মুক্তি দৌলতদিয়া যাওয়ার আগে সেখানকার অ্যাপ্রন পরা নারীকর্মীর শরণাপন্ন হয়। তারা পতিতাপল্লিতে বয়স্ক ও শিশু শিক্ষার প্রজেক্ট চালায়, কনডম ব্যবহারের গুণাগুণ ব্যাখ্যা করে আর ভবিষ্যহীন মেয়েগুলোকে সঞ্চয় করার উৎসাহ দেয়। তাদের একজনের মাধ্যমে মুক্তির প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে একাত্তরের বীরাঙ্গনা রাধারানীর সঙ্গে।
দৌলতদিয়ার অলিগলিতে তাদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলে রাধারানী। মুখ ভোলা দূরে থাক, ধরাই দেয় না। একবার একটা চিপাগলিতে উভয় পক্ষ মুখোমুখি। রাধারানী বলে, ‘আমি একাত্তরের বীরাঙ্গনা, শিক্ষিত, তায় বেশ্যা–এগুলি আমার পাপ, মহাপাপ। তোমরা আমারে বিরক্ত করবা না। পথ ছাইড়া খাড়াও।’ গলি থেকে বাইন মাছের মতো শরীর মুচড়িয়ে সে বেরিয়ে যায়। অ্যাপ্রন পরা এনজিওকর্মী জল-কাদা ডিঙাতে ডিঙাতে বলে, ‘এরা সত্য কথা বলে না কেউ। সাবধানে পা ফালান। নইলে আছাড় খাইবেন কিন্তু।’ উল্টোদিকের ঘরের দাওয়ায়, পরনের পেটিকোট বুকের ওপর গিঁট দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে আছে এক বেশ্যা। সে মুচকি হাসে, ‘ভাড়াইট্টা টেনেসফার করায় রাধারানী। তোমরা কি হেরে টেকা দিবা, মাল খাওনের টেকা?’
বেশ্যার স্মার্ট চেহারার দিকে মুক্তি তাকিয়ে থাকে। অ্যাপ্রন পরা এনজিও কর্মী হাসে পাশ থেকে, ‘বুঝলেন না, এইডাই এখন রাধারানীর ব্যবসা। এ দিয়া হে মদের পয়সা তোলে। আপনে কাদায় পা ফালাইয়েন না কিন্তু। পিছলায় যাবেন।’
কাদা থেকে সরে এসে মুক্তিরা একটা শুকনো উঁচু জায়গায় দাঁড়ায়। এটা রেলস্টেশনের মুখোমুখি পতিতাপল্লি ঢোকার মূল গেট। পনেরো-বিশ জন মেয়ে পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। খদ্দেররা ঢুকছে-বেরোচ্ছে। পতিতা আর খদ্দেরে যে কথা কাটাকাটি আর হাতাহাতি চলছে, দাঁত বের করে তা-ই দেখছে রাস্তার লোকজন। ক্যাসেট প্লেয়ারে উচ্চগ্রামে বাজছে মাইজভান্ডারির গান-দেখে যারে মাইজভান্ডারি, দেখে যারে মাইজভান্ডারি, হইতেছে রঙের খেলা, নূরে মাওলা বসাইছে প্রেমের মেলা, খাজা বাবা বসাইছে প্রেমের মেলা। এনজিও কর্মীর অ্যাপ্রনের হাতাটা চেপে ধরে মুক্তি শুধায়, ‘রাধারানীর কেইসটা কী–খুলে বলেন তো!’ ঠিক তখনই গলির মুখে উদয় হয় রাধারানী। ‘এ দি ভূতের লাহান, পাছ ছাড়ে না!’ বলেই কাদার ওপর দিয়ে পিছলে বেরিয়ে যায়।
‘হলো তো?’
এনজিও কর্মী তো অবাক, ‘কী অইলো?’ সঙ্গে সঙ্গে মুক্তির জবাব ‘অপমান করে বেরিয়ে গেল!’
মুক্তির রাগ দেখে এনজিও মাঠকর্মী হেসে কুটি কুটি, ‘এত সোজা অদের ধরা! অ মাগো, মদ খাইয়্যা হে যহন গালিগালাজ শুরু করবে, তহন বুঝবেন কত ধানে কত চাউল। আপনে আবার আছাড় খাইয়্যা প্যাকে পইড়েন না য্যান।’
বর্ষাকাল। বলা নেই কওয়া নেই আচমকা ঝমঝম বৃষ্টি। মুক্তিরা যার চালাঘরে দৌড়ে ঢোকে, সে নাকি রাধারানীর বোন। বলে, পাতানো বোন। নাম কুসুমকলি। রাধারানীর কাহিনি বলার জন্য কুসুমকলি প্রকৃতপক্ষে মুখিয়ে ছিল। ‘আমার বইনের মতো বেরেইন দুলুদিয়ায় কারো নাই, এমন শিক্ষিত-কথায় কথায় খালি ইংরাজি কয়!’ কুসুমকলির আফসোস, ‘মদ খায় বিধায় ঘরের ছেলেরা তারে ছাইড়া চইল্যা গেছে। এককালে ওর অনেক নামডাক ছিল। ও একটা বাড়িঅলি ছিল। টাকা কামাইছে হিউজ। মদ খাইয়্যা সব উড়াই দিছে। ভাড়াইট্টা টেনেসফার করে রাধারানীর এখন দিন চলে।’
‘ভাড়াইট্টা ট্রান্সফারের ব্যাপারটা কী?’
‘যেমন ধরেন, কারো টাকার সমস্যা থাকলে বাড়িঅলি উঠায় দেয়। হয়তো এরা লোক পায় কম। হয়তো সাজগোজের জিনিস কিনতে পারে না। বাড়িভাড়া দেয় না সময়মতন। তহন একটা গন্ডগোল বাধল…’ কুসুমকলির কথার মাঝখানে তার পালক মেয়ে আনারকলি ফোড়ন কাটে, ‘রাধারানী তখন হুগুনির লাহান হামলাই পড়ল।’
কুসুমকলি মনে মনে রাগ করলেও মেয়েকে কিছু বলে না। কারণ সে তার কামাই খায়। এখন ঠাকঠমক যা, সব পালক মেয়ের পয়সায়। মেয়েটা ব্যবসায় নেমেছে নতুন। উঠতি বয়স। পদ্মপাতায় মতো টলটলে মুখ। গলির মুখে না দাঁড়ালেও খদ্দের জোটে। তাই দেমাক বড়। বিগত যৌবনাদের প্রতি মায়াদয়া নেই। তার ঘরের চালের। নায়ক-নায়িকার পোস্টারগুলো কুসুমকলি মই বেয়ে উঠে, নিজহাতে সেঁটে দিয়েছে। তার দুঃখ, আনারকলির পছন্দ নয় রাধারানীকে। মুখের ওপর বলে কিলিকবাজ।
‘রাধারানী আসলে,’ কুসুমকলি ধীরে ধীরে কথা ভাঙে, ‘সারা পাড়া ঘুরে ঘুরে এক বাড়ির ভাড়াইটা পটাইয়ে পটাইয়ে আরেক বাড়ি দিয়ে আসে। তাতে পাঁচ শ টাকা পায়। ব্যস্–মদ-ভাঙ খাইয়া পাঁচ শ টাকাই এক দিনে শ্যাষ।’
রাধারানীর সাত বছরের মেয়েটা এই জন সেই জনের দয়ায় বেঁচে আছে। কুসুমকলি পালক নিতে চাইলে রাধারানী বলে, ‘এরে আমি লেখাপড়া শিখাব। রান্ডি হতে দেব না।’
যে রাতদিন মদ-গাঁজার ওপর থাকে, মেয়ের দেখাশোনা করার সময় পায় না, সে শেখাবে মেয়েকে লেখাপড়া?
‘তুই এত মদ খাস ক্যান’–আমি জিগাইছি, কুসুমকলি বলে তয় ও কয়। আমি মদ খাব না, আমার জীবনে তো কিছু নাই, রাধারানী যখন ছোট ছিল, তারে মেলেটারি উঠায় নিয়া যায়। ক্যাম্পে রাখে কয় মাস, তারপর ছাইড়ে দেয়।
: কী মদ খায় রাধারানী?
: সোনাগাছি থাকতে খাইত শুনছি ডবল টাইগার, রাম, জিন। দুলুদিয়া ঘাটে আইসা তো বাংলা মদই খাইতাছে।