যুদ্ধ বাধার তিন বছর আগে কলেজে মরিয়মের তখন দ্বিতীয় বর্ষ চলছে। মন্টু ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী। দাদির মৃত্যুসংবাদ আসার দিন, প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে মন্টুর দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়। মায়ের চিঠিতে দাদির জন্য পরওয়ারদিগারের কাছে দোয়া মেঙে দু’রাকাত নফল নামাজ পড়ার নির্দেশ ছিল। কারণ তিনি ছিলেন নেকবান্দা। পরম করুণাময় জায়নামাজে সিজদার সময় তার প্রিয় ইনসানের জান কবজ করিয়াছেন। পর সমাচার এই যে, মেরি ও মন্টু তোমরা অহেতু বিলাপ-আলাপ করিও না। উহাতে তোমাদের প্রিয় দাদির কবরের আজাব বাড়িবে বৈ কমিবে না।
মরিয়ম আর মন্টু, যা করার কথা চিঠিতে নিষেধ ছিল, তা-ই করে। মন্টু বাসায় ফেরার পর বই-খাতা নামিয়ে রাখারও সময় পায় না, ঘরে ঢুকতেই দাদির মৃত্যুসংবাদ তাকে জানানো হয়। সঙ্গে সঙ্গে তার হাতের ফাউন্টেন পেন মেঝেতে পড়ে যায়। তারপর জ্যামিতির বাক্সটা স্কেল-কম্পাসসহ। মরিয়ম দোয়াদরুদ পড়া বাদ দিয়ে ভাইয়ের গলা ধরে কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে ব্যাগ গোছায়। দরজায় তালা লাগিয়ে শেষ বাস ধরার জন্য বাসস্ট্যান্ডে ছোটে।
মধ্যরাতে সুন্দরীর জলায় জনমানুষ দূরে থাক, এক কণা আলোও নেই। মেরি মন্টু কাটা ধানগাছে পা ফেলে অন্ধকারে ফটফট শব্দ করে হাঁটে। মন্টু মাঝসমুদ্রে দিকহারা নাবিকের ভয়ত্রস্ত কণ্ঠে বলে, ‘মেরিবু আমাদের একটা দিগদর্শন যন্ত্র থাকলে পথ হারানোর ভয় থাকত না।’ মরিয়মের আফসোস যে, তাড়াহুড়োয় একটা টর্চ সঙ্গে নিতেও সে ভুলে গেছে। ঠিক তখন অদূরে সে আগুন দেখে। বিজ্ঞানমনস্ক মন্টু বলে, ‘মরীচিকা, এই দ্যাখ এখন নাই।’ তাই তো! পরক্ষণে আবার আগুন জ্বলে ওঠে। একজন দেখে, আরেকজন দেখে না। এই করে করে একসময় তারা দুজনেই তা দেখতে পায়। সেই সঙ্গে শোনে মানুষের মৃদু গুঞ্জন। ‘চোর-ডাকাত না তো, যদি আমাদের ধরে!’ মেরির ভয়টা মন্টু আমলে নেয় না। এ ছাড়া লুকিয়েচুরিয়ে মাত্র। ছ’মাস হয় সিগারেট ধরলেও নেশাটা এখন তার তুঙ্গে। বাড়ির মুরুব্বিদের কাছে ধরা পড়ার ভয়ে দিয়াশলাই-সিগারেট সঙ্গে আনেনি। ওই অগ্নিকুণ্ডের কাছে মানুষ থাকবেই। আর মানুষ থাকলে সিগারেট, বিড়ি, হুক্কা না-থেকে পারে না। মন্টুর হাঁটার গতি হঠাৎ বেড়ে যায়। যেতে যেতে সে বলে, ‘মেরিবু, তুই যে কী কস! আমাগো লগে কি ধনসম্পদ আছে যে, ডাকাইতে ধরব?’
তারা যত এগোয় আগুন তত পিছিয়ে যায়। কাছে যেতে মানুষ বা আগুন কিছুই থাকে না। মৌমাছির মতো মানুষের মৃদু গুঞ্জনও অন্তর্হিত। যেন লণ্ঠন হাতে এক ঝাঁক মৌমাছি উড়ে গেছে মধু আহরণে। ভাইবোনের শরীর ভার ভার ঠেকে, ভয়ে বুক কাঁপে, জিব শুকিয়ে যায়। এর মধ্যেও মরিয়মের একবার মনে হয়, এটি আলেয়ার আলো। মুখ ফুটে ভাইকে বলতে গিয়ে দেখে গলায় স্বর নেই। আগুনের পেছনে ছুটতে ছুটতে কখন যেন পুব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ একসঙ্গে সব কটা দিক হারিয়ে ফেলেছে। বাকি আছে নিচে মাটি, ওপরে আকাশ। ভাইবোন মাটিতে বসে উত্তরাকাশে ধ্রুবতারার সন্ধান করে। তারা ঝলমলে আকাশটা যেন জবরজং বেনারসি শাড়ি–এমন ঘন। বুনটের জরির কারুকাজ বিয়েবাড়িতে বাহবা কুড়ালেও, এখন তাদের কাছে মনে হয়। বিভীষিকা। এ থেকে চোখ সরিয়ে যখন নিচে তাকায়–সুন্দরীর জলার শীতের মৌসুমের ছোট ছোট জলাশয়ে তারাখচিত আকাশের টুকরা-টাকরাসমেত নিজেদের দেখে। মাথায় ভর দিয়ে দুজন যেন দাঁড়িয়ে আছে। আর দূর আকাশের নীল আলোর। বিচ্ছুরণ তাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।
এই হলো সুন্দরীর জলার কুহেলিকা, যা দিগ্ভ্রান্ত মানুষদের বশ করে মৃত্যুফাঁদে নিয়ে ফেলে। কিন্তু মেরি-মন্টুকে এর বশ হলে চলবে না, যে করেই হোক বাড়ি পৌঁছাতে হবে। সেখানে তাদের প্রিয় দাদির দেখা পাওয়া যাবে না ঠিকই, তবে তার কবরটা তো রয়েছে, যে কবরের বুক ফেটে তখনো রসুনের কোয়া থেকে চারা গজায়নি, চারধারের নতুন বাঁশের বেড়াটাও অক্ষত। তখন মন্টু আলোর দিক থেকে চোখ সরিয়ে নেয় আর নিজে নিজে ঠিক করে, এখন থেকে অন্ধকারে যা দেখবে, তা বিশ্বাস করবে না। যা দেখবে না, তাতে আস্থা রেখে তাকে বাকি পথ চলতে হবে। ঠিক এরকমই একটা সিদ্ধান্ত সাড়ে তিন বছর পর সে সঙ্গীদের না-জানিয়ে নিয়েছিল। রাতের অন্ধকারে সীমান্তের নিকটবর্তী একটি ব্রিজ ওড়ানোর সময় ঘটনাটি ঘটে। সব কটা সার্কিটের মাথার সেফটি ফিউজে আগুন দেওয়া হয়ে গেছে। চারদিকে জ্বলন্ত অগ্নিশিখার ফরফর আওয়াজ। পরিকল্পনামতো দলের ছেলেরা যেদিকে পালায়, তার ঠিক উল্টোদিক থেকে মন্টু হঠাৎ একটি আলোর রেখা দ্রুতগামী জিপের গতিতে ছুটে আসতে দেখে। সে তেড়ে আসা এই অগ্নিস্ফুলিঙ্গের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না এবং উইপোকার মৃত্যুতাড়নায় ছুটতে থাকে সেদিকেই, যেদিক থেকে প্রবল বেগে আলোটা আসছিল।
সুন্দরীর জলায় চোখের সামনে ছোট ছোট খড়ের স্তূপ দেখেও মন্টু ভাবে, এগুলো খড় না, খড়ের সারি সারি স্তূপ না, জিনের পঙক্তি ভোজের আসর। সঙ্গে সঙ্গে সে পথ বদলায়। মরিয়ম তার সঙ্গে খানিকটা পিছিয়ে এলেও মানুষের ঘর-বসতির কাছাকাছি এসব খড়ের স্তূপ থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিতে পারে না। সে মন্টুর পুলওভার ধরে টানে, বলে ফিরে আসতে। মন্টু গোঁ-গোঁ করে গোঙায়। অন্ধকারে তার পাগল পাগল ভাবটা মরিয়মের তখন ঠাহর হয়। সে খানিকটা জোরাজুরি করতেই ভাই প্রলাপ বকতে শুরু করে, না গো মেরিবু,’ সে কফতোলা ঘড়ঘড়ে গলায় বলে, ‘ওইদিকে যাইস না, ওরা ঘাড় মটকে পুঁতে ফেলবে সুন্দরীর মতন।’