মন্টুর শরীরটা করাত-কাটা গাছের মতো মটমট শব্দে কাত হয়ে পড়ে যায় মাটিতে।
কে এই সুন্দরী? মরিয়ম জানে না। ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফুটছে। ভাইয়ের গাঁজলা-তোলা মুখ কোল থেকে নামিয়ে সে কাছের জলাশয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। সেখানে তারার ম্লান ছায়ায় এক ভয়ার্ত নারীর প্রতিবিম্ব। নিজেকে মরিয়ম চিনতে পারে না। মৃদু স্বরে ডাকে, ‘সুন্দরী! সুন্দরী!’ ছায়াটা নড়ে ওঠে। জলের গায়ে ছোট ছোট তরঙ্গ। মেয়েটি যেন বহু বছর পর তার নাম ধরে কাউকে ডাকতে শুনে জলাশয়ের বুকে ঢেউ তুলে জেগে উঠেছে। কে এই নারী? অসফল প্রেমের যন্ত্রণায় কি আত্মহত্যা করেছিল? কিংবা না খেতে পেয়ে? অথবা অবৈধ সন্তান গর্ভে ধারণ করে নির্বাসিত হয়েছিল সুন্দরীর জলায়? তারপর লোকালয়ে ফিরে যায়নি। হারিয়ে গেছে জলাশয়ে, খড়ের স্থূপে, অগণিত তারার প্রতিবিম্বের মাঝখানে। শুধু তার নামে নাম যে জলাভূমির, সূর্যাস্তের পর সেটি আতঙ্ক ছড়ায়। পথিককে দিগ্ভ্রান্ত করে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়। মরিয়ম জলাশয়ের প্রতিবিম্বে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সুন্দরী নামের কিংবদন্তি নারীর সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। যে এই সমাজ-সংসারের একজন হয়ে বাঁচেনি। যার সব পরিচয় হারিয়ে গিয়ে লোকমুখে ঘোরে শুধু নাম। সেই রাতের শেষ প্রহরে মরিয়ম আর সুন্দরী–একজন হু-হুঁ করে কাঁদে, আরেকজনের হাসির প্রতিধ্বনি হয় শূন্য চরাচরে। কে হাসে, কে কাঁদে–আলাদাভাবে শনাক্ত করা যায় না।
আর মন্টু! বড় বোন পাশে থাকা সত্ত্বেও যে সুন্দরীর জলায় পথ হারিয়ে বেহুঁশ হয়, দুদিন ধরে মুখ দিয়ে গাঁজলা তোলে, সাত দিন জ্বরে ভোগে, এর মাত্র তিন বছর পর তাকে এই জলাভূমি, খড়ের স্তূপ, আলেয়ার আলো, ঘরবাড়ি, শস্যখেত আর মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য যুদ্ধে যেতে হয়েছিল, রক্ত দিতে হয়েছিল।
০২. মরিয়ম ওরফে মেরি
দেব দেব দেব দেব/ রক্ত রক্ত রক্ত দেব।
বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো/ বাংলাদেশ স্বাধীন করো।
মরিয়মদের বাসার সামনের চিপা গলিতে ঝড়ের বেগে ঢোকে সর্পাকৃতির একটি মিছিল। লোকগুলোর হাতে লোহার রড, বাঁশের লাঠি, নৌকার বৈঠা, খাটের স্ট্যান্ড। হঠাৎ মিছিলের পেট চিরে হাঁপাতে হাঁপাতে দুটি ছেলে গেটের ভেতর ঢুকে পড়ে। ‘মন্টু বাড়ি চলে গেছে,’ মরিয়ম তা বলামাত্র তারা আরেক দৌড়ে ফিরে গিয়ে মিছিলের লেজটাকে ধরে। এ সময় মিছিলের অগ্রভাগে চোঙায় ঝংকার ওঠে, ‘তোমার আমার ঠিকানা,’ সঙ্গে সঙ্গে লেজে আছড়ে পড়ে ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’র কুলভাঙা ঐকতান। মরিয়ম যেন নদীতীরের নিঃসঙ্গ গাছ, মাটি ভাঙনের আবেগে থরথরিয়ে কাঁপছে। যে সংগ্রাম আর সবার স্বাধীনতার, তার জন্য বন্দিত্বের। সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। অফিস-আদালত হয় কি হয় না। সে নিজে বিএ পাস দিয়ে ঘরে বসে আছে। দেশের এ পরিস্থিতিতে চাকরির খোঁজে বেরোলে লোকে পাগল ভাববে। অবশ্য চাকরিবাকরি তার বর্তমান সমস্যার সমাধানও নয়।
মরিয়মের ইচ্ছে হয়, মিছিলের ছেলে দুটিকে ডেকে কিছুটা সময়ের জন্য ঘরে বসায়। প্রেসিডেন্ট ভবনের আলোচনা কতদূর, আমরা কি জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে বসতে পারব, না যার যা আছে তা-ই দিয়ে যুদ্ধ করে নিজেদের ন্যায্য পাওনা আদায় করতে হবে–এসব জানার জন্য নয়। সে আসলে তাদের কাছে। আবেদের খবর জানতে চায়। লোকটা কি আজ আসবে না? মরিয়মের যে তার সঙ্গে জরুরি কথা ছিল। সেসব জানানোর জন্য মানুষ তো মানুষ, পাখিদেরও এখন তার পক্ষে দূত ভাবা সম্ভব। কারণ মেরি ওরফে মরিয়মের ২৫ মার্চের আগ পর্যন্ত চাওয়া ছিল–আর দশটা মেয়ের মতো নানান বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও তার যেন একটা নিজস্ব জীবন হয়, যাতে সময়মতো মা হয়ে স্বামীর সংসার করার নিশ্চয়তা থাকে। এদিকে সর্পাকৃতির মিছিলটা তখন গলি কাঁপিয়ে বেরিয়ে গেছে। মরিয়ম জানে, নদী-শাখানদী সব মিলে যেমন সাগরে পতিত হয়, এটিও তেমনি আর সব মিছিলের সঙ্গে পল্টন ময়দানে গিয়ে পড়বে। যদিও শুরু থেকে শেষতক কোনো মিছিলে সে কখনো ছিল না।
উনসত্তর সালে মরিয়মদের বকশীবাজার কলেজ থেকে রোজ একটা করে মিছিল বেরোত। বিক্ষুব্ধ ছাত্রীদের স্রোতের তোড়ে সেও দু-তিনবার খড়কুটোর মতো ক্লাসরুম, কলেজের মাঠ থেকে ভেসে গেছে। একবার তাদের মিছিলটা বুয়েটের সামনের রাস্তায় পৌঁছানোর পর মরিয়মের পায়ের একপাটি স্যান্ডেল ছিঁড়ে যায়। মিছিলটা যাবে ইডেন কলেজে। সে খালি পায়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে কিছুদূর। তারপর পলাশীর কাছাকাছি। আসতে সুযোগ বুঝে সটকে পড়ে। সেখানে এক মুচির কাছে স্যান্ডেল সারানোর সময়। মরিয়মের প্রথম পরিচয় এসএম হলের আবসিক ছাত্র আবেদ জাহাঙ্গীরের সঙ্গে। সেদিন মেরি মিছিল থেকে সটকে না পড়লে, আবেদ প্রায়ই বলত, তাদের হয়তো দেখাই হতো না, তারা যে যার জায়গায় থেকে যেত। উনসত্তর থেকে একাত্তর। এখন আবেদ বলে, ‘তোমার মতো মেয়েরা যখন ডামি রাইফেল দিয়ে ট্রেনিং নিচ্ছে, রোদে দাঁড়িয়ে লেফট-রাইট করছে, গলা ফাটিয়ে স্লোগান দিচ্ছে, তোমার মুখে খালি বিয়ে বিয়ে–জপ-তপ।’
কেন মরিয়ম বিয়ের কথা বলে–এখন তা বলতে গেলেও শুনতে চায় না আবেদ। মেয়েটিকে আবর্জনার মতো এড়িয়ে চলে সে।