দলের বাকি লোকজন রাতের বর্ষণে খোদার লীলাখেলার আলামত কিছু দেখতে পায় না। গোলাগুলি থামারও কোনো লক্ষণ নেই। স্বাভাবিকভাবে তারা নিজের নিজের গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে পায়ে হেঁটে যাত্রা করে। নিখরচায় ছোট ছোট খেয়া পারাপার হয়। ধানখেতের আইল ধরে হাঁটে। খায়-ঘুমায় অচেনা লোকের বাড়ি। দিনের বেলায় গ্রামবাসী ডাব কেটে, চিড়ে-গুড়, সেদ্ধ ডিম নিয়ে মাঠে, গাছতলে আপ্যায়ন করে। তারা দেখে, ধনী হোক গরিব হোক শহরের লোকগুলো জান নিয়ে পিঁপড়ার মতো পিলপিলিয়ে পালিয়ে আসছে। সাধ্যে যা কুলায়, তাদের সাহায্য করাই কর্তব্য। এদিকে যার যার গন্তব্য অনুযায়ী পথ ভাগ হয়ে যাচ্ছে। চলতে চলতে বদলে যাচ্ছে দলের লোকজন। উত্তরবঙ্গ থেকে বরিশালে ধান কাটতে যাচ্ছিল কয়েকজন খেতমজুর। তাদের নৌকায় করে মরিয়ম যখন উত্তাল পদ্মা পার হয়, তখন দলের লোক সব তার অপরিচিত। সে ভাত খাচ্ছে নৌকার এক মাল্লার মাটির সানকিতে-পোড়া মরিচ-লবণ মেখে পান্তাভাত। পদ্মায় জেলে-নৌকা বিস্তর, মাছও উঠছে, তখনো মানুষের মৃতদেহ নদীর মাছের খাদ্য তালিকাভুক্ত হয়নি আর মানুষও খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দেয়নি নদীর মাছ। কিন্তু পয়সার অভাবে মাল্লা-মজুররা মাছ কিনতে পারছে না। মরিয়মের গাল বেয়ে দু’ফোঁটা নোনা পানি পান্তাভাতে ঝরে পড়ে।
০৫. স্বর্গধামের পতন
এপ্রিলের মাঝামাঝি মরিয়মদের নতুন দলটা পদ্মা পার হয়ে পাকা সড়ক, বৈদ্যুতিক তার, টেলিফোনের পিলার অনেক অনেক পেছনে ফেলে এক প্রত্যন্ত গাঁয়ের পরিত্যক্ত বাড়িতে আশ্রয় নেয়। বাড়ি ঢোকার মুখে টিনের পাতে খড়ি দিয়ে লেখা-স্বর্গধাম। স্বর্গধামে ঘর প্রচুর, মানুষ নেই। দরজাগুলো হাট করে খোলা। তখনো উঠানের রোদে কাপড় মেলা রয়েছে। চুলার আগুনটাও নেভানো হয়নি। বাড়ির বাসিন্দাদের পালিয়ে যাওয়ার পর, বাড়িটা লুট হওয়ার আগে তারা ওখানে পৌঁছায়। পরিত্যক্ত মালামালের মালিক হয়ে বসে। বাড়ির সুবিধা-অসুবিধাগুলো গভীরভাবে নিরিখ করে। উঠানের কোনের তুলসীমঞ্চ, বাঁশঝাড়ের তলায় শীতলা ঠাকুর দেখে বোঝে যে, বাড়ির লোকগুলো ভারতে চলে গেছে এবং আপাতত ফিরছে না। তারা তুলসীগাছ উপড়ে ফেলে আর শীতলা ঠাকুরকে ভোগের ঝুনা নারকেলসমেত জঙ্গলের ভেতর ঠেলে দেয়। এখন কারো বোঝার সাধ্য নেই যে, বাড়িটা হিন্দুর। তাতে তারা নিরাপদ বোধ করে। ততক্ষণে পাশের ঝোঁপঝাড় থেকে বেরিয়ে আসে এক দঙ্গল মুরগি। সঙ্গে ঝাঁকে ঝাঁকে ছানাপোনা। বাড়িতে ঢুকেই প্রাপ্তবয়স্ক মুরগিগুলো কুড়কুড়িয়ে ডিম পাড়ার জায়গা খোঁজে। একটিমাত্র মোরগ গলা ফুলিয়ে উঠান, বারান্দা, রান্নাঘর মুরগিদের দাবড়িয়ে বেড়ায়। গোয়ালঘরে লাল ও সাদা গাই দুটি হাম্বা রবে ডেকে ওঠে।
পরিত্যক্ত বাড়ি, রান্নার চুলা, তারে মেলা কাপড়, জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসা মোরগ-মুরগি আর গোয়ালের গরু-বাছুর দেখে উদ্বাস্তুদের ফের সংসারী হতে ইচ্ছে করে। জোড়াতালি দিয়ে পরিবার রচিত হয়। যা থেকে মরিয়ম বাদ পড়ে যায়। নিজেরা পক্ষে-বিপক্ষে বিভক্ত হয়ে পড়ে। কমন বিষয় বলতে থাকে হানাদার বাহিনীর আক্রমণের ভয়–যা রাতদিনের যে-কোনো প্রহরে জানান না দিয়ে হতে পারে।
মিসেস আলাউদ্দিন স্বামীর মৃতদেহ ঢাকায় ফেলে এসেছেন। তিনি এখন বিধবা, দুটি কন্যাসন্তানসহ। আট বছরের যমজ শিশু দুটি জানে না তাদের বাবা-মা কোথায়। তারা তিন-চার দিন হয় দলে আশ্রয় নিয়েছে। এদের পরিচয় এখন এতিম। নিঃসন্তান আতিক দম্পতি যমজদের পালক নিলেও প্রকারান্তরে চাকরের মতো খাটাচ্ছেন। মলিনা গুপ্তের স্বামী, দেওর, পুত্র, শ্বশুরসহ পরিবারের ১১ জন পুরুষ লাইন করিয়ে পাকসেনারা হত্যা করেছে। লাইনটি ছিল দৈর্ঘ্যে বাঁকা, উচ্চতায় অসমান। ব্যাটন মেরে, ভয় দেখিয়ে, একজনের জায়গায় আরেকজনকে টেনে এনে সৈন্যরা তা সোজা আর সমান করতে পারেনি। ব্রাশফায়ারের আগমুহূর্ত পর্যন্ত লাইনটা পূর্বাবস্থায় থেকে যায়। সৈন্যরা একে অবাধ্যতা মনে করে ফেরার সময় ঘর-বাড়িতে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। মলিনা কোমরের বটুয়ায় স্ত্রীধন আর দু’হাতে দুটি সন্তান নিয়ে পালিয়ে এসেছেন। ডাকাত বা মিলিটারির হাতে কে কখন তাকে সোপর্দ করে, এই ভয়েই সন্ত্রস্ত। মনটা তার এখানে নেই, সীমান্তের ওপারে। দাদা-বউদির কৃষ্ণনগরের বাড়িতে বৈধব্যের বেশে ফেরত যাবেন, না সল্টলেকের শরণার্থী ক্যাম্পে উঠবেন–এ নিয়ে খানিকটা সময় ভাবনা-চিন্তা করেন। বাকি সময় নিজের মেয়ে দুটিকে মুরগির মতো ডানার নিচে লুকিয়ে আপনমনে কথা বলেন। একটা বাঁকা ও অসমান লাইনের ধাঁধা তার কিছুতেই ঘোচে না।
ইঞ্জিনিয়ার তৈয়ব ওয়াপদার বড় অফিসার। বারংবার রেডিওতে ঘোষণা দেওয়া সত্ত্বেও তিনি যে চাকরিতে যোগ দিচ্ছেন না, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী স্বপ্ন মনে করে, তা মেরির জন্য। নাম শুনে মনে হয় মেয়েটা খ্রিষ্টান, আবার মুসলমানও হতে পারে। তবে স্বভাবে ছেনাল। ওর স্বামীকে কুপথে টানছে। সাতকুলের সব ফেলে তাদের সঙ্গে ভিড়েছে পুরুষ ধরার জন্য। অন্তঃসত্ত্বা স্বপ্ন, যার সন্তান মাতৃগর্ভে খুন হবে, তিনি দলের আরেকজন সধবাকে ডেকে বলেন, ‘আতিক ভাবি, পুরুষ মানুষরে বিশ্বাস করছেন তো মরছেন। ওরা চাইলে মেয়েটারে বাইর কইরা দিতে পারে না স্বর্গধাম থেকে! আলাউদ্দিন ভাবির আর ভাবনা কী। মাথা থাকলেই না মাথাব্যথা। তবে ওনার নৈতিক দিকটা খুব স্ট্রং। বেশ্যা সন্দেহে মেরির সঙ্গে ওঠবোস বন্ধ করে দিয়েছেন।’