পুতুল তোমার জনম কী রূপ যে জানে।
আলোকলতায় বাইন্ধা সুতায় সে টানে।
[সেলীম আল দীন]
গত পাঁচ বছরে পুতুলমাস্টারের প্রতিটা সুতোর টান মরিয়ম তীব্রভাবে অনুভব করেছে। বারবার সুতো ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেও নিস্তার পায়নি। এই যে সিঙ্গার সেলাই মেশিন, পুনর্বাসনকেন্দ্রের মেয়েদের হাত দিয়ে ঘোরে, তা এখনো মরিয়মের রুটিরুজির উপায়। মনোয়ারা বেগমের সোনার গয়না বিক্রি করে সেলাই মেশিন খরিদ করা, আবেদ সামির আর সুমনের ‘মা-মেয়ে টেইলারিং’ নামকরণ, জিগাতলা-রায়েরবাজার ট্যানারির মোড়ে পোস্টারিং–সবকিছু নেপথ্যে থেকে পুতুলমাস্টারের কারসাজি। এখন তার গুলিবিদ্ধ নিস্পন্দ শরীরটা যখন সিঁড়ির ওপর কাত হয়ে পড়ে রয়েছে, সেলাই মেশিনের গুনগুনানিও সেই সঙ্গে থেমে গেছে। মরিয়ম আজ পুতুলমাস্টারের হাত দুটি থেকে চিরদিনের মতো মুক্তি পেল। যদিও লোকটাকে জীবনে সে একবারই মাত্র দেখেছে। মরিয়ম তখন নিউ ইস্কাটন রোডের পুনর্বাসনকেন্দ্রে। বঙ্গবন্ধু পরিদর্শনে আসবেন, মেয়েদের তাই রিহার্সেল করানো হচ্ছে, ও আমার দরদি/ আগে জানলে তোর ভাঙা নৌকায় চড়তাম না। গোঁফের তলায় মুচকি হেসে এগিয়ে যান তিনি। গানটা থেমে গেল মাঝপথে। সারা দিনের মহড়া ভুলে মেয়েরা ততক্ষণে সুরহীন, ছত্রভঙ্গ। তিনি তাদের বিশৃঙ্খল চাকের ভেতর আটকে গেলেন। অদূরে দাঁড়িয়ে মরিয়ম শুধু দেখেছিল, মোটা কালো ফ্রেমের চশমা পরা একজন লম্বা মানুষ, যার বুকের বেশ নিচে, নাভির প্রায় কাছাকাছি একটি বিপন্ন মেয়ের ঊর্ধ্বমুখী মুখ। মেয়েটির চোখ দিয়ে। দরদরিয়ে পানি পড়ছে। তার ভবিষ্যৎ কী–সে জানে না। তিনি সবার উদ্দেশে হাত তুলে বললেন, ‘তোরা আমার মা। তোরা বীরাঙ্গনা।’
২৬. রাধারানী একপ্রকার ভালো আছে
‘বঙ্গবন্ধু চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে পুনর্বাসনকেন্দ্রগুলোও উঠে গেল,’ প্রবীণ এক সমাজকর্মী দুঃখ করে বলছিলেন মুক্তিকে। শুনেছি জিনিসপত্রও নাকি ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে রাস্তায়। পতিতালয় উচ্ছেদ করার মতো করে মেয়েদের তাড়িয়ে দেয়।
‘তারপর মেয়েরা কী করল, কোথায় গেল?’
‘সবকিছু থেকে অ্যালুফ তখন আমি। চারদিকে ধরপাকড় চলছে। কোন সময় জেলে ঢুকব, কোন সময় কীভাবে টর্চারড হব–এটাই চিন্তা করতাম সারাক্ষণ।
তারপর সমাজকর্মী বীরাঙ্গনাদের খোঁজার জন্য যে কয়েকটা জায়গার নাম মুক্তিকে বলেন, তার সব কটিই ব্রথেল, বেশ্যালয়। কিন্তু মুক্তি তো খুঁজছে বীরাঙ্গনাদের! ‘তাতে কী! বীরাঙ্গনা থেকে যারা বারাঙ্গনা হয়ে গেল, সমাজকর্মী বললেন, তারাই আজ তোমার কাছে মুখ খুলবে। এ দিয়ে একটা মেগা স্টোরি লিখতে পারবে তুমি।
‘কিন্তু একাত্তরের নির্যাতিতরা কি সত্যি সত্যি প্রস্টিটিউশনে চলে গেছে?’
‘যাবে না তো কী করবে? নো বডি কেয়ারস ফর বীরাঙ্গনাস। সমাজ তো দূরের কথা, কেউ ফিরেও তাকায়নি।’
তারপর মুক্তিকে তিনি অদৃশ্য বীরাঙ্গনাদের লম্বা এক ফিরিস্তি দেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যেসব মেয়ে বিদেশ চলে গেছে দালালদের খপ্পরে পড়ে, তারা চিরদিনের মতো হারিয়ে গেছে। তখন আত্মহত্যা করেছে কেউ কেউ। স্বেচ্ছায় বিদেশে পালিয়ে গিয়ে সেটেল্ড করেছে যারা, ওখানে নোবডি কেয়ারস ফর দ্যাট। তিনটা বিয়ে করলে যদি অসুবিধা না-হয়, এটা তো একটা অ্যাকসিডেন্ট। এ নিয়ে তারা মাথা ঘামায়নি। তবে সেটেল্ড লাইফে একাত্তরের নির্যাতিত মেয়েরা আমাদের দেশে যে একেবারে নেই, তা নয়। তারা এখন ফিফটি আপ বা সিক্সটি–গোপনে সংসার করছে। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তারা কি একাত্তরের কাহিনি বলে স্বামী বা পুত্রহারা হবে? সে অধিকার তোমার-আমার কারো নেই। তার পরও তুমি যদি কথা বলতে চাও–নিজে গিয়ে দেখতে পারো, কেউ রেসপনস করবে না।
একসময়ের পুনর্বাসনকেন্দ্রের বেতনভুক কর্মী বেবির হদিশ দিয়েছিলেন এই সমাজকর্মীই। নাম-ঠিকানা নিজের হাতে পোড়ানো সত্ত্বেও মরিয়মের ঠিকানাটা যুদ্ধের আটাশ বছর পরও তার মনে ছিল। বেবি তত দিনে মহিলা অধিদপ্তরের একজন বড় কর্মর্কতা। পুনর্বাসন বোর্ড মহিলা অধিদপ্তরে মার্জড করে গেলে বেবিও ওখানে স্থানান্তরিত হয়। তার পর থেকে ওখানেই আছে। বেবির সঙ্গে যোগাযোগ করার আগে মুক্তি পতিতাপল্লি যাওয়া মনস্থ করে। এ ব্যাপারে তাকে দিকনির্দেশনা দেন উক্ত সমাজকর্মী।
‘তুমি যেতে পারো বানিশান্তায়,’ তিনি বলেছিলেন। মংলা পোর্টের দক্ষিণ দিকে পশুর নদের পশ্চিম পাড়ে বানিশান্তা পতিতাপল্লি। আরো দক্ষিণে গেলে সুন্দরবন। সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চেয়ে মুক্তির ভয় বেশি ব্রথেলের দালাল আর সর্দারনিদের। পতিতাপল্লিতে একবার ঢুকলে সে যদি বেরোতে না পারে! সব মেয়েরই পায়ে পায়ে একটা বেশ্যালয় ঘোরে। তা ছাড়া এত দূরের পথ বানিশান্তা, একা। যাওয়ার তার সাহস হয়নি। ‘তারপর ধরো ইংলিশ রোড, এই ঢাকার মধ্যেই, পতিতাপল্লির নাম কান্দুপট্টি।’ কান্দুপট্টি উচ্ছেদ হয়ে গেছে দু’বছর আগে, ১৯৯৭ সালের মে মাসে। সেখানকার মেয়েরা এখন ঢাকার পথে-পার্কে-দরগায় খদ্দের বসায়। সমাজকর্মীর বয়স দুই হাজার সালে আশি হবে। কান্দুপট্টি উচ্ছেদের খবর শুনে থাকলেও তার মনে নেই। তিনি মুক্তিকে এরপর টানবাজার যেতে বলেন। টানবাজার ব্রথেলে ঢোকার মুখেই দেখবে হংস থিয়েটার-পুরোনো সুন্দর একটা বাড়ি। আনারকলি ছবিটা তিনি হংস থিয়েটারেই ষাটের দশকে দেখেছিলেন। মধুবালা ছিল আনারকলির রোলে, আর দিলীপকুমার হচ্ছেন গিয়ে শাহজাদা সেলিম। পরে যিনি চতুর্থ মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর হন।