এই মিষ্টি মিষ্টি খুনসুটি বেশি দিন চলে না। দেশ-বিদেশের পরিস্থিতি উত্তপ্ত : ঢাকার রাস্তায় মিছিলের ওপর ট্রাক তুলে দিয়েছে পুলিশ, ইরাক আক্রমণ করতে যাচ্ছে আমেরিকা, লৌহমানবী থেচারের পতন আসন্ন, বেনজির ভুট্টো নির্বাচনে হেরে যাচ্ছেন। বিবিসির খবর না শুনলে দেবাশিসের রাতে ঘুম আসে না। অনুপম ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে খবরের মাঝখানে রেডিওটা একদিন আছাড় মেরে ভেঙে ফেলে। মরিয়ম নিজের ঘরে শুয়ে ম্যাগাজিন পড়ছিল। ভাঙাভাঙির শব্দে তার ভুরুজোড়া সামান্য কোঁচকায়, পরক্ষণে সে ফিরে যায় চটুল ম্যাগাজিনে। থমথমে মুখে ঘরে ঢোকে। দেবাশিস। কী যেন বলতে এসেছিল, তাকে বইয়ের পাতায় নিমগ্ন দেখে না-বলেই বেরিয়ে যায়।
এরশাদ পদত্যাগ করার পরদিন বিজয় মিছিল থেকে দেবাশিস আর অনুপম ফেরে না। অপেক্ষা করে করে মাঝরাতে তাদের ঘরে ঢুকে বাতি জ্বালায় মরিয়ম। দরজার পাশের আলনাটা খালি। ঘরে জিনিসপত্র কিছু নেই। বিছানায় বালিশচাপা এক টুকরো কাগজ। আত্মহত্যার নোটের মতো কাঁপা কাঁপা হাতে লেখা। চলে যাচ্ছে দেবাশিস। কারণ মরিয়মকে সহ্য করতে পারছে না অনুপম। সে জেলাস। দুজনের না-বলে যাওয়ার কারণ–দেবাশিস মনে করে, মরিয়ম তাকে যেতে দেবে না। তাদের খোঁজ করাটাও অযথা সময় নষ্ট হবে–জানিয়ে গেছে দেবাশিস।
মহল্লার জনতার উদ্যম, কৌতূহলে ভাটা পড়ে গেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মতো ব্যর্থ এ মহিলার জীবন। বারংবার অন্ধকার গর্তে পড়া তার নিয়তি। তার জন্য ভালো কিছু করতে গেলে হিতে বিপরীত হয়। তাদেরও তো বয়স বাড়ছে। খোদার লীলাখেলা আর নেতাদের ভণ্ডামি দেখতে দেখতে ক্লান্ত। পাড়ার নতুন প্রজন্ম যারা হাফপ্যান্ট ছেড়ে ফুলপ্যান্ট ধরেছে, লুকিয়ে-চুরিয়ে সিগারেট ফুঁকছে, না-ওঠা মোচে তা দিচ্ছে, তাদের মায়ের বয়সি মরিয়ম। তবে কারো মা নয় সে, তার না-থাকা সন্তানের বাবারা আজ আছে, কাল নেই। এসব দেখে দেখে তারা হাঁটতে শিখেছে। এখন পাড়ার গলিতে সকাল-বিকাল ফুটবল খেলে। শরীরের জন্মদাগের মতোই প্রশ্নাতীত এ নারী তাদের জীবনে। শুধু তার ব্যবহারটা যদি আরেকটু ভালো হতো, তারা খুশি। থাকত। তাদের ফুটবল ঘরের চালে পড়লে মরিয়ম গলা ফাটিয়ে চিৎকার জুড়ে দেয়। কখনো তার কাছ থেকে বল ফেরত পাওয়া যায় না। সাহস করে দেয়াল টপকে কখনো যদি ছেলেরা বাড়িতে ঢোকে, ‘আন্টি এই শেষ, আর কোনোদিন ঘরের চালে বল পড়বে না’ বলে নাকে খত দিয়ে বেরিয়ে আসতে হয়। বাড়ির ভেতরটা অবশ্য ছেলেদের খুব টানে। কেন, তা তারা জানে না। তাদের কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধটা। সুদূর পলাশী বা পানিপথের যুদ্ধের কাছাকাছি ইতিহাস বইয়ের ঘটনা বৈ কিছু নয়। বাতাসে কিছু কথা ভেসে উঠে হারিয়ে যায়।
বাস্তব জীবনের মতো রাতের দুঃস্বপ্নেও মরিয়ম বারবার অন্ধকার গর্তে পড়ে। তবে অলৌকিকভাবে উদ্ধারও পেয়ে যায়। এক রাতে হয়তো দেখল, একটা উঁচু দালানের ওপর থেকে পড়ে যাচ্ছে, পায়ের তলায় সাপোর্ট নেই, পড়তে পড়তে কার্নিশ ধরে সে ঝুলে রইল। কিংবা আরেক রাতে উঁচু দালান থেকে পড়ার আগে দেখতে পেল, নেমে যাওয়ার একটা ঝুলন্ত সিঁড়ি। অন্য একটা স্বপ্ন যা মরিয়ম প্রায়ই দেখে, সেটা হলো, সে একটা গাঙ পার হচ্ছে কাঠের সাঁকোর ওপর দিয়ে, যার মাঝখানটা নেই। ঘুমের ভেতর যখন সে ভয়ে দিশাহারা, পানিতে পড়ো পড়ো ভাব, তখন অস্পষ্ট কিছু একটা দেখতে পায় ওপারে যাওয়ার। জিনিসটা কী–জেগে ওঠার পর মনে থাকে না। তবে মরিয়ম ওটাকে আলকাতরা মাখানো, নতুন পাল-বৈঠার একটা নৌকাই ভাবে।
জীবনের শেষ কোথায় আর কীভাবে–না জানলেও, দেবাশিস চলে যাওয়ার পর মরিয়ম যে শূন্য গর্তে পড়ে গেছে, একটা নতুন পালতোলা নাও তাকে এতখানি ভরসা দেয় যে, সে নিশ্চিত–আজ হোক কাল হোক এ থেকে উতরাতে পারবে। তাই ১৯৯২-এর ২৬ মার্চ, সকাল এগারোটায় পশ্চিম পার্শ্বের গেট দিয়ে সে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশ করে। জায়গাটা মানুষে মানুষে সয়লাব। ২১ বছর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় ঘোষণা হবে। মরিয়মের চোখে কালো চশমা, মাথার চুল চূড়ায় তুলে খোঁপা-বাঁধা। তাকে ছদ্মবেশী নায়িকার মতো দেখায়। সে কালো চশমার আড়াল থেকে পুরোনো মানুষদের খুঁজছে। যারা নির্যাতিত হয়েছিল, তারা কি এই বিলম্বিত বিচারসভায় হাজির হবে না? হোক না তা প্রতীকধর্মী। আর কেউ না আসুক, অনুরাধা আসবেই, যদি সে বেঁচে থাকে। মরিয়মের মতো কালো চশমা, উঁচু খোঁপার আরো কয়েকজন ইতস্তত ঘুরছে। তারাও হয়তো একাত্তরের বীরাঙ্গনা। গণ-আদালতের রায় শুনতে এসেছে বা তার মতো খুঁজে বেড়াচ্ছে নির্যাতন ক্যাম্পের সাথিদের। রোদের তেজ ক্রমশ বাড়ছে। অদূরে বাজছে বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-আর যদি একটা গুলি চলে…ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। সেই একই জায়গা–তখনকার রেসকোর্স ময়দান। তখন এত গাছপালা ছিল না। বিরান মাঠ। বিশাল জনসমুদ্র দেখে মন্টু ঘাবড়ে গিয়েছিল, ‘মেরিবু, আমি যদি হারাই যাই, খুঁজিস না, তুই। একটা রিকশা ধরে সটান বাসায় চলে যাইবি।’ কত বছর আগের কথা? বিশ! না একুশ? মরিয়ম চশমা খুলে চোখ মুছে ফের জনসমুদ্রের দিকে তাকায়। শাড়িতে হঠাৎ টান পড়ে। ‘কে, মেরি আফা না?’ পেছন ফিরতেই তার মুখোমুখি টুকি। হাতে টিফিন কেরিয়ার। নতুনগাঁওয়ের সেই কাজের মেয়ে, একই দিনে মিলিটারি তাদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল। টুকি গণ-আদালত দেখতে আসেনি। উদ্যানটা তার গার্মেন্টসে আসা-যাওয়ার শর্টকাট পথ। আলসারের ব্যথা ওঠায় আজ তার কাজে যেতে দেরি হয়েছে। বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবসেও গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি খোলা থাকে? আশ্চর্য তো! মরিয়ম অবাক হয়। টুকি বলে, ‘আপনে কী মনে করেন! বচ্ছরের ৩৬৫ দিনই খোলা। কামাই দিলে বেতন কাইটে নেয়। কিন্তু মরিয়মের সঙ্গে দেখা হওয়াতে টুকি অফিস কামাই দিয়ে সোহরওয়ার্দী উদ্যানে ঘুরতে থাকে। কার বিচার, কী বৃত্তান্ত ভিড়ের ঠ্যালায় বোঝার উপায় নেই। কুষ্টিয়া থেকে তিনজন বীরাঙ্গনার সাক্ষী দিতে আসার কথা। মরিয়ম তাদের একনজর দেখতে চায়। যদি পরিচিত কেউ হয়! ‘তাইলে তো আপনেরে গাছের আগায় উঠতে হবে।’ পাশ থেকে একজন পাজামা-পাঞ্জাবি পরা পুরুষ মন্তব্য করে। সত্যি গাছের ডালে ডালে মানুষ। ট্রাকের ওপর থেকে জাহানারা ইমাম যে গণ আদালতের বিচারের রায় ঘোষণা করছেন, নিচের মানুষ তা দেখতে পাচ্ছে না। মাইকও নেই যে, ঘোষণাটা কানে শুনবে। ‘পুলিশ ঢাকা শহরের সব মাইক বাজেয়াপ্ত করেছে।’ তারা প্রশ্ন না করলেও পাজামা-পাঞ্জাবি পরা লোকটি জবাব দিয়ে যাচ্ছে। ‘লোকটার চরিত্র খারাপ!’ বলে টুকি মরিয়মকে টানতে টানতে উদ্যানের বাইরে নিয়ে আসে।