শিরীষ অরণ্যে বসে বসে মরিয়ম অন্যের স্বপ্ন নিজের চোখ দিয়ে দেখে। যদিও এসব শপ-উইন্ডোর ওপাশের সারি সারি দামি সামগ্রীর মতো তার নাগালের বাইরে আর ধরাছোঁয়ারও অতীত, তবু সে পরোক্ষ স্বপ্ন দেখা থেকে বিরত হয় না। সে স্বপ্নের কুয়াশাময় পথে হেঁটে হেঁটে প্রবেশ করে পাঁচ বছর আগের হারিয়ে যাওয়া এক নগরীতে। সেখানে মিছিল-মিটিং আর বক্তৃতার ফুলঝুড়ি। মানুষগুলো টগবগিয়ে ঘোড়ার মতো ছুটছে। প্রত্যেকের মুখে একটাই স্লোগান। প্রত্যাশাও সবার এক। অভুক্ত মানুষ, ভরপেট বা ভুড়িঅলা মানুষ, নাঙা মানুষ, সুটবুট পরা মানুষ–একযোগে তারা চায় স্বাধীনতা। এমন এককাট্টা, জটিলতাহীন, প্রাণবন্ত শহরে জানান না দিয়ে একদিন সৈন্য নামে। গুলির শব্দে, বারুদের গন্ধে আর বুটের আওয়াজে পাখির মতো ঝাঁক বেঁধে স্বপ্নরা পালিয়ে যায়। বাদামের ঠোঙা ফেলে প্রেমিকেরা চলে যায় যুদ্ধ করতে। প্রেমিকারা অরক্ষিত, ভাসমান। শত্রু সৈন্য তাদের তাড়া করে ঝোঁপঝাড়, পুকুরপাড়, গাছতলা থেকে ক্যাম্পে ধরে আনে। তখন মৃত্যু কি গর্ভধারণ তাদের অনিবার্য নিয়তি। যুদ্ধশেষে জীবিত প্রেমিক-প্রেমিকারা ফিরে আসে। তবে তাদের মিলন হয় না। শিরীষ অরণ্যে পুরোনো স্বপ্নের খোঁজে প্রেমিকার দুপুর-বিকাল কচুপাতা থেকে জলের ফোঁটার মতো নিঃশব্দে গড়িয়ে পড়ে।
সময় ভয়ানক প্রতারক। মরিয়মের কাছে নতুন কোনো স্বপ্ন দুপুর-বিকালগুলোতে আর ধরা দেয় না। তবে প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট জায়গায় একা বসে থাকার জন্যই হোক বা তার মাত্রাতিরিক্ত সাজসজ্জার কারণেই হোক, সে একসময় পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। এ-ও নতুন করে স্বপ্ন দেখার প্রথম ধাপ, যার অর্থ বয়সটাকে এই প্রেমিক-প্রেমিকার স্তরে নামিয়ে আনা। কিন্তু তার দিকে পুরুষগুলোর ইশারা-ইঙ্গিত সবই এক কিসিমের। তারা শুধু পাঁচ মিনিটের একটা সংগম চায়, দশ বিশ টাকার বিনিময়ে। আর এর জন্য অঙ্গুলিনির্দেশ করে তাকে যেতে বলে রমনাপার্ক বা খদ্দেরদের মেসবাড়িতে। আব্রুহীন পার্কের শয্যা বাদ দিলে বাকি থাকে মেসবাড়ি-ব্যাচেলর কোয়ার্টার। সেখানে একেকটা কামরায় তিন-চারজনের বাস। তাদের বাথরুম সাবানজল জমে নোংরা। তামাকের বাসি কটু গন্ধ মাকড়সার জালে ঝুলে থাকে। লোকগুলোর পানের রসসিক্ত দাঁত, কামার্ত চোখ মরিয়মের ভালোবাসাহীন দেহে সাড়া জাগাতে পারে না। তারা যখন রিকশার সিটের একপাশে সরে বাকি অর্ধেকটায় তাকে ইশারা করে বসতে, সে তখন মুখ ঘুরিয়ে পাশের প্রেমিক যুগলের দিকে তাকিয়ে থাকে। কারণ সে কাম নয় স্বপ্ন চায়, তা শপ উইন্ডোর নিচ্ছিদ্র কাঁচের মধ্য দিয়ে হলেও। সেই অবস্থাটাও তার প্রতিকূল। প্রেমিক-প্রেমিকার নিবিষ্টতায় লজ্জা পেয়ে সে ফের রাস্তার দিকে তাকায়। কোনো-কোনোদিন গাছ থেকে কাকের বিষ্ঠা পড়ে মাথায়। মরিয়ম চারদিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি চুলে-বেণিতে রুমাল ঘষে। এখানে বসে থাকার আর কোনো অর্থ থাকে না। প্রেমিক যুগলদের কটুক্তি শুনে বিতাড়িত হওয়ার আগে, সেসব দিনে সে ফুটপাতের আসন ছেড়ে আগেভাগে উঠে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পলাশীর মোড়ে এসে রিকশার জন্য দাঁড়ায়। সেখানে প্রথম দিনের মুচির জায়গায় নতুন মুচি। মাথা নিচু করে একই ভঙ্গিতে ছেঁড়া জুতো সেলাই করছে। লোকটা মরিয়মের ক্লান্ত পায়ে ঘষটে ঘষটে চলার শব্দ শুনে মুখ তুলে তাকায়। তবে তাকে না দেখে, তার পাশে প্রথম দিনের মুচির চোখ দিয়ে যেন আবেদকে খোঁজে। মরিয়ম ভাবে, সে হয়তো নতুন করে গড়ে ওঠা পাশের বস্তিটারই বাসিন্দা, ফের যুদ্ধ বাধলে রাত বারোটার পর প্রথম দিনের মুচির মতোই যে সপরিবারে পুড়ে ছাই হবে।
যদি আরেকটা যুদ্ধ হয় জ্যান্ত পুড়ে ছাই হবে যে, সেই মুচির চোখ একদিন মরিয়মের হেঁটে আসার পথে আটকে যায়। দুজন রিকশা আরোহী মেয়েটিকে অনুসরণ করে করে শিরীষ-অরণ্য থেকে পলাশীর মোড় পর্যন্ত চলে এসেছে। তাদের একজনের চোখে সানগ্লাস, পরনে ব্যালবটম প্যান্ট আর গায়ে চকরা-বকরা প্রিন্টের শার্ট। অন্যজন সাধারণ পোশাকের, মাথাভর্তি লম্বা চুল। বাক্স-পেটরা ছেড়ে মুচি হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়তে মরিয়ম পেছন ফিরে তাকায়। সানগ্লাস পরা লোকটি ততক্ষণে রাস্তায় নেমে তার দিকে দ্রুত এগিয়ে আসছে। মুখটা আশ্চর্য রকমের হাসি হাসি। মরিয়ম ফুটপাতের সাদা দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়ে এবং চোখ থেকে সানগ্লাস না-খোলা পর্যন্ত আবেদের একসময়ের গোবেচারা রুমমেট সুমনকে চিনতে পারে না। এ নিয়ে ওরা তিনজনই হেসে কুটিকুটি, মুচি ছাড়া। সে ততক্ষণে মাথা নিচু করে ছেঁড়া জুতো ফের সেলাই করতে লেগে গেছে।
সুমন এখন একজন রোজগেরে যুবক। বলে, চাকরি না পেয়ে কন্ট্রাকটরি করছে। আজিমপুরে বাসা। এখান থেকে হাঁটা পথ। আর পাশের ছেলেটি চাকরি-বাকরি কিছু করে না। লেখালেখির হাত আছে। তার প্রতিভার সমঝদার সুমন। ছেলেটার প্রতি সুমনের সমীহভাব চোখে পড়ার মতো। মরিয়মকে তারা বাসায় যাওয়ার আমন্ত্রণ জানাতে এক কথায় সে রাজি হয়ে যায়। তা নতুন মুচির পছন্দ হয় না। মেয়েটি রোজ চটি-ঘষটে তার ধ্যানভঙ্গ করে একা একা এ পথ দিয়ে বাড়ি ফিরেছে। নতুন মুচিও তাতে স্বস্তি পেয়েছে। আজ যুবকদের সঙ্গে মরিয়মের চলে যাওয়া দেখে, প্রথম দিনের মুচির চেনা আবেদ-মেরি জুটির জন্য তার বুক ছেড়ে ছোট্ট একটুকরো দীর্ঘশ্বাস পাখির মতো ডানা ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে উড়ে যায়।