: তুম ইহা কেয়া কার রাহা হ্যায়?
: সায়েব হাম তো নোকরি করতা হ্যায়। ঘরমে ছোটা ছোটা বাচ্চা হ্যায় ম্যারা–কোনো কাজ হয় না। লাশ বহন করা শেষ হলে তাদেরও লাইন করিয়ে হত্যা করা হয়। সৈন্যদের চিরুনি অভিযানের পর ঘটনার সাক্ষী হয়ে বেঁচে থাকে কয়েকজন। ম্যানহোলের আশ্রয় থেকে একজন দেখেছিল পুরো হত্যাকাণ্ডটি। উনিশ ঘণ্টা পর বেরিয়ে এসে তার মনে হয়, পৃথিবীর সব লোক মৃত, সেই একমাত্র জীবিত ব্যক্তি, যে নর্দমার পাতাল থেকে উঠে এসেছে।
জগন্নাথ হল। উত্তর বাড়ি। ২৯ নম্বর কক্ষ। তিনজন ছাত্রকে একত্রে ব্রাশফায়ার করা হয়। গ্রেনেড ছোড়ে রুমটিতে। ধ্বংসস্তূপ আর রক্তের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে একজন–মানুষ নয়, যেন প্রেতাত্মা।
ছাদে পঁচিশজনকে একসঙ্গে ব্রাশফায়ার করা হয়। তার মধ্যে কাঁধে গুলি খেয়ে বাঁচে খর্বাকৃতির একজন। আসল বুলেটটি তার মাথার ওপর দিয়ে চলে যায়।
আরেকজন পায়ে গুলি খেয়েছিল কক্ষের ভেতর। সে জানালার রড খুলে বাইরে এসে ড্রেনে পড়ে। তারপর কুলগাছের নিচের ঝোঁপঝাড়ের ভেতর দিয়ে নেমে যায় পুকুরে। নাকটা শুধু ভাসানো ছিল। মাথার ওপর ভোরের কুয়াশায় ডানা মেলে ঝাঁকে ঝাঁকে কাক-শকুন উড়ছিল। একটা কাক নেমে আসে নিচে। নাকে ঠোকর দেবে যখন, সে জিব নেড়ে কাকটাকে তাড়ায়।
হলজীবনের সঙ্গী, রুমমেট, শিক্ষকদের মৃতদেহ টেনে এনে জড়ো করা হয়েছিল যে জায়গায়, সেখানে লাশ টানা লোকদের ব্রাশফায়ার করার আগমুহূর্তে একজন ক্লান্তিতে শুয়ে পড়ে। খোলা পানির কলের মতো কলকলিয়ে গরম রক্ত ছুটে আসছে চারদিক থেকে। সে ঢাকা পড়ে যায় রক্তের আড়ালে। অদূরের কোয়ার্টার থেকে এক অধ্যাপক ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে দেখেন, সৈন্যরা চলে যাওয়ার পর মৃতদেহের স্তূপ থেকে উঠে এক অদ্ভুত চেহারার লোক ধোয়া আর কুয়াশায় দৌড়ে যাচ্ছে। গায়ের রক্ত দিয়ে যারা আড়াল করেছিল, লোকটির জীবদ্দশায় তারা খালি হাতছানি দিয়ে ডাকত। কারণ বুলডোজার চালিয়ে সমান করার পরও কারো কারো হাত কবজি পর্যন্ত গণকবরের বাইরে থেকে গিয়েছিল।
: বিশ্ববিদ্যালয়ে কত জন হতাহত হলো–তোমার আনুমানিক হিসাবটা বলল। জাস্ট গিভ মি দ্য অ্যাপ্রোক্সিমেট নম্বর। ওভার।
: তিন শ’র মতো।
: এক্সসিলেন্ট। ইমাম জানতে চাচ্ছেন, তিন শ মারা গেছে, না আহতও আছে?
: আমি একটাই বিশ্বাস করি…তিন শ মারা গেছে।
: আমিও তোমার সঙ্গে একমত। ওই কাজটাই সহজ। নো, নাথিং আড়, নাথিং ডান। তোমাকে ব্যাখ্যা করতে হবে না। আমি আবারও বলছি, ভালো করেছ। চমৎকার কাজের জন্য আবারও বলছি, শাবাশ। ম্যায় বহৎ খুশ হু।
ওভার… রাত্রি ভোর হয়ে আসছে। পর্দাটা খালি। বায়স্কোপ দেখাও শেষ। দর্শকরা ব্যারাকে ফিরে যাচ্ছে ঘুমোতে। ইমাম এসি রুমে ঢুকে আবার গত রাতের উন্মুক্ত অপারেশন কক্ষে ফিরে আসেন। চশমার ঘোলা কাঁচ মোছেন রুমালে ঘষে ঘষে। শহরের শরীর থেকে ধোঁয়া উড়ছে। ভোরের আজানের সুরে সুরে ঝরে পড়ছে করুণ আর্তনাদ। ইমাম। চোখে চশমা তুললেন–খোদা মেহেরবান, একটা মানুষও নেই। একটা রাস্তার কুকুর ভয়ে ভয়ে ধোঁয়া ভেদ করে শহরের দিকে অদৃশ্য হয়ে যায়।
০৪. ঢাকা ত্যাগ
২৬ মার্চ সকাল। কারফিউ চলছে। হাজি সাহেবের বাড়ির সামনের লাইটপোস্টে দড়ি বাধা কুকুরটা যে মরে পড়ে আছে, আশপাশের বাড়ির লোকজন তা শুধু জানালার পর্দা সরিয়ে দেখে, ভয়ে ঘর থেকে বেরোয় না কেউ। তখনো এদিক-ওদিক ফুটফাট গুলির আওয়াজ, বাতাসে পোড়া দুর্গন্ধ। ধারেকাছে নিশ্চয় ঘাপটি মেরে আছে ঘাতক। তা না হলে কুকুরটা মরল কীভাবে? পাড়ার প্রথম শহিদ পাহারাদার কুকুর একদিন একরাত রাস্তায় পড়ে রইল। সকালবেলায় একটা সাদা বিড়াল গুটি গুটি পায়ে মরদেহটা একচক্কর ঘুরে যায়। খানিক পর ডাক্তারের বাড়ির গলাছোলা মুরগিটা এক ঝাঁক ছানাপোনা নিয়ে এর লেজ থেকে মাথা পর্যন্ত ঠোকরায়, ঘাড় তুলে কুড়কুড়িয়ে বাচ্চাদের কী যেন বলে, তারপর জোরে কোথাও বোমা ফাটতে গম্ভীর চালে হেঁটে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ে। দুপুরবেলা ডাক্তার সাহেব সাহস করে রাস্তায় নেমে শনাক্ত করেন–কুকুরটা গুলি খায় নাই, হার্টফেল করেছে। তখন ছাদে উঠে পাড়ার ছেলেরা স্বাধীন বাংলার পতাকা নামিয়ে ফেলে ঝটপট। মরা কুকুর ডিঙিয়ে কেউ কেউ ত্রস্তপায়ে এবাড়ি-ওবাড়ি যায়। কে বাঁচে কে মরে, তাদের হয়তো জরুরি কথা আছে প্রতিবেশীকে শেষবার বলার মতো।
২৫ মার্চ রাতে মহল্লার লোকেরা খাটের তলায়, টেবিলের নিচে, দেয়ালের আড়ালে কাঁথা মুড়ি দিয়ে বেঁচেছে, এখন অদৃষ্টে কী আছে, কে জানে। যে কুকুরটা গত দু’দিন করুণ সুরে বিলাপ করে তাদের আগাম বিপদসংকেত জানাচ্ছিল, তার নেতৃত্বের অভাবে শহরের বাদবাকি কুকুরগুলোও চুপ। টেলিফোন বিকল। রেডিওতে সামরিক আইন অধ্যাদেশের মুহূর্মুহূ প্রচার, বিরতিতে যন্ত্রসংগীত, পুনঃপুন ঘোষিত হচ্ছে-রাস্তায় বের হলেই গুলি। নানা রকম আশঙ্কায় দিনটা শেষ হয়। রাতে ইয়াহিয়ার বেতার ভাষণ শুনে চোখে সবাই অন্ধকার দেখে।
সেই আঁধারে গা-ঢাকা দিয়ে হাজির বাড়ির দোতলার লোকটা নিঃশব্দে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে এক দৌড়ে রাস্তা পার হয়। লোহার গেট বেয়ে উঠে লাফিয়ে পড়ে উঠানে। কোনো শব্দ হয় না। মাটি টিউবওয়েলের জলে ভিজে কর্দমাক্ত। উঠানের বিক্ষিপ্ত ইটের সারি সে সন্তর্পণে পেরিয়ে যায়। খোলা জানালা দিয়ে লাফিয়ে ঘরে ঢোকে। অন্ধকারে প্রথম কিছুই ঠাহর হয় না। নাকে দুর্গন্ধ। রক্তপিণ্ডে পা পিছলে কয়েক গজ সামনে চলে যায়-অন্ধকারে বোঝা মুশকিল ভেজা আঠালো জিনিসটা কী। সে ডান দিকে তাকায়–কিছু নেই। বাঁয়ে তাকায়–খাট শূন্য। গেল কোথায় মেয়েটা? সে দম আটকে রেখে কান খাড়া করে। খাটের তলায় হালকা গুঞ্জন। যেন একটা বেখেয়ালি মাছি মাকড়সার জালে আটকে পড়েছে। লোকটা উবু হয়-খাটের নিচে মরিয়ম, যাকে ২৫ মার্চ রাত উড়িয়ে নিয়ে ফেলেছে ওখানে। মরে যে যায়নি, নাকের কাছে আঙুল ধরে কিংবা বুকে কান পেতে বোঝার চেষ্টা করে না। সে মেয়েটিকে খাটের নিচ থেকে টেনে বাইরে আনে। ঘরের মেঝে ভর্তি কাঁচের টুকরো আর ভেজা-আঠালো অদ্ভুত জিনিসটা। সেদিকে তার খেয়াল নেই। সে এখন এমন উত্তেজিত যে, নিঃশব্দে চলাফেরার কথাও ভুলে যায়। তবে দরজাটা সে খোলে না। হয়তো ভাঙা জানালাটা দিয়েই তার চলাচলের সুবিধা। সে টিউবওয়েল চেপে মগভর্তি পানি নিয়ে এই পথেই আসা-যাওয়া করে। মরিয়মের সারা গা ভিজে জবজবে। তবু জ্ঞান ফেরে না। কতক্ষণ ধরে বেহুশরাত ১২টার আগে নিশ্চয়ই নয়, গোলাগুলি শুরু হওয়ার পর খাটের তলায় নিজে থেকেই ঢুকেছে যখন। লোকটা আঙুল গুনে হিসাব করে, চব্বিশ ঘণ্টা পার হতে এখনো দুই আঙুল বাকি। সে অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে রান্নাঘরে যায়। ওখানে দিয়াশলাই, মোম, কেরোসিনের কুপি সব রাখা আছে। চুলার কাছের কাঠের তাকে হলুদ, লবণ, গুড়ো মশলার পাশে শুকনো মরিচের কৌটা। কৌটাটা হাতে তুলে নেওয়ার সময় লোকটাকে মিটিমিটি হাসতে দেখা যায়। সেকেন্ডে ১ লক্ষ ৮৬ হাজার মাইল আলোর গতিতে একটা হারানো স্মৃতি তার ওপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে-বউয়ের দাঁতকপাটি লেগে গেছে। দু’দিন যায়, তিন দিন যায়, খোলে না। ওঝা আসে বাড়িতে। মাটির মালশার তুষের আগুনে লাল টুকটুকে মরিচ পোড়ানো হয়। বউ হেঁচে-কেশে রক্ত জবার মতো চোখের পাপড়ি খোলে, যা তিন দিন আগে দু’পাটি দাঁতের সঙ্গে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তারপর বাপের বাড়ি চলে যায়। সেখান থেকে জোরজবরদস্তি আনতে গিয়েই খুনখারাবির ঘটনাটা ঘটে।