দেড়শ-দু’শ বছরের পুরোনো টানবাজার পতিতালয়। শীতলক্ষ্যা পাড়ের প্রাচীন বন্দরনগরী নারায়ণগঞ্জে। বিদেশি নাবিক-বণিকদের মনোরঞ্জনের জন্য অতীতের কোনো এক সময় তা গড়ে ওঠে। আজ যদিও শীতলক্ষ্যার বুকে বিদেশি জাহাজ নোঙর ফেলে না, পাট আর সুতোর জমজমাট ব্যবসাও নেই, তবু পতিতাপল্লিটিতে হু হু করে বন্যার পানির মতো মেয়ে বাড়ছে। বর্তমানে তারা প্রায় তিন হাজার। মালিক ও খদ্দের এখন তাদের ভিন্ন। সমাজকর্মী যখন মুক্তিকে টানবাজারে যেতে বলেন, তখন পতিতাপল্লি উচ্ছেদের পাঁয়তারা চলছে। প্রতিদিন কাগজে কোনো-না-কোনো খবর থাকছেই টানবাজার নিয়ে। কয়েকজন সাংবাদিক বন্ধুর সঙ্গে মুক্তিও একদিন যায়। ওখানে। ঢোকার মুখে হংস থিয়েটারের পুরোনো সুন্দর বাড়িটার দিকে তাকাবে কি, মেয়েদের দেখেই তো চক্ষু স্থির। গলির দু’দিকে শাটার-ফেলা দোকানের রোয়াকে বা সিঁড়িতে দিনদুপুরে খদ্দের ধরার জন্য দাঁড়িয়ে করছে। তাদের সাজসজ্জা, ঠাকঠমক, দাঁড়ানোর অতি প্রাচীন ভঙ্গিমা, জীবনে প্রথম দেখলেও বোঝা যায়–এরা কারা। অথচ এই গলিপথেই সিগারেট বিক্রেতা, বাড়িঅলার এজেন্ট, ইনফরমার, সাংবাদিক, প্রেমিক, খদ্দের যারা আছে, জনে জনে পরিচয় না দিলে তাদের চেনা মুশকিল। প্রাপ্তবয়স্কদের পায়ে পায়ে ছোট ছোট বাচ্চারা ঘুরছে, হামা দিচ্ছে। গলির এপাশ ওপাশ করতে গেলে তাদের ডিঙিয়ে যেতে হয়। এদিকে বোঝার ওপর শাকের আঁটির মতো খানে খানে ইউনিফরমধারী পুলিশ। মুক্তির মনে হয়, স্মৃতিভঙ্গুর এক বৃদ্ধার কথায় এমন জায়গায় একাত্তরের বীরাঙ্গনা খুঁজতে না-এলেই ভালো করত। মুখ ফুটে সহযাত্রীদের বলতেও পারছে না। কিছুটা ধাতস্থ হতে দেখে, তারা একদল মারমুখী মেয়ের বেষ্টনীর মধ্যে। সাংবাদিকরা তাদের দাবিদাওয়া জানতে চাচ্ছে। সাধারণ সব প্রশ্নের তুখোড় সব জবাব আসছে মেয়েগুলোর কাছ থেকে। কেউ কেউ প্রশ্নের তোয়াক্কাও করছে না। আমরা কি রোডে গিয়ে পুরুষগো ডাকতাম, আমরা কি আপনার স্বামীরে ডাইক্যা নিতাম বসতিতে যে আমাদের উচ্ছেদ করবার নাগছেন? মুক্তি এর জবাব না দিয়ে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। যদিও তার বিয়ে হয়নি, স্বামীও নেই। তারপর যে পুরুষ সাংবাদিকটির পেছনে সে আশ্রয় নেয়, মেয়েটি তার উদ্দেশে বলে, ‘তোমরা বউ থুইয়্যা আসো বা বউ ছাইড়া দেও, আমরা কইলাম হেইডাও কিনো দিন কই নাই। তোমরা টাকা দিছো, এনজয় কইরা চইল্যা গেছে। খেইল খতম, পয়সা হজম।’
উচ্ছেদবিরোধী আন্দোলনে যে মেয়েরা নেতৃত্ব দিচ্ছে তাদের মুখে রং নেই, সাজসজ্জার বালাই নেই। দু’দিন আগে রাজধানীতে গিয়ে বক্তৃতা-স্লোগান দিয়ে সবার গলা ভাঙা। আজ যাদের বয়স পঞ্চাশ, মুক্তি হিসেব করে একাত্তরে তারা ছিল ২১/২২ বছরের তরুণী। সেই বয়সের একজন ভাঙা গলায় বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ নকল করে, ‘আমরা তোমাদের ভাতে মারব, পানিতে মারব।’ শেখের পার্টির লোকেরা এখন ক্ষমতায়। তারা টানবাজারে পানির সাপ্লাই বন্ধ করে, বিদ্যুতের লাইন কেটে, খদ্দের আসার পথে নানা প্রকার বাধা সৃষ্টি করে বেশ্যাদের ভাতে মারছে, পানিতে মারছে। ‘আমার কী লাভ হইল,’ একজন বিহারি মহিলা বলে। ‘আমি তো বিহারি আছিলাম, বাঙালি অইছি, আমারেও তো শেখের বাহিনী উচ্ছেদ করে দিতাছে।’ বিহারি মহিলার নাম নাসিমবানু। বাঙালি পুরুষদের গ্যাংরেপের শিকার হয়ে বাহাত্তর সালে টানবাজারে আসে। মা-বাবা-ভাই-বোনের খোঁজ নেই। বেঁচে আছে না মারা গেছে, জানে না।
শুরুতেই গন্ডগোল। মুক্তি দেখে, ইতিহাসের এক অন্ধকার গলিতে সে ঢুকে পড়েছে। বাঙালি মেয়ে খুঁজতে এসে পেয়ে গেছে বিহারি নারী। নিজে সে বীরাঙ্গনার পুনর্বাসনকেন্দ্রে না গিয়ে, চলে এসেছে পতিতাপল্লিতে। মাঝখানে অনেকগুলো বছর। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর পুনর্বাসনকেন্দ্র উচ্ছেদ করা হয়েছিল। এখন পতিতাপল্লি উচ্ছেদ করতে চাচ্ছে তার দলের লোক, যেখানে সমাজকর্মীর ভাষ্যমতে– পুনর্বাসনকেন্দ্রের মেয়েরাও আছে। থাকলে তারা কোথায়? উচ্ছেদের ডামাডোলে হাজার হাজার মেয়ের অতীত পরিচয় উদ্ঘাটন সহজ কাজ নয়। জিগ্যেস করলে জবাব আসে, ‘আমার মা খানকি আছিল, আমিও খানকি।’ অতীত নিয়ে মাথাব্যথা নেই, ভবিষ্যতের চিন্তা সবার।
মুক্তি ফিরে এসে রিপোর্ট করে। সব শুনে সমাজকর্মী বলেন, ‘আমি কালের সাক্ষী বৃদ্ধ বটগাছ। আমার কাছে অসহ্য লাগে এগুলি।’ তবে তিনি তাকে ওইসব জায়গায় খোঁজখবর চালিয়ে যেতে বললেন। মুক্তির আর ওখানে যাওয়া হয়নি। টানবাজার উচ্ছেদ হয়ে গেছে। মেয়েদের ধরে-বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়েছে কাশিমপুর, পুবাইল ভবঘুরে আশ্রয়কেন্দ্রে। যদিও বঙ্গীয় ভবঘুরে আইন, ১৯৪৩ অনুযায়ী টানবাজারের মেয়েদের পেশা ভিক্ষাবৃত্তি ছিল না, অথবা রাস্তা বা জনপদে এমন কোনো ভঙ্গিমায় তারা দাঁড়িয়ে থাকেনি, যা দেখে মনে হতে পারে, তারা খয়রাত চাচ্ছে।
কাছাকাছির মধ্যে বাকি থাকে দৌলতদিয়া। পদ্মাপাড়ের পতিতাপল্লি। মুক্তি এবার সমাজকর্মীর নির্দেশমতো না-এগিয়ে নিজেই পথ ঠিক করে। কারণ তিনি বটগাছ হতে পারেন, কালের সাক্ষীও বটে, তবে এনজিওর কর্মকাণ্ড যে অরণ্যের দাবানলের মতো পতিতাপল্লি পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে, আর আড়কাঠি, দালাল, খদ্দের ছাড়াও সেখানে যে। বাইরের মেয়েরাও যাতায়াত করে, যদিও অ্যাপ্রন পরে, নিজেরা যে বেশ্যা না, তা বোঝানোর জন্য, এসব কথা বোধ হয় শোনেননি। শুনলেও মনে নেই। তার শুধু এক কথা, ‘তুমি কান্দুপট্টি যেতে পারো।’ কান্দুপট্টি উঠে গেছে দুই বছর আগে। ‘তাহলে তুমি টানবাজারে যাও।’ টানবাজারের মেয়েরা এখন ভবঘুরে আশ্রয়কেন্দ্রে। প্রতি জুম্মার দিনে মিলাদ-মহফিল হয় টানবাজারে। ‘আশ্চর্য, ঢাকা শহরে বসে থাকলে কাজ হবে তোমার! তুমি দৌলতদিয়া যাচ্ছ না কেন?’