নতুনগাঁও, রাধানগর নামগুলো কেমন চেনা লাগে মরিয়মের। আজ থেকে বছর তিরিশ আগে তার বড় ফুপু সাহার বানুর বিয়ে হয়েছিল রাধানগর মুন্সিবাড়ি। বিয়ের বছর ঘুরতে-না-ঘুরতে গুটিবসন্তে ফুপুটা মারা যায়। মেরি তাকে দেখেনি। সে স্কুল ফাঁকি দিলে বা পড়ালেখা করতে না চাইলে কফিলউদ্দিন আহমেদ দুঃখ করে ছোট বোন সাহার বানুর কথা বলতেন। সাহার বানুর নাকি লেখাপড়ায় খুব মাথা ছিল। বিয়ের পর ফিরানির সময় যে ট্রাংকে করে সে বইখাতা নিয়ে যায়, এক বছরে পড়ালেখা দূরে থাক, একবার এর তালা খোলারও সুযোগ পায়নি। সাহার বানুর মৃত্যুর পর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা শাড়ি-কাপড়, গয়নাগাটি রেখে তালাবন্ধ ট্রাংকটা শুধু ফুলতলি গ্রামে ফেরত পাঠিয়েছিল। কারণ সেইকালে রাধানগর মুন্সিবাড়িতে বউ ঝিদের লেখাপড়ার রেওয়াজ ছিল না।
কিছুদূর হাঁটার পর রাধানগর গ্রাম ছাড়িয়ে তারা নতুনগাঁওয়ে পৌঁছায়। সেখানকার মানুষগুলো উড় উড়। তাদের এক পা বাইরে, আরেক পা ঘরে। রমিজ শেখের কাঁধে রাইফেল দেখে তারা ইঁদুরের মতো চোঁ-চো পালাতে শুরু করে। সে মুক্তিযোদ্ধা কি রাজাকার, তাতে কিছু যায়-আসে না। মুক্তিফৌজের গন্ধ পেয়ে দু’দিন আগে পাকসেনারা পাশের গ্রাম শশ্মশান বানিয়ে রেখে গেছে। এদিকে রাজাকারের উৎপাতে তারা নিজেরাই অতিষ্ঠ। এ অবস্থায় রমিজ শেখ যে মুক্তি বা রাজাকার নয়, সমানে ডাকহক ছেড়ে জনে জনে তা বোঝতে শুরু করে।
‘তো ভাইজান,’ পনেরো-ষোলো বছরের একটি ছেলে, যার বন্দুক হাতে যুদ্ধ করার শখ, সে অন্ধকার থেকে বেরিয়ে ‘রাইফেলটা কেন সঙ্গে রাখিছেন, আমারে দেন দিকি! আমি চালাই।’ বলেই থাবা মেরে নিয়ে যায়।
এমন জবরদস্ত অভ্যর্থনার জন্য মরিয়ম বা রমিজ শেখ কেউ প্রস্তুত ছিল না। যদিও অস্ত্রটা এযাবৎ তাদের কোনো কাজেই লাগেনি, তবু লোকটাকে একই সঙ্গে তা পরিচিত করেছে মুক্তিযোদ্ধা এবং রাজাকার হিসেবে। পাকিস্তান জিন্দাবাদ আর জয় বাংলা স্লোগান দুটি এখন রমিজ শেখের সড়গড়। কিন্তু কোনটা কোথায় বলতে হবে-বুঝতে পারছে না। হয়তো পারত পুরো নয় মাস সময় পেলে। এখন সবে যুদ্ধের তৃতীয় মাস।
বন্দুকটা হারিয়ে রমিজ শেখ নতুনগাঁওয়ে অসহায় হয়ে পড়ে। আগের মতো সে যেন আবার জেলখানায়, হাত-পা ঝাড়া, নিজের বলতে কিছু থাকল না। পুরোনো অভ্যাসমাফিক এক কথা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বারবার বলতে থাকে। মেরি কেন স্বর্গধাম থেকে তাকে নিয়ে এল, একদঙ্গল মেয়ে আর পুরুষ দুজনকে খেদিয়ে রাজা-রানির হালে তারা থাকতে পারত ওখানে। কিন্তু জেলখানার মতো লোহার গরাদ ধরে এক কেচ্ছা দশবার শোনার শ্রোতা নতুনগাঁওয়ে নেই। অস্ত্র কেড়ে নিলেও গ্রামের চৌধুরী বাড়িতে তাদের রাতের খাবার আর আশ্রয় জোটে। তারপর গ্রামের মেয়েরা মরিয়মকে নিয়ে পড়ে আর হাতে একখানা লাঠি দিয়ে রমিজ শেখকে পাঠিয়ে দেয় হাফ ডজন জোয়ান মরদের সঙ্গে গ্রাম পাহারা দিতে।
টেঁটা-বল্লম, রামদা, লাঠি হাতে হাঁক ছেড়ে নতুনগাঁওয়ের লোকেরা যেন চর দখল করতে যাচ্ছে, এমনই তাদের হাবভাব, প্রস্তুতি। বা পাকা ধানখেতের ছিঁচকে চোর ধরতে যাচ্ছে যেন। রমিজ শেখ মনে মনে হাসে-গ্রামের লোকেরা কী বোকা, পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে এসব অস্ত্র দিয়ে হবে গ্রাম পাহারা! ছয়জন পাহারাদারের মাঝখানে নিজেকে তার বেশ চালাক মনে হয়। বন্দুকটা খোয়ানোর দুঃখ সে ভুলে যায়। গড়গড়ায় টান দিতে দিতে খেতের আইলে বসে নানান কথা বলতে ইচ্ছে করে।
হাফ ডজন পাহারাদার, রমিজ শেখের শহরে মেয়ে আর মুরগি পাকসেনাদের ভেট দেওয়ার কেচ্ছাটা বিনাবাক্যে হজম করে। কিন্তু হাজি সাহেব যে দেশপ্রেমিক নাগরিক, তা তারা মানতে রাজি নয়। তারা বলে, লোকটা বেইমান-মুক্তিরা পেলে তাকে জ্যান্ত কবর দেবে। কেন? রমিজ শেখ ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। সে জানে, বিশেষত মেয়েদের জোরজবরদস্তি বা কৌশলে আর্মির হাতে তুলে দেওয়াটা খারাপ কাজ। এর কারণ হাজি সাহেবের কাছে একদিন সে জানতেও চেয়েছিল। হাজির ব্যাটা পরহেজগার মানুষ, ধর্মের পথছাড়া এক কদম চলেন না। ব্যাখ্যা করে বললেন, ‘দেখ। রে বাজান, পূর্ব পাকিস্তানটা এখন শত্রুর দেশ, আর মেয়েরা হইলো গিয়া গনিমতের মাল। যুদ্ধের ময়দানে তাদের ভোগ করার কথা আল্লার কালাম পাকে বলা আছে। তাতেও যখন শ্রোতার মন গলে না, তার শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখটা নেমে আসে রমিজ শেখের মুখের কাছে। যাকে রাতের অন্ধকারে কয়েদির পোশাক পাল্টিয়ে নিজের একপ্রস্থ কাপড় পরিয়েছেন, শয্যা পেতে দিয়েছেন ত্যাজ্য পুত্রের বিছানায়-আশ্রয়দাতার অগোচরে তার কিছু থাকতে পারে না। তিনি পরপর দু’দিন জেরা করে কয়েদির অপরাধ-বৃত্তান্তের প্রায় সবটুকু জেনে নেন। তারপর যখন দেখলেন সে দাগি, তা আবার খুনের মামলার, সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিলেন, সে-ই হবে এই অবিশ্বাসের দুনিয়ায় তার বিশ্বস্ত অনুচর। নিজের অপরাধ জানাজানির ভয়ে বাকি জীবন দড়ি-বাঁধা কুকুরের মতো পায়ের কাছটায় পড়ে থাকবে। ভুলেও কুঁই কুঁই করবে না। তবে এখন যুদ্ধের সময়–তিনি নিজেকে প্রবোধ দেন, সওয়াল-জবাব করতে মন চাচ্ছে যখন কুকুরটার, বাধা দিলে পালিয়ে যাবে। হাজি সাহেবের আনত মুখের লালা ছিটকে পড়ে রমিজ শেখের চোখে-মুখে। রাগ চাপতে গিয়ে তার দু’টি দাঁত প্রবল ঘর্ষণে কিড়মিড় করে, ‘কী হালার পো, নিজে বউ ছাড়া থাকতে পারলি না, বয়ে আনতে গেলি–হা-হা । অরা থাহে ক্যামনে-ক দেহি? হাজার মাইল দূরে বউ-বাচ্চা–মাইয়্যা মানুষ ছাড়া থাহে ক্যামনে, ক দেহি?’ বলে বাপের বয়সি মুরুব্বি রাগ আর গায়ের জোর মিশিয়ে লুঙ্গির ওপর দিয়ে রমিজ শেখের পুরুষাঙ্গটি খপ করে ধরেই মুচড়ে দিলেন। রমিজ শেখ চোখে অন্ধকার দেখতে দেখতে হাজির বাহাস্ শোনে, ‘লাঠিটা খালি তোর একলারই, অগোর নাই!’