গোলাম মোস্তফার কথা শেষ হওয়ার আগে মনোয়ারা বেগম ভাইয়ের সামনে থেকে অভুক্ত নাশতার প্লেট দু’হাতে টেনে নিয়ে রান্নাঘরে চলে যান। সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন যখন, তখন তার চোখ দুটি টকটকে লাল। তাতে পানি নেই। শুকনো খটখটে। বারুদের সামান্য ঘষা লাগলেই দাউদাউ জ্বলে উঠবে। গোলাম মোস্তফা ‘জরুরি একটা মিটিং আছে’ বলে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালে মনোয়ারা বেগম গর্জে ওঠেন, ‘যাস কই মোস্তফা? খাড়া!’ গলাটা তার ওই উঁচু থেকে হঠাৎ খাদে নেমে আসে। তিনি থেমে থেমে দম নিয়ে বলেন, ‘তুই আমার মরা মুখ দেখবি, আর কোনো দিন যদি মন্টুর নাম এ বাড়িতে উচ্চারণ করছস।’
দুপদাপ করে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যান গোলাম মোস্তফা। কিন্তু মনোয়ারা বেগমের অভিশাপ, ভর্ৎসনা কিছুতেই থামে না। ‘চামার চামার, ভাইটা আমার চামার। অমানুষ। যে আগুনে আমি জ্বলছি, খোদা য্যান তারে সেই আগুনে পোড়ায়। নিজের পোলার মরা-মুখ তুই দেইখ্যা মরবি মোস্তফা–এই আমি কয়ে রাখলাম।’
কথাগুলো গোলাম মোস্তফার কানে না পৌঁছালেও এসব বলে বলে মনোয়ারা বেগমের মনটা একসময় হালকা হয়। ভাই চলে যাওয়ার পর তিনি ট্রাংক থেকে পাটভাঙা শাড়ি খুলে যত্নসহকারে পরেন। ভাঙাচোরা চোয়াল, চোখের কোল, কপালে পাউডার ঘষে, পানের খিলি মুখে পুরে, হিল খটখটিয়ে পাড়া বেড়াতে বের হন। মনোয়ারা বেগম মরিয়মের তৈরি রেডিমেড পোশাকের মার্কেটিং ম্যানেজার। মানুষের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে বলেন, ‘আমার বড় মেয়ের হাত দুইটা সোনার মতো খাঁটি। ভেজাল নাই বাজারের জিনিসের মতো। পেটিকোট, ব্লাউজ (হাতঅলা, হাতকাটা), ব্যালবটম, কোর্তা অর্ধেক প্রাইজে হে সেলাই কইর্যা দিব। আপনেরা যাইবেন গো হেই বাঁশঝাড়অলা (এখন হাস্নাহেনার ঝোঁপ) বাসায়!’
পাড়ার পুরোনো বউ-ঝিদের স্মৃতিতে বাঁশঝাড়টা অম্লান। তবে হাস্নাহেনা ফুলের গন্ধ শুঁকে শুঁকে বাড়ি চিনে তারা আসে। এ বাড়ির ছেলেটা যুদ্ধে মারা গেছে। মেয়ে বীরাঙ্গনা। মায়ের আমন্ত্রণে তারা আসে আসলে মেয়েকে দেখতে। মাও দ্রষ্টব্যের বিষয়। কিন্তু ছেলের জন্য মনোয়ারা বেগমের কোনো শোকতাপ আছে বলে তাদের মনে হয় না। তারা শুধু তার বাইরের ঠাটবাটই দেখে। মায়ের ভেতরটা যে ঘুণে ধরা, কুটকুটিয়ে দিনরাত কাটছে, তিনি যে খুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছেন–সেসব বোঝার ক্ষমতা নেই মেয়েগুলোর। মনোয়ারা বেগম তাদের মনের গতিবিধি, চোখের চাহনি পরখ করে যারপরনাই হতাশ হন। আনকোরা সেলাই মেশিনটা তারা দেখেও দেখে না। মেরির সোনার হাতের দিকে তাদের নজর নেই। নতুন ডিজাইনের সুন্দর সুন্দর জামাকাপড়গুলো একপাশে সরিয়ে, মিলিটারির নষ্ট করা শরীরটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার পর নাশতার সঙ্গে ঘন দুধের চা খেয়ে উঠে পড়ে। মনোয়ারা বেগম অভ্যাসবশত। অতিথিদের গেট পর্যন্ত এগিয়ে দেন। তারা ঘরের ভেতরের চেয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলা পছন্দ করে বেশি। একথা-সেকথার পর শেষ পর্যন্ত বলে ফেলে, ‘মাইয়্যার রোজগার খাইলে চলব। বিয়া দিবেন না? অথবা বিয়া দ্যান না ক্যান। নাকি সম্মন্ধ আসে না?’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে পাড়ার মহিলারা যে যার মতো চলে যায়। মনোয়ারা বেগম গজগজ করতে করতে ঘরে ফিরে হিসাবপত্র নিয়ে বসেন। চা-নাশতা আটআনা আটআনা এক টাকা। পান এক খিলি দুই পয়সা। ‘অহ্ মরিয়ম, মাইয়্যালোকগুলি কি খাইয়্যা খাইয়্যা চইল্লা যাইব? কাজ দিব না? তুই নিজেও দুবছস। আমারেও ডুবাইছস।’
তারপর আর ভালো কোনো কথা থাকে! তারা কে কাকে কতখানি ডোবাচ্ছে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে তা জাহির করে। সোনার ভাণ্ড যত ফুরিয়ে আসে, তাদের বচসা তত বেড়ে যায়। মরিয়ম একদিন অতিষ্ঠ হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। রাগটা তার নিজের ওপরই বেশি। সে এমন কেন যে, আপন মায়ের সঙ্গেও তার বনিবনা হয় না! পৃথিবীর কোন জায়গায় এ মেয়ের ঠাই হবে। যুদ্ধের আগেও সংকটে পড়লে ফুলার রোডের শিরীষ অরণ্য তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকত। এর জাফরি-কাটা ছায়ায় মরিয়মের স্বপ্নগুলো একদিন ডানা মেলে উড়তে শিখেছিল। এবারও বাড়ি থেকে বেরিয়ে সে ছুটে যায় হারানো সেই স্বপ্নের উৎসস্থলে। জায়গাটা আগের মতোই কোলাহলপূর্ণ। তবে কাক তাড়ানো সেই মিছিল-স্লোগান আর নেই। দেয়ালগাত্র থেকে দাবিদাওয়া মুছে ফেলা হয়েছে। দীর্ঘদিনের সংগ্রাম-আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটেছে তাহলে! নাকি মানুষগুলো ক্লান্ত? মরিয়ম তখনো স্বর্ণযুগে। তাই জানে না যে, দেশে এখন জরুরি অবস্থা চলছে। সভা-সমিতি, শোভাযাত্রা, ধর্মঘট, লকআউট নিষিদ্ধ।
মরিয়ম সাদা দেয়ালের পাশ ঘেঁষে স্লোগানহীন রাস্তা দিয়ে হাঁটে। ক্লান্ত হলে বসে পড়ে ধুলিমলিন ফুটপাতে। মাথার ওপর প্রাচীন শিরীষ বৃক্ষের কারুকাজময় ছত্র। নিচে নতুন নতুন প্রেমিক যুগল বাদাম ভেঙে একে অন্যকে দিয়ে খাচ্ছে। তাদের স্বপ্নগুলো মনে হয় অলীক, কুয়াশাময়। মরিয়ম অদূরে বসে আছে কি নেই, তা তাদের চোখে পড়েও যেন পড়ে না। বিকালের দিকে প্রেমিক-প্রেমিকার সংখ্যা দ্রুত বেড়ে জায়গাটায় ভিড়ভাট্টা লেগে যায়। মাছবাজারের মতো গমগম করে। তখন বসার বিশেষ জায়গা মেলে না। মরিয়ম জোরপূর্বক কখনো-সখনো বসে থাকলে তারা নানারকম কটুক্তি করে তাকে তুলে দেয়। একে তো সে সঙ্গীহীন-একা, তার ওপর এখানে বয়সের হিসাবও বড্ড কড়াকড়ি। মরিয়মের যে বয়স বাড়ছে, প্রেমিকদের কথা শুনে সে বুঝতে পারে। তার পরও স্বপ্নের উৎসস্থলের অধিকার সে ছাড়ে না। বাসায় মায়ের তিরিক্ষি মেজাজ, লবণের অভাবে কাছাকাছি ট্যানারিগুলোর চামড়া-পচা দুর্গন্ধ। সকালে ঘুম থেকে উঠেই মরিয়মের বাইরে বেরোনোর প্রস্তুতি শুরু হয়। কিন্তু দুপুরের আগে সে বাড়ি থেকে বের হয় না। যে সময়টায় শিরীষ অরণ্যের প্রেমিক-প্রেমিকারা ক্লাসরুমে লেকচার শোনার ফাঁকে ফাঁকে কবজি উল্টে ঘড়ি দেখে, মরিয়ম তখন তৃক আর কেশচর্চায় ব্যস্ত থাকে। মনোয়ারা বেগম হঠাৎ করে মেয়ের এ সাজসজ্জার ঘটা দেখে তাজ্জব। তবে বোঝেন যে, দোষটা বয়সের। কিন্তু মেয়ে আলাদা সংসার পাতলে তার কী গতি হবে? অথবা সে যদি রান্ডি হয়ে যায়? ধরা যাক, মেয়ে রান্ডি হলো না, কলমা পড়ে ফের বিয়েই করল, এরপর তার বাচ্চা হলো। মনোয়ারা বেগম জানেন, মেরির। কোলের সন্তান তার পুত্রশোক কমাতে পারবে না। হতাশায় ঘরের জিনিসপত্র যখন তখন তিনি হাত থেকে পাকা মেঝেতে ফেলে দেন। তুলতে তুলতে আবার ফেলেন। মেয়েকে কী বলবেন বুঝতে পারেন না। মরিয়ম যখন শাড়ির আঁচল উড়িয়ে, প্রসাধনের সুবাস ছড়িয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়, তখন তিনি নির্বাক। তবে বিশ্ব নারীবর্ষের ‘৭৫ সালে মা হব না’ স্লোগানটি, যা মেয়ের মুখ থেকে শোনা, তা চৌকাঠে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মন্ত্রের মতো জপতে থাকেন। মনোয়ারা বেগমের ভয়ার্ত মুখে একসময় দুষ্ট হাসি খেলে। তিনি কফিলউদ্দিন আহমেদকে একটা সংক্ষিপ্ত চিঠি লেখার পরিকল্পনা করেন। তাতে শুধু এই কথাটাই থাকবে—’৭৫ সালে মা হব না।’ ছেলে-ছেলে করে যে লোক খেপেছে, তার জন্য এ হবে উচিত শিক্ষা। ভাবনাটা মনোয়ারা বেগমকে অতিশয় আনন্দ দেয়।