কে আইছে মা, মন্টু? মাগো মন্টু আইছে? মরিয়মের স্বপ্নাচ্ছন্ন মনটা নিঃশব্দে চিৎকার করে ওঠে। ছোটবেলার মতো চৌকি থেকে লাফিয়ে মেঝেতে নামে সে। এবার অবাক হওয়ার পালা মনোয়ারা বেগমের। খাড়া মরিয়ম, পরনের কাপড়টা আগে ঠিক কইর্যা ল। আবেদরে আমি বারান্দায় বসাইছি।’ আবেদ! মেরির বুকের ওপর আস্ত পাহাড় ভেঙে পড়ে। কিন্তু মায়ের তাড়া খেয়ে সে ততক্ষণে বারান্দায়। নামের পুনরাবৃত্তি তার জীবন থেকে আর গেল না। মেজর ইশতিয়াক নম্বর ওয়ান, নম্বর টু, আবেদ জাহাঙ্গীর, আবেদ সামির।
মরিয়মের দু’ভুরুর মাঝখানের গভীর ভাঁজ দেখে সামির ভড়কে যায়। সে তাড়াতাড়ি বারান্দার বেঞ্চি ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ে, এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। পথেই এমন বৃষ্টি নামল!’ মনোয়ারা বেগম পেছন থেকে গলা মেলান, ‘হ বাবা, এমন পচা বিষ্টি। ঘর থাইক্যা বাইর অওনের জো নাই। তুমি আওনে আমরা বহুৎ খুশি অইছি, বাবা।
মায়ের ব্যাপার কী! ব্যবসাপাতিতে তো আর মন নেই। আবেদ সামিরকে টেনে বসাচ্ছেন কেন। তার ওপর ‘তোমরা গল্পগুজব করো’ বলে নিজে ভিজতে ভিজতে চা বানাতে চলে যান রান্নাঘরে। ওহ্, এ তাহলে মায়ের দ্বিতীয় প্রজেক্ট! মরিয়ম দীর্ঘদিনের তন্দ্রা থেকে জেগে ওঠে-স্বামী-সন্তানের বাইরে আরেক রকম জীবন আছে কি না মেয়েকে খুঁজে দেখার সুযোগ করে দিচ্ছেন মা। কোনো দিন মা-বাবার চাওয়ার সঙ্গে তার চাওয়া-পাওয়ার মিল হলো না। সে যখন আরেক রকম জীবন খোঁজায় ইস্তফা দিয়েছে, মা তখন তাকে পীড়াপীড়ি করছেন তা আবার শুরু করতে। কে আসলে ঠিক–মা, নাকি সে নিজে?
মা-মেয়ের এমন উল্টাপাল্টা আচরণে আবেদ সামির বিভ্রান্ত। তবে মরিয়মকে সে বুঝতে পারে-তার সেই দিনের রাগটা এখনো কমেনি। কমার কথাও নয়। সে যে এখন দুটি টিউশনি করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে–এ খবরে মেয়েটা নিশ্চয় খুশি হবে। তাতেও যখন মরিয়মের কোনো ভাবান্তর হয় না, সে তখন তার তৈরি পোশাকগুলো দেখতে চায়। কিন্তু বিষয়টা গোপন, আবেদ সামিরের কাটাকুটিভরা কবিতার খসড়ার চেয়েও। বাচ্চাদের নিমা তৈরি করে থরে থরে সাজানোতে মরিয়মের একার আনন্দ। সেসব প্রদর্শনী বা বিক্রির জন্য নয়। এ ক্ষেত্রে বালিশের কভার, কুশন, টিকোজি শুধু দেখানো চলে। ঘরে ঢুকেই মরিয়মের একার আনন্দসামগ্রীর দিকে প্রথম চোখ যায় আবেদ সামিরের। দেখি দেখি’ বলে একগুচ্ছ নিমা-জামা সে বিছানা থেকে টেনে নেয়। মরিয়ম থাবা মারতেই তার হাত থেকে সেসব ঝুরঝুরিয়ে পড়ে যায়। কতগুলো সেলাই করা কাপড়ই তো, গোপন করার কী আছে। কাপড়গুলো মেঝেতে পড়ে যেতে মেয়েটা এমন ফুঁপিয়ে উঠল কেন। সামিরের কৌতূহল বেড়ে যায়। নবজাতকের অনেকগুলো জামা, শিশুহীন এক বাড়ির মেঝেতে করুণভাবে পড়ে রয়েছে। দৃশ্যটা পুরুষের বাৎসল্য আর মেয়েদের মাতৃত্ব জাগানোর জন্য যথেষ্ট। মরিয়মের অপ্রস্তুত চেহারার দিকে তাকিয়ে আবেদ সামিরের এই প্রথম মনে হয়, রুক্ষ মেজাজের আড়ালে এ মেয়ের মনটা আসলে কোমল। তা সমবেদনার চেয়ে মনোযোগ দাবি করে বেশি।
মনোয়ারা বেগমের নতুন প্রজেক্ট-স্বামী-সন্তানের বাইরে মেয়ের অন্যরকম জীবন’ পরিণতির দিকে এগোয়। তবে শুকনো মাটির বুকে দাগ ফেলে কচ্ছপের খড়খড়িয়ে চলার মতো শ্লথগতিতে। আবেদ সামির সন্ধ্যার দিকে ঝোলা কাঁধে হাজির হয়। বারান্দার বেঞ্চিতে বসেই নতুন লেখা কবিতা বের করে। সারা দিনে মেরেকেটে দুজনের বেশি কাস্টমার আসে না। তা-ও বেশিরভাগ কাজ–ব্লাউজ অল্টার করার, শাড়ির ফলস লাগানোর, অসময়ে ছিঁড়ে যাওয়া কাপড়ে তালি বসানোর মতো সংস্কারমূলক। দিন থাকতেই এসব কাপড় দেয়া-নেয়ার পাট চুকে যায়। সন্ধ্যায় সাহিত্য পাঠের আসর বসে। মরিয়ম স্নান করে পরিষ্কার শাড়ি-ব্লাউজ গায় দিয়ে কবিতা শুনতে বসলেও তার মনোযোগ বেশিক্ষণ স্থির থাকে না। অনুরাধার কথা মনে পড়ে। মেয়েটা বেঁচে থাকলে হয়তো নামকরা লেখক বা কবি হতো। তার কল্পনাশক্তি ছিল প্রবল। শ্রোতার মনের গতিবিধি আবেদ সামিরের চোখ এড়িয়ে যায়। কারণ মনোযোগটা তার মরিয়মের চেয়ে নিজের দিকেই বেশি। মনোয়ারা বেগম তার জন্য ভালোমন্দ রান্না করেন। সে বড় লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখতে দেখতে ভাত খেয়ে হাত ধুয়ে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে চলে যায়।
এমন জীবনের কোনো গতি নেই। যেন পানাপুকুর, কচুরিপানা ঠেলে ঠেলে এগোতে হচ্ছে। মনোয়ারা বেগমের শক্তি ফুরোনোর সঙ্গে সঙ্গে অস্থিরতাও বাড়ে। তার স্বামী মানুষটা কেমন, পাক্কা পঁয়ত্রিশ বছর একসঙ্গে ঘর করেছেন, আট মাস পেরিয়ে গেল স্ত্রী ঢাকায়, এক লাইনের একটা চিঠিও লিখলেন না! মনোয়ারা বেগমের ‘৭৫ সালে মা হব না’ চিরকুটেরও জবাব দেয়নি লোকটা। এক্কেবারে গাইয়্যা ভূত, শহরের সূক্ষ্ম ব্যাপার-স্যাপার মাথায় ঢোকে না। মনোয়ারা বেগমের স্বামীর প্রতি বিরক্তির ভাবটা মরিয়মের ওপর পড়ে। তিনি কপট রাগ দেখিয়ে বলেন, ‘ক্যামন মাইয়্যা তুই, বাপের কোনো খবর নিস না। বাপ বাঁচল না মরল–দুই কলম লিখে ডাকে দিতে তোর ইজ্জত যায়?’
মরিয়মের তাতে ইজ্জত যায় না ঠিকই, তবে সে বাপকে দুই কলম লেখেও না। সময় কাটানোর জন্য মাকে খবরের কাগজ পড়তে বলে। একদিন বড় ধরনের বিপত্তিও ঘটে তাতে। পত্রিকায় সোনার মুকুট পরা পুত্রবধূর পাশে হাস্যরত বঙ্গবন্ধুর ছবি দেখে মনোয়ারা বেগম বিষণ্ণ হয়ে যান। বেঁচে থাকলে মন্টুর এত দিনে বিয়ের বয়স হতো। তাদের যা সামর্থ্য তা-ই দিয়ে তিনি ছেলের বিয়ে দিতেন। মুকুট না হোক, টিকলি কি গড়িয়ে দিতে পারতেন না ছেলেবউকে! যে ঘরে ঘরে দুর্গ বানাতে বলল, যার যা আছে, তাই দিয়ে যুদ্ধ করতে বলল, তার ছেলেমেয়ের তো কিছু হলো না। কী নিষ্ঠুর! এখন নিজের ছেলে বিয়ে দিয়ে ঘরে বউ এনেছে। মনোয়ারা বেগমের আহাজারি আর থামে না। থেকে থেকে শুধু বলেন, ‘এইডা কী অইলো মরিয়ম? এক যাত্রায় পৃথক ফল! কে মরলো আর কে ফল ভোগ করছে এই মুক্তিযুদ্ধের? বৃষ্টি ছাড়ক। ৩২ নম্বরে গিয়া শেখের ব্যাটা শেখেরে আমি কথাডা জিগাইয়্যা ছাড়ুম।’