মায়ের মাথাটা একেবারে খারাপ হয়ে গেছে–মরিয়ম ভাবে। তা না হলে এমন উদ্ভট চিন্তা করেন কীভাবে। রাজা-প্রজা কখনো এক হয়? একদিন তার নিষেধ সত্ত্বেও মনোয়ারা বেগম বৃষ্টি মাথায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। যাচ্ছে যাক, পেছনে মরিয়ম গজগজ করে, দারোয়ানের গলাধাক্কা খেয়ে যখন ফিরে আসবে, তখন টের পাবে। এমনকি প্রেসিডেন্টের বডিগার্ডের হাতে বন্দি হওয়াও আশ্চর্যের কিছু নয়। সন্ধ্যায় আবেদ সামির মরিয়মের মুখে খুঁটিনাটি বৃত্তান্ত শোনার আগেই বলে, সে আজ বিকালে বাহাদুর শাহ পার্কে টিয়া পাখি দিয়ে ভাগ্য গণনা করাতে দেখেছে মনোয়ারা বেগমকে। লজ্জা পাবেন ভেবে, সামনে যায় নাই সে।
বাহাদুর শাহ পার্ক! সে তো বহুদূর। মা বাড়ি চিনে আসতে পারবেন তো? মরিয়মের মাথায় হাত। আবেদ সামির সাহিত্য পাঠের বদলে সেদিনের কাগজটা খুলে জোরে জোরে পড়তে শুরু করে–
সদরঘাট, বাহাদুর শাহ পার্ক, বঙ্গবন্ধু অ্যাভেনিউ, গুলিস্তান, ফার্মগেট। ভাগ্য গণনা আর হস্তরেখার ফলক টাঙিয়ে, জীর্ণ মলাটের কিছু বই সামনে নিয়ে টিয়ে পাখি হাতে ফুটপাতে বসে পড়েছে গণকরা। হস্তরেখা ও কোষ্ঠি বিচার করে ফাড়া কাটানোর জন্য মাদুলি, কবচ, রঙিন পাথরের আংটি ধারণের পরামর্শ দেন। টিয়াপাখির মাধ্যমে ভাগ্য পরীক্ষা করা আরো সহজ। চারটা পোষমানা টিয়া পাখি সাজানো খাম থেকে একটি খাম ঠোঁট দিয়ে টেনে আনে। সেই খামের ভিতর ছাপানো অক্ষরে ভাগ্যলিপি লেখা আছে। গোলকধাঁধার এই গোলকে ভাগ্যের গোল চাকাটা গন্তব্য খুঁজে পায় না।
আবেদ সামিরের পড়া শেষ হতেই মনোয়ারা বেগম বাড়ি ফিরে আসেন। তাদের দিকে ফিরেও তাকান না। অন্য দিনের মতো ভালোমন্দ রান্না করা দূরে থাক, নিজের ঘরের দুয়ার দিয়ে শুয়ে পড়েন। অবস্থা বেগতিক দেখে সামির সটকে পড়ে। মরিয়মেরও রাতে খাওয়া হয় না। মা সেই যে বিছানা নিয়েছেন, ওঠার নাম নেই। কী হলো তার? গণক কী বলেছে যে, মা শয্যা নিলেন? নয়-ছয় ভাবতে ভাবতে মরিয়মের তন্দ্রা ভাব হয়তো খানিকটা এসেছিল। মনোয়ারা বেগম মাঝরাতে তাকে ডেকে তোলেন। আবার শুরু হচ্ছে রাতের নাটক। এখন সংলাপ যা বলবেন, তার শৈশবে দেখা কোনো যাত্রাপালার।
মরিয়মের নানার বাড়ির কাছেই ছিল বিরাট গরু-ছাগলের হাট। শীতের মৌসুমে যাত্রার পার্টি এসে তাঁবু ফেলত ওখানে। যাত্রা দেখতে দেখতে মা বলেন, আমি বালেক অইলাম। ঋতুস্রাব হওয়ার পর যাত্রাপালা দূরে থাক, ঘরের বাইরে উঁকি দেওয়ারও অনুমতি ছিল না। মনোয়ারা বেগম পর্দার ঘেরাটোপে বন্দি হলেন। সেই সঙ্গে তাঁর পাঁজরের গ্রিলে চিরতরে আটকে গেল অতীতে দেখা যাত্রাপালার অগণিত সংলাপ। বুকে কান পাতলে শোনা যায় ধুকপুক করে হৃৎপিণ্ডের তালে তালে তিনি এখনো রিহার্সেল করছেন। সময় সময় রাত গম্ভীর হলে বহুদিনের অশ্রুত সংলাপগুলো। পর্দানশিন মহিলার মতো লোকচক্ষুর আড়ালে বেরিয়ে আসে। সে সময় বাতি জ্বালানো একদম পছন্দ করেন না মনোয়ারা বেগম। আজকেও রাতের অন্ধকারে মেরির শিথানে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘মরিয়ম, আমি মা ভিখারির অধম। আমার যা আছিল, সব তোরে দিছি–সাধ্যের বাইরেই দিছি। বাকিডা তোর নিজের হাতে।’
কাপড়ের তলা থেকে দোমড়ানো-মোচড়ানো বাড়ির দলিলটা মেয়ের হাতে দিয়ে বলেন, ‘বোকামি করিস না, মা। আল্লাপাক বোকা মাইয়্যামানুষ পছন্দ করেন না। পুরুষলোকেরে মন দিলেও দলিল দিবি না। এইডা তোর। একান্তই তোর–মনে রাখিস।’
মরিয়মের ঘুম ছুটে গেছে। মা তাহলে চলে যাচ্ছেন! কোথায়? কথাবার্তায় মনে হয়, রাজা হরিশচন্দ্রের মতো ধন-দৌলত বিলিয়ে সংসারত্যাগী হবেন! রায়েরবাজারের বাড়িটা মায়ের নামে, মরিয়ম জানে। কিন্তু লিখে-পড়ে না দিয়ে শুধু দলিলটা মেয়ের হাতে দিলে কী লাভ। মা হয়তো অতীতের কোনো যাত্রাপালায় দোমড়ানো-মোচড়ানো ময়লা কাগজ হস্তান্তর করতে দেখেছেন। তবে এ নিয়ে কথা বলতেও তার ইচ্ছে করে না মাঝরাতে। মা যে চলে যাচ্ছেন, এটাই দুঃস্বপ্ন। মধ্যরাতে স্বপ্ন কি দুঃস্বপ্নই হোক, কথা বলতে গেলে গলা থেকে আওয়াজ সরে না। মেরি অস্ফুটস্বরে জড়িয়ে জড়িয়ে জিগ্যেস করে, ‘এত যে তড়পাইতাছে, যাইবা কই?’
উত্তরটা সরাসরি দিতে বোধ করি মনোয়ারা বেগমের সংকোচ হয়। তিনি ঘুরিয়েপেঁচিয়ে বলেন, ‘তোর বাপ একটা পাগল-ছাগল। এই আট মাসে ঘরদোরের কী হাল হইছে কে জানে। তোরে ছাড়া আমার তো আরো দুইডা মাইয়্যা আছে। তোর বাপ চিডির জবাব না দেইক, অদের আমি দেখভাল না করলে কে করবে, মরিয়ম?’
অহ, এই কথা? আট মাস ধরে যে মেয়েরা একবারও মায়ের খবর নিল না, তাদের দেখভাল করার দায়িত্ব এখন তার! মা আসলে জাতে মাতাল তালে ঠিক। আর মনোয়ারা বেগমের মতে, মেরি হচ্ছে এক নম্বরের স্বার্থপর । যমজ দুটিকে এত দিন সে তার প্রাপ্যের ভাগীদারই শুধু ভেবেছে, নিজের ছোট বোন বলে মনে করেনি। এই বয়সে তারা স্বাবলম্বী হয় কী করে, দশ বছরের বড় বোন যেখানে গলাপানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে! রাতের অন্ধকার দুজনকে এর চেয়ে বেশি বিবেচক হতে দেয় না। মা-হীন বাড়িতে নিজের ভবিষ্যৎ দিনগুলোর কথা ভেবে মরিয়ম শিউরে ওঠে। নিপ্রদীপ ঘরে চাঁদের আলো পড়ায় মায়ের ভোলা চুল আর মুখের একপাশ আভাময়। তিনি নিস্পন্দ। মরিয়মের চোখের সামনে এই যে ভূতুড়ে কায়া কাল থেকে তা-ও থাকবে না। জনমনিষ্যিহীন বাড়িতে সে একা। মেশিন থেকে মাথা তুললে হাস্নাহেনার ঝোঁপটাই শুধু চোখে কাটার মতো বিধবে। শব্দ বলতে মেশিনের একঘেয়ে ভনভনানি, চাপকলে পানি তোলার ঘটর-ঘটর আওয়াজ। পড়শিরা কাস্টমার মারফত অচিরেই জেনে যাবে, যে বাঁশঝাড়অলা বাড়িটায় এত দিন মা-মেয়ে বাস করত, ওখানে এখন শুধু মেয়েটা থাকে। এ সেই মেয়ে, যে একাত্তরে যুদ্ধ লাগার সময় বাড়িটাতে একা ছিল।