‘প্লিজ মা, আর দুইডা দিন থাকো।’ মরিয়ম মায়ের হাত ধরে। ঠান্ডা কম্পমান হাত–মা-মেয়ে দুজনেরই। মা হাত আলগা করে গুটিয়ে নেন। মেয়ে নাছোড়, ‘মা, আমি আব্বারে লিখি! হে আইস্যা তোমারে নিয়া যাবে!’
‘আমি কি কচি খুকি, মরিয়ম? তোর বাপেরে ছাড়া বাড়ি যাইতে পারি না? বাড়ি কি হের একলার? আমার হক নাই কোনো?’
এতগুলো প্রশ্ন একসঙ্গে! মরিয়ম বুঝতে পারে না, আর কীভাবে মিনতি করলে মা যাবেন না–থাকবেন। সে মায়ের ঠান্ডা হাত দুটি অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ায়। মুখে বারবার বলে, ‘আর দুইডা দিন থাকো না মাপ্লিজ, থাকো না মা…।’ মনোয়ারা বেগম এলোচুল টেনে হাতখোঁপা বাঁধেন। ‘বাধা দিস না মরিয়ম, মা কারো আজীবন থাহে না, তুই একলা হইছস নিজের কপাল দোষে, আল্লার দোহাই–আমারে যাইতে দে,’ কথাগুলো বলতে বলতে নিজের ঘরে চলে যান। কী নিষ্ঠুর, কী ঔদ্ধত্য! এমন মা যার, তার কপালে দুঃখ থাকবে না তো সুখ থাকবে? বাকি রাতটা মরিয়ম মেঘের আড়ালে চাঁদের লুকোচুরি দেখতে দেখতে পার করে। তারপর আরো এক পক্ষকাল চাঁদ সাক্ষী মেনে মেয়ে সওয়াল-জবাব করে মায়ের সঙ্গে, ‘মা কারো আজীবন থাকে না–মানি। কিন্তু আমার কপালের দোষ কে খণ্ডাবে, মা? আমি যে আর একা থাকতে পারছি না!’
২৫. ও আমার দরদি…
অমাবস্যার এক ঘুটঘুঁটে অন্ধকার রাতে আবেদ সামির দুয়ারে এসে দাঁড়ায়। তাদের কচ্ছপ গতির সম্পর্ক অতি দ্রুত রূপান্তরিত হয় খরগোশ-রেসে। নারী জানতে চায় না, পুরুষ এত দিন ডুব দিয়েছিল কোথায়–কী তার বৃত্তান্ত। তবু পুরুষটির মুখ থেকে সে স্বগতোক্তি শোনে–কাব্যের পথ বড় পিছল। তাতে বিস্তর সাধনা লাগে। ঘাটে, আঘাটে গমন সাধকের জন্য জরুরি। সামির প্রথম দু’রাত বিশ টাকার বিনিময়ে এক বেশ্যার শরীরের ভাঁজ খোলা শুধু দূরে বসে দেখেছে। তৃতীয় রাতে স্পর্শ অবশ্যম্ভাবী জেনে টাকা না দিয়ে পালিয়ে আসে। পেছনের বীভৎস গালাগাল দুদিন আগের ঘটনা হলেও, এখন তা মনে পড়াতে সে মরিয়মের পাশে বসে কানে হাত চাপা দেয়। তারপর হয়তো প্রশ্ন করা যেত, সে এখানে কেন? এ ঘাট, না আঘাট? কাব্যসাধনার বাহন এবার তাহলে মরিয়ম!
মরিয়ম অন্ধকারে চোখ রেখে শুধু শুনে যায়, প্রশ্ন করে না। অভিজ্ঞতা থেকে জানে, স্বামী-সন্তানের বাইরে অন্যরকম যে জীবন, যাতে মনোয়ারা বেগমেরও সায় আছে, সেখানে এসব প্রশ্ন করা বৃথা আর জবাবগুলো হয় প্রতারণায় ভরা। তাতে বিড়ম্বনা বাড়ে বৈ কমে না। সম্পর্কের শুরুর দিকে কাস্টমারের বেঞ্চিতে বসে সন্ধ্যায় সাহিত্যপাঠের যে সাজানো আসর, তা ছিল দুজন নরনারীর একসঙ্গে সময় কাটানোর অজুহাত। তাতে শরীরের দেনা-পাওনার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত ছিল। মা চলে যাওয়ার পর তারা বেঞ্চি ছেড়ে বিছানায় উঠে আসে। চার বছর দীর্ঘ সময়, নশ্বর শরীরের জন্য তো অবশ্যই। যুদ্ধের পর এই প্রথম মরিয়মের শরীর ও মন তৈরি হয়েছে। আপাতত মন বাদ দিয়ে শরীর শরীরের পাওনা শোধ করে।
আবেদ সামির অনভিজ্ঞ পুরুষ। তার আচরণ বেতাল, বেখাপ্পা হলেও মমতাজ বা পাকিস্তানি সৈন্যদের মতো মুখে ‘হুইস্কির গন্ধ নিয়ে সে আসে না। যে গন্ধটা পিস্তল ছাড়াই মরিয়মকে আগাম সারেন্ডার করতে বাধ্য করত। মমতাজ এ নিয়ে খুশি ছিল না। তার মতে, যে আগ বাড়িয়ে আত্মসমর্পণ করে, হাত ধরলেই যার শরীরের ভাঁজ খুলে যায়–সে বেশ্যা। মমতাজের পরিচিত বেশ্যাদের মতো আচরণ করায় অল্প ক’দিনেই মরিয়মের বিয়েটা ভেঙে যায়। এখন আবেদ সামির বিছানায় লম্বা হয়ে কাতর গলায় বলে, ‘মেরি আমারে শিখাও, আমি শিখতে চাই।’
যুদ্ধের চার বছর পর মরা মাছের চোখে দৃষ্টি ফিরে এসেছে। এ দৃষ্টি অন্তর্ভেদী। মরিয়ম দেখছে–ছেলেটি যৌনতার পাঠ নিতে চায় এমন এক নারীর কাছে, যে দিনের পর দিন ধর্ষিত হয়েছে। সে এজন্য একজন পেশাদার বেশ্যার কাছে যেতে পারত। গিয়েছিল। তবে জায়গাটা নোংরা, অস্বাস্থ্যকর। পুলিশ রেইডের ভয় আছে। বাজে রোগ-ব্যারামেও আক্রান্ত হতে পারে। তাই ওখানে না গিয়ে আবেদ সামির মরিয়মের বাসায় এসেছে। পকেটে ওই বিশ টাকা। যা দিয়ে বাসায় ঢোকার আগে কেনে। খাবারদাবার বা মরিয়মের জন্য সস্তা প্রসাধন। মা-মেয়ে টেইলারিংয়ের ব্যবসায় মন্দা যাচ্ছে। আবেদ সামির প্যাকেট খুলে যখন বলে, দুপুরে খাওয়ার সময় পাই নাই, আসো মেরি দুজনে মিলে খাই’ মরিয়ম তখন হাত ধুয়ে খেতে বসে যায়। তা ছাড়া সাবান, পাউডার, কেশতেল যে দেয় আর যে নেয়, সত্যটা তারা দুজনে প্রকাশ্যেই গোপন করে।
এসব নিয়ে মরিয়ম আজকাল ভাবে না। যা নিয়ে ভাবে, তার কূলকিনারা পায় না। স্বামী-সন্তানের বাইরের অন্যরকম জীবনটা একা মরিয়মের। আবেদ সামির এখানে শুধু লেফট-রাইট করছে। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সংসার পাতার সামর্থ্য হলেই সে পালাবে। এ সময়টা তখন হবে অতীত অভিজ্ঞতা–যা তার সাহিত্যের জন্য একান্ত জরুরি। কথা হলো, অভিজ্ঞতা অর্জন কত দিন ধরে চলবে। তা কি গলায় প্যাচানো গজফিতাটা দিয়ে মাপা সম্ভব? কিছু একটা করতে হয় বলে মরিয়ম একদিন তা করার চেষ্টা করে। তাতে আবেদ সামির রেগে আগুন, ‘তোমাদের মেয়েদের এ এক দোষ। ভালোবাসাকেও তোমরা ফিতা দিয়ে মাপতে চাও।