দুই রুমের মাঝখানের দরজাটা ভেজানো। তবে পাল্লা দুটির ফাঁক ইঞ্চি খানেক হবে। পাশের ঘরের চাপা কথাবার্তা এ ঘর থেকে শোনা যায়। সুমন ফিরেছে। দুই বন্ধু বাতচিত করছে, মরিয়মের মনে হয় ওকে নিয়ে। যদিও বাস্তবের চেয়ে স্বপ্নে দেখা মানুষগুলোকে তার বেশি কাছের মনে হয়, তবু পাশের কামরার ছেলে দুটিকে সে অগ্রাহ্য করতে পারে না। ইশ, কী গরম!’ কথাটা কি সুমন বলল? তাহলে এখন আবেদ সামিরের কণ্ঠ, ‘এমন গরমে মইষের মতো ঘুম!’ ‘এই না-না, আমি বাসা ছেড়ে ছাদে চলে গেছলাম। মনে হয় বাসায় কোনো ঝামেলা হইছে?’ ‘হইলেই কী, তাই বলে তুমি ছাদে চলে যাইবা?’
কথাগুলোর কোনো মাথামুণ্ডু নেই। মরিয়ম কি এখনো স্বপ্ন দেখছে? সে জোর করে শরীরটা বিছানা থেকে তুলে, শাড়ির ভাজ ঠিক করতে করতে পা টেনে টেনে ভেজানো দরজার দিকে এগোয়। সুমনের দেহের অর্ধেকটা খবরের কাগজের আড়ালে। আবেদ সামির নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে। এই, তোমরা আমার দুর্নাম করতেছিলা ক্যান? মরিয়মের কথা শুনে সুমন মুখ থেকে কাগজ নামিয়ে অবাক হয়ে তাকায়। সেই সঙ্গে চেহারায় কষ্টেসৃষ্টে ফুটিয়ে তোলা প্রসন্ন ভাব, এত গরমে মানুষ ঘুমায় ক্যামনে?’ মরিয়ম গোলযোগপূর্ণ ঘুমে ভারী হয়ে যাওয়া গলায় হেসে বলে, ‘মইষের মতো ঘুম! ‘এই না না, গত রাতে গরমে টিকতে না পেরে আমি ছাদে চলে গেছলাম। মরিয়মের স্বপ্নের আবেশ মুহূর্তে ছুটে যায়। সুমন চটজলদি জানতে চায়, বাসায় কোনো ঝামেলা হইছে? স্বপ্ন এমন বাস্তবের সঙ্গে মিলে যেতে পারে, আশ্চর্য! নাকি তাকে ঘরে ঢুকতে দেখে একজন ঘুমের ভান করছে, অন্যজন আপাদমস্তক ঢেকে ফেলেছে খবরের কাগজে? কিন্তু সুমনের কথা শুনে মনে হচ্ছে, তা নয়। সে ঝা-ঝ রোদ মাথায় করে ঘরে ঢুকে দেখে, দুজন ঘুমন্ত মানুষের দখলে দুটি কামরা। নিজঘরে সে পরবাসী। সুমন হেসে হেসে কথা বললেও মরিয়মের মনে হয়, সে আবেদ সামিরের সঙ্গে তাকে জড়িয়ে কিছু একটা ইঙ্গিত করছে। তা করুক। মরিয়ম স্বপ্নের জালে এমন জড়িয়ে আছে যে, ছাইপাশ ভাবতেও তার ভালো লাগছে না। সুমন নাছোড়। সে হঠাৎ আবেদ জাহাঙ্গীরের কথা অপ্রাসঙ্গিকভাবে টেনে আনে। আবেদ শ্বশুরের ব্যবসা করতে গিয়ে। লাট খেয়ে পড়েছে। বউ বাপের বাড়ি লাহোরে বেড়াতে গিয়ে ফিরছে না। চিঠিপত্রও বন্ধ। মাথা খারাপের জোগাড় আবেদ ভাইয়ের। সুমন খোশমেজাজে বয়ান করে, ‘এখন বাকশালে যোগ দিয়ে তিনি নেতা হইতে চান। তাই অভাগা সুমনের ডাক পড়েছে অসময়ে।’
মরিয়মের মনে হয়, এসব কথা বাদ দিয়ে আবেদ সামিরের লেখাপত্র বালিশের তলা থেকে টেনে আনলে সুমন ভালো করত। তার মেজাজটা ঠিক থাকত। কিন্তু সেদিকে সুমনের আজ মন নেই। বোঝা যায়, প্রাক্তন গুরুর কাছ থেকেই ঝা-ঝা রোদে বাসায় ফিরেছে। মস্ত বড় ঢেকুর তুলে সুমন বলে, ‘আবেদ ভাই এমনভাবে ধরলেন, নইলে এই গরমে কেউ বিরানি খায়! তা-ও আবার কাচ্চি!’ মরিয়মের হঠাৎ মনে পড়ে সে দুপুরে কিছু খায়নি। আবেদ সামির কি খেয়েছে? বেচারার দিন শেষ হয়ে এল বলে। সুমন যেমন ঝড়ের গতিতে প্রাক্তন গুরুর দিকে ধাবিত হচ্ছে, প্রতিভাবান সাহিত্যিকের মাথার ওপরের ছাদটা দুদিন বাদে এমনিই সরে যাবে। হয়তো পথে বসতে হবে তাকে। কিন্তু এমন কাউকে নিয়ে ভাবছে কেন মরিয়ম, যে ঘণ্টা দুই আগে তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে! নাকি পুরুষের কাছ থেকে খারাপ ব্যবহারই সে। আশা করে। যেন তারা তাকে মানুষ না ভেবে রাস্তার কুকুর ভাবে! তা না হলে সে মমতাজের মতো পাষণ্ড আর মেজর ইশতিয়াকের মতো খুনির সঙ্গে থাকল কীভাবে। মরিয়মের অস্থির অস্থির লাগে। সুমনের ঘন-ঘন ঢেকুর তোলা মুখটায় কষে একটা চড় লাগিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। রাস্তার কুকুর আসলে কে–সে, না সুমন? আয়-আয় উঁহুঁ করে ডাকলে লেজ নাড়তে নাড়তে যে বিরানি খেতে ছুটে যায়–সে মরিয়ম না, সুমনই।
সুমন আপনাতে আপনি বিভোর। হঠাৎ জিগ্যেস করে, ‘রাজনীতি করবেন?’
কত বড় আস্পর্ধা! মরিয়ম দাঁত কিড়মিড় করে বলে, ‘কেন?’
‘না মানে, দর্জিগিরি বাদ দিয়ে রাজনীতিটা কেরিয়ার হিসাবে নিলে ক্ষতি কী? এখন তো রাজনীতির যুগ।’
‘নাকি আবেদ জাহাঙ্গীর ফের রাজনীতি করতে চাচ্ছে বলে আমাকেও করতে হবে?’
‘না-না, আবেদ ভাইয়ের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কী। হে বিবাহিত মানুষ। আর আপনে…’
‘আমি?’
সুমন বিরক্ত হয়।
‘আর আমি?’ মরিয়মের মাথায় খুন চেপে গেছে। সে কে–আজ সুমনের কাছ থেকে জানতেই হবে। আবেদ সামির ঘুম থেকে উঠে দুজনের দিকে অবাক হয়ে তাকায়। ঘরটা কখন রণক্ষেত্রে পরিণত হলো! মরিয়ম এসবের পরোয়া করে না। হিস্টিরিয়া রোগীর মতো কাঁপতে কাঁপতে সে একই প্রশ্ন করে বারবার। তার প্রশ্ন করা শেষ হয়, যখন সুমন বাড়ি মাথায় তুলে চিৎকার করে বলে, ‘এত সতী সাজেন ক্যান? আপনে কে–সবাই জানে। আর্মির ভুসিমাল। মুখে আবার বড় বড় কথা!’
রাস্তায় বেরিয়ে মরিয়মের যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে। সবাই তো ভালো মানুষের মুখোশ পরে ভালো ভালো কথা বলতে আসে। আর কত। একটা একটা মুখোশ টেনে ছিঁড়ে তবে তার শান্তি। ‘হ-হ আমি আর্মির ভুসিমাল। তাতে তোমার কোনো অসুবিধা আছে? আমি তোমার ঘরের বউ, না ছেলের মা?’ মরিয়ম হাঁটতে হাঁটতে পাগলের মতো প্রলাপ বকে। তার পেছন পেছন আসে আবেদ সামির। কী যেন সে বলতে চায়। হয়তো সুমনের হয়ে সে তার কাছে ক্ষমা চাইবে। মরিয়ম সেই সুযোগ দিতে নারাজ। এদের সব কটাকে তার চেনা আছে। সুমনও একদিন এসএম হল থেকে পলাশীর মোড় পর্যন্ত তাকে এগিয়ে দিয়েছিল। আর্মির ভুসিমালের প্রতি সমবেদনায় সেদিন তার চোখ ছিল ছলছল।