সর্পিল মিছিলটা বড় রাস্তায় উঠে গেলে, মরিয়ম টিউবওয়েলের নর্দমার জলকাদা ডিঙিয়ে গলির মুখে এসে দাঁড়ায়। এখন তার ঘরে ফেরা উচিত, না আবেদের খোঁজে বেরোবে সে–তা বুঝতে না পেরে গলির মুখেই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। যত দূর স্মরণ হয়, মরিয়ম সেদিন বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ওখানেই ছিল, যতক্ষণ না সামনের দোতলা বাড়ির জানালা খুলে দুটি জ্বলজ্বলে চোখ অন্ধকারে জ্বলে ওঠে। তার পরও খানিকটা সময় সে অসাড়, যেন এক জোড়া চোখ নয়, সে আটকে গেছে বন্দুকের গোলাকার রেঞ্জে। নড়ামাত্র গুলি। মরিয়ম লোকটাকে কখনো দেখেনি, তার ওই চোখ জোড়া ছাড়া। সে যে মেয়ে নয়–তা তার আন্দাজই কেবল। কারণ মন্টুর অনুপস্থিতিতেই লোকটা তাদের বাসার দিকের জানালা খুলে ওই বন্দুক চোখে মরিয়মের দিকে তাকিয়ে থাকে। তখন গলিতে একটা মিছিল ঢুকল তো শাট শাট কপাট বন্ধের আওয়াজ। মন্টু বলে, লোকটা খুনের আসামি, না হয় চোর। কদিন আগে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের তালা ভেঙে ৩২৫ জন কয়েদি যে পালিয়েছে, সে হয়তো তাদেরই একজন। তবে লোকটা দালালও হতে পারে। বাড়ির মালিক হাজি সাহেব ব্রিটিশ আমলের মুসলিম লীগার। নির্বাচনের সময় আওয়ামীপন্থি ছেলেকে সপরিবারে তাড়িয়ে দেওয়ার পর মাঝখানে কয়েক মাস দোতলাটা খালি পড়ে ছিল। এখন তো দেশের নিরানব্বই শতাংশেরও বেশি মানুষ আওয়ামী লীগ করে। তাই দোতলাটা ভাড়া দিয়ে বাড়িতে শত্রু তোলেননি তিনি। মরিয়ম ভাবে, হাজি সাহেবকে একদিন বললে হয়–তার নতুন ভাড়াটে মেয়েলোকের দিকে তাকিয়ে থাকে কেন! সে লোকটার বেলাল্লাপনার শাস্তি দাবি করবে। কিন্তু হাজির বাড়ির মহিলারা তো পর্দানশিন, যদি উল্টো নসিহত শুনে তাকে বেরিয়ে আসতে হয়! এমনিতেই হাজি সাহেব মন্টুর ওপর মহা খাপ্পা। নির্বাচনের সময় সে হাজির বাড়ির চুনকামহীন খড়খড়ে দেয়ালে নৌকার চিকা মেরেছে। কিন্তু মন্টু চিকা মারুক, মেরি তো মারেনি। সে কখনো রিকশার চাকার হাওয়া ছাড়েনি, বাসে আগুন ধরায়নি, পুলিশের গায়ে ঢিল ছোড়েনি। তখন যদি হাজি বলেন, ‘তা না হয় বুঝলাম, কিন্তু তুমি তো একজন কলেজছাত্রী, শিক্ষিত, সচেতন নাগরিক। আমারে ভেঙে কও দেখি, তুমি পাকিস্তানের অখণ্ডতা চাও, না ভারতের দালালি করে দেশটা ভাগ হোক–হেইডা চাও?’
এখন তো দাঁড়িপাল্লার দুদিকে নব্বই ডিগ্রি কোনাকুনি এই দুই পক্ষের অবস্থান। হাজি সাহেবদের পাল্লায় মণ মণ ওজনের বাটখারা চাপালেও মন্টুদের পাল্লার সমান। হবে না। তাই তিনি একরকম ঘরবন্দি থেকে দল ভারী করার জন্য একটা প্যাচা ধরে দোতলায় রেখে দিয়েছেন। কিন্তু এসবের মধ্যে মরিয়ম কোথায়? আজ মন্টু চলে যাওয়াতে সে পক্ষ-নিরপেক্ষও হয়ে পড়েছে। এই ভাবনাটা তাকে বিচলিত করে। বুকে কাঁপন ধরায়। এখন যে যেখানেই থাকুক, যার যা আছে, তাই নিয়েই সশস্ত্র। মরিয়ম সশস্ত্র হওয়ার জন্য গেটের পাশের বেড়ার খুঁটি ধরে টানাটানি জুড়ে দেয়। কাজটা যত সহজ ভেবেছিল, ততটা নয়। ঘুণে ধরা বাঁশ যেন মাটিতে শিকড় গেড়েছে। ভাঙবে তবু উঠে আসবে না। সে খুঁটি ওপড়ানো ছেড়ে বাড়ির ভেতর চলে যাওয়ার কথা ভাবে একবার। পরক্ষণেই অনুভব করে পিঠের ওপর বন্দুকের সেই গোলাকার চাকতি। গায়ের সমস্ত শক্তি জড়ো করে টান দিতেই যখন বাঁশটা মাঝখানে ভেঙে হাতে চলে আসে আর মাটিতে পড়তে পড়তে সে টাল সামলে উঠে দাঁড়ায়, তখন দোতলার জানালার জমাট অন্ধকার হাসির তাণ্ডবে খান খান হয়ে যায়। হাসির শব্দে বোঝা যায়, কে হাসে। হায়েনাও তো মানুষের মতো হাসে। কিংবা মানুষ হায়েনার মতো। মরিয়ম এইটুকু ভাঙা-বাঁশ দিয়ে কী করবে? দোতলার জানালা ছুঁতে গেলেও তো আস্ত একটা বাঁশ দরকার। তা বলে বাঁশের টুকরাটা ফেলে দিলে হাত একদম খালি। মরিয়মের ভয় হয়, তারপর সে শুধু নয়, তাদের এই ছোট্ট বাড়িটাও ওই জানালার দখলে চলে যাবে।
ভয়টা মরিয়মের রক্তেই ছিল।
’৬৪ সালের হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা এবং ’৬৫-এর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর হিন্দুরা যখন ঝাঁক বেঁধে ভারতে চলে যাচ্ছিল, তখন মেরি-মন্টুর আব্বা পানির দরে রায়ের বাজারের এই জায়গাটা কেনেন। শহরের জমি-জিরাতের ওপর কোনোকালেই তার তেমন লোভ ছিল না। বড় শ্যালক গোলাম মোস্তফা দেশভাগের পর থেকে হিন্দুদের জমিজমা বেচা-কিনি করে তত দিনে লাখপতি। তিনি জোতদার ভগ্নীপতিকে উপদেশ দেন–এক বছরের পাট বেচার টাকা দিয়ে শহরে যেহেতু জমি পাওয়া যায়, ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে তার তা করা উচিত। তা ছাড়া একমাত্র ছেলে লেখাপড়া শিখে তো হাল-বাওয়ার জন্য গায়ে পড়ে থাকবে না! তাদের আব্বা কৃষক মানুষ। মাটির সঙ্গে তার নাড়ি-বাঁধা সম্পর্ক। সেই মাটি ফলনশীল, উর্বর। শুরুতে তাই দোনামনা করছিলেন। কিন্তু কেনার পর, চারদিক থেকে দালানকোঠায় টুটি চেপে ধরা জমিটার ওপর তার মায়া পড়ে গেল। জমির প্রাক্তন মালিক ভারতে চলে গেছে। তার পরিত্যক্ত ভঁই এখন শত্ৰু-সম্পত্তি। কোর্ট-কাছারির সিংহভাগ মামলা তখন এসব জমিজমাসংক্রান্ত। বড় শ্যালকের শহুরে জারিজুরির ওপর কোনোকালেই তার তেমন আস্থা ছিল না। তাই অপরিচিত, অনুর্বর, নিষ্ফলা জমি দখলে আনার জন্য নিজ গ্রাম ফুলতলি থেকে দুজন কামলা এনে টিনের চালের দুই কামরার একটি ঘর তড়িঘড়ি বানিয়ে ফেলেন। দেয়াল ইটের গাঁথুনির, চুনকামহীন। ঘরের সামনে গাঁও-গেরামের ধাঁচে ভোলা আঙিনা, পাশে রান্নাঘর, পেছনে বাঁশঝাড়। বাকি দুই ভিটেই খালি, যেখানটায় ফুলতলি গাঁয়ে হলে গোয়ালঘর ও বৈঠকখানা উঠত। উঠানের মধ্যিখানে টিউবওয়েল, তার পাশে টিনের বেড়ার গোসলখানা। সেখানে নদীর ঘাটের অনুরূপ একটা ভারী তক্তা ফেলা হয়েছে বসে বসে গায়ে জল ঢালার, কাপড় কাঁচার জন্য। বাঁশের পাটাতনের ল্যাট্রিনটা বসেছে বাঁশঝাড়ের পাশে। এর তিন দিক চাটাই ঘিরে প্রবেশপথে চটের পর্দা টাঙানো হয়েছে। সবশেষে পুরো চার কাঠা জমি ঘিরে ফেলা হয়েছে মুলিবাঁশের বেড়া দিয়ে। রাস্তার দিকে মুখ করা কালো লোহার গেট। তার ওপর সাদা রং দিয়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা–এই জমির মালিক কফিলউদ্দিন আহমেদ, সাং ফুলতলি, ডাকঘর সাহারপাড়। বহুদিন নেমপ্লেটে বাড়ির নম্বর ছিল না। বোতলপড়ার মাধ্যমে বাড়িবন্ধ করতে গাঁয়ের এক মৌলবিকে রাহা খরচ দিয়ে শহরে আনা হয়েছিল। সে বাড়ির চার কোনায় চারটি বোতল পুঁতে যায়। এভাবে ফুলতলি গাঁয়ের কফিলউদ্দিন আহমেদ জিন-ইনসানের নজর আটকিয়ে দু’কামরার আধা-শহুরে বাড়ির নিরঙ্কুশ মালিক হন। তারপর বছর খানেক বাড়িটা যে খালি পড়ে ছিল, ভাড়া দেওয়া হয়নি, তা এই কারণে যে, অপরিচিত-অনাত্মীয় লোকজন কটা টাকার বিনিময়ে প্রকারান্তরে বাড়ির মালিক হয়ে বসুক, তিনি সেটি চাননি। বাড়িটা হয়তো খালিই পড়ে থাকত, যদি-না মরিয়ম এমন একটা কাজ করে বসত, যা পরে বড় আর ভয়ংকর হবে, তা না ভেবেই।