বহু বছর পর টুকি বাড়ি গেছে একটুখানি জমি ক্রয় করতে। তার পরিকল্পনা–নিজের জায়গায় পুষ্করিণী খুঁড়ে কয়টা মাছ ছাড়বে, পুকুরের তিন পাড়ে গাছ লাগাবে, আরেক পাড়ে হাঁস-মুরগির খামার। এ ছাড়া দামে বনলে নিজের কবরের জায়গা খরিদ করে টুকির এবার ঢাকায় ফেরার ইচ্ছা। স্বাধীনতার চার বছরের মাথায় তাকে গ্রাম থেকে পালিয়ে আসতে হয়েছিল। নিজের বাবা-মাও চায়নি সমাজে কলঙ্কিনী হয়ে এ মেয়ে বেঁচে থাকুক। মানুষের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে প্রথম টুকির বাবা বঁটিতে শান দেয়। তবে নিজের হাতে মেয়েকে খুন করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। পরের বার মা বদনায় বিষ গুলে তার গালের ভেতর ঢেলে দিয়েছিল। মায়ের রাতদিন এক কথা, ‘তোরে বাঁচায় রাইখ্যে কিনো লাভ নাই। তুই মর!’ টুকি যখন মরো মরো, তখন ওর চাচি নাকের কাছে ঘেঁড়া জুতো ধরে, আর চাচাতো বোন যায় দায়ের আগায় করে মানুষের বিষ্ঠা তুলে আনতে। জুতোর গন্ধে আর গু খেয়ে বমি করে পেটের বিষ বের করে দিয়েছিল টুকি বেগম। তাকে হাসপাতালে নিতে হলে পথেই মারা পড়ত। সেই চাচি আর চাচাতো বোন দুদিন পর তাকে রওনা করে দেয় ঢাকার পথে।
বর্তমানে টুকির বাপ-মা দুজনেই বিগত। সে ভেবেছিল, আজ ছাব্বিশ বছর পর বাড়ি যাচ্ছে, লোকজন তাকে চিনতে পারবে না অথবা চিনলেও বীরাঙ্গনার সম্মান দেবে। কিন্তু সেখানে তার অভিজ্ঞতাটা হয় তিক্ত। ‘আরে টুকি বেগম, তুই পাড়া থেইক্যে কবে আলি?’ বাড়ির সীমানায় ঢোকার মুখে একজন তাকে গায়ে পড়ে জিগ্যেস করে। টুকি কিছু বোঝার আগে অন্য জন জবাব দেয়, বয়স হয়েছে তো, পাড়ার থে রিটায়ার করছে। গ্রামের লোকেরা তার কাছে জমির দাম হাঁকলো ডবল আর টাকা নিয়েও কবরের জায়গা বেচতে রাজি হলো না। জমি ও কবরের জায়গা কিনতে ব্যর্থ হয়ে টুকি ঢাকা ফিরে এসেছে।
টুকির ভাগ্যটাই খারাপ। জীবনে একটা গণ-আদালত চাইল–হলো না। আরেকটা মুক্তিযুদ্ধ চাইল, তারও সম্ভাবনা নেই। বাকি জীবন গৃহস্থ হয়ে কাটাতে চেয়েও সে ব্যর্থ হলো। মরলে যে কবরে শোবে, নগদ টাকা দিয়েও সে তা কিনতে পারল না। ঢাকা ফিরে টুকি বেগম সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকে। মরিয়ম দশবার জিগ্যেস করলে, একবার জবাব দেয়, কখনো দেয়ও না। কী মুশকিল! মরিয়ম নিজেকে সামলাবে না টুকিকে দেখবে? অনুরাধার বিষয়টা তাকে এলোমেলো করে দিয়েছে। জীবন নাটক-সিনেমার চেয়েও আজব। সে বিশ্বাস করবে কি করবে না? বিশ্বাস করলে নিজে সে দাঁড়াবে কোথায়? যে দেশে বীরাঙ্গনা মরলে কবর পায় না, সে দেশে হবে যুদ্ধাপরাধের বিচার! দুই বছর ধরে মুক্তিকে জবানবন্দি রেকর্ড করতে দেওয়াটাই তার ভুল হয়েছে।
এসব চিন্তা যার মাথায় আসে, তার রেগে যাওয়া অসম্ভব কিছু নয়। মরিয়ম দেখে, সে রেগে যাচ্ছে, তবে টুকির ওপর।
অবশেষে টুকি একদিন মুখ খোলে–
‘বেশ্যা না হয়েও বেশ্যা হয়ে গেলাম। কী সার্থকতা আমার জীবনের! আজীবন কুমারী থাইক্যে কী লাভ হলো।’
‘কে কুমারী?’
‘কেন আমি! তুমি তো দু-দুটি বিয়ে করেছ। আমি করিছি?’
‘কিন্তু তোমার না একটা বাচ্চা হইছিল মিলিটারি ক্যাম্পে?’
‘হইয়েছিল তো কী? তখন কি আমার স্বামী আছিল, না মন থাকি আমি চাচ্ছিলাম যে, আমার একটা বাচ্ছা হোক? এ তো অত্যাচারের ফসল।’
চাক বা না চাক, বাচ্চা হওয়ার পর কেউ যে কুমারী থাকে না–এ কথাটা মরিয়ম বোঝাতে গেলে দুজনের মধ্যে ঝগড়া হয়ে যায়। কথাবার্তা বন্ধ। মুক্তি বাড়ি গেলে, টুকি আঙুল তুলে বন্ধ ঘর দেখায়, ‘খিল দিয়া পড়ি রইছে। দুয়ারে বাড়ি মারা নিষেধ।’ কী ব্যাপার? মরিয়ম কি অনুরাধার জন্য শোক পালন করছে? মহিলা মারা গেছে এখনো চল্লিশ দিন পুরো হয়নি। এত্তেকাফে বইছে মনে লয়, টুকি বলে। এই বেলা আল্লার বন্দিগি না করলে করবে কবে! সময় তো শ্যাষ। কিন্তু পরের বার মুক্তি গিয়ে শোনে, মরিয়ম দৌলতদিয়া গেছে এবং সেখানে সে প্রায়ই যায়, অনুরাধার ছোট মেয়েটার জন্য জামাকাপড়, কলম-পেনসিল, বইখাতা নিয়ে। তাতে বিশেষ লাভ হচ্ছে না। অনুরাধার মেয়ে নয় বছরের চম্পাবতাঁকে ব্যবসায় নামিয়ে দিয়েছে কুসুমকলি। চম্পাবতী তাতে অমত করেনি। সে এখন হাসি মুখে গরু মোটাতাজাকরণের ইঞ্জেকশন নিচ্ছে।
টুকিও এক-দুইবার দৌলতদিয়া গেছে মরিয়মের সঙ্গে। জায়গাটা তার পছন্দ হয়নি, ‘এমুন জায়গায় সুখ আছে তয় শান্তি নাই। এত হইচই, যেন বছরচুক্তি মেলা বসাইছে।’ ব্রথেলে ঢুকেই তার পালাই পালাই ভাব। এদিকে মরিয়মের ইশারা পেয়ে কুসুমকলি টুকিকে বলে, ‘বুইন, তুমারে আমি একটা কমিডি দেখাই, মনে ফুর্তি লাগবে তোমার।’
ঘরের মাঝখান থেকে ট্রাংক, চেয়ার, টেবিলফ্যান সরিয়ে মঞ্চ তৈরি হয়। কুসুমকলি পরনের শাড়ি কোমরে প্যাঁচ দেয় শক্ত করে। এ তার একক অভিনয়, নৃত্যগীত সহযোগে–
এক ধনী রাজা থাকে, রাজার দুটি স্ত্রী থাকে, রাজা বৃদ্ধ। বড় স্ত্রী থুয়ে, নাতি নাতনি রাইখ্যাও সে আবার বিয়া করে। আমার রূপ দেখে সে পাগল হয়া যায়। পাগল হয়া সে আমারে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। আমি গরিবের মেয়ে থাকি, একটা ঝিয়ের মেয়ে থাকি। ধন-সম্পদের লোভে আমার মা ওই বুড়া রাজার সাথে আমারে বিয়া দেয়। আমার বাবা থাকে না। বুড়ার নাতি থাকে চন্দন কুমার। দাদু তো বুড়া মানুষ, আমি চ্যাংড়া মানুষ, দাদুর বউ হইয়্যা আমি তার নাতির সাথে প্রেম করি। গোপনে গোপনে প্রেম করি। এক রাইতে আমি বাগানে চলে যাই। বুড়া ঘরে আইস্যা পায় না আমারে। না পায়া হরিকল আর লাঠি নিয়া খুঁজতে খুঁজতে দেখে যে, আমারে পাওয়া গেছে। স্টেজে তখন একটা টেবিল থাকে। টেবিলের নিচে পর্দা থাকে। তখন চন্দন যায়া টেবিলের নিচে পলায়। বুড়া কচ্ছে কী, তুমি এখানে রয়েছ গিন্নি, আমি খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে যাচ্ছি। আমি বুড়া রাজাকে ল্যাং মেরে ফেলায় দিয়ে একটা গান ধরি–আমি তুমার ভাত খামু না। তুমার বাড়ি আর যামু না। তোমার সংসারেতে খাইট্টা মলাম বুড়া, তুমি পরনেতে, হায় হায় পরনেতে, ও পরনেতে ভালো একখান রঙিন শাড়িও দিলা না। তুমার বাড়ি আর যামু না।