রক্ত ঝরার ভেতর দিয়ে আত্মসমর্পণের নতুন অধ্যায় সূচিত হয়। মরিয়ম অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় আবেদকে শুধু প্রেমিক ভাবা তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। স্বামীই ভাবতে হচ্ছে। যদিও নিজের জন্য একটা চাকরি, বাসা, বউ, বাচ্চা–এসবের মধ্যে আবেদ আর নেই। ক্ষমতা, রাষ্ট্র, আন্দোলন নিয়ে এখন তার কারবার। কথাও বলে শুধু এসব বিষয়ে। এমনকি তাদের সংক্ষিপ্ত শয্যায় মরিয়ম যখন জোঁকের মতো তাকে আঁকড়ে ধরে, যা বাহ্যত গভীর আলিঙ্গন, তখনো।
মরিয়ম-আবেদের শরীরী সম্পর্কের তিন মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। প্রথম কটি সপ্তাহ আবেদ ছিল দিশাহারা। মরিয়মের কাছে এলে মন পড়ে থাকত বাইরে, আর বাইরে থাকার সময় মনটা থাকত মরিয়মের কাছে। একদিকে দেশ, আরেক দিকে নারী। দুজনেরই গা থেকে তত দিনে পোশাক সরে গেছে। কামজ্বরে ফুটছে তার সামনে দুটি নগ্ন শরীর। কোথাও যেন স্বস্তি নেই। মনহীন শরীরটাই তখন তার রাতদিনের সঙ্গী। তাই শরীরের উপস্থিতি শুধু প্রকট হয়ে ওঠে বিছানায়, রাজপথে সর্বত্র। ক্রমে মরিয়মের কাছ থেকে শরীরটা তুলে নিয়ে, মনের সঙ্গে শরীরের সমন্বয় সে ঘটায় বাইরে। যার বিস্তার ৫৬ হাজার বর্গমাইল, সম্ভাবনাও প্রচুর। সেখানে কয়েকটা শব্দের বা সংকেতের যেমন, গাঢ় সবুজের বুকে লাল টুকটুকে সূর্য, সূর্যের মাঝখানে সোনালি মানচিত্র আঁকা পতাকার, জাতীয় সংগীতের আর স্বাধীনতার কী দুর্মর আকর্ষণ! ভাগ্যের অজুহাতে নিজেদের দুর্দশাকে আর মেনে নেওয়া যায় না। অতীত ভোজবাজির মতো ধুলায় মিলিয়ে যাবে, তারপর যা হবে, সব ভবিষ্যতের জঠরে। এর মাঝখানে আছে লড়াই। এক অসম যুদ্ধ-ক্ষমতাসীনের বিরুদ্ধে ক্ষমতাহীনের; ট্যাংক, কামান, রকেট, বিমান আর মেশিনগানের বিপরীতে বোমা, পটকা, লোহার রড, মলোটভ ককটেল, টু-টু বোর রাইফেল, টেটা, বল্লম আর লাঠি। ঘরোয়া হাতিয়ারগুলো বিদ্রোহীর করতলের উত্তাপে ঝলকায়। কে কাকে সামনে টানে, উত্তেজনা জোগায়–বিদ্রোহী, না তাদের হাতের অস্ত্র-অস্ত্রধারীও জানে না। উভয়ে এতটাই বেপরোয়া।
আবেদকে আর চেনা যায় না। কখনো-সখনো তার সঙ্গে মরিয়মের এখন দেখা হয়। বাকি সময় মেয়েটার কাটে এক অদ্ভুত ঘোরে। থেকে থেকে চমকে ওঠে সে। ফুলতলি গায়ে বাবা-মার কাছে ফেরার পথ নেই। তার সামনে রয়েছে বাঁচা-মরার সমতুল্য এক অগ্নিপরীক্ষা।
তখন দেশের সামনেও কঠিন পরীক্ষা। মন্টু চলে যাওয়ার সময় বলেছিল, ‘মেরিবু ঠিক আছে আমি যামু তুইও চল, সামনে যুদ্ধ।
‘যুদ্ধ তো কী? করবে তো আবেদরা।’ সেদিন মরিয়মের কথার পিঠে মন্টু আর কথা বলেনি। বোন আর দু-চারটা দিন ঢাকায় থাকতে চাচ্ছে–থাকুক। কফিলউদ্দিন। আহমেদ যখন নিতে আসবেন, তখন বাপ বাপ করে ঠিকই যাবে। তারপর বাড়ি যাওয়ার অন্যতম শর্ত হিসেবে রেডিওটা সঙ্গে নিয়ে যায় মন্টু।
আজকে ঘরে রেডিও নেই, মন্টুও নেই। অন্যদিন ঘরে-বাইরে পাল্লা দিয়ে শোরগোল চলত। এমনকি কারফিউর সময়ও সারা রাত তাদের গলির তস্যগলিতে
মিছিল। গুলি হচ্ছে জেনে, মানুষগুলো যেন আরো বেশি করে কারফিউ ভেঙে মিছিল করে গুলি খায়। এক কারফিউর রাতে ঝড়ে ঝাঁপটা খাওয়া কাকের মতো আবেদ উপস্থিত। মন্টু তো অবাক। ‘আরে আবেদ ভাই, এত রাইতে? বাইরে না কারফিউ, আসলেন ক্যামনে?’ আবেদ আর ঘরে ঢোকেনি। ‘তোমরা কেমন আছো দেখতে আসলাম।’ বলে মরিয়মের সঙ্গে দেখা না করেই বাইরে থেকে চলে যায়। আজ তো কারফিউ নেই, মন্টুও নেই। আবেদ কি আসতে পারে না? একবার এসে পড়লে আজ আর বাইরে থেকে চলে যেতে হতো না।
গেট নাড়ার শব্দ শুনে মরিয়ম বেরিয়ে আসে। বাতাসই হয়তো অথবা কানের ভুল। তার যত দূর চোখ যায়, একটা কুকুর ছাড়া, গলিটা একদম সুনসান। কুকুরটাকে হাজি সাহেবের বাসার সামনের লাইটপোস্টে বেঁধে রাখা হয়েছে পাহারা দেওয়ার জন্য। মরিয়ম ঠিক করে, বাইরে দাঁড়িয়ে আবেদের জন্য অপেক্ষা করবে। যদি সে আসে! যদি সে গেটে তালা দেখে ফিরে যায়। বাড়ির ভেতর তো মানুষ কি রেডিওরও সাড়াশব্দ নেই। মরিয়ম গেটের মুখটায় এসে দাঁড়ায়। ঠিক তখন হাজির বাড়ির দোতলার জানালাটি ফের মটমট করে খুলে যায়। এই মাঝরাত্তিরে! লোকটার সাহস দেখি বহুৎ বেড়ে গেছে। আবার গলা খাকারিও দিচ্ছে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে। সে তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে সশব্দে দরজা বন্ধ করে দেয়।
সেই রাত্রিরে মরিয়ম বিছানায় একবার শোয় একবার উঠে বসে। অস্বস্তিতে মশারির দড়ি খুলে দেয়। পায়ের পাতায় বাতাসের সুড়সুড়ি। পর্দাটা উড়ে উড়ে জানালায় বাড়ি খাচ্ছে। লাইটপোস্টে বাঁধা কুকুরটা থেকে থেকে কেঁদে ওঠে। দু-চার বাড়ি পর আরো একটা কাঁদে। হাজির বাড়ির সামনের দড়ি-বাঁধা কুকুর যেন নেতৃত্ব দিচ্ছে। দূরের আরো দূরের শত শত কুকুরের করুণ কান্না রাতের বাতাস কাঁপায়, আতঙ্ক ছড়ায়। ফুলতলি গ্রামে মহামারির বছর কুকুর কাঁদত। মরিয়ম শুনেছে–মানুষের শোকে নাকি কুকুর কাঁদে। এই মাসে শতাধিক মানুষ গুলি খেয়ে মারা গেছে। আরো মরবে যদি যুদ্ধ হয়। কুকুরগুলো কি মৃতদের জন্য কাঁদছে, নাকি সংকেত দিচ্ছে–যুদ্ধ বাধার পর আরো মানুষ মারা যাবে! শহরের নির্জন রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে গেট খুলে যুদ্ধ এসে মরিয়মদের বাড়ির চৌকাঠে বসে। একটুখানি জিরোয়। তারপর হামা দিয়ে ঘরে ঢোকে। যুদ্ধ মরিয়মের বিছানার চারপাশে নৃত্য করে। আগামী যুদ্ধে সে কি মারা যাবে, যুদ্ধ না করেও? আবেদ মরবে, না বাঁচবে? মন্টু গ্রামে চলে গেছে। একটা যুদ্ধাতঙ্কের রাত মরিয়মকে পাথর চাপা দিয়ে চলে যায়।