সরফরাজের চলে যাওয়া দেখতে দেখতে মরিয়মের হঠাৎ মনে পড়ে, লোকটা মন্টুর সহযোদ্ধা, তার কাছ থেকে অনেক কথা শোনার ছিল। কীভাবে তার ভাই মারা গেল, মরার আগে কী বলে গেছে, মন্টুর শেষ ইচ্ছাই-বা কী ছিল, তার কবরটা পাকা। করা যায় কীভাবে–মরিয়ম খালি পায়ে খানিকটা পথ দৌড়ে যায়। অ্যাই-অ্যাই, শোনেন-শোনেন কয়েকবার ডেকে বুঝতে পারে, লোকটার নামও সে জানে না। ঠিকানা কি রেখেছে? রাস্তায় দাঁড়িয়ে খাতার পাতা উল্টেপাল্টে ঘটি হাতার ব্লাউজের ডিজাইনের নিচে লেখা কয়েকটা শব্দ সে উদ্ধার করে-গ্রাম মধ্যমতলা, পোস্টঅফিস চান্দেরহাট। অদূরে লেখা-মন্টুর শেষ যুদ্ধস্থল। পাশে আছে লোকটার নাম সরফরাজ হোসেন। ঠিকানা কোথাও নেই। গলির বাকে হারিয়ে গেছে সরফরাজ হোসেন। মন্টুর। খবর এর বেশি জানা গেল না। চার বছর পর এমন একটা সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেছে যার জন্য, সে তখনো মশারির নিচে নিদ্রা যাচ্ছে।
ঘরের ভেতর আবেদ সামিরের ঘুমানোর দৃশ্যটা উঠোন থেকেই মরিয়মের আজ উকট, খাপছাড়া লাগে। কার বুকভাঙা কষ্টের বিনিময়ে কে সুখের নিদ্রা যায়! ছেলেটা তো তার ভালোমন্দের অংশীদার নয়! চায়ের কেটলি চুলা থেকে নামাতে গিয়ে ন্যাকড়ায় আগুন ধরে গেলে মরিয়ম ভাবে, জ্বলন্ত ন্যাকড়াটা ছুঁড়ে দেবে নাকি মশারির ওপর! তাহলে একবারেই সবকিছুর ফয়সালা হয়ে যায়। কয়েক দিন পর চা খেতে খেতে আবেদ সামিরকে মশারিতে আগুন ধরানোর কথাটা বলে সে। শোনামাত্র ছেলেটা তো ভয়ে দিশেহারা। এ অবস্থায় সামনে দেখে একজন অপ্রকৃতিস্থ নারী, যে হাসতে হাসতে তাকে পুড়িয়েও মারতে পারে। কবি হওয়ার জন্য এই অভিজ্ঞতাটার তার দরকার নেই। অর্ধভুক্ত চায়ের কাপ রেখে আবেদ সামির সেই যে প্যান্ট পরে ঝোলা কাঁধে বেরিয়ে গেল, তার আর দেখা নেই।
ন্যাকড়ার আগুনে মশারি পোড়ানোর দৃশ্যটা সমস্ত দিন ধরে মরিয়মকে আমোদ দেয়। সে একা ফিকফিক করে হাসে। তাকে দেখলে যে-কেউ তখন ভাবতে পারত, সে একজন ষড়যন্ত্রকারী-অদ্য রজনী শেষ হওয়ার পূর্বে রাস্তায় যারা ট্যাংক নামাবে, দেশের রাষ্ট্রনায়ক সপরিবারে যাদের হাতে খুন হবেন, মরিয়ম তাদের একজন। পার্থক্য শুধু ঘটনাস্থলে সে সরাসরি উপস্থিত থাকবে না, তার হাতে আর্মির ওয়ারলেস নেই, গত এক সপ্তাহ সে ঘরের বাইরে একবারও যায়নি, সর্বোপরি এই ঘাতকদলে বীরাঙ্গনা দূরে থাক, কোনো নারীই ছিল না।
ভোরের দিকে গোলাগুলির শব্দে মরিয়মের ঘুম ভাঙে। শব্দটা মনে হয় পিলখানার বিডিআর ক্যাম্প থেকে আসছে। পরক্ষণে মনে হয় গোলাগুলি চলছে বিশ্ববিদ্যালয় পাড়ায়। এ যেন আরেকটা ২৫ মার্চ রাত। আচমকাই যেন সে সাড়ে চার বছর পেছনে চলে গেছে। সামনে শিরীষ অরণ্য। অদূরের ফুটপাতে প্রথম দিনের সেই মুচি, অপারেশন সার্চলাইটের আগুনে পুড়ে যে ছাই হয়ে গেছে। সময়ের এ পেছন-দৌড় মরিয়মের অসহ্য লাগে। সে বিছানা ছেড়ে সেলাইঘরে যায়, সুইচ টিপে বাতি জ্বালায়, মেশিন সামনে নিয়ে একমনে ধ্যানে বসে। এখন সে যে হাতলটা ঘোরাবে, সেটি তাকে বড়জোর পুনর্বাসনকেন্দ্র অব্দি দাবড়িয়ে নিয়ে যাবে, এর পেছনে, অর্থাৎ–যুদ্ধ পর্যন্ত। কিছুতেই নয়।
মরিয়ম তখনো সেলাইঘরে। একজন কাস্টমার এসে যখন ভোররাতের হত্যাযজ্ঞের খবর দেয়, তার চলন্ত সেলাই মেশিনটা আপনা হতে বন্ধ হয়ে যায়। ঘরে পিনপতন নীরবতা। মন্টু চলে যাওয়ার সময় সেই যে বগলে করে রেডিওটা নিয়ে গিয়েছিল, আর কেনা হয়নি। পাশের বাড়িতে এখন রেডিও বাজছে। মরিয়ম হামাগুড়ি দিয়ে তক্তপোশের গা-লাগা জানালাটা খুলে দেয়–’আমি মেজর ডালিম বলছি, স্বৈরাচারী শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।’
‘মেজর ডালিমটা কে?’ সংবাদদাতাকে বসতে না বলেই মরিয়ম প্রশ্নটা করে। কাস্টমার মেয়েটা হাসপাতালের একজন নার্স। নাইট ডিউটি সেরে ফেরার পথে ট্যাংক দেখে এসেছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যার খবরটা পথচারীর মুখ থেকেই তার শোনা। এর বেশি কিছু জানে না। মরিয়ম আপনমনে বলে, ‘মেজর যখন, আর্মিটার্মি কেউ হবে।’
‘সব্বোনাশ, আস্তে কন!’
‘কেন, কী হইছে?
‘ওরা সাঙ্ঘাতিক! শুনলে পরে ট্যাংক নিয়া চইল্যা আসবে।’ মেয়েটার ট্যাংক-বিভীষিকা এখনো যায় নাই। ঢাকা মেডিক্যাল থেকে নিউমার্কেট হয়ে এটুকু পথ, তার মধ্যে তিনটা ট্যাংক সে নাক উঁচিয়ে রাস্তায় ঘুরতে দেখেছে। একেকটার চেহারা কী! হাতির মতো লম্বা গুঁড়তোলা। ‘মেরি আপা, আবার দেইখ্যেন একটা যুদ্ধ লাগবে।’ যুদ্ধ লাগলে কে কোথায় চলে যায়, মানুষের নির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা থাকে না। এটি তাদের মাত্র সাড়ে চার বছর আগের অভিজ্ঞতা। মেয়েটি তাই দুদিন আগে বানাতে দেয়া ব্লাউজের কাপড় ফেরত নিতে এসেছে। মরিয়ম জানালা বন্ধ করে, কালো কাপড়ে মেশিনের শরীরটা আগাপাশতলা ঢেকে দেয়। দৃশ্যটা উদ্ভট। কিন্তু সংবাদদাতার এসব তাকিয়ে দেখার সময় নেই। তাকে না-বানানো ব্লাউজ নিয়ে এক্ষুনি বাড়ি ফিরতে হবে। কারণ শহরে আজ কারফিউ।
যে লোকটা গতরাতে সপরিবারে নিহত হয়েছে, তার সারা জীবনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে মরিয়ম যেন অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা। নিজেকে সে যদি ভাবতে পারত একটা কাপড়ের বা কাঠের পুতুল, সে ক্ষেত্রে লোকটা পুতুলমাস্টার।