মরিয়ম তখন খুব ছোটও নয়, বড়ও নয়, ক্লাস টেনের ছাত্রী। প্রতিবছর একদল ছাত্র দূরদূরান্ত থেকে তাদের বাড়িতে থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে আসত। এক মাইলের ভেতর থানা শহর। সেখানকার হাইস্কুলের দোতলা দালানঘরে আর প্রাইমারির টিনের ছাপরায় পরীক্ষার সেন্টার পড়ে। সেবারও তারা আসে। পরীক্ষার বিরতিতে লুঙ্গি মালকোচা দিয়ে পুকুরের মাছ ধরে আর দিনান্তে হাটে যায়। সিজনের প্রথম আম, ছোট ছোট কোয়ার কাঁঠাল, বিস্কুট, মিষ্টি নিয়ে ফেরে। খাওয়া-থাকা বাবদ গৃহকর্তাকে টাকা দেওয়ার রেওয়াজ ছিল না। তাই সবাই মিলে পুকুরের মাছ ঘরে তুলে, বাজারের টুকিটাকি জিনিস কিনে এনে খানিকটা পুষিয়ে দিতে চাইত। পরীক্ষার্থী একজনের প্রথম দিন থেকেই মরিয়মের পড়াশোনার দিকে নজর খুব। দু’বেলা খাওয়ার সময় ভেতর-বাড়িতে আসা-যাওয়ার পথে মরিয়মকে বলত, অঙ্কে লেটার মার্ক তুলতে হলে পাটিগণিত, জ্যামিতিতে ভালো হলে চলে না, বীজগণিতই আসল। ছেলেটা আবার তাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। নাম জসিম। জসিমুল হক। পরীক্ষার শেষ দিন জসিমুল হক মরিয়মকে সিনেমা দেখার প্রস্তাব দেয়। আব্বা বাড়ি নেই। ঢাকায় বাড়ি বানানো নিয়ে ব্যস্ত আছেন। মাকে না বলেই মরিয়ম জসিমের সঙ্গে সিনেমা দেখতে কাছের জেলাশহরে যায়। বাড়ি ফেরে তিন দিন পর। ছেলেটি ভয়ে পথ থেকেই লাপাত্তা। তারপর প্রথম প্রথম বাড়ির লোকজন মেয়ের বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। গ্রামদেশে কলঙ্ক শিমুল তুলোর মতো বাতাসে ছড়ায়। যখন বাবা-মা বুঝলেন যে, দেদার খরচা করলেও মেয়ের এখন বিয়ে হবে না, তখন শহরের বাড়িটার কথা তাদের মনে পড়ে। মরিয়ম শহরে চলে যাক, লেখাপড়া করুক, গ্রামের লোকেরা বেশিদিন কোনো কিছু মনে রাখতে পারে না। ক’বছর বাদে তারা এসবও ভুলে যাবে, তখন মেয়ের বিয়ে দিতে কোনো সমস্যাই হবে না। বুদ্ধিটা আসলে কফিলউদ্দিন আহমেদের বড় শ্যালক গোলাম মোস্তফার। জমির দালালি করে করে মানুষের মনের অন্ধিসন্ধি তার জানা হয়ে গিয়েছিল। সবচেয়ে বড় কথা, তার আত্মবিশ্বাস ছিল প্রবল। মরিয়ম তত দিনে ম্যাট্রিক পাস করেছে ফার্স্ট ডিভিশনে, বীজগণিতের সূত্র মুখস্থ করে অঙ্কে সে লেটার মার্কও পায়। যে বাড়ি একমাত্র ছেলের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে বানানো হয়েছিল, তার উদ্বোধনটা হয় মেয়েকে দিয়ে। মন্টু ফাউ–বড় বোনকে পাহারা দিতেই। তার ঢাকা শহরে আসা।
শহর আক্রান্ত হওয়ার আগমুহূর্তে পাখিরাও যখন নীড় ভেঙে পালাচ্ছে, সে সময় পাহারাদার মন্টুকে বাড়ি পাঠিয়ে, ঘুণে-ধরা ভাঙা বাঁশ হাতে ঘরে ঢোকে মেরি। তাদের বাড়িটা গাঁয়ের নাম-ঠিকানা আর শহরের বাড়ির আধাআধি চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফুলতলি গাঁয়ের কলঙ্ক রটানোয় ওস্তাদ লোকগুলোর চোখে ধুলা দেওয়ার জন্য গত পাঁচ বছর তাকে এখানে রাখা হয়েছে। তারপর তাদের ভুলো-মনের সুযোগ নিয়ে তার বিয়ের আয়োজন করা হবে। মরিয়ম তা জানে। যে-কেউ চৌকাঠে দাঁড়ালে তা আন্দাজ করতে পারে। বাড়িটা যেন পান্থনিবাস। এর দু’কামরায় আসবাব বলতে দুটি খাট, একখানা আলনা, পড়ার টেবিলের দু’পাশে দুটি হাতলবিহীন সস্তা কাঠের চেয়ার। আবেদ এলে চেয়ারে না-বসে সরাসরি বিছানায় উঠে যেত। মন্টুও তাতে আপত্তি করত না। প্রথম দিন থেকেই সে তার রাজনীতির চ্যালা বনে গিয়েছিল। আবেদ ভাই, আগরতলায় কি সত্যই একটা ষড়যন্ত্র হইছিল? মোনেম খান নাকি আইয়ুব খানের ভাতিজা? মন্টুর এমন সব বোকা বোকা প্রশ্নে ছাত্রনেতা আবেদ কখনো ধৈর্যচ্যুত হয়নি। বরং সে উত্তেজিত, উদ্দীপ্ত, যেন তার সামনে পল্টন ময়দানের হাজার হাজার শ্রোতা, গলাটা একলাফে আকাশে চড়ে যেত। মরিয়ম তখন ঘর-বাহির করেছে। সে শঙ্কিত একদিকে মন্টুকে নিয়ে, রাজনীতি মাথায় ঢুকে পড়াশোনা যার লাটে ওঠার জোগাড়; অন্যদিকে তার চোখ দুটি চরকির মতো ঘুরত চারপাশের বাড়ির জানালা অলিন্দে। এ বাসায় তৃতীয় ব্যক্তির আনাগোনায় লোকজনের চোখ টাটায়, কানগুলো যেন সারি সারি বন্দুকের নল, এদিকে তাক করা থাকে। তখন আবেদের সময়-অসময় আসা-যাওয়া মরিয়ম ঠেকাতে পারেনি। যদি সে হাতছাড়া হয়ে যায়! তার কাছে বন্ধক দিয়ে ফেলেছে তো নিজেকে! ফেরার পথ নেই। কতবার ফেরা যায়?
জসিমুল হক মহুয়া সিনেমা হলে ইংরেজি মুভি দেখতে দেখতে আবেগে তার হাত চেপে ধরেছিল। ওরা যে রিয়ালে, খেয়াল ছিল না। পাশের সিট থেকে গাঁয়ের একজন সিটি বাজালে তাদের আর বাড়ি ফেরার সাহস হয় না। তিন দিন পথে পথে ফেরা। জসিমের চাকরি থাকলে হাত ধরার খেসারত হিসেবে তারা কোর্টম্যারেজ করত, মেরিকে একা গায়ে ফিরতে হতো না–এই কথা জসিম ইংরেজিতে বলেছিল। তার পাণ্ডিত্যে মরিয়ম তখন মুগ্ধ। এমন গুণী ছেলে তার পনেরো-ষোলো বছরের জীবনে দ্বিতীয় আরেকটিও দেখেনি। মরিয়ম জসিমুল হকের কথা বিশ্বাস করেছিল।
বাড়ি ফেরা ছিল এই কিশোরীর স্বর্গ থেকে পতন। সেই এক বছরেই সে বড় আর বয়স্ক হয়ে ওঠে। পুরুষের প্রতি ভালোবাসা বুঝতে-না-বুঝতেই অকালে ঝরে যায়। সাধারণ বিষয়েও মনে সংশয় জাগে। শুধু বোঝে যে, বিয়ে হলো নারীজীবনের একমাত্র সফল পরিণতি, বাকি সব মিথ্যা। বিদ্বান প্রেমিক সুন্দর সুন্দর কথা বললেই কী, বিয়ে করার তো মুরদ ছিল না। এর ফলে জসিমুল হক লজ্জা-ঘেন্নার কাঁথা-প্যাঁচানো রক্তাক্ত জ্বণের পিণ্ড যেন, অচিরেই তার হৃদয় থেকে আবর্জনায় নির্বাসিত হয়। মরিয়ম ঢাকা আসে পঙ্কে সাঁতার কাটার পর পালক-ঝাড়া শুভ্র হংসিনীর মতো। উপমাটা আবেদের। কলেজ ড্রেসে মরিয়মকে প্রথম দিন দেখে তার নাকি সেরকমই মনে হয়েছিল। পরে সব শোনার পর বলেছে সে। কিন্তু মরিয়মের মনে তখন অন্য ভাবনা। জসিম ছিল সম্ভাবনাময় চারা গাছ, আর সে মনে করে আবেদ হচ্ছে আগামী সিজনে ফল দেবে, এমন এক পরিণত বৃক্ষ। সুযোগ পেলে তাতে চড়ে বসা যায়। তারপর আবেদ ফল যা ফলাবে, সব মরিয়মের। সেইমতো ‘৬৯-৭০, এই দুই বছর আবেদ স্বপ্ন দেখায়, মরিয়ম দেখে.. ’৬