পরদিন শহরে জয় বাংলা পতাকার সাজ। রাস্তার দু’পাশের বাড়িগুলোর মাথায় নতুন দেশের মানচিত্র আঁকা লাল-সবুজ পতাকা পতপত করে উড়ছে। মরিয়মের রিকশার ঘণ্টিতে একটা ছয় ইঞ্চি পতাকা সুতো দিয়ে পাটখড়ির দণ্ডে বাঁধা। টুংটাং আওয়াজের ছন্দে হেলেদুলে নাচছে। স্বায়ত্তশাসন বা স্বাধীনতা যদিও মরিয়মের সংকটের দাওয়াই নয়, তবুও মনে তার অশেষ আনন্দ। সে এসএম হলের গেটে নেমে ফেরিঅলার কাছ থেকে কিনে নেয় এক টাকায় দুটি পতাকা। এই তো টাকায় কেনা পতাকা–স্বাধীনতা, রক্তপাত ছাড়াই তার হাতে চলে এসেছে! সে স্বাধীনতার ঝান্ডা উড়িয়ে আবেদের কক্ষে প্রবেশ করে।
মরিয়ম চূড়ান্ত বোঝাপড়া করতে এসএম হলে এসেছে। কিন্তু আবেদের ক্ষুব্ধ চেহারা দেখামাত্র স্বাধীন বাংলার পতাকা দুটি তার হাতের মুঠোয় ভাঁজ হতে থাকে। পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়ে যায়। সে তালগোল পাকিয়ে খাটের কোনায় পা ঝুলিয়ে বসে। পড়ে। আবেদ সুস্থির হয়ে তাকালেই দেখতে পেত–রাত-জাগা মেয়েটি ভীষণ অবসন্ন, ভয়ে দিশাহারা, একটুখানি আশ্রয়ের জন্য তার কাছে ছুটে এসেছে। সেদিকে তার চোখ নেই। আজ ২৩ মার্চ। পাকিস্তান প্রজাতন্ত্র দিবস রূপান্তরিত হয়েছে বাঙালির প্রতিরোধ দিবসে। সকালবেলা অনেকগুলো দূতাবাসসহ হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে জয় বাংলার পতাকা উড়িয়ে এলেও আবেদের মনের ওপর আশঙ্কার পাহাড়। পতাকা তো একখণ্ড কাপড়, ত্যানা। ওড়ানো-নামানো দুমিনিটের ব্যাপার। এদিকে ইয়াহিয়া-ভুট্টোর সঙ্গে অসংখ্য সেনা-সামন্ত এখন ঢাকায়। জলপথে ভারী অস্ত্রশস্ত্র পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসছে। এসবের ভেতর শুধু শুধু কতগুলো দিন আলোচনার নামে সাবাড় হচ্ছে। মূল্যবান একেকটা দিন। এর দাম কে দেবে? রুমের মধ্যিখানের স্তূপ করা মশারির স্ট্যান্ড, লাঠি, রড, সুরকি, হাতবোমা বানানোর মশলার প্যাকেট–সব ধরে ধরে তার ছুঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। এ দিয়ে হবে যুদ্ধ! ৩২ নম্বরে গিয়ে শেখকে সরাসরি জিগ্যেস করা দরকার, তিনি এভাবে অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে কত দিনে দেশটা স্বাধীন করবেন। নাকি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার খোয়াব ত্যাগ করতে পারছেন না, এত কিছুর পরও। তিনি জনগণকে বলছেন, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো, আন্দোলন অব্যাহত রাখে। আর নিজে প্রেসিডেন্ট ভবনে বসে ইয়াহিয়া-ভুট্টোর সঙ্গে মাছ কেনার মতো দর-কষাকষি চালিয়ে যাচ্ছেন।
আবেদ আর মরিয়মের মাঝখানে বসে পা দোলাতে দোলাতে রুমমেট সুমন নাটকীয়ভাবে বলে, ‘আবেদ ভাই, নেতারা যা-ই করুক, আমাদের কিন্তু পেছন হটার উপায় নেই।’
মরিয়ম ঘরে ঢোকার আগে কোনো কথার সূত্রেই হয়তো কথাটা বলেছে সুমন। যদিও পরিস্থিতি ততক্ষণে পাল্টে গেছে। ঘরে যে তৃতীয় ব্যক্তি উপস্থিত আরেকটি ঘোরতর সমস্যা নিয়ে, দু’রুমমেট তা গ্রাহ্যই করে না এবং করবে বলেও মনে হয় না। মরিয়ম তাই সুমনের কথার পিঠে তাড়াতাড়ি বলে, ‘আমারও পেছন হটার উপায় নেই।’
কথাটার অর্থ বোঝে একা আবেদ। তীক্ষ্ণ চোখে ঝট করে সে মরিয়মের দিকে তাকায়। সুমন ভেবেছিল, হেঁয়ালিই হচ্ছে, এ ছাড়া মেয়েটার কথার এমন কী অর্থ আছে যে, নেতার রেগে যেতে হবে? কিন্তু আবেদের জ্বলন্ত দৃষ্টি তাকেও বিদ্ধ করে। সে মানে মানে ঘর ছেড়ে বারান্দায় চলে যায়।
আবেদ তখন চেঁচিয়ে ওঠে, ‘তোমার পেছন হটার উপায় নেই, কথাটার মানে কী?’
তার স্বরে চ্যালেঞ্জ ছিল, দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহ্বান ছিল। মরিয়মের গলা যেন একখণ্ড ভেজা কাঠ। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে সে বলে, ‘আবেদ, তুমি ভালো করে জানো, আমি কী বলতে চাই।’
‘না, আমি জানি না, কিছু জানতে চাই না।’ সে বসা থেকে চিৎকার করতে করতে উঠে দাঁড়ায়। ‘যা বলার খোলাখুলি বলো। এসপার-ওসপার হয়ে যাক।’
মরিয়মের ভয় লাগে। তবু মনে মনে হিসাব করে বলে, ‘এসপার-ওসপার আবার কী। যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। তার জন্য আমি তোমাকে দায়ী করছি না।’
‘দায়ী! কীসের জন্য দায়ী হব আমি? একহাতে তালি বাজে?’
আজকে আবেদের সঙ্গে কথা বলার জো নেই। সবকিছুর শেষ দেখতে চায় ও-মরিয়মের সঙ্গের সম্পর্কের, স্বাধীনতার জন্য আন্দোলনের। সে আজ মারমুখী, যুদ্ধংদেহী।
মরিয়ম ভেতরে ভেতরে রিক্ত হতে থাকে। এখান থেকে বেরিয়ে কী করবে সে। কোথায় যাবে। আবেদের সঙ্গে লতার মতো জড়িয়ে থাকার শেষ চেষ্টাস্বরূপ সে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় কাঠের রাইফেল দিয়ে ট্রেনিং নেওয়ারও প্রস্তাব দেয়। তাতে আগুনে যেন তেল পড়ে। তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে আবেদ। ‘যুদ্ধ! যুদ্ধ করবে তুমি? যুদ্ধ কোনো ছেলেখেলা নয়। হাসপাতালে না গিয়ে এখানে আসছ কেন?’
‘হাসপাতালে যাব না তো বলেছিই!’ মরিয়ম ডাইনির মতো গোঁ ধরে। আবেদ তাকে বাসায় যেতে বললে, ও বলে, বাসায়ও যাবে না। ওখানে একা থাকতে তার ভয় লাগে। জানালা দিয়ে লোকটা এখন খালি তাকায় না, কী যেন ইঙ্গিত করে। দোতলার লোকটার দুঃসাহস নিয়ে মরিয়ম আরো কীসব বানিয়ে বানিয়ে বলতে যাচ্ছিল, আবেদ মাঝখানে চেঁচিয়ে ওঠে, মন্টু কোথায়? ওর মাথায় বাড়ি মারতেছে না ক্যান?
‘মন্টু বাড়ি চলে গেছে। আমিই বলে-কয়ে ওরে পাঠাই দিছি। তুমি তো আজকাল মন্টুর সামনে অস্বস্তি বোধ করো!’
মরিয়মের ইঙ্গিতময় কথায় আবেদের কী যেন মনে পড়ে। সংগ্রাম-আন্দোলনের বাইরের তুচ্ছ কিছু। একেবারে বাতিল করার মতোও নয় আবার। শরীর থাকলে এর খাঁই থাকবেই। হতাশার সমুদুরে ডুবে থাকা কামনা ফের ধীরে ধীরে মাথা তোলে। সে খোলা দরজা দিয়ে বারান্দায় তাকায়। সুমন ওখানে নেই। আবেদ এগিয়ে এসে। মরিয়মের বাহু ধরে কাছে টানে। মেয়েটি অসাড়। আবেদ বিরক্ত হয়ে গম্ভীর গলায় বলে, ‘শহরের অবস্থা ভালো নয়, মেরি। তুমি দেশের বাড়ি চলে যাও।’