। কানে নয়, যেন আঁতে গিয়ে ঢুকে পড়ে।
অ্যালার্মটা বাজছে দোতলায়, মেজো বউমার ঘরে, ভোর পৌনে চারটের গভীর নিস্তব্ধতায় শব্দটা চারদিকে যেন ছুরির ফলার মতো বারবার ঢুকে যাচ্ছে।
মহিমের ঘুম ইদানীং এমনিতেই পাতলা। শেষরাতে ঘুম আরও মিহি হয়ে আসে। চারটে থেকে সাড়ে চারটের মধ্যে উঠে পড়ে সে।
আজ বুডঢা কলকাতা যাবে। বর্ধমান থেকে ভোর ছটায় একটা লোকাল আছে, সেইটে ধরবে। খবরটা মহিমের জানার কথা নয়। যাওয়াআসার স্বাধীনতা ওদের তো আছেই। জিজ্ঞাসাবাদ অনুমতি নেওয়া ইত্যাদির বালাই নেই।
কাল রাত দশটা নাগাদ হঠাৎ মোনা–অর্থাৎ মোনালিসা তার ঘরে এসে হাজির। বাবা বলে ডাকে না কখনও। কালও ডাকেনি। তবে বেশ নরম গলায় বলল, বুডঢা আজ কলকাতা থেকে এসেছে। খুব টায়ার্ড। কিন্তু কাল সকালেই ওকে কলকাতা ফিরতে হবে।
মহিম কথাটার প্যাঁচ ধরতে না পেরে তাকিয়ে ছিল। বুডঢা যে কলকাতা থেকে এসেছে, এ খবরটাও তার জানা নেই, যেমন জানা নেই বুডঢা এখান থেকে কলকাতা গিয়েছিল কবে।
মোনা বলল, মুশকিল হয়েছে ট্রেনটা খুব ভোরে। ছটায়। এখান থেকে অত ভোরে বাস বর্ধমান যায় কি না কে জানে। কিন্তু ট্রেনটা ওকে ধরতেই হবে। সকাল সাড়ে নটায় ওর কম্পিউটার ক্লাস।
মহিম তাকিয়ে ছিল। বুঝতে পারছিল, আসল কথাটা এর পর আসবে।
মোনা এবার বলল, কমলদার ছেলে রতনের তো মোটরবাইক আছে। ওকি সকালে একটু বুডঢাকে স্টেশনে পৌঁছে দিতে পারবে?
এ কথাটা মহিমকে জিজ্ঞেস করার মানেই হয় না। যার মোটরবাইক তাকে জিজ্ঞেস করলেই হত। মহিম মৃদু গলায় বলল, রতনের সঙ্গে কি বুঢডার আলাপ পরিচয় নেই?
মোনা একটু অপ্রতিভ হল কি? ফর্সা রংটা যেন একটু রাঙা হয়ে গেল। বলল, আসলে ওরা ভাইবোন তো তেমন মিশুকে নয়।
মিশুকে নয়–এ কথাটা মিথ্যে। ওরা ও-বাড়ির লোকজনকে মেশবার যোগ্য বলেই মনে করে না। কিন্তু কথাটা তো আর বউমাকে বলা যায় না। মহিম বলল, স্টেশনে পৌঁছে দেওয়াটা তো কোনও ব্যাপার নয়। নিশ্চয়ই দেবে। আমি বলে দেবোখন।
মহিম এটুকু বলেই চুপ করে গিয়েছিল।
মোনা একটু দ্বিধাগ্রস্ত ভাবে দাঁড়িয়ে থেকে বলল, কথাটা হয়তো রতনকে আমারই বলা উচিত ছিল। কিন্তু আমাদের মধ্যে তেমন রাপো তৈরি হয়নি বলে বলতে সংকোচ হচ্ছে।
একটু হাসল মহিম। বলল, সংকোচের কোনও কারণই ছিল না। আপনজনই তো। বললেই পারতে। ওরা তাতে খুশিই হত।
মোনা বলল, আপনি বললে বলব। তবে রতন তো বাড়িতে থাকেই না, অনেক রাতে ফেরে শুনেছি। কমলদাকে বলতে পারতাম, কিন্তু তিনি আজ কোথায় যেন গেছেন, রাতে ফিরবেন না।
ওঃ, ঠিক আছে, রতনকে আমি বলে দেব।
মোনা চলে যাওয়ার পর মহিম রায় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। টানা প্রায় পনেরো-ষোলো দিন এখানে আছে, তবু কেন যে পর্দাটা এখনও টেনে রেখেছে, কোথায় বাধছে, কোথায় বাধক হচ্ছে তা বোঝা যাচ্ছে না। মেজো বউমার সঙ্গে ভাসুর কমলের একটু আলাপ আছে বটে, কিন্তু সম্পর্কটা ফাইফরমাশের। মহিমের ছেলেদের মধ্যে কমলই একটু ব্যক্তিত্বহীন এবং ভালমানুষ। আত্মসম্মানের বালাইও নেই তেমন। উপযাচক হয়ে সে-ই ওদের খোঁজখবর নেয়, গায়ে পড়ে কাজ করে দেয়। আর কেউ ওদের ছায়াও মাড়ায় না।
মহিম খুব ভোরেই ওঠে। পরশুদিনও উঠে প্রাতঃকৃত্য সেরে ঠাকুরপুজোর ফুল তুলতে বাইরে বেরিয়েছিল। বেশি দূর যেতে হয় না, ঘরের পিছনেই বাগান। সকালে তখনও অন্ধকার ঝুলে আছে চারদিকে, কুয়াশা আছে, ঠান্ডা ভাবও আছে, একটু পাতলা আলোর আভাসও আছে, কাক ডাকছিল, দূরে একটা মোরগও ডেকে উঠল। রোজকার মতোই ভোর। নতুন কিছু নয়।
বাগানে বেশি দূর ঢুকতেও হয় না, সামনেই শিউলি ফুলের ঝুপসি গাছ। নীচে অজস্র ফুল পড়ে থাকে ভোরবেলা। সেগুলো পুজোয় লাগে না। বোঁটা-খসা ফুল অনেক আটকে থাকে পাতায় আর ডালপালায়। ফুল তুলতে গিয়ে আচমকা তার চোখ গিয়ে পড়ল বাগানের মাঝখানে। কেন যে তার চোখই পড়ল। সাদাটে ঢিলা পোশাক-পরা স্থির মূর্তিটা দেখে আঁতকে ওঠবারই কথা তার। কিন্তু পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল বলে একটু চমকাল মাত্র।
কে ওখানে? সোহাগ নাকি?
না আজ মেয়েটা সেদিনের মতো আচ্ছন্ন নেই। মহিমের সাড়া পেয়ে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল।
দাদু!
ভারী অবাক হল মহিম। এর আগে কখনও দাদু বলে ডেকেছে কি না মনে পড়ল না। ডাকটা শুনেই তাই ভাল লাগল।
তুমি ওখানে কী করছ ভাই?
সোহাগ এগিয়ে এল কাছে, তুমি রোজ ভোরে ওঠো বুঝি?
মহিম বলে, হ্যাঁ। ওখানে কী করছিলে?
এমনি দাঁড়িয়েছিলাম। ট্রায়িং টু ফিল দি ওয়ার্ল্ড।
তোমার পায়ে জুতো বা চটি নেই কেন দিদিভাই?
চটি পরলে আই ক্যান্ট ফিল দি আর্থ।
কিন্তু কাঁটা ফুটতে পারে তো!
ফুটলেই বা!
আর শুঁয়োপোকা, সাপ এসবও তো থাকতে পারে।
আমার একটুও ভয় করে না।
মহিম স্নেহভরে বলে, তোমার গাছপালা ভাল লাগে বুঝি?
ভীষণ। মাঝে মাঝে ভাবি, ইস আমি যে কেন গাছ হয়ে জন্মালাম না।
ঠান্ডা লাগবে দিদিভাই, গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে এসো গিয়ে।
একদিন তো মানুষের কোনও পোশাক ছিল না। তখন কীভাবে থাকত মানুষ?
মহিম একটু থতমত খেয়ে বলে, সেসব তো আদ্যিকালের কথা দিদিভাই। তখন মানুষের ইমিউনিটি ছিল।
এখন নেই?
না, মানুষের অভ্যাস পালটে গেছে।
পোশাক একটা বাধা।
মহিম বড্ড অবাকের পর অবাক হচ্ছে, মেয়েটার কি একটু মাথার দোষ আছে?
দিক বসন কাকে বলে জানো দাদু?
হ্যাঁ, দিক বসন মানে আবরণহীন। দিকই যার বসন।
আমি জানি। কথাটা খুব সুন্দর, না?
ওসব ঠাকুর-দেবতার ব্যাপার দিদিভাই। মানুষের ক্ষেত্রে খাটে না।
ইট হ্যাজ এ মেসেজ, এ মেসেজ ফর হিউম্যানিটি।
মহিম প্রমাদ গুনছিল। বিদেশে নুডিস্ট কলোনি আছে বলে শুনেছে সে। মেয়ে-পুরুষ ন্যাংটা হয়ে ঘুরে বেড়ায়। পাগলের কাণ্ড সব। এ মেয়েটা তাদের খপ্পড়ে পড়েনি তো রে বাবা! বিদেশে যে কত কুশিক্ষাই আছে!
মেয়েটা কি তার মনের কথা শুনতে পেল? স্বগতোক্তির মতো করে বলল, তা বলে আমি নুডিস্ট নই, দে আর এ স্যাড অ্যান্ড পারভারটেড লট। আমার শুধু মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে চারদিকটাকে সমস্ত শরীর দিয়ে শুষে নিতে।
একটু পাগুলে ব্যাপার আছে মেয়েটার। মহিম বলল, এ নিয়ে তোমার সঙ্গে একদিন কথা বলব। এখন শিশির পড়ে তোমার ঠান্ডা লেগে যাবে।
আমি ইমিউন হওয়ার চেষ্টা করছি।
ওসব কি সইবে তোমার? শুনেছি তোমার একটা অ্যালার্জি আছে।
হ্যাঁ, কিন্তু গাছপালার মধ্যে আমি তো ভাল থাকি।
গাছপালা তো ভালই, কিন্তু বিপদের কথাও খেয়াল রাখতে হয়, এটা ঋতু পরিবর্তনের সময়।
তুমি একজন খুব কারেজিয়াস লোক!
মহিম তটস্থ হয়ে বলে, আমি! কে বলল তোমাকে? না দিদিভাই, আমি একটা ভিতু লোক।
তুমি সেদিন আমাকে কাঁধে করে অনেক দূর থেকে নিয়ে এসেছিলে। অ্যান্ড ইউ আর অ্যান অকটোজেনেরিয়ান।
বিপদে পড়লে মানুষ বাঁচার তাগিদে অনেক কিছু করে। কিন্তু দিদিভাই, তোমার যে বড্ড সাহস! একা একা ওভাবে ঘুরে বেড়াও কেন?
মেয়েটা হাত উলটে বলে, জানি না।
তুমি একটা ঘোরের মধ্যে ছিলে।
মেয়েটা মাথা নেড়ে বলে, সামটাইমস ইট হ্যাপেন।
তুমি কি রোজ এত ভোরে ওঠো?
না, কখনও কখনও আমি বেলা আটটা-নটাতেও উঠি, কিছু ঠিক নেই। মাঝে মাঝে রাতে আমার ঘুম আসে না।
এই বয়সে ঘুম আসে না কেন?
ভাবতে ভাবতে মাথা গরম হয়ে যায়।
কী ভাবো তুমি?
মাই রিলেশন উইথ দিস ভাস্ট ইনফাইনিট ইউনিভার্স। আরও কত কী, ভাবতে ভাবতে আমি উঠে বসে থাকি, তারপর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ি।
কিন্তু তাতে যে বিপদ হতে পারে।
হিহি করে একটু হাসল সোহাগ, সেই হাসিতে ওর শৈশব ফুটে উঠল যেন। বলল, কাল রাত দুটো-আড়াইটার সময় আমি উঠে নীচে নেমে আসি। তারপর হেঁটে হেঁটে কোথায় কোথায় যে চলে গেলাম।
সর্বনাশ!
কিন্তু কিছু বিপদ হয়নি তো, আমার সঙ্গে তোমাদের ওই কালো কুকুরটা ছিল।
কতদূর গিয়েছিলে?
অনেক দূর, আমি তো এ-জায়গাটা ভাল চিনি না, জঙ্গল-টঙ্গল মাঠঘাট দিয়ে অনেক হেঁটে তারপর একটা হাইরোডে উঠে দেখলাম, ট্রাক যাচ্ছে, তখন ফিরে আসি।
কী করে ফিরলে?
কুকুরটাই পথ দেখিয়ে নিয়ে এল, যখন এসে কোর্ট ইয়ার্ডে ঢুকছি তখন–ওই যে ওই ঘরে যিনি থাকেন–উনি কে বলো তো! জেঠিমা না?
হ্যাঁ, উনি তোমার জেঠিমা।
উনি হঠাৎ ভয় পেয়ে চোর, চোর বলে কাকে যেন ডাকছিলেন। আমি তখন জানালার কাছে গিয়ে বললাম, আমি চোর নই, আমি সোহাগ। উনি খুব অবাক হয়ে গেলেন। তারপর বললেন, মাঝরাতে একা মেয়েছেলে এলোচুলে ঘুরছ যে বড়! হাওয়া বাতাস লাগবে যে! ঘরে যাও।
উনি ঠিকই বলেছেন।
হাওয়া বাতাস লাগার কথাটা আমি বুঝতে পারিনি। তুমি জানো?
অস্বস্তিতে পড়ে মহিম বলে, উনি বোধহয় ভূতপ্রেতের কথাই বলতে চেয়েছেন। গাঁয়েগঞ্জে তো অনেক সংস্কার থাকে।
সংস্কার মিনস সুপারস্টিশনস?
হ্যাঁ, এসব জায়গায় মানুষকে মাঝে মাঝে নাকি ভূতে পায়। ওসব বিশ্বাসযোগ্য নয়।
কিন্তু আই বিলিভ ইন গোস্টস।
মহিম একটু হাসল। বলল, কেন বিশ্বাস করো?
আই ফিল দেম। আই ইভন সি দেম।
মহিম অবাক হয়ে বলে, কী দেখেছ তুমি?
আমার মনে হয় লক্ষ লক্ষ বছর ধরে যেসব মানুষ মরে গেছে তাদের প্রত্যেকের একটা করে ইমপ্রেশন রয়ে গেছে অ্যাটমোসফিয়ারে। আই সি দেয়ার শ্যাডোজ, আই ফিল দেয়ার প্রেজেন্স।
সেটা কীরকম দিদিভাই, বুঝিয়ে বলো।
তারা তো আমাদের মতো নয়, তারা কেউ নেইও। কিন্তু তাদের ইমপ্রেশন, তাদের অনেক কথাবার্তা, অনেক সময় তাদের শ্বাসপ্রশ্বাসও টের পাই এবং মাল্টিচুডস অব দেম।
তুমি যে আমাকে চিন্তায় ফেললে দিদি। তোমার এরকম হয় কেন?
আমি তা জানি না। আমার বন্ধুরা কেউ ভূতে বিশ্বাস করে না, তারা শুনলে অবাক হয়। বলে অল বোগাস।
হয়তো তুমি খুব ভালো বলেই ওসব কল্পনা মাথায় আসে।
মে বি৷ আই হ্যাভ এ ভেরি স্ট্রং ইমাজিনেশন। কিন্তু আমার মনে হয় আমি ভুল দেখি না। ভূতকে অনেকে ভয় পায়। আমার একটুও ভয় করে না, আমার মনে হয় দে আর মাই ফ্রেন্ডস, মাই বেস্ট ফ্রেন্ডস।
চিন্তিত ও শঙ্কিত মহিম রায় ভোরের আবছা আলোয় তার এই প্রায় অচেনা নাতনিটির মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলল, তুমি মাঝে মাঝে আমার কাছে এসো। আমি তোমার কথাগুলো আরও একটু বুঝতে চেষ্টা করব।
কিন্তু বিশ্বাস করবে না তো? আমার কথা কেউ বিশ্বাস করতে চায় না।
মহিম একটু হাসল, পৃথিবীতে কত রহস্যই যে আছে, সব কি উড়িয়ে দেওয়া যায়? না দিদি, আমি তোমার কথাগুলো নিয়ে ভাবব। হয়তো বিশ্বাসও করব, কে জানে! এই বুড়ো বয়সে খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় যে মানুষ মরে গেলেও একেবারে শেষ হয়ে যায় না। তার কিছু একটু থেকে যায়।
এসব কাল ভোররাতের কথা। আজ এই ভোররাতে বিছানায় মশারির মধ্যে বসে অ্যালার্ম ঘড়ির শব্দ শুনতে শুনতে কত ভাবনাই যে সিনেমার ছবির মতো মাথার ভিতরে ভেসে ভেসে যায়। মাঝে মাঝে যতিচিহ্নের মতো মৃত্যুর কথাও মনে পড়ে।
অচেনা অমল এবং ততোধিক অচেনা অমলের বউ, ছেলে, মেয়ে এদের সঙ্গে তার একটা সেতুবন্ধন হল কি? সেতুটি ওই ছিটিয়াল, বায়ুগ্রস্ত, চঞ্চলমতি সোহাগ। ঠিক বুঝতে পারছে না মহিম, সেতুবন্ধনটি টিকে থাকবে কিনা।
মশারি তুলে পাকাপাকি উঠে পড়ল মহিম। প্রাতঃকৃত্য, বাসি ছাড়া, ঠাকুরঘর সারা, ফুলহোলা, পুজোয় বসা।
তার মাঝখানেই নিস্তব্ধ ভোরে বজ্রাঘাতের মতো রতনের মোটরবাইক গর্জে উঠল। পাঁচটা বাজে। বুডঢাকে অবশেষে স্টেশনে পৌঁছে দিচ্ছে রতন, দুর্গা, দুর্গা।
রতন আর তার মোটরবাইক যেন দুটো জিনিস নয়। একটাই। যেন মোটরবাইকে করেই জন্মেছিল রতন। দিনরাত সে ওটায় চড়ে ঘুরছে, মোটরবাইক ছাড়া রতনকে আজকাল ভাবাই যায় না, মাঝে মাঝে বলে, যখন মোটরবাইকে চড়ে থাকি তখন নিজেকে আমার চে গুয়েভারা, ফিদেল কাস্ত্রো, জোসেফ স্তালিন, মাওসেতুং কত কী মনে হয়, মনে হয় আমি একজন লিডার, একজন পায়োনিয়ার।
কিন্তু ওরা কি মোটরবাইকে চড়তেন?
তা কে জানে। মোটরবাইকে চড়লে আমি ওরকম কেউ হয়ে যাই।
বন্ধুরা বলে ভটভটিয়া রতন। মোটরবাইকই ওর হাত পা মগজ। কাউকে জরুরি খবর দিতে চাও, অসময়ে হঠাৎ কিছু আনতে চাও বাজার থেকে, কাউকে কোথাও পৌঁছে দিতে চাও, রতন সঙ্গে সঙ্গে রাজি, মোটরবাইকে যতই তাকে দৌড় করানো হোক তার ক্লান্তি নেই।
মহিম রায় উঠোনের একধারে পাতা কাঠের চেয়ারে এসে বসল, বাঁ ধারে বাঁশবনের ফাঁকফোঁকর দিয়ে অন্ধকারকে ঝাঁঝরা করে দিয়ে আলো আসছে।
আরও একটা দিন। আরও এক পা এগিয়ে যাওয়া।
.
০৮.
আশি চুটকি, নব্বে তাল তব জানিয়ো খইনিকে হাল। খইনি মজানো কি সোজা কথা রে বাপু? দু চারবার ডলেই ঠোঁটে ফেলে দিলেই হল? ও হল চাষাড়ে জিনিস, ধকের চোটে ব্রহ্মরন্ধ্র পর্যন্ত চমকে ওঠে। খইনির গভীরে যে প্রাণরস আছে তাকে টেনে বের করা চাই তো। সেই মোলায়েম নেশা শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে চনমনে করে তোলে মানুষকে। হ্যাঁ, তবে তার জন্য ধৈর্য চাই। পরিমাণমতো চুনটুকু দিয়ে মশলা, মলো, মলো। ফিন তালি লাগাও। চুণা উড়েগা, ধূল উড়েগা। ফিন মলো, মলো, মলো। ফিন তালি লাগাও–হাঁ। আশি চুটকি, নব্বে তাল, তব জানিও খইনিকে হাল…
উত্তরের দাওয়ায় বসে খইনিটাকে মজিয়ে ফেলেছে প্রায় বাঙালি। বাঙালি রাম কাহার। পাশে বিস্কুটের কাঁচ লাগানো টিন। দাওয়ার নীচে ছাড়া মোটা চামড়ার ধুলিধূসর একজোড়া শস্তা জুতো। বাঙালির পরনে হেঁটো জনতা ধুতি, গায়ে মোটা কাপড়ের পিরান। মাথা ন্যাড়া, মস্ত টিকি, খইনি ডলতে ডলতে তার চোখ এখন ভাবালু।
হাত চারেক তফাতে উঠোনে উবু হয়ে বসে আছে গোকুল আর বাসু। তারা মুখ চোবলাচ্ছে, জিব রসস্থ, ভারী উন্মুখ হয়ে চেয়ে আছে বাঙালির দিকে। ব্যাটা খইনিটা বানায় বড় ভাল। মিহি, মোলায়েম, খুব সোয়াদ। তবে বড় সময় নেয়। গোকুলের কাজ বেশির ভাগই গোয়ালঘরে। তিনটে গোরুকে মাঠে খোঁটায় বেঁধে এসে গোয়াল পরিষ্কার করেছে এতক্ষণ। এই একটু হাঁফ ছাড়ার সময়। বাসু বাগান সামলায়। নিড়েন দিতে দিতে উঠে এসেছে বাঙালিকে দেখে। দুজনেই কিছু উশখুশ। কিন্তু বাঙালিকে হুড়ো দিয়ে লাভ নেই। তার মনের মতো না হওয়া ইস্তক সে খইনির ভাগা দেবে না।
রুখু চুলের খোঁপায় আজ একটা কলাবতী ফুল গুঁজেছিল দুখুরি। হাঁসের ঘর থেকে বারোটা ডিম বের করল। আজ তার মনে একটু আনন্দ ছিল সকাল থেকেই। মেলা লোক আসবে আজ। দুই দিদিমনি, দুই দাদাবাবু, তাদের বরেরা, বউয়েরা, ছেলেমেয়েরা। আজ খুব হই-চই লেগে যাবে বাড়িতে। দুখুরি তাই ঘরদোর পরিষ্কার ন্যাকড়া দিয়ে মুছছিল। টেবিল, চেয়ার, তাক, জানালার গরাদ, দরজার পাল্লা। ওই জানালা দিয়েই সে তার বাপকে দেখেছিল একটু আগে। অমনি মনটা খারাপ হয়ে গেল। ওই যে এসেছে তার যম।
গিন্নিমার ঘরে ঢুকেই দুখুরি কাঁদুনে গলায় বলল, ওই আবার এসেছে গো, দ্যাখো গে।
বলাকা চট্টোপাধ্যায়ের বয়স এখন বাহাত্তর চলছে। শরীরে এখনও মেদের সঞ্চার নেই। সাদা থানে গৌরবর্ণা বলাকাকে অনেক সময়ে মানবী বলে মনে হয় না। শোকের একটা গাম্ভীর্য তাকে আরও একটু অবাস্তব দূরত্বে নিয়ে গেছে। ছেলেমেয়েরা কেউ কাছে নেই। একা বাড়ি আগলে তার পড়ে থাকা। এই দুখুরি, রাঁধুনি বামনি, কাজের মেয়েরা, মুনিশ, দু-চারটে কাজের লোক, পাড়া-প্রতিবেশী, জ্ঞাতিরা, কিছু স্মৃতি, কিছু চিহ্ন আর বস্তুপুঞ্জ নিয়ে তার বাস। এই আগলে থাকা ভাল লাগে না বলাকার। একটা মানুষ যতদিন ছিল ততদিন সেই মানুষটার জন্যই এত ফাঁকা লাগত না কখনও। তার স্বামী গৌরহরি চট্টোপাধ্যায় মেজাজি, প্রতাপশালী, খেয়ালি এক মানুষ। তবু সারা জীবন বলাকার কাছে ওই মানুষটাই ছিল যেন সবচেয়ে বেশি। ওই মানুষটাকে ছাড়া যে বেঁচে আছে বলাকা তাতেই সে ভারী অবাক হয়ে যায়। ওকে ছাড়া একটা দিনও কাটবে বলে কখনও ভাবেনি। অথচ অবাক কাণ্ড, এখনও বলাকা বেঁচেই আছে দিব্যি।
ঝন্টু আর মন্টু তাকে নিজেদের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য টানাটানি করে। বকুল, পারুল, জামাইরা সবাই তাকে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু কোথাও যেতে ইচ্ছেই হয় না তার। মানুষটা নেই, কিন্তু তার শ্বাসপ্রশ্বাসটুকু যেন এখনও আছে।
স্টিলের আলমারি খুলে আজ শাড়ির ডাঁই বের করে মেঝেয় পাতা মাদুরে জড়ো করেছে বলাকা। কমলা আর কালী সাজিয়ে রাখছে থাকে থাকে। কত শাড়ি তার। গৌরহরি কোনও বড় মামলায় জিতলেই একটা শাড়ি বা গয়না আনত। এইভাবে জমেছে মেলা, অনেকগুলো তো পরাই হয়নি আজ অবধি। বলাকা গুণে দেখেছে বেনারসিই আঠারোখানা, পিওর সিল্ক অন্তত পঞ্চাশটা, গরদ কম করেও বারোটা, তাঁত আর সিন্থেটিকের হিসেব নেই।
দুই মেয়ে আর দুই বউমাকে এ সবই আজ ভাগ করে দেবে বলাকা। কোনটা কাকে সেই নিয়েই কথা হচ্ছে। কমলা পুরনো লোক, তার টান বেশি বকুল আর পারুলের ওপর। ভাল শাড়িগুলো সে ওদের ভাগে ফেলতে চাইছিল। বলাকা বলল, তাই কি হয়? বউমারা কী ভাববে তা হলে?
বলাকা আবার একথাও ভাবে, ওদের কারও তো কম নেই। এসব পুরনো শাড়ি-টাড়ি পেয়ে খুশি হবে তো? নাকি মনে মনে নাক সিঁটকোবে?
একখানা ডুরে শাড়ি বেরোল এক ডাঁই শাড়ির তলা থেকে। সাদা খোলের ওপর টানা লাল সবুজ নীল ডুরে। তেমন কোনও বাহারি শাড়িও নয় এবং বহরে একটু খাটো। শাড়িটা এত পুরনো যে সাদা রংটা হলদেটে হয়ে গেছে। তেমন মজবুতও নেই আর, টানাহ্যাঁচড়া করলে ফেঁসে যাবে। শাড়িটা কোলে নিয়ে একটু বসে রইল বলাকা। চোখে জল আসি-আসি করে যে!
দশ সাড়ে দশ বছর বয়সে বিয়ে হল পরিপূর্ণ যুবক গৌরহরির সঙ্গে। বলাকা তখন মেয়েমানুষই হয়ে ওঠেনি ভাল করে। ভয়ে আধমরা। আর বরটি এত ছোট্ট একটা বউ পেয়ে মোটেই খুব স্বস্তিতে ছিল না। নাক সিঁটকে বলত, এ বাবা এর তো এখনও নাক টিপলে দুধ বেরোয়! গৌরহরি তাকে তার বউ বলেই ভাবতে পারত না। স্বামীর বিছানাতেই শুত বটে সে, কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর মতো নয়। ঘুমের মধ্যে হাত-পা ছোঁড়ার অভ্যেস ছিল তার, গৌরহরি তাই খ্যাপাত, ঘুমের ভান করে তো দিব্যি লাথি ঘুষি চালাও দেখছি! ভীষণ লজ্জা পেত বলাকা। তেরো বছর বয়স অবধি ওরকমই চলেছিল। প্রাপ্তবয়স্ক এক পুরুষের পাশে একটি নাবালিকাই মাত্র ছিল সে। তেরো বছর বয়সে একবার টাইফয়েড হয়ে বলাকার যায়-যায় অবস্থা। তখন গৌরহরি তাকে বেডপ্যান দিত, জামাকাপড় পালটে দিত। লজ্জায় আজও মরে যায় বলাকা। কিন্তু গৌরহরি তখনও তাকে তো মেয়েমানুষ হিসেবে দেখতেই শুরু করেনি। বিয়ের পর চার বছরের মাথায় একদিন গৌরহরি একটা মামলার কাজে কলকাতা যাচ্ছে। সেই রাতে তার ফেরার কথা নয়। কিন্তু হঠাৎ বলাকা তাকে বলে বসল, আজ ফিরবে কিন্তু, আজ আমাদের বিয়ের তারিখ। গৌরহরি অবাক হয়ে বলল, তাই নাকি?
তখন বৈশাখ মাসের শেষ। দুদিন পরই সংক্রান্তি। সেই দিন সন্ধের পর এক ক্ষ্যাপা মহিষের মতো মেঘ উঠল আকাশে। সেই সঙ্গে এক অতিকায় কালবোশেখী। জীবনে ওরকম ভয়ংকর ঝড় বলাকা আর দেখেনি। চারদিকে যেন মধ্যরাতের অন্ধকার ঘনিয়ে উঠল, আর পাগলা মোষের মতোই ছুটে এল ঝড়। উপড়ে পড়তে লাগল গাছ, উড়ে গেল আশপাশের চালের টিন। গোরু, কুকুর, হাঁসমুরগিদের যে কী প্রাণান্তকর আর্তনাদ! আর সেই সঙ্গে শাঁখের শব্দ, মানুষের চেঁচামেচি। সেই প্রচণ্ড ঝড় আর বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট গেল ভেসে, গাছ উপড়ে পড়ে চলাচল বন্ধ।
খুব ভাবছিল বলাকা। জানালায় দাঁড়িয়ে কেঁদেছিল অঝোরে। এই ঝড়ের দিনে সে লোকটাকে ফিরতে বলে দিয়েছে, যদি ফেরে তা হলে কোন অপঘাত ঘটে তার ঠিক কী?
ভয়টা অমূলক ছিল না তার। বউয়ের কথার দাম রাখতে প্রবল ঝড়ের সূচনা দেখেও গৌরহরি হাওড়ায় এসে ট্রেন ধরেছিল। বর্ধমান পৌঁছতে সময় লেগেছিল অনেক। তারপর ওই ডাকাবুকো মানুষটা সেই ঝড়-বৃষ্টি-বজ্রাঘাত মাথায় করে হেঁটে অতিক্রম করেছিল গোটা পথ। চারবার আছাড় খেয়ে, ভিজে, জলকাদা মেখে যখন বাড়ি পৌঁছেছিল তখন ভোর চারটে। ঘুমকাতুরে বলাকা সেই রাতে ঘুমোতেই পারেনি। দু চোখ সটান মেলে শুয়ে শুয়ে শুধু ঠাকুর-দেবতাকে ডেকেছে। গৌরহরি উঠোনে পা দিতেই কী করে যেন সে-ই টের পেয়েছিল তার মানুষটা এসেছে। কড়া নাড়ার আগেই দরজা খুলে দিয়ে সে ডুকরে কেঁদে উঠেছিল, তুমি এসেছ?
গৌরহরি খুব অবাক। একটু হেসে বলল, কী করে টের পেলে?
অভিমানভরে বলাকা বলেছিল, আমি পাবো না তো কে টের পাবে?
গৌরহরির মুখটা হ্যারিকেনের আলোতেও উদ্ভাসিত দেখাচ্ছিল। পোর্টম্যান্টো খুলে শাড়ির প্যাকেটটা বের করে তার হাতে দিয়ে বলল, ইংরিজি মতে বিয়ের তারিখ পার হয়ে গেছে। কিন্তু দিশি মতে এখনও পেরোয়নি। শাড়িটা পরো।
এই শাড়ির দাম কে দেবে? কে জানবে এ-শাড়ির প্রতিটি সুতোয় কত ভালবাসা জড়িয়ে আছে! সেই প্রথম গৌরহরি তাকে মেয়েমানুষের দাম দিল। হয়তো সেদিনই তাকে প্রথম বউ বলে মনে হল তার।
চোখের জল মুছে শাড়িটা কমলার হাতে দিয়ে বলল, এটা আলমারিতে তুলে রাখ।
কালী বলল, কেন যে তুমি থান পরো তা বুঝি না। আজকাল বিধবারা অত মানে না তোমার মতো। সাদা খোলের শাড়ি পরলেই তো হয়।
বলাকা জবাব দিল না। বড় দেওরের ছেলে বিজুটা বড্ড ফচকে। সেদিন এসে বলল, ও বড়মা, থানটা কি বিধবাদের জার্সি নাকি? তুমি কি জানো যে, থান পরলে তোমাকে পাথরপ্রতিমা বলে মনে হয়?
আজকাল বিধবারা অম্বুবাচী করে না, কেউ কেউ মাছমাংসও খায় এসবও বলছিল বিজু। বলাকা হেসে বলল, আর বলিসনি রে ছেলে। বিধবারা তো বিয়েও করছে। আমরা সেকেলে লোক, আমাদের ছেড়ে দে বাবা, আর একেলে করে তুলবার চেষ্টা করিসনি।
না বড়মা, তোমাকে আর মানুষ করা গেল না। তবে থাকো তুমি দেবী-টেবী হয়ে।
পুরনো শাড়িগুলোর প্রত্যেকটার গায়েই একটা করে গল্প আর ঘটনা জড়িয়ে আছে। আছে দীর্ঘশ্বাসও। কয়েকটা বেছে আলমারিতে তুলে রাখল বলাকা। কোনওদিন পরবে না আর, শুধু মাঝে মাঝে নেড়ে-চেড়ে দেখবে।
ও মা! কথা কানে যাচ্ছে না তোমার?
চোখ তুলে দুখুরিকে দেখে বলাকা বলে, কী হয়েছে?
বলছি না, বাবা এসেছে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ গো, উঠোনে বসে খইনি ডলছে।
তাতে কী হল?
ফের বিয়ের কথা বলবে যে! আজ খুব বকে দাও তো!
বিয়ের কথা বলবে কী করে বুঝলি?
খুব জানি। আমাকে বেচে দোকান আর মোষ কিনবে।
ব্যাপারটা সবাই জানে। তবু কমলা আর কালী খুব হাসছিল। বলাকা হাসল না, দুখুরির বয়স এখন দশ-এগারো, ঠিক যে বয়সে তার নিজের বিয়ে হয়েছিল। দেহাতে এখনও এই বয়সেই মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়। পরে গাওনা হয়। কিন্তু মুশকিল হল, দুখুরি তার বাপের মতো দেহাতের মানুষ নয়। পাঁচ ছয় বছর বয়সে তার মা মারা যাওয়ার পর বাঙালি রাম কাহার মেয়েটাকে বলাকার কাছে গচ্ছিত করে দিয়ে নিজে আর একটা বিয়ে করে। গত পাঁচ ছয় বছরে দুখুরির গায়ে অন্য হাওয়া লেগেছে। সে এখন লেখাপড়া করে, ইস্কুলে যায়, চারদিকটা দেখে এবং বুঝতেও পারে, দেহাতি নিয়ম চাপালে চলবে কেন?
কিন্তু বাঙালিরও কিছু বক্তব্য আছে। মাত্র হাজার খানেক টাকা হলে সে ননী পালের দোকানঘরটা নিতে পারে। আরও হাজার দুয়েক পেলে একটা বাচ্চা মাদী মোষ কিনবার জো হয় তার। শুধু বেকারির দিশি বিস্কুট বেচে অত বাড়তি টাকা ফেলবার উপায় নেই। কিন্তু দুখুরির বিয়ে দিলে দু-আড়াই হাজার তার হাতে আসে। পাত্রও প্রস্তুত। বর্ধমানের পান-বিড়িওলা লছমন দাসের ছোট ছেলে রণবীর। কথা হয়ে আছে। তাই কিছুকাল যাবৎ ঘুরঘুর করছে বাঙালি। মেয়েকে নিজের অধিকারবলে টেনে নিয়ে যাবে তেমন তাকত নেই তার। চাটুজ্যেদের প্রতিপত্তির কথা সে জানে। সহিষ্ণুতা এবং বিনয়বচন আর কাকুতিমিনতি ছাড়া তার অন্য পথ নেই। দুনিয়া যে অনেক এগিয়ে গেছে, মেয়েদের যে আর ধরে বেঁধে বিয়ের ফাঁস পরানো যায় না এসব খবর সে রাখে না। সে শুধু সাদাসাপটা হিসেবটা বোঝে, মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলে তার দোকানঘর আর একটা মোষ হয়ে যায়। আর এটা হলে তার অনেক দিনের স্বপ্নটাও সার্থক হয়।
বলাকা বলল, অত ভয় পাস কেন? আমি তো আছি। বাঙালিকে তো বলেছি তোর বিয়ে আমি দেবো।
তবে কেন ঘুরে ঘুরে আসে বলো তো! আজ ভাল করে বকে দিও।
তোকে অত ভাবতে হবে না, ভাল করে ঘরদোর ডাস্টিং কর।
দুখুরি চলে গেলে মায়াভরে দরজাটার দিকে চেয়ে থাকে বলাকা। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়, বাঙালিকে তিন হাজার টাকা দিয়ে দুখুরিকে রেখেই দেয়। কিন্তু একজন উঁদে উকিলের ঘর করে বলাকার কিছু বাস্তববুদ্ধি হয়েছে। সে জানে টাকা নিয়ে আপাতত মহানন্দে চলে যাবে বটে বাঙালি, কিন্তু কিছুদিন বাদে ফের টাকায় টান পড়লে এসে হাজির হবে। ফের ঘ্যান ঘ্যান করবে। এ এক জ্বালা!
দুখুরি যে খুব কাজের মেয়ে তা নয়, ফাঁক পেলেই খেলতে লাগে। ঘুমোনোর নেশা আছে। কাজের জন্য নয়, দুখুরি বলাকার একটা সম্বল। ফাঁকা বাড়িতে ও সারাদিন কাছেপিঠে থাকে, ডাকলে সাড়া দেয়। কত কথা কয় বসে বসে। বলাকার এখন জনের অভাব।
তা বলে কি বাঙালিকে দুর দুর করে তাড়িয়ে দিতে পারে বলাকা? পারে না, কারণ যত দূরের মানুষ হোক, বাঙালির তো পিতৃত্বের একটা অধিকার আছেই।
খইনিটা মজে এসেছে। শেষ কয়েকটা তালি লাগিয়ে আর একটু ডলে বাসু আর গোকুলকে ভাগা দিয়ে নিজেরটুকু ঠোঁটে ফেলল বাঙালি। হ্যাঁ, জমেছে। মুখে দিতেই মনটা যেন খুশ হয়ে গেল।
গোকুল বলল, ও বাঙালি, উঠোনে থুথু ছিটোস না যেন। মা দেখলে আস্ত রাখবে না।
আরে নেহি বাবা, উঠানমে কৌন থুক ফেলবে?
দোতলা থেকে বলাকাকে নামতে দেখে গোকুল আর বাসু পালাল।
কী রে বাঙালি, কিছু বলবি?
বাঙালি শশব্যস্তে উঠে হাতজোড় করে রাম রাম দিয়ে এক গাল হাসল, তবিয়ত ঠিক আছে তো মাতাজি?
আছি একরকম বাবা। তা তোর কী খবর? বিয়ে পাকা করে এলি নাকি?
ভারী লজ্জা পেয়ে মাথা নত করে বাঙালি বলে, ঠিকঠাক তো সব আছে। আমি বলেছি কী, শাদি এখুন হোবে, গাওনা দশ বরষ বাদ।
দশ বছর বাদে দুখুরি যে কলেজে পড়বে সে খেয়াল আছে তোর? পাত্র তো লেখাপড়াই জানে না ভাল করে।
হাঁ হাঁ, কেন জানবে না, উ ভি ইস্কুলে পড়ছে। পাস ভি দিবে।
ও তোর বানানো কথা। বিয়ে দিবি দেশওয়ালির সঙ্গে, দুখুরি তো দেহাতি ভাষা বলতেই পারে না।
তো কী আছে মাতাজি? বাংলা বলবে। রণবীর ভি বাংলা বলতে পারে।
তোকে তো বলেছি, দুখুরিকে আমায় দিয়ে দে। ওর ভাবনা তোকে ভাবতে হবে না। বিয়েও আমিই দেবো। কথাটা কেন পছন্দ হচ্ছে না তোর?
উ বাত তো ঠিক আছে মাতাজি। লেকিন ননীবাবুর দুকানটা শম্ভুবাবু লিয়ে লিবে। ভৈঁষওয়ালা ভি বলছে আর দেরি হলে মুশকিল।
আঠারো বছর বয়সের আগে মেয়ের বিয়ে দিলে জেল খাটতে হয় তা জানিস?
যেন খুব একটা হাসির কথা হয়েছে, এমনভাবেই হাসল বাঙালি, হাঁ, উ তো বাবুলোগদের জন্য আছে। মুলুকমে উরকম শাদি হরবখত হচ্ছে।
তা জানি বাবা। তোরা আইনকানুন একটুও মানিস না। কিন্তু মেয়ে যদি থানায় যায় তা হলে বিপদে পড়বি। দুখুরির একটুও মত নেই বিয়েতে।
ভারী অবিশ্বাসের সঙ্গে চেয়ে থাকে বাঙালি, থানায় যাবে? থানায় যাবে দুখুরি?
তুই বেশি চাপাচাপি করলে যাবে না তো কী? তোকে দেখলেই মেয়েটা ভয় পায় কেন রে?
বাঙালি উবু হয়ে বসে পড়ল। মাথায় হাত। দুখুরি থানায় যাবে, এতটা ভাবেনি বাঙালি। খইনির থুতু গিলে ফেলায় একটা দুটো হেঁচকি উঠল তার।
বলাকার একটু মায়া হল। বলল, শোন মুখপোড়া, দুখুরি এখন আমার কাছেই থাকবে। বড় মায়া পড়ে গেছে আমার। দোকান আর মোষ কেনার টাকা আমি তোকে দেবো। কিন্তু টাকা নিবি লেখাপড়া করে। পরে ফের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এলে কিন্তু বিপদে পড়বি। বুঝেছিস?
খুব বুঝেছে বাঙালি। তাড়াতাড়ি হাতজোড় করে বলে, রাম কি কৃপা মাতাজি। দুকানটা আর ভৈঁষটা হলে হামার আর কুছু লাগবে না।
মনে থাকে যেন। কখানা ভাল বিস্কুট রেখে যা। আমার নাতি-নাতনিরা দিশি বিস্কুট খেতে ভালবাসে। খাস্তা দেখে দিস বাবা।
বাঙালি বিস্কুট নিয়ে ভারি ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
গৌরহরি চাটুজ্যে দুঁদে উকিল হলেও বিষয়বুদ্ধি তেমন ছিল না। খরচের হাত ছিল বড্ড বেশি। এ নিয়ে বলাকার চাপা ক্ষোভ ছিল। স্বামী-স্ত্রীতে কখনও ঝগড়াঝাঁটি বা মন কষাকষির বালাই ছিল না তাদের। গৌরহরির কথাই সুপ্রিম কোর্ট। তবু এ নিয়ে মাঝে মাঝে মৃদু একটু-আধটু অনুযোগ কখনও তুলেছে বলাকা। গৌরহরি জবাবে বলত, ভার কমাও বলাই, ভার কমাও। নইলে মরার সময় বড় কষ্ট হবে যে!
বলাই বলে বলাকাকে ডাকার আর কেউ নেই। ঠাট্টার ওই ডাক আজও যেন কানকে স্নিগ্ধ করে দেয়। আর কী আশ্চর্য, গৌরহরি চলে যাওয়ার পর বলাকারও যেন টাকাপয়সা, বিষয় সম্পত্তির ওপর টান হঠাৎ ছিঁড়ে খুঁড়ে গেল। জেটি থেকে স্টিমার যেন পৃথক হয়ে ভেসে আছে। কোনও বাঁধন নেই। তাই দোনোমোনো করেও টাকাটা বাঙালিকে কবুল করে ফেলল বলাকা। সামান্যই টাকা। তার তো অভাব নেই। গৌরহরি অনেক রেখে গেছে, তার ওপর ছেলেরা পাঠায়, মেয়েরা পাঠায়। টাকা কোন কাজে লাগে তার? চাল ডাল সবজি কিছুই কিনতে হয় না তাকে। বরং ধান, সবজি, দুধ, সর্ষে এসব বিক্রি করেও বেশ টাকা পায় সে। কটা টাকা দিয়ে যদি মা-মরা মেয়েটার মুখে হাসি ফোটানো যায়।
ঘরে এসে ফের আলমারির সামনে বসে বলাকা। চারদিকে ডাঁই করা সব শাড়ি, শায়া, ব্লাউজ।
কমলা গলা নিচু করে বলে, গয়নাগুলোও কি সব দিয়ে দিচ্ছ মা?
কেন বল তো!
নিজের হাতের পাতের কয়েকখানা রেখো।
গয়না দিয়ে করব কী? ওসব আপদ বিদেয় করাই ভাল। শেষে চোরে ডাকাতে নেবে।
তুমি যেন কেমনধারা হয়ে যাচ্ছ। কর্তাবাবা মরল তো তুমি যেন যোগিনী হলে। এমন দেখিনি।
দুর মুখপুড়ি। বুড়ো বয়সে কি গয়না পরে বসে থাকব নাকি?
তাই বললুম বুঝি। বলছি, গয়না তো একটা সম্বল। সোনা-দানা হাতে রাখে না মানুষ?
তা রাখে। দুর্দিনের ভয় পায় বলে রাখে, লোভেও রাখে। আমার সেসব নেই। আমার আসল গয়নাই চলে গেল তো সোনা-দানা দিয়ে কী হবে?
আসল গয়না যে কে তা কমলা জানে, কালী জানে। গাঁয়ের লোকও জানে।
কমলা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, একটা মটরদানা হার ছিল না তোমার! সেই যে ডায়মন্ড কাটা মটরদানা গো, কী ঝিকমিকই না করে!
হ্যাঁ। কর্তা দিয়েছিলেন। খয়রাশোলের বড় মামলাটা জিতে খুব আনন্দ হয়েছিল। তাই দিয়েছিলেন।
ওইটে রেখো। তোমাকে বড় সুন্দর দেখায়।
দুর! গলায় একটা চেন পরি, এই যথেষ্ট। মেয়েরা, বউমারা খালি গলায় থাকতে দেয় না বলে পরি। আর এই হিরের আংটিটা। এটা ঝন্টু চাকরি পেয়ে দিয়েছিল, তাই খুলিনি। ব্যস, আর কিছু রাখব না।
উঠোনে একটা শোরগোল উঠল। দুজন মুনিশ পুকুরে জাল ফেলেছিল। মস্ত একটা কাতলা তুলে এনে উঠোনে ফেলেছে।
দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে মাছটা দেখল বলাকা। পাকা কাতলা, এখনও কানকো নড়ছে। তার কি মাছ দেখে লোভ হয়? একটুও হয় কি?
মুখটা ফিরিয়ে নিল বলাকা। না, তার কোনও লোভ নেই। একটা মানুষের সঙ্গে সঙ্গেই যেন চলে গেল ওসব। এখন আঁশটে গন্ধে তার গা গুলোয়।
এই যে আজ তার ছেলেমেয়েরা আসবে, নাতি-নাতনিরা দামাল পায়ে সারা বাড়ি দাপিয়ে বেড়াবে, হাসিখুশি হইহট্টগোল হবে এসব ভালই লাগবে বলাকার। ভর ভরন্ত সংসার কার না ভাল লাগে? তবু সব থেকেও বুকের একটা পাশ যেন চিরকালের মতো ফাঁকা হয়ে গেছে। ওইখানে অন্ধকার আর হু হু করে বিরহের বাতাস বহে যায় সারাক্ষণ।
ভালবাসা কারে কয়? দশ বছর বয়সের বালিকা কামবোধহীনা বলাকা তা জানতই না। আবার মেয়েদের সহজ সংস্কারবশে জানতও। সে এক জানা না-জানার রহস্যময় আলো-আঁধারিতে তাদের শুভদৃষ্টি। ঘুমকাতুরে বলাকার বিছানায় এক প্রাপ্তবয়স্ক অচেনা পুরুষ-তার তথাকথিত স্বামী। পনেরো বছর বয়সের তফাত। দেহ জাগেনি, মন জাগেনি। রজোদর্শনও হয়নি তখনও। তার শোওয়া খারাপ ছিল বলে লোকটা তাকে সযত্নে পাশ ফিরিয়ে দিত। পাছে চঞ্চলতাবশে ঘুমের ঘোরে খাট থেকে পড়ে যায় সেই জন্য বারবার উঠে পাশবালিশের ব্যারিকেড ঠিকঠাক করে দিত। আর টাইফয়েডের সময় তো কোলে তুলে বাথরুমেও নিয়ে গেছে। টাইফয়েডের যখন বাড়াবাড়ি যাচ্ছে তখন আর বাথরুমে গিয়ে বসবার ক্ষমতাও ছিল না বলে বেডপ্যান দিত ওই লোকটাই। এসবের ভিতর দিয়েই বুনে ওঠে ভালবাসা। তার অত বাহার নেই, রোমান্স নেই, কিন্তু ভিতরে ভিতরে সে এমন বজ্ৰবাঁধন তৈরি করে যে আর জোড় ভাঙে না কখনও, ভালবাসা কি শুধু উথালপাথাল ঝড় জল, নাকি উথলে-পড়া দুধ, নাকি বর্ষায় ফুলে ফুলে ছেয়ে যাওয়া কদম গাছ, নাকি সুফলা বছরে সম্পন্ন গৃহস্থের ধানের গোলা, সে কি সেতারের মির, নাকি আশ্চর্য সুগন্ধ কোনও? না না, ওরকম নয়। ওরকম নয় কিছুতেই। দুটো নারী পুরুষের সম্পর্কই তো শুধু নয়, তার মধ্যে শ্বশুর-শাশুড়ি, দেওর-ননদ, গোরু-ছাগল, পাখি-পশু, খরা বন্যা, কাঙাল-ভিখিরি কত কী ঢুকে পড়ে এসে। সহবত, নিয়মকানুন, অভদ্রতা ভদ্রতা–সব মিলিয়ে সম্পর্ক কি সোজা কথা? তারা যেন এক কুলি আর এক কামিন সযত্নে খেটেপিটে রচনা করেছিল এই সংসার। কাজ ভাগ করা ছিল, দায় ছিল, দায়িত্ব ছিল।
দশ বছর বয়সে বিয়ে। একটি সমর্থ পুরুষের ছায়ায় সে ক্রমে ক্রমে বয়ঃসন্ধি পেরোল। তার সংযত পুরুষটি স্ত্রীর যৌবন সমাগমের জন্য অপেক্ষা করেছিল, কখনও নিয়ম ভাঙেনি কোনও। পৌরুষের অন্যায্য জোর খাটায়নি কখনও। তার কাম কখনও ছিল না অন্ধ ও বধির। দীর্ঘকায়, গৌরবর্ণ, অতীব সুপুরুষ এই লোকটি কখনও ছিল বাবার মতো স্নেহশীল ও প্রযত্নপরায়ণ, কখনও ছিল বন্ধুর মতো বিশ্বস্ত দোসর, কখনও নির্জন রাতে গোপনে হ্যারিকেন জ্বেলে ষোলো গুটি খেলতে খেলতে হয়ে যেত তার সঙ্গী খেলুরি। বলাকা বুঝতেই পারেনি, লোকটি তার কে? শুধু বুঝত, একে ছাড়া তার চলে না।
তারপর ক্রমশ শরীরে বন্যার জল এল তার, কূল ভাসিয়ে। কানায় কানায় ভরে এল সে। এক পাগল বর্ষার রাতে হ্যারিকেনের নিবু নিবু আলোয় মানুষটার মুখের দিকে চেয়ে হঠাৎ যেন চিনতে পেরেছিল তাকে বলাকা। দুটি লীলায়িত হাতে তার কণ্ঠ বেষ্টন করে লজ্জায় মরে গিয়ে খুব আস্তে বলেছিল, এবার…।
সেই রাতের কথা মনে পড়লে আজও এই বাহাত্তর বছরের শরীর ও মনে একটা ঝংকার ওঠে, রক্তে নুপুর বেজে যায়। বিবশ হয়ে যায় মন। সে তো শুধু কাম নয়, সে এক অপার্থিব নিবেদন। একটি চুম্বন গড়ি, দোঁহে লই ভাগ করি, এ বিশ্বে মরি মরি এত আয়োজন। এ হল সেই পৃথিবীর কথা যখন দেবতারা পুষ্পবৃষ্টি করতেন। যখন শরীর জুড়ে শঙ্খধ্বনি আর জোকার শোনা যেত।
বড়মা! ও বড়মা।
দুটি টইটুম্বুর চোখ তুলে দরজাটা বড্ড আবছা দেখল বলাকা। গলার স্বরটা অবশ্য চেনা।
আয়। দুদিন আসিসনি তো! কী হয়েছিল?
পান্নার সঙ্গে ওর বয়সি একটা মেয়ে। চোখের জলটা আঁচলে মুছে ভাল করে দেখল বলাকা। ভারী ফুটফুটে চেহারার মেয়ে। কিন্তু মুখটা বড় দুঃখী।
কাঁদছিলে নাকি বড়মা? জ্যাঠার কথা মনে পড়লে আমারও যে কী ভীষণ কান্না পায়!
কষ্ট করে একটু হাসল বলাকা।
কিন্তু অনেক কেঁদেছ বড়মা। আর কেঁদো না। অজ্ঞান হয়ে জ্যাঠার খাট থেকে পড়ে গিয়েছিলে সেদিন, মাথা কেটে রক্তারক্তি। কী ভয় পেয়েছিল সবাই।
বলাকা একটু হেসে বলল, তবু তো মরিনি। তার আগেই যে কেন গেলাম না সেই দুঃখ কি কম? আয় বোস সামনে। তোকে একটু দেখি।
সঙ্গে কাকে এনেছি বলো তো! চেনো একে?
বলাকা একটু তাকিয়ে থেকে বলল, অমলের মেয়ে না?
ও মাঃ চিনলে কী করে, আগে দেখছ কখনও?
না রে। শুনেছি ওরা গাঁয়ে এসেছে। তা ছাড়া ওর মুখে অমলের মুখের আদল আছে।
মেয়েটা এগিয়ে এসে একটু আড়ষ্টভাবে দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ বলল, আচ্ছা, আমি কি আপনাকে প্রণাম করব?
না, না, প্রণাম করতে হবে না, একটা মোড়া টেনে নিয়ে বোসো।
মোড়াতে নয়, মেয়েটা ঝুপ করে মেঝেতেই বলাকার মুখোমুখি বসে পড়ল। পাশে পান্না।
কী করছিলে বড়মা? আজ তো তোমার খুব আনন্দ, না? সবাই আসছে।
বলাকা হেসে বলল, আনন্দ তো বটে মা, কিন্তু ফের যখন চলে যাবে সবাই, তখন আমি যে একা সে-ই একা।
ও বড়মা, বাবাকে বলো না, আমি এসে তোমার কাছে থাকি।
থাকবি?
এত বড় বাড়িতে তুমি একা একা থাকো, তোমার ভয় করে না?
বলাকা হেসে বলে, ভয়! ভয়টা কীসের?
আমার যা ভয়! বাব্বাঃ, ভয়ে যেন মরে যাই। মাঝে মাঝে এমন হয়, যেন ভয়ে হার্টফেল হয়ে যাবে।
তোর তো চিরকাল ভয়। সেই ছোট থেকে। আমার কাছে এসে থাকতে চাস সে তো খুব ভাল কথা। কিন্তু এই ফাঁকা বাড়িতে তো তোর আরও ভয় করবে।
ম্লান মুখে পান্না বলে, সেটাই তো প্রবলেম। তোমার কেন ভয় করে না বলো তো!
কাকে ভয় করব? ভূতপ্রেতকে! আমি নিজেই তো ভূতপ্রেতের কাছাকাছি চলে গেছি, আর ভয় করে কী হবে?
তুমি বড় জ্যাঠাকে দেখতে পাও?
না, তবে দেখতে পেলে ভয় পেতাম না। খুশিই হতাম।
তোমার দুর্জয় সাহস বড়মা। আর এই যে দেখছ সোহাগ, এরও খুব সাহস। রাতে একা একা বেরিয়ে পড়ে, জানো? বলে কী, ভূতেরা নাকি ওর বন্ধু! হিঃ হিঃ!
মেয়েটার দিকে তাকাল বলাকা। মুখের বিষণ্ণতাটা ভারী গভীর। পোশাকটাও ভাল নয় তেমন। রংচটা একটা ঢোলা ধুলোটে রঙের কামিজ আর একটা কালচে সালোয়ার। গায়ে কোথাও গয়নার চিহ্ন নেই।
বলাকা মৃদু স্বরে বলে, রাতবিরেতে একা একা বেরোনো ভাল নয়। গাঁ-গঞ্জেও পাজি লোক আছে।
মেয়েটা বড় বড় চোখ করে বলাকার মুখের দিকে চেয়ে ছিল। খুব এক নজরে। হঠাৎ বলল, আপনাকে দেখলে রিয়েল বলে মনেই হয় না, মনে হয় ম্যানেকুইন বা স্ট্যাচু।
এটা প্রশংসা না নিলে বুঝতে না পেরে বলাকা হেসে ফেলল, বলল, হ্যাঁ, এখন স্ট্যাচুই হয়ে গেছি। বোধবুদ্ধিও বোধহয় আর কাজ করে না।
মেয়েটা মাথা নেড়ে বলে, তা বলছি না, ইউ লুক হেভেনলি। আপনি তো পারুলের মা!
পারুলের মা শুনে একটু অবাক হল বলাকা। পারুল তো আর ওর সমবয়সি নয়। তবু রাগ হল না। সাহেবি কেতায় ওরকমই সব বলে বোধহয় ওরা। ঠিকঠাক সব হলে আজ তো পারুলেরই ওর মা হওয়ার কথা ছিল।
আজ মনে হয়, বিয়েটা না হয়ে বেঁচেছে পারুল। সবটুকু অবশ্য বাঁচেনি। মায়েরা অনেক কিছু টের পায়। বলাকাও পেয়েছিল। পারুল কিছুই ভেঙে বলেনি তাকে। তবু ঘটনা যে একটা ঘটেছিল এটা খুবই স্পষ্ট টের পেয়েছিল বলাকা। মা আর মেয়ের মধ্যে একটা লুকোচুরি চলছিল বটে, কিন্তু বলাকা নজর রেখেছিল, অঘটনের ফল কতদূর গড়ায়। গড়ায়নি, কিন্তু মর্মে গভীর আঘাত পেয়েছিল বলাকা।
কোনও কথাই সে কখনও স্বামীর কাছে গোপন করেনি। এক রাতে সে গৌরহরিকেও নিজের আশঙ্কার কথা বলে ফেলে। রাগী ও মেজাজি গৌরহরি সটান উঠে বসে বলেছিল, বলো কী? হারামজাদার এত সাহস!
গৌরহরিকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ঠান্ডা করতে হয়েছিল। বলাকা বলেছিল, অমলকে শাসন করতে গেলে হিতে বিপরীত হবে যে! চারদিকে রটে যাবে।
গৌরহরি ফুঁসছিল রাগে। গরগর করছিল। সেই পুরুষের রাশ ধরা বড় সহজ ছিল না তখন।
মেঘটা কেটে গিয়েছিল কয়েকদিন পর। তারপর পারুলই বেঁকে বসল, অমলকে বিয়ে করবে না। বলাকার মন থেকে ভার নেমে গিয়েছিল।
আজ মেয়েটাকে দেখে সেইসব পুরনো কথা একটা ঝটকা মেরে গেল যেন।
হ্যাঁ, আমি পারুলের মা। পারুলকে চেনো?
হ্যাঁ, চিনি। শি ইজ এ গডেস।
বলাকা হেসে ফেলে, সে কী? পারুল আবার গডেস কীসের?
ওকে আমার ওরকমই লাগে। আই অ্যাডোর হার।
বলাকা খুশিই হল। বলল, বেশ তো, ভালই তো।
সোহাগ আর আমি খুব বন্ধু হয়ে গেছি, জানো বড়মা? ও-ও একটু পাগল, আমিও একটু পাগল। তাই খুব মিল।
তাই বুঝি? তা কী পাগলামি করিস তোরা?
খুব হোঃ হোঃ হিঃ হিঃ করে হাসি, আবোলতাবোল কথা বলি, আচার চুরি করে খাই আর ক্যারিক্যাচার করি।
কিন্তু সোহাগের মুখে তো হাসির চিহ্ন দেখছি না। মুখখানা ভার কেন?
ও খুব চিন্তা করে যে!
কীসের চিন্তা?
সেটাই তো আমি বুঝতে পারি না। সব সময়ে কেবল ভাবে আর ভাবে।
এইটুকু বয়সে অত ভাবো কেন?
সোহাগ মৃদু হেসে মাথাটা নোয়াল।
পুজো অবধি কি থাকবে তোমরা?
সোহাগ উদাস মুখে বলে, কী জানি!
তোমাদের তো কয়েকদিন আগেই চলে যাওয়ার কথা ছিল, শুনেছিলাম।
হ্যাঁ, বাবা হঠাৎ জরুরি কাজে লন্ডন গেছে, তাই আমরা আর যাইনি, কলকাতায় আমার হেলথ হ্যাজার্ড হয়।
সেও যেন শুনেছিলাম। ভালই তো, থাকো। আজ তোমার পছন্দের পারুলও আসবে। সেও পুজো অবধি থাকবে বলেছিল। মাঝে মাঝে এসে গল্প-টল্প করে যেও।
হঠাৎ হি হি করে হেসে পান্না বলে, ও কী বলে জানো বড়মা? বলে, আমি যদি পারুলের মেয়ে হতাম তো খুব ভাল হত।
বলাকার মনটায় একটা ধাক্কা লাগল। হঠাৎ এ কথা বলে কেন মেয়েটা? এরকম ভাবা তো স্বাভাবিক নয়?
আলগা গলায় বলাকা জিজ্ঞেস করে, তাই নাকি সোহাগ?
কথাটার জবাব না দিয়ে সোহাগ হঠাৎ বলল, আপনার নামটা খুব অদ্ভুত, না?
কেন বলো তো!
বেশ আধুনিক নাম।
মোটেই না। রবীন্দ্রনাথ বলাকা লিখেছিলেন সেই কবে। সেই থেকেই তো বাবা আমার নাম রেখেছিল বলাকা। পড়েছ বলাকা?
ঘাড় হেলিয়ে সোহাগ বলে, হ্যাঁ। মেলিতেছে অঙ্কুরের পাখা, লক্ষ লক্ষ বীজের বলাকা। ইট ইজ ফ্যানটাস্টিক।
এ কথায় মুগ্ধ হল বলাকা। না, ততটা সাহেবি চাল নেই তো!
কী খাবে বলো তো!
ফের ঘাড় হেলিয়ে বলল, এনিথিং, এখানে সবাই খুব খাওয়াতে ভালবাসে, না?
বলাকা স্মিত মুখে বলে, খাওয়ানোর মধ্যে একটা আদর থাকে তো!
সোহাগ হাসিমুখেই বলল, আমার মাও আমাকে খুব খাওয়াতে চায়। কিন্তু তার মধ্যে আদরটা থাকে না।
.
০৯.
প্রথম দৃশ্য। বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিক জীবনের উপান্তে পৌঁছে গেছেন। জরাজীর্ণ শরীর, বিরলকেশ মাথা, বেশবাসের ঠিক নেই। মধ্য রাতে বৈজ্ঞানিক একটি পুরনো, প্রকাণ্ড, কীটদষ্ট, জীর্ণ পুঁথির ওপর ঝুঁকে বসে আছেন। উত্তেজনায় তাঁর হাত-পা কাঁপছে, চোখ বারবার ঝাপসা হয়ে আসছে অতি পঠনের ফলে, বুক ধড়ফড় করছে আবেগে। জরাজীর্ণ এই প্রাচীন পুঁথির ভিতরেই তিনি নানা সংকেত পেয়ে যাচ্ছেন এবং জীবনের বহু সাধনা, অধ্যবসায়, অনেক বিনিদ্র রাত্রি ও বিশ্রামবিহীন দিন কাটিয়ে অবশেষে তিনি তাঁর অভীষ্টের কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন প্রায়। এই বিরল, অজ্ঞাত পুঁথির ভিতরেই লুকোনো রয়েছে মানুষের অমরত্ব লাভের বীজ। আর কয়েকটি পৃষ্ঠা অতিক্রম করলেই সেই বাতিঘর, যা মৃত্যুর অন্ধকার মহাসাগরে মানুষকে অনন্তকাল বেঁচে থাকার গুপ্তমন্ত্রের সন্ধান দেবে।
একটা মাছি বিরক্ত করছে বারবার। নাকের ওপর, চোখের সামনে ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে, টাকের ওপর বসে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। বৈজ্ঞানিক বিরক্ত হয়ে পতঙ্গ নিধনের জন্য চামড়ার ফলক লাগানো শলাকাটি তুলে ফটাস করে মাছিটাকে টেবিলের ওপরে মেরে ফেললেন। অতি ব্যগ্রতায় ঝুঁকে পড়লেন পুঁথির ওপর।
একটা বাতাস এল জানালা দিয়ে। দমকা বাতাসের ঝটকায় পুঁথির জীর্ণ পাতা পট করে উলটে গেল। বৈজ্ঞানিক বিরক্ত হয়ে ধমক দিলেন, থামো! এ সময়ে বিরক্ত কোরো না।
দ্বিতীয় দমকা হাওয়াটি আরও একটু জোরালো। ফড়ফড় করে পুঁথির পাতা উলটে গেল কয়েকটা, বৈজ্ঞানিকের নোটবই পড়ে গেল মেঝের ওপর। কলম গড়িয়ে যেতে লাগল।
বৈজ্ঞানিক ধমক দিলেন, এসব কী হচ্ছে এ সময়ে?
তৃতীয় দমকা বাতাসটা এল হা-হা রবে প্রবল ঝঞ্ঝার বেগে, জানালা দরজার কপাট প্রবল ঝাপটায় আর্তনাদ করে উঠল। বৈজ্ঞানিক পাগলের মতো উঠে জানালা বন্ধ করতে গেলেন আর তখনই লুঠেরা বাতাস জীর্ণ পুঁথির পাতার বাঁধন ছিন্ন করে উড়িয়ে নিয়ে যেতে লাগল। বিপরীত জানালা দিয়ে কাটা ঘুড়ির মতো উড়ে যাচ্ছে পাতাগুলি, অমূল্য পাতাগুলি। বৈজ্ঞানিক আর্তনাদ করে উঠলেন, থামো ছিন্নপত্র, স্থির হও! আমার কাজটুকু শেষ করতে দাও দয়া করে।
কেউ শুনল না তাঁর কথা। বাইরের অন্ধকার মুক্তাঞ্চলে পাতাগুলি উড়ে যাচ্ছে। বৈজ্ঞানিক পাগলের মতো দরজা খুলে ছুটে গেলেন বাইরে। অসহায় চোখে চেয়ে দেখলেন, মহার্ঘ পাতাগুলি অন্ধকারে কোন অদৃশ্য ঠিকানায় ভেসে চলে যাচ্ছে, গাছের মগডালে, পুকুরের জলে, বিছুটি বনে, আকাশে। বজ্রপাত হল, মেঘ ডেকে উঠল গম্ভীর কণ্ঠস্বরে, প্রবল বৃষ্টি ছুটে এল তার অসংখ্য খরসান বল্লমে চতুর্দিক বিদ্ধ করতে করতে। বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিক বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন।
শরীর কেঁপে উঠল বয়সের শীতে। বিধ্বস্ত বৈজ্ঞানিক ফিরে এলেন ঘরে। স্মৃতিভ্রংশ, স্থাণুর মতো বসে রইলেন নিজের আসনে। হাতে একটি পানীয়পাত্র। সেটি মুখে তুলতে ভুলে গেছেন। তাঁর চোখের জল ফোঁটা ফোঁটা ঝরে পড়ছে পাত্রের ভিতরে।
দ্বিতীয় দৃশ্য। অন্ধকার মঞ্চে একটি নারীকণ্ঠ চিৎকার করে উঠল, আমি শ্রেষ্ঠীকন্যা অম্বালিকা। দুষ্কৃতীরা অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিল আমাকে। নগরবাসীগণ, তোমরা অবহিত হও, আমার পিতা এক কোটি টাকা মুক্তিপণ দিয়ে আমাকে মুক্ত করেছেন। দেখ, আমি অম্বালিকা, এক মহার্ঘ মেয়ে। আমার দাম কোটি টাকা।
মঞ্চ আলোকিত হল। গাছতলায় দুটি কাঙাল ভিখিরি মেয়ে বসে আছে। কিশোরী। মঞ্চের মাঝখানে একটি বেদির ওপর দাঁড়িয়ে শ্রেষ্ঠীকন্যা অম্বালিকা হাত তুলে জনতার অভিনন্দন গ্রহণ করছে।
কাঙাল মেয়েদের একজন আর একজনকে বলে, হ্যাঁ লা দিদি, এক কোটি টাকা কত টাকা রে?
তা কী জানি! হাজার টাকা অবধি জানি, তা সেও অনেক টাকা। গুণে শেষ করা যায় না।
আর মুক্তিপণটা কী বল তো!
ওই তো, একজনকে ধরে নিয়ে যায়, তারপর টাকা আদায় করে ছেড়ে দেয়।
ছোট মেয়েটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, আমাদের কেউ ধরে নেবে না কখনও।
সে কথা বলিসনি, আমাদেরও মাঝে মাঝে ধরে বইকী। ভিক্ষে বা বেশ্যাবৃত্তি করাতে নিয়ে গিয়ে লাগায়। এই যে আমাদের রোগাভোগা, কালো চেহারা, মেয়ে-শরীর বলে মনেই হয় না, এই শরীরেরও কিছু ব্যবহার আছে। মেয়ে বলেই একটু-আধটু কাজে লাগি আজও। দুখানা রুটি একটু গুড় খাইয়ে আমাকেও একজন আধবুড়ো লোক ভোগ করেছিল।
আমাকে ভোগ করেছিল একজন মাতাল। আমার তুচ্ছ শরীর নিয়ে সে যখন ব্যস্ত ছিল তখন আমি তার পকেট থেকে টাকা তুলে নিই।
শ্ৰেষ্ঠীকন্যা অম্বালিকাকে ঘিরে ধরেছে সাংবাদিকরা। একজন বাঁচাল সাংবাদিক বলল, মুক্তির জন্য অভিনন্দন অম্বালিকা। দয়া করে বলুন, দুষ্কৃতীরা আপনাকে ধর্ষণ করেনি তো!
অম্বালিকা অবিচলিত হয়ে বলল, আমি এ কথার জবাব দেব না। আমি শুধু বলতে চাই, মুক্তি কীসের? কেমন মুক্তি? এক বন্দিদশা থেকে আর এক বন্দিদশায় গমন করা ছাড়া মেয়েদের কোনও মুক্তি কি কোথাও আছে? ভদ্রমহোদয়গণ, ওই দেখুন, দক্ষিণ দিকে একটু দূরে ওই দাঁড়িয়ে আছেন আমার প্রেমিক, আমি ওঁর বাগদত্তা। যখন আমাকে হরণ করা হয় তখন নগর-উদ্যানে মনোরম এক অপরাহে আমি ও আমার প্রেমিক বিশ্রম্ভালাপে রত ছিলাম। গদগদ ভাব, পরস্পরের শ্বাসবায়ুতে ঘটে যাচ্ছিল প্রগাঢ় ভালবাসার আশ্চর্য সংক্রমণ। সেই সময়ে সশস্ত্র দুষ্কৃতীরা অস্ত্র উদ্যত করে আমাদের ঘিরে ফেলে। না, আমার প্রেমিক কোনও প্রতিরোধ করেননি। আত্মরক্ষা সকলেরই জীবনধর্ম। উদ্যত অস্ত্রের সামনে তাঁর কিছুই করার ছিল না। কোটি টাকা মুক্তিপণ দিয়ে আমাকে মুক্ত করা হয়েছে বটে, কিন্তু দেখুন, আমার প্রেমিকের মুখে কোনও হাসি নেই, আনন্দ নেই। বিষণ্ণ ও দ্বিধাগ্রস্ত মুখে ওই তিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন। ওই বিষণ্ণতা অকারণ নয়। উনি চেয়েছিলেন এক শুদ্ধ ও অনাঘ্রাতা নারী। কিন্তু দুষ্কৃতীদের ডেরায় কী ঘটেছিল তা উনি জানেন না। আমার শুদ্ধতা নিয়ে উনি আজ বিচলিত, দোলাচলায়মান, দ্বিধাগ্রস্ত। পৌরাণিক সীতাই কখনও সন্দেহপাশ থেকে মুক্ত হননি, আমি তো সামান্যা নারী। ভদ্রমহোদয়গণ, আমি তাই প্রশ্ন করতে চাই, নারীর মুক্তিপণ এক ব্যর্থ প্রয়াস। তার মুক্তিই যে আদপে নেই। বরং ওই দেখুন, গাছতলায় ওই যে দুটি ভিখিরি মেয়ে বসে আছে. ওরাও আমার চেয়ে কত স্বাধীন, কত সুখী …
ওলো দিদি, মাগী কী বলছে শুনলি?
ভদ্দরলোকেরা ওরকম কত আজগুবি কথা কয়। আয়, বরং একটু ঘুমিয়ে নিই দুজনেই।
তাই ভাল। জেগে থাকলেই খিদে চাগাড় দেয়।
তৃতীয় দৃশ্য। বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিক চারধারে পাগলের মতো পুঁথির নিরুদ্দেশ পাতাগুলি খুঁজছেন। এক আধটা পেয়ে যাচ্ছেন। হতাশায় মাথা নেড়ে বলছেন, না, না, সব মুছে গেছে। সব মুছে গেছে।
বুড়োটা কী খুঁজছে রে দিদি?
পাগল-টাগল হবে। ছেঁড়া ভেজা কাগজ কুড়োচ্ছে।
বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিক এগিয়ে এলেন তাদের দিকে, ওহে, তোমরা একটা পুঁথির কিছু ছেঁড়া পাতা পেয়েছ কুড়িয়ে?
বড় জন হাই তুলে বলল, ঝড়বৃষ্টির সময় কতক উড়ে যাচ্ছিল দেখেছি। কাগজ কুড়িয়ে কী হবে? আমরা কি পড়তে জানি!
মূর্খ বালিকা। কী অমূল্য সম্পদ যে ওই কাগজের মধ্যে ছিল তা তোমরা জান না।
লটারির টিকিট নাকি রে পাগলা-বুড়ো?
তার চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান। ওতে লেখা ছিল মানুষের মৃত্যুর প্রতিষেধক। মৃত্যুহীনতার মোহনায় মানুষকে পৌঁছে দিচ্ছিলাম আমি। বিধি বাম। মৃত্যুকে রোধ করা গেল না।
কী বলছে রে দিদি?
বলছে এমন ওষুধ বের করবে যাতে মানুষ আর মরবে না।
মরণ! একটু আগে ঝড়বৃষ্টির সময় ওই তালগাছে যে বাজটা পড়ল সেটা আমাদের মাথায় পড়লেও কি মরব না?
ওগো ও বিটলে বুড়ো, মানুষ মরবে না তো খাবে কী?
বৈজ্ঞানিক হতবাক হয়ে বললেন, তার মানে?
বলি মানুষকে যে বাঁচিয়ে রাখতে চাও তার খোরাকির জোগাড়টা আগে করে রাখ বাপু।
মূর্খ বালিকা, মৃত্যুর হাত থেকে মুক্তি চাও না তোমরা?
দুই বোন হেসে গড়িয়ে পড়ল। বড় জন বলল, বেঁচে আছি কিনা সেটাই যে টের পেলুম না এখনও। আয় তো বিটলে বুড়ো, গায়ে একটা চিমটি কেটে দেখ তো বেঁচে আছি কিনা।
নাটকের নাম মুক্তিপণ। কিংবা ঠিক নাটকও নয়। ঈষৎ নাটকীয় গদ্য। কী এটা, কী সে বলতে চাইছে তা অমল নিজেও জানে না। কিন্তু কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকে তার আজকাল এরকম কিছু কিছু লেখার ঝোঁক চেপেছে। শুরু হয়, কিন্তু প্রায়ই শেষ হয় না। তবে নানা ছদ্মবেশে এসব লেখার মধ্যে সে নিজে ঢুকে যায়, আর চলে আসে পারুল। পারুলের সঙ্গে কখনও আর কেউ মিশে যায়, যেমন তার নিজের আদলেও আসে অন্যের আদল।
অম্বালিকা কি পারুল? না, ওর মধ্যে সোহাগও রয়েছে কিছুটা। কীভাবে যে মিশে গেল দুজন কে জানে। ছয় সাত বছর আগে তাদের কলম্বাস শহরের বাড়ি থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল সোহাগ। তখনও সে নিতান্তই বালিকা। দশ এগারো বছর বয়স। এইলিন নামে একজন ব্রাজিলীয় মেয়ে আসত তাদের বাড়িতে। সে এক এজেন্সির মাধ্যমে বুডঢার বেবি সিটিং-এর কাজ পায়। সেই থেকে যাতায়াত। এইলিন প্রায়ই ব্ল্যাক ম্যাজিক হিপনোটিজম এবং অদ্ভুত সব বিষয়ে কথা বলতে ভালবাসত। ভুডুর প্রতি ছিল অমোঘ আকর্ষণ। সোহাগকে নিয়ে গিয়েছিল সে-ই।
সোহাগকে অপহরণের পরই বাড়িতে ফোন আসত যাতে তার খোঁজখবর করা বা পুলিশে জানানো না হয়। আশ্বাস দেওয়া হত, সোহাগকে নিরাপদে ফেরত দেওয়া হবে। উদ্বিগ্ন অমল আর মোনা পুলিশকে জানায়, কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। এইলিনের চিহ্নও খুঁজে পায়নি তারা। দিন সাতেক বাদে এক ভোরবেলায় একটা গাড়ি সোহাগকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে যায়। যে সোহাগ ফেরত এল সে যেন ঠিক আগের সোহাগ নয়। একটু গম্ভীর, একটু ভাবুক, একটু বিষণ্ণ আর উদাসীন। অমল আর মোনা এবং পুলিশের লোকেরা তাকে প্রশ্নে প্রশ্নে জেরবার করেছে। সে নানা উলটোপালটা জবাব দিত। রেপ করা হয়েছে কিনা। তার ডাক্তারি পরীক্ষাও হয়। রেপ না হলেও তার গায়ে বিশেষ জায়গায় কয়েকটি উল্কি পাওয়া যায়। পুলিশ বলেছিল, কোনও ধর্মোন্মাদ গোষ্ঠীর কাজ। কথাটা হয়তো মিথ্যে নয়। সোহাগ গোপনে নানা প্রক্রিয়া করত, অদ্ভুত ভাষায় মন্ত্রোচ্চারণ করত এবং কখনও কখনও তার অর্ধচেতন অবস্থা হত। অনেক সময় মধ্যরাত্রে সে নিশি-পাওয়ার মতো সারা ঘর ঘুরে ঘুরে নাচত। মোনা মাঝে মাঝে মারধরও করেছে ওকে। সোহাগের ই-মেল-এ কিছু অদ্ভুত ও দুর্বোধ্য বার্তা আসতে শুরু করেছিল। অমলের কলকাতায় ফিরে আসার কতকগুলো কারণের মধ্যে সোহাগও একটা কারণ।
সোহাগ ফিরল, কিন্তু তার সত্তার খানিকটা অংশ রয়ে গেল অন্য কোথাও, কোনও এক রহস্যময় গোষ্ঠীর কাছে। এখনও সোহাগের ই-মেল মার্কিং করলে সেই সব অদ্ভুত বার্তা পাওয়া যায়। কী যে হল মেয়েটার! কোন বিটকেল মানুষদের পাল্লায় পড়ল তার সমাধান আজও করতে পারেনি অমল রায়।
শ্ৰেষ্ঠীকন্যা অম্বালিকার মধ্যে পারুলই রয়েছে বটে, একটু সোহাগও আছে যেন। আর ওই বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিক কি তারই প্রতিচ্ছবি নয়? স্বপ্ন আর সম্ভাব্যতার মধ্যে কী বিপুল ফাঁক? এখন সে মাসে এক কাঁড়ি টাকা মাইনে পায়। দেড় লাখেরও কিছু বেশি। দিল্লি বা বম্বে বা বিদেশে গেলে আরও অনেক বেশি পেত। কিন্তু শুধু টাকা রোজগারের যন্ত্র হওয়ার ইচ্ছে তো ছিল না তার। সে হতে পারত একজন আবিষ্কারক, একজন দার্শনিক বা না হয় একজন কবিই। এখন তার মনে হয় এত টাকাই তার সব সম্ভাব্যতা নষ্ট করে দিল। বানিয়ারা মগজ কিনে আনে, নষ্ট করে দেয়। এর চেয়ে কত ভাল ছিল গবেষণাগার, ভাল ছিল একাগ্র চিন্তার গৃহকোণ।
শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসের এ.সি. চেয়ারকারে বসে অমল রায় কিছুতেই ভারতের শিল্পমন্ত্রীর নামটা মনে করতে পারছিল না। গত কয়েক দিনে অফিসের বিভিন্ন মিটিংয়ে কয়েকবারই নামটা শুনেছিল সে। এখন কিছুতেই নামটা যে কেন মনে আসছে না। মনে করার কোনও জরুরি কারণও নেই। শরতের এই সুন্দর সকালে শিল্পমন্ত্রীর নাম নিয়ে কে-ই বা মাথা ঘামায়? কিন্তু সে ভিতরে ভিতরে অস্পষ্ট একটা তাগিদ টের পাচ্ছে, নামটা তার মনে পড়া উচিত। ইদানীং তার স্মৃতিশক্তি কমে যাচ্ছে। সন্দেহ হয়, এখন ফের মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসলে, স্ট্যান্ড করা তো দূরের কথা, সে আদৌ সেকেন্ড ডিভিশনেও পাস করবে কিনা। আজকাল হঠাৎ যেন বিস্মৃতি এসে বন্ধুর মতো পাশে দাঁড়ায়, মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, লোপাট করে দেয় মাথার যত প্রোগ্রামিং, যত ডাটা, যত ফাইল। কী যে হয় মাঝে মাঝে। যত দিন পরেই দেখা হোক, চেনা মানুষের মুখ দেখলেই তার নাম ঠিক মনে পড়ে যেত অমলের। মাসখানেক আগে একসঙ্গে ওয়ান থেকে টেন অবধি পড়া সহপাঠী এবং গলাগলি বন্ধু গৌরাঙ্গ যখন তার অফিসে দেখা করতে এসেছিল, কিছুতেই নামটা মনে পড়ল না তার। ঠিক বটে, গৌরাঙ্গর সঙ্গে মাধ্যমিকের পর আর দেখাই হয়নি। তবু তার স্মৃতিশক্তি কখনও এরকম ডিলিট হয়ে যায়নি কখনও। তিনটে ক্ষিপ্র জিনিস ছিল তার। ক্ষিপ্র চিন্তা, ক্ষিপ্র স্মৃতি, ক্ষিপ্র কাজ।
হঠাৎ অমল টের পেল, আজ যেন এ.সি. চেয়ারকারে প্রার্থিত নিস্তব্ধতাটা নেই। বড্ড বেশি কথাবার্তা হচ্ছে চারদিকে। সামনে পিছনে। সুবেশ ও সুভদ্র কয়েকজন এক রকমের স্যুট-পরা তোক আইল দিয়ে ঘন ঘন যাতায়াত করছে। অমল বিরক্ত হয়ে সদ্য কেনা ইংরিজি খবরের কাগজটা খুলে খুঁজতে লাগল, যদি কোথাও ভারতের শিল্পমন্ত্রীর নামটা পাওয়া যায়। খুবই হাস্যকর এই চেষ্টা। কারণ নামটা জানার কোনও প্রয়োজনই নেই তার। কিংবা সূক্ষ্মভাবে আছেও। শিল্পমন্ত্রী নয়, সে খুঁজছে তার স্মৃতির হারানো তথ্যগুলিকে। কেন হারিয়ে যাচ্ছে তারা, কেন উবে যাচ্ছে অকারণে?
আজকাল কি এ.সি. চেয়ারকারে ব্রেকফাস্ট দেওয়া হয়? তাই তো মনে হচ্ছে। সুবেশ ও সুভদ্র স্যুট পরা লোকগুলো ট্রে-ভর্তি বাক্স সাজিয়ে এনে বিলি করছে, সঙ্গে সিল করা বোতলে জল। ভাল, বেশ ভাল। এরা এ.সি-র যা ভাড়া নেয় তাতে ব্রেকফাস্ট তো দেওয়াই উচিত। খাবারের আমিষ-গন্ধে অমলের পেটের ভিতরটা কেমন করে ওঠে। সে আজ সকালে এক কাপ কফি ছাড়া কিছুই খেয়ে আসেনি। বাসুদেব ব্রেকফাস্ট করে দিতে চেয়েছিল, তার তখন খাওয়ার ইচ্ছে হয়নি। আজ সকালে কিন্তু ক্লান্ত ও অবসন্ন ছিল অমল। কাল রাতে একটা দুঃস্বপ্ন দেখার পর শেষ রাতে ঘুম আসেনি আর।
দুঃস্বপ্ন! ঠিক দুঃস্বপ্নও বলা চলে না সেটাকে। একটা অন্ধকার গলি। এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে অমল। গলির অন্য প্রান্তে একটা মরা আলোর মলিন চৌখুপি। গোধূলির মতো পাঁশুটে আলো। কেউ কোথাও নেই। ওপরে নিরেট কালো অন্ধকার আকাশ। কিংবা হয়তো আকাশ বলেও কিছু ছিল না। শুধু ওই জনহীন গলিটাই দেখতে পেয়েছিল অমল। ঘেয়ো কুকুর বা রাস্তার বেড়ালও ছিল না, ছিল না দৌড়ে-যাওয়া ইঁদুর কি আরশোলা। এত প্রাণহীন গলি আর কখনও দেখেনি অমল। গলির ও-প্রান্তে ওই পাঁশুটে আলোর চৌখুপিও যেন এক নিষ্প্রাণতা। কোনও যাতায়াত নেই কারও, ছায়া নেই, গাছ নেই, প্রাণ নেই, শব্দ নেই। অমল দাঁড়িয়ে আছে তো আছেই, এক পা-ও এমোনোর সাধ্য নেই তার। আর তার চোখ বেয়ে অঝোরে জল পড়ে যাচ্ছিল।
অন্ধকারের চেয়েও ভয়ংকর ওই পাঁশুটে আলো। সম্মোহিতের মতো চেয়ে থেকে অমল টের পাচ্ছিল, এখানেই সব শেষ। এখানেই মানুষের সব আয়াস ও প্রয়াসের শেষ, সভ্যতার শেষ, মানুষের স্বপ্ন ও সাধ্যের শেষ। আর কোথাও যাওয়ার নেই তার। বৃথা তার বেঁচে থাকা, বৃথা তার দর্শন বিজ্ঞান। এই গলিমুখ আর ওই পাঁশুটে আলোর চৌখুপি এক ভয়ংকর সংকেতের মতো নিশ্রুপে বলে দিচ্ছে, কিছু নেই, আর কিছু নেই।
একটুও বাতাস ছিল না, শ্বাসের শব্দও নয়, জ্যোৎস্না নয়। এত কান্না আসছিল তার। এইভাবে শেষ হয়ে যায় বুঝি সব কিছু?
যখন জেগে উঠল অমল তখন তার আকাশপাতাল জুড়ে ভয়। এত ভয় সে কখনও পায়নি। কিন্তু ভয়ের স্বপ্ন তো নয়! আশ্চর্য! তবে সে এত ভয় পেল কেন? পিপাসায় ব্লটিং পেপার হয়ে গিয়েছিল জিব। ভয় আর অজানা এক হাহাকার ঘুরে বেড়াচ্ছিল তার শূন্য বুকের খাঁচায়। চোখে জল ছিল তখনও। হাত-পা কাঠ হয়ে ছিল।
বারবার স্বপ্নটার কথা ভাবছে। ভাবছে স্বপ্নটার মধ্যে ভয়ের বীজ কীভাবে ছড়ানো ছিল? কোন সর্বনাশের সংকেত ছিল তার মধ্যে? কোন কূট আভাস?
এখনও ভাবছে সে। যদিও একটা স্বপ্নের জন্য এত বিচলিত হওয়ার কোনও মানেই হয় না। স্বপ্নের মধ্যে সত্য থাকে না কখনও। আবার কোনও জটিল প্রক্রিয়ায় হয়তো থাকেও। স্বপ্নটা নিয়ে অনিচ্ছের সঙ্গেও সে হয়তো আরও কয়েকদিন ভাববে।
যে লোকটা খাবারের বাক্স দিচ্ছিল সে অমলের ডান ও বাঁপাশের দুজনকে দুটো বাক্স দিয়ে অমলকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে চলে যাচ্ছিল। অমলের রাগ হল। তাকে কি দেখতে পায়নি নাকি লোকটা! আশ্চর্য তো!
সাধারণত সে যা করে না আজ তাই করে ফেলল অমল। হয়তো হঠাৎ নিজের খিদেটাকে আবিষ্কার করেই সে ধৈর্য হারিয়ে হঠাৎ এগিয়ে যাওয়া লোকটার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, এই যে, এখানে দেননি কিন্তু।
লোকটা একটু বিস্মিত চোখে ফিরে তাকাল তার দিকে। লোকটার মাথায় টাক এবং বেশ ভারী গোঁফ। হঠাৎ একটু হেসে লজ্জিতভাবে বলল, সরি, আপনাকে দেওয়া হয়নি। বলে একটা বাক্স এগিয়ে দিল তার হাতে।
লোকটাকে ক্ষমা করে দিয়ে অমল ফোল্ডিং টেবিলটা নামিয়ে তার ওপর রেখে বাক্সটা খুলল। চমৎকার ব্যবস্থা। বড় একটা পরোটা রোল, দুটো চিকেন স্যান্ডউইচ, ডিমসেদ্ধ, এক টুকরো চিজ, দুটো সন্দেশ, একটা কলা। অমল খেতে খেতে হঠাৎ একটু অস্বস্তিবোধ করছিল কেন যেন। তার মনে হল দুপাশের দুজন যাত্রী তাকে মাঝে মাঝে কৌতূহলের সঙ্গে দেখছে। আইলের ওপাশের সিট থেকেও যেন দুজন একটু ঝুঁকে চকিতে দেখে নিল তাকে। হঠাৎ তাকে ঘিরে একটু নিস্তব্ধতাও ঘনিয়ে উঠল যেন।
হঠাৎ ডানপাশের লোকটা খুব বন্ধুর মতো তাকে জিজ্ঞেস করল, আপনার এজেন্সিটার নাম কী?
অমল বিরক্ত হল। গায়ে-পড়া লোক তার পছন্দ নয়। বলল, আমার এজেন্সি নেই।
ও! লোকটা আর কিছু বলল না।
হঠাৎ যেন বোধবুদ্ধির একটা ঝিলিক জেগে উঠল মাথার মধ্যে। কাণ্ডজ্ঞান ফিরে এল, যখন সে লক্ষ করল, কামরার সবাই ব্রেকফাস্টের বাক্স পায়নি। তার সামনের সিটের অন্তত দুজন, আড়াআড়ি সামনের ডানদিকের সারির তিনজন এবং লক্ষ করলেই, আরও অনেকেই খাচ্ছে না। জলের বোতলটা খুলে দু ঢোঁক জল খেয়ে অমল তার ডানদিকের লোকটাকে জিজ্ঞেস করল, সামথিং ইজ রং, ইজনট ইট! আপনারা কারা?
লোকটা খেতে খেতে মুখ তুলে একটু হেসে বলে, আমরা একটা ইলেকট্রনিক গুডস কোম্পানির সাব এজেন্ট। ইয়ারলি কনফারেন্সে শান্তিনিকেতনে যাচ্ছি।
ইস ছিঃ ছিঃ, আমার বড় ভুল হয়ে গেছে
লোকটা হাসিমুখেই বলল, তাতে কী? ইউ আর ওয়েলকাম–
বিস্তারিত ক্ষমাপ্রার্থনা বা ক্ষতিপূরণের সময় ছিল না। বর্ধমান এসে গেছে। অমল অ্যাটাচি কেসটা তুলে নিয়ে দ্রুত পায়ে আইল পেরিয়ে প্রিং-এর দরজাটা ঠেলে বেরিয়ে আসার সময়ে পিছনে, কামরার ভিতর থেকে একটা বড়সড় হাসির রোল শুনতে পেল।
তার কান গরম, লজ্জায় ঝাঁঝাঁ করছে মাথা। একদল ডেলিগেট কনফারেন্সে যাচ্ছে, তাদের জন্য কোম্পানি রাজকীয় ব্রেকফাস্ট আয়োজন করেছে এই সহজ ব্যাপারটা অমল রায়ের মতো বুদ্ধিমান, দুনিয়া-চষা একজন লোক বুঝতে পারল না!
ঘটনাটা হয়তো সামান্যই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গিন্নী গল্পের সেই ছোট ছেলেটির মতো তার আজ মনে হচ্ছিল, এ ঘটনাটা ওরা কেউ হয়তো কোনওদিনই ভুলতে পারবে না।
লজ্জা, নিজের ওপর বিরক্তি আর রাগ নিয়ে অমল স্টেশনের ফটক পেরিয়ে এল, নিজেকে চোর, লোভী, বেকুব ও অপদার্থ ভাবতে ভাবতে আনমনা অমল তার অ্যাটার্চি কেসটার একটা গুঁতো লাগাল একজনকে হাঁটুতে। লোকটা বাপ-রে বলে চেঁচিয়ে উঠতেই অমলের ইচ্ছে হল দৌড়ে পালায়। আজ তার এসব কী হচ্ছে?
সামনে একটা অ্যাবস্ট্রাক্ট মডার্ন আর্ট। অবিশ্বাস্য রিকশার জড়াজড়ি, সাইকেল, গাড়ি, মানুষ, হর্ন, চিৎকার, ধুলো। এই জটিলতার দিকে হতাশভাবে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল অমল। সুশৃঙ্খল লন্ডন শহর থেকে সদ্য ফিরে এসে এই ভিড়ে ভিড়াক্কার, রিকশা-গাড়ি-মানুষের বিশৃঙ্খলা বড় ক্লান্তিকর মনে হয়। এই জটাজাল পার হয়ে বড় রাস্তায় গিয়ে ভিড়ের বাসে ঠেলে ওঠা গন্ধমাদন বহন করার মতোই কঠিন ব্যাপার। অমলের হাল ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করে। মনে হয় সে কখনওই কোথাও গিয়ে পৌঁছতে পারবে না।
পৌঁছনোর কোনও তাড়াও নেই তার। ভিড় একটু হালকা হওয়ার জন্য থাম ঘেঁষে সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। নিজের গন্তব্য বিষয়ে সে যেন নিশ্চিত নয়। বউ, ছেলে, মেয়ের প্রতি সাধারণ গৃহস্থের যেমন টান থাকে কেন তার সেরকম নেই তা সে ভেবেও পায় না।
এর মূলে কি পারুল? ওই নামটা তার মনের মধ্যে উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অ্যাড্রেনালিন প্রবাহ বেড়ে যায়। এখনও। বাড়ে অস্থিরতা। আর আচমকা অন্ধ রাগ তাকে ছোবল মারতে থাকে। পারুলকে তার খুন করতে ইচ্ছে করে, আর কাঁদতে ইচ্ছে করে পারুলের জন্যই।
মোনালিসা বিয়ের সাত দিনের মধ্যেই জেনে গিয়েছিল সব কিছু।
নতুন বউয়ের প্রতি আদিখ্যেতার অভাবই মোনালিসাকে হয়তো একটু সন্দিহান করে থাকবে। তারপর উড়ো কথা, ফিসফাস, রটনা এসব থেকেও কিছু আঁচ করে নিয়েছিল। গোয়ায় মধুচন্দ্রিমা যখন নিতান্ত ম্যাড়ম্যাড়ে, রসকষহীন একটা সাইট সিয়িং-এ পর্যবসিত হয়ে যাচ্ছিল তখনই কথাটা তুলেছিল মোনালিসা।
পারুল কে?
পারুল! পারুল একটা বন্ধ দরজা।
দরজা বন্ধ হলেও ওপাশে কেউ তো থাকতেও পারে।
সে আছে। পারুলের কথা নিয়ে আমাদের ভাববার দরকার নেই।
তুমি রবীন্দ্রনাথের মধ্যবর্তিনী গল্পটা পড়েছ?
না। কিন্তু প্লিজ, গল্পটা আমাকে আবার শোনাতে বসো না।
যে মানুষটা অ্যাবসেন্ট তার প্রেজেন্স অনেক সময়ে খুব স্ট্রং হয়ে ওঠে।
এসব তো ফিলজফি।
তাই কি? ফিলজফিও কিন্তু ফ্যালনা নয়।
লিভ পারুল অ্যালোন, প্লিজ মোনা।
তোমার আর আমার মধ্যে পারুল যে বড্ড বেশি ঢুকে বসে আছে।
উত্তেজিত অমল বলেছিল, না, নেই! নেই!
অত জোর দিয়ে বলছ বলেই সন্দেহ হচ্ছে।
পারুলের কথা মনে হলেই আমার মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে। ও আমাকে ভীষণ অপমান করেছিল।
আমি পারুলের বিষয়ে আরও একটু জানতে চাই। বলবে?
পারুল একটা নষ্ট মেয়ে।
নষ্ট? কীরকম নষ্ট?
শি ওয়াজ নট ফেইথফুল।
তোমার বোন ছায়া বলছিল, পারুল দেখতে খুব সুন্দর আর খুব ভাল মেয়ে। আমাকে ঠেস দেওয়ার জন্যই বলছিল। কথাটা কি মিথ্যে?
অ্যাপারেন্টলি লোকে ওকে ভালই বলবে।
তুমি বলছ না?
না। পারুল ভাল নয়।
তোমাকে রিফিউজ করেছে বলে?
কেন যে এসব কথা খুঁচিয়ে তুলছ মোনা! অকারণ অশান্তি করে লাভ কী তোমার?
স্বামী আর স্ত্রীর মধ্যে এসব গোপন থাকলে পরে আমাদের অসুবিধে হবে। বরং ফ্র্যাঙ্ক হওয়া ভাল। তাতে আমরা আমাদের প্রবলেমগুলো সর্ট আউট করতে পারব।
তোমাকে নিয়ে আমার কোনও প্রবলেম নেই। আমি তোমাকে ভালবাসি। আমি এখন একজন সুখী মানুষ।
সে তো খুব ভাল কথা। ভালবাসাটা কীরকম জানো? মুখের কথা নয় কিন্তু। কেউ ভালবাসলে সেটা ফিল করা যায়। আমি সেটা ফিল করছি না।
ফিল করছ না, তার কারণ পারুলকে নিয়ে তোমার সন্দেহ দেখা দিয়েছে। সন্দেহ এক মারাত্মক ব্যাধি।
আমি তা জানি। আমার এক কাকিমা স্বামীকে সন্দেহ করত। শেষ অবধি স্বামীর এমন সব অসম্ভব যৌন সম্পর্কের কথা বলত যে আমরা কানে আঙুল দিয়ে পালাতাম। মিথ্যে সন্দেহটাই হল ব্যাধি। আমি তো তোমাকে সন্দেহ করছি না। কাউকে ভালবাসা তো অপরাধ নয়। সন্দেহের কী আছে বল!
এতই ফর্সা ছিল মোনা যে ওর গায়ের তিলগুলো পর্যন্ত তেমন কালো হয়ে উঠতে পারেনি ফর্সা রঙের ঠেলায়। সেগুলো ছিল লালচে বা বাদামি। মুখের একটা খর সৌন্দর্য ছিল। নাকটা পুরুষালি রকমের তীক্ষ্ণ। কিন্তু ওর রূপ চেয়ে দেখার মতো মুগ্ধতা কখনওই অমলকে পেয়ে বসেনি। অসহায় এক দেহভোগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল মোনার প্রতি তার মনোভাব।
পারুলের কথা তুমি না তুললেই আমি স্বস্তি বোধ করব।
সেটা হবে অভিনয়। পারুলের কথা জেনেও তার কথা কখনও তুলব না সে কি হয়?
অতীত নিয়ে পড়ে থাকলে লাভ কী?
অতীত যে কখনও কখনও বর্তমানকে বিষিয়ে দেয়।
তাহলে কী জানতে চাও বলো!
সব জানতে চাই। বলবে?
কোন একটা উপন্যাসে যেন পড়েছিলাম, একটি মেয়ে তার প্রেমিক সম্পর্কে বলছে, আমরা এক বৃন্তের দুটি ফুল, আমাদের ছিঁড়িলেন কেন?
এতটা?
হয়তো এতটাই। ছেলেবেলা থেকে চেনাজানা, যাতায়াত। সেই থেকে একটা বোঝাপড়া। পারুলের সঙ্গে আমার বিয়ে হবে এটা সকলেই জানত। অন্যরকম যে হতে পারে এটা ভাবাই যেত না।
তাহলে অন্যরকম হল কেন? কী নিয়ে তোমাদের বনল না?
আমি জানি না।
অন্য কোনও পুরুষ?
আমি জানি না। শুধু জানি হঠাৎ একদিন পারুল আমাকে ঘেন্না করতে শুরু করে।
তাই কি পারা যায়?
হল তো! আমার কিছু করার ছিল না।
তুমি কোনও দোষ করনি?
না। কোনও দোষ করিনি। তুমি বড় উকিলের মতো জেরা করছ। জেনে রাখো, এসব ঘটনা আমাকে আর স্পর্শ করে না।
শুনেছি পারুল তার মা বাবার পছন্দ করা পাত্রকে বিয়ে করেছে।
হ্যাঁ।
ওর বাবা-মা জোর করে বিয়ে দেয়নি তো!
না। ওঁরা ওরকম লোক নন।
ব্যাপারটা অদ্ভুত। তোমাকে হঠাৎ ঘেন্না করার কী হল?
অহংকারীদের অনেক প্রবলেম মোনা।
পারুল কি অহংকারী?
ভীষণ। শি ইজ অলসো এ পিউরিটান।
পিউরিটান! তার মানে কী?
আমাকে কখনও ওর হাতটাও ধরতে দিতে চাইত না।
মাই গড! তাহলে কি তুমি কখনও ওর পিউরিটি নষ্ট করার চেষ্টা করেছিলে?
এ কথায় আতঙ্কিত হয়ে অমল প্রায় আর্তনাদ করে উঠেছিল, না, না। আমি কিছু করিনি।
কথার চক্করে ফেলে সেদিনই মোনা তার মুখ থেকে সত্যটা প্রায় বের করে ফেলেছিল। আর সেইদিন থেকেই এই চালাক, গোয়েন্দার মতো তদন্তে ওস্তাদ, প্রোবিং, ন্যাগিং মেয়েটিকে সে ভয় পেতে শুরু করে। ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে ঘেন্নাও।
যেই ঘেন্না শুরু হল অমনি অমলের নজরে পড়তে লাগল অদ্ভুত সব ব্যাপার। মনে হত, ওর গালে কি মেচেতা আছে? মাথার চুল তেমন ঘেঁষ নয় তো, টাক পড়ে যাবে কি? নীচের ঠোঁটটা একটু ঝুলে-পড়া না? ইস, দাঁতের সেটিং কী বিচ্ছিরি! বেশ মোটা কিন্তু। লোকে কি ওর মুখখানা একটু চোয়াড়ে দেখে না? হাতে বেশ লোম আছে তো! আর ও কি একটু গোঁফের রেখা?
অথচ অমল জানে নিরপেক্ষ বিচারে তা নয়। মোনা বেশ সুন্দরী। খুবই সুন্দরী। ওর এত বেশি চোখধাঁধানো রূপটাও যেন একটা অপরাধ বলে মনে হত তার।
জার্মানিতে বা ইংল্যান্ডে বা আমেরিকায় তাদের বিবাহিত জীবন যখন পুরনো হচ্ছে তখন তাদের ঝগড়াও হতে লাগল খুব। মোনা মাঝে মাঝেই বলত, তোমাকে বিয়ে না করে পারুল ঠিক কাজই করেছে। পারুলই ঠিক চিনেছিল তোমাকে।
পারুলের নাম মুখে আনার যোগ্যতাও তোমার নেই।
সে যোগ্যতা তোমারও নেই।
এইভাবেই তাদের সম্পর্ক থেকে মুছে-যাওয়া পারুল আবার স্পষ্ট হয়ে উঠত, জেগে উঠত। নবীকরণ হত পারুলের, পারুল তাই পুরনো হতে পারল না, বিস্মৃত হতে পারল না কখনও।
শেষ অবধি ধরা পড়ে গিয়েছিল অমল। একদিন নেশার ঘোরে সে ঘটনাটা প্রকাশ করে দেয়। বউয়ের সামনে, মেয়ের সামনে।
পরদিন মোনা তাকে বলেছিল, আমার এরকম সন্দেহ ছিলই। ছিঃ ছিঃ!
তোম্বা মুখ করে অমল বসে রইল কিছুক্ষণ। তার পর মুখ তুলে বলেছিল, সো হোয়াট! উইল ইউ ডেজার্ট মি?
আমি তোমাকে ছেড়ে গেলেও তো শূন্য স্থান ভরাতে পারুল ফিরে আসবে না।
আমি তোমাকে ঘেন্না করছি মোনা।
তার চেয়ে ভাল হত তুমি যদি নিজেকে ঘেন্না করতে কাপুরুষ।
আশ্চর্যের বিষয় হল, মেয়েদের সহজ সংস্কারবশে মোনার রাগ হওয়ার কথা পারুলের ওপর। কিন্তু অবাক কাণ্ড, সে কখনও পারুলের বিরুদ্ধে একটি কথাও বলেনি কখনও। বরং পারুলের ছবিখানা আলাদা করে সযত্নে অ্যালবামের একটা আলাদা পৃষ্ঠায় সেঁটেছিল সেই। সে জানত, মাঝে মাঝে অমল ছবিটা খুলে দেখে। ধরা পড়লে সংকোচ বোধ করত অমল। কিন্তু মোনা বলত, দেখ, দেখ, ওই ছবি দেখে তোমার বিবেক জাগ্রত হোক।
ভিড় কমেছে। অমল ক্লান্ত পায়ে স্টেশনচত্বর পার হল। এখন তার কানে এত কোলাহল কিছুই ঢুকছে না। বড় আনমনা সে আজ। দিনটা বিচ্ছিরিভাবে শুরু হল। দিনশেষে কী ঘটবে আরও, বলা যায় না। শরীরের ভার টেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। অফুরান মনে হচ্ছে পথ। পথের শেষে কেউ নেই তার। কেউ নেই।
.
১০.
ওইখানে ওই কদমগাছের তলায় শিব এসে দাঁড়ান। বেশ পেল্লায় চেহারা, একটু ভুঁড়ি আছে, বেশ বড় জটা, গোঁফ আছে, দাড়ি নেই। কাঁধ আর মাথার ওপর তিনটে সাপ ফোঁস ফোঁস করছে ফণা তুলে। বাঁ হাতে কমণ্ডলু, ডান হাতে ত্রিশূল, পরনে শুধু বাঘছাল। পিছনে ষাঁড়। শিবঠাকুর তাকে ডেকে বলেন, বৎস, তুমি তিনটে বর চাও।
মরণের এইখানেই মুশকিলটা হয়। তার এত কিছু চাওয়ার আছে যে তিনটে বরে তার সিকিভাগও হয় না। কিন্তু ঠাকুর-দেবতাদের নিয়মই হল, তিনটের বেশি বর দেন না, তাই মরণ খুব হিসেবনিকেশ করে রোজ। এমন তিনটে বর চাইতে হবে যে, আর কিছু চাওয়ার না থাকে। খুব কায়দা করে, বুদ্ধি খাটিয়ে তিনটে বর তৈরি রাখতে হবে। শিবঠাকুর একটু ভোলেভালা আদমি। কৌশল করে যদি একটা বরের মধ্যেই তিন-চারটে বর ঢুকিয়ে দেওয়া যায় তাহলেও হয়তো খেয়াল করবে না। এই নিয়ে তার গ্যাঁড়ার সঙ্গে কথাও হয়েছে। গ্যাঁড়ার অবশ্য বর নিয়ে তেমন কোনও সমস্যা নেই। সে শুধু চায় অমিতাভ বচ্চনের মতো লম্বা হবে, কুংফু ক্যারাটের ওস্তাদ হবে আর বড় হয়ে আমেরিকায় যাবে। ব্যস, ওতেই তার তিনটে বর ফুস।
কিন্তু মরণের সমস্যা অত সরল নয়, প্রথমে সে ভেবেছিল, শিবঠাকুরের কাছে রসিক বাঙালের বদলে একজন ভাল বাবা চেয়ে নেবে। কিন্তু পরে ভেবে দেখেছে, তার মা রসিক বাঙাল বাবাকে এতই ভালবাসে যে, বাবা বদলালে মা কেঁদেই মরে যাবে। তার চেয়ে বরং রসিক বাঙালই তার বাবা থাক, শুধু মেজাজটা অমন তিরিক্ষি না হয়ে যেন একটু নরম-সরম হয়, আর তাকে যেন ন্যাংটো করে চান না করায়, আর যেন ন্যাড়া করে না দেয়। দুনম্বর হল, কলকাতার বড়মা আর দাদা-দিদিরা যেন বেশ ভাল লোক হয় আর তারা যেন তাকে খুব ভালবাসে। মরণের মাঝে মাঝে মনে হয়, বোনটা হওয়ার পর থেকে তার মা যেন তাকে আর ততটা ডাক-খোঁজ করে না। তার ধারণা, এক মায়ের জায়গায় দুটো মা হলে আদর-টাদর ডবল হয়ে যাবে। সুতরাং তার দুনম্বর বর হল, বড়মা আর দাদা-দিদিরা যেন এখানে এসেই থাকে। তিন নম্বর বরটা নিয়ে সে খুব ভাবছে। ভেবে কোনও কূলকিনারা করে উঠতে পারছে না।
সকাল থেকে জিজিবুড়ি বারবার টানা মারছে। মুখ শুকনো। চোখ কপালে উঠেছে, সাতসকালে এসে ধপাস করে বারান্দায় বসে পড়ে খানিক হাঁফ ছেড়ে বলল, ওরে ও বাসি, কাল রাত থেকে বাড়িতে যে সুন্দ-উপসুন্দের লড়াই হচ্ছে। তিষ্ঠোতে দিচ্ছে না যে।
মরণের মা দোতলার বারান্দা থেকে ঝুঁকে বলল, আহা, ভারী নতুন বৃত্তান্ত কিনা। ও তো নিত্যি হচ্ছে।
জিজিবুড়ি কাহিল গলায় বলে, এ তা নয় মা, এবার একটা খুনোখুনি না হয়ে যায়। সারা রাত কুরুক্ষেত্তর হল, সকালেও হচ্ছে। পাড়াসুদ্ধ সবাই ঝেটিয়ে এসে মজা দেখছে। এই রঙ্গে লোক।
ছেলেদের যেমন শিক্ষা দিয়েছ তেমনই তো হবে। আমার ধান চাল কম হরির লুট করেছে? ধার বলে টাকা নিয়ে যায়, একটা পয়সা আজ অবধি শোধ করেনি, মায়ের পেটের ভাই বলতে লজ্জা করে।
ওঃ, খুব যে ফোঁটা কেটে বষ্টুমি হয়েছিস আজ। তুইও তো একই ঝাড়ের বাঁশ। বাঙালের টাকায় দুদিন ধরে না হয় ফুটুনি করছিস, তা বলে নিজের জনদের দিকে চাইবি না? এই কি ধর্মের বিচার?
আমাকে আর ধর্ম দেখিও না মা, তোমার গুণধর ছেলেরা আমার সর্বনাশ করে পথে বসাতে চেয়েছিল, তখন তোমার ধর্ম কি পাশ ফিরে ঘুমাচ্ছিল নাকি? এখন যেই অশান্তি লেগেছে অমনি নাকি কান্না কাঁদতে এসেছ! ধর্ম এখনও আছে বলেই দু ভাইয়ে খুনোখুনি হচ্ছে। আরও হোক, সত্যনারায়ণের সিন্নি দেব।
বলতে পারলি ও কথা? অভাবের সংসার বলে ঝগড়া হয়, তা কোথায় না হচ্ছে শুনি? তা বলে নিজের ভাইদের শাপশাপান্ত করবি? এতে কি তোরই ভাল হবে ভেবেছিস?
খবরদার মা, শাপশাপান্ত করবে না বলে দিচ্ছি। সেবারও খুঁড়েছিলে বলে ছেলেটার একশো চার-পাঁচ জ্বর উঠেছিল, তোমার মুখে বিষ আছে, শাপশাপান্ত করলে এ বাড়িতে ঢোকার দরজা বন্ধ হয়ে যাবে।
জিজিবুড়ির গুণ হল টক করে ভোল পালটাতে পারে। হঠাৎ ভারী নরম হয়ে বলল, ওমা! খুঁড়লুম কোথায়? বলছিলুম যে, মেয়েদের বাপের বাড়ির ওপর কত টান থাকে, তুই যে কেন ওদের ওরকম বিষনজরে দেখিস।
জিজিবুড়ি কিছুক্ষণ বারান্দার থামে মাথা হেলিয়ে বসে রইল। তারপর বলল, তোকে তো ওবাড়িতে যেতে বলিনি। বলছিলুম, দু ভাইয়ের একটা ব্যবস্থা করে দে। বাঙালকে বল না তার দোকানে কর্মচারী করে নিক।
আর বাঁধানো কথা বোলো না তো মা। তোমার ছেলেরা সেই চরিত্রের মানুষ কিনা! দোকানের টাকা ভেঙে জুয়ো খেলবে, মদ-গাঁজা খাবে, গুণের তো শেষ নেই।
জিজিবুড়ির সঙ্গে সবসময়ে পানের বাটা থাকবেই। এসব কথার পর পান সাজতে সাজতে বলল, বাঙালের ঘর করে করে তোরও মায়া-দয়া সব উবে গেছে। বাঙাল এলে এবার না হয় আমিই তাকে বলব, দুদুটো হুমদো হুমদো সম্বন্ধী বেকার বসে আছে বাপু, দোষঘাট থাকতে পারে, কুটুম তো, তাদের কথাও একটু ভেব বাপু। না হয় বাসরাস্তায় দুখানা মুদির দোকান করে বসিয়ে দাও।
আহা, একেবারে গিল্টি করা কথা। দোকান করে বসিয়ে দাও। তোমার ভীমরতি হলেও তার তো হয়নি। সম্বন্ধীদের সে খুব চেনে। তুমিই চিনলে না কী ছেলে পেটে ধরেছ!
ভীমরতি কি তোকেও ধরতে বাকি রেখেছে? ক বিঘে জমি আর একটা পাকা বাড়ি পেয়ে আহ্লাদে ডগমগ হয়ে আছিস। বাঙালের যে লাখো লাখো টাকা কারবারে খাটছে তার কাছে এ তো চুষিকাঠি। দেবে ভেবেছিস তোকে সে টাকার ন্যায্য ভাগ? সব ওই বড়বউয়ের গর্ভে যাচ্ছে। বাঙাল চোখ বুজলে উকিল লাগিয়ে আইনের প্যাঁচে তোর সম্পত্তিও এক ঝটকায় নিয়ে নেবে। তাই বলছি, এখনও সময় আছে, সব বুঝেসুঝে নে। দুটো দোকান না হয় তোর নামেই করে দেবে, ভাইরা খেটেখুটে, দোকান চালিয়ে তোর ন্যায্য পাওনা-গণ্ডা মাসকাবারে মিটিয়ে দেবে।
সাধে কি বলে যে, তোমার মুখে বিষ! এর মধ্যে আমার স্বামীর মরণের ভাবনাও ভেবে ফেলেছ! তোমার আর কবে আক্কেল হবে মা? জামাইয়ের বাড়বাড়ন্ত দেখে তোমার চোখ টাটায় কেন? মেয়ে সুখে আছে সেও তোমার সহ্য হয় না। তুমি কেমনধারা মানুষ?
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জিজিবুড়ি উঠে পড়ল। বলল, জামাইয়ের বাড়বাড়ন্ত দেখেই তো বলছি, বেশি বাড়ও তো ভাল নয়। তোর ভাল ভেবেই বলছি, টাকাপয়সা নগদ যা পারিস ঝেঁকে নে। বাসরাস্তায় দুখানা দোকানঘর বন্দোবস্তে আছে শুনেছি। দশ বিশ হাজারে হয়ে যাবে।
তুমি এখন যাও তো, আমার মাথাটা আর খারাপ করে দিও না।
জিজিবুড়ি গেল, পড়া ফেলে দিব্যি জানালা দিয়ে দৃশ্যটা দেখে খুব হাসছিল মরণ। আজ মায়ের হাতের রান্না খুলবে। রেগে গেলে মা দারুণ রাঁধে।
জিজিবুড়ি আর দুবার এল, শেষবার দশটা নাগাদ। এসে বলল, ও বাসি, কাল রাত থেকে দানাপানি জোটেনি মা, ছোটবউ খানকির মেয়ে ওই নয়নটা এমন ধাক্কা দিয়েছে যে কাঁকাঁলে বড্ড ব্যথা, আজ তোর এখানে দুটো ভাতে ভাত করে দিবি? এক ফোঁটা ঘি দিয়ে
আজ সুবিধে হবে না মা, আজ তোমার জামাই আসছে।
মোলো যা, আজ আবার বাঙাল আসছে কেন?
তাতে কি তোমার গতরে শুঁয়োপোকা ধরল? তার বাড়িতে সে আসবে, তাতে কথা কীসের?
তাই কি বললুম, বলছি, আজ তো আর শনিবার নয়, কাজকারবার ফেলে আসছে তো!
তার বিশ্বাসী কর্মচারী আছে, তোমার অত মাথাব্যথা কীসের?
ঘরে যে যেতে পারছি না মা, ধুন্ধুমার কাণ্ড দেখে এসেছি একটু আগে। শোনা যাচ্ছে থানা-পুলিশেও খবর গেছে। তারা এল বলে! কী যে হবে কে জানে বাবা।
কী আবার হবে, নতুন বৃত্তান্ত তো নয়। থানা-পুলিশ তো আগেও হয়েছে। চাটুজ্যেদের গোরু নিয়ে হাটে বেচে দিয়ে তোমার বড় ছেলে হাজতে গিয়েছিল মনে আছে?
মনে আছে বাবা, সব মনে আছে। কপালের দোষ মা, ও কি খণ্ডায়?
দুধ চিঁড়ে দিয়ে ফলার করতে পার। ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
মুখটা বিকৃত করে জিজিবুড়ি বলে, ম্যাগো, পেটে এখন ভাতের খিদে, দুধ চিঁড়ে কি গলা দিয়ে নামে বাছা!
ঠিক আছে। মরণের ঘরে গিয়ে বসে থাক, ভাতের কথা বলেছ, গেরস্থের ঘর বলে কথা, খেও খন দুপুর বেলায়।
তবে দুটো পোস্তর বড়া করিস আর একটু টক, টক ছাড়া মুখে রোচে না।
মরণের আজ দুঃখের কপাল, বাবা আসছে, বাবা আসা মানেই যমদূতের আগমন, আজ সকাল থেকেই মা পড়তে বসিয়ে দিয়েছে। পড়ছে তো লবডঙ্কা, কিন্তু পড়ার টেবিলে বই-খাতা মুখে করে এই বসে থাকাও এক যম-যন্ত্রণা। বাইরে খোলা মাঠঘাট আয়-আয় করে ডাকছে। স্কুলটা খোলা থাকলেও না হয় হত। কিন্তু কপাল খারাপ, স্কুলের এক প্রাক্তন হেডমাস্টার মারা যাওয়ায় স্কুলও আজ ছুটি।
হ্যাঁ লা বাসি, তোর ঘরে কি পান আছে?
মা দোতলা থেকেই বলল, না মা, আমরা কেউ পান খাই নাকি যে থাকবে?
তবে যে মুশকিল হল। আমার পান ফুরিয়েছে, পান ছাড়া আমার এক দণ্ড চলে না। ও ভাই মরণ, দিবি এনে একটু পান?
মরণ আনন্দে লাফিয়ে উঠল, এক লাফে উঠোনে নেমে বলল, পয়সা দাও এনে দিচ্ছি।
ওপর থেকে মা ধমক দিয়ে বলে, ওকে বলছ কেন মা? ওর বাবা টের পেলে রাগ করবে। ওই মুনিশ-টুনিশ কেউ এলে এনে দেবে খন।
মরণ ঊর্ধ্বমুখ হয়ে করুণ গলায় বলে, আমার পড়া হয়ে গেছে মা, এক ছুটে যাব আর আসব।
তোর বাবা এসে যদি দেখে–
বাঃ, তা বলে সারা দিন পড়ব নাকি? সকাল থেকে তো পড়ছি৷
ওঃ, কী রকম পড়া তা খুব জানা আছে। বই খুলে বসে থাকলেই বুঝি পড়া হয়?
যাই না মা।
বাসন্তী আর আপত্তি করল না, বলল, যাবে যাও, দয়া করে তাড়াতাড়ি ফিরো।
পয়সা নিয়ে মরণ দুই লাফে বেরিয়ে পড়ল। ছুটি! ছুটি!
অবারিত মাঠ-ঘাট, আলো-হাওয়ায় এসে বুকটা হাঃ হাঃ করে হেসে ওঠে তার। ছুট! ছুট! হালকা পায়ে খানিকক্ষণ দৌড়ে নেয়, কদমতলায় দুর্গাপূজার প্যান্ডেল হচ্ছে। দাঁড়িয়ে একটু দেখে নেয় সে। দক্ষিণপাড়ায় ফুটবল ম্যাচ। তাও একটু দেখে, তারপর হাঁটতে থাকে। পান্নাদির বাড়ি থেকে ঘুঙুরের আওয়াজ আসছে। ঘোষ জ্যাঠাইমার বাড়ি থেকে গুড় আর নারকেল পাক দেওয়ার মিঠে গন্ধ। আর রায়বাড়ির বারান্দায় আজও সেই মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে, যাকে দেখলে ঠিক মনে হয় এক রাজপুত্তুর এসে ওকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে বলে অপেক্ষা করে আছে। চাটুজ্যে বাড়ি থেকে খুব হাসিখুশির একটা শব্দ আসছে। খোলা উঠোনে কানামাছি খেলছে একদঙ্গল হুমদো হুমদো মেয়ে-পুরুষ, মাঝখানে ওটা পারুলমাসি না? হ্যাঁ, পারুলমাসিই। রুমালে চোখ বাঁধা পারুলমাসি হাসতে হাসতে টলোমলো পায়ে দু হাত সামনে বাড়িয়ে কাউকে ছোঁয়ার চেষ্টা করছে। মাঝে মাঝে এরকম জমায়েত হয়, আবার সব সুনসান হয়ে যায়। দাদু আর দিদা একা পড়ে থাকত, দাদু ওই একতলার বড় দালানের বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে থাকত সকালের দিকটায়, তাকে দেখলেই ডাক দিত, এই বাঙাল আয় তো দেখি তোর লেজ আছে কিনা। গৌরহরি দাদু বাবাকে বড় ভালবাসত। বলত, বাঙালটার রসকষ কম বটে, কিন্তু লোকটা জব্বর খাঁটি, আর এখন দিদা একদম একা, মরণ মাঝে মাঝে হাজির হয়ে যায় এসে। দিদার নারকেল বা সুপুরি পেড়ে দেয়, গোয়ালঘরের চাল থেকে চালকুমড়ো। দিদা প্রায়ই রাগ করে বলে, তুই তো বড়লোকের ছেলে, তবে কেন চেহারাটা অমন চাষাভুসোর মতো করে রেখেছিস? ভাল জামাকাপড় নেই তোর? দাঁড়া তোর বাবা আসুক, বলব।
কানামাছি খেলায় কাউকে ছুঁতে পারল না পারুলমাসি। একটা টু দিয়ে পালাচ্ছিল বিজুদা, ছুঁতে গিয়ে দক্ষিণের দালানের বারান্দায় উপুড় হয়ে পড়ে গিয়ে হেসে উঠল। কাকে কী ডাকবে তার বেলায় সম্পর্কে ঠিক রাখতে পারে না মরণ। গৌরহরিদাদুর ছোট ভাই রামহরিকে সে ডাকে জ্যাঠামশাই। আবার পারুলমাসির খুড়তুতো বোন পান্নাদিকে তো দিদিই ডাকে সে। মা অবশ্য বলেছে, ওদের সঙ্গে তো আর আত্মীয়তা নেই, যা খুশি ডাকতে পারিস।
বাসরাস্তার কাছে এসে খানিক দাঁড়িয়ে লোকজন দেখল মরণ, বেশ লাগে তার। বেঁটে, লম্বা, সরু, মোটা, কালো, ফর্সা কত রকমের যে লোক আছে দুনিয়ায়। কোথা থেকে যে আসে আর কোথায় যায়।
গাঁ গাঁ করে বর্ধমানের একটা বাস এসে ধুলো উড়িয়ে থামল। লোক নামছে। বাবা নামে কিনা তা সতর্ক চোখে দেখছিল মরণ। না, বাবা নামল না। তবে সবার শেষে যে নামল তাকে সে খুব চেনে। তার স্কুল থেকেই অমলদা মাধ্যমিকে স্ট্যান্ড করেছিল। সারা গ্রামে নাকি হুলস্থুল পড়ে গিয়েছিল সেই ঘটনায়। স্ট্যান্ড করা ছেলে দেখলে কি বোঝা যায়? মরণ তো কিছু বুঝতে পারে না। লোকটা কেমন টালুমালু চোখে চারদিকে চাইল, যেন জায়গাটা চিনতে পারছে না। ডান হাতের ভারী অ্যাটাচি কেসটা টানতে লোকটার যেন কষ্ট হচ্ছে। মাথায় বড় বড় চুল, এলোমেলো হয়ে কপালে ঝুলে আছে। মুখটায় রাজ্যের দুশ্চিন্তা যেন। মরণের একবার ইচ্ছে হল, গিয়ে বলে, দিন আপনার অ্যাটাচি কেসটা পৌঁছে দিয়ে আসি। কিন্তু কেমন যেন সাহস হল না।
দীনু সিংহের এস টি ডি বুথের পাশে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ লোকের টেলিফোন করা দেখল সে, মাঝে মাঝে তার খুব ইচ্ছে হয় এখান থেকে বড়মার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে। কিন্তু সাহসে কুলোয় না। বড়মা তাকে চিনতেই পারবে না।
আর একটা বাস এসে ওই দাঁড়াল। লোক নামছে। আর হঠাৎ সে ভিড়ের মধ্যে এক মাথা উঁচু তার বাবা বাঙালকে দেখতে পেল।
পাঁই পাঁই করে ছুঁটতে লাগল মরণ, হঠাৎ খেয়াল হল, এই যা, পান কেনা হয়নি যে!
পান কিনতে বাজারের নাবালে নেমে গিয়ে সে একটু আড়াল হয়ে দেখতে গিয়ে দেখল, বাবা একা নয়, সঙ্গে একটা সুন্দরমতো ছেলে, আঠারো-উনিশ বছর বয়স হবে। হাতে স্যুটকেস। ছেলেটার মুখ খুব গম্ভীর।
পানটা কিনেই ফের ছুট লাগাল মরণ। বাড়িতে ঢুকেই অভ্যাসবশে চেঁচাল, ও মা, বাঙাল এসেছে, সঙ্গে বোধহয় দাদা!
দোতলার রেলিং-এর ওপর ঝুঁকে বাসন্তী বলল, সঙ্গে কে বললি?
মনে হচ্ছে দাদা, বেশ লম্বাপানা, সুন্দর দেখতে।
ও মা গো! এখন কী হবে!
কী হবে মা?
কী জানি কী হবে বাবা! বড্ড ভয় করছে। শহুরে ছেলে। ঘরদোর তো গোছগাছও করা নেই, ও মরণ, তোর দিদিমাকে বল যেন এ সময়ে ঘর থেকে না বেরোয়।
আমি কি ফের পড়তে বসব মা?
আর পড়ার দরকার নেই বাবা, বরং ওপরে এসে ফর্সা জামা-প্যান্ট পরে যা, ফিটফাট না দেখলে কী মনে করবে।
একটু বাদে উঠোনের ওপর যে দৃশ্যটা দেখা গেল সেটা যেন যাত্রা- থিয়েটারের একটা সিন। মাকে কোনওদিন সাজতেগুজতে দেখে না মরণ। এমনকী যেদিন বাবা আসে সেদিনও না। কিন্তু মা আজ পাটভাঙা একটা ঢাকাই শাড়ি পরেছে, চুল আঁচড়ানো, মাথায় ঘোমটা, কপালে টিপ, তাড়াহুড়োয় যতটা করা যায়। মায়ের পাশে ইস্তিরি করা নীল জামা আর খাকি হাফ প্যান্ট পরা মরণ। তারও চুল আঁচড়ানো, পায়ে আবার হাওয়াই চটি–যা সে কস্মিনকালেও পরে না। তিন পা পিছনে বোনটাকে কোলে নিয়ে মুক্তাদি দাঁড়িয়ে। সব কেমন অ্যাটেনশন হয়ে আছে। মায়ের মুখটা দেখে মায়া হচ্ছে মরণের, কেমন কান্না কান্না ভাব, অথচ ঠোঁটে আবার একটু হাসিও। মা ভীষণ ঘাবড়ে গেছে, বারবার ঢোঁক গিলছে।
ও মুক্তা, সব ঠিক আছে তো, উঠোনটা ভাল করে দেখেছিস? কোথাও গোবর-টোবর বা কুকুরের গু পড়ে নেই তো?
না বউদি, সব দেখেছি।
একটু আগে জিজিবুড়ি মরণের ঘর থেকে জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখে বলেছিল, আদিখ্যেতা দেখে মরে যাই, যেন বড়লাট আসছেন।
মা যেন উঁকিঝুঁকি না দেয়, বলেছিস?
হ্যাঁ, কিন্তু এঃ মা, তুমি যে দু পায়ে দু রঙের চটি পরে আছ।
বাসন্তী নিজের পায়ের দিকে চেয়ে জিব কেটে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, এমা কী হবে?
মুক্তা বলল, দাও তো, কচুগাছের আড়ালে রেখে দিয়ে আসি।
খালি পায়ে থাকব, কেমন দেখাবে?
এর চেয়ে তো ভাল।
মরণ ফিক করে হেসে ফেলেছিল। বাসন্তী তার দিকে চেয়ে ধমকে বলল, ওরকম হাসতে নেই, দাদা উঠোনে এসে দাঁড়ালে গিয়ে পেন্নাম করিস, বাবাকেও, মনে থাকে যেন!
মরণ জানে, এসব তাকে একটু আগেই শিখিয়েছে মা।
হ্যাঁ রে ভুল দেখিসনি তো! আসতে দেরি হচ্ছে কেন?
বাবা তো মাঝে মাঝে কেনাকাটা করতে বাজারে ঢোকে।
যত দেরি হচ্ছে তত আমার বুক কাঁপছে বাবা। ও মুক্তা, মেয়েটা কাজলের টিপটা জেবড়ে ফেলেনি তো!
না বউদি, কাঁধে মাথা রেখেছে, ঘুমোবে মনে হয়।
একটু জাগিয়ে রাখ, ওর বাবা আবার এসে মেয়েকে জাগা না দেখলে খুশি হয় না। আর হাঁক দিয়ে মুনিশটাকে বল তো, এ সময়ে যেন হুট করে গোরু-ছাগল না ঢুকে পড়ে উঠোনে।
জানালা দিয়ে জিজিবুড়ির গলা পাওয়া গেল, গাঁয়ে তো গোরু-ছাগলই থাকে রে বাপু, আর সেসব দেখতেই তো বাবু ভায়েরা আসে।
ফের ফিক করে হেসে ফেলল মরণ, ইস্তিরি করা জামায় তার গরম লাগছে। এমন কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকারও অভ্যাস নেই তার। কেবল মনে হচ্ছে তারা একটা থিয়েটারের পার্ট করতে নেমেছে।
একটু চুপ করবে মা? মুখে আঁচল ঢুকিয়ে বসে থাকো তো, যখন তখন ফুট কেটো না, আমার বলে বুক কাঁপছে আর উনি কুট কুট করে কথা ফোঁটাচ্ছেন, ও নবীনা তোর হল?
দোতলার বারান্দায় বেরিয়ে এসে নবীনা বলল, হ্যাঁ গো বউদি, ফুলদানিতে ফুল সাজিয়েছি, ছোট কার্পেটটাও পেতে দিয়েছি।
বেডকভারটা টানটান করে পেতেছিস তো!
হ্যাঁ গো, ধূপকাঠিও জ্বালিয়ে দিয়েছি।
বারান্দার কাপড় মেলার দড়িগুলো খুলে ফেল, বিচ্ছিরি দেখাচ্ছে।
মরণেরও একটু বুক কাঁপছে, তেষ্টা পাচ্ছে। সে জানে তাদের পরিবারটা আর পাঁচ জনের মতো নয়। কলকাতা আর পল্লীগ্রাম ভাগ হয়ে যাওয়া একটা ব্যাপার আছে তাদের। একবার ক্লাসে একটা ছেলের সঙ্গে তার ঝগড়া হয়েছিল। ছেলেটা ঝগড়ার সময়ে বলে ফেলেছিল, যা যা, বেশি কথা বলিস না, তোর বাবার তো দুটো বউ।
বাড়িতে এসে সে মাকে জিজ্ঞেস করেছিল, দুটো বউ থাকা কি খারাপ মা?
মা বলেছিল, খারাপ কেন বাবা? যার সাধ্য আছে সে দুটো-তিনটে বিয়ে করতেই পারে। আগে তো আরও কত বিয়ে করত লোকে।
তবে যে ওরা বলে!
বলে বলুক। ওদিকে কান দিও না, বাবার ওপর যেন অশ্রদ্ধা না আসে। তোমার বাবা ভাল লোক।
সে তো জানি। কিন্তু লোকে বলে যে, আইন নেই নাকি!
আইন কি মানুষের জীবনের সঙ্গে সবসময়ে মেলে? দরকার পড়লে মানুষকে কত বে-আইনি কাজ করতে হয়। আমি না থাকলে তোমার বাবার এত বিষয়সম্পত্তি কে যক্ষীর মতো আগলাত বলো তো! লোকের কথায় কান দিও না, বড় হলে নিজেই বুঝতে পারবে সব কিছু।
বাবার দুই বিয়ের কথা আজকাল খুব ভাবে মরণ। মনে হয় তার বাবার দুটো ভাগ। একটা শহরে লোক আর একটা গেঁয়ো লোক। ওই বড়মা, দাদা, দিদি ওরা একটু ওপরতলার লোক। সে তার মা, বোন এরা সব একটু নিচুতলার লোক। তাই তার বুক কাঁপছে, তেষ্টা পাচ্ছে।
উঁচু মাথার লোকটাকে শেফালি ঝোপের ওপর দিয়ে এক ঝলক দেখা গেল।
মরণ চাপা গলায় বলল, ওই আসছে!
সঙ্গে ছেলে আছে ঠিক দেখেছিলি তো!
সেরকমই তো মনে হল।
আগে জানলে একটু আয়োজন করে রাখতাম। কী খেতে ভালবাসে তাই তো ভাল করে জানি না।
মায়ের যে কত উদ্বেগ! ভয়ে ভাবনায় কাঁটা হয়ে আছে। মরণের একটু কষ্ট হয় মায়ের জন্য।
কই গো! আরে দ্যাখো কারে আনছি! বলতে বলতে রসিক বাঙাল আগর ঠেলে উঠোনে ঢুকল। হাতে একটা মস্ত ইলিশ মাছ। সামনেই তাদের এমন নাটুকে ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থমকেও গেল। পিছনে লম্বাপানা, ফর্সা, ছিপছিপে সুন্দর ছেলেটা, মরণ জানে তার দাদা সুমন উচ্চ মাধ্যমিকে স্টার পেয়ে পাস করেছে। ডাক্তারি পড়বে বলে জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষাও দিয়েছিল। পাসও করেছে হয়তো। সে মুগ্ধ স্বপ্নাচ্ছন্ন চোখে চেয়ে রইল।
মা হাসি কান্না মেশানো মুখে বলল, এই বুঝি–?
আরে হ, এই হইল সুমন। হারু বইল্যাই ডাইক্যো, আয় রে হারু, এই হইল গিয়া তর ছোটমা। আরে, বান্দরটা দেখি আইজ সাইজ্যা গুইজ্যা খাড়াইয়া আছে!
মরণ গিয়ে টপাটপ প্রণাম সেরে ফেলল।
দাদা মাকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে যাচ্ছিল, মা প্রায় সাপ দেখার মতো চমকে গিয়ে পিছিয়ে তার হাত ধরে ফেলে বলল, না না, ছিঃ ছিঃ আমাকে প্রণাম করতে হবে না বাবা, এসো, কতকাল পথ চেয়ে আছি তোমাদের জন্য। আমি এক অভাগী মা।
এসব কথা মা বোধহয় আগে থেকে তৈরি করে রেখেছিল মনে মনে। অভাগী মা কথাটা ঠিক খাটল না যেন, ঘাবড়ে গিয়ে মা নাটকের ডায়লগ দিচ্ছে।
তবে হ্যাঁ, দাদাটাকে খুব পছন্দ হল মরণের। হালকা নীল জিনসের প্যান্ট আর খুব কারুকাজ করা লম্বা ঝুলের পাঞ্জাবিতে খুব টং দেখাচ্ছে। নরম পাতলা গোঁফ আছে, অল্পস্বল্প দাড়িও। মাথায় বেশ ঢেউ খেলানো লম্বা চুল, ডান ধারে সিঁথি, কাঁধে একটা ব্যাগ।
ও মরণ দাদাকে দাদার ঘরে নিয়ে যা বাবা।
সুমন ওরফে হারু চারদিকটা চেয়ে দেখছিল। তার দিকে ফিরে বলল, তুমি মরণ?
মরণ কৃতার্থ হয়ে গেল। ঘাড় হেলিয়ে বলল, হ্যাঁ।
আর বোনটা?
মা বলল, ওই তো মুক্তার কোলে। ঘুমিয়ে পড়ল বোধহয়। যাও বাবা, তুমি ঘরে গিয়ে একটু বিশ্রাম করো। জামাকাপড় পালটাও, চা খাবে তো!
না, আমি চা খাই না।
কী খাবে এখন বলল তো! ময়দা মাখা রয়েছে, একটু লুচি-টুচি ভেজে দেব?
না। খেয়ে এসেছি। একেবারে দুপুরে খাব।
গলার স্বরটা বড় ভাল দাদার। বেশ গমগমে। একটু লাজুক আছে। চোখ তুলে চাইছে না বেশি।
জড়তা, আড়ষ্টতা, লজ্জা অনেক কিছু মিশে আছে দু পক্ষের সম্বন্ধের মধ্যে।
হাত বাড়িয়ে মাছটা মার হাতে দিয়ে বাবা বলল, ভাপা কইরো তো, প্যাটে ডিম থাকলে ভাইজ্যা দিও।
এখন খাওয়া-দাওয়া নিয়ে মাতে আর বাবাতে কিছুক্ষণ কথা হবে। বাঙালরা খুব খাওয়া নিয়ে কথা কইতে ভালবাসে।
তার পিছু পিছু দাদা উঠে এল ওপরে। দক্ষিণ পশ্চিমের বড় ঘরখানায় ভুরভুর করছে চন্দন ধুপকাঠির গন্ধ। খোলা জানালা দিয়ে আলো-হাওয়া আসছে। এক ধারে বড় খাটের ওপর বিছানা। নতুন একটা ফুলকারি বেডকভার দিয়ে ঢাকা, খাটের পাশে টুল, তার ওপর ঢাকা দেওয়া কাচের গ্লাসে জল, পাশে সাদা স্বচ্ছ প্লাস্টিকের জগে আরও জল। দুটো স্টিলের ফোল্ডিং চেয়ারের ওপর আসন পাতা। ঘরের কোণে একটা টেবিলে কিছু বই। তাদের বাড়িতে বেশি বই নেই। যে কখানা আছে তাই মা টেবিলে সাজিয়ে রেখেছে। টেবিলের ওপর ফুলদানিতে টাটকা কিছু গোলাপ আর গোলাপের ফাঁকে ফাঁকে ছড়িয়ে রাখা শিউলি ফুল। এ-ঘর অনেকদিন ধরেই দাদার জন্য সাজিয়ে রেখেছে মা। যদি কখনও আসে!
দরজায় দাঁড়িয়েই ঘরটা একটু দেখল সুমন। তারপর তার দিকে চেয়ে একটু লজ্জার হাসি হেসে বলল, আমার একটা জিনিস ভুল হয়ে গেছে। বাড়িতে পরার চটি আনিনি। এখানে হাওয়াই চটি পাওয়া যায় না?
হ্যাঁ, বাজারে মাখন দাসের দোকানে ভাল জিনিস পাওয়া যায়। এনে দেব!
পরে হলেও চলবে।
চটি বাইরে ছেড়ে ঘরে ঢুকল সুমন। ব্যাগটা বিছানায় রেখে তার দিকে চেয়ে বলল, এ ঘরে কে থাকে?
আপনি না তুমি কী বলবে ঠিক করতে পারছিল না মরণ, শেষমেশ আপনি করে বলাটাই সাব্যস্ত করে বলল, কেউ থাকে না। এ-ঘরটা আপনার জন্যই রেখে দিয়েছে মা।
তাই বুঝি! বলে অবাক চোখে চারদিকটা ফের দেখল সুমন।
ওইটে বাথরুম। আপনি হাতমুখ ধোবেন না?
সুমন একটু হেসে বলল, তার চেয়ে চলো জায়গাটা একটু ঘুরে দেখে আসি।
কোথায় যাবেন?
বিশেষ কোথাও নয়। এমনিই একটু ঘুরে দেখব।
সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে মরণ বলে, চলুন।
যখন নীচে নামল তারা তখনও মায়ের সঙ্গে বাবার খাওয়া নিয়ে কথা হচ্ছে। বাবা মাকে কইমাছ রান্নার একটা পদ্ধতি শেখাচ্ছিল।
মা বলল, ও মা, দাদাকে নিয়ে এই দুপুরে কোথায় চললি? ওর স্নান-খাওয়া নেই?
মরণ জবাব দেওয়ার আগে সুমনই বলল, একটু ঘুরে আসি।
বাবা বলল, যাউকগা, ঘুইরা-টুইরা আসুক। গ্রামের হাওয়া বাতাস লাগাইয়া আসুক একটু শরীরে। কইলকাতায় তো অন্ধকূপে থাকে।
বাইরে বেরিয়ে দাদার পাশে পাশে হাঁটতে হাঁটতে মরণের ইচ্ছে হচ্ছিল সবাইকে ডেকে ডেকে বলে, দেখ, দেখ, এই আমার দাদা, স্টার পাওয়া দাদা, কেমন সুন্দর চেহারা দেখেছ? আছে তোমাদের এমন দাদা?
সুমন বেশি কথা বলছিল না। চারদিকে চেয়ে চেয়ে দেখছিল শুধু।
ঘোষবাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় উঠোনে টিনের পাতের ওপর বড়ি দিতে দিতে জ্যাঠাইমা চেঁচিয়ে উঠল, ও মরণ, আমার সুপুরিগুলো পেড়ে দিয়ে গেলি না বাবা! কবে থেকে খোশামোদ করছি।
আজ নয় জ্যাঠাইমা। পরে পেড়ে দিয়ে যাব। আজ কলকাতা থেকে আমার দাদা এসেছে।
কথাটা বেশ অহংকারের সঙ্গেই বলেছিল মরণ, কিন্তু তার জবাবটা এল বিছুটির মতো।
ঘোষ জ্যাঠাইমা কপালে হাত দিয়ে নিরীক্ষণ করে বলল, অ বাঙালের আগের পক্ষ বুঝি?
লজ্জায় কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল মরণের। ওভাবে বলতে আছে? গাঁয়ের লোকগুলোর মুখের কোনও আগল নেই। দাদা শুনে কী ভাবল? ছিঃ ছিঃ। আর কখনও জ্যাঠাইমার সুপুরি যদি পেড়ে দেয় তো তার নাম মরণই নয়।
সুমনের মুখে অবশ্য খুব একটা ভাবান্তর দেখতে পেল না মরণ। মাথা নিচু করে হাঁটতে হাঁটতে বলল, তুমি গাছে উঠতে পার বুঝি?
হ্যাঁ।
নারকেল গাছে উঠতে পার?
হ্যাঁ। খুব সোজা।
তোমার তো খুব সাহস দেখছি। যদি পড়ে যাও?
প্রথম প্রথম ভয় করত। এখন বেশ ভাল পারি।
আর কী পার?
আর? বলে একটু ভাবল মরণ। তারপর মাথা নেড়ে বলল, আর কিছু পারি না।
খেলতে পার? ফুটবল ক্রিকেট?
তা পারি। আর হ্যাঁ, আমি খুব জোরে দৌড়োতে পারি।
কত জোরে?
তা তো কখনও মাপিনি, এখানে তো স্টপ ওয়াচ নেই। তবে প্রতি বছর স্পোর্টসে আমি তিনটে দৌড়ে ফাস্ট হই।
লেখাপড়াতে?
না। টেনে-মেনে পাস করে যাই।
লেখাপড়া ভাল লাগে না তোমার?
না।
সুমন একটু হাসল, আর কিছু বলল না।
হাওয়াই চটি কিনে যখন তারা ফিরল তখন অনেক বেলা হয়েছে।
মা বলল, ও মরণ, তুই আলাদা বসে রান্নাঘরে খেয়ে নেগে যা। ওদের বাপ ব্যাটাকে দোতলার ডাইনিং হল-এ দিচ্ছি।
আচ্ছা মা।
কিন্তু খাওয়ার সময় সুমন বাসন্তীকে বলল, মরণ কোথায়?
ও রান্নাঘরে বসে খাবেখন বাবা। তোমাদের জন্য এই ব্যবস্থা।
না, ওকে ডাকুন, ও আমার পাশে বসে খাবে।
বাসন্তী হেসে বলল, আচ্ছা ডাকছি।
মরণ লজ্জায় মরে গিয়ে ওপরে এল। আসলে বাবার সঙ্গে বসে সে কখনও খায় না। তাই আজ ভারী লজ্জা করছে, এক সঙ্গে দাদা আর বাবার সঙ্গে বসে খাওয়া! আজ তার পেটই ভরবে না।
সুমন বাপকে তেমন ভয় পায় না। অন্তত মরণের মতো তো নয়ই। খেতে বসে কত কথা কইতে লাগল তার সঙ্গে।
দুপুরে মা যখন রান্নাঘরে খেতে বসেছে তখন মরণ গিয়েছিল লেবুপাতা দিতে। মা ছলো ছলো চোখে বলল, দেখলি, এখনও পর্যন্ত একবারও মা বলে ডাকল না আমাকে ছেলেটা!
মরণ বলে, তাতে কী মা! আমি তো মা বলে ডাকি।
মা আঁচলে চোখ মুছে বলল, আমি শত্রুর বই তো নয়। ডাকবে কেন?
বড় কষ্ট হল মরণের।
দুপুর যখন ঘন হল, বেলা গড়িয়ে গেল তখন মরণ চুপি চুপি কদমগাছটার তলায় এসে দাঁড়াল। এইখানে শিবঠাকুর আসেন। চোখ বুজে মরণ তার তিন নম্বর বরটা চেয়ে ফেলল, ঠাকুর, দাদা যেন মাকে একবার মা বলে ডাকে।
১১-১৫. পাউরুটি জিনিসটা
১১.
পাউরুটি জিনিসটা হল অনেকটা ব্লটিং পেপারের মতো। যাতেই ভোবাও সুট করে রসটা টেনে নিয়ে একেবারে ভোঁট হয়ে যায়। চায়ে ডোবালে পাঁউরুটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে অন্ধিসন্ধিতে ঢুকে যায় চায়ের রস। কী ভালই যে লাগে তখন খেতে। চায়ে টুসটুসে পাঁউরুটি যে না খেয়েছে তার জন্মই বৃথা। রসগোল্লার রসে ডুবিয়ে খাও, যেন অমৃত। পাঁউরুটি নিজেই যেন তখন ছ্যাদোনো রসগোল্লা। রসে-পাঁউরুটিতে সে যেন দাঙ্গা-হাঙ্গামা। এ বলে আমাকে দ্যাখ, ও বলে আমাকে। আর দুধে যদি ডোবাও, তা হলে তো কথাই নেই। গরম দুধে পাঁউরুটি ছেড়ে একটুক্ষণ বসে থাকো। দুধে-পাঁউরুটিতে ভাব-ভালবাসা হওয়ার জন্য একটু সময় দিতে হয়। তারপর দেখবে দুটিতে মিলেজুলে থকথকে মতো হয়ে গেছে। তখন চামচে করে মুখে দাও। পায়েস কে পায়েস, রসমালাই কে রসমালাই, কিংবা রাবড়ি কে রাবড়ি। চোখটি বুজে যা ভেবে মুখে দাও না কেন তেমনটিই মনে হবে। জিভ থেকে পেট অবধি সোয়াদ ছড়াতে ছড়াতে যাবে।
এ-বাড়িতে দুধের রোজ নেই। গত বছর গাইটা বিক্রি করে দিতে হল বড় বউমার প্রসবের সময়। বড় ছেলে নয়ন সাট্টায় অনেক নাকি টাকা লাগিয়েছিল, পথে বসেছে। খুব দুর্ভোগ গেছে তখন। গাই গোরু, এক বিঘে জমি, খোরাকির ধানও গেল কিছু। সেই থেকে দুধের জোগাড় নেই। তিনটে দুধের শিশু আছে বটে, শটিফুডের সঙ্গে একটু গুঁড়ো দুধ মিশিয়ে তাদের খাওয়ানো হয়। শটিফুডই বাঁচিয়ে রেখেছে। বেঁচে থাক শটিফুড। আর বাচ্চারা দুনিয়ার অনিয়ম অবিচার তেমন বোঝেও না বলে রক্ষে।
কিন্তু ধীরেনের এখন এই বয়সে নানান ইচ্ছে চাগাড় দিয়ে ওঠে। গত তিন রাত্তির সে স্বপ্ন দেখেছে। দুধ-পাঁউরুটি খাচ্ছে। ঘুমের মধ্যেই জিভে আর টাগরায় এমন টকাস টকাস শব্দ করেছিল যে তার বউ বিরক্ত হয়ে তাকে নাড়া দিয়ে তুলে দেয়। শেষ রাতের স্বপ্ন বলে কথা। পাঁউরুটির জোগাড় হয়, কিন্তু দুধটাই কঠিন। জোগাড় হলেই যে মুখে তুলতে পারবে তাও তত সহজ নয়। তিনটে দুধ-উপোসি শিশু মুখের দিকে চেয়ে থাকবে না কি? আর তার বউ কি বলবে না, কোন আক্কেলে বুড়ো মানুষ তুমি এতগুলো চোখের সামনে দুধ নিয়ে বসতে পারলে? গলা দিয়ে নামবে? পাষণ্ড আছ বাপু!
কিন্তু তিন দিন স্বপ্ন দেখার পর ধীরেনকে এখন দুধ-পাঁউরুটি নিশিতে পাওয়ার মত পেয়েছে। যখন নিশিতে পায় তখন আর কাণ্ডজ্ঞান বলে কিছু থাকে না। নাতি-পুতি বউ-বাচ্চা তখন বিস্মরণ হয়ে যায়।
জামার আড়ালে পিতলের ঘটিটি নিয়ে সকালবেলাতেই বেরিয়ে পড়ল ধীরেন। মুখ বারবার রসস্থ হয়ে পড়ছে। সামনের গোটা চারেক দাঁত নেই বলে মাঝে মাঝে সুট করে মুখের ঝোল টেনে নিতে হয়। বয়স হলে নানা অসুবিধে।
বাঙালের বাড়িই ভরসা। তিনটে দুধেল গাই কামধেনুর মতো অনবরত দুধ দিয়ে যাচ্ছে। দুধের সমুদুর একেবারে। তবে মুশকিল হল বাসি নগদ ছাড়া দুধ দেয় না বড় একটা। এমনিতে নরম-সরম মেয়েই ছিল। ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছে। ফ্রক পরে গোবর কুড়িয়ে বেড়াত, কাঠকুটো জোগাড় করত, পুকুরে ডাঁই কাপড় কাঁচত খার দিয়ে, আবার কদমতলায় এক্কাদোক্কাও খেলত। কথা কইলে কাঁচুমাচু হয়ে যেত। কিন্তু সেই দিন তো আর নেই।
বাঙালের বউ হয়ে ইস্তক বাসি ধিঙ্গির মা সিঙ্গি হয়েছে। জমিজমা, মুনিশ, ঝি-চাকর, গোরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি নিয়ে ফলাও সংসার। চারদিকে যেন মা লক্ষ্মী ঢেউ তুলে দিয়েছেন। রোগা, শ্যামলা মেয়েটাকে আর চেনার জো নেই। গায়ে গত্তি লেগেছে, মেজাজও হয়েছে একটু।
বাবা বাছা বলে যদি একটু আদায় হয় সেই ভরসাতেই বেরিয়েছে ধীরেন। তবে সে বুঝতে পারে, আজকাল মায়া-দয়া জিনিসটা বড্ড কম পড়ে যাচ্ছে চারধারে। কোথাও যেন আর জিনিসটা তেমন পাওয়া যাচ্ছে না। আগে এ-গাঁয়েই দুধের গাহেক খুঁজলে পাওয়া যেত না। বাড়তি দুধ চাইলে ফেরাত না কেউ।
রসিক বাঙালের বাড়িতে ঢুকবার আগে একটু দাঁড়াল ধীরেন। আহা, কী বাড়িই করেছে বাঙাল। ডানধারে বিশাল প্রাসাদের মতো দোতলা দালান। দক্ষিণে উঠোনের দিকে টানা লম্বা বারান্দা। এক এক তলায় পাঁচ ছয়খানা করে ঘর। তাও এখনও দালানের গায়ে পলেস্তারা পড়েনি। পড়লে আরও দেখনসই হবে। পুবে একখানা একতলা দালান, তাতেও তিন চারখানা ঘর আছে। পাকা গোয়ালঘর, গোলাঘর, ঢেঁকিশাল, কী নেই বাঙালের। দু আড়াই বিঘে জুড়ে ফলাও বাগান। মেলা সুপুরি আর নারকোলের গাছ। সবজিও ফলছে দোহাত্তা।
ধীরেন মেটে পথটায় তাকিয়ে লক্ষ্মীর পদচিহ্ন দেখতে পায় যেন। লক্ষ্মী ঢুকেছেন, সহজে বেরোবেন না।
এই সব দেখার মধ্যে আনন্দ আছে। অনেকে বাঙালকে হিংসে করে বটে, কিন্তু ধীরেনের হিংসে হয় না। কারও বোলবোলাও হয়েছে জানলে ধীরেন তাকে দেখতে যায়। বাড়ি দেখে, ঘর দেখে, মানুষটার মুখে আহ্লাদ আর খুশির আভা দেখে। তখন তার মনটা খুব হে-হে করতে থাকে। ভারী একটা সুড়সুড়ে সুখ হতে থাকে তারও। কেন হয় কে জানে।
ধীরেন দেখতে বড় ভালবাসে। চোখে ছানি পড়ায় দৃষ্টি একটু ঝাপসা বটে, কিন্তু তাই দিয়েই সে অনেক কিছু দেখে। ছানি কাটাবে বলে বর্ধমানের লায়নস ক্লাবে একটা দরখাস্তও দিয়ে এসেছে সে। পঞ্চায়েতের সার্টিফিকেটও জুড়ে দিয়েছে তাতে। এখনও জবাব আসেনি। নির্যস গরিব বলে প্রমাণ হলে বিনা পয়সায় ছানি কাটিয়ে দেবে। দেখার নেশা আছে বলেই ছানিটা কাটানো বড় দরকার।
ফটকের বাইরে মুগ্ধ চোখে ৰাড়িটার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়েছিল ধীরেন।
জ্যাঠামশাই, কাকে খুঁজছেন?
ধীরেন তাকিয়ে মরণকে দেখে এক গাল হাসল, এই দেখছি তোদর বাড়িটা। তা তোদের কী খবর টবর রে? বাঙাল আসে-টাসে?
হ্যাঁ। পরশু এসেছিল, আজ সকালে চলে গেছে।
ধীরেন আগল ঠেলে ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বলে, বাসি নেই?
আছে। ডেকে দেব?
তাড়া নেই। কাজ-টাজ করছে হয়তো। বসি একটু দাওয়ায়।
বসুন না। বারান্দায় উঠে চেয়ারে বসুন।
ধুতির খুঁটে দাওয়ার মেঝেটা একটু ঝেড়ে বসে পড়ল ধীরেন। বলল, এই ভাল।
সকালের মিঠে রোদ নিকোনো উঠোনে রুপোর থালা হয়ে পড়ে আছে। বাঃ বাঃ। যার ভাল তার সবই ভাল। এ বাড়ির রোদটাও যেন ধীরেনের বাড়ির রোদের চেয়ে অনেক বেশি সরেস, অনেক বেশি জমকালো। এরকমই সব হয়, লোকে বিশ্বাস করে না বটে, কিন্তু হয়।
দোতলা থেকে বাসি রেলিং-এ ঝুঁকে বলল, ও ধীরেনখুড়ো, কিছু বলবেন?
এই মা, তেমন কিছু নয়। তত্ত্বতালাশ করতেই আসা। তা খবর-টবর সব ভাল তো!
আছি খুড়ো একরকম। ঝামেলা ঝঞ্জাট তো কম নয়।
তা তো হবেই রে বাসি। কত বড় বিষয় সম্পত্তি, কত লোকলস্কর খাটছে, কত দিক সামাল দেওয়া। হওয়ারই কথা কি না।
বেরিয়েছেন কোথা?
এই ঘুরে-টুরে দেখছি। ঘরে আর কাজটা কী বল!
তা তো বটেই। বড় ছেলে কী করছে এখন?
কে জানে মা। সাট্টার পেনসিলার না কী যেন শুনি। বর্ধমানে যায় রোজ।
সে কি ভাল কাজ খুড়ো?
কে জানে মা? ভাল কাজ করার মতো বিদ্যে কি আছে?
যখন ইস্কুলে যেতুম তখন রোজ পিছু নিত আমার। ভারী অসভ্য ছেলে।
ধীরেন ছেলের অপরাধে কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ওই সবই তো করত। মায়ের আসকারায় শাসনও করা যায়নি কি না।
একলা দোতলায় কথা চালাচালির অসুবিধে। চেঁচিয়ে তো আর দুধের কথাটা বলা যায় না।
বাসন্তী বলল, একটু বসুন খুড়ো, আসছি।
তা বসে ধীরেন। ওদের কাজের মেয়েটা পুকুর থেকে কাচা কাপড়-চোপড় এনে উঠোনের তারে মেলছে। দৃশ্যটা খুব মন দিয়ে দেখে ধীরেন। কমলা সবুজ নীল রঙের নানা শাড়িতে উঠোনটা যেন ভারী রঙিন হয়ে গেল। বাতাসে দুলে দুলে যেন হাসছে শাড়িগুলো। যেন বলছে, দেখেছো, কেমন চান করে ফর্সা হয়ে এলুম!
দুনিয়ায় দেখার জিনিসের কোনও শেষ নেই। এইটুকু এক রত্তি একটু গাঁয়ের চৌহদ্দির মধ্যেই ঘোরাফেরা তার। কিন্তু এইটুকুর মধ্যেই যেন অফুরান সব দৃশ্য, কুলিয়ে ওঠা যায় না।
জ্যাঠামশাই, মা জিজ্ঞেস করল চা খাবেন?
এক গাল হাসল ধীরেন, দিবি? তোদের কষ্ট হবে না তো!
না না।
তবে দে একটু। চিনি আর দুধটা একটু যেন বেশি দেয় দেখিস।
আচ্ছা জ্যাঠা।
হ্যাঁ রে মরণ, বলি দুধে ভিজিয়ে পাঁউরুটি খেয়েছিস কখনও?
মরণ মুখটা বিকৃত করে বলে, এঃ বাবা! দুধে পাঁউরুটি! ওয়াক।
পাষণ্ড আর কাকে বলে। এ ছেলে দুধ-পাঁউরুটির মর্মই বোঝে না। ধীরেন তটস্থ হয়ে বলে, তা বাবা, খাসনি বুঝি কখনও?
নাঃ। ও তো পিটুলিগোলার মতো খেতে!
দুর! তুই জানিস না। একটু দানা চিনি ছড়িয়ে খেতে
বাসি নেমে এল নীচে। বেশ চেহারাটা হয়েছে এখন। সেই রুখু শরীরে এখন একটু তেল চুকচুকে ভাব। ফর্সা একটা মেজেন্টা রঙের শাড়ি পরা, কপালে মস্ত সিঁদুরের টিপ, সিঁথি ভর্তি সিঁদুর থেকে খানিক নাকের ডগায় ঝরে পড়েছে। স্বামী-সোহাগের লক্ষণ। না, বেশ আছে মেয়েটা। সময়মতো বাঙালের চোখে পড়ে গেল, তাই বেঁচে গেছে। চোখে পড়াটাই হল আসল কথা। ওই হল ভাগ্য, ওই হল গ্রহানুকূল্য। ভাল চোখ যদি পড়ে তবে তরে গেলে। আর মন্দ চোখ যদি পড়ে তবে হেঁচড়ে হেঁচড়ে জীবন যাবে।
কিছু বলবেন খুড়ো?
হ্যাঁ মা, তা তোদের গোরুগুলো দুধ-টুধ কেমন দেয়?
আর বলবেন না। কালো গাইটা দুধ বন্ধ করেছে সেই কবে। দুটো দিচ্ছে এখনও, তবে কমে এসেছে। আমার বড় ছেলে এসেছে কলকাতা থেকে, তাকে কোথায় একটু পিঠে পায়েস করে খাওয়াবো, তাই হচ্ছে না ভাল করে। মাসিক বন্দোবস্তের গাহেকও তো আছে।
ঘটিটা জামার তলা থেকে আর বের করল না ধীরেন। না, হবে না।
কাজের মেয়েটা কাপে চা নিয়ে এল, প্লেটে দুটো থিন এরারুট বিস্কুট। চলকানো চায়ে বিস্কুট দুটো নেতিয়ে গেছে। তা যাক। এটুকুই বা মন্দ কী?
খুব যত্ন করে চাটুকু খেল ধীরেন। চায়ে ভেজানো বিস্কুটেরও একটা স্বাদ আছে।
উঠছেন খুড়ো? আবার আসবেন।
আসব বইকী! এই ঘুরে ঘুরেই সময় কাটাই। যোগাযযাগটাও রাখা হয়, সময়ও কাটে।
মরণ পোশাক পরে ইস্কুলে বেরোচ্ছে। তার পিছু পিছুই বেরিয়ে পড়ল ধীরেন। ফাঁকা ঘটিটা জামার নীচে ধরা আছে এখনও। ছোট ঘটি, বাইরে থেকে টের পাওয়া যায় না।
বেগুনক্ষেতটা পার হওয়ার সময় ধীরেন দাঁড়াল। গাছে ফুল এসে গেছে। দু-একটা গাছে কচি বেগুনের শিশুর মতো নিষ্পাপ মুখ উঁকি মারছে। কী সুন্দর দেখতে! শীতের বেগুন, তার স্বাদই আলাদা। বেগুন বড্ড তেল টানে বলে তার মা চাকা-বেগুনে আগে একটু চিনি মাখিয়ে রাখত। তাতে নাকি তেল কম লাগে। তা হবে হয়তো। আজকাল আর বেগুন ভাজা হয় না। মাঝে মধ্যে একটু পোড়া টোড়া হয় বড় জোর।
খুব ধীর পায়েই এগোয় ধীরেন। সকালটা এখনও আছে। শীত শীত ভাবটাও ক্রমে বাড়ছে বাতাসে। নাকি বয়স হচ্ছে বলেই শীতভাব হয় তার?
রায়বাড়ির উঠোনে ইজিচেয়ারে মহিমাই বসে বোধহয়। ঠিক ঠাহর হয় না। সজনের ছায়ায় ঝিরঝিরে বাতাসে এই অলস বসে থাকাটা ভালই লাগে ধীরেন কার।
উঠোনে চাটাই বিছিয়ে নানা জিনিস রোদে দিচ্ছে সন্ধ্যা। আমলকী, আমসি, সারি সারি আচার আর কাসুন্দির বোতল।
একটু কাছে গিয়ে ভুল বুঝতে পারে ধীরেন। মহিমদা নয়, বসে আছে অমল।
ভারী খুশি হয়ে ওঠে ধীরেন।
উরে বাপ রে! অমল নাকি?
অমল মানে হচ্ছে এক চোখ-ধাঁধানো ছেলে, গ্রামের গৌরব। বিলেত আমেরিকা ঘুরে এসেছে। এক এক মাসে যা বেতন পায় তা দিয়ে হাতি কিনে ফেলা যায়। গরিবগুর্বোর সম্বৎসরের খরচ।
অমল একটা বই পড়ছিল। ইংরিজি বই-ই হবে। তাকিয়ে কিছুক্ষণ ভারী আনমনা চোখে চেয়ে রইল। চিনতে পারল না। তারপর সোজা হয়ে বসল। একটু হেসে বলল, ধীরেনকাকা না?
হ্যাঁ বাবা।
ইস, একদম বুড়ো হয়ে গেছেন যে! চিনতেই পারিনি।
অমল তাকে চিনতে পারায় ভারী আপ্যায়িত হয়ে ধীরেন বলে, তা বয়সও হল। আমাদের তো আর কিছু হয় না, শুধু বয়সটাই হয়।
বসুন কাকা। বাবাকে ডেকে দিচ্ছি। ঘরেই আছে।
তোমার সঙ্গে কতকাল পরে দেখা! দেশের গৌরব তুমি।
অমল কথাটা শুনে খুব খুশির ভাব দেখাল না। মুখটা শুকনো। ধীরেনের চোখ যদি খুব ভুল না হয়, তা হলে মুখে একটু দুঃখের ছাপও যেন আছে। হওয়ার কথা নয় এরকম। লম্বা বেতন, হোমরা-চোমরা চাকরি, পেটে গিজগিজ করছে বিদ্যে, এরকম মানুষের মুখে তো আহ্লাদ ফেটে পড়ার কথা!
আপনি কেমন আছেন ধীরেনকাকা?
এই আছি বাবা। টিকে আছি।
ছেলেরা সব দাঁড়িয়েছে তো?
এই একরকম। টুকটাক করে আর কী। তোমার তো ভালই চলছে বাবা! আমাদের কথা বাদ দাও। পাপীতাপী লোক আমরা।
.
চারদিকে জল, জল আর জল। ডাঙাজমির দেখাই নেই। তার ভিতর দিয়ে জল ভেঙে ছুটতে ছুটতে হাঁফ ধরে যাচ্ছিল ধীরেনের। কতবার যে খানা ডোবায় পড়ল, কতবার পা হড়কাল তার হিসেব নেই। কতটা সময় লেগেছিল তাও ভেবে পায়নি কখনও ধীরেন। যখন ডাঙাজমিতে উঠল এসে তখন তার সর্বাঙ্গ জলে কাদায় মাখামাখি। চোখ উদভ্রান্ত, মনে বিভীষিকা, পাপবোধ, পাগলের মতো অবস্থা।
যখন বাড়ি ফিরল তখন সে প্রায় উন্মাদ। আপনমনে বিড় বিড় করছে, কখনও চিৎকার করে কেঁদে উঠছে, কখনও নিজের চুল ছিঁড়ছে দু হাতে মুঠো করে। ওর মধ্যেই তার বাবা ঠ্যাঙা নিয়ে মারতে এসেছিল তাকে। মা এসে ঠেকাল, দেখছ না কী অবস্থা! নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। আগে ঠান্ডা হতে দাও।
মা-ই তার গলায় তারের ফাঁসটা আবিষ্কার করেছিল। বলল, এটা তোর গলায় কী রে? কে তোকে তুক করেছে? অ্যাঁ!
কিছু বলতে পারেনি ধীরেন। দিন দুই লেগেছিল সেই বিকারের ঘোর কাটতে। তারপর পুলিশের ভয়ে সে কালনায় তার মাসির বাড়িতে পালিয়ে গেল। মাসখানেক বাদে যখন ফিরল তখনও পুলিশ তাকে খোঁজেনি। খোঁজার কথাও নয়। বৃষ্টি বাদলা কেটে গিয়ে জোড়া লাশ যখন পাওয়া গিয়েছিল তখন দিন পাঁচেক কেটে গেছে। মড়া পচে ঢোল। পুলিশ একটা তদন্ত করেছিল বটে, কিন্তু তখন গ্রামদেশে এসব নিয়ে তেমন একটা মাথা ঘামানোর রেওয়াজ ছিল না। যেটা রটেছিল তা হল, বরুণ মিদ্দার তার বউকে মেরে ডোবায় ফেলতে গিয়ে নিজেও ডুবে মরেছে।
ধীরেন খুনের দায় থেকে বেঁচে গেল। ধীরে ধীরে স্মৃতি আবছা হল, সময়ের পলিমাটি পড়তে লাগল, কিন্তু আচমকা কখনও-সখনও মনে পড়ত দৃশ্যটা। শিউরে উঠত।
ইদানীং ধীরে ধীরে স্মৃতিটা ফের কেন যেন জ্বলজ্বলে হয়ে ওঠে। আর তাকে একা পেলেই কেন যে বরুণ মিদ্দার কাছেপিঠে চলে আসতে চায়! সে আজকাল অন্ধকার ভয় পায়, একা ঘরে ভয় পায়, নিরিবিলি মাঠ পেরোতে ভয় পায়। বাতাসে যেন একটা ফিসফাস শুনতে পায় সে। বরুণ মিদ্দারের গলা বলেই কেন যেন মনে হয় তার।
ইদানীং জ্ঞানগম্যিওলা মানুষদের কাছেপিঠে গিয়ে বসার একটু ঝোঁক হয়েছে ধীরেনের। যারা অনেক জানে-টানে তাদের কাছে গেলে অনেক ধাঁধা কেটে যায়।
এ-অঞ্চলে অবশ্য জ্ঞানী লোক বেশি নেই। গৌরহরিদা ছিলেন, মহিম রায় এখনও আছে।
তা হরিদার কাছে ব্যাপারটা একবার বলে ফেলেছিল সে। বেশি বলতে চায়নি, শুধু একটা পাপ কথা বলে ভণিতা করেছিল মাত্র। কিন্তু গৌরহরি দুঁদে উকিল। জেরা করে করে সবই পেট থেকে বের করে নিল। তারপর বলল, তা কি প্রাশ্চিত্তির করতে চাস নাকি?
এর কী আশ্চিত্তির আছে হরিদা?
কিছু নেই রে, কিছু নেই। বরাতজোরে খুনের দায় থেকে বেঁচে গেছিস, এসব কথা পাঁচকান না করাই ভাল।
কাউকে বলিনি, নিজের বউকে অবধি নয়।
বউকে আরও বলবি না। মেয়েমানুষের পেটে কথা থাকে না।
বলি না। কিন্তু আজকাল বড় মনে পড়ে যায়। ওই আদিগন্ত জল, ওই সাংঘাতিক বর্ষা, বরুণ মিদ্দার, বাতাসী সব যেন মাঝে মাঝে এসে ঘিরে ফেলে। বিশেষ করে মিদ্দার।
কেন যে অমলের মুখোমুখি বসে কথাটা আজ মনে পড়ল কে জানে। মাঝে মাঝে বড় মনস্তাপ হয়। জীবনটা ভণ্ডুল হয়ে গেছে বলে মনে হয় যেন। পাপটা কি সইবে তার?
বসুন কাকা, বাবাকে ডেকে দিচ্ছি।
ঘটিটা মোড়ার পাশে নামিয়ে রাখল ধীরেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হঠাৎ হঠাৎ মিদ্দার আজকাল মনের মধ্যে হানা দেয়। হানা দেয় বাতাসীও।
সন্ধ্যা বলল, ঘটিতে কী নিয়ে যাচ্ছেন ধীরেনকাকা?
কিছু নয় মা। বাঙালের বাড়িতে একটু দুধের খোঁজে গিয়েছিলাম। তা পাওয়া গেল না।
ওঃ দুধের যা টানাটানি চলছে আমাদেরও! মেজদারা সব এসেছে তো! দুটো মোটে গোরু। বাবার বরাদ্দই কমিয়ে দিতে হয়েছে।
ধীরেন চেয়ে চেয়ে দেখছিল।
উরেব্বাস, কত রকমের আচার করেছিস রে সন্ধ্যা! অ্যাঁ!
হ্যাঁ কাকা, মাথা থেকে সব বের করতে হয়।
তাই বুঝি? আমাদের তো ভাতপাতে একটু তেঁতুল হলেই হয়।
সে দিন আর নেই কাকা। এখন লোকে সব কিছুরই আচার চায়। শুনেছি নাকি বিলেত-টিলেতে মাংসেরও আচার হয়।
বাপ রে! বটে!
হ্যাঁ। এই যে দেখুন না, কেউ কখনও গাজরের আচার খায় শুনেছেন? এক খদ্দের চেয়েছে বলে তাও করে দিচ্ছি।
অমল উঠে গেছে। আরামকেদারার ওপর বইটা পড়ে আছে উপুড় হয়ে। ডানামেলা পাখির মতো দু মলাট দুদিকে ছড়ানো। বইটার নাম একটু ঝুঁকে দেখল ধীরেন। ইংরিজি পড়ার অভ্যাস নেই। সেই কবে একটু শিখেছিল। শুধু নামের শেষটুকু পড়তে পারল, গ্লোরি।
সন্ধ্যা বলল, খাবেন একটু আচার? দেব প্লেটে করে?
ধীরেন হাসল। বলল, দে একটু। চেখে দেখি।
একটা প্লেটে দুরকম আচার নিয়ে এল সন্ধ্যা, দেখুন তো খেয়ে কেমন টেস্ট হয়েছে।
ভাল বলার জন্য মুখিয়েই আছে ধীরেন। খেতে খেতে মাথা নাড়া দিতে দিতে বলল, বাঃ বাঃ, এ তো ফার্স্ট ক্লাস জিনিস দেখছি।
সন্ধ্যার মুখে যে হাসিটা ফুটল তা অহংকারের।
ভাল?
খুব ভাল রে মা। তাই তোর জিনিস এত চলে।
চলে তো কাকা। কিন্তু টাকা থাকলে ব্যবসাটা আরও বড় করতে পারতাম। একটা কারখানাই করে ফেলতাম।
দুধটা এখানেও হল না। আচার খেয়ে ধীরেন উঠে পড়ল। মহিমা এল না। দরকারও নেই। খানিক গল্প করা যেত।
উঠলেন কাকা?
উঠি।
বাবা বোধহয় বাগানে ঢুকেছে। ডাকব?
না মা। আবার আসবখন।
টুক টুক করে ধীরেন হাটে। আচারগন্ধী একটা সুবাসিত ঢেঁকুর উঠল। বেশ ভালই লাগল ঢেঁকুরটা তুলে। ঢেঁকুরও যে একটা উপভোগ্য জিনিস সেটাও কি সবাই বোঝে? যদি জিজ্ঞেস করে কাউকে, ওহে, ঢেঁকুর তুলে যদি মাংসের বা পায়েসের গন্ধ পাও তা হলে কেমন লাগে? তা হলে হয়তো চটেই উঠবে লোকটা। ধীরেন কাউকে জিজ্ঞেস করে না বটে, কিন্তু কথাগুলো মনে মনে খুব ভুড়ভুড়ি কাটে।
ওই গৌরহরিদার বাড়ি। এই গাঁয়ের টাটা-বিড়লা যা-ই বলো তা ছিল ওই গৌরহরি চাটুজ্যে।
দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ বাড়িটা নিরীক্ষণ করে ধীরেন কাষ্ঠ। দুই ভাইয়ের অংশ কিনে নিয়েছিলেন হরিদা দুনো দামে। যা করার ইচ্ছে তা করবেনই। জান কবুল। ওরকম মানুষকে রোজ সকালে উঠে পেন্নাম করতে হয়। বড় বড় থাম, মজবুত খিলানের ওপর বাড়ি। তিন তিনটে দোতলা দালান, কত যে ঘর তার হিসেব নেই। হরিদা কি জানতেন না শেষ অবধি কেউ গাঁয়ের মাটি কামড়ে পড়ে থাকবে না? ছেলেরা যাবে, মেয়েরা যাবে, পড়ে থাকবে বুড়োবুড়ি? জানতেন। জেনেও ভাইয়েদের অংশ কিনে নিয়েছিলেন। রাজা-জমিদারের মতো মেজাজটা ছিল খুব।
সসংকোচে বাগানের লোহার ফটক পেরিয়ে বাড়িতে ঢুকল ধীরেন। ভিতর থেকে অনেক লোকের গলা পাওয়া যাচ্ছে। ছেলেরা এসেছে বোধহয়।
উঠোনের মুখে একটা ছেলের সঙ্গে দেখা। বিজু, নরহরির ছেলে। ভারী ফর্সা, সুন্দর চেহারা। কী যেন খেলে-টেলে। ফুটবল বা ক্রিকেট যাই হোক। লেখাপড়াতেও চৌখশ।
ধীরেনখুড়ো নাকি?
ধীরেন সরে সাইকেল যাওয়ার রাস্তা দিয়ে বলল, হ্যাঁ বাবা।
কিছু মনে করবেন না খুড়ো, পানুকে যে মেরেছিলাম সে এমনি নয়। পাতা খায় বলেই মেরেছি। যারা ওসব নেশা করে তাদের দোষ কী জানেন? তারা আর পাঁচজনকে জুটিয়ে নিতে চেষ্টা করে। পুরো গাঁয়ের আবহাওয়াই নষ্ট করে দেবে। একটু খেয়াল রাখবেন।
ধীরেন হাঁ করে চেয়ে থাকে। পানু তার ছোট ছেলে। সে যে বিজুর কাছে মার খেয়েছে এখবরটাই জানা নেই ধীরেনের। তবে পাতার কথাটা সে আবছা শুনেছে। খুব খারাপ নেশা নাকি, কিন্তু ধীরেনের কীই বা করার আছে! ছেলেরা এখন দূরের মাস্তুল, দরিয়ায় অনেক তফাতে চলে গেছে। পড়লে, মরলে শোক হবে বটে, কিন্তু নোঙর নেই যে!
সসংকোচে ধীরেন বলে, ঠিকই তো, ঠিকই করেছ বাবা মেরেছ।
একটু সামলে রাখবেন। নইলে ঘটিবাটি চাঁটি করে দেবে। এ নেশা যে করে তার কাণ্ডজ্ঞান থাকে না।
ধীরেন মাথা নাড়ে। বুঝেছে, আবার বোঝেওনি সে। বিড়ি-আসটা খায়, ঠিক আছে। ধেনো-টেনো খেলেও না হয় একরকম। দুনিয়া যত এগোচ্ছে নেশাও তত এগোলে বড় কঠিন পরিস্থিতি।
যান ধীরেন খুড়ো, ভিতরে যান।
ভিতরে এক আনন্দের হাট। স্বর্গের ছবি যেন। দুটো বিশাল বারান্দার সিঁড়ির বিভিন্ন ধাপে নানা বিভঙ্গে বসে আছে সুন্দর সুন্দর সব নারী ও পুরুষ। খুব হাসছে, হল্লা করে কথা বলছে।
ধীরেন হঠাৎ শিহরিত হয়ে মাথা নেড়ে আপনমনে বলে উঠল, না, না, উচিত হচ্ছে না। এখানে আমার ঢোকাটা উচিত হচ্ছে না।
সে তাড়াতাড়ি এই সুন্দর দৃশ্যটি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য পিছু হটে চলে আসছিল। একটি মেয়ে তাড়াতাড়ি উঠে এসে সামনে দাঁড়াল, এ কী খুড়ো, চলে যাচ্ছেন যে!
পারুল, বরাবরই জগদ্ধাত্রীর মতো দেখতে ছিল। এখন যেন আরও জমকালো হয়েছে।
ধীরেন ভারী অপ্রস্তুত হয়ে বলে, না মা, তেমন কোনও কাজ ছিল না। এমনিই দেখা করতে আসা। ঘুরে ঘুরে খোঁজখবর নিই আর কী।
আসুন না ভিতরে, মার সঙ্গে দেখা করবেন না?
আজ থাক।
থাকবে কেন খুড়ো? আমরা যখন থাকি না তখন তো আপনারাই যা হোক খোঁজখবর নেন। আপনাদের ভরসাতেই তো মা আছে এখানে। আসুন।
কী সহবত! তার মতো নকড়াছকড়া লোককেও কী আপ্যায়ন। গৌরদা তার ছেলেমেয়েকে কী শিক্ষাটাই দিয়ে গেছে! বুক ভরে যায়।
হাতে ওটা কী খুড়ো? ঘটি নাকি?
সসংকোচে ঘটিটা ফের আড়াল করতে করতে ধীরেন হে হে করে একটু হাসে, ও কিছুনয় মা। গাঁয়ের মানুষ তো, এক কাজে বেরিয়ে অন্য কাজও সেরে নিই। একটু দুধের খোঁজে বেরিয়েছিলুম, তাই।
পেলেন না?
সে হবে খন।
উঠোনে নিমের ছায়ায় পাতা একখানা কাঠের চেয়ারে সাদা থান পরা বউঠান বসা। গায়ের রং আগে দুধে-আলতায় ছিল, এখন শ্বেতপাথরের মতো। একটু ফিরে তাঁকে পাশচোখে দেখছেন।
ধীরেন ঠাকুরপো বুঝি! এই দেখুন আমার বাচ্চারা সব এসেছে। সবাইকে তো চিনবেনও না।
ধীরেন খুব হাসি হাসি মুখ করে কয়েক পা এগোল। বড্ড লজ্জা হচ্ছে তার। এমন সুন্দর দৃশ্য যেন মা দুর্গা আর কার্তিক গণেশ আর লক্ষ্মী সরস্বতীরা সব জড়ো হয়েছে। তার মধ্যে সে এক মহিষাসুর যেন ঢুকল এসে।
বলাকা তার দিকে চেয়ে বলে, অনেকদিন দেখিনি আপনাকে। চেহারাটা খারাপ হয়ে গেছে কেন?
ধীরেন বড় বেকায়দায় পড়েছে, জোড়া জোড়া চোখ তার দিকে।
অসুখ-বিসুখ করেনি তো ঠাকুরপো?
না বউঠান, বুড়ো হচ্ছি তো!
বলাকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, তা তো সবাই হচ্ছি।
আজ যাই বউঠান, আপনারা গল্প-টল্প করুন। অসময়ে এসে পড়েছি।
কোনও কথা ছিল নাকি?
না না, এই খবরটবর নিতেই আসা। আসি তাহলে?
আসবেন মাঝে মাঝে।
ঘাড় কাত করে সম্মতি জানিয়ে বেরিয়ে আসছিল ধীরেন। শুনতে পেল, পেছনে একটা মেয়ে বলে উঠল, জানো, জ্যাঠামশাইয়ের কাজের দিন ধীরেন জ্যাঠা আমার ঘরের পাশে সাপ দেখে কাপড়ে পেচ্ছাপ করে ফেলেছিল!
একটু হাসির ঢেউ উঠল। বড় যন্ত্রণা হয় ধীরেনের। যা ঘটে তার কোনওটাই সে আর আটকাতে পারে না। ছেলে পাতা খায়, অন্য ছেলে সাট্টা খেলে, সে আটকাতে পারে না। এই যে পেচ্ছাপ বেরিয়ে পড়ে তাও কি পারে আটকাতে? এবারে চলে যাওয়ারই সময় হল বুঝি! তবে বানের জলে মিদ্দারকে ডুবিয়ে মেরেছিল তার পাপই কি অর্শাচ্ছে?
একটা শিউলি গাছের কাছে পারুল। ডিং মেরে পাতায় পাতায় আটকে থাকা ঝরা শিউলি তুলছে।
খুড়ো চললেন?
হ্যাঁ মা।
এত তাড়াতাড়ি? মায়ের সঙ্গে দেখা হল?
হ্যাঁ। এই একটু দেখে গেলুম। ঘুরে ঘুরে সবার খোঁজখবর নিই আর কী। আজ মহিমার মেজো ছেলে অমলের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। কত কাল পর, চিনতেই পারছিল না।
একটু ভ্রূ কোঁচকাল পারুল, কে বললেন?
সেই যে মাধ্যমিকে স্ট্যান্ড করেছিল মনে নেই? এখন কেষ্টবিষ্টু হয়ে উঠেছে। বড় ভাল লাগল দেখে।
পারুল ফুল তুলতে তুলতেই বলল, অমলদা এসেছে বুঝি?
হ্যাঁ।
আর কথা নেই। ধীরেনের কথা বড্ড তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়। ধীরে হেঁটে সে রাস্তার দিকে যাচ্ছিল।
ধীরেনখুড়ো!
ধীরেন থমকে দাঁড়ায়, কী মা?
আপনি কি এখন দুধ জোগাড় করতে যাচ্ছেন?
ধীরেন ক্লিষ্ট একটু হেসে বলে, দেখি যদি পাই।
দিন তো, ঘটিটা আমাকে দিন।
অ্যাঁ!
পারুল ঘটিটা তার অবশ হাত থেকে নিয়ে লঘু পায়ে ভিতরবাড়িতে চলে গেল। ধীরেন একটু আশাভরসায় বুক বেঁধে দাঁড়িয়ে রইল। নিজেকে একটু কাঙাল ভিখিরির মতোই লাগছে বটে, কিন্তু সে তো তাই। সমাজের নীচের তলাতেই বাস ছিল তার। হয়তো আরও কয়েক ধাপ নেমে গেছে। কে জানে! তবে কী এসে যায় তাতে? এইসব বড় বড়, উঁচু উঁচু মানুষের দয়াধর্মের ওপরেই তো বেঁচে থাকা, ছোট ছোট ইচ্ছাপূরণ!
দেবী যেমন বর দেন তেমনই ছোট ঘটিটা দুধে ভরে নিয়ে এসে তার হাতে দিল পারুল। মুখটা কচুপাতায় ঢেকে দিয়েছে। কী বুদ্ধি মেয়েটার।
সাবধানে নিয়ে যাবেন খুড়ো।
কৃতজ্ঞতায় গলে যেতে ইচ্ছে করে ধীরেনের। চোখে জল আসতে চায়। একটু উথলানো গলায় বলে, দিলে মা! দিলে!
বেশি তো নয়। ছোট্ট ঘটি আপনার।
যথেষ্ট মা, এই যথেষ্ট।
আর খুড়ো!
হ্যাঁ মা।
অমলদার সঙ্গে যদি দেখা হয় তাহলে একবার আমাদের বাড়িতে আসতে বলবেন। বলবেন আমি বলেছি।
ধীরেন মাথা হেলিয়ে বলে, আচ্ছা মা। এখনই বলে আসব?
পারুল একটু হেসে বলল, আমি কয়েকদিন এখানে থাকব। যখন হয় বলবেন, আপনার সময়মতো।
হ্যাঁ মা।
দুধ! শেষ অবধি ঘটি ভর্তি দুধ! আনন্দে ধীরেনের বুকটা একটু তোলপাড় হল৷ এবার একটু পাঁউরুটি জোগাড় হলেই হয়। ঘটিটা দু হাতে মণিরত্নের মতো ধরে ধীরেন সাবধানে হাঁটে। হোঁচট টোচট খেলে দুধ চলকে যাবে বাবা। আর হঠাৎ যদি এখন তার পেচ্ছাপ পেয়ে বসে তাহলেও বিপদ। পাজি পেচ্ছাপটা যে কখন পেয়ে বসে তার কিছু ঠিক নেই। শালা ঠিক মিদ্দারের ভূতের মতো। যখন তখন এসে হানা দেয়। কাণ্ডজ্ঞান থাকে না তখন।
পাঁউরুটি কিনতে বাসরাস্তায় এসে ধীরেন চায়ের দোকানে বসল একটু। অনেক কিছু ভাবার আছে। এই দুধ নিয়ে বাড়ি গেলে কি তার ভোগে লাগবে? চারদিকে লোভী চোখ। ঘটিটা সাবধানে টেবিলের ওপর রেখে এক হাতে যখের মতো ধরে থাকল ধীরেন। তারপর অনেকক্ষণ ভাবল। ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এক কাপ চা আর কোয়ার্টার রুটি নিল ধীরেন। চায়ে ডুবিয়ে পাঁউরুটি কিছু খারাপ নয়। চায়ের মধ্যেও তো একটু দুধ থাকে রে বাপু। চোখ বুজে মনে মনে ভেবে নিলেই হয় যে, দুধে ভিজিয়েই খাচ্ছি।
কাঙাল গরিবদের ভগবান কল্পনাশক্তিটাও খুব দেন বটে। ওইটুকু আছে বলেই তারা পান্তাকে পোলাও মনে করে খেয়ে নিতে পারে। না না, পোলাও-টোলাও গরিবেরা ভালবাসে না। তাদের জিভে পোলাও বা লুচির কোনও স্বাদ নেই। তারা ভালবাসে মিঠে ভাত, লঙ্কার ঝাল বা তেঁতুলের টক। তাই দিয়েই ভরপেট উঠে যায়।
চায়ে ভিজে গেলাসের মধ্যে পাঁউরুটিটা টইটম্বুর হয়ে উঠল। দৃশ্যটা মুগ্ধ চোখে দেখল ধীরেন। তারপর একটু একটু চুমুক দিয়ে আর দু-তিন আঙুলে চায়ে ভেজা পাঁউরুটির দলা মুখে দিয়ে খেতে লাগল সে। খুব ধীরে ধীরে। অন্য হাত দুধের ঘটির ওপর সতর্ক পাহারা দিচ্ছে।
অনেকক্ষণ সময় নিল ধীরেন। সব জিনিস রয়ে-সয়ে করতে হয়। জিভ, টাকরা কণ্ঠনালি বেয়ে পেট অবধি স্বাদের আলো ছড়িয়ে নেমে যাচ্ছে চায়ে ভেজানো পাঁউরুটি। পুরো এই ব্যাপারটা খুব মন দিয়ে উপভোগ করছে সে। প্রতিটি বিন্দু।
দুধটুকু থাক। এটুকু বাড়িতেই নিয়ে যাবে সে। দুধ-উপোসি শিশুরা আজ দুধ দেখে ভারী খুশি হবে। না, ধীরেনের বরাতে জুটবে না। তা না জুটুক। আজ তার একটু মহৎ হতে বড্ড ইচ্ছে করছে।
.
১২.
প্রস্ফুটিত কমলের মতো তোমার আশ্চর্য আনন। মনে হয় এখনই মধুকর গুনগুন করে উড়ে এসে ভুল করে ফুল ভেবে বসবে ওই আননে। এইভাবে পুরুষের স্তাবকতা শুরু হল, শেষ হল না আজও। কত ভূর্জপত্র, তালপাতার পুঁথি, কত কাগজ আর কলমের কালি খরচ হয়ে গেল, রচনা হল কত কাব্য, মহাকাব্য, নাটক, উপন্যাস। উপমায় উপমায় চাঁদ, ফুল, শ্রাবস্তীর কারুকার্য গেল ফুরিয়ে। পুরুষ দমেনি এখনও।
দেখন সুন্দরী না হলেও হয়। হয়তো মুখে জুতসই একটা তিল বা আঁচিল, ঠোঁটের একটু অভিমানী ভাঁজ, মুখের ডৌল, চোখ বা চাহনি, হয়তো বা গজদন্ত, গালের টোল কিছু একটা হলেই হল। বোকা পুরুষ তাই নিয়েই মাতল, মজল, পাগল হল। ডোবাল জাহাজ, ছারখার করে দিল দেশ, লাগাল ধুন্ধুমার যুদ্ধ। না পারলে হয়তো মদ খেয়ে হল দেবদাস বা কবি, আত্মহত্যা করে বসল, পাগল বা সাধু হয়ে গেল।
হ্যাঁ গা, শুধু রূপটুকু চাই? কুরূপার বুঝি প্রেম নেই?
ওই যে বারান্দার উত্তর কোণে এসে বসে আছে রাইকিশোরী। সামনে মুড়ির বস্তা, বেতের দাড়িপাল্লা নামিয়ে রেখে আঁচলে মুখের ঘাম মুছছে। ওর একটুও শ্রী নেই। খবুটে পুরুষালি গড়ন, দাঁত উঁচু, মুখে অনেক খানাখন্দ। কোনও পুরুষ বিরলে বসে একবারটিও ভাববে না ওর কথা। এক লাইন কবিতাও কোথাও লেখা হবে না ওর জন্য। তবু হয়তো ওরও একদিন বিয়ে হয়ে যাবে। প্রকৃতির নিয়মে ছেলেপুলে হবে, সংসার করবে। কিন্তু প্রেম হবে না।
আজ সে জানালা দিয়ে চেয়ে মুড়িউলি রাইকিশোরীকে দুপুরের আলোয় দেখছে আর রূপের কথা আর বেহদ্দ পুরুষের কথা ভাবছে।
আজ জানালা দিয়ে কে তার বিছানায় একখানা ভাঁজ করা প্রেমপত্র ফেলে দিয়ে গেছে। ভাল কাগজও জোটেনি। শস্তা এক্সারসাইজ বুকের একখানা ফাঁস করে ছেঁড়া পাতা। হাতের লেখাটা অবশ্য তত খারাপ নয়।
আজকাল আবৃত্তিকারদের কল্যাণে জীবনানন্দ ঘরে ঘরে। চিঠির মধ্যেও সেই বিদিশার নেশা, পাখির নীড়ের মতো চোখ, হালভাঙা নাবিক এইসব আছে। ভাল করে পড়লও না পান্না। তার সতেরোখানা প্রেমপত্রের সঙ্গে আঠেরো নম্বরটাও রেখে দিল চন্দনকাঠের বাক্সে। নীচে যার নাম সই সেই মণীশকে সে চেনেও না। হয়তো কারও বাড়িতে এসেছে। কারও আত্মীয়স্বজন হবে।
প্রেমপত্র পেলে পান্না খুশি হয় না। আবার রেগেও যায় না। আসলে তেমন কোনও প্রতিক্রিয়াই হয় তার। এসব ছ্যাবলাদের সঙ্গে নিজেকে ভাবতে তার ইচ্ছেই হয় না কখনও।
তবু ট্রফি হিসেবে থাকে। প্রেমপত্র একধরনের সার্টিফিকেটও তো বটে।
দুপুরবেলাটা গড়িমসি। আলিস্যিতে ভরা তার শরীর। তবু উঠতে হল। আজ বড়মার বাড়িতে তার নেমন্তন্ন। নেমন্তন্ন প্রায়ই থাকে। একা ফাঁকা বাড়িতে বড়মা একা বসে খায় বলে তাকে প্রায়ই ডেকে পাঠায়। কিন্তু বড়মার বাড়িতে সে কিছুতেই মাছটা খেতে পারে না।
বড়মা অবশ্য জোর করে, কেন মাছ খাবি না? খা, একটু তফাতে বসে খেলেই হবে।
না বড়মা, নিরামিষই ভাল।
তোর যে তাহলে পেট ভরবে না?
কেন বড়মা? গোবিন্দভোগ চালের ভাত, সরবাটা ঘি, আলুভাজা, পোস্ত, আলুর দম, টক–এতেও ভরবে না?
তাহলেও তোর কষ্ট তো হবে।
একটুও না। মাছে আমার আজকাল আঁশটে গন্ধ লাগে।
আজ অবশ্য তা নয়। আজ নেমন্তন্ন করেছে পারুলদি, কী সব চাইনিজ আর ইটালিয়ান রান্না করবে বলে নানারকম জিনিস আনিয়েছে কলকাতা থেকে। কাল রাতে বলল, তোর জামাইবাবু একটু আনইউজুয়াল ডিশ পছন্দ করে। তুইও খাবি। দুবেলাই নেমন্তন্ন। মনে থাকে যেন।
আর কাকে বলবে?
কাউকে না। বাইরের লোক ডাকলে বাপু ঘরোয়া আড্ডার মেজাজটা থাকে না। নিজেরা বেশ গল্প টল্প করব। অনেকদিন বাদে নিজের হাতে রান্না করব, কীরকম হবে কে জানে বাবা। নুন-টুন কমবেশি হতে পারে।
কেন, তুমি রান্না করো না?
দুর! সময় পাই কোথায়? এক মিশিরজি আছে, সেই রাঁধে। আমাকে তো তোর জামাইবাবুর অফিস সামলাতে হয়।
তাই তো! পাস-টাস করলে আমাকে তোমার অফিসে একটা চাকরি দেবে?
কেন রে মুখপুড়ি, চাকরি করবি কেন?
খারাপ কী বল! চাকরি, না হয় বিয়ে করে ঘরসংসার- এই তো! আর কোনও অলটারনেটিভ আছে?
পারুলদি একথায় হাসল না, ভাবল। বলল, অলটারনেটিভ অনেক হয়তো আছে। কিন্তু আমরা তা ভাবি না। তবে তোকে বলি, বিয়ে না করে চাকরি করলেই কিন্তু কিছু সুখ হয় না, ওটা ভুল ধারণা। বিয়ে যদি দাসত্ব হয় তবে চাকরি আরও দাসত্ব। ওসব চাকরির চিন্তা মাথা থেকে তাড়া।
ধর, চাকরি না করে যদি বুটিকের দোকান করি বা ফ্যাশন সেন্টার বা বিউটি পার্লার!
ব্যস, ফুরিয়ে গেল তো! আজকাল সব মেয়েই কেবল ওসব লাইনে ভাবে। প্রফেশনাল হয়ে যে কিছু লাভ হয় না তা বুঝতে চায় না। ভাবে গাদা গাদা টাকা রোজগার করলেই বুঝি খুব সুখ।
কী করব তাহলে বল তো! ঘরসংসার? সেও তো ফুরিয়ে যাওয়া। কী সুখ আছে বল!
পারুলদি একটা গভীর শ্বাস ফেলে বলে, সত্যি বলতে কী, আমার কেবল মনে হয়, আমরা একটা ভুল জীবন কাটিয়ে যাচ্ছি। আমার কথাই ধর না। তোর জামাইবাবু তো ভীষণ ভাল একটা লোক। আমার কোনও অভাব নেই। কাজকর্ম, সংসার নিয়ে দিব্যি সময় কেটে যায়। তবু মাঝে মাঝেই কেমন যেন হাঁফ-ধরা লাগে।
চোখ গোল গোল করে পান্না বলল, তোমারও হাঁফ ধরে যায়! তাহলে আমাদের কী হবে?
তাই তো বলছি, অলটারনেটিভ খুঁজে কিছু লাভ নেই। স্বামীর দাসত্ব করবি না, ঠিক আছে। কিন্তু আর যা করতে যাবি কোনওটাই বেটার অলটারনেটিভ নয়। বেশি টাকা রোজগার করারও একটা একঘেয়েমি আছে। মনে হবে, দুর ছাই, এত টাকা দিয়ে কী হবে?
যাঃ, আমার তা কখনও মনে হবে না।
এ বয়সে বুঝবি না। টাকা জিনিসটাকে কিছুতেই ভালবাসা যায় না।
কেন?
টাকা হচ্ছে বায়িং পাওয়ার। কেনা-বেচার মিডিয়াম। তাই যদি হয় তাহলে শুধু বেচা-কেনার জন্যই তো টাকা। ওটার তো আর কোনও মূল্য নেই। কনভার্টিবিলিটি ছাড়া টাকার আর কোন গুণ আছে বল।
ও বাবা, ওসব শক্ত কথা বুঝতে পারি নাকি?
তোকে অত বুঝতে হবেও না। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে তত আমার কাছে টাকা জিনিসটা অসাড় হয়ে যাচ্ছে।
তোমার অনেক টাকা আছে বলেই ওরকম মনে হয়।
মাথা নেড়ে পারুলদি বলল, না রে, তা নয়। মানুষ তো ভোগ করবে বলেই রোজগার করে। কিন্তু বুঝতে পারে না তার ভোগ করার ক্ষমতা খুব বেশি নয়। ধর আমি যদি পাঁচশোটা বেনারসি কি বমকাই কিনি, হাজার ভরি গয়না গড়াই, দশটা গাড়ি এনে গ্যারেজে ভরি বা দশটা বাড়ি তৈরি করি–কিছু লাভ হবে তাতে? ক্লান্তি লাগবে না?
ইস্, আগে হোক তো!
পারুলদি হেসে ফেলল, আচ্ছা যা, এখন ওসব বোঝার বয়স হয়নি তোর। পরে বুঝবি।
না পারুলদি, এসব বয়স হলেই বোঝা যায় না। এসব বোঝার জন্য অন্যরকম মন চাই। তুমি হলে বড়মার মতো। দেখ না, বড়মা কেমন যেন হয়ে গেছে। শাড়িগুলো বিলিয়ে দিল সবাইকে। গয়নাগুলো দিয়ে দিল। জ্যাঠামশাই চলে যাওয়ার পর থেকে বড়মা একদম পালটি খেয়ে গেছে। আমাকে তিনটে পিওর সিল্ক আর একটা আংটি দিয়েছে, জানো? হীরাকে দিয়েছে দুটো ঢাকাই, একটা বেনারসি আর ঝুমকো দুল।
পারুলদির চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। একটু চুপ করে থেকে বলল, ঠিকই বলেছিস হয়তো, মায়ের মনটাই হয়তো পেয়েছি। মা যেন বেঁচেই ছিল শুধু বাবার জন্য। বাবাই ছিল মায়ের ধ্যানজ্ঞান। এখন মা যেন ঠিক বেঁচেও নেই। মাঝে মাঝে ভয় হয় মা বোধহয় মনে মনে সহমরণেই চলে গেছে। চলে ফিরে বেড়াচ্ছে, কথা কইছে, মজার কথা শুনে হাসছে, কিন্তু মা যেন মা নেই।
উঃ পারুলদি, ওভাবে বোলো না। শুনে এখন আমার কেমন ভয়-ভয় করছে। সহমরণ কেন হবে? বড়মার মনটা খুব খারাপ, তা তো হতেই পারে।
পারুলদি অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, সারাদিন আমি কেবল মাকে ঘুরে ঘুরে দেখি, স্টাডি করি, বুঝবার চেষ্টা করি। বড্ড ভয় হয়, এত শোক সইতে না পেরে মাও যদি চলে যায়?
না না, বড়মা কেন মরবে? শোক কত কেটে গেছে দেখ না? এখন বড়মা অনেক সামলে গেছে।
মাকে দেখে রাখিস। মা তো কিছুতেই আমাদের কারও কাছে গিয়ে থাকবে না। তোরাই ভরসা।
একটা কথা জিজ্ঞেস করব পারুলদি?
বল না।
সোহাগ খুব তোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়। তোমাদের বাড়িতে অনেক লোকজন আছে বলে আসতে চায় না।
কেন রে, আমার কাছে আসতে চায় কেন?
কী জানি। তোমাকে ওর খুব পছন্দ।
তোর সঙ্গে ভাব হয়েছে বুঝি?
হ্যাঁ।
তোকে বলেছিলাম না ওর সঙ্গে বেশি মিশিস না।
কী করব বলল, বেচারার বন্ধু নেই। আমার কাছে আসে গল্প করতে।
এঁচোড়ে পাকা মেয়ে, না?
না পারুলদি, একটু পাগলি, কিন্তু ভারী ভাল মেয়ে।
মাও বলছিল, ওর নাকি আমাকে গডেস বলে মনে হয়।
হ্যাঁ। ও তো কতবার সে কথা বলে।
আর কী বলে?
তোমার প্রতি ওর ভীষণ সফটনেস!
বাজে কথা কিছু বলে না তো?
কী বাজে কথা?
খারাপ কিছু?
তোমার সম্পর্কে? না তো!
আমার গা ছুঁয়ে বল।
পান্না অবাক হয়ে পারুলের হাত ধরে বলল, গা ছুঁয়ে বলছি।
ফিক করে একটু হেসে পারুল বলে, তা হলে আনিস একদিন। সবাই চলে যাওয়ার পর।
ওরা বোধহয় খুব বেশিদিন থাকবে না। পুজোর পর কলকাতা চলে যাবে।
তা হলে পরে কখনও হবে।
একটু আনিই না একদিন পারুলদি?
পারুল একটু গম্ভীর হয়ে বলল, এখন বড় হয়েছিস, কাজেই তোকে বলা যায়। অমলদার সঙ্গে আমার একটা রিলেশন ছিল। সবাই জানে। ওর মেয়ে এলে সকলের সামনে আমার একটু অস্বস্তি হয়।
দুর! তুমি ভীষণ পিউরিটান। তাতে কী হয়? সেসব তো কবে চুকেবুকে গেছে।
পারুল হাসল, সে অবশ্য ঠিক। কিন্তু মেয়েটাকে কেন যেন আমার পছন্দ হয় না।
কেন হয় না বলো তো!
কী জানি। ভিতর থেকে একটা অপছন্দের ভাব আসে।
সোহাগ কিন্তু হেলপলেস মেয়ে।
কেন, হেলপলেস কেন?
ওর মা বাবার সঙ্গে রিলেশন খুব খারাপ। ওর মা বাবার ধারণা ওর মধ্যে কেউ ইভিল স্পিরিট ঢুকিয়ে দিয়েছে।
যাঃ!
হ্যাঁ গো। আমেরিকায় থাকতে নাকি একটা বাজে গ্রুপ ওকে চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর নাকি ব্রেনওয়াশ করে ফেরত দেয়।
ধ্যেত! গাঁজাখুরি গল্প বলেছে।
গল্পটা ও বলেনি।
তাহলে?
বলেছে ওর মা।
ওর মাকে তুই চিনিস নাকি?
হ্যাঁ, সোহাগ নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।
মহিলা কেমন?
খারাপ নয় তো!
ওটা একটা কথা হল? খারাপ না হোক, একটা রকম আছে তো!
আমার তো ভালই লাগে। কাছে গেলে গল্প-টল্প করে।
কীসের গল্প?
বিদেশের গল্প।
আমার কথা কখনও জিজ্ঞেস করেনি তো!
না। কিন্তু ভদ্রমহিলা ভীষণ ডিপ্রেশনে ভোগেন।
কেন?
তা জানি না।
.
রাইকিশোরী নামটা শুনলেই একটা কবিতার মতো কিশোরী মেয়ের ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠবেই উঠবে। সরু কোমর, সদ্য ফুটে-ওঠা বুক, অবাক মুখ, আর চোখে মুগ্ধ চেয়ে থাকা। হায়, এই রাইকিশোরী কিছুতেই মেলে না ছবিটার সঙ্গে।
বস্তা তুলে বড় টিনে সাবধানে এক অবিশ্বাস্য দক্ষতায় মুড়ি ঢেলে দিচ্ছে সে। এবাড়িতে মুড়ির খুব টান। চারটে মুনিশ ওই পুবের বারান্দায় বসে বড় বড় অ্যালুমিনিয়ামের কানা উঁচু থালায় মুড়ির পাহাড় নিয়ে বসবে। একটা তরকারি আর ডাল ঢেলে দিতে হয় মুড়ির মাথায়। তার ওপর জল ছিটকে ছিটকে মুড়িটা মেখে নিয়ে বড় বড় সূর্যমুখী লঙ্কা কামড়ে খেয়ে নেবে চোখের পলকে। দুদিন বাদে বাদেই রাইকিশোরীকে আসতে হয়।
সামান্য একটু সেজে নিতে নিতে দৃশ্যটা জানালা দিয়ে দেখছিল পান্না। কোনও মণীশ ওকে চিঠি দেবে কি কখনও? মুড়ি ফেরি করে করে যৌবন যায় রাইকিশোরীর। রূপহীনার তো প্রেম নেই।
আয়নায় নিজেকে একটু মন দিয়ে দেখে পান্না। না, নিজের চোখ দিয়ে নয়। অজানা এক মণীশের চোখ দিয়ে।
হাই।
পান্না হেসে বলে, হাই।
কোথাও বেরোচ্ছ?
সে একটু পরে গেলেও হবে। বোসো না।
আমি কি তোমাকে ডিস্টার্ব করলাম?
না তো! বোসো।
বসব না। আমার আজ চারদিকটা খুব ভাল লাগছে। শরৎকালটা এখানে ভীষণ ভাল, না?
ভীষণ।
চলো একটু হেঁটে আসি।
চলো।
আমার একটা মুশকিল হয়েছে।
কী মুশকিল?
চলো, হাঁটতে হাঁটতে বলব।
উঠোন পেরিয়ে সরু পথটা ধরে হাঁটতে হাঁটতে ভারী উদাস গলায় সোহাগ বলে, বাস্তুসাপ কাকে বলে জানো?
হ্যাঁ। কেন জানব না? এখানে অনেকের বাড়িতে আছে।
আমাদের বাড়িতেও আছে। সাপের একটা হিপনোটিক পাওয়ার আছে, তাই না?
ও বাবা! ওসব জানি না। সাপ শুনলেই আমার গা সিরসির করে।
আমি রোজ আমাদের খড়ের মাচানটার কাছে গিয়ে উবু হয়ে বসে সাপগুলোর জন্য অপেক্ষা করি।
তুমি একটা ক্ষ্যাপা মেয়ে। ওরকম করতে আছে?
আমার ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু একদিনও আমার সামনে বেরোয় না।
আচ্ছা, সাপ দেখে তোমার কী লাভ হবে বলো তো!
আমার ভীষণ একটা অ্যাট্রাকশন। সাপ তো ইভিল, যেমন, ডেভিল। সাপই ইভকে জ্ঞানবৃক্ষের ফল খাইয়েছিল। তাই না?
তাতে কী হল?
সাপ ভীষণ মিস্টিরিয়াস একটা প্রাণী। আমার অনেকদিন ধরে একটা সাপ পুষতে খুব ইচ্ছে করে। সাপটা আমার গায়ে বেয়ে বেড়াবে, গলায় পেঁচিয়ে থাকবে, মাথার ওপর উঠে ফণা তুলে থাকবে। অনেকটা শিবের মতো।
ও মা! মাথাটা তো গেছে দেখছি! কী বিটকেল ইচ্ছে রে বাবা।
সবাই তাই বলে।
সাপ-খোপের চিন্তা মাথা থেকে তাড়াও তো।
আজ একটা কাণ্ড করে ফেলেছি।
কী করেছ?
আজ সকালে একটা সাপুড়ে যাচ্ছিল। আমি তাকে ডেকে একটা সাপ কিনতে চাইলাম। তাতে সে খুব অবাক হয়ে গেল। বলল, সাপ নিয়ে কী করবেন? বললাম, পুষব। লোকটা মাথা নেড়ে বলল, সাপ পোষা বিপদের কাজ। বিদ্যে না জানলে নাকি ওসব করতে নেই।
ঠিকই তো বলেছে।
তখন আমি তাকে কিছু টাকা বখশিস দিয়ে বললাম, তাহলে আমাকে সাপ ধরা শিখিয়ে দাও। খড়ের মাচার নীচে তিনটে গোখরো সাপ আছে, সেগুলো যদি সে ধরে তাহলে আমি কায়দাটা শিখে নেব। টাকার লোভে সে রাজি হয়ে গেল।
বাস্তুসাপ ধরতে বললে? কী সর্বনাশ! তারপর?
তখন বাড়িতে তেমন কেউ ছিল না। পিসি বর্ধমানে গেছে, জেঠিমা পাড়ায় বেরিয়েছে। শুধু বাচ্চারা কয়েকজন ছিল। সাপুড়েটা কী সব মন্ত্র বলে একটা শেকড়ের টুকরো মাচার নীচে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিতে লাগল। আর ভেঁপুতে কুক কুক করে অদ্ভুত শব্দ করতে লাগল।
মা গো! তুমি তখন কোথায় দাঁড়িয়েছিলে?
আমি ওর সঙ্গে সঙ্গেই ছিলাম।
তোমার দুর্জয় সাহস ভাই! তারপর কী হল?
হঠাৎ ফোঁস ফোঁস শব্দ করতে করতে ইয়া বড় একটা সাপ খুব তেড়ে বেরিয়ে আসছিল। কী সাংঘাতিক স্পিড! লোকটা চেঁচিয়ে আমাকে বলল, দিদি সরে যান! কিন্তু জানো, সাপটা যখন বেরিয়ে এল আমি তখন তার দুটো পুঁতির মতো চোখের দিকে চেয়ে একদম হিপনোটাইজড হয়ে গেলাম। একটুও নড়তে পারিনি।
ও বাবা!
লোকটা আমাকে একটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে না দিলে ইট কুড বি ফ্যাটাল। সাপটা আমার খুব কাছে চলে এসেছিল দুম করে।
ইস, কী যে হত আজ!
লোকটা কিন্তু খুব এক্সপার্ট। সাপটা বেরিয়ে আসতেই চট করে একধারে সরে গিয়ে এক ঝটকায় সাপটার লেজ ধরে তুলে ফেলে একটা ঝাঁকুনি দিল শুধু। তারপর ঝুড়িতে ভরে ফেলল। বলল, আমার আর ঝাঁপি নেই দিদি, আজ এই একটাই ধরলাম। অন্যগুলো এখন গর্তে নেইও, ওরা এই সময়ে নাকি খেতে বেরিয়ে যায়।
ব্যাপারটা বাড়ির লোক জানে?
হ্যাঁ। জানতে পেরেই তো আজ খুব চেঁচামেচি হল। জেঠিমা ফিরতেই বাচ্চারা তাকে সাপ ধরার কথা বলে দেয়। জেঠিমা ভীষণ ভয় পেয়ে চেঁচাতে থাকে, সর্বনাশ হয়ে যাবে! বংশ থাকবে না। ভিটেমাটি উচ্ছেদ হবে…আরও কত কী! খবর পেয়ে জ্যাঠামশাই এল, বাবা কোথায় গিয়েছিল, চলে এল। তারপর রতনদাকে ডাকিয়ে আনা হল। বাবা আমাকে ভীষণ বকল আজ। তারপর রতনদার মোটরবাইকে চেপে বাবা আর রতনদা বেরোল সাপুড়েকে খুঁজে বের করতে।
পাওয়া গেল তাকে?
হ্যাঁ। বাসরাস্তায় গুমটিতে বসেছিল। তাকে ধরে নিয়ে আসা হল। সে যেসব ওষুধ ছড়িয়েছিল সেগুলো কুড়িয়ে নিয়ে সাপটাকে ছেড়ে দিয়ে গেল ফের। আমি এখন বাড়িতে খুব আনপপুলার।
তুমি হাসছ! কাজটা মোটেই ভাল কয়নি। বাস্তুসাপ ধরাও ভাল নয় শুনেছি।
আমি জাস্ট শিখতে চেয়েছিলাম। আর কিছু নয়।
ওসব শিখতে অনেক সময় লাগে, গুরুর কাছে শিখতে হয়।
সোহাগ ঠোঁট উলটে বলে, তা হবে, কিন্তু আমার মনে হয় ব্যাপারটা কিছু কঠিন নয়। আসলে দরকার স্পিড, আর ঠিক জায়গায় ধরে ফেলা, আর ভয় না পাওয়া।
তার মানে! তুমি কি সাপ ধরার চেষ্টা করবে নাকি?
মনে হচ্ছে চেষ্টা করলে পারব।
খবদার সোহাগ ও-কাজও করতে যেও না।
একটু দূর থেকে নিউ স্পোর্টিং ক্লাবের বারান্দায় কয়েকটা ছেলেকে বসে থাকতে দেখতে পেয়েছিল পান্না। চেনা ছেলেই সব।
ক্লাবঘরটা পেরিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ একটা ছেলে বেশ উঁচু গলায় বলে উঠল, এখানে বেশি রংবাজি মারাতে এলে মুখের জিওগ্রাফি চেঞ্জ করে দেব। গাঁয়ে ফুটানি মারতে এসেছে..
পান্না অবাক হয়ে ফিরে দাঁড়িয়ে ছেলেগুলোর দিকে চেয়ে বলে, কাকে বলছেন?
একটা ছেলে বলল, তোমাকে নয়। যাকে বলেছি সে বুঝতে পেরেছে।
কাকে বললেন?
বললাম তো তোমাকে নয়।
সোহাগ অন্য দিকে চেয়ে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। পান্নার হাতটা টেনে বলল, চলে এসো। দে আর কাওয়ার্ডস।
হাঁটতে হাঁটতে পান্না বলে, কাকে বলছিল বলো তো!
আমাকে।
তোমাকে! কেন বলছিল?
তা জানি না, আমি রাস্তায় বেরোলেই আজকাল কয়েকটা ছেলে আওয়াজ দেয়।
তুমি রুখে দাঁড়াওনি?
না, ঝগড়া করতে আমার ভাল লাগে না। তিন-চার দিন আগে যখন প্রথম ব্যাপারটা হয় তখন আমি একটা ছেলেকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কথাটা কি আমাকে বললেন? সে জবাব না দিয়ে চলে গেল।
খুব সাহস হয়েছে তো এদের! দাঁড়াও বিজুদাকে বলে ঠান্ডা করে দেব।
বিজুদা কে?
আমার জ্যেঠতুতো দাদা, স্পোর্টসম্যান, বিজুদাকে সবাই ভয় পায়।
তার মানে একজন পুরুষের সাহায্য চাইবে?
তাতে কী?
মাথা নেড়ে সোহাগ বলে, তাতে আমার আত্মসম্মানে লাগবে। পুরুষের অ্যাটাক থেকে বাঁচার জন্য পুরুষেরই সাহায্য নেওয়াটা কি ভাল?
এটা পুরুষ-মেয়ের ব্যাপার তো নয়, এরা বাজে ছেলে, এদের ঢিট করা দরকার।
না পান্না। বিজুদাকে বলার দরকার নেই। সব জায়গায় তো আর আমি এক একজন করে প্রোটেক্টর খুঁজে পাব না। পৃথিবীর সব জায়গাতেই অল্পবিস্তর এসব হয়। সেসব আমাকে একাই তো হ্যান্ডেল করতে হবে।
ওদের তোমার ওপর এত রাগ কেন বলো তো!
আমি তো ওদের পাত্তা দিইনা, তাই বোধহয়। দিন সাতেক আগে একটা ছেলে নির্জন রাস্তায় আমার সঙ্গে একটু ঘনিষ্ঠ হওয়ায় চেষ্টা করে। আমি মাঝে মাঝে খুব ঘোরের মধ্যে থাকি, জানো তো! সেদিনও ছিলাম। ছেলেটা কী বলছিল আমাকে, শুনতে পাইনি। ছেলেটা আমার হাতে একটা কাগজ গুঁজে দিয়ে চলে যায়। তাতে ভুল ইংরিজিতে বিচ্ছিরি বিচ্ছিরি কথা লেখা ছিল।
এ মা! কী লেখা ছিল তাতে?
ফোর লেটার ওয়ার্ডও ছিল।
কে ছেলেটা বলো তো!
তাকে আবার দেখলেও চিনতে পারব না। বললাম না, আমি তখন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম।
এসব আগে এখানে কখনও হত না, আজকাল হচ্ছে।
প্লিজ তোমার বিজুদাকে বোলো না।
যে ছেলেটা চেঁচাল তাকে আমি চিনি। শিবেন্দ্র, কামার পাড়ার দিকে থাকে। দাঁড়াও খোঁজ নিতে হবে।
কিন্তু আমাকে নিয়ে কোনও হইচই হোক আমি চাই না। আমরা তো কিছুদিন পরেই চলে যাব।
শোনো সোহাগ, আমাদের গ্রাম সম্পর্কে তুমি যদি খারাপ ইমপ্রেশন নিয়ে যাও তাহলে তুমি হয়তো আর আসতে চাইবে না, একটা খারাপ ধারণা নিয়ে বসে থাকবে।
উদাস মুখে সোহাগ বলল, একমাত্র গভীর অরণ্য ছাড়া সব জায়গাই তো খারাপ, কলকাতা ভাল নয়, মিউনিক ভাল নয়, লন্ডন ভাল নয়, নিউ ইয়র্ক ভাল নয়। না পান্না, আমার কোনও রাগ বা অভিমান হচ্ছে না।
তুমি খুব অদ্ভুত!
সবাই তাই বলে।
জানো, আজ একটা ছেলে আমাকে প্রেমপত্র দিয়ে গেছে!
সোহাগ হাসে, তাই বুঝি?
হ্যাঁ। সেটা অবশ্য লাভ লেটার, অসভ্য কথা নেই।
.
পরনে ধুতি, গায়ে হাতাওয়ালা একটা গেঞ্জি, আর ধুতির খুঁটটা তার ওপর জড়ানো, এই পোশাকে অমল গাঁয়ের রাস্তায় ঘুরতে বেরিয়েছিল, ভারী অন্যমনস্ক, এসে অবধি সে গাঁয়ের কারও সঙ্গে দেখাসাক্ষাতের চেষ্টা করেনি, পুরনো বন্ধুদের খোঁজখবর নেয়নি, কারও বাড়িতে গিয়ে বসেনি, শৈশবের স্মৃতিচারণাও তার ভাল লাগে না।
কয়েকদিন ছুটি আছে তার। ঘরে বসে বই পড়ে আর একা একা ঘুরে ঘুরে ছুটিটা কাটিয়ে দেবে সে, বাবা, ভাই, বোন, বউ, ছেলেমেয়ে কারও সঙ্গেই সে আজকাল স্বচ্ছন্দ বোধ করে না। শুধু একা থাকতে ভাল লাগে। হৃদয় খুঁড়লেই ব্যথা-বেদনার উৎসমুখ খুলে যায়।
জনহীন জায়গাগুলো তার জানা, সন্ধের পর খেলার মাঠ, পতিত জমি, জংলা জায়গা, শুধু রতনের সঙ্গে তার কিছু কথাবার্তা হয়। ছেলেটার সংসারী বুদ্ধি নেই। মোটরবাইক হল তার নেশা। সারা দিন ঝাড়ে, মোছে, যত্ন করে, টুকটাক সারাইও করে নেয়। মোটরবাইকই তার ধ্যানজ্ঞান। অন্য খেয়াল নেই, সে অমলকে প্রায়ই দুর্গাপুর বা কালনা নিয়ে যেতে চায় তার বাইকে। বর্ধমান ঘুরিয়ে আনল কাল, বেশ চালায়।
ঘুরে ঘুরে তেষ্টা পেল অমলের। একটু চা পেলে হত। কোনও অসুবিধে নেই। যে কোনও বাড়িতে ঢুকে পড়লেই হল। আদর করে বসিয়ে চা খাওয়াবে। চা পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু আজকাল কথা বলা বা শোনা তার কাছে অসহ্য ঠেকে।
বাড়িতে ফিরে ধীর পায়ে দোতলায় উঠতেই মোনালিসা দরজা খুলে দিয়ে বলল, এসো দেবদাস। তোমার পারু তোমাকে দেখা করতে বলে পাঠিয়েছে।
থতমত অমল বলে, কে?
পারু গো পারু। ভুলে গেলে নাকি?
অমল গোরুর মতো নিস্পৃহ চোখে চেয়ে থাকে।
.
১৩.
আমি ভারী অবাক হয়ে দেখছি তোকে।
কেন, অবাক হওয়ার মতো কী দেখলেন?
আমার হিসেবমতো তোর বয়স এখন পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ। ঠিক তো!
না মশাই, আপনার শ্যালিকার বয়স এখন আটত্রিশ।
বাজে বকিস না। আচ্ছা, ছত্রিশই ধরছি।
স্নেহের পাত্রী বলে সত্যি কথাটা স্বীকার করতে চান না তো!
তা নয়। হিসেব করেই বলছি।
আচ্ছা, নয় তাই হল, এবার অবাক হওয়ার কথাটা বলুন।
আমি দেখছি তোর শরীরে এক ফোঁটাও চর্বি জমেনি। আশ্চর্য সেটাই।
কেন, এতে আশ্চর্য হওয়ার কী আছে বিশুদা?
কিছু মানুষ থাকে দড়কচা-মারা চেহারা, তাদের কখনও চর্বি হয় না। কিন্তু তোর তো সেরকম সিঁটকোনো চেহারা নয়। তোর চর্বি হওয়ার কথা। এমনকী তোর পেট বা কোমরেও ভাঁজ পড়ে না। হ্যাঁ রে, ডায়েটিং করিস নাকি।
খাটে বসে আপন মনে উল বুনে যাচ্ছিল বকুল। সে পারুলের চেয়ে নয় বছরের বড় দিদি। এতক্ষণ চুপ করে থেকে এবার বলল, চিরকাল ডায়েটিং করাই তো ওর স্বভাব। সেই ছেলেবেলাতেও একটুখানি খেয়েই ওর পেট ভরে যেত।
বিশ্বনাথ মাথা নেড়ে বলে, যতই কম খাক, চর্বি না জমার কথা নয়। ওর দেখো, একটুও নেই। বেশি ডায়েটিং করলে চেহারায় একটা অসুস্থ শীর্ণতার ছাপ পড়ে, ওর তাও হয়নি।
পারুল হাসছিল, এসব ম্যাজিক মশাই, ম্যাজিক।
তুই কি ব্যায়াম করিস?
খুব বেশি কিছু নয়। সকালে বরের সঙ্গে একটু হাঁটি। আর সামান্য কয়েকটা আসন করি।
তোর বয়সটাও এক জায়গায় আটকে আছে। এখনও কলেজের ছাত্রী বলে চালিয়ে দেওয়া যায়।
বকুল বলে, ওগো, ওকে অত নজর দিও না তো! তোমার নজর বাপু খুব খারাপ। জানিস পারুল, ও যখনই আমাকে ভাল দেখে তখনই আমার শরীর খারাপ হয়।
বিশ্বনাথ হাসে, নজরের দোষ কী বল! পারুল যে আমাকে বড্ড অবাক করে দিয়েছে। দু-তিন বছর বাদে দেখা, একইরকম আছে। একটুও বদলায়নি।
হ্যাঁ রে, আমার বয়সটা বোঝা যায়, না?
তা কেন? তবে তুই একটু মোটা হয়ে গেছিস দিদি।
কী করব বল! জল খেলেও মোটা হই।
বিশ্বনাথ একজন সরকারি আমলা। রিটায়ার করার মুখে। কালোর ওপর চেহারাটা একসময়ে ভালই ছিল। কালো বলে বিয়েতে কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না বকুল। আপত্তি ছিল বকুলের মা বলাকারও। এ বংশে সবাই ফর্সা। ছেলেমেয়ে কেউ কালো নয়। তা হলে কালো জামাই কেন পছন্দ করা হচ্ছে?
গৌরহরি তাঁর স্ত্রী বলাকাকে বলেছিলেন, কালো বলে আমারও যে আপত্তি হচ্ছে না তা নয়। বকুল ফর্সা, কালো বরে তারও আপত্তি হওয়ারই কথা। কিন্তু বিশ্বনাথের যে-গুণটার জন্য সম্বন্ধ করছি তা হল ছেলেটি খুব সৎ। যে-ডিপার্টমেন্টে চাকরি করে সেখানে লাখপতি হওয়া কোনও ব্যাপারই নয়। এই ছেলেটি ঘুষ খায় না, মিথ্যে কথা বলে না, নেশা নেই। এর বাবাও সরকারি অফিসার ছিলেন, সেই মানুষটিও সৎ।
বলাকা বললেন, খুঁজলে কি অমন আর পাওয়া যাবে না?
যাবে বলাই, যাবে। খুঁজলে কী না পাওয়া যায়!
তা হলে আর একটু দেখো না। মেয়ে তো সুন্দরী, আর বয়সও বয়ে যাচ্ছে না।
গৌরহরি একটু চিন্তিত হলেন। বললেন, তুমি কখনও আমার মতের বিরুদ্ধে মত দাও না। এবার যখন দিলে তখন ভাবতে হবে। চট করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত হবে না।
গৌরহরিকে যতই স্বাধিকারপ্রমত্ত এবং খেয়ালি বলে মনে করুক অন্য লোক, পারুল জানে, তার বিবেচনাশক্তি বড় কম ছিল না।
বলাকা বললেন, ওগো, তুমি আবার আমার কথায় কিছু মনে কোরো না। পাত্র ভাল স্বীকার করছি। কিন্তু ওরা আবার বাঙাল দেশের লোক, সেটাও একটু ভেবে দেখো।
গৌরহরি চিন্তিত মুখে বললেন, সবই ভেবেছি। আবার ভাবব। চট করে কিছু করব না। কিন্তু বলাই, একটা জিনিস ভেবে দেখেছ?
কী গো?
এমন পরিবার কি আজকাল খুঁজে পাবে যারা বংশানুক্রমে ছেলের বিয়েতে পণ নেয় না?
সেটা পাওয়া মুশকিল। কিন্তু আমাদের তো টাকার অভাব নেই। পণ দিয়ে যদি ভাল পাত্র পাওয়া যায়, না হয় দিলুম পণ!
গৌরহরি হাসলেন, বেশ বললে বলাই, বেশ বললে। পণ দিলে যদি ভাল পাত্র পাওয়া যায়! কিন্তু ভেবে দেখেছ কি যারা পণ নেয় তাদের কিছুতেই ভাল বলা যায় না?
ওটা যে রেওয়াজ।
মৃদু মৃদু মাথা নেড়ে, সহাস্যে গৌরহরি বলেন, রেওয়াজ নয়, রেওয়াজ নয়। করাপশন যখন ছড়িয়ে যায় তখন সেটাকে কাস্টম বলে মেনে নেওয়া যে ভয়ংকর রকমের অন্যায়।
বলাকা একটু ভয় পেলেন। দুঁদে উকিলের সঙ্গে পেরে ওঠা তাঁর কর্ম নয় বুঝে বললেন, পণ ছাড়াও কি পাত্র জুটবে না?
জুটবে। চেষ্টা করলে পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই। দেখছি চেষ্টা করে।
তুমি রাগ করলে না তো!
না। বলছি, মেয়েটার ভালমন্দ বিবেচনা করার অধিকার তো আমার চেয়ে তোমার কম নেই। এক্ষেত্রে আমার মতামত জোর করে চাপানো ঠিক হবে না।
বিশ্বনাথকে তোমার কি খুব পছন্দ?
সে কথা থাক বলাই। আমি আর তার কতটুকু জানি? সৎ হওয়াটাই বড় কথা নয়, অন্যান্য ব্যাপারও দেখা উচিত। এইজন্যই তো বলে, লাখ কথা ছাড়া বিয়ে হয় না।
বিশ্বনাথ এরকম বাতিলই হয়ে গেল সেদিন।
বুড়ো ঘটক সর্বানন্দ ভট্টাচার্য তখনও বেঁচে। এ সম্বন্ধ তাঁরই করা। তিনি একদিন বলাকার সঙ্গে এসে দেখা করে বললেন, মা, এ সম্বন্ধ তোমার পছন্দ নয় বলে শুনলাম।
বলাকা ঘোমটা দিয়ে আড়াল থেকে বললেন, ছেলে যে কালো।
সর্বানন্দ হাসলেন। সত্তর বছর বয়সেও ঝকঝকে দাঁত। সুঠাম চেহারা। বললেন, তাই তো মা! বামুন কালো হলেই গেরো! তবে কিনা সব ক্ষেত্রেই কিছু ব্যতিক্রম থাকে। তা হলে মা, মুগেবেড়ের ছেলেটার কথা ভেবে দেখো। কুলীন, ফর্সা, যেমনটি চাও তেমন।
কী করে?
পড়তি জমিদার। ছেলে ফেলনা নয়। ডাক্তার।
তবে তো ভালই কাকা।
হ্যাঁ। ভাল। দেখো, কথা কয়ে। আমি গৌরহরিকেও বলেছি। পাত্র অপছন্দের নয়।
পণ দিতে ওঁর তো খুব আপত্তি। এরা কি পণ চায়?
তা এখনও কিছু বলেনি। কথা এগোলে বোঝা যাবে।
মুগবেড়ের পাত্রের নাম সায়ন্তন। চেহারা ভাল, ডাক্তারি পাস, জমিদারের ছেলে। আর কী চাই! তরতর করে কথাবার্তা পাকা হয়ে গেল। হ্যাঁ, পণের ব্যাপার একটু ছিল তবে ঠিক পণও বলা যায় না। পাত্রের বাবা মেয়ে দেখে পছন্দ করে আর পাঁচটা কথার পর দেনা-পাওনার প্রসঙ্গ উঠতে বললেন, পণ-টন নয়। তবে আমাদের অবস্থা এখন পড়তি। ছেলের বিলেত গিয়ে এম আর সি পি করার প্ল্যান। ফিরে এসে বাড়িতেই নার্সিংহোম করবে। অনেক টাকার পাল্লা। যদি লাখখানেক টাকা ধার হিসেবে দেন তা হলে আমি বাকিটা সামলে নিতে পারব। এ টাকাটা আমরা ধীরে ধীরে শোধ দিয়ে দেব। চাইলে সুদও পাবেন।
গৌরহরি শান্ত গলায় বললেন, সায়ন্তনকে আমার স্ত্রীর খুবই পছন্দ হয়েছে। সে উপযুক্ত পাত্র। এক লাখ টাকা ধার হিসেবে নয়, যৌতুক হিসেবেই দেব। ও নিয়ে চিন্তার কিছু নেই।
ভদ্রলোক একটু ভাবিত হলেন, যৌতুক দেবেন!
দেব।
ভদ্রলোক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আমাদের আগের অবস্থা থাকলে এসব কথা উঠত না। অবস্থা বিপাকে পড়েই–ঠিক আছে, আপনার যা ইচ্ছে।
ওঁরা চলে যাওয়ার পর বাড়িটা কিছুক্ষণ থমথম করেছিল, মনে আছে পারুলের। বলাকার মুখে যুদ্ধজয়ের হাসি ছিল না। বকুলেরও মন খারাপ। ব্যাপারটা বড় বাড়াবাড়ি হয়ে গেল যেন।
পরদিন সর্বানন্দ এলেন। বলাকাকে ডেকে বললেন, কেমন মা, সব দিক রক্ষে হয়েছে তো!
বলাকা হতাশার গলায় বললেন, মনটা ভাল নেই কাকা। এত টাকা দিয়ে বিয়ে!
তা মা, ভাল পাত্র চেয়েছিলে পেয়েছ। গৌরহরি টাকা কবুল করেছে, পুরুষের মতোই কাজ করেছে।
কিন্তু কাকা, ওঁরা তো ধার হিসেবেই চেয়েছিলেন। উনিই যৌতুক দিতে চাইলেন।
সর্বানন্দ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, বিয়ের শুরুতেই একটা ধারকর্জের সম্পর্ক কি ভাল লক্ষণ মা? শুভ কাজে ঋণ সুলক্ষণ নয়। তার চেয়ে এই তো ভাল হয়েছে।
আমার খারাপ লাগছে। উনি হয়তো আমার ওপর একটু রাগ করেই কাণ্ডটা করলেন।
সর্বানন্দ মাথা নেড়ে বললেন, তা নয় মা, তা নয়। গৌর তোমার ওপর রাগ করেনি। সেও ধারকর্জের মধ্যে যেতে চাইল না, উকিল মানুষ ত, মানুষ চরিয়ে খায়। মনুষ্য চরিত্র ওরা খুব বোঝে। ধর, ধার দিলে যদি ওঁরা শোধ দিতে না-পারেন বা ইচ্ছে করেই শোধ না-দেন তখন গোলমাল বেধে উঠতে পারে। আত্মীয়-কুটুম মানুষ তাঁরা, মামলা-মোকদ্দমাও করা যাবে না, ঝগড়া বিবাদ করলেও বিপদ। তিক্ততা যাতে না ঘটে তার জন্যই গৌরহরি গোড়া মেরে রাখল। ভালই হল, তোমার মেয়েরও খানিক হক থাকবে। শ্বশুরবাড়িতে মাথা উঁচু করে থাকতে পারবে।
আমার স্বামী কখনও টাকাকে টাকা মনে করেন না। ওইটেই ওঁর দোষ। যেখানে তিন টাকায় হয় সেখানে উনি তিনশো টাকা দিয়ে বসেন।
সর্বানন্দ ফের হাসলেন। বললেন, গৌরহরি কাঁচা মানুষ নয় মা। মেয়ের ভবিষ্যৎ ভেবেই সে টাকাটা দিতে রাজি হয়েছে। পুরনো জমিদারবাড়ি তো! তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনেক ঝুল ময়লা পোকামাকড় থাকে যে! অনেক প্রথা আছে, সহবত আছে, সেসব মেনে চলার হ্যাপা আছে। তোমার মেয়ে সব সয়ে বয়ে নিতে যদি না পারে মা? টাকাটা সেই ব্যাপারে কাজ দেবে। মেয়ের দোষঘাট আর তত দেখবেনা কেউ। কাজটা গৌরহরি ঠিকই করেছে।
সম্বন্ধটা কি ভাল হল বলে আপনি মনে করেন?
ভাল মানে! খুব ভাল। পাঁচজনকে বুক ফুলিয়ে বলার মতো সম্বন্ধ।
আমারও তাই মনে হচ্ছিল। এখন যেন মনটা কেমন আড় হয়ে আছে।
ওসব নিয়ে ভেবো না। কথা পাকা হয়ে গেছে। বিয়ের তোড়জোড় শুরু করে দাও।
পারুলের মনে আছে বিয়ে পাকা হয়ে যাওয়ার পর তার দিদি বকুল যেন কেমন মনমরা হয়ে গেল। বলতে লাগল, আমার বিয়ে দিয়ে বাবা তো সর্বস্বান্ত হয়ে যাবে। এ বিয়েতে আমার সুখ নেই।
সবাই তাকে বোঝাতে লাগল।
দুই বোন তখন এক খাটে শোয়। এক রাতে বকুল বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদছিল।
পারুল বলল, দিদি, কাঁদছিস কেন? এ মা, বিয়ে হবে, এখন কেউ কাঁদে?
আমার ইচ্ছে যাচ্ছে না রে। এ বিয়ে ভাল হবে না।
কেন? জামাইদা দেখতে কেমন সুন্দর, ডাক্তার, বড়লোক–আর কী চাস তুই?
সে আমি জানি না। আমার ভাল লাগছে না।
এক লাখ টাকা নগদ দিয়ে ক্ষান্ত হবেন না বলে গৌরহরি সোনা-দানা, দানসামগ্রীরও বেশ এলাহি আয়োজন করতে লাগলেন।
বলাকাকে বললেন, এক লাখ টাকাটা তো ওরা পাবে। আমার মেয়ে তো পাবে না। তার হাতে কী থাকবে বল! গয়নাগুলোই হবে তার অ্যাসেট।
বড় বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু!
তা হোক বলাই, তা হোক। এই আমার প্রথম মেয়ের বিয়ে। একটু পাগলামি করতে দাও।
পাত্রপক্ষ কি জানে যে, তুমি এতসব দিচ্ছ?
জানবে না কেন? সর্বানন্দ ঘটক রীতিমতো তাদের সব খবর পৌঁছে দিচ্ছে।
তারা কি খুশি?
খুশি না হওয়ার কী আছে?
বলাকা আর কিছু বললেন না। শুকনো মুখে উঠে গেলেন।
বিয়ের বোধহয় সাতদিনও তখন বাকি নেই, হঠাৎ এক মধ্যরাতে পারুলের ঘুম ভেঙে গেল বকুলের ধাক্কায়।
কী রে দিদি?
চুপ। আয় আমার সঙ্গে।
কোথায়?
পাশের ঘরে মা-বাবার কথা হচ্ছে। চল শুনি।
এঃ মা।
আয় না।
পিঠোপিঠি না হলেও তাদের দুই বোনের ভাব ছিল সাংঘাতিক। ভীষণ বন্ধুর মতো। কোনও কথাই গোপন থাকত না তাদের মধ্যে।
চুপি চুপি দুই বোন উঠে পাশের ঘরের দরজায় কান পাতল।
বলাকা বলছিলেন, আমার ঘাট হয়েছে তোমার কথা না-শুনে। বরাবর দেখে আসছি তুমি যা বল, ঠিকই বল। আমিই বারবার ভুল করে ফেলি।
তা কেন বলাই? আমি তোমার ওপর তো নির্ভরই করি। করি না বলো! যদি জানতাম তুমি বিচক্ষণ নও তা হলে কি নির্ভর করতাম। না, তা নয়। আমি তোমার মতো সাংসারিক বুদ্ধি রাখি না। আমি আমার ছেলেমেয়ের মানসিকতারও খোঁজ রাখি না। এসব ভালমন্দ বিচার করার ভার আমি তোমার ওপরেই দিয়ে রেখেছি।
তোমার পায়ে পড়ি, এ বিয়ে ভেঙে দাও।
সে কী বলছ বলাই! এখন বিয়ে ভাঙা কি সম্ভব?
কেন নয়?
এতদূর এগিয়ে কি পিছোনো যায়?
আর কেউ না পারুক, তুমি ঠিক পারবে বুদ্ধি করে বিয়েটা ভেঙে দিতে। ওগো, দশটা গাঁয়ের লোক যে তোমার বুদ্ধি-পরামর্শ নিতে আসে সে কি এমনি?
কিন্তু বিয়ে ভাঙতে চাইছ কেন?
তুমি যখন টাকাটা যৌতুক হিসেবে দিতে চাইলে তখন ভদ্রলোক একবারও আপত্তি করলেন না, মনে পড়ে?
খুব পড়ে।
ওখানেই আমার খটকা। ভদ্রলোক হলে অন্তত একবার আপত্তি করত।
দুনিয়াটা চিনলে না বলাই। শতকরা নিরানব্বই জনই তো ওরকম। কাকে ফেলে কাকে বাছবে।
বাপু, আমার মন সায় দিচ্ছে না।
তা হলে আর মনমতো পাত্র পাবে কোথায় বলো! পাত্র তো অনেক দেখলাম। সবাই কিছু না কিছু প্রত্যাশা করেই। কারও খাঁই বেশি, কারও কম। কারও চোখের চামড়া নেই, কেউ রয়ে-সয়ে চায়। কিন্তু চায় তো সকলেই। কী করবে বলো!
তোমার সেই বিশ্বনাথের কী হল?
বাঃ বলাই! সে যে কালো বলে বাতিল হয়েছে।
সে তো শুধু কালো, আর তো কিছু নয়!
না। উদ্বাস্তু পরিবার। তবে শিক্ষিত। খেটে খায়। তাদের গুণ ওইটুকুই।
তাকেই দেখো না আবার।
সেখানে তো একরকম অমত জানিয়েই দেওয়া হয়েছে। এখন কী আর
তোমার চোখ বড় একটা ভুল করে না গো। তুমি যখন তাকে পছন্দ করেছ তখন সে ভালই হবে। দেখো না গো একটু।
ভাল করে ভেবে দেখ বলাই।
ভাল করেই ভেবেছি।
তারা কিন্তু দানসামগ্রীও নেবে না। বিশ্বনাথের বাবা সাফ বলেছে, জিনিসপত্র সোনা-দানা রাখার জায়গা তাদের নেই। এসব তারা নেবে না।
তোমার পায়ে পড়ি।
ঠিক আছে বলাই, তোমার কথা আর কবে ফেলেছি?
কালো, কিন্তু কেষ্টঠাকুরের মতো কমনীয় মুখশ্রীর ভালমানুষ বিশ্বনাথ লাজুক মুখে যেদিন বিয়ে করতে এল সেদিনই তাকে খুব ভালবেসে ফেলল পারুল।
বিশুদা তার এগারো বছর বয়সি শালিটিকে বাসরঘরে একটাই মাত্র ইয়ার্কির কথা বলেছিল, আগের দিনে বিয়ে করলে শালি ফাউ পাওয়া যেত, জানো?
শুনে কী যে রোমাঞ্চ হয়েছিল পারুলের। ওই বয়সটাই অমনি।
তারপর সারাক্ষণ জামাইদার সঙ্গে লেগে লেগে ছিল সে। কী ভাল! কী নরম কথাবার্তা, কী লজ্জাশরম!
সেই বিশুদা এখন প্রবীণ এক মানুষ! চুল পেকেছে কিছু, গোঁফেও পাক। শোনা যায় তিনি বড় চাকরি করলেও তেমন সচ্ছলতা অর্জন করতে পারেননি। এখনও তাঁর বাড়িতে শৌখিন জিনিস দেখা যায় না। বকুলের গায়ে গয়না ওঠেনি, তার আলমারি ভর্তি শাড়ি নেই, যথেচ্ছ খরচ করার মতো টাকাও তারা হাতে পায় না। তাদের দুটি ছেলেই লেখাপড়ায় ভাল, এইটুকুই যা সান্ত্বনা। বড়টি এখন চল্লিশ হাজার টাকা মাইনের চাকরি করে।
না, বিশ্বনাথ জাগতিক অর্থে একজন সফল মানুষ নয়। কিন্তু এই মানুষটাকে শ্রদ্ধা করতে কখনও পারুলের অসুবিধে হয়নি।
বিশুদা, আমি আপনার সঙ্গে আমার বাবার স্বভাবের খুব মিল পাই, তা জানেন?
বিশ্বনাথ একটু হাসল। তারপর বলল, তা একটু আছে বোধহয়।
কী মিল বলুন তো!
সেটা তোরা ভেবে বলবি। আমার কেন যেন গৌরহরি চাটুজ্জেকে খুব পছন্দ হত। বিয়ের আগেই বউয়ের চেয়ে শ্বশুরের প্রতিই আমার আকর্ষণ হয়েছিল বেশি, তাই বিয়ে করতে আপত্তি করিনি।
বকুল বলল, বাবা তোমাকে ভালবাসত খুব। বলত, বিশ্বনাথের মতো ছেলে হয় না। এ মা, ওই দেখ তোমার নাম এনে ফেললাম! কী হবে!
গঙ্গাজল খাও।
তিনজনে একটু হাসাহাসি হল।
পারুল বলল, পতির নামে গতি। অত ভাবছিস কেন?
বিশ্বনাথ স্নিগ্ধ চোখে পারুলের দিকে চেয়ে বলল, হ্যাঁ রে, পারুল, তোকে একটা কথা বলব?
বলুন না।
ভাবছি, তুই আবার টেনশনে না-পড়ে যাস।
কীসের টেনশন?
অমলকে তুই শেষ অবধি কেন বিয়ে করিসনি তা জানি না। তাই জিত্তেস করছি, অমলের কি কিছু দোষ ছিল?
পারুল একটু গম্ভীর হয়ে বলে, দোষ না থাকলে তাকে বাতিল করলাম কেন বিশুদা?
কিন্তু কী জানিস, অমলকে সেদিন রাস্তায় দেখে খুব মায়া হল। কেমন উদাস, উদভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে, গায়ে ধুতির খুঁট জড়ানো। আমাকে অবশ্য চিনতে পারেনি। কী ব্যাপার কিছু জানিস?
না। তবে ওদের বোধহয় কিছু প্রবলেম আছে।
পরশু দিন সন্ধেবেলায় বেগুনক্ষেতের ওপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে এবাড়ির দিকে চেয়ে ছিল। আমি একটু চিন্তায় পড়লাম। ভাবলাম, সেই পুরনো প্রেম থেকে আবার পাগলামি দেখা দিচ্ছে না তো!
চেয়ে ছিল?
হ্যাঁ।
চেয়ে থাকার তো কিছু নেই। অনায়াসে এ বাড়িতে আসতেই তো পারে।
সেটাই স্বাভাবিক হত। দূর থেকে চেয়ে থাকাটা ভাল লক্ষণ নয়। তুই একটু সাবধানে থাকিস।
পারুল হেসে ফেলল, কেন বলুন তো! আপনার কি ধারণা অমল রায় এখনও আপনার প্রৌঢ়া শালিটির প্রতি দুর্বল?
ওরে পাগলি, তুই প্রৌঢ়া হলে আমি তো ভবলীলাই সাঙ্গ করেছি। তোর চেয়ে আমি কত বড় জানিস?
জানি। উনিশ বছর।
তবে? যাক গে, তোকে জানিয়ে রাখলাম।
বিশুদা, অমলদাকে আমিই আমার সঙ্গে দেখা করতে বলে পাঠিয়েছি। কিন্তু বেচারা হয়তো এখন একটু লজ্জা পাচ্ছে। আসতে চেয়েও চক্ষুলজ্জায় আটকাচ্ছে। তাই হয়তো চেয়ে থাকে।
সিরিয়াস কিছু নয় বলছিস?
দুর! ওসব কবে চুকেবুকে গেছে।
প্রেম-ট্রেমের কিছুই জানি না রে ভাই। আমার সব দৌড় তো ওই যে ওই উলবুনুনির কাছে গিয়ে গিয়ে শেষ হয়।
বকুল ভ্রূ কুঁচকে কী যেন ভাবছিল। হঠাৎ বলল, অমলকে আসতে বলেছিস কেন? ওর এখন না-আসাই ভাল। জ্যোতিপ্রকাশ যদি কিছু ভাবে?
পারুল হেসে বলল, তুই যেন কী দিদি! আমরা কি সেই আগের আমরা আছি কি? ম্যাচিওরড হইনি? তা ছাড়া আমি তো আমার কর্তার কাছে কিছু গোপন করিনি। সব বলে দিয়েছি। সেও তো বিশুদার মতোই একজন সরল সহজ মানুষ। কিছু মনেই করেনি।
না বাবা, কী থেকে কী হয়ে যায়! তোর বড্ড সাহস পারুল।
ও মা, সাহসের কী?
ওই তো শুনলি, বাইরে থেকে চেয়ে থাকে। চেয়ে থাকা কি ভাল?
অমলদার বয়স কত হল জানোনা?
পুরুষমানুষ সব বয়সেই খারাপ। বেশি বয়সে আরও খারাপ।
.
অমল ধরা পড়ে গেল পরদিন সন্ধেবেলায়। নানা আঘাটায় ঘুরে সে বেগুনক্ষেতটার বেড়ার ধারে এসে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। ক্ষেতের ওপাশে গাছপালার ফাঁক দিয়ে দোতলার আলো-জ্বলা ঘরটা দেখা যায়। যেন স্বপ্নের ঘর। রোজই কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে অমল। কাউকে দেখা যায় না। দেখতে চায়ও না অমল। কয়েক মিনিট সে তৃষিতের মতো চেয়ে থেকে ফিরে যায়।
আজ সে হয়তো একটু বেশিক্ষণ দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ একটা সাইকেল কোথা থেকে সাঁ করে এসে তার কাছেই ব্রেক কষল।
এই, কে রে ওখানে?
অমল চমকাল না। ধীরে শুধু মুখটা ঘোরাল।
কে? এখানে দাঁড়িয়ে কী হচ্ছে?
অমল জবাব দিল না। ছেলেটা সাইকেল থেকে নেমে কাছে এল।
আরে! অমলদা?
অমল চিনতে পারল। বিজু।
এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন অমলদা?
এমনি। দেখছি। অনেকদিন বাদে এলাম তো!
আসুন না ভিতরে।
না থাক।
থাকবে কেন? আসুন। বড়মা খুব খুশি হবে।
.
১৪.
পুরনো কৌটো বাউটো ডাঁই হয়ে জমে আছে খাটের তলায়, তাকে, রান্না আর ভাঁড়ারঘরে। মায়াবশে কিছুই ফেলা হয়নি তেমন। কত কৌটো বহুকাল খোলাই হয়নি। কী আছে তার মধ্যে কে জানে বাবা। আমসি, শুকনো কুল, ত্রিফলা কি গোলমরিচ। কৌটোগুলো বিদেয় না করলেই নয়। খাটের নীচে মশার আজ্ঞা হয়েছে, পোকামাকড় বেড়েছে, ইঁদুরের খুটখাট বাড়ছে, বাড়ির বেড়ালটা এই নিয়ে তিনবার প্রসব করল বলাকার খাটের তলায়।
দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকলে বলাকা কৌটো নিয়ে পড়লেন। তা শ দেড় দুই তো হবেই। নানা মাপ, নানা আকৃতির সব কৌটো, দু-চারটে সেই ইংরেজ আমলের জিনিসও আছে।
পুরনো, ভুলে-যাওয়া কৌটো খোলার মধ্যে একটি রহস্যরোমাঞ্চ আছে। কোন কৌটো থেকে কী বেরিয়ে পড়ে তা কে জানে! একবার একটা ওভালটিনের পুরনো কৌটোর মধ্যে হঠাৎ একছড়া সোনার হার পেয়েছিলেন বলাকা। বোধহয় কোনও কাজের মেয়ে চুরি করে লুকিয়ে রেখেছিল, কিন্তু নেওয়ার সময় পায়নি। সেই হারছড়া ছিল তাঁর মেজো জায়ের। পেয়ে সে কী আনন্দ!
দুখুরি কৌটো টেনে আনছে আর বলাকা একটা চ্যাপটা চাবির মুখ দিয়ে ভুটভাট শব্দে কৌটো খুলছেন। বেরোচ্ছেও জিনিস অনেক। একটা হালকা কৌটো না খুলেই বাতিল করতে গিয়ে কী ভেবে খুলে দেখলেন তার মধ্যে ঠাসা তেজপাতা। কবেকার কে জানে! আর একটা হালকা কৌটো থেকে তিনটে খুঁধুলের ছোবড়া বেরোল। শ্বশুর-শাশুড়ি আর তিন ভাইয়ের যৌথ সংসারেই জমেছিল এসব। কিছু জায়েরা নিয়ে গেছে, কিছু পড়ে আছে।
ভাগাভাগির ব্যাপারটা কখনও ভাল চোখে দেখেননি বলাকা। গৌরহরি যখন তার দুই ভাইয়ের অংশ বিপুল দামে কিনে নিয়েছিলেন তখন বলাকা রাগ না করে খুব আদুরে গলাতেই বলেছিলেন, ওগো, এত বড় বাড়ি দিয়ে আমরা কী করব? শ্বশুরমশাই তিন ছেলের জন্য তিনটে দালান করে গেছেন, আমাদের তো অকুলান হচ্ছিল না!
ভাইয়ে ভাইয়ে একটু তফাত থাকলে সম্পর্কটা ভাল থাকে।
সম্পর্ক কি খারাপ হচ্ছিল? কিছু তো বুঝতে পারিনি। বেশ তো ভাবসাবই ছিল সকলের।
তা ঠিক বলাই। বাইরের সম্পর্ক ভালই ছিল। কিন্তু হঠাৎ আমার রোজগারপাতি বেড়ে যেতে লাগল। তখন মনে হচ্ছিল শিবে আর রেমো কেমন যেন মুখ গোমড়া করে থাকছে। হয়তো হিংসে হতে লেগেছে। কাছাকাছি থাকলে ক্রমে ক্রমে ওটা বেড়ে যেত। তাই গোড়া মেরে রাখলুম।
কিন্তু মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে, ছেলেরা বাইরে থাকে, এত বড় বাড়িটা খাঁ-খাঁ করে যে গো!
অভ্যেস হয়ে যাবে বলাই, ধৈর্য ধরো।
খেয়ালি পুরুষটির সব সিদ্ধান্তের উচিত-অনুচিত আজও বুঝতে পারেন না বলাকা। মন মানতে চায়নি তবু গৌরহরি যা বলেছেন তা বরাবরই মেনে নিয়েছেন বলাকা। মানুষটা তার চেয়ে পনেরো বছরের বড়, ইয়ারবন্ধু তো নয়। বরং যেন খানিকটা বাবার মতোই এক অভিভাবক।
পুরনো কৌটোর অন্ধকারে সেকেলে বাতাস জমে আছে আজও। মুখ খুললেই ভ্যাপসামতো গন্ধ। বলাকার বেশ লাগে। কত বছরের সঞ্চিত বাতাস তার মুখে এসে লাগে। গা সিরসির করে।
কৌটোয় কী খুঁজছ মা? পয়সা?
বলাকা হেসে ফেলেন, হ্যাঁ, পয়সাই খুঁজছি। পেলে তোকে দেব।
আমি সারা বাড়িতে কত পয়সা কুড়িয়ে পাই জান? সব একটা কৌটোয় জমিয়ে রেখেছি। ঝাঁট দিতে গেলেই পয়সা পাই।
স্মিতমুখে বলাকা বলেন, পয়সা জমিয়ে কী করবি?
তোমাকে একটা জিনিস কিনে দেব।
ওমা! আমাকে আবার কী জিনিস দিবি রে?
পয়সা জমিয়ে তোমাকে একটা মহাভারত কিনে দেব। সেদিন যে বলছিলে তোমার মহাভারতখানা কে যেন নিয়ে গিয়ে আর ফেরত দেয়নি!
ও বাবা! তাও মনে রেখেছিস! দিতে যে চেয়েছিস সেই ঢের। ওতেই তোর দেওয়া হয়েছে।
একটা কৌটোর মধ্যে কিছু খুচরো পয়সা পেলেন বলাকা। কেউ বোধহয় জমাতে শুরু করেছিল, বেশি পারেনি। মোট পাঁচ টাকা চল্লিশ পয়সা। বলাকা পয়সাটা দুখুরির হাতে দিয়ে বললেন, তোর কৌটোয় জমিয়ে রাখিস।
নীচের উঠোনে নিত্যানন্দ বসে আছে। সঙ্গে দুই ছেলে আর পাঁচখানা বস্তা।
দুখুরি বারান্দায় গিয়ে ডাক দিল, এসো গো, কৌটো নেবে যে!
নিত্যানন্দ ওপরে উঠে এল।
বলাকা বললেন, এই নে বাবা, কতগুলো জমেছে দেখ।
নিত্যানন্দ কাঁচুমাচু হয়ে বলে, ওসব পুরনো কৌটো মা, দশ-বিশ পয়সাতেও বিকোবে না।
দুর মুখপোড়া! তোর কাছে পয়সা কে চেয়েছে। এগুলো বিদেয় কর আগে। পয়সা লাগবে না।
নিত্যানন্দ একগাল হাসল। তারপর ছেলেদের ডেকে নিয়ে টপাটপ বস্তায় কৌটো ভরতে লাগল।
কৌটোগুলো বিদেয় হওয়ায় খাটের তলায় এখন হাওয়াবাতাস খেলছে, ঘরটাও হালকা দেখাচ্ছে।
বলাকা ঘরের আলমারি আর আসবাবগুলো দেখছিলেন। তাঁর এত লাগে না। ধীরে ধীরে বাহুল্য জিনিসগুলো বিদেয় করে দেবেন। জিনিস বিক্রি করা খুব অপছন্দ করতেন গৌরহরি। বলাকা বিক্রি করবেন না। বিলিয়ে দেবেন। তবে তার আগে ছেলেমেয়েদের মতামত নিতে হবে। ওরা যদি চায় তো ভাল, নইলে নেওয়ার লোক মেলা পাওয়া যাবে।
তুমি কি বাঁধন কাটতে চাইছ মা?
বলাকা হেসে বললেন, আমাকে নিয়ে তোর এত ভয় কেন বল তো পারুল?
পারুল মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, তোমার হাবভাব আমার মোটেই ভাল লাগে না। এবার তোমাকে আমি জামশেদপুর নিয়ে যাবই। চোখের আড়ালে তুমি কী করে বসবে তার ঠিক নেই।
ও কথা বলছিস কেন? আমি তো বেশ আছি।
তুমি যেন কেমন উদাসী হয়ে গেছ।
দুর পাগল! উদাসী হওয়ার কি জো আছে? তোর বাবা চলে যাওয়ার পর দুনিয়াটা কেমন পানসে হয়ে গিয়েছিল ঠিকই, মনে হত বেশিদিন বাঁচব না।
তুমি বাবার সঙ্গে সহমরণে যেতে চেয়েছিলে মা। আমার সব মনে আছে।
বলাকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, সে আর তোরা যেতে দিলি কই? গেলেই যে বাঁচতুম। তাকে ছাড়া যে বেঁচে থাকা কী কঠিন তোরা বুঝবি না।
খুব বুঝি মা। আর বুঝি বলেই ভয় পাই। সংসার থেকে তুমি যেন তোমার মন গুটিয়ে নিচ্ছ।
পারুলের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলাকা বলেন, তা যদি পারতুম তাহলে তো ভালই হত। মন তুলে নিই সাধ্যি কি? ওই যে দুখুরি ওটার জন্য নতুন করে মায়ার বাঁধনে পড়লুম, গোরু, কুকুর, বেড়াল, এই বাড়ি, কাজের লোকেরা কার জন্য মায়া না করে পারি বল? মন তুলে নেওয়া কি সোজা কথা? আর তোর বাবার আক্কেল দেখ, এত বড় একখানা বাড়ি আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে গেছে। তাও দেওররা, জায়েরা থাকলে একটু জনমনিষ্যি থাকত। সারাদিন এই বিশাল বাড়িটায় থাকা কি সোজা?
তাই তো বলি আমার কাছে চলো।
এ-জায়গা ছেড়ে দুনিয়ার আর কোথাও গিয়ে থাকতে মন চায় না। শীতকালে গিয়ে দু-চারদিন থেকে আসবখন।
বলাকাকে নিয়ে যেতে চায় সবাই। তারা ভাবে, এখানে একা পড়ে থাকা মায়ের পক্ষে কষ্টকর। কিন্তু সেটা ওদের দিক থেকে ভাবা। বলাকার দিক থেকে ভাবনা অন্যরকম।
এই যে দুধের মতো সাদা গোরু আলো। দুখানা মায়াবি চোখ দিয়ে যখন চেয়ে থাকে বুকটা উথলে ওঠে। গৌরহরির প্রিয় এই গোরুটা এমন ভালবাসত তাকে যে গৌরহরি এসে গায়ে হাত দিয়ে না দাঁড়ালে দুধ ছাড়তে চাইত না। গৌরহরি চলে যাওয়ার পর কী বুঝল কে জানে, খুব ডাকত সারা দিন। দুখানা চোখ যেন টলটল করত। অবোলা জীবের সেই শোক যেন বলাকাকেও আচ্ছন্ন করেছিল। বলাকা গিয়ে রোজ আলোর গলায় মাথায় হাত বোলাতেন। মানুষের ভাষায় কত কথা বলতেন। গোরুর তা বুঝতে পারার কথা নয়। কিন্তু যেন বলাকার মনে হত আলো সব বুঝতে পারছে। ধীরে ধীরে যেন আলোর শোক কমে গেল। বলাকা নতুন মায়ার বন্ধনে পড়লেন। আসলে নতুন নয়, গৌরহরির প্রিয় যা কিছু সেগুলিকে ভালবেসে যেন গৌরহরির অস্তিত্বই ফের খুঁজে পান বলাকা। আজকাল তার মনে হয়, না, মানুষ অত সহজে মরে না। মরার পরও তার কত কী থেকে যায়। অস্তিত্ব কি শুধু দেহটাতে? তার সত্তাও যে ছড়িয়ে থাকে কত কিছুর মধ্যে।
এসব গূঢ় সত্য সবাই কি বুঝতে পারে? ছেলে-মেয়েরা ভাবে মা বড় একা। ওটা একপেশে দেখা। গৌরহরি যেদিন চলে গেলেন সেদিন তাঁর সঙ্গে বলাকারও চলে যেতে ইচ্ছে হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু তার পর ধীরে ধীরে তিনি ফের নানা অনুষঙ্গে ফিরে পাচ্ছেন গৌরহরিকে। এখন তার একাকিত্ব তত তীব্র নয়।
ওই যে স্টিলের আলমারিটা, ওটা নিবি পারুল? তোর বাবা বোম্বে থেকে অর্ডার দিয়ে আনিয়েছিল। সিকিম জিনিস, এত দিনেও একটুও রং চটেনি।
পারুল হেসে বলে, থাক না মা এসব তোমার কাছে। যেখানে যা আছে সব একইরকম থাক। তাহলে বাড়িতে এসে অচেনা ঠেকবে না কিন্তু, ছেলেবেলাটা ফিরে আসবে। না মা, তুমি সব বিলিয়ে দেওয়ার মতলব ছাড়।
কী ভাবি জানিস? আমি পট করে মরে গেলে
নরম হাতে বলাকার মুখ চাপা দিয়ে পারুল বলে, জানি তুমি মরার জন্য পা বাড়িয়েই আছ। ওসব চিন্তা কর বলেই সারাক্ষণ তোমার জন্য আমার ভাবনা হয়। মরতে চাও কেন মা? বাবা নেই বলে? আর এই যে আমরা আছি আমরা কি বাবার অংশ নই? পিতা তো জায়ার ভিতর দিয়েই ফের জন্মায় সন্তান হয়ে। জান?
মরতে চাই কে বলল? তা নয় মা, আসলে আট-দশটা আলমারি, বাক্স- প্যাঁটরা সবই প্রায় ফাঁকা। হয়ে গেছে। এগুলো পড়ে থেকে
থাক মা, পড়েই থাক।
বলাকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, নিলে তোদের ভোগে লাগত।
এখনও ভোগেই লাগছে। এই যে বাড়িতে এলে বাক্স-প্যাঁটরা, আলমারি, খাট-পালঙ্ক দেখতে পাই। তাতেই মনটা আনন্দে ভরে ওঠে। সেটা কি উপভোগ নয়? ভোগ মানে কি আলমারিটাতে ঠেসে জিনিসপত্র ভরে রাখা?
বলাকা হার মানলেন।
সারা বাড়িতে এখন আনন্দের হাট। মেয়ে-জামাই, ছেলে-বউমা, নাতি-নাতনি মিলে সারাদিন আড্ডা হচ্ছে, বেড়াতে যাওয়া হচ্ছে, পিকনিকেরও তোড়জোড় চলছে। বলাকা দূর থেকে এসব খুব উপভোগ করেন। বড় একটা ওদের মধ্যে গিয়ে পড়েন না। তাতে বোধহয় তাল কেটে যায়। ওদের একটা বয়সের বন্ধুত্ব আছে, সেখানে গুরুজনদের গিয়ে হুট করে ঢুকতে নেই। ডাকলে আলাদা কথা।
.
আজ সকালে দুটো ভাড়া করা গাড়িতে বোঝাই হয়ে ওরা কাটোয়ার দিকে কোথায় যেন পিকনিকে গেল। বলাকাকেও টানাটানি করেছিল, বলাকা যাননি। তবে দুখুরিটাকে পাঠিয়েছেন। বেচারা সারাদিন তো তার কাছেই পড়ে থাকে, যাক আজ একটু আনন্দ করে আসুক।
দুপুরবেলা চুপিসাড়ে মেয়েটা এল। ঠিক চোরের মতো। মুখে একটু ভয় মেশানো হাসি। পরনে সেই ঝালঝালে পোশাক। সাজগোজের বালাই নেই।
বলাকা দুপুরে ঘুমোন না। সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে টুকটাক কাজ করেন। কাজ না পেলে শুধুই ঘুরে বেড়ান বা বই পড়েন। একা থাকা তার অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে।
দুপুরে আজ বলাকা উঠোনে চাটাই পেতে শীতের লেপ-কম্বল রোদে দিয়েছেন। কাক-টাক যাতে এসে বসতে না পারে তার জন্য হাতে গৌরহরির হাতির দাঁতের হাতলওয়ালা লাঠিটা নিয়ে বসে আছেন। কাক-শালিক এসে কাছাকাছি হুটোপাটি করলেই বলছেন, হুশ।
এবাড়ির কাক-শালিকগুলোও তার চেনা। রোজই ঘুরে ফিরে আসে। বলাকার হাতে লাঠি হলেও চোখ জুড়ে মায়া। ওরাও তো জন। নিঃসঙ্গে সাথী।
আমি একটু আসতে পারি?
উঠোনে ঢোকার আগলটার বাইরে মেয়েটা দাঁড়িয়ে।
ও মাঃ! এসো ভাই, এসো!
মেয়েটা সসংকোচে ঢুকল।
ওই মোড়াটা টেনে এনে আমার কাছে বোসো।
লক্ষ্মী মেয়ের মতো মেয়েটা বসল।
আজ এলে! আজ যে বাড়ি ফাঁকা! তোমার বান্ধবী পান্নাও গেছে ওদের সঙ্গে পিকনিক করতে।
জানি। আমি তো আপনার কাছে এসেছি, আর কারও কাছে নয়।
কী ভাগ্যি আমার! তোমার বয়সি মেয়েরা আজকাল আর আমার মতো বুড়ির কাছে আসতে চায় না। জেনারেশন গ্যাপ না কী বলে যেন ছাই।
সোহাগ একটু হাসল। তারপর বলল, আপনারা খুব হ্যাপি ফ্যামিলি, তাই না?
বলাকা ভ্রূ কুঁচকে একটু ভাবলেন। তারপর বললেন, এটা একটা আশ্চর্য কথা বললে! আমি তেমন করে ভেবে দেখিনি কখনও। কিন্তু সত্যিই বোধহয় আমাদের হ্যাপি ফ্যামিলি। তেমন কোনও সমস্যা নেই। ঝগড়াঝাটি নেই। বউমারা খারাপ নয়, জামাইরাও ভাল। আমার দুঃখ নেই।
মেয়েটা তাকে খুব অবাক করে দিয়ে বলল, কিন্তু হ্যাপিনেস কি সবসময়ে ভাল?
ওমা! বলে কী গো মেয়েটা! হ্যাপিনেস ভাল নয় বুঝি?
সোহাগ মলিন মুখ করে বলে, আমি তো একটু পাগল, তাই আমার মাথায় খুব অদ্ভুত অদ্ভুত কথা আসে।
কী কথা?
কেন যেন মনে হয়, খুব হ্যাপি হওয়া ভাল নয়।
কেন বল তো!
তাতে মানুষের সার্চ কমে যায়, সে অলস হয়ে পড়ে, তার মন ঘুমিয়ে পড়ে।
বলাকা একটু অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে চেয়ে থাকেন। তারপর মৃদু স্বরে বলেন, মানুষ তো সুখী হতেই চায়, আর সেটা চায় বলেই তো সে কত পরিশ্রম করে, কষ্ট করে। তাই না? তোমার কি মনে হয় আমার মন ঘুমিয়ে পড়েছে?
মেয়েটা খুব লজ্জার হাসি হাসল, কিন্তু জবাব দিল না।
বলাকা বললেন, সুখ তো এমনিতে আসেনি। অনেক কষ্ট করতে হয়েছে তার জন্য। সব সময়ে তো আর সুখে থাকিনি।
মেয়েটা কিছু বলল না, সামনের দিকে চেয়ে বসে রইল।
তুমি কী বল? অসুখী হওয়াই ভাল?
মেয়েটা মাথা নেড়ে বলে, জানি না। আমরা তো ভাল নেই। আমরা খুব আনহ্যাপি।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ। আমাদের পরিবারের মধ্যে সবাই সবার অ্যান্টি।
সে কী! তা কেন?
জানি না। ওইরকমই হয়ে গেছে।
এরকম হওয়া তো উচিত নয় ভাই।
আমার খুব মনে হয়, আমি অন্য কোনও ফ্যামিলিতে জন্মালে খুব ভাল হত।
তুমি তোমার মা-বাবাকে ভালবাস না?
কী জানি! ভালবাসা ব্যাপারটাই তো বুঝতে পারি না। শব্দটা আমার কাছে অদ্ভুত লাগে।
মা বাবাকে ছেড়ে থাকতে কষ্ট হয় না?
না। একটুও না। আমার তো সব সময়ে কোনও নির্জন জায়গায় পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে।
বলাকা একটু ভেবে সন্তর্পণে বললেন, অমল কত ভাল চাকরি করে। তোমার মাও তো অনেক পাস টাস শুনেছি। অমল ছেলেও তো খুব ভাল। তাহলে তোমার এরকম মনে হয় কেন?
বোধহয় আমিই স্বাভাবিক নই।
আমার তো কখনও তা মনে হয়নি! তোমাকে আমার বেশ লাগে। সাজগোজ নেই, নিজের প্রতি বিশেষ নজর নেই, চুলটা অবধি ভাল করে আঁচড়াও না কখনও। বেশ তো সরলসোজা মেয়ে তুমি।
সাজতে আমার ভাল লাগে না। কী হবে সেজে?
এ তো বুড়ো বয়সের প্রশ্ন। তোমার বয়সে কি এরকম কেউ ভাবে?
আমি বোধহয় মনে মনে বুড়োই হয়ে গেছি।
দুর পাগল!
আমি একটা কথা বলতে এসেছি।
কী কথা?
এই গ্রামে কতগুলো ছেলে মাঝে মাঝে আমাকে টিজ করে।
তাই নাকি?
সব জায়গাতেই এসব একটু-আধটু হয়। আমি মাইন্ড করি না। আমি কাউকে ভয়ও পাই না।
কিন্তু টিজ করবে কেন? দাঁড়াও, আমি বিজুকে বলে দেবোখন।
আমি সে কথাটাই বলতে এসেছি।
বিজুকে বলার কথা তো!
না, বিজুকে বারণ করার কথা।
ওমা! কেন?
সেদিন পান্নার সঙ্গে বেরিয়েছিলাম, তখন ওর সামনেই কতগুলো ছেলে আমাকে টিজ করেছিল। পান্না বলেছিল, ওর দাদা বিজুকে বলে ওদের ঢিঢ করে দেবে। আমি বারণ করেছিলাম। কিন্তু পান্না শোনেনি। ও ওর বিজুদাকে বলে দিয়েছিল।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। আর তার ফলে সেই ছেলেগুলোকে একটা ক্লাবের ছেলেরা এসে খুব মারে। মার দিয়েই হয়নি, ওদের নিয়ে এসে আবার আমার কাছে ক্ষমাও চাইয়েছে। আমার খুব খারাপ লেগেছে।
কেন, এ তো ভালই হয়েছে। ছেলেগুলো আর তোমার পিছনে লাগবে না।
এই ছেলেগুলো হয়তো আর লাগবে না। কিন্তু সেটা তো সলিউশন নয়। আমাকে তো সব জায়গায় কেউ প্রোটেকশন দেবে না। আর প্রোটেকশন আমি তো চাইও না। আমার খুব অপমান লেগেছে।
বলাকা হাসলেন, তুমি আজকালকার মেয়ে তো, তাই পুরুষদের প্রোটেকশন নিতে চাও না বোধহয়। কিন্তু ভাই, চিরকাল যে তাই হয়ে এসেছে।
আপনার কি মনে হয় না, এখন কিছু অন্যরকম হওয়া উচিত?
আমি পুরনো আমলের মানুষ, চিরকাল পুরুষের ছায়ায় বড় হয়েছি, আমি কি আর তোমাদের মতো করে ভাবতে শিখেছি?
সেই জন্যই কি আপনি এত হ্যাপি?
কী বলছ বুঝিয়ে বলো।
চিরকাল পুরুষের প্রোটেকশনে ছিলেন বলেই আপনার গায়ে কোনও আঁচ লাগেনি। এই প্রোটেকশন নেওয়াটাকে আপনার অপমান বলে মনে হয় না?
বলাকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, পাগলি, প্রোটেকশন কি পুরুষেরও দরকার হয় না? না হলে এত পুলিশ, মিলিটারি, এত আইনকানুনের তো প্রয়োজনই থাকত না। প্রোটেকশন যে একটা ভীষণ দরকারি জিনিস। না বাপু, পুরুষমানুষের সাহায্য নিতে আমার তো কখনও অপমান লাগেনি।
কিন্তু প্রোটেকশন নেওয়ার অভ্যাস হয়ে গেলে কি মানুষ খুব নাবালক থেকে যায় না? বিপদ হলে একজন এসে বাঁচাবে এরকম ধারণা থাকলে মানুষের ডেভেলপমেন্ট কি ভাল হয়?
ও বাবা! ওসব যে শক্ত শক্ত কথা! তা ভাই, তোমার মতো করে আমি তো ভাবতে শিখিনি। কিন্তু স্বীকার করি, তোমার মতো করে ভাবাও বোধহয় খারাপ নয়। আজকাল তো পুরনো ধ্যানধারণা পালটে যাচ্ছে।
হঠাৎ ফিক করে হেসে ফেলল সোহাগ, বলল, হ্যাপিনেস মানেই কিন্তু সেন্স অফ সিকিউরিটি। আমার কখনও বিপদ হবে না, কখনও অভাব হবে না, আমার সব কিছু ঠিকঠাক থাকবে, আমাকে বাঁচানোর জন্য কিছু লোক সবসময়ে প্রস্তুত থাকবে, কেউ আমার নিন্দে করবে না! তাই না?
বলাকা ভারী অবাক হলেন। বললেন, তোমার বয়স কত?
আমি খুব পাকা, না? আমি সতেরো প্লাস।
ভাই, তুমি মোটেই এঁচোড়ে পাকা নও। তোমার বেশ মাথা আছে।
তা কিন্তু নয়। পড়াশুনোয় আমি ডাব্বা। তবে আবোলতাবোল ভাবতে খুব ভালবাসি।
কিন্তু কথাগুলো তো খারাপ বললে না! সুখ ওটাকেই বলে বটে। হ্যাঁ গো মেয়ে, সুখী মানুষকে তোমার ঘেন্না হয় না তো?
জোরে মাথা নাড়া দিয়ে সোহাগ বলে, না তো! আমার তো আপনাকে ভীষণ ভাল লাগে।
বলাকা হেসে ফেললেন, আমাকে আবার সুখী মানুষের সর্দার ভেবো না। অত কি সুখ আমার! গাঁয়ে পড়ে আছি, শোকাতাপা মানুষ, নিঃসঙ্গ জীবন। যত সুখী ভাবছ ততটা নই। তবে দুঃখও তেমন কিছু খুঁজে পাই না। আসল কথা কী জান, সুখদুঃখের বোধটাই বোধহয় ভোঁতা হয়ে গেছে। সেও একরকম ভালই।
আমি আপনাকে হ্যাপি বলিনি। আমি বলেছি আপনাদের ফ্যামিলিটা খুব হ্যাপি। সবাই কেমন হাসিখুশি ডগোমগো। আপনি তো তা নন।
বলাকা একটু হাসলেন।
সোহাগ বলল, পান্নার কাছে শুনেছি আপনার হাজব্যান্ড মারা যাওয়ায় আপনি খুব ভেঙে পড়েছিলেন। সবাই ধরে নিয়েছিল আপনিও বেশিদিন বাঁচবেন না।
বলাকা স্মিতমুখে বললেন, অনেকে এখনও মনে করে আমি বেশিদিন বাঁচব না।
আপনি আপনার হাজব্যান্ডকে খুব ভালবাসতেন, না?
কী জানি ভাই, তোমার মতোই ভালবাসার তত্ত্ব আমারও জানা নেই। শুধু টের পেতুম, ও মানুষটা আমার শ্বাসবায়ুর মতো, বুকে ধুকপুকুনির মতো। সে ছাড়া নিজেকে ভাবতেই পারতাম না।
সেটা কী করে সম্ভব? ইগো নেই? স্বাধীন মতামত নেই? ব্যক্তিত্ব থাকবে না?
তাই তো! সেসব বোধহয় আমার ছিল না। আমি বোধহয় খুব বোকা ছিলাম। আর তার জন্যেই এতগুলো বছর তো দিব্যি হাসিমুখে কাটিয়ে দিতে পেরেছি। তোমরা কি পারবে?
মাথা নেড়ে সোহাগ বলে, না। আমি কখনও আপনার মতো হতে পারব না। আমি চিরকাল একজন আনহ্যাপি মেয়ে হয়ে থাকব।
.
১৫.
যিশু এসে দাঁড়ালেন কদমগাছের তলায়। সন্ধিক্ষণ সমাগত। একটি আর্তনাদ শোনার জন্য অপেক্ষা করছে পৃথিবী। সেই আর্তনাদকে কোলাহলে ডুবিয়ে দেওয়ার জন্য ঢাক বাজছে। ঢাকি নাচছে।
ঈশ্বরপুত্র কখনও সুখী ছিলেন না। তিনি কখনও সুখী হবেনও না। সুখী হতে নেই তাঁর। বুকে দুহাজার বছরের পুরনো দীর্ঘশ্বাস নিয়ে তিনি কদমগাছের গায়ে হাতের ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ছাগশিশুটি ঘাসপাতা খেতে খেতে মাঝে মাঝে মুখ তুলে তাঁকে দেখছে।
মণিরাম… মণিরাম, তুমি যেখানেই থাকো মূল মণ্ডপের সামনে চলে এসো, তোমার পিসিমা তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন। মণিরাম… আজ রাত নয় ঘটিকার পর সবুজ সংঘ আয়োজিত নাট্যাভিনয় নটীর পূজা-নটীর পূজা… যাঁরা অঞ্জলি দেবেন তাঁরা দয়া করে লাইন দিয়ে আসুন…
যিশু চেয়ে আছেন। ছাগশিশুটি চেয়ে আছে। চোখে চোখ।
আমার অনন্ত ক্ষুধা প্রভু। ক্ষমা করুন।
ক্ষুধার কথা আমার মতো আর কে জানে বাছা। ক্ষুধা অনন্ত, তার কোনও নিবৃত্তি হল না আজও।
ক্ষুধা, ভয়, বংশবিস্তার ছাড়া আমাদের আর কী আছে প্রভু? বড় সামান্য এ জীবন।
জীবন সামান্য নয়। একটি জীবাণুরও জীবন এক আশ্চর্য ঘটনা, কত বিচিত্র অণু-পরমাণুর সমাহারে ওই শরীর রচিত হয় আর তার প্রকোষ্ঠে দীপাধারের মতো রহস্যময় প্রাণের শিখা। না বাছা, জীবন সামান্য নয়।
আপনার দীর্ঘশ্বাসে মথিত হচ্ছে বাতাস। সন্ধিক্ষণ সমাগত। শিয়রে শমন। আমি আমার শেষ আহার গ্রহণ করছি, যূপকাষ্ঠে একটি আঘাত আমার সব আলো নির্বাপিত করে দেবে। প্রভু, আপনার চোখের জলটুকুই আমার এ সামান্য জীবনকে অসামান্য করে তুলেছে। আপনি আমার জন্য কাঁদছেন ইহজীবনে এর চেয়ে সুন্দর আর কিছু ঘটেনি কখনও।
আমার চোখের জল কখনও শুকোয় না বৎস। কান্না ছাড়া আমি তোমাকে আর কী-ই বা দিতে পারি।
মাইক টেস্টিং…হ্যালো, হ্যালো… ওয়ান, টু, থ্রি, ফোর…ইলেকট্রিশিয়ান কালু, ইলেট্রিশিয়ান কালু, মণ্ডপের বাঁদিকে স্টিক লাইটটা খুলে গেছে, এখনই ঠিক করে দাও, নইলে অ্যাকসিডেন্ট হতে পারে… আজ রাত নয় ঘটিকার পর নাট্যাভিনয় নটীর পূজা… নটীর পূজা… সবুজ সংঘের নটীর পূজা.. পরিচালনা করবেন পারুল গাঙ্গুলি… মুখ্য ভূমিকায় পান্না চ্যাটার্জি, অনামিকা রায়… ভলন্টিয়াররা দেখো, অঞ্জলি দেওয়ার জায়গায় বড্ড ভিড় জমে গেছে…
প্রভু, আপনার ক্ষতচিহ্ন এখনও রক্তমুখ। আপনার মুখ বেদনায় নীল, আপনার ব্যথার অবসান নেই প্রভু?
পৃথিবীর সব আঘাতই আমাকে আহত করে, না বাছা, ঈশ্বরপুত্রের ব্যথার অবসান নেই। কতকাল এই ক্ষতচিহ্ন বহন করেছি। নিঝরের মতো আজও রক্ত বয়ে যায়। আজও তোমার সঙ্গে খড়্গাঘাত ভাগ করে নেব বলে অপেক্ষা করছি।
খাঁড়াটা ওপরে উঠে ঝক করে নেমে গেল। একটা শেষ ডাক শুধু শোনা গিয়েছিল, মা!
সুমনের হাতের ভিতরে তার হাতটা শক্ত হয়ে গিয়েছিল। আঁকড়ে ধরেছিল আঁকশির মতো।
ভয় পেলি?
মরণ মুখ তুলে চেয়ে একটু হাসার চেষ্টা করল। কাহিল হাসি।
আমারও এসব দেখলে মনটা বড্ড খারাপ হয়ে যায়। না দেখলেই হত।
ওই মা ডাকটা কানে লেগে রইল মরণের, সে সাপ-খোপ অনেক মেরেছে। কিন্তু মা জানতে পারলে খুব রেগে যায়, মা মনসার জীবকে মারিস! পাষণ্ড নাকি তুই? খবরদার আর যেন না শুনি।
মায়ের সুবাদে তাদের বাড়িতে দু-দুটো বাস্তুসাপ এখনও বেঁচেবর্তে আছে। সাপ, বিছে, বোলতা, ছারপোকা, মশা বা ক্ষতিকারক জীবাণু কি পৃথিবীর কোনও উপকারে লাগে? কে জানে কী! এক সময়ে সে ফড়িং-উড়িং ধরত, মেরেও ফেলত। আজকাল, যত বড় হচ্ছে, তত কমে যাচ্ছে ওসব।
সুমনের সঙ্গে একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বেরিয়ে এল সে। পায়ে নতুন জুতো টাইট মারছে। সে যে বড় হচ্ছে, পায়ের মাপ বেড়ে যাচ্ছে, এটা বাবা রসিক বাঙালের খেয়াল থাকে না। কলকাতার চিনেবাজার থেকে পুরনো মাপের জুতো এনে দিয়েছে এবারও। দরকার ছিল না। বর্ধমানেই কেনা যেত। কিন্তু রসিক বাঙালকে সে কথা বোঝাবে কে?
তার মাও কেনাকাটার কিছুই বোঝে না। তবু ঝোলাঝুলি করে জিনসের ফুলপ্যান্ট আদায় করেছে মরণ। এই প্রথম ফুলপ্যান্ট হল তার এবং জিনস। লম্বায় একটু বড় হয়, কিন্তু গুটিয়ে পরা যায় বলে ম্যানেজ হয়েছে। কোমরটাও ঢলঢলে ছিল, সেটা বেল্ট দিয়ে সামলানো গেছে। সবচেয়ে মজা হয়েছিল সুমনের জন্য পাঞ্জাবি আর পাজামা কিনতে গিয়ে। বড়সড় একটা ঝিনচাক দোকানে ঢুকেই তার মা দোকানিদের বলল, খুব দামি ভীষণ ভাল পাঞ্জাবি চাই। খুব ভাল হওয়া চাই কিন্তু…
দোকানদার বিনীতভাবেই বলল, মাপ কত?
মাপ! বলে মা ভীষণ ভাবনায় পড়ে গেল। মরণের দিকে চেয়ে বলল, হ্যাঁ রে, তোর দাদার মাপ কত বল তো!
মরণ বলল, তা কি আমি জানি?
দোকানের সেলসম্যান হেসে বলে, কত লম্বা বলুন, মাপ আমি ঠিক করে নিচ্ছি।
মা নিজের মাথার ওপর হাত তুলে এই এত বড় হবে বলে যে মাপটা দেখাল তা বিরাট লম্বা কোনও লোকের।
দোকানদার বলল, ও বাবা, তাহলে তো মিনিমাম চুয়াল্লিশ লাগবে। অত বড় মাপে ভ্যারাইটি হবে না।
মরণ ফিক ফিক করে হাসচ্ছিল।
মা রেগে গিয়ে বলে, হাসচ্ছিস কেন বোকার মতো?
হাসব না? দাদা বুঝি অত লম্বা?
লম্বা নয়? বেশ লম্বা।
মোটেই না। বাবার চেয়ে দাদা একটু বেঁটে।
না না, লম্বা নেওয়াই ভাল। শেষে যদি ছোট হয়?
তাদের কথাবার্তা থেকে দোকানদার যা বোঝার বুঝে নিয়ে মাঝারি সাইজের পাঞ্জাবি বের করে দেখাতে লাগল। দারুণ দারুণ সব কাজ করা তসর, সিল্ক, র সিল্ক, গরদ।
কিন্তু মা কেবলই বলে, আরও দামি নেই? আরও ভাল?
দেখাচ্ছি বউদি। তবে এগুলোও কিন্তু খুব ভাল, লেটেস্ট ডিজাইন। ভাল করে দেখুন।
সে দোকানের স্টক ফুরিয়ে গেল, মার পছন্দই হল না। মোট চারটে দোকান ঘুরে অবশেষে প্রায় ছশো টাকা দিয়ে যে-পাঞ্জাবিটা কিনল মা সেটা এখন সুমনের গায়ে।
পাঞ্জাবি দেখে সুমন একটু অবাক হয়ে বলেছিল, ইস, এত দাম দিয়ে কিনতে গেলেন কেন? আমি তো এত ডেকোরেটেড জামা পরি না।
তা হোক বাবা, এই তো প্রথম দিচ্ছি। বয়স কম, এ বয়সেই তো একটু জমকালো জিনিস পরতে হয়।
মরণ এটা বুঝতে পারে, দাদাকে নিয়ে মার একটু আদেখলেপনা আছে। আড়ালে বলে, বড্ড ভয় পাই বাবা, আমি তো আর আসল মা নই, সৎ মা। কী চোখে দেখে কে জানে!
সুমনের ভাব দেখে কিছু বোঝা যায় না। দিন দশেক ধরে টানা আছে এবাড়িতে। একটু আপন মনে থাকে, বই পড়ে। রাত জেগে পড়ে বলে সকালে উঠতে দেরি করে। কথা কম বলে। যা একটু ভাব তা মরণের সঙ্গেই।
একদিন মরণকে বলেছিল, আমি একটু ইনট্রোভার্ট।
কথাটার মানে মরণের জানা ছিল না। পরে পান্নাদির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে জেনেছে, ইনট্রোভার্ট হল অন্তর্মুখী।
দশদিন ধরে সুমন এবাড়িতে আছে, কিন্তু মার সঙ্গে সম্পর্কটা একটুও এগোয়নি। সেই জন্য মা খুব ভাবে।
একদিন মা তাকে বলল, হ্যাঁ রে, সুমন কি আমাকে ঘেন্না করে?
কেন মা? দাদা তো সেরকম নয়। খুব ভাল তো।
কী জানি বাবা, এতদিন এসেছে তেমন কথাটথা কিছু তো বলে না। বড় ভয়-ভয় করে। গেঁয়ো মানুষ আমরা, আদরযত্ন বোধহয় তেমন হচ্ছে না।
আদরযত্ন বলতে ভাল খাওয়া-দাওয়া যদি ধরা যায় তা হলে সেটা খারাপ হচ্ছে না কিছু। ভাল মাছ, মাংস, মুরগি, পায়েস, ক্ষীর এক একদিন মা তো ভোজবাড়ির আয়োজন করে ফেলে। জিজিবুড়ির রান্নার সুখ্যাতি ছিল। সেই জিজিবুড়িও এসে চিংড়ি, মুড়িঘন্ট, চাপড়ঘণ্ট রান্নার কায়দা শিখিয়ে দেয় মাকে। আর বলে, এসে তো গেড়ে বসেছে দেখছি। মতলব তো ভাল মনে হচ্ছে না। বড়গিন্নিই সাঁট করে পাঠিয়েছে। পেটের খবর বার করতে। সাবধানে থাকিস লা।
ও কী কথা মা! ও কি তেমন ছেলে? ভাবের ঘোরে থাকে, কোনও দিকে চেয়েই দেখে না।
ও লো ও হচ্ছে ভড়ং। নজর ঠিকই রাখছে। ওপরসা-ওপরসা অমন ভাব দেখাচ্ছে। যেমন মা তেমনই তো ছা হবে।
বড়গিন্নি কেমন লোক তা জানি না মা, তাকে চোখেও দেখিনি আজ অবধি। কিন্তু ছেলের নিন্দে করতে পারব না।
তোর বুদ্ধিনাশ হয়েছে, বুঝলি! ছেলে-ছেলে করে হ্যাঁদাচ্ছিস, বলি কোন পেটে ধরেছিস ওই ধেড়ে ছেলেকে? গাণ্ডেপিণ্ডে গেলাচ্ছিস, গুরুঠাকুর বানিয়ে পারলে পুজো করিস, বলি আজ অবধি পাপমুখে একবারও মা ডাক বেরিয়েছে?
কথাটা ঠিক। মাকে আজও মা বলে ডাকেনি দাদা। এটা একটা কাঁটা হয়ে আছে মরণের মনের মধ্যে।
এত আয়োজন, তবু সুমন তেমন খায় না। খেতে বসে কেবল থাক থাক আর দেবেন না, বলে বাধা দিতে থাকে।
রান্না কি ভাল হয়নি বাবা?
রান্না? না রান্না তো বেশ ভালই। আমি বেশি খেতে পারি না।
এ কথাতেও মা আড়ালে দুশ্চিন্তা করে। মার কেবল ভয়, আদরযত্ন হচ্ছে না। কথাটা মরণও খুব ভাবে। তার এই প্রায়-অচেনা দাদাকে খুশি রাখতে তাদের আর কী কী করা উচিত সেটা বের করার চেষ্টা করে সে। আজও সে দাদাকে আপনি থেকে তুমি বলতে পারেনি।
তার ছোট বোনটার নাম দেওয়া হয়েছে হাম্মি। তার খুব হামা দেওয়ার নেশা। সকালে ঘুম থেকে উঠেই খাট থেকে নেমে পড়ার জন্য হুড়োহুড়ি। সাতসকালে সারা ঘর হামা দিয়ে বেড়ায় সে। দোতলা থেকে পাছে সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়ে সেইজন্য দোতলার সিঁড়ির মুখে কাঠের আগল লাগানো হয়েছে। হাম্মিকে যে একবারও কোলে নেয়নি বা একটুও আদর করেনি সুমন, এটাও লক্ষ করেছে তারা। হয়তো মায়ের ভয়টা মিথ্যে নয়। বাইরে ভদ্রতা বজায় রাখলেও ভিতরে ভিতরে সুমন হয়তো তাদের পছন্দ করে না।
সুমন আসার চার-পাঁচদিনের মাথায় একদিন সকালে হাম্মি হামা দিতে দিতে লম্বা বারান্দা পেরিয়ে সোজা গিয়ে সুমনের ঘরে ঢুকে পড়েছিল। তারপর কী হয়েছিল কেউ জানে না। হঠাৎ দেখা গেল বারান্দার কোণে সুমন দাঁড়িয়ে আছে, তার কোলে হাম্মি এবং সুমন তাকে কী যেন আঙুল তুলে দেখাচ্ছে আর কথা কইছে আর হাম্মি খুব অবাক হয়ে চেয়ে আছে।
উঠোন থেকে তার মা আর্তনাদ করে উঠল, ও বাবা হারু, তোমার ঘরে গিয়ে ঢুকেছিল বুঝি! পেচ্ছাপ-টেচ্ছাপ করে দেবে বাবা, ওকে নামিয়ে দাও।
হারু অর্থাৎ সুমন একটু হেসে বলল, তাতে কী? বাচ্চারা তো ওসব করেই। থাক আমার কাছে একটু।
থাকল হাম্মি। সম্পর্কের শীতলতা সে-ই ভাঙল প্রথম। আর তারপর থেকে সে রোজই নিয়মিত সুমনের ঘরে হানা দেয় এবং কোলে-টোলেও উঠে দিব্যি বসে থাকে।
ষষ্ঠীর দিন বিকেলে হইহই করে এসে পড়ল বাঙাল। সঙ্গে মুটে এবং মুটের মাথায় বোঝা। পুজোর জামাকাপড়, রাবড়ি, গলদা চিংড়ি, নতুন ফুলকপি, সোনামুগের ডাল আরও নানা জিনিসপত্র। উঠোনেই জামা খুলে বারান্দায় বসে হাওয়া খেতে খেতে উঁচু গলায় বলল, পূজা কাটাইল্যা দিনে কইলকাতায় পইড়া থাকে কেডা?
মা ঘোমটা দিয়ে চা করে নিয়ে এসে হাসি-হাসি মুখ করে বলে, অত কী এনেছ গো? পয়সা তোমাকে কামড়ায়?
চা খেতে খেতে বাঙাল নিমীলিত নয়নে চেয়ে বলে, তোমার লিগ্যা কিছু আনি নাই। তোমারে দেওনও যা, ভস্মে ঘি ঢালনও তা। বছর বছর যে শাড়িগুলি কিন্যা দেই হেইগুলি কি পাতিলের মইধ্যে গুইজ্যা রাখ নাকি? পরতে পার না?
মা ভারী লজ্জা পেয়ে বলে, আচ্ছা মানুষ যা হোক, অত দামি শাড়ি পরে কোথায় যাব বলো তো! আমি কি ঘর থেকে বেরোই? সংসার সামলাতে হয় না আমাকে?
বেনারসিখান কই?
সে তোলা আছে। বিয়েবাড়ি-টাড়ি নেমন্তন্ন হলে পরে যাব।
আর পরছ! তোমার পরনে তো হাউল্যা-জাউল্যা কাপড় ছাড়া আর কিছু দ্যাখলাম না!
এক ছড়া সোনার হার বের করে মার হাতে দিয়ে বাঙাল বলল, হেই লিগ্যা এইবার আর কাপড় আনি নাই। এইটা আনছি।
মার চোখ কপালে উঠল, ও মা গো! তাই বলে সোনার হার! কী কাণ্ড বাবা! এত খরচ করার কোনও দরকার ছিল বুঝি! সোনা-দানাই কি আমাকে পরতে দেখ?
রসিক বাঙাল একটু করুণ মুখে চেয়ে থেকে বলল, আইচ্ছা, তুমি কেমন মাইয়ালোক কও দেখি! কাপড় চাও না, সোনা-দানা চাও না, শ্যাষে কি বৈরাগী হইয়া যাইবা নাকি? তাহইলে তো সাড়ে সব্বনাশ! এই যৌবনে যোগিনীরে লইয়া আমি করুম কী?
মা হেসে ফেলল, আচ্ছা বাবা, পরবখন হার। তবে বাপু, বেশি দিও না আমাকে, আমি অত সামলাতে পারি না।
কথাটা শুনে রসিক বাঙালের মুখে একটা তৃপ্তির হাসি ফুটল। বলল, বুড়া বয়স লইয়া মাইনষের চিন্তা থাকে। কোনখানে পড়ব, কোনখানে মরব, কারে ভোগাইব, গু-মুতে নান্দিভাস্যি করব কিনা। তা বোঝলা, আমি বুড়া বয়সে আইয়া তোমার কাছেই মরুম।
ছিঃ, ষষ্ঠীর দিনটায় ওসব কী কথা! ওসব মুখে আনতে আছে?
রসিক বাঙাল মিটিমিটি হেসে বলে, আ গো, এইটা আহ্লাদের কথাই। তোমার মাথায় তো বুদ্ধি নাই, বলদা মাইয়ালোক, তুমি বোঝলা না।
পড়ার ঘর থেকে দৃশ্যটা দেখতে পেয়েছিল মরণ। দুজন দুজনের দিকে অপলক চেয়েছিল কিছুক্ষণ। চা জুড়িয়ে যাচ্ছিল।
.
পৃথিবীর কোনও কোনও প্রাণী সহজেই পোষ মেনে যায়, আবার কোনও কোনও প্রাণী সহজে মানতে চায় না। যেমন কুকুর সহজেই বশংবদ হয়ে যায়, বেজি হতে চায় না।
বিজু কোথা থেকে একটা বাঁদর নিয়ে এসেছে। ছোট বাচ্চা। সরু শেকল পরিয়ে কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে খুব। আজ অষ্টমী পুজোর সকালে সেটাকে কাঁধে নিয়ে এসে হাজির।
দেখো বড়মা, কেমন কিউট দেখতে। ভাল না?
বলাকার মোটেই পছন্দ হচ্ছিল না ব্যাপারটা। বললেন, তুই তো নিজেই বাঁদর, আবার একটা বাঁদরের দরকার কী?
আমার অনেক দিনের শখ বড়মা। বাজারে একটা লোক নিয়ে এসেছিল, পঞ্চাশ টাকা দিয়ে কিনে ফেললাম।
ছিষ্টি অনাছিষ্টি করবে বাবা। কাঁধে নিয়ে ঘুরছিস, হেগেমুতে দিলে কী হবে?
সে তো মানুষের বাচ্চারাও করে ফেলে। তাতে কী? ট্রেনিং দিয়ে নিলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
না বাবা, ওসব আমার পছন্দ নয়।
হ্যাঁ বড়মা, তুমি কি শুচিবায়ুগ্রস্ত হয়ে গেলে নাকি? আগে তো এরকম ছিলে না। শুদ্ধাচার ভাল, শুচিবায়ু ভাল নয়।
কী জানি বাপু, আজকাল আমার যেন ঘেন্নাপিত্তি বড় বেড়ে গেছে। মনটা খুঁতখুঁত করে সবসময়ে। তোর জ্যাঠা চলে যাওয়ার পর থেকেই এরকম।
একটু কোলে নিয়ে দেখো না।
ও মা গো!
বিজু হি হি করে হাসে। বলে, পারলে না তো বড়মা। শুদ্ধাচারে নিজেকে গুটিয়ে রাখলে!
বলাকা মৃদু হাসলেন, বড্ড খিতখিত করে বাবা, ও আমি পারব না। তবে বাঁদরটা দেখতে কিন্তু বেশ। কেমন পিটপিট করে তাকাচ্ছে দেখ।
এদের এক প্রজাতিই তো আমাদের পূর্বপুরুষ ছিল। তাই কাঁধে নিয়ে বেড়াই।
আর একবারও তো একটা বেজি পুষেছিলি। সেটা পালিয়ে গেল জঙ্গলে।
হ্যাঁ। বেজি জাতটা একটু নেমকহারাম আছে।
এটাও না পালায়।
পালালে পালাবে। আমি ঠিক করে রেখেছি, একটু বড়-টড় করে ছেড়ে দেব। ইচ্ছে হলে থাকবে, না হয় চলে যাবে। দুনিয়াতে পার্মানেন্ট বলে তো কিছু নেই।
কত কথাই শিখেছিস। তা হ্যাঁরে বিজু, তুই কি শেষ অবধি ষণ্ডাগুণ্ডা হলি?
কেন বড়মা, হঠাৎ ওকথা কেন?
শুনতে পাই তুই নাকি মারপিট করিস?
ধুর! মারপিট করব কেন? কখনও-সখনও বেয়াদব লোকদের একটু-আধটু শাসন করতে হয়।
সোহাগ বলছিল। কয়েকটা পাজি ছেলে ওর পিছনে লেগেছিল বলে তুই নাকি মেরেছিস ওদের।
সোহাগটা কে? অমলদার মেয়ে নাকি?
হ্যাঁ।
বেশ বাহারি নাম তো!
একটু পাগলিমতো আছে, তবে মেয়েটা ভাল। ওসব আর করতে যাসনি। ছেলেগুলো গিয়ে ক্ষমা চাওয়ায় মেয়েটা লজ্জায় পড়েছে।
ফচকে ছেলেরা টিটকিরি দেয়, সেটা কি ও এনজয় করে নাকি?
কী জানি বাবা! বলছিল, কেউ ওকে প্রোটেকশন দেয় সেটা ওর পছন্দ নয়।
ওকে প্রোটেকশন দেওয়াটা তো বড় কথা নয়। গ্রামেরও তো একটা সমাজ আছে। বাইরে থেকে আসা একটা মেয়েকে টিটকিরি দেবে কেন? গ্রামের বদনাম হয় না!
এটা নারীবাদের যুগ বাপু, মেয়েরা বোধহয় পুরুষের সাহায্য নিতে পছন্দ করে না।
নারীবাদ কি তাই বড়মা যে, মেয়েরা নিজেদের সব সমস্যার সমাধান নিজেরাই করবে? পুরুষের সাহায্য লাগবে না? আমার তো মনে হয় নারীবাদের জন্য পুরুষের সাহায্য বেশিই লাগবে।
বলাকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, আমিও তো তাই জানি। তোর জ্যাঠার সঙ্গে এতকাল ঘর করে কখনও তো মনে হয়নি যে আমার আরও একটু পাখা মেলার দরকার। বাইরে থেকে তাকে অনেকে অত্যাচারী পুরুষ বলে ভাবত। খামখেয়ালি তো ছিলই একটু, কিন্তু অমন ভালবাসা যে বাসতে পারে তার সঙ্গে কি বিবাদ হয়? সে ঘিরে রেখেছিল বলে কখনও আঁচটুকুও গায়ে লাগেনি। পুরুষমানুষ মেয়েদের প্রোটেকশন দেবে না তো কে দেবে?
সোহাগকে বোলো, আমি ওকে বাঁচাতে কিছু করিনি, যা করেছি তা গ্রামের প্রেস্টিজ বাঁচাতে।
সে বলবখন, তুই আর ওর মধ্যে থাকিস না।
আচ্ছা বড়মা।
মনটা খারাপ হয়ে গেল বিজুর। এই গ্রামটাকে সে বুকের পাঁজরের মতো ভালবাসে। ইদানীং নেশাভাং, চুল্লুর ঠেক, সাট্টা, জুয়া, মদ আর বদমাইশি ঢুকে গেছে প্রচুর। সে তার মতো এই বেনোজল ঠেকাতে চেষ্টা করে।
.
আজ অনেক ভেবেচিন্তে একটা শাড়িই পরল সোহাগ।
কাল থেকে পিসি টিকির-টিকির করে যাচ্ছে, ও সোহাগ, কাল অষ্টমী পুজো, কাল একটা শাড়ি পরিস।
আমি যে শাড়ি পরতেই জানি না।
আমি পরিয়ে দেবখন।
শাড়ি পরে কী হবে বলো তো?
তোকে কেমন দেখায় একটু দেখব।
শাড়ি তো সবাই পরে, কী আর নতুন জিনিস হবে?
তুই তো পরিস না, তোকে নতুন রকমই দেখাবে। আমার কাছে আসিস চুল আঁচড়ে বিনুনি করে দেব। আমার সঙ্গে অঞ্জলি দিতে যাবি।
সোহাগ সাজতে ভালবাসে না। উলোঝুলো থাকতেই তার ভাল লাগে। মায়ের সঙ্গে এই নিয়ে তার কম যুদ্ধ হয়নি।
ভেবেচিন্তে সে আজ সকালে উঠে চান করেছে। পিসির ঘরে গিয়ে বলল, এবার কী করতে হবে বলো তো?
সন্ধ্যা এক গাল হেসে বলল, আয় তোর চুলটা আগে বাঁধি।
পিসি যত্ন করে চুল বেঁধে মুখটা তোয়ালে দিয়ে মুছে বলল, শাড়ি আছে?
আছে।
নিয়ে আয়।
সোহাগ তার মায়ের একখানা নীল সিল্কের শাড়ি নিয়ে এল।
এটা কেমন?
চমৎকার। ফর্সাদের সব রঙেই মানায়।
শাড়ি পরিয়ে কুঁচি ঠিক করতে করতে সন্ধ্যা বলল, কিছু খাসনি তো?
না।
তাহলে চল অঞ্জলি দিয়ে আসি। আজ অষ্টমীতে খুব ভিড় হবে।
স্টিলের আলমারির গায়ে লাগানো আয়নায় নিজেকে আপদমস্তক দেখে সোহাগ বলল, ওঃ পিসি! আই লুক ঘ্যাস্টলি?
কী বলছিস?
আমাকে যে ভীষণ বিচ্ছিরি দেখাচ্ছে।
সন্ধ্যা হেসে বলল, তোকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। একদম অন্যরকম।
অন্যরকম কেন হব আমি? আমি তো আমার মতো হতে চাই।
তাই তো আছিস। শুধু বাইরেটাই যা অন্যরকম দেখাচ্ছে, তা বলে কি আর তুই সোহাগ নোস নাকি?
অন্যরকম হতে আমার ভাল লাগে না।
সে জানি। তুমি একটি জিদ্দি মেয়ে। কত খোশামোদ করে শাড়ি পরালাম, দয়া করে এখনই ছেড়ে ফেলো না। অঞ্জলিটা আগে দিয়ে আসি চল।
সোহাগ কাঁধে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলে, আমাকে আজ আমার মাও বোধহয় চিনতে পারবে না।
মণ্ডপে এসে ব্যাপারটা খুব ভাল লাগছিল না সোহাগের। ভিড়, গরম, গণ্ডগোল আর অসহ্য ঢাকের বাজনা। কলকাতায় তারা পুজো দেখে বটে, কিন্তু সেটা সন্ধের পর এবং সেটা শুধু মজা দেখা মাত্র। এখানে সে অঞ্জলিও দেবে, যার কোনও মানে নেই।
ওমা! তুমি এসেছ! কী কাণ্ড! আমি তো তোমাকে চিনতেই পারিনি! এ যে একদম মেটামরফসিস!
এই বলে পান্না তাকে জড়িয়ে ধরল।
সোহাগ হেসে বলে, এ যেন ফ্যান্সি ড্রেস বলের পোশাক হয়ে গেল, না?
এ মা, তা কেন? তোমাকে ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে। মণ্ডপে যতগুলো মেয়ে আছে তার মধ্যে সেরা।
দিরি-দিরি-দিরি-দিরি করে ঢাকে একটা অদ্ভুত বাজনা শুরু হল।
পান্না বলল, এই রে! এবার বলি হবে। আমি ওসব দেখতে পারি না। চলো, একটু ওধারে যাই।
যেতে গিয়েই হঠাৎ সোহাগ এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেল। শূন্যে উত্তোলিত খড়্গ, আর তার ওপাশে এক দীর্ঘ সুঠাম পুরুষ দাঁড়িয়ে। তার কাঁধে একটা বাঁদর। কয়েক পলক স্থির চেয়ে রইল সোহাগ।
১৫-২০. শত্রুভাবে ভজনা
১৬.
রাবণরাজা নাকি রামচন্দ্রকে শত্রুভাবে ভজনা করত। শত্রু ভাবলে কি ভজনা হয়? তবে আশ্চর্য ব্যাপার হল, যাকে ঘেন্না করা হয়, যার ওপর প্রবল আক্রোশ, তার কথা কিন্তু ক্ষণে ক্ষণে মনে পড়ে। ভালবাসার মানুষকে যত না মনে পড়ে তার চেয়ে ঢের বেশি মনে পড়ে ঘেন্না আর আক্রোশের লোকটাকে। ঘেন্না, আক্রোশ, রাগও কি তাহলে একরকম আকর্ষণ? কেউ কেউ বলে ঘেন্না আর ভালবাসা টাকার এ পিঠ ও পিঠ। কিন্তু তাই কি হয়! রাবণরাজা রামচন্দ্রকে হয়তো সারাক্ষণ ভাবত, কী ভাবে তার সর্বনাশ করবে বলে। সেটা কি ভজনা রে বাপু?
তৃতীয় ফ্রন্ট হল শীতল উদাসীনতা। ওই কুয়োয় নেমে গেলে মানুষ আর উঠে আসতে পারে কমই। ভালবাসলে মনে পড়ে, ঘেন্না বা রাগ থেকেও মনে পড়ে, কিন্তু উদাসীনতা ভেজা ন্যাতার মতো মনের সেলেটখানা মুছে ফেলে। তখন সেখানে আর কোনও আঁকিঝুঁকি নেই, কিচ্ছু নেই। কালো সেলেট হাঁ করে চেয়ে থাকে শুধু।
পাশের ঘরে মোনা, সোহাগ আর বুডঢা। আর মা-বাবার পরিত্যক্ত ঘরখানায় একা অমল। গত চার পাঁচ দিন সে দাড়ি কামায়নি। শেষ কবে কামিয়েছিল তা ভাল মনেও নেই। গাল গলা কুট কুট করে দাড়িতে। চুলে চিরুনি দিতে মনে থাকে না, ইচ্ছেও হয় না। কোঁকড়া চুল বলে না আঁচড়ালেও চলে।
এ-ঘরে সাবেক মস্ত খাট। তাতে নানা গেঁয়ো কারুকার্য। কাঠ আর স্টিলের গোটা তিনেক আলমারি। গোল মতো টেবিল, ভারী কাঠের চেয়ার, ট্রাঙ্ক বাক্স মিলিয়ে ঘরে গুদোমঘরের মতো অবস্থা। ইঁদুরের উৎপাত আছে, আরশোলা ঘুরছে সারাক্ষণ। জানালা কপাট খুলে রাখলেও বন্ধ বাতাসের গন্ধ যেতে চায় না। অমল টের পায়, কিন্তু গ্রাহ্য করে না।
ওই ঘরে তার পরিবার, তার দুই সন্তান, অনাত্মীয়া স্ত্রী, মাঝখানে এক ঠান্ডা অন্ধকার সমুদ্র। ওই সমুদ্র অতিক্রম করা বোধহয় আর সম্ভব নয়। সেই চেষ্টা আর করে না অমল। পণ্ডশ্রম। দু ঘরের মাঝখানের দরজাটাও ভোলা হয়নি। প্রয়োজন বোধ করেনি কেউ।
পারুলের প্রতি কি খুব অন্যায় করেছিল অমল? খুব? অনেক ভেবে দেখেছে সে, অন্যায় হলেও সেটা ক্ষমার অযোগ্য ছিল না, বিশেষ করে বিয়ে যখন ঠিক হয়েই ছিল। তার একটা অন্যায়ের প্রতিশোধ অনেক বেশি হয়ে গেল নাকি?
এখন মধ্যরাতে উঠে বসে আছে অমল। গ্রামে শীত পড়ে গেছে। হালকা, মনোরম শীত। মায়ের পুরনো একটা কাঁথা চাপা দিয়ে ভারী আরামে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। কিন্তু মধ্যরাতে চটকা ভেঙে গেল। প্রায়ই যায়। ঘুম একবার ভেঙে গেলে সে জেগে শুয়ে থাকতে পারে না। উঠে বসে সে শুনতে পেল, দূরে লাউডস্পিকারে কোনও যাত্রাপালার সংলাপ। সবুজ সংঘ নবমী পুজোয় কলকাতার একটা নামী দলকে আনিয়েছে। বাড়ি সুষ্ঠু লোক গেছে যাত্রা দেখতে। এমন কী মহিমও। শুধু অমলের পরিবারের কেউ যায়নি।
রাত কত হল জানার জন্য ঘড়ির দিকে চাইলেই হয়। কিন্তু সেই ইচ্ছেটাও হল না অমলের। কী হবে জেনে? উঠে সে চুপচাপ ভূতগ্রস্তের মতো চেয়ে থাকে। ঘর অন্ধকার, তবে দূরের প্যান্ডেল থেকে গাছপালার ফাঁক দিয়ে একটু আলো এসে লেগে আছে মশারিতে। এইসব নির্জন, নিঃসঙ্গ সময়ে পারুলের কথা ভাবতে চেষ্টা করে সে। আগে খুব মনে পড়ত পারুলকে। আবেগ উথলে উঠতে চাইত। স্ত্রীর সঙ্গে মিলনের সময়ে পারুলের মুখশ্রী আরোপ করে নিত মোনার মুখে। বেশ কিছুকাল মোনা আর পারুলের এক সংমিশ্রণ ঘটিয়ে নিতে পারত সে। সে এক আশ্চর্য রসায়ন। প্রবল কল্পনাশক্তি বাস্তবের অনেক ঘাটতি পূরণ করে নেয়।
এখন কেন যে পারুলের মুখ আর তেমন স্পষ্ট মনে পড়ে না কে জানে! পারুলের মুখের ওপর আরও নানা মুখের আদল এসে পড়ে। তখন ভীষণ কষ্ট হয় তার। পারুল কি হারিয়ে যাচ্ছে তার স্মৃতি থেকে। অ্যালবাম খুলে সে কতবার মুখটা ফের স্মৃতিতে গেঁথে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তবু তার স্মৃতিতে বিন্দু বিন্দু অন্ধকার চলে আসে কেন? হাজার মুখের টুকরো এসে কেন যে ভেসে বেড়ায় মনশ্চক্ষে।
একটা শীতল ভয়ও আজকাল ছুরির মতো ঢুকে যায় বুকে। যদি মোনার বদলে পারুল তার বউ হত তা হলেই কি সুখী হত সে? নিজেকে সে বিরহী ভেবে, বঞ্চিত হতাশ প্রেমিক ভেবে একরকম সান্ত্বনা পেয়ে যায়। কিন্তু যদি এরকম হত, পারুলকে বিয়ে করত সে এবং তারপর ধীরে ধীরে প্রেম অবসিত হয়ে ঘৃণা আর আক্রোশ ঘুলিয়ে উঠত দুজনের মধ্যে, তারপর আসত শীতল উদাসীনতা–তা হলে কী হত? না পাওয়া পারুলকে দেবীর আসনে বসানো সোজা, কিন্তু পাওয়া পারুলকে কি পারত সে? পারুলের অপমৃত্যু ঘটে যেত কবেই। এবং আজ এই মধ্যরাতে ও-ঘর আর এ-ঘরের মধ্যে যে অথৈ সমুদুরের ব্যবধান সেই সমুদুর চলে আসত তার আর পারুলের মাঝখানেও।
শ্বাসকষ্টের মতো একটা কষ্ট হচ্ছিল অমলের। শারীরিক নয়, কষ্টটা অন্যরকম। মাথাটা বড্ড গরম। সে কৃতী ছাত্র, সফল মানুষ। কিন্তু এখন যেন তার সব সফলতা ছাড়া জামাকাপড়ের মতো পড়ে আছে কোথায়। অন্ধকারে বড় বিবসন মন হয় নিজেকে। বড় গৌরবহীন!
অমল উঠল। মশারি তুলে বেরিয়ে একটু জল খেল গেলাস থেকে। চেয়ারের ওপর পাকার হয়ে পড়ে থাকা আলোয়ানটা গায়ে জড়িয়ে নিল সে। ঘুম অসম্ভব। ঘরের মধ্যে সে হাঁফিয়ে উঠছে।
দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে এল সে। জ্যোৎস্না রাত্রি। ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে রেখে সে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল উঠোনে। ভুলু কুকুরটা দু বার ভুক ভুক শব্দ করে দৌড়ে এসে ন্যাজ নাড়তে লাগল। একবার মনে হল, দরজায় তালাটা লাগিয়ে আসে। অ্যাটাচি কেসে কয়েক হাজার টাকা আছে। জরুরি কাগজপত্র, দামি কলম, ক্যালকুলেটর, পারসোন্যাল অর্গানাইজার। চোরের আনাগোনা আছে এখানে। দোনোমোনো করেও ভাবল, থাক গে, গেলে যাবে।
বাইরের ঠান্ডায় এসে বেশ ভাল লাগছিল তার। ঘাসে শিশির জমে আছে। হিম পড়ছে। সামান্য কুয়াশায় জড়ানো ভারী ভুতুড়ে রাত। সে হাঁটতে লাগল। গত কয়েকদিন একা একা ঘাটে আঘাটায় অনেক ঘুরে বেড়িয়েছে সে। মনটা সেই থেকে জড়বস্তুর মতো হয়ে আছে। কোনও উত্তেজনা নেই, আবেগ নেই, রাগ নেই, ঘেন্না নেই, শুধু নিথরতা আছে।
খানিকক্ষণ হাঁটার পর তার মনে হল, এও পণ্ডশ্রম। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্তি আসবে মাত্র।
ছেলেবেলায় গাঁয়ে যাত্রা এলে যেন বারুদে আগুন লাগত। বাবা-মাকে ফাঁকি দিয়ে চুরি করে পালিয়ে গিয়ে কত যাত্রা দেখেছে। সিরাজদ্দৌল্লা, কেদার রাজা, শাজাহান, কঙ্কাবতীর ঘাট, কর্ণার্জুন। সব মনে আছে।
একটু ইচ্ছে, একটু অনিচ্ছের দোটানায় পড়ে খানিকটা সময় গেল। তারপর সে যাত্রার আসরের দিকেই এগোতে লাগল। পকেটে পয়সা নেই। টিকিট কাটতে হলে পারবে না।
না, টিকিট কেটে নয়। খোলা আসরেই যাত্রার আয়োজন হয়েছে। কয়েক হাজার লোকের জমজমাট ভিড়। আশেপাশে বাদাম, তেলেভাজা, ঝালমুড়ির দোকানও বসেছে অনেক। রইরই কাণ্ড।
এত কাল পরে যাত্রা দেখতে কেমন লাগবে কে জানে। ভিড় ঠেলে এগোনোও কঠিন। অমল একটু ঘুরে ফিরে একটু ফাঁকামতো জায়গায় দাঁড়াল। বড় দূরে স্টেজ। কুশীলবকে খুব ভাল করে ঠাহর করা যাচ্ছে না। তবে মাইকের দৌলতে সংলাপ শোনা যাচ্ছে।
জনৈকা কুলসুমের সঙ্গে জনৈক ফিরোজের প্রেমের ডায়ালগ হচ্ছে। ফিরোজ বলছে সে গরিব, পিতৃমাতৃহীন অনাথ, আবদাল্লা নামক জনৈক সওদাগরের অধীনে কাজ করে আর কুলসুম ধনীকন্যা, সুন্দরী, সুতরাং সে বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়াতে চায় না। আর কুলসুম বলছে, তার বুকে যে চিরন্তন প্রেমের শিখা জ্বলে উঠেছে তা দিয়ে তারা সব বাধা অতিক্রম করবে।
অমল একটা হাই তুলল। কানের ভিতর দিয়ে বাতাস বেরিয়ে গেল।
কোথা থেকে বুকে ভলান্টিয়ারের ব্যাজ আঁটা একটা ছেলে ছুটে এসে বলল, আরে অমলদা! আপনি এখানে দাঁড়িয়ে কেন? আসুন আমার সঙ্গে।
অমল সংকুচিত হয়ে বলল, না না, এই তো বেশ আছি।
পাগল! বাইরে দাঁড়ালে ঠান্ডা লেগে যাবে। আসুন, স্টেজের ওপাশে ভি আই পি-দের এনক্লোজারে চেয়ারের ব্যবস্থা আছে।
আমি তো ভাই বেশিক্ষণ দেখব না। চলে যাবো।
তা হোক না। যতক্ষণ খুশি দেখবেন। বিজুদা আমাকে পাঠাল। চলুন।
অনিচ্ছুক পায়ে এগোতে হল অমলকে। ভিড়ের পিছন দিয়ে ছেলেটা পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল। গ্রিনরুমের পাশেই স্টেজ ঘেঁষে একটা বাঁশ দিয়ে ঘেরা জায়গায় সারি সারি চেয়ার পাতা। গাঁয়ের মান্যগণ্য এবং আমন্ত্রিত অতিথিরা বসে আছে। সামনে জায়গা ছিল না। ছেলেটা কোথা থেকে একটা চেয়ার এনে তাকে সামনের সারির পাশেই বসিয়ে দিয়ে বলল, আমরা আপনাকে ইনভাইট করতে গিয়েছিলাম। চিঠি পাননি?
অমল অস্বস্তি বোধ করে বলল, না তো!
বউদির হাতে কার্ড দিয়ে এসেছিলাম।
ও। তা হবে।
ছেলেটা চলে যাওয়ার পর অমল একবার চারদিকে চেয়ে দেখল। বহু মুখ, বহু মানুষ। সকলেরই স্টেজের দিকে চোখ। নায়িকা স্টেজের ওপর পড়ে ফিরোজ, ফিরোজ চিৎকার করে কাঁদছে। ফিরোজ চলে গেছে। ঝাঁকর ঝাঁকর করে বাদ্যি বাজনা বেজে উঠল। নায়িকা উঠে বসল। তারপর ধীরে ধীরে দাঁড়াল। তারপর দিগন্তের দিকে হাত বাড়িয়ে বিরহের গান ধরল। গানের অর্থ অনেকটা এরকম, কত দূরে যাবে তুমি? আমি যে তোমার হৃদয়ের পিঞ্জরে বসে নিরন্তর তোমার নাম ধরে ডাকব…ইত্যাদি।
ঘুম পাচ্ছিল। ফের একটা হাই তুলল সে। ফের কানের ভিতর দিয়ে বাতাস বেরিয়ে গেল। রাত্রে পায়েস খেয়েছিল একবাটি, অম্বলে গলা জ্বলছে। পায়েসে বড্ড মিষ্টি দেওয়ার ধাত বউদির।
দুটি অপরূপ চোখ ভিড়ের থেকে এক ঝলক তাকে দেখে টপ করে আড়াল হল।
কে?
একটু সচকিত হল অমল। কার চোখে হঠাৎ চোখ পড়ল তার? বারবার লক্ষ করেও বুঝতে পারল না কিছুতেই। অস্বস্তি হচ্ছে। বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে।
বাঁদিক থেকে মেয়ে-পুরুষের একটি দল উঠে চলে যাচ্ছে। রাত হয়েছে। শেষ অবধি অনেকেই থাকে না। হয়তো দূরে যাবে। নিস্পৃহ চোখে তাকিয়ে দলটাকে একটু দেখল অমল।
নায়িকা কুলসুম শাশ্বত প্রেমের জয় ঘোষণা করে যে গান গাইছিল তাতে বাধা পড়ল। কর্কশ এক পুরুষের গলা গর্জন করে উঠল, গান থামাও কুলসুম, তুমি কি আত্মপরিচয় বিস্মৃত হয়েছ? ভুলে গেছ তোমার বংশমর্যাদা?
কয়েকটি মেয়ে এসে কুলসুমকে ধরে নিয়ে গেল। কুলসুমের ঝলমলে পোশাক-পরা বাবা স্টেজ জুড়ে দাপাদাপি করে নিজের বংশপরিচয় দিয়ে যেতে লাগল…
এসব ভাল লাগার জন্য যতখানি মস্তিষ্কহীন হওয়া দরকার ততটা এখনও হতে পারেনি অমল। যখন ভাল লাগত তখন ছিল ভাল লাগারই বয়স। পারিপার্শ্বিকে যাই ঘটুক বুভুক্ষুর মতো গিলে খেত সে। রাজরাজড়াদের গল্প, পৌরাণিক কাহিনী, চাঁদ সদাগর, মনসা মাহাত্ম্য কিছুই খারাপ লাগত না।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠতে যাচ্ছিল অমল।
একটা লম্বা ছিপছিপে ছেলে কাছে এসে বলল, উঠছেন?
হ্যাঁ।
মণ্ডপের পিছনে পারুলদি অপেক্ষা করছেন। একটু দেখা করে যাবেন।
হাঁ করে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইল অমল। বুকটায় ধকধক হচ্ছে।
আমি বিজু। চিনতে পারছেন না?
অমল হাসল, হ্যাঁ হ্যাঁ। কত বড় হয়ে গেছ।
সেদিনও তো দেখা হল আপনার সঙ্গে।
অমল অপ্রতিভ হয়ে বলে, কিছু মনে থাকে না আজকাল। তুমি কেমন আছ বিজু? কী করছ?
এখনও কিছু করছি না। পাস-টাস করে বসে আছি।
ভিতরে তাড়াহুড়ো অনুভব করছে অমল। বিজু কী পাস করেছে তা আর জানার ইচ্ছে হল না তার। বলল, আচ্ছা আচ্ছা, বেশ ভাল।
আলোয়ানের এক প্রান্ত খসে পড়েছিল মাটিতে। টানতে গিয়ে চেয়ারের সঙ্গে আটকে গিয়ে চেয়ারটাই পড়ে যাচ্ছিল কাত হয়ে। বিজু চেয়ারটা ধরে ফেলে আলোয়ানটা ছাড়িয়ে কাঁধে তুলে দিয়ে বলল, সাবধানে যাবেন।
একটু দিগভ্রান্ত অমল আসর থেকে বেরিয়ে মণ্ডপটা কোনদিকে তা বুঝতে পারছিল না। এত ভিড় চারদিকে। ঠাহর করতে একটু সময় লাগল তার। তাড়াহুড়োয় পড়লে মানুষের কতরকম ঠিক ভুল যে হতে থাকে।
অমলদা!
অন্ধকারে মুখটা প্রথমে দেখাই গেল না। ফিকে অন্ধকারে পারুল দাঁড়িয়ে।
পারুল!
চেহারাটা কী করেছ বলো তো!
কেন, খারাপ দেখছ?
রোগামোটার কথা বলছি না। অমন উলোঝুলো কেন? দাড়ি কামাওনি, চুল আঁচড়াওনি, দোমড়ানো পাজামা, বিচ্ছিরি আলোয়ান–এ কী রকম ভাব তোমার!
অমল হাসল, আসলে ঘুম আসছিল না বলে হঠাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম। হাঁটতে হাঁটতে যাত্রা হচ্ছে দেখে ঢুকে পড়েছি।
কতকাল পরে দেখা, কিন্তু এমন পোশাকে আর চেহারা দেখে চমকে গিয়েছিলাম। কই, বাড়িতে এলে না তো! খবর পাঠিয়েছিলাম ধীরেন খুড়োকে দিয়ে, বলেনি?
বলেছে।
তবে?
অমল শ্বাসকষ্ট টের পাচ্ছে। শরীর কাঁপছে এখনও। মৃদু স্বরে বলল, কোন মুখে আসব বলো! খুব লজ্জা হচ্ছিল।
পুরনো কথা ভাবো বুঝি খুব?
ভাবব না?
আমি তো ভেবেছিলাম, তুমি এখন মস্ত মানুষ হয়েছ, বিরাট চাকরি, অনেক দায়িত্ব, ঘন ঘন দেশ বিদেশ যেতে হয়, তুমি নিশ্চয়ই পুরনো কথা মনে রাখোনি।
অমল একটু চুপ করে থেকে বুকের থরথরানিটা সামলানোর চেষ্টা করতে লাগল। তারপর বলল, সেরকমই তো হওয়ার কথা। কিন্তু আমার আজকাল কী যেন হয়েছে।
কী হয়েছে?
আত্মবিশ্বাস কমে যাচ্ছে। ইন্ট্রোভার্ট হয়ে যাচ্ছি।
আত্মবিশ্বাস কমছে কেন?
পারুলকে এবার চারদিকের আলোর আভায় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল অমল। বলল, সামথিং ইজ রং। কিন্তু এসব কথা থাক। তোমার কথা বলো।
আমি! আমার আর কী কথা বলল। আর পাঁচজন মেয়ের মতোই ঘরসংসার করছি। নতুন কিছু নয়।
ভাল আছ তো পারুল? সব দিক দিয়ে ভাল?
তাই কি হয়? সব দিক দিয়ে কেউ কি ভাল থাকে?
তোমাকে বেশ ভাল দেখাচ্ছে। এখনও বয়সের ছাপ পড়েনি। দেখে মনে হয়, তুমি সুখী হয়েছ। তাই না?
নিজের কথা নিজে কি বলতে পারি? কিন্তু তোমাকে দেখে আমার একটুও ভাল লাগছে না।
অমল মাথা নেড়ে বলে, আমি ভাল নেই। কিংবা আমি যে কেমন আছি তা বুঝতে পারছি না।
কোনও অসুখ-টসুখ করেনি তো!
না, তেমন কিছু অসুখ আছে বলে জানি না। আর থাকলেই বা কী! ওসব নিয়ে ভাববার কিছু নেই।
বউয়ের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন?
ভালই।
জিজ্ঞেস করলাম বলে কিছু মনে করলে না তো! এ প্রশ্নটা আমি তোমাকে করতেই পারি, তাই না?
হ্যাঁ, পারোই তো! মোনাও তোমার কথা জানে।
পারুল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, শুধু মোনা নয়, তোমার মেয়ে সোহাগও জানে। আর সেইটেই দুঃখের কথা। তুমি ওদের কাছে সব বলে দিয়েছ। কাজটা ভাল করোনি অমলদা।
অমল অপ্রতিভ হয়ে বলে, কী থেকে যে কী হয়ে যায় তা বলা মুশকিল। আমি আজকাল নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি। কিন্তু ভারী আশ্চর্যের কথা, ওরা যেমনই হোক, তোমাকে কেউ অপছন্দ করে না। কী করে যে এটা সম্ভব হয় বুঝতে পারি না।
পারুল একটু হাসল, সোহাগ আমাকে গডেস বলে মনে করে। সেটা আবার আমার পক্ষে অস্বস্তিকর। তোমার বউ কী মনে করে তা অবশ্য জানি না।
অমল মাথা নেড়ে বলে, বললে তুমি বিশ্বাস করবে না।
কেন করব না?
অবিশ্বাস্য। সে তোমার সম্পর্কে কখনও একটিও খারাপ কথা বলে না। একবারের জন্যও না। বরং একবার অ্যালবামে তোমার ছবিটা দেখছিলাম, দেখে বলেছিল, দেখ দেখ, তোমার বিবেক জাগ্রত হোক।
হেসে ফেলল পারুল, যাঃ।
বললাম তো, তোমার বিশ্বাস হবে না।
অ্যালবামে আমার ছবি রাখার কী দরকার ছিল?
আমি তো রাখিনি। ছবিটা আমার পারসোনাল ফোল্ডারে ছিল। সেটা অ্যালবামে রেখেছে মোনা। তোমার বোধহয় একটা হিপনোটিজম আছে পারুল।
ওসব বাজে কথা। আমি খুব সাধারণ একটা মেয়ে। সোহাগ আমাকে কেন গডেস ভাবে বলল তো! আইডিয়াটা কি তুমিই ওর মাথায় ঢুকিয়েছ?
না পারুল। আমি ওদের মাথায় কখনও কোনও আইডিয়া ঢোকাতে পারিনি। ছেলেমেয়েকে সময়ও দিতে পারলাম কই? দিনরাত ভূতের মতো খেটেছি। ওরা তাই ওদের মতোই হয়েছে। কিছু শিখিয়েছে ওদের মা। আর বাকিটা নিজেরাই শিখে নিয়েছে। তুমি কবে, কী ভাবে সোহাগের জীবনে ঢুকে গেছ তা আমি জানি না।
পারুল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বগতোক্তির মতো বলল, পাগল।
হ্যাঁ পারুল, সোহাগ প্রবলেম চাইল্ড। স্বাভাবিক নয়। ওর একটা অদ্ভুত মনোজগৎ আছে, যেটাকে আমি বুঝতে পারি না। ও আমাদের বাধ্য নয়। ও আমাকে অনেকবার বলেছে, তোমার ছবিটা দেখলে নাকি ওর মন ভাল হয়ে যায়।
এসব শুনে আমার একটু ভয়-ভয় করছে। এরকম কেন হবে?
শুধু সোহাগ নয়, আমার ছেলে বুডঢার মুখেও শুনেছি। মোনা মুখে অতটা বলেনি বটে, কিন্তু অসম্ভব নয় যে, মোনাও তোমার একজন ভক্ত।
পারুল প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, কী যে সব কাণ্ড তোমাদের কিছু বুঝতে পারি না বাবা! এখন তো ওদের সঙ্গে দেখা করতেই আমার ভীষণ লজ্জা করবে। ভেবে রেখেছিলাম মহিমকাকাকে বিজয়ার প্রণাম করতে গিয়ে ওদের সঙ্গে পরিচয় করে আসব। দেখছি তা আর হবে না।
পালাবে পারুল? তাতেই কি সব উলটে যাবে?
আমার আড়ালে আমাকে নিয়ে যা খুশি হোক, আমাকে তো আর সাক্ষী থাকতে হবে না। না বাপু, এসব মোটেই ভাল কথা নয়।
অমল বিষণ্ণ গলায় খুব ধীরে ধীরে বলল, আমাকে তুমি তোমার জীবন থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলে পারুল। আমার কোনও চিহ্নই রাখোনি। কিন্তু আমরা তোমাকে বুকে তুলে নিয়েছি। যত অদ্ভুতভাবেই হোক, তোমাকে এক ধরনের অ্যাকসেপটেন্স দিয়েছে আমার পরিবার। ব্যাপারটা আমার ভালই লাগে।
কিন্তু আমার ভয় করে, লজ্জা হয়।
দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। জায়গাটা খুব একটা নির্জন বা শব্দহীন নয়। অদূরে ঝোপঝাড়ে অনেকে এসে পেচ্ছাপ করে যাচ্ছে। যাতায়াত করছে অনেক মানুষ। মাইক বাজছে, কোলাহল শোনা যাচ্ছে।
এবার আমি যাই অমলদা?
যাবে! চলল, একটু এগিয়ে দিই।
তার দরকার নেই। ওই তো বাড়ি দেখা যাচ্ছে। তুমি বরং একবার বাড়িতে এসো। আমার কর্তার সঙ্গে পরিচয় করে যেও।
ম্লান মুখে অমল বলে, কতবার যাব বলে তোমাদের বাড়ির ফটক অবধি গেছি। কেন যে শেষ অবধি ঢুকতে পারিনি তা জানি না। ফটক থেকেই ফিরে এসেছি।
এত লাজুক তো তুমি ছিলে না।
না পারুল, এটা লাজুক বলে নয়। আত্মবিশ্বাস কমে যাচ্ছে। কেন যেন মনে হয় আমি ভুলভাল কথা বলে ফেলব, অদ্ভুত কিছু করে ফেলব।
ওমা! ওরকম কেন মনে হয় তোমার?
সেইটেই বুঝতে পারি না। আমার আজকাল এমনও মনে হয় যে, লোকে আমাকে নিয়ে আড়ালে হাসাহাসি করে।
উদ্বিগ্ন পারুল বলে, অমলদা, তুমি কি ভুলে গেছ যে, তুমি একজন ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র ছিলে! তোমার কত ডিগ্রি, কত বড় চাকরি, কত সম্মান!
আমার মেধা, ডিগ্রি বা সম্মানকে কি আজ তুমি মূল্য দাও পারুল? একদিন কিন্তু সব মাড়িয়ে দিয়ে তুমি আমার জীবন থেকে সরে গিয়েছিলে।
সেটা অন্য প্রসঙ্গ অমলদা। অন্য ঘটনা। তোমার গুণের দাম কি তা বলে কমে গেছে।
অমল মাথা নেড়ে বলে, ওসব দিয়ে কিছু হয় না পারুল। ডিগ্রি হল, চাকরি হল, টাকা হল, তবু মনে হয় কী করে জীবনযাপন করতে হয় সেটাই তো এখনও জানা হল না।
এত ফ্রাষ্ট্রেশন কেন তোমার? আমার জন্যই কি?
তোমার জন্যই কিছুটা। কিন্তু সবটুকু বোধহয় তুমি নও। ধরো যদি তোমাকে বিয়ে করতে পারতাম তা হলে কি তুমি আমার কাছে ক্ৰমে পুরনো এক অভ্যাসের মতো হয়ে যেতে না? বরং বিয়ে হয়নি বলেই আজও অ্যালবাম খুলে তোমার ছবি দেখি। বিয়ে করা বউয়ের ছবির দিকে কেউ কি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে? না পারুল, তোমাকে অন্যভাবে তো পেয়েছিই। আরও ভালভাবে।
বেশ বললে! শুনে কান জুড়িয়ে গেল। কিন্তু তোমার এই হতশ্রী দশা তবে কেন হল বলো তোর
বুঝতে পারি না পারুল। যত দিন যাচ্ছে তত মনে হচ্ছে, ছাইভস্ম অনেক শিখলুম, কিন্তু তা দিয়ে কিছু হয় না।
একটা কথা সত্যি করে বলবে?
বলব না কেন? তোমাকে তো সবই বলা যায়। যায় না পারুল?
না যায় না! সব আমাকে কেন বলবে অমলদা? বোলো না। আমি শুধু জানতে চাই নিজের বউয়ের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক কেমন?
মাথা নেড়ে অমল বলে, ভাল নয়। একটুও ভাল নয়। প্রথম প্রথম একরকম ছিল। বিয়ের পরেই ও তোমার কথা জানতে পারে, কিছু অশান্তিও হয়। আবার একটা আপসরফাও হয়ে গিয়েছিল। তারপর কেমন করে যেন একটা ঘেন্নার সম্পর্ক তৈরি হল। সামান্য ছুতোনাতায় পরস্পরকে অপছন্দের মাত্রা বাড়তে লাগল। আক্রোশে হাত কামড়াতে ইচ্ছে করত। কিন্তু তবু সে একরকম ছিল, আক্রোশ-ঘেন্নাও একটা সম্পর্ক বজায় রাখে। কিন্তু ভয়াবহ হল ঠান্ডা উদাসীনতা। কী বলব তোমাকে, এখন ওকে সামনে দেখেও ওর কথা মনে পড়ে না।
তুমি সাইকিয়াট্রিস্ট দেখিয়েছ?
অমল একটু মলিন হেসে বলে, সাইকিয়াট্রিস্টরাই এখন সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত ডাক্তার। সাইকিয়াট্রিস্ট, ম্যারেজ কাউন্সেলর কিছু বাকি নেই।
তা হলে তোমার প্রবলেম তো খুব অ্যাকিউট।
হ্যাঁ। কিন্তু ওসব নিয়ে ভেবো না পারুল। আমার কথা বাদ দিয়ে এবার তোমার কথা বলো।
আমার তো কথা কিছু নেই।
শুনেছি জ্যোতিপ্রকাশ গাঙ্গুলি একজন ভাল মানুষ।
সে তার মতো ভাল।
কথাটার মানে কী পারুল?
তোমার মতো অত কোয়ালিফিকেশন তার নেই। অনেক কষ্ট করে, নিজের চেষ্টায় যা হওয়ার হয়েছে।
অমল একটু হেসে বলে, আমাকে কি একটু খোঁচা দিলে নাকি পারুল? দাও। খোঁচাটা আমার ভালই লাগল।
মোটেই খোঁচা দিইনি। জানতে চাইলে বলে বললাম।
বুঝলে, আগে খুব অহংকার ছিল আমার। ব্রিলিয়ান্ট বা কাজের লোক দেখলে হিংসে হত। মনে হত আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ বুঝি কেউ নেই। এখন হয়েছে তার উলটো। একটা ন্যালাক্ষ্যাপা লোককেও মনে হয় আমার চেয়ে বড় মানুষ বুঝিবা। অহংকারটা যে কোথায় গেল কে জানে।
অহংকার কি ভাল অমলদা?
অহংকারকে সাধকরা জয় করেন, সে অন্য ব্যাপার। অনেক মহৎ কাজ। আমার তো তা নয়। আমার হল ইনফিরিয়ারিটি কমপ্লেক্স।
ইনফিরিয়ারিটি কমপ্লেক্স বলে কিছু হয় না তা জানো?
মনোবিজ্ঞানে না থাক, কথাটা তো চালু আছে পারুল। যা বোঝার বুঝে নাও।
আজ অনেক দুঃখের কথা বলেছ। আর নয়। রাত দেড়টা বাজে। এবার বাড়ি যাও। ঘাড়ে গলায় জল দিও, চোখে ভাল করে জলের ঝাপটা দিও, জয়েন্টগুলো ভিজিয়ে নিও। তারপর ঘুমোও।
নির্বোধের ঘুমের অভাব হয় না। আমার ঘুম খুব গাঢ়। ইদানীং হঠাৎ হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। ঘুম ভেঙেছিল বলেই হাঁটতে হাঁটতে যাত্রা দেখতে চলে এলাম। ভাগ্য ভাল, তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।
ভাগ্য ভাল না খারাপ তা কে বলবে? আমার মনটা আজ তুমি খারাপ করে দিয়েছ।
আচ্ছা আমি কি একটু বেশি কথা বলছি বলে তোমার মনে হয়?
না তো! বেশি বলেনি, তবে যা বলেছ সবই নেগেটিভ কথা।
আমার মনে হয়, আজকাল বোধহয় আমি একা একাও কথা বলি।
ওরকম ভেবো না অমলদা। নিজেকে নিয়ে বেশি ভাবলে শেষে তুমি ক্ষ্যাপাটে হয়ে যাবে।
ক্ষ্যাপাটে কি এখনই নই পারুল? বলে মৃদু মৃদু হাসতে থাকে অমল।
মায়াভরা চোখে তার দিকে চেয়ে থেকে পারুল বলে, একটু ক্ষ্যাপাটে হওয়া পুরুষমানুষদের পক্ষে মন্দ নয়। হিসেবি, কৃপণ, উচ্চাকাঙ্ক্ষীর চেয়ে বরং একটু ক্ষ্যাপাটে হওয়া ভাল।
একটা কথা জিজ্ঞেস করব? খুব সংকোচ হচ্ছে।
সংকোচের কী? বলো।
আমাদের সম্পর্কের কথাটা কি জ্যোতিপ্রকাশবাবুকে বলেছ?
বলেছি।
সেই ঘটনাটার কথাও?
পারুল ঠোঁট কামড়াল, চাপা গলায় বলল, হ্যাঁ।
উনি কিছু মনে করেননি!
মনের কথা জানি না। তবে আমাকে গ্রহণ করেছেন।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অমল বলে, উনি তাহলে শক্তিমান পুরুষ। তুমি ঠিক মানুষকেই পেয়েছ পারুল।
হিসেবটা অত সহজ নয়। সুন্দরীদের কিছু প্লাস পয়েন্ট থাকে। তাদের অনেক দোষঘাট রূপের তলায় চাপা পড়ে যায়। পরস্পরের মনের কথা ইহজীবনে কি সবটা বোঝা যায়?
উদাস মুখে অমল বলে, তাই হবে। অত জানার দরকারই বা কী?
একটা কথা বলি। অ্যালবাম থেকে আমার ফটোটা সরিয়ে নষ্ট করে দিও।
অবাক হয়ে অমল বলে, নষ্ট করব? নষ্ট করলে আমি কী নিয়ে থাকব পারুল? আমরা কী নিয়ে থাকব?
.
১৭.
মানুষের শরীরের ভিতরে যেসব হাজারো জটিলতা রয়েছে তার খবর পান্নার জানা নেই। কিন্তু কণ্ঠনালির ভিতরে শ্বাস আর খাদ্যের নলের মধ্যে যে একটি ভয়ংকর বিপজ্জনক ফোকর রয়েছে সে খবরটা সে খুব ভাল জানে। যখন ছোট ছিল, অস্পষ্ট স্মৃতির সেই সময়ে কেউ তাকে ভয়টা দেখিয়ে রেখেছিল, খাদ্যনালি থেকে মাঝে মাঝে ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল শ্বাসনালিতে গিয়ে আটকে দম বন্ধ করে দেয়। সেই শৈশবের শেখা ভয় পান্নাকে আজও ছাড়েনি। বরং যত বয়স বাড়ছে তত ভয় বাড়ছে। জ্ঞানবয়সে আজ অবধি ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল গিলে খেতে পারল না পান্না।
এ-বাড়ির বাঁধা ডাক্তার ছিলেন মণিরাম। ধুতি জামা পরা ডাক্তার আজকাল আর দেখা যায় না। মণিরাম সেই বিরলবেশের ডাক্তার। কে জানে ওই পোশাকের জন্যই শেষ দিকটায় মণিরামের পশার কমে গিয়েছিল কিনা। ধুতি পরা ডাক্তার দেখে অকারণেই এ যুগের রুগিরা নাক সিঁটকোয়। ঠিক ঠিক নির্ভর করতে পারে না বোধহয়। কিন্তু মণিরাম বিচক্ষণ ডাক্তারই ছিলেন। বর্ধমান থেকেও তাঁর ডাক পড়ত। ইদানীং জনা দুই ছোকরা প্যান্ট-শার্ট পরা ডাক্তার এসে মণিরামকে অস্তাচলে ঠেলে দিয়েছিল।
মণিরামই পান্নাকে বলেছিলেন, ক্যাপসুল গিলতে পারিস না, কিন্তু অত বড় ভাতের গরাসটা গিলিস কী করে?
ভাতের গ্রাস আর ক্যাপসুল কি এক হল জ্যাঠামশাই?
না, তা হল না। কারণ ক্যাপসুল ভাতের গরাসের চেয়ে অনেক ছোট।
তা হোক, ক্যাপসুল বলে কথা। ও আমি গিলতে পারব না। জলে গুলে খেয়ে নেব।
মণিরাম মাথা নেড়ে বলতেন, সে তো অশৈলী কাণ্ড। সব ট্যাবলেট আর ক্যাপসুল কি গুলে খাওয়া যায়? খাওয়া উচিতও নয়। খা দেখি আমার সামনে, কেমন না পারিস।
পান্না পারেনি। চেষ্টা করেছিল, কিংবা বলা ভাল চেষ্টা করার ভান করেছিল, তারপর জলসুদ্ধ ক্যাপসুল ফেলে দিয়েছিল মেঝেয়। মা সেই ভেজা ক্যাপসুল কুড়িয়ে শেষে জলে গুলেই খাইয়েছিল। মণিরাম মাথা নেড়ে বলেছিলেন, এভাবে তো সারাজীবন পারবি না। এখন থেকে ছোট ছোট হোমিওপ্যাথিক বা বায়োকেমিক ট্যাবলেট গিলে গিলে প্র্যাকটিস কর। নইলে পরে বিপদে পড়বি।
প্র্যাকটিস আর করা হয়নি। কণ্ঠনালির রহস্যময় জটিলতা তাকে আজও আতঙ্কিত করে।
ডা. মণিরাম বেঁচে নেই। তাঁর পুরনো স্টেথোস্কোপ, প্রেশার মাপার যন্ত্র, গোরু-ছাগল-পুকুর-জমি-বাড়ি সব পড়ে আছে। ছেলেরা কেউ ডাক্তার হয়নি বলে স্টেথো আর প্রেশারের যন্ত্রে ধুলো পড়ছে।
পান্নার জ্বর এল বিজয়া দশমীর শেষ রাতে। জ্বর যে আসবে তা পান্নার জানাই ছিল। বিজয়া দশমীর বিকেলে নিগ্রোর চুলের মতো কোঁকড়া ও কালো একটা মেঘ দিগন্তে আততায়ীর মতো উঠে এল। তখন প্রতিমা লরির খোলে ভোলা হয়ে গেছে আর মেয়েরা সব হাঁচোড়-পাঁচোড় করে উঠছে লরিতে। লরিতে ওঠাও যেন এক যুদ্ধ। টুলের ওপর দাঁড়িয়ে শাড়ি সামলে উঠতে গিয়ে সে মুখ থুবড়ে পড়ল লরির নোংরা পাটাতনে।
মা অবশ্য বারণ করেছিল, যাসনি পান্না। দহে অনেক জল। তুই কিন্তু সাঁতার জানিস না।
মায়ের বারণ তেমন না শুনলেও চলে। মা কিছু নরম মানুষ। আর বাড়ির লোকের তো সবটাতেই বারণ। শুনলে কি চলে? তাদের তিন বাড়ির প্রায় সব মেয়েই যখন যাচ্ছে তখন পান্নাই বা পড়ে থাকবে কেন?
কিন্তু নিগ্রোর মাথার মতো মেঘটা একটু চিন্তায় ফেলেছিল পান্নাকে। মেঘটা ফুঁসে ফুলে উঠেছিল ক্রমে। যেন হঠাৎ এক অদৃশ্য আগ্নেয়গিরি মাটি খুঁড়ে উঠে এসেছে, ওগড়াচ্ছে তার ভিতরের চেপে রাখা রাগ।
বাদ্যিবাজনাসহ সামনে একটা পদাতিক মিছিল, পেছনে প্রতিমাসহ মেয়েদের লরি, তার পিছনে আরও দুটো লরিতে ক্লাব আর পাড়ার ছেলেমেয়েরা। লরির খোলের মধ্যে পাতা শতরঞ্চিতে ঠাসাঠাসি বসে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে করতে এক একবার আততায়ী মেঘটাকে দেখছিল পান্না। দেখেছিল পরমাণু বোমার মতো বিশাল ছত্রাকে আকাশের অর্ধেক ঢেকে ফেলেছে প্রায়, ছত্রাকের নীচে পাঁশুটে এক অতিকায় স্তম্ভ। সত্যিই কি অ্যাটম বোমা ফেলল নাকি কেউ?
দুটো কারণে মেঘটাকে ভয় পাচ্ছিল পান্না। এক তো আজকের ভাসান ভাসিয়ে দেবে। দ্বিতীয়ত, তার সর্দির ধাত। একটু ঠান্ডা লাগলেই ফুচফুচ হাঁচি আর খুকখুক কাশি আর ঘুসঘুসে জ্বর আর টিপটিপ মাথা ধরা। বৃষ্টির জল তার একদম সয় না। আর কেউ তার মতো নয়। আর সবাই বৃষ্টিতে ভিজে ঠিকঠাক থাকবে, পান্না থাকবে না। তবু বিজয়া দশমী বলে কথা। আজ একটু হুল্লোড় না করলে চলে? পান্না চেপে বসে রইল।
বৃষ্টির আগে একটা বাতাস আসবেই। অগ্রদূত। বাতাসে বৃষ্টির মিঠে গন্ধটা থাকে, আর থাকে হিম। ঝোড়ো বাতাসটা ওই ভিড়ের মধ্যেও ঠিক পান্নাকে খুঁজে নিয়ে ছুঁয়ে ফেলল, চোর চোর খেলার চোরের মতো। গায়ে কাঁটা দিল পান্নার।
মেঘ গম্ভীর গলায় সিংহের মতো ডেকে উঠল দূরে। তারপর গর্জন করতে করতে এগিয়ে আসতে লাগল। এসব ঘটনা কেউ গায়ে মাখল না, কিন্তু পান্না আঁচল তুলে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টায় মাথা ঢাকা দিয়েছিল। বৃথা চেষ্টা।
পান্নাকে লক্ষ করে বরফকুচির মতো প্রথম বৃষ্টির ফোঁটাটি নিক্ষেপ করল মেঘ। পান্না কেঁপে উঠল শীতে। তারপর সরু, ঠান্ডা ভূতের অজস্র আঙুলে তাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল বৃষ্টি। নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা ছেড়ে অসহায়ভাবে পান্না শুধু বলেছিল, হায় ভগবান!
আর সেই বৃষ্টিতে আনন্দে অনেকেই কোলাহল তুলেছিল। বিশেষ করে বাচ্চারা। তারা যে-কোনও অঘটনই খুব পছন্দ করে। ভিজছে আর আনন্দে হি-হি করে হাসছে। হাত বাড়িয়ে চেটো পেতে ধরার চেষ্টা করছে বৃষ্টির জল।
আনন্দ পান্নাও করেছিল কিছুক্ষণ।
বৃষ্টির মধ্যেই দহের ফুটন্ত জলে প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে জলে নেমে দাপাদাপি করেছিল অনেকে। পান্না নামেনি। শরীর জুড়ে জ্বরের ঝংকার টের পাচ্ছিল সে।
পারুলদি বলল, এমা! তোর কী হবে রে পান্না?
কী আবার। জ্বর আসবে।
তুই যে কেন এলি! ছাতা-টাতা কিছু আনিসনি?
পাগল! বিসর্জনে কেউ ছাতা আনে?
শোন, তুই বরং ড্রাইভারের পাশে গিয়ে বোস। আর ভিজিস না। যা ঠান্ডা জল!
ওখানে বসলে যে আলাদা হয়ে যাব।
কিছু আলাদা হবি না। সবাই তো সঙ্গেই রয়েছে। দাঁড়া, বিজুকে বলছি তোকে সামনে তুলে দিক।
তাই হল শেষ অবধি। ড্রাইভারের পাশে তার অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিল। আরও জনা দুই বুড়োবুড়ি। তাদের পাশে ঠাস হয়ে বসে ফেরার সময়ে পান্নার শরীর ভেঙে আসছিল। ভেজা শাড়ি শায়া, ভেজা শরীরে বাতাস লেগে শিহরিত হচ্ছিল গা।
যখন বাড়িতে এসে পৌঁছল তখন একশো দুই জ্বর। সকালে উঠল চারে। এবং দুপুরে সাড়ে চারে উঠে গেল। চিন্তিত মা ঘরবার করছে। মা মানেই বকুনি, মা মানেই শাসন।
কতবার বারণ করলুম যেতে, তবু শুনলি সেই কথা। তোর কি আর পাঁচটা মেয়ের মতো স্বাভাবিক ধাত? পচা শরীর তোর যখন-তখন ঠান্ডা লাগে, টনসিল ফোলে, তার ওপর ওরকম মুষলধারের বৃষ্টিতে অতক্ষণ ভেজা!
আরও চলত কিছুক্ষণ।
হঠাৎ সেই চিরাচরিত ঝ্যালঝালে লম্বা ঝুলের বিচ্ছিরি জামা পরা একটা মেয়ে এসে দাঁড়াল দরজায়।
মাই গড! তোমার কি জ্বর? চোখ দুটো তো খুব লাল দেখাচ্ছে!
আবছা একটু হাসল পান্না। ক্ষীণ গলায় বলল, ওই চেয়ারটা টেনে বোসো।
কাল খুব ভিজেছ বুঝি?
হ্যাঁ।
শুনেছি তোমরা সব ভাসানে গিয়েছিলে।
তুমিও গেলে না কেন সোহাগ? কতবার বললুম।
অত ভিড় আমার ভাল লাগে না। আর যা শব্দ।
খুব আনন্দ হয়েছিল কিন্তু।
মুখ টিপে হেসে সোহাগ বলে, একটু একটু ইচ্ছেও হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত ভাবলাম, আমি তো অনেককেই চিনি না।
যাঃ, না চেনার কী আছে! প্রতিমার লরিতে তো আমরাই সব ছিলাম বাবা। সব মেয়েরা। তোমার গডেসও ছিল।
সোহাগ একটু হাসল। তারপর ফের বলল, একটু একটু ইচ্ছে যে হয়নি তা নয়। চুপি চুপি গিয়ে প্যান্ডেলের কাছে দাঁড়িয়েছিলাম। কিন্তু কেউ ডাকল না দেখে আর এগোইনি৷
আমি দেখতে পেলে ঠিক তোমাকে তুলে নিতাম।
তোমাকেই খুঁজছিলাম। দেখতেই পেলাম না ভিড়ের মধ্যে। এই জন্যই ভিড় আমার ভাল লাগে না। ভিড়ে আইডেন্টিটি হারিয়ে যায়।
সবুজ সংঘের পুজো অনেকটা বাড়ির পুজোর মতোই। অচেনা তো কেউ নয়।
আমার কাছে সবাই প্রায় অচেনা।
তা অবশ্য ঠিক।
তোমরা চলে যাওয়ার পর আমার একটু মন খারাপ লাগছিল। মনে হল, আমি আর একটু মিশুক হলে ভাল হত।
তুমি কি লাজুক?
ঠিক তা নয়।
তবে কি অহংকারী?
একটু বোধহয় তাই। সবাইকে ইনফিরিয়র ভাবা ভীষণ অন্যায় জানি। কিন্তু আমার ওই এক স্বভাব।
যাঃ, তুমি মোটেই অহংকারী নও। আমার সঙ্গে ভাব হল কী করে বলো?
তুমি বোধহয় অন্যরকম।
একটুও না। তবে আমিও কিন্তু একটু অহংকারী। কীসের অহংকার জানি না বাবা। তবে আছে একটু। বন্ধুরা বলে, তোর ভীষণ দেমাক।
তুমি কথা বলতে গিয়ে হাঁফিয়ে পড়ছ। আর কথা বোলো না। চুপ করে চোখ বুজে শুয়ে থাকো। আমি কি তোমার জন্য কিছু করতে পারি?
কী করবে?
মাথা টিপে দিতে পারি বা আইসব্যাগ ধরতে পারি।
না, না, তুমি বসে থাকো। আমার এখন একটু ভাল লাগছে। অসুখ হলে বড় একা লাগে।
পান্না বাস্তবিক বড্ড ক্লান্ত বোধ করছিল। চোখ বুজতেই কেমন যেন এক আচ্ছন্নতায় তলিয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্য। হিজিবিজি স্বপ্নে ভরে গেল মাথা। তারপর চটকা ভেঙে চেয়ে দেখল, সোহাগ তখনও বসে আছে, চলে যায়নি। একটা হাত রেখেছে তার কপালে।
পান্না ক্ষীণ হেসে বলে, আমি একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আর তার মধ্যেই একটু স্বপ্নও দেখে ফেললাম।
তুমি ঘুমাও।
তুমি থাকবে তো?
একটু থাকব। আমার তো কোনও কাজ নেই।
চুপচাপ বসে থেকো না। কথা বলো। নিস্তব্ধতা আমার ভাল লাগে না।
তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
করো না। একটা লম্বামতো ছেলে, খুব ফর্সা, কাঁধে একটা বাঁদর নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, ছেলেটা কে বলো তো!
পান্না হি হি করে হেসে ফেলল, ও তো বিজুদা, ওর অদ্ভুত অদ্ভুত সব কাণ্ড। কোথা থেকে একটা বাঁদর এনেছে পুষবে বলে। আমাদের গায়ে ছেড়ে দেয় মাঝে মাঝে। যা ভয় পাই না।
দ্যাট হিরো!
বিজুদা কিন্তু ভীষণ ভাল। ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র।
উনি একজন ডু গুডার, তাই না?
হ্যাঁ। কেন বলো তো?
কাল যখন তোমরা ভাসানে যাচ্ছিলে তখন আমাকে একা প্যান্ডেলের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উনি এসে বললেন, তুমি যাবে না খুকি?
এই যে তুমি বললে তোমাকে কেউ ডাকেনি? বিজুদা তো ডেকেছিল।
মাথা নেড়ে সোহাগ বলল, মোটেই ডাকেনি।
তা হলে?
উনি কথাটা এমনভাবে বলেছিলেন যাতে আমি খুব অপমান বোধ করেছি।
সে কী? বিজুদা তো সেরকম নয়।
জুতোর পেরেক কোথায় ফোটে তা টের পায় শুধু জুতোটা যে পরে। আর আমি কি খুকি?
ওঃ, খুকি বলায় তুমি রাগ করেছ বুঝি?
সেটাও একটা কারণ। আর বলার ধরনটাও ছিল ঠাট্টার মতো। আমার একটুও ভাল লাগেনি।
তুমি ভুল বুঝেছ সোহাগ। বিজুদা সেরকম ছেলেই নয়।
সেটা তোমার চোখে। আমার চোখে নয়।
তোমাকে বিজুদা অপমান করবে কেন বলো তো! তুমি তো কিছু করোনি।
করেছি। আমি ওঁর সাহায্য রিফিউজ করেছি। যে বাজে ছেলেগুলো আমাকে দেখে কমেন্ট করত উনি তাদের শাসন করতে চেয়েছিলেন। আমি বড়মাকে বলে দিয়েছি ওর সাহায্যের কোনও প্রয়োজন আমার নেই।
ও, তুমি ভীষণ একগুঁয়ে মেয়ে। ছেলেগুলোকে যে একটু ভয় দেখানো দরকার সেটা কেন বোঝো না। প্রশ্রয় দিলে যে বাড়াবাড়ি করতে থাকবে। তোমাকে দেখে যে ভীষণ খারাপ খারাপ কথা বলছিল সেদিন।
সবাই ওকথা বলে।
কিন্তু আমার কথা হল, লড়াই যদি করতেই হয় তবে আমিই করব। আমার কোনও বডিগার্ডের দরকার নেই।
পান্না খুব ক্লান্তি বোধ করে চোখ বুজল। সোহাগকে তার মাঝে মাঝে খুব ভাল লাগে, মাঝে মাঝে খুব খারাপ। এখন খারাপ লাগছে।
সন্ধেবেলা একজন ডাক্তারকে ধরে নিয়ে এল বাবা। নতুন ডাক্তার। জ্বরের ঘোরে খুব আবছা চেহারাটা দেখতে পেল পান্না। লোডশেডিং বলে হ্যারিকেনের আলো জ্বলছে। সেই আলোয় বড় বড় ছায়া পড়েছে চারদিকে। ভূত-ভূত আলো-আঁধারিতে সবকিছুই যেন ভাসমান।
মাথার যন্ত্রণায় চোখে জল আসছে। সেই অস্পষ্ট চোখে সে হঠাৎ আবিষ্কার করল, ডাক্তারের মুখটা খুব গম্ভীর। তার কি তবে সাংঘাতিক কিছু হয়েছে? সে কি মরে যাবে?
আমার কী হয়েছে ডাক্তারবাবু?
স্টেথোস্কোপ বুকে লাগিয়ে ডাক্তার গম্ভীর গলায় বলল, কথা বলবেন না। জোরে শ্বাস নিন।
আমার সারা গায়ে খুব ব্যথা।
জানি। ব্যথা হওয়ারই কথা। জোরে শ্বাস নিন।
বুকে লাগছে যে শ্বাস নিতে।
যতটা জোরে পারেন।
আমি মরে যাচ্ছি না তো!
মরা কি মুখের কথা? দেখি পাশ ফিরে শোন তো একটু।
ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া নয় তো! কিংবা মেনিনজাইটিস।
আজকাল রুগিরা বেশ ভাল ডাক্তারি বুঝে গেছে দেখছি।
একটু আগে আমার মা পাশে বসে কাঁদছিল যে!
মায়েরা অল্পেই কাঁদে।
আপনি গম্ভীর কেন? বাবার মুখেও হাসি নেই।
আপনি চোখ বুজে থাকলেই ভাল হয়। আপনার কিছু হয়নি তেমন। পালসটা একটু দেখি।
লেপের তলা থেকে হাতখানা বের করে দিতেই যেন কত পরিশ্রম হল পান্নার।
এবার জিবটা বের করুন।…এবার হাঁ করুন তো, গলাটা একটু দেখব।
প্লিজ চামচ ঢোকাবেন না কিন্তু, আমার বমি হয়ে যাবে।
আচ্ছা আচ্ছা, চামচ ছাড়াই দেখে নিচ্ছি। বড় করে হাঁ করুন।
মণিরাম জ্যাঠাও এইভাবেই দেখতেন। খুব মন দিয়ে। নাড়ি ধরে অনেকক্ষণ চোখ বুজে থাকতেন। স্টেথোস্কোপ বসাতেন চেপে চেপে। নানারকম প্রশ্ন করতেন। পায়খানা, পেচ্ছাপ, খিদে সবকিছুর খতেন নিয়ে তবে প্রেসক্রিপশন লিখতেন। এ ডাক্তার অবশ্য অত সময় নিল না। প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে বলল, জ্বর খুব বাড়লে ঠান্ডা জলে গা স্পঞ্জ করে পাখার বাতাস করবেন। জ্বর নেমে যাবে। প্যারাসিটামলটা দুবারের বেশি দেবেন না।
মা অবাক হয়ে বলে, ঠান্ডা জলে?
হ্যাঁ। ভয় নেই, কিছু হবে না।
ডাক্তারটা বোধহয় পাগল। এমনিতেই শীতে মরে যাচ্ছে পান্না, ঠান্ডা জল গায়ে দিলে সে তক্ষুনি হার্টফেল করবে।
পথ্যি কী দেব ডাক্তারবাবু?
কেন, ভাতরুটি যা খেতে চায়?
এই জ্বরে ভাত?
হ্যাঁ, ভাতে কোনও ক্ষতি হবে না।
ডাক্তারটার মাথা খারাপ। মণিরাম জ্যাঠা জ্বর সারবার পরেও আরও দুদিন ভাত পথ্য দিতেন না। স্নান নিষিদ্ধ ছিল বেশ কয়েকদিন। বার্লি ছাড়া পথ্য ছিল না।
কী দিলেন ডাক্তাবাবু? ক্যাপসুল?
হ্যাঁ। কেন বলুন তো।
আমি ক্যাপসুল গিলতে পারি না।
সে কী? ক্যাপসুল না খেলে অসুখ সারবে কেমন করে?
লিকুইড নেই?
লিকুইড। না, এই হাই পোটেনসিতে লিকুইড পাওয়া যায় না।
আমি যে গিলতে পারি না। ক্যাপসুল গুলে খেতে রয়।
ডাক্তারবাবুটি হাসলেন। কিন্তু উপদেশ দেওয়া বা জবরদস্তির চেষ্টা না করে বললেন, সেভাবেই খাবেন। তবে একটু তেতো লাগবে হয়তো। অরেঞ্জ স্কোয়াশ থাকলে তাতে গুলেও খেতে পারেন।
ক্যাপসুল গিলতে পারি না বলে আপনি কই বকলেন না তো!
ডাক্তারবাবুটি ফের হাসলেন, অনেকের সাইকোলজিক্যাল প্রবলেম থাকে, ওষুধ গিলতে ভয় পায়। বকবার মতো কিছু তো নয়। আমার এক জামাইবাবু আছেন, তিনিও ট্যাবলেট গিলতে পারেন না।
বাঁচল পান্না, শ্বাস ফেলল একটা।
আচ্ছা এনকেফেলাইটিস বলে একটা অসুখ আছে, না! সেটা হলে কী হয়?
খারাপ হয়।
মরে যায়?
মরতেও পারে।
আমার এনকেফেলাইটিস হয়নি তো!
আপনি খুব খারাপ খারাপ অসুখের কথা ভাবতে ভালবাসেন বুঝি?
আমার যে মনে হচ্ছে আমি মরে যাব।
অসুখ হলেই অনেকের ওরকম মনে হয়।
টাইফয়েড হয়নি তো!
সেটা এত আর্লি স্টেজে তো বলা যাবে না। তবে আপনার জ্বর হয়েছে ঠান্ডা লেগে। বুকে সর্দি জমেছে। ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
কয়েক মুহূর্তের জন্য তার ভিতরে চলে গেল পান্না। দেখতে পেল মণিরাম ডাক্তার ঘোড়ায় চেপে রুগি দেখতে যাচ্ছেন, সাদা জামার ওপর ফর্সা রোদ পড়েছে।
কিন্তু মণিরাম জীবনে কখনও ঘোড়ায় চড়েননি। তাঁর ছিল একখানা বশংবদ সাইকেল। তা হলে ঘোড়াটা এল কোথা থেকে?
পান্না যখন চোখ মেলল তখনও ডাক্তার যায়নি। তবে উঠে দাঁড়িয়েছে। এবার যাবে। কারেন্ট আসায় ডাক্তারবাবুটিকে স্পষ্ট দেখতে পেল পান্না। বেশি বয়স নয়। ত্রিশ-বত্রিশ হবে হয়তো। তার দিকে চেয়ে হেসে বলল, দু-একদিনের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবেন। ভয় নেই।
পান্না চোখ বুজল এবং সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্নের মধ্যে চলে গেল। মণিরাম জ্যাঠা পাশে এসে বসেছে। চোখে নিবিষ্ট দৃষ্টি।
দেখি, হাতখানা দে তো!
উঃ জ্যাঠা, আপনার হাত এত ঠান্ডা কেন?
ঠান্ডা! ঠাণ্ডাই তো হওয়ার কথা। তোর গায়ে যে জ্বর।
জ্যাঠা, আপনার কি ঘোড়া আছে?
হ্যাঁ। থাকবে না কেন?
ঘোড়ায় চেপে আপনি রুগি দেখতে যান?
হ্যাঁ। এই তো বিদ্যাধরীপুর থেকে এলুম। সেখানে কলেরা হচ্ছে।
ইস। তা হলে আমার হাতটা ছাড়ুন। আপনার হাতে যে কলেরার জীবাণু রয়েছে।
তা আছে। খুব আছে।
এখন আমাকে যে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে!
হ্যাঁ, ধোয়া ভাল। হাত ধোয়া খুব ভাল।
কতক্ষণ কে জানে। ফের চোখ মেলল সে। মাথার আইসব্যাগ থেকে সমস্ত শরীরে শীত ছড়িয়ে পড়ছে।
ওঃ মা, আইসব্যাগটা সরিয়ে নাও। ঠান্ডা লাগছে যে!
তোর যে জ্বর।
কত জ্বর?
একশো দুই-টুই হবে।
মোটেই না। আমার এখন একশো ছয় সাত হয়ে গেছে।
না না, অত নয়।
ডাক্তারবাবু কী বলে গেল?
কী আর বলবে?
আমার কী হয়েছে?
কী আবার হবে। জ্বর হয়েছে।
সাধারণ জ্বর নয় মা, আমি জানি।
এতই যদি জানো বাছা, তবে জ্বরটাকে ডেকে আনতে ভাসানে না গেলেই তো পারতে।
একটা দিন ভাসানে আনন্দ করব না?
আনন্দ তো এখন বেরোচ্ছে। এখন চিঁচিঁ না করে আনন্দ করলেই তো হয়।
তুমি একটা বিচ্ছিরি মা। পচা মা। অসুখ হলে কাউকে বকতে হয় বুঝি?
বকব না তো কি আহ্লাদ করব নাকি? পই পই করে বারণ করলুম, শুনলি সে কথা!
শোনো মা, আমি একটু আগে মণিরাম জ্যাঠাকে স্বপ্নে দেখেছি, জ্যাঠা এসে আমার নাড়ি দেখছিল। আমি কিন্তু আর বাঁচব না। মরা মানুষের স্বপ্ন দেখা খারাপ, তা জানো?
দুর্গা দুর্গা। ওসব কথা বলে না। বলতে নেই। বড় ডাক্তার দেখে গেছে। ভয়ের কী আছে মা?
ডাক্তারটি কে বলো তো! কখনও দেখিনি।
বর্ধমানের ডাক্তার। অনেক ডিগ্রি।
বর্ধমানের ডাক্তার যা বলে গেল শুনবে তো! জ্বরের মধ্যে আমাকে ভাত খেতে দেবে?
বড্ড ভয় পাই মা। কোনওকালে এমন অশৈলী কথা তো শুনিনি। আজকালকার তেজালো ওষুধের জোরে ওসব হয়তো চলে। কিন্তু ভাত না হয় জ্বর সারলেই খাস।
তা হলে ডাক্তার দেখিয়ে কী হবে?
পান্না ফের আচমকা স্বপ্নের জগতে চলে গেল। ঝোপের আড়াল থেকে কে একটা পাগলি তাকে ঢিল মেরেই লুকিয়ে পড়ল। ঢিলটা ঠং করে কপালে এসে লাগতেই মাথাটা ঝনঝন করে উঠল ভয়ংকর ব্যথায়।
কে? কে রে তুই?
পাগলিটা হি হি করে হেসে একটা ঝোপের আড়াল থেকে যখন আর একটা ঝোপের আড়ালে ছুটে গেল তখনই পান্না দেখতে পেল তার পরনে ঝালঝালে একটা বিবর্ণ জামা।
তুমি সোহাগ।
হি হি হি।
এমা! তুমি পাগল হলে কী করে?
ওরা যে আমাকে রেপ করল!
কারা রেপ করল তোমাকে?
ওই তো ওরা।
তুমি আমাকে ঢিল মারছ কেন?
ওরা পাজি। ভীষণ পাজি।
তোমাকে তো বলেইছিলাম ওদের একটু ভয় দেখানো দরকার। তুমি শুনলে না। বিজুদাকে কিছু করতেও দিলে না।
তোমার বিজুদা কি ভগবান?
তা কেন? বিজুদা একজন ডু গুডার।
ওকে আমার চাই না, বলে দিও। বেশ করেছে রেপ করেছে।
কাছে এসো সোহাগ। ঢিল মেরো না। আমি তো তোমার বন্ধু।
হি হি হি হি।
ফের চটকা ভেঙে গেল।
ওষুধটা খেয়ে নে!
তেতো বিচ্ছিরিওষুধটা খেয়ে নিয়ে পান্না বলল, ইস, অরেঞ্জ স্কোয়াশ দাওনি। ডাক্তারবাবু বলে গেল যে!
ভুল হয়ে গেছে মা। এর পর থেকে দেব। আরও ওষুধ আছে। একটা ট্যাবলেট আর একটা ক্যাপসুল।
ভীষণ বেশি ওষুধ দেয় তো লোকটা।
তা দেবে না কেন। অসুখটাও তো ভালই বাধিয়েছ।
স্বপ্ন আর জাগরণের মধ্যে একটা মজার যাতায়াত চলছে তার। মায়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই সে দুর্গা প্রতিমার মুখ দেখতে পাচ্ছিল কিন্তু মুখটা জলে ডুবে আছে। মা দুর্গা যেন চিৎকার করে বলছে, এই! এই! আমি ডুবে যাচ্ছি যে! আমি সাঁতার জানি না, আমাকে তোলা।
এক দঙ্গল ছেলেমেয়ের চেঁচামেচিতে মা দুর্গার চিৎকার চাপা পড়ে গেল। আর তখন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। পান্না একজনের বুকে দুম দুম কিল মারতে মারতে বলল, কী করছ তোমরা! মা দুর্গাকে ভোলো শিগগির! মা দুর্গা ডুবে যাচ্ছে যে!
লোকটা বলল, মা দুর্গাকে তুলতে নেই। আপনি ঘুমোন।
কেন ঘুমোব?
আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন। সব দিকে নজর রাখার দরকার কী?
অবাক হয়ে পান্না দেখল, লোকটা নতুন ডাক্তারবাবুটি।
সে লজ্জা পেল। জ্বর নেমে যাচ্ছিল তার। মাথা ধরা কমে যাচ্ছে। গা ঠান্ডা হয়ে আসছে। শীত লাগছে না তেমন। প্যারাসিটামল খেলে এরকম হয় কিছুক্ষণের জন্য। সে জানে। জ্বর কমল বলেই বোধহয় স্বপ্নও আর তেমন দেখল না সে।
মা।
কী রে?
জল দাও।
মা জল দিল।
এখন রাত কত মা?
বারোটা।
আমাকে ওষুধ খাওয়াবে না?
খাওয়াব। তার আগে বার্লি।
ওয়াক। ওরকম করতে হয় না মা। ডাক্তারবাবু কি কাল আবার আসবে।
তো! বড় ডাক্তার কি রোজ আসে? পান্না একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সে যদি বিয়ে করে একজন ডাক্তারকেই করবে।
.
১৮.
যেন অতল জল থেকে উঠে আসা। এক ঘোর-ঘোর রূপকথার জগৎ থেকে বাস্তবের চৌকাঠে পা রাখা, কোনটা ভাল তা পান্না বলতে পারবে না। স্বপ্ন আর সত্যের মেলামেশা যে অদ্ভুত জগতে সে ছিল কয়েকদিন–তা তো কই খারাপ লাগছিল না তার। মৃত্যুভয় অবশ্য ছিল, কিন্তু তা তো তার সবসময়েই থাকে। অসুখ হলে একটু বেড়ে যায়, এই যা।
সকালবেলার আলো-ঝলমলে ঘরে দুর্বল শরীরে উঠে বসেছে পান্না। বুক অবধি লেপ টানা দেওয়া ছিল। লেপটা কোলের ওপর খসে পড়েছে। নিজের দুখানা হাত চোখের সামনে তুলে ধরে খুব মন দিয়ে দেখছে সে। একেই সে রোগা। এই অসুখে আরও কি রোগা হয়ে গেছে সে?
জ্বর ছেড়ে গেলে শরীরটা যেন বেশি ঠান্ডা মেরে যায়। খুব শান্ত এক শীতলতায় ভরে আছে শরীর। খুব দুর্বল। মুখে বিস্বাদ।
মা!
হুঁ।
আমি কি আজ চান করব?
পাগল!
গা থেকে বোঁটকা গন্ধ পাচ্ছি যে!
মোটেই কোনও গন্ধ নেই। আমি তো পাশেই শুই, গন্ধ হলে পেতুম না!
আমি পাচ্ছি যে!
গন্ধের নাক একটু কমাও মা। সবতাতেই গন্ধ-গন্ধ বলে নাক সিঁটকোলে তো হবে না। বড্ড গন্ধ বাই। তোর।
তাহলে কি নাকটা উকো দিয়ে ঘষে দেব?
আর উকো দিয়ে ঘষতে হবে না, এমনিতেই তো নাকটা একটু চাপা।
কই চাপা? দাও তো আয়নাটা! তুমি তো আমার সবকিছুই খারাপ দেখ।
আয়নায় নিজের নাক মোটেই চাপা বলে মনে হল না তার। একটু ছোট বটে, কিন্তু মোটেই চাপা নয়।
আমি কি খুব কুচ্ছিত মা?
কুচ্ছিত না হলেও ডানাকাটা পরি তো আর নও। জ্বরের আগে তাও যা একটু ছিল, জ্বরের পর তো হাড়গিলে চেহারা হয়েছে।
শুধু বার্লি গিলিয়ে রেখেছ, চেহারা তো খারাপ হবেই। ডাক্তারবাবু ভাত দিতে বলে গেল, তুমি কিছুতেই দিলে না।
আহা, ডাক্তাররা বড় পণ্ডিত কি না। নিদান দিয়ে দক্ষিণা পকেটে খুঁজে পগার পার হল, তারপর যত হ্যাপা সব আমাদের সামলাতে হবে।
ডাক্তারের কথা যদি না-ই শুনবে তবে ডাক্তার ডাকো কেন?
সে ডাকতে হয় বলে ডাকা। ডাক্তার ওষুধ দেবে, পথ্যি আমাদের হাতে।
বাঃ, বেশ মজা তো! ডাক্তারের কথা অর্ধেক শুনবে আর অর্ধেক ফেলে দেবে?
সেটাই রেওয়াজ। ডাক্তারদের কথা পুরো কেউ শোনে না। জন্মে শুনিনি একশো পাঁচ ছয় জ্বরে কেউ ভাত দেয়। মণিরাম ডাক্তার শুনলে মূর্ছা যেতেন। ওসব হালফিলের ডাক্তারের ওপর আমার ভরসা হয় না তেমন।
আজ তো জ্বর নেই, দেবে তো চাট্টি ভাত?
আজকের দিনটা থাক না, কাল খাস।
আমি কিন্তু আর বার্লি গিলতে পারব না। বার্লির বাটি ছুঁড়ে ফেলে দেব জানালা দিয়ে।
আচ্ছা, দুটো পাতলা রুটি দেব খন, আলু বড়ির ঝোল দিয়ে খাস।
রুটি! আমার যে অম্বল হয়ে যায়।
বাবা রে, বায়নাক্কার শেষ নেই তোর।
মুখটা যে কী বিস্বাদ! একটা লঙ্কা দেবে?
লঙ্কা!
লঙ্কা আর নুন খেলে জিবটা বোধহয় পরিষ্কার হবে।
পাগল নাকি? বরং আদাকুচি আর নুন খা। কাশিরও উপকার হবে।
তাই দাও বাবা। তার আগে এক কাপ চা। দেবে তো?
আবার চায়ের বায়না কেন? একেই তো লিভার ভাল নয়।
ওই এক কথা শিখেছ তুমি। লিভার ভাল নয়। কী করে জানলে যে আমার লিভার ভাল নয়? তুমি কি ডাক্তার? লিভার কাকে বলে তাই তো জানো না।
না জানলেও বুঝতে পারি। ওসব শিখতে হয় না আমাদের। তোর কটা শ্বাস পড়ল তারও হিসেব আমার আছে।
কাঁচকলা আছে। বলো তো সকাল থেকে কটা শ্বাস ফেলেছি? অত সোজা না। মা হয়েছ বলে মাথা কিনে নিয়েছ বুঝি!
তাই নিয়েছি। এই যে বৃষ্টিতে ভিজতে বারণ করলুম, শুনলি সেই কথা? মায়েরা সব আগাম খবর পায়, তা জানিস?
পান্না হেসে ফেলে, দুহাত বাড়িয়ে বলে, এসো তো আমার কাছে! একটু আদর করো।
আর আদিখ্যেতায় কাজ নেই মা। জড়াজড়ি করলেই বুঝি আদর হয়? রাত জেগে মুখের দিকে চেয়ে বসে থাকা, মাথায় জলপট্টি বা তালুতে বরফ দেওয়া, ঘণ্টায় ঘণ্টায় ওষুধ খাওয়ানো সেসব বুঝি আদর নয়?
সে তো কেজো আদর। একটু অকাজের আদর করো তো! মুখটা সবসময়ে ওরকম গোঁসাপানা করে রাখো কেন? হাসতে জানো না?
হাসি বুঝি অমনি আসে! কটা দিন তো হাড় ভাজা-ভাজা করে খেলে। একশো পাঁচ ছয় জ্বর উঠে যাচ্ছে, সবাই ভয় দেখাচ্ছে বেশি জ্বরে নাকি মাথায় রক্ত উঠে যায়। ভয়ে মরি। হাসি আমার শুকিয়ে আমসি হয়ে গেছে।
জ্বর বুঝি মানুষের আর হয় না! না হয় মরেই যেতাম। তোমার একটা চক্ষুশূল কমত। হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে।
খুব বুঝেছ।
তুমি সবচেয়ে বেশি ভালবাসো দাদাকে, সেকেন্ড হীরা, আমি লাস্ট।
তাই না?
ওই তো বললুম, খুব বুঝেছ।
জ্বরের ঘোরে আমি বারবার কাকে দেখেছি জানো? মণিরাম জ্যাঠাকে। মণিরাম জ্যাঠা এসে পাশে বসে আমার নাড়ি দেখছিল। কী ঠান্ডা হাত!
থাক, ওসব আবার মনে করতে হবে না। অলক্ষুণে সব স্বপ্ন।
মরা মানুষকে স্বপ্ন দেখা ভাল নয়, না?
স্বপ্ন স্বপ্নই। তার কি কোনও মাথামুণ্ডু আছে! জ্বরের ঘোরে কত হাবিজাবি দেখে মানুষ। ওসব নিয়ে ফের ভাবতে বোসো না। একেই তো ভিতুর ডিম!
আমার অত জ্বর দেখে বাবা কেমন করল বলবে?
পুরুষমানুষ বড্ড নরম হয়। তার ওপর বাপসোহাগী মেয়ে। কেমন আবার করবে। ঘরবার করেছে, বারবার জ্বর মেপেছে, আর উদ্ভট উদ্ভট সব নিদান দিয়েছে।
কী রকম মা? একটু বলো না!
কোথায় কোন তান্ত্রিকের কাছে যাবে বলে বায়না ধরেছিল। আমি যেতে দিইনি। তান্ত্রিকদের নানা মতলব থাকে। কোন ফকিরবাবার জলপড়ার কথাও যেন বলছিল। তখন কি আর কারও মাথার ঠিক ছিল মা?
আর হীরা?
ও বাবা এমনিতে দু বোনে বনিবনা নেই বটে, কিন্তু যেই দিদির জ্বর হল অমনি হীরা জব্দ, সারাদিন চোখ ছলোছলে, ভাল করে খায় না, ঘুমোয় না। বেশ খেলা দেখিয়েছ।
তাকে নিয়ে যে বাড়িতে একটা ভীষণ টেনশন গেছে এটা জেনে খুব খুশি হচ্ছিল পান্না। এইসব অসুখ-বিসুখ শরীর নিংড়ে নেয় বটে, কিন্তু বিনিময়ে কিছু পুরস্কারও তো দিয়ে যায়। অসুখের ভিতর দিয়ে কি মানুষের একটা নবীকরণও হয়?
কে কে আমাকে দেখতে আসত বলো তো! বড়মা আসেনি?
ওমা! বড়দি আসবে না? রোজ দুবেলা এসেছে। বকুল, পারুল, জামাইরা সবাই এসে ঘুরেফিরে দেখে গেছে।
আমি কিন্তু টের পাইনি কিছু।
কী করে পাবে? চৈতন্যই তো ছিল না একরকম। মাঝে মাঝে একটু চেতনা এলে দু-চারটে হাবিজাবি কথা বলে ফের ঘোরে ডুবে যেতিস।
ধ্যেৎ! বলে হাসে পান্না, হাবিজাবি বলতাম বুঝি?
বেশিরভাগই অসংলগ্ন কথা। মাথামুন্ডু নেই।
কেউ শোনেনি তো!
তেমন কেউ নয়। শুধু ওই অমলের মেয়ে সোহাগ। সে সারাক্ষণ তো মুখের ওপরই পড়ে থাকত।
সোহাগ কি কলকাতায় চলে গেছে মা?
জানি না বাপু। কাল থেকে তো আসছে না। আমারও কি পাড়াপ্রতিবেশীর খবর নেওয়ার সময় ছিল?
আজ কি খুব শীত পড়েছে?
তা পড়েছে বাছা। সকালে তো কনকনে হাওয়া দিচ্ছিল।
তা হলে আমাকে উঠোনে একটা চেয়ার পেতে দাও। রোদে একটু বসি। কতকাল বাইরেটা দেখা হয়নি।
আজ থাক না। শরীর দুর্বল, মাথা-টাথা যদি ঘুরে যায়।
কিছু হবে না মা। পেতে দাও।
বাইরে রোদে বসে চারপাশটাকে চোখ নাক ত্বক দিয়ে শুষে নিচ্ছিল পান্না। বাঁ ধারে বড় জ্যাঠাদের তিনতলা বাড়ির ছাদ দেখা যায়, ঘোষবাড়ির মস্ত মস্ত নারকোল গাছে আছাড়ি-পিছাড়ি হাওয়া, পুকুরপাড় থেকে বাসন ধোয়ার শব্দ আসছে, একটা গোরু হাম্বা বলে ডেকে উঠল।
আজ হাওয়ার দিন। বাতাসে লুকোনো ছুরির মতো শীত এসে তার শরীরের আনাচে কানাচে ঢুকে যাচ্ছে। একটা বাটিতে মুড়ি আর আধকাপ চা দিয়ে গেছে মা। মুড়িটা বাতাসের থাবায় অর্ধেক উড়ে গেল। তাড়াতাড়ি জুড়িয়ে গেল চা। গায়ের আলোয়ানটা উড়ে যাচ্ছে বারবার বাতাসের ঝাপটায়। রোদ তেমন গায়ে লাগছে না।
না, এই শীত বাতাসটা সহ্য করা তার উচিত হচ্ছে না। ফের যদি জ্বর আসে।
হাহাকারের মতো শব্দ উঠছে গাছপালায়। বাতাস বড্ড দামাল। রোদের তাপটুকু লুটপাট করে নিয়ে যাচ্ছে। উঠোনে এ সময়ে যেসব পুষি বেড়াল বা ভেলু কুকুরেরা বসে থাকে তারাও কেউ নেই।
একটু বসে থাকার ইচ্ছে হয়েছিল পান্নার। সাহস হল না। উঠে ঘরে চলে এল। বিছানায় বসে কোমর অবধি লেপটা টেনে নিল। গলায় জড়িয়ে নিল মাফলার। কোলে পুবের জানালা দিয়ে ঝকঝকে রোদ এসে পড়েছে। তাপটুকু বড় ভাল লাগছে তার। বাইরে লুটেরা বাতাসের দাপাদাপি। শীত করছে।
চোখ জ্বালা করে জল আসছে। বুকে ধুকুরপুকুর। গলায় খুশখুশ। জ্বর আসছে নাকি? ও বাবা, তা হলে মরেই যাবে সে। রোদে রোগা দুখানা হাত মেলে দিয়ে সে ফর্সা চামড়ার নীচে নীল শিরা উপশিরা দেখতে পাচ্ছিল। গায়ে জ্বরের গন্ধ। না, তার ভাল লাগছে না। সে চোখ বুজল, ঠিক তার জ্বর আসবে।
চোখ বুজে ভারী মন খারাপ লাগছিল তার। জ্বর এলে আবার তো পড়ে থাকা। কান্না পাচ্ছে যে!
দাঁতে ঠোঁট কামড়ে যখন এই অলক্ষুণে চিন্তা করছিল পান্না, তখনই ফের মনে হল, জ্বর কি খুব খারাপ? বেশ তো কয়েকটা দিন এক অদ্ভুত আলো-আঁধারের জগতে বাস করে এল সে। স্বপ্নের কত ফুলঝুরি ঝরে পড়ল চোখে। কত কিম্ভুত দৃশ্য দেখল। জ্বর এলে হয়তো সেই ডাক্তারটিও আসবে। তার নাম অনল বাগচী। কী অদ্ভুত নাম। ডাক্তারের মুখটা মনেও পড়ে না তার। কেমন দেখতে কে জানে! ক্যাপসুল-ট্যাবলেট গিলতে পারে না বলে তাকে বকেনি একটুও। আর ভাত খেতে বলেছিল। বেশ ডাক্তার। মণিরাম জ্যাঠার মতো নয়।
মণিরাম জ্যাঠা রুগি দেখতে আসতেন ঠিক ডাক্তারের মতো নয়। অনেকটা আত্মীয়ের মতো। বসে রাজ্যের গল্প ফেঁদে বলতেন। একসময়ে সত্যাগ্রহ করেছেন, জেল খেটেছেন, গান্ধীবাবার কাজ করেছেন–সেসব কথা, বাজারদর, গাঁয়ের পলিটিক্স, তাবিচকবচ, রান্নাবান্না, এমনকী ভূত-প্রেত নিয়েও কথা কইতেন, যার মধ্যে ডাক্তারির নামগন্ধও থাকত না। বেশ ভালই লাগত জ্যাঠাকে। কিন্তু ডাক্তারির রকমটা ছিল বড্ড সেকেলে। জ্বর হয়েছে তো কী? মণিরাম ডাক্তার কিছুতেই চট করে জ্বর কমানোর ওষুধ দেবেন না। তাঁর বক্তব্য, ওরে বাবা, জ্বর যখন শরীরের দখল নিয়েছে তখন তারও একটা মেয়াদ আছে। ঘাড়ধাক্কা দিয়ে তাকে বার করতে গেলে শরীরে তার দাঁত নখের দাগ থেকে যায়। হুড়োহুড়ি করার কিছু নেই। জ্বর ঠিক সময়মতো ছেড়ে যাবে। যাতে খুব জট না পাকায় ডাক্তারের কাজ হচ্ছে তাই দেখা।
মণিরাম দাস্ত বা বমিও চট করে বন্ধ করার পক্ষপাতী ছিলেন না। পেনিসিলিন পারতপক্ষে দিতেন না। এমনকী পান্নার বাবার যখন টাইফয়েড হয়েছিল তখনও টাইফয়েডের নির্দিষ্ট ওষুধ না দিয়ে বাহান্ন দিন ভুগিয়েছিলেন বাবাকে। আর বাবাও মণিরামের অন্ধ ভক্ত ছিলেন বলে অন্য ডাক্তার ডাকেননি। বার্লি গিলেছিলেন, রোগা হয়ে মুরগির ছানার মতো চেহারা হয়েছিল, এত দুর্বল যে হাঁটাচলা করতে দিন পনেরো সময় লেগেছিল।
এটা নিশ্চিত যে মণিরামের যুগ আর নেই। মণিরাম জ্যাঠার সঙ্গে অনল বাগচীর অনেক তফাত।
অনল বাগচী! কী অদ্ভুত নাম! নামটা গুনগুন করছে মনের মধ্যে। মানুষটার নয়, নামটারই প্রেমে পড়ে গেল নাকি সে? নাকের কাছে হাতটি ফেলে সে শ্বসের তাপ দেখছিল গরম নয় তো!
তার একটু গন্ধ-বায়ু আছে এ কথা ঠিক। যেখানে কেউ কোনও দুর্গন্ধ পায় না সেখানেও দুর্গন্ধ আবিষ্কার করার আশ্চর্য প্রতিভা আছে তার। গেলবার পিকনিকে যে নোকটা মাংস পরিবেশন করছিল তার জামায় আঁশটে গন্ধ পেয়ে ওয়াক তুলে মরে। মানুষের গায়ের গন্ধ, মুখের গন্ধ, হাসপাতালের গন্ধ, লোহার গন্ধ, বিড়ির গন্ধ, জামাকাপড়ে বাসি গন্ধকত গন্ধই যে সারাদিন তাকে তাড়া করে তার ঠিকঠিকানা নেই।
এ-বাড়ির রেওয়াজ হল, জ্বর হলে ব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজা বন্ধ। সর্ষের তেল আর নুন দিয়ে মাজতে হবে। মাকে কে যে এই নিয়ম শিখিয়েছে কে জানে বাবা! তেল নুন দিয়ে মাজলে দাঁত একটুও পরিষ্কার হয় না, বরং কাঁচা সর্ষের তেল আর নুনে দাঁত ঝিনঝিন করে। নিজের মুখ থেকে যেন বাসি গন্ধ পাচ্ছিল পান্না। আর গা থেকেও বোঁটকা গন্ধ। অপছন্দের গন্ধ সে একদম সইতে পারে না। সে শরীরে ট্যালকম পাউডার ছড়াল। মুখে লবঙ্গ ফেলে চিবোল খানিকক্ষণ। তবু খিতখিত করে তার। কিছু করার নেই বলে উঠে বাসি জামাকাপড় ছেড়ে কাঁচা শাড়ি পরল। চুল আঁচড়াল। কপালে একটা টিপ সেঁটে নিল। তারপর একখানা গল্পের বই নিয়ে বসল বিছানায়। বিরহের গল্প তার ভীষণ প্রিয়। বিরহের মতো জিনিস আছে! পড়লে চোখে জল আসবে, বুক ভার হয়ে উঠবে, মরে যেতে ইচ্ছে করবে–তবে না গল্প!
এই উপন্যাসটা তার বহুবার পড়া। বামুনের মেয়ে। পড়তে পড়তে উদাস হয়ে মাঝে মাঝে জানলা দিয়ে বাইরে চেয়ে থাকে পান্না। এত সব বিয়োগান্ত ঘটনা যে, এই সুন্দর ঝকঝকে সকালটা যেন আস্তে আস্তে বিবর্ণ পাঁশুটে হয়ে যেতে থাকে।
সরস্বতী গোবর কুড়াচ্ছে। ময়লা কাপড় পরনে, পিঙ্গল চুল, মুখশ্রীতে কোনও আনন্দ নেই। আজকাল দেখা হলে হাসে একটু, কথা বলতে লজ্জা পায়। সরস্বতী তার সঙ্গে পড়ত। কিন্তু মাথায় পড়া ঢুকত না বলে সিক্স থেকে ফেল করতে শুরু করে। তারপর অনেক পিছিয়ে পড়াই ছেড়ে দিল। একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল পান্নার। পৃথিবীতে যে কত ট্র্যাজেডি! সরস্বতীর সঙ্গে এখনও তার তুই তোকারির সম্পর্ক। তবু দুজনের যে কত তফাত!
সরস্বতীর দিকে তাকিয়ে থাকত অমলেন্দু। তাকিয়েই থাকত। শোনা যায় চোখের পলক অবধি পড়ত না। সরস্বতী স্কুলে যাচ্ছে, কদমতলায় ঠিক অমলেন্দু নিষ্ঠার সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে। দুটি চোখ পেতে। সরস্বতী টিফিনের সময় স্কুলের মাঠে খেলছে বা আলুকাবলি খাচ্ছে, উলটোদিকে ঠিক অমলেন্দু দাঁড়িয়ে আছে স্ট্যাচুর মতো।
না, কখনও কথাটথা বলতে এগিয়ে আসেনি, হাতে চিঠি গুঁজে দেয়নি বা হিন্দি প্রেমের গান গায়নি চেঁচিয়ে। শুধু তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই তেমন করেনি সে।
কিন্তু এতেই ভারী ভয় পেত সরস্বতী। অমলেন্দুকে দেখলেই সে সাদা হয়ে সিঁটিয়ে যেত।
দেখ, দেখ, ছেলেটা আজও দাঁড়িয়ে আছে।
বন্ধুরা বলত, দে না একদিন দু কথা শুনিয়ে।
ও বাবা, সে আমি পারব না, বড্ড ভয় করে।
আহা, ভয়টা কীসের? তুই না পারিস, আমরাই দিচ্ছি শুনিয়ে।
সরস্বতী ভয় খেয়ে বলত, তাতে যদি খেপে গিয়ে আরও কিছু করে?
কী করবে?
কী করবে তা ভেবে পেত না সরস্বতী। মেয়েদের বিরুদ্ধে পুরুষেরা কত কীই তো করতে পারে। অ্যাসিড বালব ছুঁড়ে মারল, কি কলঙ্ক রটাল বা গুণ্ডা লাগিয়ে টেনে নিয়ে গেল। মেয়েরা কি পারে পুরুষদের সঙ্গে?
বন্ধুরা শেষ অবধি একদিন কদমতলায় ঘিরে ধরল অমলেন্দুকে।
এই যে, আপনি রোজ এখানে দাঁড়িয়ে থাকেন কেন বলুন তো! কী মতলব?
অমলেন্দু ভয়ে লজ্জায় অধোবদন হয়ে, শরীর মুচড়ে সপ্রতিভ হয়ে বলল, এমনি দাঁড়িয়ে আছি। মতলব কিছু নেই।
মতলব নেই বললেই হল! সরস্বতী আপনার ভয়ে স্কুলে যেতে পারছে না। ফের যদি এরকম করেন তা হলে কিন্তু আমরা তোক ডাকব।
অমলেন্দু অপমানিত হয়ে চলে গেল।
প্রকাশ্যে আর সে দেখা দিত না বটে, কিন্তু ঘাপটি মারার সুযোগ তো কম নেই। এই ঘটনার পর সে পুরনো শিবমন্দিরের ভাঙা পাঁচিলের আড়াল থেকে একটা ফুটো দিয়ে সরস্বতীকে রোজ দেখত।
আর কেউ টের না পেলেও সরস্বতী ঠিকই টের পেত অমলেন্দুকে। প্রকাশ্যে একরকম ছিল। তাতে গা-ছমছম করত না। কিন্তু অমলেন্দু যখন আড়াল হল তখন উৎকণ্ঠা আর ভয় বেড়ে গেল সরস্বতীর।
বন্ধুরা এবারও অমলেন্দুকে ধরল। তাদের দেখে সে পালাতে যাচ্ছিল। স্কুলের সাহসী মেয়ে বনলতা দৌড়ে গিয়ে তাকে ল্যাঙ মেরে ফেলে দেয়।
অতগুলো মেয়ের মারমুখী ভাব দেখে অমলেন্দু ভয়ে কেঁদেই ফেলেছিল।
আমি তো কিছু দোষ করিনি!
দোষ করেননি মানে! আপনি রোজ গা ঢাকা দিয়ে সরস্বতীকে ফলো করেন। আপনার মতলব খারাপ।
বিশ্বাস করুন, আমার খারাপ মতলব ছিল না।
তবে ওরকম করেন কেন?
কী জানি! ওকে না দেখলে আমার ভীষণ মন খারাপ হয়।
বাঃ, বেশ তো কথা! দাঁড়ান, আপনার বাড়িতে বলে দেবো।
না না, বলবেন না। আমি আর আসব না।
অমলেন্দু ভয় পেয়ে কদিন সত্যিই আর সরস্বতীর যাতায়াতের পথে আসত না।
দেখতে সরস্বতী বরাবরই ভাল। সুন্দরী না হলেও মিষ্টি লাবণ্য আছে। ঢলঢলে গোলপানা মুখ, বড় টানা চোখ। কিন্তু ভারী ভিতু। কোনও ছেলের সঙ্গে প্রেম করার কথা ভাবতেই পারত না।
পান্না ওকে বলেছিল, ছেলেটা যখন ওরকম হ্যাংলামি করে তখন একটু-আধটু কথা বললেই তো পারিস। কথাটথা বললে আর ওরকম ছোঁকছোঁক করবে না।
কথা! ও বাবা, ভাবতেই বুক ধড়াস ধড়াস করে। আমি পারব না।
তোর বুক ধড়াস ধড়াস করে কেন? তুই তো আর ওর প্রেমে পড়িসনি।
প্রেম! দুর, কী যে বলিস! বুক ধড়াস ধড়াস করে ভয়ে।
অমলেন্দুরা গাঁয়ের পুরনো লোক হলেও ওরা থাকত বাইরে বাইরে। ওর বাবা শান্তনু ঘোষাল মধ্যপ্রদেশে কলিয়ারিতে চাকরি করতেন। রিটায়ার করে গাঁয়ের পৈতৃক বাড়িতে এসে থিতু হয়েছেন। কাজেই অমলেন্দুর তেমন বন্ধুবান্ধব, দল বা ক্লাব নেই যারা তার পেছনে দাঁড়াবে,শ্যামলা রোগা লাজুক ছেলেটিকে খারাপ বলেও মনে হত না পান্নার।
শান্তনু ঘোষালও নিরীহ সজ্জন মানুষ। রিটায়ার করার পর গাঁয়ে ফিরে সকলের সঙ্গে আলাপ সালাপ করে পুরনো সম্পর্ক ঝালিয়ে নিতেন। পান্নাদের বাড়িতেও এসেছেন কয়েকবার। তাঁর মেয়ে বড়, ছেলে ছোট। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে অমলেন্দু অঙ্কে অনার্স নিয়ে বি এসসি পাশ করে বসে আছে। কলিয়ারিতে তার একটা চাকরি হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু শান্তনু ঘোষাল ছেলেকে মধ্যপ্রদেশে একা ফেলে রাখতে চান না।
পান্না একদিন সরস্বতীকে বলল, হ্যাঁ রে সরস্বতী, অমলেন্দু তত খারাপ ছেলে নয়। তুই ওকে অপছন্দ করিস কেন?
ও এরকম কেন? গাঁয়ে আর মেয়ে নেই?
ওর যে তোকে পছন্দ!
না না বাবা, ওসব আমার ভাল লাগে না।
অমলেন্দু এরপর যেটা করেছিল সেটা একটু বাড়াবাড়ি। স্কুলের পথে দিনের বেলা সরস্বতীকে দেখার যে অসুবিধে আছে সেইটে বুঝতে পেরে সে এরপর রাতের দিকে সরস্বতীর বাড়ির আনাচে কানাচে ঘোরা শুরু করে। সুবিধে হল, সরস্বতীদের বাড়ি একতলা। চারদিকে বাগান আর গাছগাছালি আছে। পাগল প্রেমিক সেইসব গাছপালার মধ্যে সাপ-খোপ উপেক্ষা করে ঘাপটি মারতে পাগল।
একদিন পড়ার ঘরের জানালা দিয়ে সন্ধেবেলা সরস্বতী লক্ষ করল, জানালার বাইরে পাতিলেবুর গাছটায় হঠাৎ সরসর শব্দ হল।
কে? কে ওখানে? বলে আর্তনাদ করে উঠতেই কে যেন দুড়দাড় দৌড়ে পালায়। লোকটা যে অমলেন্দু তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না সরস্বতীর। বাড়ির লোককে সে ভয় পেয়ে সব বলে দেয়।
বোকা ছেলেটা ধরা পড়ল পরদিনই। বাড়ির লোক ওত পেতে ছিল। লেবু গাছের আড়ালে ছায়ামূর্তির আবির্ভাব হতেই টর্চ জ্বলল, লাঠিসোঁটা বেরিয়ে এল।
তারপর কী মার! মাথা ফেটে রক্ত পড়ল, ঠোঁট ফুলে গেল, কোমরে চোট হল। উঠোনে দাঁড়িয়ে এই রঙ্গের দৃশ্যটা লোক দেখল। অমলেন্দু মাটিতে পড়ে থর থর করে কাঁপছে। চোখে পশুর মতো বোবা দৃষ্টি।
সেই দৃশ্য দেখতে শান্তনু ঘোষালকে টেনে আনা হল। ভদ্রলোক ছেলের দশা দেখে কেঁপেকেঁপে অস্থির।
অমলেন্দুর বিরুদ্ধে যে সব নালিশ করা হল তার কোনও জবাব দেওয়ার মতো অবস্থায় ছিলেন না শান্তনু ঘোষাল। তিনি শুধু হাতজোড় করে সকলের কাছে ক্ষমা চাইতে লাগলেন। অমলেন্দুর মুখ থেকে কোনও কথাই বেরোয়নি।
ঘটনার দিন দুই বাদেই ছেলেকে নিয়ে শান্তনু ঘোষাল মধ্যপ্রদেশে চলে গেলেন। ফিরলেন প্রায় মাসখানেক পর। নিজের ছেড়ে আসা কলিয়ারিতে ধরে করে অমলেন্দুকে চাকরিতে ঢুকিয়ে দিয়ে এসেছেন তিনি। ছেলে মুখে চুনকালি মাখিয়েছে বলে গাঁয়েও আর থাকলেন না ভদ্রলোক। শ্বশুরবাড়ি শ্রীরামপুরে বাড়ি কিনে চলে গেলেন।
অমলেন্দু যেদিন মার খায় তার পরদিনও স্কুলে সরস্বতীর সঙ্গে দেখা হল পান্নার। সরস্বতীর মুখচোখ ফুলে আছে কান্নায়। পান্নাকে বলল, জানিস পান্না, আমি কিন্তু সবাইকে বলেছিলাম ওকে মারধর না করতে।
তবে মারল কেন?
বাড়ির লোক সবাই খুব রেগে গিয়েছিল, কেউ কথা শুনল না।
পান্না খুব দুঃখের সঙ্গে বলল, ভালবাসা জিনিসটা খুব সেনসিটিভ, দু-চারটে ধমক বা অপমান করলেই যথেষ্ট হত। কেন যে তোর বাড়ির লোকেরা বাড়াবাড়ি করল!
আমার বুকের ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে।
এখন আর কী করবি! যা হওয়ার হয়ে গেছে।
সরস্বতীর চোখ ফের ছলছল করে উঠল। বলল, আমি ওকে ভয় পেতাম ঠিকই, কিন্তু দেখলাম ও কিছু খারাপ মানুষ তো নয়।
কী করে বুঝলি?
চুপচাপ মার খেয়ে গেল। প্রতিবাদ করেনি।
এখন কি তোর একটু অনুশোচনা হচ্ছে?
ভীষণ। সবসময়ে মনটা খারাপ লাগছে আর কান্না পাচ্ছে।
ক্ষমা চাইবি ওর কাছে?
ইচ্ছে তো করে। কিন্তু ওরা নিশ্চয়ই এখন আমাকে ভাল চোখে দেখবে না।
তা ঠিক। তাহলে?
তুই একটা কাজ করবি পান্না? আমার হয়ে ওর কাছে যাবি?
গিয়ে?
বলিস আমি ঠিক এরকমটা চাইনি। আমি অত নিষ্ঠুর মেয়ে নই।
বলে কী হবে?
অন্তত জানুক যে, সব দোষ আমার নয়।
তোরই দোষ সরস্বতী। তুই অত ভয় পেতে গেলি কেন? আর কেনই বা বাড়িতে নালিশ করলি? আড়াল থেকে তোকে দেখত। ভাল লাগে বলেই দেখত। সেটা কি খুব বড় অপরাধ?
আর বলিস না। আমার ফের কান্না পাচ্ছে।
পরদিন স্কুলে এসে গোপনে একটা মুখ আঁটা খাম পান্নার হাতে দিয়ে সরস্বতী বলল, তুই এ চিঠিটা ওকে দিস।
কী লিখেছিস চিঠিতে?
যা লেখার লিখেছি।
আমাকে খুলে বল।
লিখেছি আমি ক্ষমা চাই।
আর কিছু?
সরস্বতী মৃদু লাজুক হাসি হেসে বলল, লিখেছি ও যা চায় তাই হবে।
অমলেন্দু কী চায় তা জানিস?
জানব না কেন? আমাকে চায়।
সে তো ঠিক। কিন্তু এখনও চায় কি? এত মারধর অপমানের পরও?
খুব দৃঢ় গলায় সরস্বতী বলেছিল, এখনও চায়।
কী করে বুঝলি?
আমার মন বলছে।
ঠিক আছে, ও যদি তোকে বিয়ে করতে চায়, করবি?
হ্যাঁ। চিঠিতে সে কথাই তো লিখেছি।
তুই তো একদম পালটি খেয়ে গেছিস দেখছি।
হ্যাঁ। ওর জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।
কিন্তু মনে রাখিস, ওরা বামুন, আর তোরা কায়েত।
তাতে কী?
বিয়ে করতে চাইলে দু পক্ষেরই আপত্তি হবে।
আমি মাকে রাজি করাব। আর আমার বাবা তো নাস্তিক।
চিঠিটা নিয়ে পান্না সত্যিই গিয়েছিল। ছেলেটার সঙ্গে একান্তে একটু কথা বলারও ইচ্ছে ছিল তার। এরকম লাগামছাড়া প্রেম সে বড় একটা দেখেনি।
গিয়ে দেখে সামনের ঘরে সুটকেস বিছানা বাঁধা ছাঁদা হচ্ছে সন্ধেবেলা। শান্তনু ঘোষাল তাকে দেখে বললেন, লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছি না মা। আমার দুর্ভাগ্য। কী যে সব হল?
পান্না বলল, তেমন কিছু তো হয়নি। ওরা বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে।
না মা, ওরা ঠিক কাজই করেছে। উপযুক্ত হয়েছে।
শান্তনু ঘোষাল বলতে বলতে কেঁদেই ফেললেন। অপমানটা বড্ড লেগেছিল ভদ্রলোকের।
অমলেন্দু পাশের ঘরেই শুয়ে ছিল। কপালে, গালে স্টিকার, মাথায় ব্যান্ডেজ। ঘরে ওর মা আর এক পিসি ছিলেন। তাই একান্তে কথা বলার সুযোগ হল না। তাকে দেখে অমলেন্দু এমন লজ্জা আর সংকোচ বোধ করতে লাগল যে, চোখ তুলে তাকাতেই পারল না।
পান্না বলল, ওরকম লজ্জা পাওয়ার মতো কিছু হয়নি আপনার। যারা এ কাজ করেছে তারাও অনুতপ্ত। হয়তো ক্ষমা চাইতে আসবে।
অমলেন্দু মুখ ঢাকা দিয়েছিল দু হাতে।
ওর মা বলল, প্