‘ওহ্, এ তাইলে ভালোবাসা?’
‘ভালোবাসাই তো!’
‘খাবারের প্যাকেট আর তেল-সাবান-পাউডার?’
‘গিফট।’
গিফট হোক আর যা হোক অভাবের সংসারে এসবের দরকার আছে। মরিয়ম হতাশ হয়ে বলে, এসব কথা বাদ দেও এখন।
আবেদ সামির সঙ্গে সঙ্গে বাদ দিলেও মরিয়মই দেয় না। সুখ যদি তার কপালে–ই থাকে, নিজে সে অন্যের সুখের উপলক্ষ হবে কেন, সামান্য কয়েকটা জিনিসের বিনিময়ে? সে আসলে ধূপ না, চ্যালা কাঠ। আগুনে সশব্দে জ্বলে আর গলগলিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে। স্বল্প মূল্যে সুখ বিলানো এমন মেয়ের কাজ নয়। ধোঁয়ার ভেতর হেঁচে-কেশে যে যত দিন থাকতে পারবে–থাকবে, না হয় চলে যাবে। কেউ তো চিরদিন থাকার জন্য তার কাছে আসে না। নিজের মা-ই থাকল না, অন্যকে দোষ দিয়ে কী লাভ।
মাস খানেক হয় মনোয়ারা বেগম চলে গেছেন। যাওয়ার সময় মেয়েকে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত এগিয়ে দিতেও দেননি। মরিয়ম, আমি কি কচি খুকি যে তুই আমারে আউগাইয়া দিবি? বাসায় থাক, মা। কাস্টমার আইয়্যা ফিরা যাইব।’ মরিয়ম দাঁড়িয়ে থাকে কলতলার আধখান ইটের ওপর। ডান হাত কাপড় মেলার দড়িটা খামচে ধরা। বাঁ হাতে আঁচলের খুঁট তুলে চোখ মোছে সে। তখন মন্টুর মতো এলোমেলো ইটের ওপর পা ফেলে বাড়ি ছেড়ে চলে যান মা। মন্টুর সামনে ভয়াল যুদ্ধ ছিল। সে আর ফেরেনি। মা কি ফিরবেন?
রোজ সকালে বারান্দার বেঞ্চিতে বসে মরিয়ম ভাবে, মা তো ফিরে গিয়ে কোনো । চিঠিপত্র দিল না, সে বরং আজ লিখবে। তুমি আমারে মুক্তি দিয়ে গেছ মা। আমি ভালো আছি। তারপর কি আবেদ সামিরের কথা লিখবে চিঠিতে? ছেলেটা এখনো তার শয্যায়, আরাম করে ঘুমাচ্ছে। সে রাতে থেকে গেলে মরিয়মের খুব টেনশন হয়। নতুন কাপড় নিয়ে কোনো অধৈর্য কাস্টমার যদি সকালবেলায় বাসি মুখে চলে আসে, তাকে গেট দিয়ে কিছুতেই ঢুকতে দেওয়া যাবে না। দরকার পড়লে সেখানে দাঁড় করিয়ে গজফিতা দিয়ে মরিয়ম তার বডির মাপ নেবে। রসিদ কেটে বিদায় করে দেবে ওখান থেকেই। সেইমতো গলায় ফিতা পেঁচিয়ে, খাতাপত্র, চক-পেনসিল হাতে নিয়ে মরিয়ম অন্ধকার থাকতেই বারান্দার বেঞ্চিতে গিয়ে বসে। কাঠের বেঞ্চিটা আরামের না হলেও স্বস্তিদায়ক। মাকে চিঠি লেখা থেকে শুরু করে সারা জীবনের যাবতীয় অসমাপ্ত কাজ ওখানে বসেই মনে মনে শেষ করে সে। তাতে হয়তো তার পরিশ্রম হয়। গজফিতাটা ফাঁসির দড়ির মতো গলায় পেঁচিয়ে সেখানে সে ঘুমিয়ে পড়ে। তার কোলে খাতার পাতাগুলো ভোরের মৃদুমন্দ হাওয়ায় ক্যালেন্ডারের মতো উল্টে যায়।
সময় কত দ্রুত চলে যাচ্ছে। ভালো-মন্দ মিলিয়ে দেখতে দেখতে চারটা বছর চলে গেল। সরফরাজ বিয়ে করেছে। তার মেয়ের বয়স ছয় মাস পেরিয়ে দুদিন পর সাতে পড়বে। মন্টু যেখানে ছিল সেখানেই তার বয়স বাড়ে না। বিয়েশাদিরও ব্যাপার নেই। গতকাল ঢাকা এসে শরিফ ভাইয়ের সঙ্গে সরফরাজ দেখা করতে গিয়েছিল। মন্টুর কবর পাকা করার কথা তিনিই তুললেন। তারপর কথায় কথায় জানালেন যে, আগামী বিজয় দিবসে সহযোদ্ধারা যে যেখানেই থাকুক, ঢাকায় তাদের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান হবে। স্যুভেনিরের কাজটা এখন থেকে শুরু করা দরকার। তার জন্য মন্টুর একটা পাসপোর্ট সাইজের ছবি চাই। দায়িত্বটা পড়েছে সরফরাজের ওপর। যদিও বিজয় দিবসের আরো পাঁচ মাস বাকি, সে বাড়ি ফেরার পথে সকাল সকাল কফিলউদ্দিন আহমেদের বাসার সামনে দুরু দুরু বুকে মন্টুর ছবির জন্য হাজির হয়। গতবার সরফরাজ আশা করেছিল, মন্টুর মেরিবু দরজা খুলে দেবেন। তিনি তখন ছিলেন না। সস্ত্রীক কফিলউদ্দিন সাহেবকে ছেলের মৃত্যুসংবাদ জানাতে হয়েছিল। আজ মন্টুর বাবা-মাকে যখন সে আশা করছে, তখন গেট খুলে আলুথালু বেশে এক দজ্জাল প্রকৃতির মহিলা তার সামনে দাঁড়ায়।
মরিয়মের কাস্টমাররা সব মহিলা। পুরুষ হলেও দাড়ি-গোঁফ গজাতে কয়েক বছর বাকি এমন সব বালক, যারা ইজের সেলাই করাতে মায়ের হাত ধরে আসে। অথবা ফুলপ্যান্ট পরার শখ, বয়স হয়নি বলে বাবা-মা কিনে দিচ্ছে না, বাবার ওল্ড ফ্যাশনের খাকি প্যান্ট নিয়ে এসে বলে, কাইট্টা ছোড কইরা দেন, আর কোমর সরু করে ইলাস্টিক বসাইবেন। তারাও মায়ের সঙ্গেই আসে। একে তো মা ছাড়া, তার ওপর প্রাপ্তবয়স্ক একজন পুরুষ সকাল না হতেই দোরগড়ায়, মন্টুর নাম বারবার। উচ্চারণ করার পরও লোকটার কথা বুঝতে মরিয়মের সময় লাগে। যখন বোঝে, তখন তার মনে পড়ে, আবেদ সামির মশারির নিচে। লোকটাকে বাড়ির ভেতর নেওয়া যাবে না। এ অবস্থায় গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে মন্টুর ছবি যে ফুলতলি থেকে আনাতে মাস খানেক সময় লাগবে, কারণ জানেন তো, আমাদের আর কোনো ভাই নাই, আব্বার শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না এসব কথা ঘরের দিকে এক চোখ রেখে মরিয়ম গড়গড়িয়ে বলে যায়। সরফরাজ অবাক হয়ে কিছু শোনে কিছু শোনে না। তার সামনে দর্জির ডিজাইনের খাতাটা বাড়িয়ে দেওয়া হলে, সে তাতে কী ভেবে মন্টুর শেষ যুদ্ধক্ষেত্রের নাম লিখে দেয়, যেখানে শহিদ মুক্তিযোদ্ধা সাইফুদ্দিন আহমেদের কবর। কবরটা যে গেল বছরের বন্যায় ভেঙেচুরে ডেবে গেছে, এর সংস্কার দরকার-এ কথাটা এক নিঃশ্বাসে এলোমেলোভাবে বলে সে। কারণ সরফরাজের মনে হয়, তার কথাবার্তার প্রতি মহিলার বিশেষ মনোযোগ নেই। তারপর মাস খানেক পর তাকে আসতে বলা হলে, সে গেটের বাইরে থেকেই বিদায় নেয়। তাদের দুজনের কারোর তখন জানার কথা নয় যে, মন্টুর ছবিটার আর কোনোদিন দরকার হবে না। কারণ আর মাত্র দশ দিন পর ১৫ আগস্ট, সেদিনের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গে পরবর্তী বিজয় দিবসের স্যুভেনির প্রকাশ শরিফ ভাইয়ের হাতছাড়া হয়ে যাবে।