মরিয়ম সামনে একটা খালি রিকশা পেয়ে উঠে বসে। পেছন ফিরে তাকায় না। সামনে এগিয়ে গেলে পলাশীর মোড়। ওখানে মেজর ইশতিয়াক ব্রিফকেস হাতে দাঁড়িয়ে আছে অফিস-ফেরত কেরানির মতো। প্রথম দিনের মুচি নিবিষ্ট মনে জুতো সেলাই করছে। শিরীষ অরণ্যে আজ কারফিউ। ওদিকে যাওয়া যাবে না। এখন থেকে স্বপ্নগুলোকে হিসাবের মধ্যে রাখতে হবে। কত কাছের মানুষ, অল্প সময়ে তার জীবন থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে। স্বপ্ন ছাড়া তাদের ফিরে পাওয়ার অন্য কোনো পথ নেই। এই পথটা খুলে না রাখলে তার জীবন ঘিরে তো খরা সৃষ্টি হবে। যা অন্ধকার কবরের একাকিত্বতুল্য। মরিয়ম রিকশাঅলাকে তাড়াতাড়ি রায়েরবাজারের দিকে চালিয়ে যেতে বলে।
মনোয়ারা বেগম নিঃশব্দে দুয়ার খুলে সরে দাঁড়ান। মরিয়ম একজন পরাজিত মানুষ–যে কয়েক ঘণ্টা আগে ঝড়ের বেগে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল, সে বিড়ালের মতো পা টিপে টিপে ঘরে ঢোকে। ঘরটা তবু আশ্রয়। বাইরের পৃথিবীতে যে কণ্টক বিছানো আছে, মা কি তা জানেন?
এই এক বেলায় মনোয়ারা বেগমেরও শক্তি ক্ষয় হয়ে তলায় লেগে গেছে। রঙিন কাপড়ের টুকরা-টাকরা আজ দুপুরে বস্তাবন্দি করতে করতে তার হঠাৎ মনে হয়েছিল, তিনি মেরির রোজগার খাচ্ছেন। আঙুলে ব্যান্ডেজ বেঁধে মেশিন ঘুরিয়ে জীবন কাটবে মেয়ের? মেশিনের ঘূর্ণনের সঙ্গে সঙ্গে দিন-মাস-বছরও তো ঘুরে যাচ্ছে। এ মহাকাল ঠেকাবে কে। মেরি নিজের পথ খুঁজে নিক, যদি কোনো পথ থাকে। তিনি কোনোভাবে তার পথে বাধা হবেন না।
মা-মেয়ে গরমে ভিজে-ওঠা বাসি ভাত নিয়ে সন্ধ্যাবাতির তলায় খেতে বসে। ঘরে কোনো শব্দ নেই। যে যার চিন্তায় মগ্ন। একটা দিন হঠাৎ করে অন্য দিনগুলো থেকে আলাদা হয়ে যায়। মনোয়ারা বেগমের আঙুল গুনে বাজারের হিসাব করা এখন বন্ধ। মা-মেয়ে টেইলারিং’-এর লাভ-লোকসান, ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি আর চিন্তিত নন। জীবন বড় প্রতারক। এর বড় হিসাবটা মানুষের দৃষ্টির আড়ালে, আঙুল গোনা ছাড়াই শেষ করে দিচ্ছে আরেকজন। আতঙ্কে মনোয়ারা বেগমের ভাত গলায় আটকে যায়। তিনি পানির গ্লাস নামিয়ে ধীরে ধীরে কোমল স্বরে মেয়েকে বলেন, আমি এক রকমের জীবন চিনি মরিয়ম। স্বামী-সন্তান। খোদা তা-ও রাখল না। তবে আমার মনে লয়, জীবন শুধু এক রকমের না। তোর সামনে সময় আছে। তুই মা খুঁইজা দেখ।
ছেলের মৃত্যু, মেয়ের ইজ্জতহানি মাকেও কি সাবালক করে দেয়? তা না হলে কার মুখে কী কথা। মহুয়া সিনেমা হলের ঘটনার পর, মেরির নামে অপবাদ রটার ফলে মায়ের জীবন বরবাদ হয়ে গিয়েছিল। তিনি সারাক্ষণ নিজের মৃত্যুকামনা করতেন। মেয়েকেও বলতেন, ‘মর মর, বিষ খাইয়্যা মর তুই। এমন কালসাপ পেটে লইছিলাম মাগো। খোদা, তোমার এ পাপী বান্দারে তুইল্যা নেও, তুইল্যা নেও।’
মনোয়ারা বেগম জীবনের জটিলতার কাছে হেরে গেছেন। শহরের রাস্তায় বৃষ্টি পড়ে পড়ে গলাপানি লেগে গেছে। তিনি অনড়। যেখানে সকালে মুখ ধুয়ে আল্লার নাম করে বসেন, সেখানেই এক বসায় দিন শেষ। মরিয়ম থেমে থেমে মেশিন ঘোরায়। মা-মেয়ে টেইলারিংয়ের রঙিন পোস্টার বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে গেছে। বর্ষাকালে কাগজের নতুন পোস্টার লাগিয়ে ফায়দা নেই। তা ছাড়া রায়েরবাজার, ট্যানারির মোড় আর জিগাতলার পোস্টার অধ্যুষিত এলাকার লোকজন মা-মেয়ে টেইলারিংয়ের খবর জানে। তারা প্রয়োজনমতো কাপড়চোপড় বানিয়ে নিয়েও গেছে। গত তিন মাসে এই এলাকার নিম্নমধ্যবিত্তের চাহিদা শেষ। বারান্দার কাস্টমারদের বসার বেঞ্চিটা শূন্য পড়ে থাকে। পুঁজির বিকাশের নিয়মে এখন দরকার নতুন এলাকা, নতুন ভোক্তা। তার জন্য লাগবে নতুন নতুন দৃষ্টিনন্দন, আকর্ষণীয়, চটকদার সব পোস্টার। মা-মেয়ের উদ্যোগে ভাটা পড়াতে তা আর সম্ভব হচ্ছে না। মরিয়ম টুকরা কাপড় জোড়া দিয়ে বাচ্চাদের নিমা, বালিশের কভার, কুশন, টিকোজি তৈরি করে। শরীরের গিঁটগুলো আলগা করে আড়মোড়া ভেঙে দরজায় এসে দাঁড়ায়। মনোয়ারা বেগম জানালার পাশে বসে আছেন তো আছেনই। বৃষ্টির দিকে তার চোখ অনির্দিষ্টকালের জন্য নিবদ্ধ। এখন কে নিয়ে যাবে তৈরি পোশাক বাজারে বেচতে?
একদিন অঝোর বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে আবেদ সামির মরিয়মদের বাসায় আসে। মনোয়ারা বেগম সুমন আর মেরির ঝগড়ার বৃত্তান্ত কিছুই জানেন না। তিনি জানালার ধার থেকে উঠে তাকে সমাদর করে বারান্দায় বসান। মরিয়ম সেলাইঘরে, টুকরা কাপড় দিয়ে বাচ্চাদের নিমা বানাচ্ছে। মনোয়ারা বেগমের চেঁচামেচিতে সে মেশিন বন্ধ করে ঘোরভাঙা চোখে তাকায়। দেইখ্যা যা মরিয়ম, কে আইছে! ওঠ-ওঠ,– শিগগির আয়।’
আজকাল সেলাই করাটা মরিয়মের খালি রুটিরুজির উপায় নয়। মেশিনের ঘূর্ণনের মধ্য দিয়ে উল্টো ঘুরতে ঘুরতে সে অতীতে চলে যায়। রঙিন জামাগুলো বিছানায় সাজাতে সাজাতে ভাবে–এইটা শোভা রানীর বাচ্চার, এইটা বিন্দুবালার, টুকির। পুনর্বাসনকেন্দ্রের যেসব বাচ্চারা প্লেনে চড়ে বিদেশ চলে গেছে, জামাকাপড় থেকে তাদেরও বঞ্চিত করে না মরিয়ম। বিছানার শেষ প্রান্তে অভিবাসী যুদ্ধশিশুদের জন্য আলাদা করে কিছু কাপড় গুছিয়ে রাখে। বাড়িতে নির্বাক মা ছাড়া আর কেউ নেই যে, তার এসব গোপন কাজকর্মে ব্যাঘাত সৃষ্টি করবে। তাই আজ মনোয়ারা বেগমের ডাকাডাকি কাঁচা ঘুম থেকে টেনে তোলার মতো তার মনে হয়। ওঠ-ওঠ, শিগরির আয়! দেইখ্যা যা মরিয়ম, কে আইছে!’