তখন মিছিল-মিটিংয়েও বড় বড় প্রতিশ্রুতি। সেসব এক জায়গায় জড়ো করলে ডজন ডজন উঁচু পাহাড় হয়। পাহাড়গুলো সব বঞ্চিত মানুষের স্বপ্নের। এ দেশের মানুষ জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি হরেক কিসিমের লাঞ্ছনার-বঞ্চনার শিকার হয়। এর কারণ যে অবাঙালি শাসকগোষ্ঠী, দেশভাগের পর থেকে তারা তা একটু একটু করে শুনে আসছিল। এবার হাতে-কলমে বোঝাপড়া। পশ্চিম পাকিস্তানের মানচিত্র থেকে উত্থিত অজগর ভারতের বিশাল ভূখণ্ড ডিঙিয়ে এখানে যে ছোবল মারছে, সচিত্র পোস্টার দেখে তারা এর বিষযন্ত্রণা অনুভব করে। বক্তৃতাগুলো রূপকথার মতো আকর্ষণীয়। সোনার বাংলা লুণ্ঠন করে কীভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের রাস্তাঘাট সোনার পাতে মোড়া হচ্ছে, সে দৃশ্য শ্রোতাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। পাকিস্তানটা যেন দেশ নয়, গাভি একটা। তার সামনের দুই পা পূর্বে, পেছনের দুই পা পশ্চিমে। বাঙালিরা রোজ একে ঘাস খাওয়ায়, আর দুধ দুইয়ে নেয় পশ্চিম পাকিস্তানিরা। শতকরা ৬০ ভাগ রাজস্ব আয় করে পূর্ব পাকিস্তান, খরচ করতে পারে মাত্র ২৫ ভাগ। বাকিটা যায় পশ্চিম পাকিস্তানের উদরে। সেখানে মাথাপিছু আয় বেশি, জিনিসপত্রের দাম কম। ‘৭০-এর নির্বাচনী পোস্টারে বৈষম্য আর শোষণের পাই-পাই হিসাব সংখ্যাচিত্রের আকারে ছাপা হয়। মরিয়ম নিজে যেন বঞ্চিত দেশমাতৃকা আর আবেদ হচ্ছে প্রতিশ্রুতিশীল নেতা। সে মেয়েটির উদ্ধারের স্বপ্লবীজ ফুলার রোড থেকে শহিদমিনার, কার্জন হল, রমনাগ্রিনের লেকের গায়ের ঝুলন্ত রেস্টুরেন্ট পর্যন্ত পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে ছড়াতে ছড়াতে যায়। আবেদের সমাজবিজ্ঞানে এমএ দেওয়া হয়ে গেছে, এখন চাকরি পেলেই বীজ থেকে গাছ হবে। ‘৭১ সালটা বারুদের গন্ধ নিয়ে আসে। মরিয়মের স্বপ্নগুলো পাখি হয়ে উড়ে যায়। এখন ডামি রাইফেল হাতে ট্রেনিং নেওয়া ছাড়া আবেদকে আর কিছু বলতে শোনা যায় না।
‘৬৬ থেকে ‘৭১-এই পাঁচ বছরে জল ঘোলা হয়েছে বিস্তর। ঘোলাজলের পাঁকে পাঁকে জটিল আবর্তও সৃষ্টি হয়েছে। মরিয়ম তখন ছিল কিশোরী। জসিমুল হক শুধু তার হাত ধরেছিল। তার জন্য গ্রাম থেকে তাকে শহরে চলে আসতে হয়। এখন আবেদ আর মরিয়মের সম্পর্ক গড়িয়েছে বিছানা পর্যন্ত। প্রথম প্রথম এসএম হল আর বুয়েটের মাঝখানের দু’সারি বড় বড় মেঘশিরীষের কারুকাজময় ছায়াতলে তারা শান্তই ছিল। পরস্পরের অংশীদারত্ব বলতে বুঝত একটা বাদাম ভেঙে একজন আরেকজনকে দিয়ে খাওয়া। ঢাকা ক্রমশ উত্তপ্ত হতে শুরু করে। আবেদের পড়াশোনা শেষ। চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গেলে বড় সাহেবরা ভাবেন, তারা প্রভু, যে চাকরি চাইতে এসেছে সে তাদের দাস। তখন পাকিস্তানি সামরিক জান্তার থাবার বাইরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবিক এক স্বাধীন দ্বীপ। সেখানে সামরিক কি বেসামরিক কোনো আইনই কার্যকর ছিল না। এমন এক ভূখণ্ডের অর্ধযুগের স্বাধীন সার্বভৌম বাসিন্দা আবেদ। ইন্টারভিউ টেবিলে বড় সাহেবের প্রতিটি প্রশ্নের জবাবে তার একটা করে ঘুষি মারতে ইচ্ছে করে। তা নিবৃত্ত করতে গিয়ে সে আরো খেপে ওঠে। তারপর সিদ্ধান্ত নেয়, আর নয়। মোটা হাবড়াদের সালাম ঠুকে, নতজানু হওয়া আর পোষায় না। সে লাইব্রেরি সায়েন্সে ভর্তি হয়ে স্বাধীন দ্বীপে বসবাসের মেয়াদ বর্ধিত করে। এর আগে কখনো-সখনো মিছিলে শ্লোগান দেওয়া কিংবা আইয়ুব খানের কুশপুত্তলিকা পোড়ানোর সময় পেছন থেকে তালি বাজানোর মধ্যে তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ ছিল। এই পর্বে মিছিলের অগ্রভাগে সে চলে আসে। আগুনও ধরায় স্বহস্তে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই স্বাধীন বাসিন্দা তার ক্ষুদ্র দ্বীপটিকে নিয়ে আর সন্তুষ্ট নয়। বড় সাহেবদের যারা আবার অধিকাংশই অবাঙালি, তাদের উচ্ছেদ করে, এর সম্প্রসারণের প্রয়োজন অনুভব করে। ব্যস্ত হয়ে পড়ে আবেদ। শিরীষের ছায়ায় হেঁটে হেঁটে বাদাম খাওয়ার দিন ফুরিয়েছে। কিন্তু মরিয়মকে দরকার অন্য কারণে। বীরত্বের পাশাপাশি নারী-শরীরের দখল কায়েমও তার কাছে জরুরি হয়ে পড়ে। তখন হুডতোলা রিকশায় কালো পেড়ে সাদা শাড়ির বেড়া ভেঙে ব্লাউজের তলায় আঙুল চালিয়ে বীরের উত্তেজনা প্রশমিত হচ্ছিল না। এ যেন জ্বলন্ত মশাল হাতে কোথাও আগুন না জ্বালিয়ে সারা শহর ঘুরে বেড়ানো। সঙ্গে আগুন আছে ঠিকই কিন্তু তা জ্বালানো যাচ্ছে না। তার জন্য, সম্পূর্ণভাবে মেয়েটিকে পাওয়ার জন্য বিছানা চাই। সবকিছু এত দ্রুত ঘটতে থাকে যে, মরিয়ম বেদিশা হয়ে পড়ে। সে নিজেও কদিন ধরে হুডতোলা রিকশায় সিক্ত হচ্ছিল। তার ভয় ছিল, প্রতিরোধ ছিল না। একদিন মন্টুর অনুপস্থিতির সুযোগে আবেদ ভরদুপুরে মরিয়মকে বিছানায় নেয়। যেখানে পা ভাঁজ করে বসে বছরাধিক সময় সে মন্টুকে রাজনীতির পাঠ দিয়েছে, মুহূর্তেই তা পাল্টে যায়। এলোপাতাড়ি ঝড়ের ভেতর মরিয়ম ভয়ে আর উত্তেজনায় কাঁপছিল। বুঝতে পারছিল না, বিয়ের আগে এসব করা ঠিক হচ্ছে কি না। তা ছাড়া মন্টু যে-কোনো সময় চলে আসতে পারে। এবার মরিয়মের ভয়, প্রতিরোধ দুটোই ছিল। প্রতিরোধের ফলেই হয়তো পুরো ব্যাপারটা যন্ত্রণাদায়ক হয়ে ওঠে। বিছানা রক্তে ভাসিয়ে আবেদ যেন তক্তপোশ থেকে নয়, মঞ্চ থেকে মেঝেতে পদার্পণ করে।