এ অবস্থায় দেশের বাড়ি যাবে মেরি! আবেদের কি মাথা খারাপ হয়েছে? মরিয়ম রাগ করার বদলে ছেলেটির কাছে একটুখানি দয়া ভিক্ষা চায়, ‘আবেদ, বাচ্চার কী হবে?’
আবেদ ঘরের এদিক-ওদিক দিয়াশলাই খোঁজে। কোথায় রেখেছে মনে করতে পারে না। ইন্টারভিউ দিয়ে তার একটা চাকরি পাওয়ার কথা ছিল। সেই যোগ্যতা দলে-মুছে গেছে বুটের তলায়। তাকে জুতার তলার দুর্গন্ধ শুঁকতে বলছে নাকি মেয়েটা! সে তো এখন অন্য মানুষ। সামনে নতুন দিন। দিয়াশলাই ঠুকে ঠুকে আবেদ সিগারেট ধরায়। তাতে টান দিতে দিতে মরিয়মকে জোর করে কাছে টানে।
মরিয়মের কিছুই আর বলা হলো না। একটা প্রলয়ংকরী মিছিলের ঘায়ে দুজন বিভক্ত হয়ে গেল। আবেদের হুঁশ ফিরেছে-সে তো পদানত এখনো। শত্ৰু এগিয়ে আসছে। সামনে যুদ্ধ। মারতে হবে, না-হয় মরতে হবে। মেরিটা একটা জোক। এখনো তার গায়ের সঙ্গে লেপ্টে রয়েছে। যতই যন্ত্রণা হোক, রক্ত ঝরুক, জেঁকটাকে গা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে।
সে সময় এসএম হলের সামনের রাস্তা দিয়ে একটা মিছিল যাচ্ছিল–যার গতি ঝোড়ো হওয়ার বেগের। শ্লোগানে ছিল ধারালো শিলাবৃষ্টির তীব্রতা। শিরীষ অরণ্যের পাখিগুলো নীড় ছেড়ে উড়তে শুরু করে। আবেদ শাড়িটা গুছিয়ে পরারও সময় দেয় না। মরিয়মকে। ডানা ধরে বারান্দায় নিয়ে আসে। তার হাতে লোহার রড। সুমন দৌড়ে এসে একগাদা লাঠি পাঁজাকোলে তুলে নেয়। গুজব রটেছে মুজিব-ইয়াহিয়া-ভুট্টোর আলোচনা ভেঙে গেছে। ২৫ মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন পুনরায় স্থগিত । আবেদের রুমের স্তূপীকৃত হাতিয়ার মুহূর্তেই লোপাট হয়ে যায়। ছাত্ররা হল থেকে দৌড়ে যাচ্ছে রাস্তার দিকে। মরিয়ম পদপিষ্ট হওয়ার ভয়ে অন্ধের মতো যা আঁকড়ে ধরে, তা একটা ঠান্ডা, সর্পাকৃতির লোহার রড। আবেদ কয়েক পা দৌড়ে হাত খালি দেখে পিছিয়ে আসে। মরিয়মের হাত থেকে রডটি ছিনিয়ে নিতে তার বল প্রয়োগের দরকার হয় না। তবু পেছন ফেরাটা যেন তার রাগের কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং মরিয়মকে যে সে আর চায় না, কয়েক মুহূর্ত আগের সিদ্ধান্তটা, লোহার রড দু’হাতে চেপে ধরে ডামাডোলের ভেতর জানিয়ে দেয়। তারপর অস্ত্রটি যেন তার বাহুল্য লাগে, বা অপ্রয়োজনীয় মনে হয়, সে ফেলে দেয় হাত থেকে। মিছিলেও যায় না। মরিয়মকে নিয়ে জনশূন্য হোস্টেল ছেড়ে রাস্তায় আসে। মেঘশিরীষের কারুকাজময় ছায়ার নিচে রিকশার জন্য দাঁড়ায়। মিছিলটা একবুক তরঙ্গ নিয়ে সরে গেছে। এর অস্পষ্ট কলধ্বনি ভেসে আসে যেন গহিন সাগরের মাঝখান থেকে। এর পরও শিরীষগাছের পাখিরা ভয়ে নীড়ে ফেরে না। চারদিক শূন্য। কোনো পথচারী কি যানবাহনও নেই। আবেদ আর মরিয়মের পায়ে পায়ে রাস্তাটা গিয়ে পলাশীতে পড়ে। সেখানকার ফুটপাতে প্রথম দিনের সেই মুচি জুতো সেলাইয়ের সরঞ্জাম নিয়ে আজও বসে আছে। তার পাশেই একটা খালি রিকশা। মরিয়ম উনসত্তর থেকে একাত্তর, একটা আনন্দ আর বেদনাময় অধ্যায় সমাপ্ত করে রিকশায় উঠে বসে।
ঘরে ফিরে মরিয়মের কান্না কেঁদে কেঁদে বুক হালকা করার জন্য নয়। বুক পাখির পালকের মতো হালকা হলে তারপর কী? তারপরই তো যুদ্ধ। যুদ্ধ মানেই অনিশ্চয়তা। কে বাঁচে, কে মরে–ঠিক নেই। বিবদমান দু’পক্ষের আবেদ এক পক্ষ। যুদ্ধের সনাতন নিয়মানুসারে তার মারার এবং মারা যাওয়ার সম্ভাবনা আধাআধি। ধরা যাক সে বাঁচল, মরল না। একটা জীবন-মরণ সংঘর্ষ বাধার আগেই তো তাদের সম্পর্ক চুকেবুকে গেছে। মেরি পিতাহীন সন্তানের জননী হবে। যুদ্ধ না হলেও এই তার নিয়তি। সে ঘুমের বড়ির পাতাটা এক বসায় শেষ করে দেয়। ফলত বুধ-বৃহস্পতি দু’দিন, যুদ্ধ যে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে দোরগোড়ায়, সেটি তার দেখা হয় না। সেই সময়টায় নতুন করে জন্ম নেওয়ার জন্য মেরি ওরফে মরিয়ম যেন পুনরায় জ্বণাকৃতিতে ফিরে গিয়েছিল।
.
মেরি-মন্টুর খোঁজে পরপর দু’দিন দুজন লোক পাঠিয়েছিলেন গোলাম মোস্তফা। ভাগনে-ভাগনির তথ্য-তালাশ করতে মোস্তফার না আসার কারণ নিজের কাছা সামলাতেই তিনি তখন ব্যস্ত। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করা অথবা তাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর–দুটোর সম্ভাবনাই তখন আধাআধি। বাঙালিরা ক্ষমতাসীন হলে হিন্দুদের ভারত থেকে এসে জমিজমা, দালানকোঠা, ভিটেবাড়ি ফেরত চাওয়াটা অসম্ভব কিছু নয়। তা তারা চাইতেই পারে। যদিও তাদের পরিত্যক্ত ডোবাখন্দে এখন বড় বড় ইমারত, কলকারখানা, কারো-বা বাসাবাড়ি। শখের বাগানবাড়িতে মক্তব বসেছে। দাঁতব্য চিকিৎসালয়ের সাইনবোর্ড ঝুলছে নাটমন্দিরের নোনাধরা দেয়ালগাত্রে। পুকুর, বসতবাড়ি, পূজামণ্ডপ সমান করে ধানপাটের চাষ হচ্ছে। গোলাম মোস্তফার হাত দিয়ে এই চব্বিশ বছরে দেশভাগের নেতাদের স্বপ্নমাফিক হিন্দুস্থান বাস্তবিকই পাকিস্তান হয়েছে। স্বপ্নদ্রষ্টারা তো স্বপ্ন দেখেই খালাস, কবরে নিদ্রা যাচ্ছেন। এখন হিসাবের পালা এসেছে যখন, কৈফিয়ত দিতে হবে এমন একজনকে, যে আদতে এ বিষয়ে কোনো স্বপ্নই দেখেনি। গোলাম মোস্তফা ‘৭০-এর নির্বাচনের সময় গা-বাঁচাতে আওয়ামী লীগে ভিড়ে যান। চড়ে বসেন নৌকায়। মনটা পড়ে থাকে তীরে, নিজের হাতে গড়া পাকিস্তানে। তিনি যার স্বপ্নদ্রষ্টা নন, একজন সাচ্চা কারিগর। তার পরও জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি দুটি মাস তাকে নৌকাতেই থাকতে হয়। কারণ জাতীয় পরিষদের ৩১৩টি আসনের ১৬৭টিতে জিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে আওয়ামী লীগ। সরকার গঠনের এখতিয়ার এখন তাদেরই। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাহ্যত তা ঠিক ছিল। মার্চের পয়লা তারিখ দুপুর একটায় ইয়াহিয়া খান রেডিওতে ঘোষণা দিয়ে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে দেন, যা ৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। ইয়াহিয়ার ঘোষণা শুনে ক্রিকেট ম্যাচের দর্শকরা যখন গ্যালারি ছেড়ে মাঠে নেমে পড়ে, গোলাম মোস্তফা নৌকা থেকে লাফিয়ে পড়েন পানিতে। তারপর আন্দোলন বিক্ষোভের চোটে তিনি আর তীরে উঠতে পারেননি। এ অবস্থায় বুধবার দিন ভাগনে ভাগনির কথা হঠাৎ তার মনে পড়ে। তিনি তিন ছেলেকে ডেকে তাদের খোঁজ নিতে বলেন। মেজো ছেলে হাবা সাজু, যে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে মরিয়মকে ছাড়া জীবনে কাউকে শাদি করবে না, সে-ই শুধু পিতৃআজ্ঞা পালনে রাজি হয়। সাজু হাজি সাহেবের বাসা পর্যন্ত ঠিক ঠিক আসে। তারপর কুকুর দেখে পড়িমরি পালায়। মেরি-মন্টুদের বাড়ির পঞ্চাশ গজের ভেতর উল্টে পড়ে থাকা এক পাটি স্যান্ডেল এর সাক্ষী। যদিও কিল-চড় দেওয়ার সময় গোলাম মোস্তফা কথাটা গ্রাহ্যই করেননি। সাজুর দোষ এইটুকুই যে, কুকুরটা যে লাইটপোস্টের সঙ্গে এক হাত দড়িতে বাধা, বেচারা ভয়ের চোটে দিনদুপুরেও তা দেখতে পায়নি। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মামা তার সহকারীকে পাঠান। রাস্তায় আসতে আসতে লোকটা শহরে আর্মি নামানোর নানা প্রকার গুজব শোনে। সৈন্যদের নেতৃত্ব দিচ্ছে ‘বেলুচিস্তানের কসাই’ জেনারেল টিক্কা। সে গুলি ছুঁড়ে গাছের পাতাও রাখবে না। শহরটাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেবে। এর মধ্যে শোনা গেল, গেরুয়া পোশাকের সেনারা টহল দিতে রাস্তায় নেমে পড়েছে। গোলাম মোস্তফার সহকারী ডানে-বাঁয়ে তাকায়, আগু-পিছু করে, তারপর খানিকটা এগোয়। এই করে করে পিলখানা পর্যন্ত সে আসে। তারপর ইপিআর ক্যাম্পের গেটে বালুর বস্তার গানপোস্ট দেখামাত্র সাহেবের ভাগনে-ভাগনির নাম ভুলে যায়। তখন তার জানের মায়ার সঙ্গে যুক্ত হয় চাকরি হারানোর আতঙ্ক। তবে জানে বাঁচলে মানুষের যে চাকরির অভাব হয় না, এই বিশ্বাস তাকে নির্ভয়ে গোলাম মোস্তফার সামনে নিয়ে দাঁড় করায়। আর তোতলাতে তোতলাতে বলে যে, খোকা-খুকু দু’জন অদ্য বৃহস্পতিবার বাদ জোহর দেশের বাড়ি চলে গেছে। কিন্তু কার কাছ থেকে সংবাদদাতা এ তথ্য পেল? এ প্রশ্নের জবাব দিতে সহকারী অপারগ। মামার ধমক খেয়ে লোকটা রাস্তায় যা যা গুজব শুনেছে, সেসব সবিস্তারে বয়ান করে। গোলাম মোস্তফার বিক্ষুব্ধ মনটা তখন আশকারা পাওয়া, নৌকা মার্কায় ভোট দেওয়া, শেষ পর্যন্ত তাকে না-বলে বাড়ি চলে যাওয়া ভাগনে-ভাগনির ওপর থেকে সরে গুজবের সোপান বেয়ে উঠতে চায় তীরে–চব্বিশ বছরের পুরোনো পাকিস্তানে। কিন্তু সেই পথে তখনো বাধা বিস্তর। ছাত্র-জনতা তখন। বড় বড় গাছ কেটে শুমার করছিল। তা দিয়ে রাস্তায় ব্যারিকেড দেয়। পথে-ঘাটে জলের ট্যাংক, সুয়ারেজ পাইপ টেনে এনে ফাঁকা জায়গাগুলো বুজিয়ে দেয় ইট দিয়ে। এসব জঞ্জাল সাফ করে সৈন্যদের শহরে ঢুকতে হবে।