স্বর্গের নিষিদ্ধ ফল খেতে রমিজ শেখকে প্ররোচিত করে মরিয়ম। বলে যে, এক কোটি মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে এখন ভারতে শরণার্থী। স্বর্গধামের মতো পরিত্যক্ত বাড়ি খুঁজলেই পাওয়া সম্ভব। সেখানে তাদের অপমান করার কেউ থাকবে না।
রমিজ শেখ মরিয়মের কথা ফেলতে পারে না। মেয়েটার বিদ্যাবুদ্ধি অনেক। সে নিজে পড়েছে–অ-তে অজগর, আ-তে আম, ওই অজগর আসছে তেড়ে, আমটি আমি খাব পেড়ে। তা বলে দুজন অকর্মা পুরুষ আর এক দঙ্গল মেয়ের ভয়ে পালাতে হবে! যা হোক কথাটা যে বলছে, সে তার নিজের লোক। হাতে অস্ত্র থাকা সত্ত্বেও রমিজ শেখ বিনা যুদ্ধে স্বর্গধামের কর্তৃত্ব ছেড়ে দেয়।
স্বর্গধাম থেকে বেরিয়ে আসে আদম আর হাওয়া অগ্নিদগ্ধ, খুনাখুনির বিপজ্জনক এক পৃথিবীতে। সঙ্গে নেয় পেছনে ফেলে আসা আবাসের অনুরূপ একটি বাড়ির স্বপ্ন। সেখানে তারা হবে একমাত্র নর-নারী। তাদের দেখতে আকাশের ফালি চাঁদ দূর থেকে উঁকি দেয়। পরক্ষণে ভয় পেয়ে মেঘের আড়ালে লুকোয়। আকাশের বুক ফেটে গুমগুম আওয়াজ ওঠে। ছাই ছাই গাছের পাতা প্রবল ত্রাসে কাঁপতে থাকে। খারাপ কিছুর আশঙ্কা ব্যতিরেকেই দুজন অজানার উদ্দেশে যাত্রা করে।
তখনো রাত শেষ হয়নি। খানিক আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। কর্দমাক্ত রাস্তায় দু’ফাইল করে একদল সৈন্য স্বর্গধামের দিকে এগিয়ে আসছে। তাদের ভুতুড়ে ছায়া পড়েছে রাস্তার পাশের জলাশয়ে। যুদ্ধের এখন তৃতীয় মাস। উদ্যোগ-আয়োজনে তাদের খামতি নেই। খুন-ধর্ষণ-লুণ্ঠন-মার্চের তালে তালে শেষরাতের পৃথিবী ঘুমের ভেতর চমকে চমকে ওঠে। তাতে ভোরের গান গাওয়া পাখির তাল ভঙ্গ হয়।
স্বর্গের দুয়ারে কোনো পাহারা ছিল না। মরিয়ম আর রমিজ শেখ যে পথ দিয়ে বেরিয়ে গেছে, সৈন্যরা তার ঠিক উল্টো দিক থেকে আসে। স্বর্গধাম শূন্য। লোকজন বুটের আওয়াজ পেয়ে পালিয়েছে। বাউন্ডুলে মুরগিগুলো রাতে খোয়াড়ে না-ঢুকে গাছে উঠে বসেছিল। ওখান থেকে স্বপ্নার প্রসববেদনার কাতরানি শোনা যায়। তার জন্য ধাই আসে না। আতিক ভাবি, পুরুষ মানুষরে বিশ্বাস করছেন তো মরছেন’-কথাটা। কদিন আগে যে বলেছিল, তার জীবনে তা সত্য হয়ে ওঠে। সৈন্যরা প্রতিটি ঘরে। তল্লাশি চালায়। সদ্য ত্যাগ করা উষ্ণ বিছানা-বালিশ রাগে লন্ডভন্ড করে। তবে কোনো গুলি ছোড়ে না। বেয়নেট দিয়ে স্বপ্নর উঁচু পেটটা চিরে দেয়। গোয়ালঘরে তখনো গাই দুটি বাঁধা। তারা এদের আঘাত করে না। শুধু দড়ি খুলে হিড়হিড় করে বাইরে নিয়ে আসে। অপারেশনের লাভের তালিকায়-বাছুরসহ দুটি গরু (জীবিত), একজন নারী ও একটি শিশু (মৃত)। তারা তাতে সন্তুষ্ট হয় না। স্বর্গধামের ঘরগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এর গরম আঁচে গাছের ডালে বসা মুরগিগুলো কককক ডাকতে শুরু করে। তাদের গায়ে গায়ে ঠ্যালাঠেলি অন্ধকারে দেখা যায় না। সৈন্যরা সন্ত্রস্ত–যেন এক দল মুক্তিফৌজ এলএমজি কক করে অটোতে নিয়ে বাগিয়ে ধরেছে। তারা ঝটপট মাটিতে। শুয়ে, সেই অবস্থায় পজিশন নেয়। প্রথম দফায় বুলেটগুলো মাথার ওপর দিয়ে উড়ে চলে যায়। কককক আওয়াজ বাড়তে শুরু করলে সৈন্যরা গাছের ডাল লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। বাউন্ডুলে মুরগিগুলো সারেন্ডার করে না। থলে শূন্য হালকা শরীর নিয়ে উড়তে শুরু থাকে। সৈন্যরা নাছোড়, কককক আওয়াজ বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত টানা গুলি চালিয়ে যায়।
০৬. এখন যুদ্ধের তৃতীয় মাস
যুদ্ধের আটাশ বছর পর, মরিয়মের সাক্ষাৎকার যে গ্রহণ করে, অর্থাৎ মুক্তি, সে স্বর্গধামের পতনের রাতটির ওপর মোটা করে হলুদ মার্কারে দাগ টেনে মার্জিনে লেখে—‘দুর্ভাগ্যের সূচনা?’ প্রশ্ন চিহ্নটা শেষ পর্যন্ত থেকেই যায়। কারণ প্রশ্নগুলো জটিল আর উত্তরটা সহজ–বিষয়টা ওর কাছে এমন ছিল না। কারো কারো মনে হতে পারে, মরিয়মের দুর্ভাগ্যের শুরু মহুয়া সিনেমা হল থেকে, যেখানে ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী এক তরুণ, পর্দায় লাভসিন দেখে তার হাত চেপে ধরেছিল। কিংবা ভাবা যাক–যুদ্ধ বাধার ঠিক দুদিন আগে, সে যখন মন্টুকে বাড়ি পাঠিয়ে টিউবওয়েলের নর্দমায় আধখানা ইটের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল–সেই মুহূর্তটি। যা মরিয়ম নিজেই দুর্ভাগ্যের সূচনা হিসেবে শনাক্ত করেছিল। হয়তো আলাদা করে এসবের কোনোটাই নয়। মরিয়মের জীবন এ সমস্ত কিছুরই যোগফল। মুক্তির আরো মনে হয়, এ ক্ষেত্রে মেরি প্রকারান্তরে মরিয়ম একটি উদাহরণ মাত্র। তার দুর্ভাগ্যের কারণ হয়তো নারীর প্রজনন অঙ্গটি, যা বংশরক্ষার সূচিমুখ-এর পবিত্রতা। যা শুধু একজন পুরুষের ব্যবহারের জন্য এবং বৈধভাবে। সেটি অরক্ষণীয় হয়ে পড়ে যুদ্ধের বছর। শত্রুর পুরুষাঙ্গ তাতে ঢুকে পড়ে। বীর্য ডিম্বাশয়ে চলে যায়। জ্বণ দ্রুত বাড়তে শুরু করে। স্বাধীনতার পর বিশেষ অধ্যাদেশ জারি করে গর্ভপাত ঘটানোর পরও নারীদেহের পবিত্রতা পুনরুদ্ধার হয়নি।
এসব অবশ্য পরের কথা।
যুদ্ধের এখন তৃতীয় মাস। ফুলতলি গ্রাম আর কত দূর বা ওখানে কোনো দিন পৌঁছানো যাবে কি না মরিয়ম তখনো জানে না। সে রমিজ শেখকে সঙ্গে নিয়ে স্বর্গধামের অনুরূপ একটি বাড়ি খুঁজছে। পরিত্যক্ত, জনহীন, ঐশ্বর্যময়। তারা যেসব জনপদের ওপর দিয়ে যায়, সেখানে দু-চারটা খালি ঘরবাড়ি আছে বটে, সেসব হতদরিদ্র, বসবাসেরও যোগ্য নয়। জানালা-দরজা-বেড়ার চিহ্নমাত্র নেই, চালটুকু শুধু শূন্যে ঝুলে আছে, ভিটাবাড়ির আশপাশে আগাছার জঙ্গল, দিনের বেলা পুকুরপাড়ে শিয়াল ডাকে, বসতবাড়ির কড়িকাঠে পাচা ডিগবাজি খায়, আর উঠানে ঢোকার পথটা শ্যাওলা জমে এমন পিচ্ছিল যে, হাঁটতে গেলে হাত-পা ভাঙার উপক্রম হয়। তবু মরিয়ম আর রমিজ শেখ আশা ছাড়ে না। যুদ্ধ শুধু দু’হাতে নেয় না, দেয়ও। তা না হলে তারা স্বর্গধাম পেয়েছিল কীভাবে! তবে চলার পথে অহেতু ঝঞ্ঝাট কোনোভাবেই কাম্য নয়। তাই যথাসম্ভব মানুষের ছায়া এড়িয়ে চলে। ভুলক্রমে গৃহস্থবাড়ির কাছে। গেলেই ‘কিডা যায় রে, দেখ দিকিনি’ বলে মানুষজন হাঁকডাক জুড়ে দেয়। তখন একথা-সেকথা বলে ছাড়া পেতে অযথা সময় নষ্ট হয়। সেই তুলনায় ফসলের মাঠ নিরাপদ। যুদ্ধের দিনে খেতে যারা কাজ করে, পেটের দায়েই করে। সেখানে বাড়তি কথা বলার সুযোগ কম। তার মধ্যে হঠাৎ দূরের ধানখেতে প্রথম একটা মাথাল, পরে আস্ত মানুষটা মাথা তুলে দাঁড়ায়, ‘আপনেরা যাচ্ছেন কনে-এ-এ, কোথা থেইক্যে আসা হচ্ছে-এ?’ লোকটা দু-দুবার চাচানোর পর আর চুপ থাকা যখন ভালো দেখায় না, তখন রমিজ শেখ সামনের গ্রামটার নাম জানতে চায়। কৃষক দিগন্তের দিকে ঈদের চাঁদের মতো হাতের কাস্তে উঁচিয়ে বলে, ‘ওই-ওইটা হলো গে রাধানগর, মিলিটারিরা পুইড়ে ছাই করে দেছে। তার পরের গিরামের নাম নতুনগাঁও। ওই গিরামে মানুষজোন পালিও পাতি পারেন।’