গোলাম আযমের ফাঁসির রায় কার্যকর না হলেও, সেই স্মরণীয় দিনে মরিয়ম টুকিকে কুড়িয়ে পায়। টুকি আসার পর বাড়িটা আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে। মনোয়ারা বেগম হাস্নাহেনার ঝোঁপ নিকেশ করে চলে গেছেন। বাঁশঝাড় তো কবেই শেষ। পাকা কুয়ার ধার ক্ষয়ে গেছে। টুকি প্রথম কোদাল দিয়ে কুয়ার পাড়টা সাফ করে। দেয়ালের ধার ঘেঁষে পেঁপে আর কলাগাছ লাগায়। কয়েকটা মোরগ-মুরগি নিয়ে সে গার্মেন্টসের চাকরির বিকল্প একটা প্রকল্প দাঁড় করায়। প্রকল্পের পুঁজি মরিয়মের আর পরিকল্পনা ও শ্রম টুকির। ‘বাসায় ইত্তো ইত্তো খালি জাগা! পশু-পাখি ছাড়া মানুষের জীবন চলে?’ এটা টুকির থিওরি। এদিকে মুরগিগুলোর ঘরের যত্রতত্র পায়খানা করায়, বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে বিছানায় ওঠায়, অসময়ে ডাক ছাড়ায় মরিয়ম ত্যক্ত-বিরক্ত। মুখে কিছু বলে না। টুকি থাকলে মুরগি থাকবে, মুরগি না থাকলে টুকি থাকবে না–এ অলিখিত নিয়ম। তা মানতে হবে। না মানলে আবার অন্ধকার গর্তে পড়া অনিবার্য, যা সে যমের মতো ভয় পায়।
বাড়িতে মরিয়ম আর একা নয়। অফিস থেকে সন্ধ্যায় ফিরে এলে হাসিমুখে দরজা খুলে দেওয়ার একজন মানুষ আছে। সারা দিন কোন ক্লায়েন্ট কী করল, বসের ব্যবহার কেমন ছিল, দুপুরে লাঞ্চ করেছে কী দিয়ে–মন খুলে এসব তুচ্ছ কথা বলা যায়। টুকি টুকটুক করে মোরগ-মুরগিদের আধার খাওয়ায়, ‘গার্মেন্টস মালিকের কত বড় সাহস, এত দিন আমারে শোষণ করছে! আমি একজন বীরাঙ্গনা। আয় আয় কক কক। মেরি আফা, সাদা ডুরি মুরগিডার মনে অয় ডিম পাড়ার সময় হয়েলো, সারা দিন টইটই কইরে জাগা বিছরায়।’
দেরিতে হলেও ’৭২ সালের আদলে টুকির পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হয়েছে। তখন মিরপুরে পোলট্রি ফার্ম করা হয়েছিল বীরাঙ্গনাদের রোজগারের জন্য। তারা মুরগি পুষবে। ঝকায় আঁকায় ডিম যাবে বাজারে। উৎসাহ জোগাতে শুরুর দিকে পুনর্বাসনের উদ্যোক্তারা ডিম কেনা শুরু করেন। বাড়িতে রান্নার পর গৃহকত্রী জনে জনে জানান দিতেন, ‘ডিম খাচ্ছো-খাও। জিগ্যেস করো না, কাদের মুরগির ডিম খাচ্ছে।’ কারণ বিষয়টা গোপন রাখার কেন্দ্রের নির্দেশ ছিল। মানুষ যদি সত্য কথা জানতে পেরে বাজার থেকে ডিম কেনা বন্ধ করে দেয়! টুকির সেই চিন্তা নেই। সে যে বীরাঙ্গনা, ঢাকা শহরে মরিয়ম ছাড়া কাকপক্ষীও জানে না।
‘কিন্তু মেরি আফা, আমার কী লাভ অইলো?’ রাতে মুরগিগুলো ঘুমিয়ে পড়লে পাশাপাশি বিছানায় শুয়ে টুকি জানতে চায়। মরিয়ম প্রথম বুঝতে পারে না—‘লাভ অইলো মানে?’
‘এই যে ঢাকার কাকপক্ষীতেও জানতি পারল না, আমি একজন বীরাঙ্গনা!’
অন্ধকারে মরিয়ম নিঃশব্দে হাসে। একটা গণ-আদালত টুকিকে উচ্চাকাঙ্ক্ষার দিকে ঠেলে দিয়েছে। সে আর সাধারণ থাকতে চাচ্ছে না, নেত্রী হতে চাচ্ছে। কিন্তু দেশের মানুষ কি মানবে, যে এক লাইনও পড়তে জানে না! একটা সংবর্ধনা দিয়ে ছেড়ে দেবে–এবার নিজেরটা নিজে করে খাও। আর সন্তানের বয়সি ছেলেমেয়েরা ক্যামেরায় ছবি তুলে সামনে মাইক ধরে জানতে চাইবে, ‘দিনে কয়বার পাকিস্তান আর্মি আপনেরে ধর্ষণ করছে?’
অন্ধকারে মরিয়মের চিন্তার নাগাল পায় না টুকি। তার মুখের ক্রুর হাসিটাও দেখতে পায় না সে। ‘জীবনে আমি স্বামী পালাম না, বাচ্ছা পালাম না, সংসার পালাম না।’ টুকি না-পাওয়ার তালিকাটা দীর্ঘ। সারা রাত বলেও শেষ করা যাবে না। তবে হাতে এখন তার টাকা আছে। টাকা থাকলে টুকির ডবল বয়সের পুরুষও স্ত্রী পায়, বাচ্চা পায়, সংসার পায়। টুকি হচ্ছে মেয়েলোক। তার জন্য বয়স একটা ফ্যাক্টর। বীরাঙ্গনা হওয়ার দুর্নাম বা সুনাম না-হয় এ বেলায় বাদই দেওয়া গেল। সেই বুঝে টুকির কথাগুলোও অন্ধকারে মোড় নেয়। ‘মেরি আফা, ঘুমাই পড়ছেন? আরেকটা কথা।’ মরিয়ম সাড়া দেয় না। সে ঘুমিয়ে পড়লেও টুকি আরেকটা কথা না-বলে পারবে না। আর সেটি হচ্ছে, কুষ্টিয়ার তিনজন মহিলা গণ-আদালতে সাক্ষী দিয়ে চলে গেল। টুকির মনে খেদ, ‘তারা টাকাও পাইছে শুনলাম! আমরা ঢাকা বইসে কিছু জানতি পারলাম না। বুইঝতে পারলাম না। মেরি আফা, আমাদের মতো বীরাঙ্গনা এ দেশে কয়জনা। এখনো অমাবস্যা-পূর্ণিমা আলি এই পাশ থেইক্যে ওপাশে নড়ে শুতি পারি না। শইলের সব জায়গায় ব্যথা। ভিতুরে ভিতুরে জ্বর বায়।’ অন্ধকারে টুকি দীর্ঘশ্বাস ফেলে । মরিয়ম একজন লেখাপড়া জানা মহিলা। অফিসে চাকরিও করে। তার অগোচরে কোন ফাঁকে একটা গণ-আদালত হয়ে গেল! মরিয়ম আশ্বস্ত করে যে, এবার থেকে সে চোখ-কান খোলা রাখবে। যাতে মঞ্চে উঠে সাক্ষী দেওয়ার সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া না হয় টুকির।
আরেকটা গণ-আদালতের স্বপ্ন নিয়ে টুকি ঘুমিয়ে পড়ে। এবার বিছানায় এপাশ ওপাশ করার পালা মরিয়মের। গণ-আদালত বসলে সে কি সাক্ষী দেবে? কার বিরুদ্ধে? যে পাকিস্তানি সৈন্যরা দিনের পর দিন তাকে ধর্ষণ করেছে, সেসব ধর্ষকের সে নাম জানে না, পদ কী বলতে পারবে না, চেহারাও তাদের অস্পষ্ট। যার কথা যুদ্ধের এত বছর পরও মরিয়মের মনে আছে, সে মেজর ইশতিয়াক। মেজর ইশতিয়াকের সঙ্গের প্রেমের উপ্যাখ্যান সে কোথায় ফেলবে? তা লোকটার পক্ষে, না বিপক্ষে যাবে? আবেদ জাহাঙ্গীর, আবেদ সামির, মমতাজের বিরুদ্ধে মরিয়মের কোনো অভিযোগ নেই? যারা তার জীবনটা ছারখার করে দিয়েছে? মরিয়মের ছোট ভাই মন্টু সম্মুখযুদ্ধে শহিদ। তার মৃত্যুর নাকি বিচার হবে না। কারণ সে সিভিলিয়ান নয়, যোদ্ধা। কিন্তু গোঁফ ওঠার আগেই কেন তাকে যুদ্ধে যেতে হয়েছিল–এর জবাব নেই। গোলাম মোস্তফা মরিয়মের মামা, কোলাবোরেটর ছিলেন পাকিস্তান আর্মির, ১৯৭১ সালে। তিনি স্বয়ং যুদ্ধাপরাধী। মরিয়ম যে বাড়িতে থাকে, সেটি ছিল শত্রুসম্পত্তি, জলের দরে কফিলউদ্দিন আহমেদ হিন্দুর পরিত্যক্ত ভিটাবাড়ি ক্রয় করেছিলেন। তিনি আজ মৃত। মরিয়ম তার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী। এদিক দিয়ে ইতিহাস কি তাকে ছেড়ে কথা কইবে?