তখন বুড়ার মনে আবার সাধ জাগে, বুড়া রাজা তখন কয়–এবার আমি চাকরি পামু, ও সোন্দরি তোমায় নিয়া যামু গো, কত সাজনকাজন, হায় হায় সাজনকাজন, কত সাজনকাজন আলতা দিমু কেন তুমি যাইবা না…
তোমার বাড়ি আর যামু না।
বুড়া যাইয়া আসনে বসে। আরেক চেয়ারে বসি আমি। বসার পর বুড়া রাজা ওই টেবিলের নিচ দিয়া পা ঢুকায় দেয়। ঢুকাই দিয়া বলছে যে, আচ্ছা গিন্নি ও ছোট গিন্নি! ওই টেবিলের নিচে লড়ে কী? আমি কই, ওহো লড়ে কী! ওহ্ মনে পড়ছে। বাড়ির পাশ দিয়া চাল কুমোড় যাইতে লাগছিল গো। পাকা চাল কুমোড় তাই টাকা দিয়া কিনে রাখছি। তো বলছে চালকুমড়ো লড়ছে কেন? আমি বলছি, তুমি পাও দিয়া লড়াচ্ছো, একটার গায়ে একটা ধাক্কা খাচ্ছে, তারি জন্য লড়ছে। তখন বুড়া আঙুল ঢুকায় দেয় চন্দন কুমারের শরীলে। ও গিন্নি নরম কেন? আমি বলছি, তালি বোধ হয় একটায় পচন ধরেছে।
চন্দন কুমার তকন পিছ দিয়া বার হইয়্যা দৌড়ে পালায়।
কাহিনিটা টুকির পছন্দ হয়। কুসুমকলি মহিলাটাও খারাপ না। তবে বেলা পড়ে গেছে। তাদের ঢাকা ফেরা দরকার।
পরের বার দৌলতদিয়া যাওয়ার সময় ফেরিতে ওঠার আগে মরিয়ম টুকিকে নিয়ে চলে যায় অন্যদিকে। সেখানে গিয়ে মাঝিমাল্লার সঙ্গে সে মুলামুলি করে। কত বড় সাহস নৌকায় করে পদ্মা পারাপার! মরিয়ম মুখ টিপে হাসে-কেন যুদ্ধের বছর তো বরিশালগামী ধানকাটার মজুরদের নৌকায় করে সে পদ্মা পার হয়েছিল। কিন্তু তখন। ছিল যুদ্ধের সময়। ফেরি চলাচল বন্ধ। মিলিটারি যাতে ব্যবহার করতে না পারে আইডব্ৰুটি-এর মোটরযানগুলো ঘাট থেকে আগেভাগে সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। এখন পারাপারের লঞ্চ-ফেরি থাকতে নৌকা ভাড়া করে কোথায় যেতে চায় মরিয়ম? টুকিকে সে ভেঙে কিছু বলে না। পীড়াপীড়ি করতে বলে, ‘মাঝিমাল্লার আয়-ব্যয়ের হিসাব নিচ্ছিলাম।’ কেন? ‘এম্নি এম্নি।’
মুক্তি অফিসে খোঁজ নিতে গিয়ে শোনে, সেখানে মরিয়ম অনেকদিন যায় না। একটা হাতে লেখা পদত্যাগপত্র দাখিল করে এসেছে বহুদিন আগে। তা গৃহীত হয়েছে। কি হয়নি, খোঁজ নিতেও সে আর যাচ্ছে না ওদিকে।
আরেক দিন মরিয়মের বাড়ি গিয়ে মুক্তি দেখে, টুকি এটা-সেটা গোছগাছ করছে। তাকে দেখেই মিটিমিটি হাসে, ‘আপনে বসে খানিক বিশ্রাম করেন, মেরি আফা দুলুদিয়ায়।’ কখন ফিরবে, টুকি জানে না। মুক্তি বসে আছে। টুকির হাতে প্রচুর কাজ। একসময় উঠে গিয়ে টুকিকে সে জাল পেতে মুরগি ধরায় সাহায্য করে। হাতে হাতে তারা মোরগ-মুরগির পায়ে দড়ি পরাচ্ছে। মুক্তি কেমন ধন্ধে পড়ে যায়। জোড়ায় জোড়ায় মোরগ-মুরগির পায়ে দড়ি পরাচ্ছে কেন টুকি বেগম, ওর কি পুরোনো বাতিকটা ফিরে এসেছে? ফেরিঅলার কাছে লুকিয়ে লুকিয়ে মুরগি বেচে দিচ্ছে? টুকি আবার মিটিমিটি হাসে, ‘মেরি আফা কইল কাজটা করে রাখতি–তাই করছি।’ গোঁয়ারের হদ্দ যে টুকি, মরিয়ম বলেছে বলে কাজ করে যাবে, কথাটা ঠিক বিশ্বাস করার মতো না। মুক্তির জেরার মুখে বলবে না বলবে না করেও টুকি কয়েকটা কথা বলে ফেলে। মাল টানার জন্য সওয়ারি নাও ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে না, তাই মেরি আফা অফিস থেকে টাকা তুলে নতুন একখানা নৌকার বায়না করতে গেছে আরিচায়। মুক্তি চমকে ওঠে-মরিয়মের স্বপ্নেও তো বারবার দেখা দেয় একটা নতুন নৌকা, যা পাল উড়িয়ে তাকে পারাপার করছে। কিন্তু মোরগ-মুরগির পা বাঁধার সঙ্গে এর সম্পর্ক কী? ‘সম্পর্ক নেই মানে?’ টুকি অবাক আর বিরক্ত হয়, ‘আমরা চলি গেলে এ বেচইন দুনিয়ায় মোরগ-মুরগি ক’খান পড়ে থাইকবে?’
‘মোরগ-মুরগি সঙ্গে নিচ্ছেন, আমারে নিবেন না?’ মুক্তি মশকরা করে। টুকি সিরিয়াস-তার মেরি আফা একমাত্র বলতে পারবে, তার জীবনকাহিনি যে লিখছে, তাকে সঙ্গে নিতে চায় কি না। তবে কথা হলো, কাছের মানুষ হলেই যে সঙ্গে নেওয়া যাবে, এমন কোনো কথা নেই। মহা প্লাবন শুরু হয়ে গেল, হজরত নুহ (আ.) খোদার অবাধ্য পুত্রকে নৌকায় তুলতে পারলেন না। তার ওপর খোদাতালার কড়া নির্দেশ ছিল–তোলার রহমানির রাহিম বলেছিলেন, দেখো রে নুহ নবি, তোমার পাপ পুত্রের জন্য ফের সুপারিশ করছ কি তোমার নবুওয়াতি চলে যাবে।
টুকির ভাবগতিকে মনে হয়, এই পাপীতাপীর দুনিয়ায় একমুহূর্তও মন টিকছে না তার। যতটুকু না পারলে নয় ততটুকুই সঙ্গে নিচ্ছে। ব্যাপারটা আর হেঁয়ালি মনে হয় না মুক্তির। কিন্তু এরা যাচ্ছে কোথায়? খাওয়া-পরার তো অভাব নেই যে, দৌলতদিয়া চলে যেতে হবে। তার পরও গেল না-হয়, কিন্তু বয়স যাদের পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে, তারা বেশ্যাপল্লি গিয়ে কী করবে। টুকিকে এসব প্রশ্ন করা নিরর্থক। সে হয়তো ভালো করে জানেও না, তাদের এ যাত্রাপথের শুরু বা শেষ কোথায়।
মরিয়মের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না মাসাধিক কাল হয়ে গেল। সে মুক্তিকে এড়িয়ে এড়িয়ে চলে। মুক্তি ঘরে ফিরে ভাবে, যে একটা উদ্দেশ্যহীন জীবনের লগি তিরিশ বছর টেনেছে, সে কি এর শেষ দেখার জন্য এমন মরিয়া হয়ে উঠবে যে, একটা ডেডবডির পেছনে নৌকা নিয়ে ধাওয়া করবে? এ পাগল ছাড়া কেউ বিশ্বাস করবে? অথবা মালসামান নৌকায় তুলে মরিয়ম আর টুকির দৌলতদিয়া চলে যাওয়া যে অসম্ভব নয়, কুসুমকলি তাদের সাহায্য করতে পারে–তা-ও তার বিশ্বাস হয় না। সে ভাবনা দুটিকে শুধু চোখ ঠারে আর অন্য চিন্তা করে–অভিযোগকারী ছাড়া যুদ্ধাপরাধের বিচারসভা ঠিকভাবে চলতে পারে না, তা প্রতীকী হোক আর আসলই হোক। মরিয়মকে আরো কয়েকটা দিন তার দরকার ।