আজিমপুর গোরস্থানসংলগ্ন দু’কামরার ব্যাচেলর কোয়ার্টার। মাথার ওপর লম্বা দড়িতে লুঙ্গি-জাঙ্গিয়া গামছা জড়াজড়ি করে ঝুলছে। বাথরুমটা নোংরা, সাবানজলে স্যাঁতসেঁতে। সেখানে বাসি তামাকের কটু দুর্গন্ধ। রিকশায় উঠে বসতে যারা মরিয়মকে ইশারা করে, তাদের ঘরদোর যেমন হতে পারত, অবিকল সেরকম। মরিয়মের মনে হয়, তার দেখা কোনো দুঃস্বপ্নের সঙ্গে দৃশ্যটা হুবহু মিলে যাচ্ছে–যা ভয়ানক অস্বস্তিকর। কিন্তু সে চাইলেও বাসাটা থেকে এখন বেরিয়ে আসতে পারছে না। আর যা-ই হোক স্বেচ্ছায় এসেছে। ছেলে দুটিও খারাপ আচরণ করছে না। তাকে তারা বসতে দিয়েছে ঘরের একমাত্র চেয়ারের ধুলা ঝেড়ে। তাড়াতাড়ি ব্যালবটম ছেড়ে লুঙ্গি পরে সুমন রান্নাঘরে চা বানাতে গেছে। সেখান থেকে এক ফাঁকে দৌড়ে গিয়ে গলির দোকান থেকে বিস্কুট-কলা-চানাচুর কিনে এনেছে। প্রতিভাবান সেই তুলনায় স্থবির। মরিয়ম সুমনের অনুপস্থিতিতে তার সঙ্গে কী নিয়ে কথা বলবে বুঝতে পারে না। ছেলেটিও চুপ। লম্বা চুলে শুধু বিলি কাটছে। মনে হয়, সুমন যতখানি সরব কবিকে নিয়ে, সে ঠিক ততটাই নীরব। যেন একরকম দায়ে পড়ে ভক্তকে সহ্য করে যাচ্ছে। চা-বিস্কুট-চানাচুর সামনে সাজিয়ে দিয়ে সুমন ছেলেটির ছাপা, আ-ছাপা, খসড়াসহ এক গুচ্ছের লেখাপত্র বালিশের তলা থেকে টেনে বার করে। কাজটা করতে গিয়ে সে চাপাস্বরে লেখকের ধমকও খায়। তাতে তার আগ্রহ বাড়ে বৈ কমে না। বেচারা সুমন! উনসত্তর থেকে একাত্তর ছাত্রনেতা আবেদ ছিল তার গুরু, পঁচাত্তরে একজন লেখক। এখন তাহলে রাজনীতি থেকে মানুষের মন উঠে সাহিত্যে পড়েছে? আজ কি তারাই হিরো, যারা লেখে? মরিয়ম সুমনের মুগ্ধতার মধ্য দিয়ে বর্তমান সময়টা বোঝার চেষ্টা করে। কাগজগুলোর পৃষ্ঠা উল্টে সে দেখে, লেখকের নামও আবেদ। তবে সঙ্গে জাহাঙ্গীর নেই। সামির। আবেদ সামির-সাহিত্যিকের মতো নাম বটে।
২৪. মা-মেয়ে টেইলারিং
এ কোন সাহসে নারী
যাতনার এই সংসার দাও পাড়ি?
আকাশ ঝরায় বিজুলির রেখা
বাতাসে তুহিন নামে
তুমি স্থির, তুমি উদ্যত থাকো বামে
আল্লার তরবারি।
[আল মাহমুদ]
আবেদ সামির যেদিন সুমনের সঙ্গে মরিয়মদের বাসায় আসে, সেদিন সে রীতিমতো প্রগল্ভ। কাউকেই কথা বলতে দিচ্ছে না। তার মতে, কফিলউদ্দিন আহমেদের নাম ঠিকানা লেখা বাড়িটা ইতিহাসের টুকরো, মূল্যবান ভগ্নাংশ। আগাপাশতলা সংরক্ষণের দাবি রাখে। এমন বাড়িতে থাকার কথা লেখক-শিল্পীদের। দুঃখের বিষয়, যারা এখানে বাস করে তারা শিল্পীমনে হলেও প্রতিভা বিকাশের তাগিদ বোধ করছে না। সুমন সাহিত্যিক বন্ধুর বাতচিতে যারপরনাই গর্বিত। ঘন-ঘন মাথা নেড়ে সায় দিচ্ছে। মনোয়ারা বেগম আড়ালে ডেকে মেরিকে জিগ্যেস করেন, ‘অহ, মরিয়ম, পোলাডার মনে অয় মাথা খারাপ? ক্যামন মাইয়্যা মানষ্যের মতো চুল রাখছে! তুই যে দিনচুক্তি আসর বসাইছস, হেরা কাপড়-চোপড়ের অর্ডার দিব?’ তত দিনে তাদের রেডিমেড কাপড়ের জয়েন্ট ভেঞ্চারে লালবাত্তি জ্বলে উঠেছে। সেলাই মেশিনে মরচে পড়ার জোগাড়। সোনার ভাণ্ডও শূন্য। মনোয়ারা বেগমের মাথার ঠিক নেই। এদিকে মেয়ে। তার কথার জবাব না দিয়ে মুখ ঝামটা মেরে ফের আসরে ঢুকেছে।
মনোয়ারা বেগম বাইরে দাঁড়িয়ে আকাশ-পাতাল ভাবেন। মেয়েটা উচ্ছন্নে যাচ্ছে। তাকেই সংসারের হাল ধরতে হবে। তা যে-কোনো মূল্যেই হোক। তার রাগ কমতে কমতে ক্রমে ব্যবসায়িক বিবেচনায় রূপান্তরিত হয়। তিনি পেশাদার নট-নটীর মতো মেকআপ নিয়ে আসরে নামেন। এবার ঠান্ডা মাথায় ফ্লোর দখল করার পালা। অতি দ্রুত সাহিত্যের বিমূর্ততা থেকে আড়ার বিষয় দেশের পরিস্থিতির দিকে বাঁক নেয়। তিনি বলেন, ‘সৎপথে দু’পয়সা উপার্জন করে মানুষ যে চারটা ডালভাত খাবে–তার উপায় দেখি না। কী হইলো দেশটার!’ তারপর কথার পিঠে কথা চড়িয়ে মা-মেয়ের। বর্তমান বেহাল অবস্থার দিকে তার বক্তব্য আল টপকে চলে যায়। শ্রোতারা অস্বস্তি বোধ করে। তিনি উঠে গিয়ে চটকদার ডিজাইনের কয়েক সেট পোশাকের সঙ্গে সেলাই মেশিনটাও এনে বসান আসরের ঠিক মধ্যিখানে। ‘জানো তো বাবারা,’ মনোয়ারা বেগমের গলার গাম্ভীর্যে বাকি দুজন চমৎকৃত হলেও মরিয়ম বেশ উদ্বিগ্ন। তিনি থেমে থেমে বলেন, ‘আমার একমাত্র ছেলে মুক্তিযুদ্ধের শহিদ। হে কি যুদ্ধে গেছিল এই পোড়া দেশের জন্য? এ দেশটা অহন কার–কতগুলি চোরবাটপার, মজুতদার, কালোবাজারির।’ এমন কথার শেষে জনসভায় হলে হাততালি পড়ত। মরিয়ম আর আবেদ সামির হাত গুটিয়ে বসে থাকে। সুমন উঠে গিয়ে নেড়ে-চেড়ে দেখে কাপড়গুলো। তাকে চিন্তামগ্ন দেখায়। ছেলেটা পরোপকারী। মা-মেয়ের বেহাল অবস্থা নিরসনের প্রথম উদ্যোগ নেয় সে-ই।
সেদিনের আসরে বসে আবেদ সামিরের সাহিত্যিক বয়ানে মা-মেয়ে টেইলারিং’ এর পোস্টার লেখা হয়। মনোয়ারা বেগম রান্নাঘরে গিয়ে ময়দা গুলে আঠা তৈরি করেন। তারা জিগাতলা, রায়েরবাজার, ট্যানারির মোড়ের দেয়ালগুলোতে, লাইটপোস্টে আর গাছে গাছে রঙিন কাগজের পোস্টার লাগিয়ে দেয়। উদ্যোগটা অভিনব। পোস্টারগুলো দৃষ্টিনন্দন। মূল্যবৃদ্ধির বাজারেও দর্শকদের নতুন কাপড় বানাতে উদ্বুদ্ধ করে। তারা রঙিন ছিট কাপড় বগলে খুঁজে বা খবরের কাগজে মুড়ে কফিলউদ্দিন আহমেদের নাম-ঠিকানা লেখা বাড়িটাতে হাজির হয়। মনোয়ারা বেগম বারান্দায় লম্বা বেঞ্চি পেতে দিয়েছেন খদ্দেরদের বসার জন্য। মরিয়ম ফিতা দিয়ে তাদের বডির মাপ নেয়, কাচির নিচে কাপড় ফেলে কচকচ করে কাটে, ববিনে সুতো ভরে, ভনভন শব্দে মেশিনের হাতল ঘোরায়। তার চারপাশে টুকরা-টাকরা রঙিন কাপড়ের পাহাড় জমে ওঠে। তাকে সুতোর জাল ঘিরে রাখে সব সময়। আর গলায় দিনরাত প্যাচানো থাকে ডোরাকাটা সাপের মতো শরীর মাপ নেওয়ার একটা গজফিতা।