পাকিস্তানি জনগণের বাঙালি-অবাঙালি বিভক্তির সময়টার পাক্কা দশ বছর রমিজ শেখ জেলখানায় ছিল। কী নিয়ে যুদ্ধটা বেধেছে, কে কাকে কেন মারছে–মার্চ এপ্রিলের পর মে মাস, এখনো তার কাছে বিষয়টা পরিষ্কার নয়। রাজনীতির জ্ঞানগম্যি তার যতটুকু, তাও হাজি সাহেবের কাছ থেকে। তাই উত্তেজিত হলে এখনো পাকিস্তান। জিন্দাবাদ বলে চেঁচিয়ে ওঠে। জয় বাংলা বলার সময় তোতলায়। যেখানে গলা টিপে মানুষ খুন সম্ভব, অস্ত্রশস্ত্র তার বাহুল্য লাগে। তবে কাঁধের রাইফেলটা সে হাতছাড়া করে না। জিনিসটার বাড়তি শক্তিতে সে মুগ্ধ। এর মসৃণ বাঁটে সময়-অসময় হাত বোলায়, রোজ তেল পালিশ করে। সে দেশপ্রেমিক জনগণ বলতে বোঝে শান্তি কমিটির লোকদের। তার জানামতে, তাদের কাজ শুধু মেয়ে ও মুরগি সরবরাহ করে পাকিস্তানি সৈন্যদের খেদমত করা। হাজি সাহেব একজন দেশপ্রেমিক নাগরিক। কেরানীগঞ্জ থেকে ঢাকা ফিরে তিনি শান্তি কমিটির মেম্বার হয়েছেন। রমিজ শেখকেও সঙ্গে রেখেছিলেন। একেক দিন একেক মহল্লায় জাল ফেলার মতো মেয়ে আর মুরগি ধরার নির্দেশ ছিল তার ওপর। এখন শহরে জিনিস দুটির ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
স্বর্গধামে মোরগ-মুরগির স্বাধীন বিচরণ আর মেয়েদের সংখ্যাধিক্য রমিজ শেখকে নতুন করে ভাবনায় ফেলে। তাকে যদি দেশপ্রেমিক হতেই হয়, সে এখানকার ছোট বড় মেয়েসহ মুরগির ছানা-পোনা আর্মির হাতে তুলে দেবে। কিন্তু মেরিকে নয়। মেয়েটাকে পোড়া মরিচের ধোয়া দিয়ে বাঁচিয়েছে সে। ওর বাকি জীবন তার হাতে। আর এজন্যই হাজির জাল ছিঁড়ে পথ হাতড়ে হাতড়ে স্বর্গধামে তার আগমন।
রমিজ শেখের অতীত না জানলেও তার কিছু ত্রুটি আতিক মিয়া, তৈয়ব সাহেবের নজর এড়ায় না। তারা মুক্তিফৌজের অপেক্ষায় থাকেন। লুঙ্গিপরা একদল লোক খালি পায়ে স্টেনগান কাঁধে কোনো একদিন স্বর্গধামের দরজার কড়া নাড়বে, রাতের মতো আশ্রয় আর ভাত চাইবে। আতিক মিয়া, তৈয়ব সাহেব স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের নির্দেশমতো মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করবেন বটে, তার আগে তাদের কানে তুলে দেবেন রমিজ শেখের আড়ষ্ট জিবের তোতলানো জয় বাংলা স্লোগান আর আঙুল দিয়ে দেখাবেন মসৃণ বাঁটের একটি বন্দুক, যা যুদ্ধের বাজারে শত্ৰু না মেরে বেগার বয়ে বেড়ানো হচ্ছে।
দিন যায়, রাত আসে। ভাত আর আশ্রয় চেয়ে দরজায় কাউকে কড়া নাড়তে শোনা যায় না। এর পরিবর্তে মুক্তিযোদ্ধাদের পরস্পরের কাছে লেখা একটা সাংকেতিক চিঠি ভুল করে স্বর্গধামে চলে আসে। চিঠির দুটি লাইন তাদের কলজেয় জোর কামড় বসায়–এতগুলি মুরগি আর ডিম পাঠালাম কোনো কাজেই লাগাচ্ছ না, ব্যাপার কী?…আমি আবারও বলছি বিশ্বাসঘাতকের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। সেই থেকে দুজন ভয়ে অস্থির। রমিজ শেখকে তাদের মনে হয় ছদ্মবেশী মুক্তিযোদ্ধা, যে গোপনে তাদের বিরুদ্ধে চিঠি চালাচালি করছে। আর নিজেদের তারা ভাবতে শুরু করেন, মুরগির ডিম ভালো কাজে না-লাগিয়ে, খেয়ে সাবাড় করে দিচ্ছে এমন এক নতুন ধরনের বিশ্বাসঘাতক–যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
বাকি থাকে মেয়েরা। যারা সংখ্যাগুরু এবং রমিজ শেখের ধামাধরা। স্বর্গধাম বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপের মতন। উত্তাল সাগরে ছোট্ট একটি ছিপ নৌকায় চেপে লোকটা যেন হাজির হয়েছে। সঙ্গে নিয়ে এসেছে একটা বন্দুক, একজোড়া লৌহবর্ণের কাঁধ, বেপরোয়া মনোভাব। মেয়েরা তাকে বীর মুক্তিযোদ্ধার সম্মানে ভূষিত করেছে। আর বীরের জন্য বরাদ্দ হয়েছে দ্বিগুণ খাবারদাবার, উত্তম বিছানা।
যা ভাবনার কথা অথচ কেউ ভাবে না, কিছুদিন পর তা ঘটে। স্বর্গধামে খাদ্যসংকট দেখা দেয়। ফলশূন্য গাছগুলো ডালপালাসমেত মাথা তুলতে শুরু করে। গাভির ওলান শুকিয়ে যায়। মুরগিরা থলে শূন্য হয়ে ঘুরে বেড়ায়। ডিম পাড়ার পর নিয়মমতো তা দিয়ে বাচ্চা ফোঁটাতে না পেরে খুব হতাশ। শূন্য খাঁচা দেখলে খেপে ওঠে। ডিমপাড়ায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে বাউন্ডুলেপনা জুড়ে দেয়। এই পরিস্থিতির প্রথম শিকার হয় মরিয়ম। মেয়েরা তার খাবার বন্ধ করে দেয়। তাতে পুরুষ দুজনেরও হাত থাকে। কারণ মরিয়মের প্রতি তাদের ব্যর্থ অনুরাগ তত দিনে ক্রোধে রূপান্তরিত হয়েছে। এ ছাড়া মেয়েদের হাতে রেখে হলেও স্বর্গধামের কর্তৃত্ব বজায় রাখায় তারা বদ্ধপরিকর।
প্রথম প্রথম নিজের পাতের খাবার মরিয়মকে দিয়ে খেলেও রমিজ শেখ এ অন্যায় বরদাস্ত করে না। মেয়েটি না খেয়ে মরবে তার চোখের সামনে, যাকে সে নিজ হাতে জীবন দান করেছে! স্বর্গধামে প্রলয়কাণ্ড শুরু হয়। মেয়েরা অবস্থান পরিবর্তন করে এবং পুরুষদের সহযোগিতায় রমিজ শেখকে বীরের আসন থেকে ফেলে দেয়। তারা জনে জনে বলে বেড়ায়, মরিয়ম আর রমিজ শেখ লটঘট করছে, যা বিয়ের আগে করা ঠিক নয়–এ ব্যভিচার।
রটনাটির সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের প্রশ্নই ওঠে না। কেউ এর প্রমাণও চায় না। যুদ্ধের দিন। আইন নেই, আদালত বসে না। এর সর্বোচ্চ শাস্তি হতে পারে স্বর্গধাম থেকে বহিষ্কার।
রমিজ শেখের পাতের খাবার ভাগ করে খেতে খেতে মরিয়ম অনুভব করে, তাকে বুক পেতে রক্ষা করছে রমিজ শেখ। লোকটা তার মা-বাবা-ভাই-বোন-স্বামী-বন্ধু-যে কোনো কিছুই হতে পারে। আবার নাও হতে পারে। চোখের সামনে আবেদ, মন্টু, কফিলউদ্দিন পরিবার, কলেজের বান্ধবী কেউ নেই যে মরিয়মের পাশে রমিজ শেখকে দেখে ভিরমি খাবে। সে জেলপালানো খুনের আসামি। দশ বছর কয়েদ খেটেছে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর স্বাধীন বাংলাদেশে রমিজ শেখের পরিচয় কী হবে-মরিয়ম জানে না। এখন দরকার শুধু দুই বেলা খাবার, মাথা গোঁজার ঠাই, নিরাপদ আশ্রয়, যা এই লোকটাই তাকে দিতে পারে।