দৌলতদিয়ার মুক্তিকে দেখে হায় হায় করে ওঠে এনজিওকর্মী, ‘এত দেরিতে আইছেন, রাধারানী মইর্যা গেছে।’
বলে কী! ‘কীভাবে মরল?’
‘হার্টফেইল করছিল।’
মুক্তিও মনে হয় বিশ্বাস করেছিল, রাধারানীর একশ বছর পরমায়ু। কিন্তু এনজিওকর্মী তা বিশ্বাস করে না। সে বলে, ‘ধুর ধুর, শিক্ষিত মানুষ, কী কন, পাগল ছাগলের মতো কথাবার্তা।’ এদিকে কুসুমকলি রাধারানীর একশ বছর পরমায়ুতে এখনো অটল। ‘রাধারানী মরলো ক্যামনে’ মুক্তি জানতে চাইলে সে বলে, ‘মদের মইধ্যে বিষ মিশাইয়া দিছিল। নইলে অত সহজে মরণ হয় রাধারানীর! ওর একশ বছর পরমায়ু ছেল।’
‘কে করল কাজটা?’
পতিতালয়ে শত্রুর অভাব! ভালোবাসাবাসির পীঠস্থান বেশ্যাপল্লি। সংসারে প্রেমের ভাটা পড়লে পুরুষমানুষ ভালোবাসা খুঁজতে আসে এখানে। সঙ্গে নিয়ে আসে হিংসা-বিদ্বেষ-সন্ত্রাস। এই ‘এক বচ্চরে, জানেন, কয়জন বেশ্যা খুন অইছে এই পতিতালয়ে? জোছনা, পিরিয়বালা…’ কুসুমকলি একদিকে আঙুলের গিঁট গোনে আরেক দিকে মৃত বেশ্যাদের নাম স্মরণ করার চেষ্টা করে। এই ফাঁকে এনজিওকর্মী বলে, ‘মোট পাঁচজন।’
‘তুমি রাধারানীরে বাদ দিয়া গুনছো!’ এনজিওকর্মীর ওপর রেগে টং কুসুমকলি। একজন মনে করে, রাধারানী খুন হয়েছে, আরেকজনের দৃঢ় বিশ্বাস–এ স্বাভাবিক মৃত্যু। দুজনের মাঝখানে পড়ে গেছে মুক্তি। তার মধ্যস্থতা আবশ্যক—‘রাধারানী যে খুন অইছে আপনে শিওর?’ কুসুমকলি ঝাঁঝিয়ে ওঠে, ‘শিউর শিউর একশবার শিউর। হাজারবার শিউর।’
রাধারানীর মৃত্যুর চার দিন আগে দৌলতদিয়ায় দুজন মাঝবয়সি খদ্দের আসে। এসেই পাশাপাশি দুটি ঘরে ঢুকে পড়ে। এদের দেখলে মনে হয় যমজ, আসলে আজরাইল-রাধারানীর জান কবজ করতে এসেছিল। তারা বেরিয়ে যাওয়ার সময় রাধারানী মাতাল অবস্থায় তাদের সামনে পড়ে যায়। তখন যমজ বা আজরাইল একজন বলে, ‘এই তুমি অনুরাধা না? বি কে সরকারের মাইয়্যা! যে লোয়ার কোর্টের উকিল ছিল।’
মুক্তির বুক কেঁপে ওঠে। ওদিকে তখন রাধারানীর নেশা ছুটে গেছে। সে বলে, ‘না, আপনেরা ভুল করতাছেন, আমি রাধারানী। বাপের নাম খেদমত আলি। হে চৌকিদার ছিল। বর্তমানে মৃত।’ এক নিঃশ্বাসে কথা কটা বলে রাধারানী ঘরে ঢুকে খিল তুলে দেয়। সে সময় রাধারানীর জন্য কলাপাতায় শুঁটকি মাছের চচ্চড়ি নিয়ে আসছিল কুসুমকলি। গলির মুখে যমজ দুজনের সঙ্গে দেখা। তারা তখন বলাবলি করছিল, ‘অনুরাধা সরকার পাড়ায় আইয়্যা রাধারানী অইছে। হের ত্যাজ দ্যাকছো? আবার মদও খায়!’ কুসুমকলি আগামাথা কিছু না বুঝে শুঁটকির চচ্চড়ি হাতে রাধারানীর দুয়ারে ধাক্কা দেয়। অহ্ রাধে, ‘অহ্ রানী, দুয়ার খোল দিনি! তোর চাট বানাই আনছি।’ রাধারানী দুয়ার খোলে না। পাশের ঘর থেকে দুজন বেশ্যা তখন বেরিয়ে আসে। তাদের যমজ সোয়ামিরা যে হাটে হাঁড়ি ভেঙে গেছে, কুসুমকলি তখন তা। সবিস্তারে জানতে পারে। রাধারানীর মারা যাওয়ার দিন বিকালে যমজরা ফিরে আসে। হাতে বিলাতি মদের বোতল। এবার তারা বেশ্যা দুটির ডাকাডাকি অগ্রাহ্য করে সরাসরি রাধারানীর ঘরের দিকে চলে যায়। তারপর ঘরের মধ্যে খুব চিল্লাফাল্লা হয়। যমজরা চলে যাওয়ার পর সেই রাতেই রাধারানী হার্টফেল করে।
মরিয়ম বিশ্বাস করে না। অনুরাধাকে এ তিরিশ বছর সে মৃতই ধরে নিয়েছিল। মৃত্যুসংবাদটা তাই নতুন কিছু নয়। কিন্তু কেউ কি নিজের ভবিষ্যদ্বাণী ফলানোর জন্য জোর করে রান্ডি হয়? মুখে বলে, ‘ওর মতো শিক্ষিত মেয়ে বীরাঙ্গনা বলে বেশ্যা হয়ে যাবে? ওর কি ভাত-কাপড়ের অভাব ছিল?’
‘কিন্তু সে বেশ্যা হয়ে গেছিল তো।’ মুক্তি জোর দিয়ে এই কথা বললে মরিয়ম মাথা নাড়ে, ‘না না, তুমি ভুল করছো।‘ তারপর ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে অনুরাধার চোখে চশমা ছিল কি না জানতে চায়। মুক্তি বলে, ‘ছিল। তবে ডাঁটিভাঙা। পাটের দড়ি দিয়া মাথার চুলের সঙ্গে বেঁধে রাখছিল।’ মরিয়ম তাতেও ভড়কায় না। যে অনুরাধা একদিন অনুসন্ধানকারী দলের কথা বলত, যারা ওর হাড়গোড়, ছেঁড়া কাপড়চোপড়, চুলের গোছা নির্যাতন শিবির থেকে উদ্ধার করবে, তাকে ভুলে যেতে দেবে না, অমর করে রাখবে, যুদ্ধের তিরিশ বছর পর মারা গিয়েও সে স্বাধীন বাংলাদেশে গোর পেল না, তার মৃত দেহটা ভাসিয়ে দেওয়া হলো পদ্মায়–এ কাহিনি শোনার পরও মরিয়ম একইভাবে মাথা নাড়ে। ‘না না, তুমি মেয়ে নিজেরে কী ভাবো? নিজে তুমি দেশ-দশের ওপর রাগ করে বেশ্যা হইবা? বা এমন কেউ বেশ্যা হবে, যার ভাত-কাপড়ের অভাব নাই, যে শিক্ষিত? তোমার ভুল হতে পারে না! এক নামে। দুনিয়ায় বহুৎ মানুষ থাকে। এই বেশ্যা অন্য কেউ।’
মুক্তি মুখ ফুটে বলে না যে, এই মেরি ওরফে মরিয়মও একদিন বেশ্যা হওয়ার চিন্তা করেছিল, মমতাজের সঙ্গে বিয়ে ভেঙে যাওয়ার সময়, যদিও সে শিক্ষিত, তার ভাত-কাপড়ের অভাব ছিল না। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চিন্তা-ভাবনাও কেমন বদলে যায়।
তাদের কথাবার্তার মাঝখানে টুকির মোরগ-মুরগি উঠান থেকে বারান্দায় লাফিয়ে লাফিয়ে ওঠে। অনুরাধার মৃত্যুসংবাদে যেন মানুষ নয়, কতগুলো অবোধ প্রাণী এক জায়গায় জড়ো হয়েছে। সন্ধ্যালোকে এ বাড়িটার রং ধূসর, বিস্মৃতকালের প্রাসাদের মতো মলিন, বিবর্ণ। মরিয়ম গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। টুকি দেশের বাড়ি গেছে আজ চার দিন। দিন শেষে মোরগ-মুরগিদের আধার খাইয়ে খোয়াড়ে তোলার কাজটা এখন তাকে করতে হবে।