সত্তর-আশি–এই দুই দশক মরিয়ম নিজের সমস্যা নিয়েই ছিল। নব্বইয়ের শুরু হিসাব-নিকাশ আর বোঝাপড়া দিয়ে। তাতে কে হারে, কে জিতে বলা যায় না। কষ্টের নিরিখে যদি বিচার হয়, তবে মরিয়মেরই জিত হবে। কারণ পাকিস্তানিরা তাকে যে অত্যাচার করেছে, এর তুলনায় মেজর ইশতিয়াকের সঙ্গে ভালোবাসাবাসি সমুদ্রে এক ফোঁটা শিশিরবিন্দু। আর গোলাম মোস্তফার রাজাকারি করার পেছনে মরিয়মের কোনো হাত ছিল না। লোকটাকে সে বরাবর অপছন্দই করেছে।
নিজেকে একবার বাদী আরেকবার বিবাদী ভাবতে ভাবতে মরিয়মের রাত কাবার। যুদ্ধাপরাধীর বিচার নিয়ে অনেকের মতো সেও বিভ্রান্ত। এসব ঝামেলা নেই টুকির। সে প্রলেতারিয়েত। ঘুমের ভেতর দিয়ে সুখী-সমৃদ্ধিশালী ভবিষ্যতের দিকে ছুটে যাচ্ছে। তার গন্তব্য আরেকটা গণ-আদালত।
বছরের পর বছর গড়ায়, গণ-আদালত আর বসে না। টুকি জেরা করে, ‘মেরি আফা, খবরের কাগজটা খুটোয় খুটোয় দেখছেন তো? চশমা পরে আরেকটু দ্যাখেন।’ আরেকটা গণ-আদালত বসাতে লোকজনের এত দেরি হচ্ছে–টুকির বিশ্বাস হতে চায় না। হালে মরিয়মেরও চোখে নতুন একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। আগে চশমা ছাড়া দূরের সবকিছু ঝাপসা লাগত, এখন খবরের কাগজ পড়তে গেলে চোখ থেকে চশমাটা খুলে ফেলতে হয়, নয়তো ঝাপসা লাগে। সে টুকির দিকে চশমা পরে তাকায়, পরক্ষণে খবরের কাগজ পড়ে চশমা খুলে। টুকি তা পছন্দ করে না। মেরি আফার সবকিছুতেই ধরি মাছ না-ছুঁই পানি ভাব। নিজে তো মরে মরে বেঁচে রয়েছে, টুকির জীবনে উন্নতি হোক, সেটিও চায় না। এ কেমন মানুষ!
গণ-আদালতের ভাবনাটা যখন মুছে যাচ্ছিল টুকির মন থেকে, তখন হঠাৎ একদিন খবরের কাগজ ঘাঁটতে ঘাঁটতে মরিয়মের কুয়াশাময় দৃষ্টিপথে মুক্তিযোদ্ধা। তারামন বিবি ভেসে ওঠে। ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্ব পাড়ে চরাঞ্চলে তার বাড়ি। পথ দুর্গম। নদী পার হয়ে, চরের উত্তপ্ত বালুর ওপর দিয়ে সাংবাদিকেরা ছুটে যাচ্ছে। তাদের সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হওয়ার পর তারামন বিবি সশরীরে আবির্ভূত হন। চোয়াল ভাঙা রোগাক্রান্ত চেহারার এক নারী। পেশা উঞ্ছবৃত্তি। স্বাধীনতার ২৪ বছর পর যক্ষ্মা রোগে ভুগে ভুগে শেষাবস্থায় জাতির সামনে উপস্থিত হয়েছেন। খবরের কাগজ খুললেই তার ছবি, খবর, সাক্ষাৎকার। তারামন পেট ভরে ভাত খেতে চায়। তারামন বাঁচতে চায়। বাঙালি জাতির প্রতি তারামনের আহ্বান, ‘একসময় আমার শরীলে জোর ছিল, এখন কডা হাড্ডি আছে খালি, গায়ে শক্তি নাই, তাই আপনাদের কাছে আমার একটা কথা, এই বাংলাদেশটারে আপনেরা সবায় ধইরা রাইখেন। কারো হাতে ছাইড়া দিয়েন না।’ তারামনের অভিব্যক্তি, ‘মনে অয় য্যান দেশ আবার স্বাধীন হইছে।’ তারামনের মুক্তিযুদ্ধ করার কারণ, ‘পশ্চিম পাকিস্তানিরা আমাগো ভালো ভালো খাদ্যবস্তু, কাপড়লতা সব লইয়া যাইতো। আমরা পাঞ্জা দিয়া ধরছি, যুদ্ধ করছি, যুদ্ধ কইরা দ্যাশ স্বাধীন করছি।’ ঢাকা এসে তারামন বিস্মিত, ‘মানুষ কত ভালো ভালো খাওন খায়, দালানে ঘুমায়। আর আমার কপালে দুই বেলা নুনভাত জুটে না!’ বিবিসির কাছে তারামনের নালিশ, ‘খুনি আসামি যদি অইতাম, তাইলে নিশ্চয় সরকার আমারে বাহির করা হারতো। আমারে হাজতে দিয়া থুইতো। আইজ যুদ্ধ কইরা, শরীলের রক্ত দিয়া যুদ্ধ কইরা আমি ঘরে বইস্যা রইছি। কেহই খোঁজও নেয় না।’
এসব টুকিরও মনের কথা। তবে কথাগুলো স্টেজে উঠে নিজের মুখে বলতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু এ সুযোগ একা তারামনের। রাস্তায় দাঁড়িয়ে লাফালাফি করলেও সাংবাদিকদের ক্যামেরা এখন টুকির দিকে ঘুরবে না। সেসব ব্যস্ত তারামনকে ধরতে–প্রধানমন্ত্রী পদক তুলে দিচ্ছেন তারামন বিবির হাতে, শহিদমিনারে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করছেন তারামন বিবি, সাভার স্মৃতিসৌধে পুষ্পমাল্য অর্পণ করতে গেছেন তারামন বিবি, তারামনকে সামনে দাঁড় করিয়ে শিল্পীরা দেশাত্মবোধক গান গাইছেন, নারী নেত্রীরা মাইক ধরে আছেন তারামনের মুখের ওপর।
মরিয়মের কাছে টুকি শোনে, সরকার পঁচিশ হাজার টাকা দিয়েছে তারামন বিবিকে। ‘ইত্ত টাকা! হে তো বড়লোক হইয়ে যাবে, আফা। কী কাজ করে এত টাকা পাইলো?’
‘অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছে তারামন।’
‘যুইদ্ধ করলে টাকা পাওয়া যায়? এ দেশে আর যুইদ্ধ হবে না?’
যুদ্ধাপরাধের বিচারের গণ-আদালত বাদ দিয়ে, আরেকটা যুদ্ধের অপেক্ষা করে টুকি বেগম। যাতে সে অস্ত্র হাতে লড়তে পারে। কিন্তু টাকা আর খ্যাতি তো পাওয়া যায় যক্ষ্মা হওয়ার পর, স্বাধীনতার ২৪ বছর পর। এতগুলো বছর কি তার হাতে আছে? এক ঝাঁক মোরগ-মুরগির মধ্যে মন খারাপ করে বসে থাকে টুকি। সুযোগের অভাবে জীবনে উন্নতি হলো না। মুরগির ডিম বেচে পঞ্চাশ-একশো টাকা দিয়ে কী হয়। তারামন বিবির মতো একমোটে পঁচিশ হাজার, পঞ্চাশ হাজার পেলে না কথা ছিল।
সপ্তাহ খানেক পর মরিয়মের খেয়াল হয়, মুরগির সংখ্যা ধাই ধাই করে কমে যাচ্ছে। টুকিকে জিগ্যেস করলে সে মুখ ঝামটা দেয়, ‘বেজিতে ধইরে নে যাচ্ছে। আমি কী করব?’ বেজি! ঢাকা শহরে বলে বিড়ালই প্রায় নেই, বেজি আসে কোত্থেকে? দু তিন রাত জেরা করার পর বের হয়, ফেরিঅলার কাছে মুরগি বেচে দিচ্ছে টুকি। ক্ষুদ্র ব্যবসায় তার আর মন বসছে না। তাহলে সে কী করবে? মরিয়ম ক্ষুব্ধ-এ বাড়িতে যারাই থাকতে আসে, তাদেরই মাথা বিগড়ে যায়। দোষ বাড়িটার, না মেরির? আবার বোতল পরা এনে চারধারে পুঁতলে কেমন হয়? মরিয়ম তা-ই করবে। তার আগে, টুকির এত অর্থ-প্রতিপত্তির লোভ, সে যে একজন বীরাঙ্গনা, এ খবরটা পত্রিকা অফিসে ফোন করে জানাতে হয়। সাংবাদিকরা হয়তো ক্যামেরা নিয়ে আসবে, কিন্তু টুকির অর্থপ্রাপ্তির তাতে গ্যারান্টি নেই। পেতে পারে, আবার না-ও পারে। তা ছাড়া সাংবাদিকরা হয়তো কথায় কথায় জেনে যাবে, এ বাড়িতে একজন না, দুজন বীরাঙ্গনা। পরের জন শিক্ষিত, চাকরি করে। এযাবৎ যত বীরাঙ্গনার হদিশ পাওয়া গেছে, তারা সবাই গরিব। টাকাপয়সা আর ছেলেমেয়ের চাকরির জন্য একাত্তরের ইজ্জত লুণ্ঠনের কথা বলে সমাজের কাছে আরেকবার বেইজ্জত হয়েছে। শিক্ষিতরা বেনামি, চেহারাহীন। টিভি নাটকে তাদের জায়গায় পেশাদার নায়িকারা অভিনয় করেন। সাংবাদিকরা মরিয়মের সন্ধান পেলে, দেখা যাবে, টুকিকে বাদ দিয়ে তার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে।