বীরাঙ্গনা নিয়ে এত পলিটিক্স! দেখে-শুনে সাক্ষাৎকার দেওয়ায় টুকির রুচি হয় না। সে মুরগি পোয় ফের মন দেয়। সন্তানস্নেহে ছানাপোনা লালন-পালন করে। সে একাই এদের বাপ-মা, ভাই-বোন, মামা-খালা। আর অবসর সময় তার কাটে জায়নামাজে বসে তজবি জপে। টুকি তো পরকালের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, মরিয়মের বয়স পঞ্চাশ হতে চলল, কাউকে কিছু না জানিয়ে দুনিয়া থেকে সে বিদায় নেবে?
গোলাম মোস্তফার মৃত্যুতে মরিয়মের বুক থেকে পাষাণ নামে। যুদ্ধাপরাধের শাস্তি না পেয়েই তিনি রোগে ভুগে গত হয়েছেন। আরেকজন যিনি, খবরের কাগজে মেয়ের নির্যাতনের কাহিনি পড়ে ভর্ৎসনা করতে ছুটে আসতেন ঢাকায়, তিনিও পরলোকগত। মনোয়ারা বেগমের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে মরিয়ম গোপন কথা ফাঁস করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ ব্যাপার রত্না-ছন্দাকে জানানোর সে প্রয়োজন মনে করে না। তাদের একজন ফুলতলি, আরেকজন সৌদি আরবে সুখে-শান্তিতে স্বামীর সংসার করছে। বিপদে আপদে কোনোদিন তাদের পাশে পাওয়া যায়নি। এ ব্যাপারেও তাই বোনদের দূরে রাখা মরিয়ম শ্রেয় মনে করে। প্রস্তুতির শেষ অবস্থায় মুক্তি যখন দরজায় কড়া নাড়ে, তত দিনে বাংলাদেশের বয়স আটাশ। আর সময়টা হচ্ছে ১৯৯৯ সাল।
২৯. জীবনের শেষ কোথায়
দুই বছর দীর্ঘ সময়–একটা কেস স্টাডির জন্য তো অবশ্যই। মরিয়ম যে একাত্তরের বীরাঙ্গনা, এর কোনো লিখিত তথ্য-প্রমাণ ছিল না। এ ব্যাপারে আগে থেকেই বীরাঙ্গনা অফিস দেউলিয়া। পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের পর নতুন শাসকদলের উত্থান ঘটে। যে দেশে ক্ষমতার লড়াই মুখ্য, সে দেশে মহৎ কাজ সরল গতিতে চলতে পারে না। এদিকে দুর্গম পথের যাত্রী চিরকালই দুর্লভ। প্রাক্তন সমাজকর্মীরা পাততাড়ি গুটালেও এ থেকে মুক্তি পান না। ১৬ ডিসেম্বর, ২৬ মার্চসহ বছরের আরো কয়েকটা দিন টিভির ক্যামেরার সামনে তাদের বসতে হয়। দীর্ঘ সাক্ষাৎকারও দেন কেউ কেউ খবরের কাগজে। তরুণেরা তাঁদের কথা অভিসন্দর্ভে কোড করে। কিন্তু মুক্তির হাত শূন্য–দেখা হওয়া মাত্র দৌলতদিয়ার রাধারানী বাইন মাছের মতো পিছলে বেরিয়ে গেছে। বেতনভুক সমাজকর্মী বেবি এসব দৃশ্যের বাইরে থাকলেও কিছু স্মৃতি সে টেবিলের কাঁচের ঢাকনার নিচে সংরক্ষণ করেছিল। সেই সুবাদে হয়তো মরিয়মের ঠিকানাটা তার মনে থাকে। পরে যা চলে আসে মুক্তির হাতে। সেখানে মরিয়ম আছে আবার নেই। কারণ তার পেছন পেছন নয় মাসের যুদ্ধের কাহিনি পদ্মা পার হয়ে চলে গেছে বহু দূর। মুক্তিকে সেই পথ ধরে এগোতে হচ্ছিল। নতুন অনুসন্ধানে দেখা গেল, যে রমিজ শেখ যুদ্ধের তৃতীয় মাসে পাকিস্তান জিন্দাবাদ আর জয় বাংলা স্লোগান দুটি আলাদা করতে পারেনি, সে একজন মৃত দেশপ্রেমিক। নতুনগাঁয়ের জৈতুন বিবি ফোকলা মুখে কথা কয়ে ওঠেন। মরিয়মের চাঁদপানা মুখ এখনো তার মনে আছে। তবে আশি বছরের বৃদ্ধা মনে করেন, মেয়েটি বড় অলক্ষুনে। তার শরীরের গন্ধ শুঁকে নতুনগাঁয়ে মিলিটারি এসেছিল। মন্টুর কবর পাকা করার মানত ছিল মরিয়মের। হানাদার বাহিনীর গাড়ির হেডলাইটের ওপর পতঙ্গের মতো মন্টুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখেছে মুক্তিযোদ্ধাদের গাইড, ভূমিহীন কৃষক আমিনুল। সে জানায়, যার লাশই পাওয়া যায়নি, তার কবর আসবে কোত্থেকে। বৃষ্টি আর বন্যায় তিরিশ বছরের ভাঙা কবর উদ্বাহু মুক্তিযোদ্ধা মজিবরের। কমলগঞ্জের ঘরজামাই আতা মিয়া, যে একের পর এক ব্যর্থ অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছে, অথচ এ নিয়ে কখনো দুঃখ করেনি, সে মেজর ইশতিয়াককে শনাক্ত করার একমাত্র দাবিদার। মেজর ইশতিয়াক তালাবন্ধ ঘরে। মরিয়মকে আটকে রেখে পালাতে গিয়ে গ্রামবাসীর ক্রোধানলে পড়ে এবং মরতে মরতে বেঁচে যায়। মরিয়মের উদ্ধারকারী মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল, যে পর্যায়ক্রমে যুদ্ধ আর মদে মাতাল, মরিয়মের শত্রু লাঞ্ছিত, দুর্গন্ধময় শরীরটা আজও তার মনে ঘৃণার উদ্রেক ঘটায়। এফডিসির সাইড একট্রেস বকুল বেগম, যার সঙ্গে মরিয়মের দেখাই হয়নি, হবেও না হয়তো কোনোদিন, বীরাঙ্গনা অফিস’ অধ্যায়ে যে হঠাৎ হাজির হয় আবার চলেও যায়, যাকে বাস্তবের চেয়ে সিনেমার চরিত্র বলেই বেশি মনে হয়, তার ব্যাপারে মরিয়মের কোনো আগ্রহই নেই। মেরি ওরফে মরিয়মের মুখে খালি এক কথা, মুক্তি, অনুরাধার সঙ্গে আমার একটা সাক্ষাতের ব্যবস্থা করো। তোমার অফিস তো কত জনকে খুঁজে বের করেছে। দেখো না চেষ্টা করে–পারো কি না!’
‘কেন?’
‘ওর কাছে একটা কথা জানতে চাই আমি। আরেকটা ভবিষ্যদ্বাণী।’
‘কী সেটা?’
‘আমার জীবনের শেষ কোথায়, আমি জানতে চাই।’
দুই বছর পর হঠাৎ করে মুক্তির তখন দৌলতদিয়ার রাধারানীর কথা মনে পড়ে। যে হাত না দেখেই অন্যের ভবিষ্যৎ বলতে পারত, নিজের পরমায়ুও বলেছিল–একশ বছর, মরিয়মের জীবনের শেষ কোথায়, এমন এক ভবিষ্যৎ বক্তারই তো তা জানার কথা। মুক্তি দ্বিতীয় দফায় দৌলতদিয়া যাওয়ার কথা ভাবে। মরিয়ম বলে, ‘যেতে চাচ্ছ। যাও। আমি গণকফনকে বিশ্বাস করি না। আমার মা করত।’
না করুক বিশ্বাস মরিয়ম। রাধারানীর সঙ্গে মুক্তির অন্য কাজ আছে। তার সাক্ষাৎকারটা নিশ্চয় ব্যতিক্রমধর্মী হবে। টুকির উচ্চাকাঙ্ক্ষায় মুক্তিকেও পেয়ে বসেছে। আরো জবানবন্দি তার চাই যুদ্ধাপরাধের বিচারের আয়োজন করতে, যা তাদের গবেষণা প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য বা গৌল।