মনোয়ারা বেগম টাকা নিয়ে তৈরি-পোশাক ডেলিভারি দেন। রসিদ কাটা, টাকাপয়সার হিসাবনিকাশ–সব তার হাতে। নতুন কাজ নিয়ে মা-মেয়ে দুজনেই ব্যস্ত। যত দিন মেশিনের হাতল ঘুরবে, তত দিন সংসারের চাকাও সচল থাকবে। তাদের রুটিরুজি বাঁধা পড়ে গেছে একটা মেশিনের কাছে। মনোয়ারা বেগম কাস্টমার-পড়শি যাকে যখন পান, কথাটা বলেন। কষ্টে না গর্বে, ঠিক বোঝা যায় না। তবে দিনের পর দিন কাজটা করতে করতে মরিয়ম একসময় বিগড়ে যায়। তার মনে হয়, সে তো পুনর্বাসনকেন্দ্রের কাজই এখনো করছে। জীবন থেকেই যে উদ্বাস্তু, একটা সামান্য মেশিন তার পুনর্বাসন করে কীভাবে। এ কি সম্ভব? এই যে আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে ফোঁসকা পড়ে গেছে, যন্ত্রণায় শিরদাঁড়া টনটন করছে, পায়ে সারাক্ষণ ঝিঁঝি ধরে থাকে–এসব কীসের জন্য। একলা মানুষের পেট তো একটাই। তার বাইরে শরীরের আরো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আছে। তা ছাড়া জীবমাত্রই শুধু শরীর নয়। একটা মেশিনের ওপর সারা দিন উপুড় হয়ে পড়ে থাকা-বেঁচে থাকার নামে নিতান্তই অপচয়। তার কাপড় কাটায়, সেলাইয়ের ফোঁড়ে ঘনঘন ভুল হতে থাকে। একদিন ব্লাউজের হাতা উল্টো সেলাই করে, রঙিন টুকরা কাপড়ের পাহাড় ভেঙে, সুতোর জাল ছিঁড়ে, মেশিন ঠেলে সরিয়ে সে উঠে পড়ে অসময়ে। বারান্দার বেঞ্চি থেকে মনোয়ারা বেগম হা-হা করে ওঠেন, কাজটা ভালো হচ্ছে না মরিয়ম। এক ডজন বেলাউজের ডেলিভারির ডেট আইজ। লোকজন আইস্যা বইস্যা থাকব। রুটি-রুজি নিয়ে মশকরা চলে না, মা।’ এর জবাবে গুচ্ছের থালাবাসন রান্নাঘরের মেঝেতে সশব্দে ফেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় মরিয়ম।
শিরীষ অরণ্যের প্রেমিক-প্রেমিকারা এখনো ক্লাসরুমে, হয়তো লেকচার শোনার ফাঁকে ফাঁকে লুকিয়ে ঘড়ি দেখছে। নতুন মুচি রাস্তার বাঁ পাশ থেকে ডান দিকের ফুটপাতে সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়লে জাঁকিয়ে বসবে। ওদিকটা এড়িয়ে আজিমপুরের দিকে চলে যায় মরিয়ম। সুমন বাসায় নেই। আবেদ সামির ব্যর্থ লেখার দলা পাকানো মুঠো মুঠো কাগজের মাঝখানে চোখ লাল করে বসে আছে। চুল উশকোখুশকো। মেজাজ রুক্ষ। দরজা খুলেই কী চাই’ বলে মরিয়মকে সম্ভাষণ জানায়। মেরিও তখন খাট্টা মেজাজে। আর যা চাই, তোমাকে নয়। সুমন কোথায়? প্রশ্নটার জবাব না শুনেই সে সুমনের ঘরের দিকে ঘটঘট করে হেঁটে যায়। তক্তপোশের নোংরা চাদরে বসতে খানিক ইতস্তত করে। এর কারণ চাদরটা নোংরা, নাকি ঘরের মালিকের অনুপস্থিতি? মরিয়মের মনে হয়, দুটোই। যুদ্ধের নয় মাস বীভৎস নোংরায় থেকে, সে তাতে অভ্যস্ত তো হয়ইনি বরং খুঁতখুঁতে স্বভাব নিয়ে ফিরেছে। তবে ঘরের মালিকের অনুপস্থিতিটা এখন তাকে একরকম স্বস্তি দেয়। কিছুটা সময় অন্তত একা থাকা যাবে। বাড়ি থেকে রাগারাগি করে এসেছে, তার মধ্যে আবেদ সামিরের এমন উকট মেজাজ, এ পুরুষগুলো নিজেদের ভাবে কী? লিখতে না পারলেও মেয়েদের দোষ? এখানে না এসে শিরীষতলার ফুটপাতে বসে থাকা কি ভালো ছিল না? কী ভালো ছিল! তেল চিটচিটে ওয়াড় একটানে খুলে উলঙ্গ বালিশটা মাথার নিচে ঠেসে দিতে দিতে সে ভাবে–স্বপ্নটপ্ন সব বোগাস। পুরোনো হলে তো আরো।
তার পরও সুমনের বিছানায় শুয়ে মরিয়ম পুরোনো দিনের একটা স্বপ্ন দেখে। মেজর ইশতিয়াক রাইফেল কাঁধে ঢাকার ট্রাফিক কন্ট্রোল করছে। সিগন্যাল পোস্ট থেকে নেমে হুইসেল বাজাতে বাজাতে সে মরিয়মের দিকে লেফট-রাইট করে আসে। এখানে কেন এসেছে লোকটা! যাদের জন্য মন্টু মৃত, সে আজ পথে পথে-তার এখানে আসার দরকারটা কী? মেজরের মুখে কথার খই ফোটে। সে বলে, মায়া। কী করব, মায়া ছাড়তে পারি না! মরিয়ম মনে মনে ভাবে, মায়া না ছাই, গোলাম মোস্তফা তার গার্জিয়ান তো, তিনিই মেজর ইশতিয়াককে আনিয়েছেন। লোকটা এসেছেই যখন, তাদের এখন বিয়ে হবে। যুদ্ধের কারণে মেরির তো বিয়েই হচ্ছে না। মেজর ইশতিয়াক বিয়ের প্রসঙ্গ পাশ কাটিয়ে লাজুক হেসে বলে, এ দেশটা আমার জন্মস্থান। মরিয়ম অবাক, জন্মস্থান? মেজর বলে, না আবার! এই দেখো আমি কী সুন্দর রবীন্দ্রসংগীত গাই-সহে না যাতনা, দিবস রজনী…
মরিয়ম গানের মাঝখানেই বুঝতে পারে, তাদের বিয়েটা হবে হবে করে এবারও হবে না, আজিমপুরে সুমনের বাসার ময়লা বিছানায় শুয়ে সে আসলে একটা স্বপ্ন দেখছে। গান গাইছেন দেব্রত, পাশের বাড়ির রেকর্ড প্লেয়ারে। এতখানি বুঝতে পারা সত্ত্বেও তার ঘুম ভাঙে না। স্বর্ণলতার মতো একটা স্বপ্ন তাকে কোমলভাবে জড়িয়ে রাখে। সূর্যটা পশ্চিমাকাশে। মেজর ইশতিয়াক পলাশীর মোড়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরায়। তার চেহারাটা অফিস-ফেরত কেরানির মতো। হাতে ব্রিফকেস। মরিয়ম তার স্ত্রী। মেজর হাত তুলে স্ত্রীকে শিরীষ অরণ্যে যেতে বারণ করে। কেন? মরিয়ম নিষেধ মানতে একদম রাজি নয়। মেজর বলে, কারফিউ চলছে ওখানে। প্রবেশ নিষেধ। মরিয়ম যাবেই, লোকটা কিছুতেই যেতে দেবে না। প্রথম দিনের মুচি বিবাদ মিটাতে এসে বুকে গুলি খায়। না-আ-আ-স্বর্ণলতার বাঁধন ছিঁড়ে মরিয়ম এক লাফে বিছানায় উঠে বসে। দরদরিয়ে সে ঘামছে। বিকালের রোদতপ্ত বিছানা, আলনার লুঙ্গি-গেঞ্জি, স্থান সম্পর্কে তাকে বিভ্রান্ত করে। স্বপ্নটার চেয়েও এমন জায়গায় তার ঘুমিয়ে পড়াটাই যেন বিসদৃশ বেশি।