মরিয়ম পুরোনো ভুক্তভোগী। আড়াল তার জীবনে ভীষণ প্রয়োজন। খানিকটা ফাঁক পেলেই ওরা ঢুকে পড়বে তার অতীতে। তখন সামান্য যে আশ্রয় যা খুব বড়ও নয়, ছোটও নয়, অনেকটা কবরের মাপের–যে পরিধিতে এখন সে মিসেস আলাউদ্দিন ও তার সন্তানদের পাশে শুয়ে আছে, তাও হারাবে। আহার নিয়ে ভাবনা নেই স্বর্গধামে। এখানে কেউ কারোর খাচ্ছে না। এখানকার গাই দুধ দেয়। ফলের ভারে বাগানের গাছগুলো সেজদার ভঙ্গিতে নুয়ে থাকে। মুরগির ডিম সমান ভাগে ভাগ হয়। দু’দিন ধরে মরিয়ম লক্ষ করছে, খাওয়ার সময় কেউ তাকে ডাকছে না। কাঁসার থালায় প্রসাদ আসে যমজদের হাত দিয়ে। সে দেবী না ডাইনি? এই যে সবার মতো আলাউদ্দিন ভাবিও দিনের বেলায় তাকে এড়িয়ে চলেন, পারত কথা বলেন না, এখন। তিনি অন্ধকার বিছানায় এপাশ-ওপাশ করছেন। রাত কিছুতেই শেষ হচ্ছে না। স্বর্গধামের পালঙ্ক দুটি দুই জোড়া দম্পতির দখলে। সেখানে সুখ আর আনন্দের ঝড় বইছে। মাস দেড়েক আগে স্বামী বেঁচে থাকাবস্থায় যেসবে মিসেস আলাউদ্দিনের অংশীদার ছিল, এখন ওসব জিনিস দরজা-জানালা ভেদ করে তাকে তিরবিদ্ধ করে। এরকম সময় তিনি মরিয়মকে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন। জোরে জোরে দু-চারটা কথা বলে তিরগুলোর গতিমুখ অন্যদিকে সরিয়ে দিতে চান। দিনে যে শত্রু, রাতে সে মিত্র। এ সময় মেরিকে ডাকতে মিসেস আলাউদ্দিনের সংকোচ হয়, কেমন যেন বাধো বাধো ঠেকে, আবার মায়াও হয় মেয়েটার জন্য। দিনে বড় অবিচার করেছেন। কোথায় বাবা-মা, আপনজন। তার তো তবু দুটি সন্তান রয়েছে। দিনের আলোয় মানুষ অন্ধ হয়ে যায়। মিসেস আলাউদ্দিনের এসব ভাবনা কেবল রাতের বেলার–যখন তিনি একা শরশয্যায়, যখন দিনের মিত্ররা বন্ধ দরজার ওপাশে শত্রুতে রূপান্তরিত হয়।
স্বর্গধামের মানুষগুলো ভুলে যায়, যদিও গরু দুটি বালতি ভরে দুধ দেয়, মুরগি ডিম পাড়ে, গাছ ফল ফলায়–এখন যুদ্ধের সময়। স্বর্গধাম আসলে মায়া, তাদের যুদ্ধ তাড়িত মনের কল্পনা, অথবা স্বপ্ন, ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে যা মিলিয়ে যাবে। যদি সত্যিও হয়, মর্তে স্বর্গসুখ বেশিক্ষণ টেকে না। মরিয়ম দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যে স্বাধীনতা ভোগ করে, তাতেও প্রশ্ন থাকে। প্রশ্নগুলো দিনে দিনে বড় হয়। তার গোপন অতীত সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে বিস্ফোরণ ঘটায় আচমকা। সবাইকে অবাক করে দিয়ে রমিজ শেখ স্বর্গধামে হাজির হয়। তারপর যা ঘটতে থাকে, প্রকারান্তরে তা মরিয়মের জীবনে। আগেই ঘটেছিল।
রমিজ শেখের আগমনে অন্তঃসত্ত্বা স্বপ্ন সবচেয়ে বেশি খুশি। কারণ স্বামীর ওপর তার ভরসা নেই। প্রসবের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই যেন মানুষটা স্ত্রীর প্রতি উদাসীন হয়ে যাচ্ছেন। একই ঘটনায় মলিনা গুপ্তের প্রতিক্রিয়া হয় ভিন্ন। রমিজ শেখের আগমনের রাতেই কোমরের বটুয়ায় স্ত্রীধন বেঁধে মেয়ে দুটিকে নিয়ে তিনি স্বর্গধাম ছেড়ে চলে যান। মিসেস আলাউদ্দিন আর আতিক ভাবি রমিজ শেখকে উষ্ণ সংবর্ধনা জানান। তারা তা করেন স্বপ্নর মতো একই কারণে। তাদের নিজেদের গর্ভজাত বা পালক সন্তান রয়েছে। অথচ এত বড় দলটায় কর্মক্ষম পুরুষ মাত্র দুজন। তাদের আবার স্বর্গধামের আরাম-আয়েশে থেকে গায়ে পোকা পড়ার উপক্রম। আতিক মিয়া আর তৈয়ব সাহেবের অবস্থা দেখে মেয়েরা ভুলতে বসেছিল, পাকসেনার বিরুদ্ধে। এ দেশের পুরুষেরা বন-বাদাড়ে থেকে লড়াই করছে। স্বাধীন বাংলা যতই জাহির। করুক, রেডিওটা তো যন্ত্র। সত্য-মিথ্যা যাচাই করার উপায় নেই। বন্দুকধারী রমিজ শেখ রক্ত-মাংসের মানুষ। কখন, কোন দিক থেকে বিপদ চলে আসে–তখন চওড়া কাঁধের, খর্বাকৃতির, অভিব্যক্তিহীন, গেঁয়ো লোকটা সব সামাল দেবে।
এদিকে তৈয়ব সাহেব, আতিক মিয়া মেয়েদের আদেখলাপনায় বিরক্ত। রমিজ শেখ তাদের সৌভাগ্যে ভাগ বসাতে এসেছে, যা পুরুষ হিসেবে দুজন স্বর্গধামে একচেটিয়া ভোগ করছিল। মরিয়মের প্রতি তাদের আকর্ষণ দলের কারো অজানা নয়। এ নিয়ে আড়ালে-আবডালে প্রতিযোগিতাও চলে দুজনের। সেটি প্রকট হয় তাস পেটানোর সময়। খেলার যে নিয়ম-একজন হারলে আরেকজনের জিত হবে, তা তারা ভঙ্গ করে। প্রত্যহ চেঁচামেচির মধ্য দিয়ে তাস গোটাতে হয়। মরিয়ম মরিয়মের জায়গায়। বিবাহিত পুরুষ হিসেবে তাকে বাগে আনার পথে বাধা বিস্তর, যা রমিজ শেখের নেই। লোকটা গোঁয়ার, বন্য প্রকৃতির, সারা দিন রাইফেল কাঁধে ঘুরে বেড়ায়। এমন জিনিস হাতে থাকলে আজকের দিনে আর কিছু লাগে! যে যা খুশি করতে পারে। অবিবাহিত যুবতীসহ স্বর্গধামের পুরো কর্তৃত্ব তার হাতে চলে গেলে আতিক মিয়া, তৈয়ব সাহেব বুঝতে পারেন না, তারা তখন কী করবেন। মিলিটারির আক্রমণের চেয়ে এই বিপদটাই দুজনের বড় মনে হয়।
রমিজ শেখের পক্ষে-বিপক্ষে স্বর্গধাম বিভক্ত হয়ে গেলে মরিয়ম ফাঁপরে পড়ে। ভাবে, এই লোকটা তার শত্রু না মিত্র? স্বর্গধামের লোকজনের ব্যাপারে তার মনে কোনো সংশয় নেই। যুদ্ধের আগের ফুলতলি গাঁয়ের মানুষদের সঙ্গে এদের বদলে ফেলা যায়-কুটি আঁকা, তিরস্কার আর ঘৃণায় বাঁকানো মুখের অভিব্যক্তিসমেত। এই বাকা মুখগুলো যেন মৃত্যুঞ্জয়। মাঝখান থেকে মন্টু হারিয়ে যায়, আবেদের খোঁজ থাকে না, কফিলউদ্দিনের পরিবার ক্রমাগত ছোট হতে থাকে, গোলাম মোস্তফা তীরে বসে রোদ পোহান, হাজি সাহেব দেশপ্রেমিক বনে যান, রমিজ শেখ পাকিস্তান জিন্দাবাদ আর জয় বাংলার ভেতর তালগোল পাকিয়ে দিগভ্রান্ত হয়ে পড়ে।