এভাবে বঞ্চিত হওয়া কি ধর্ষণের চেয়ে খারাপ? মরিয়ম অতীতের ধর্ষকদের একে একে স্মরণ করে। বাড়ির উঠোন থেকে গলির শেষ মাথা পর্যন্ত তাদের লম্বা লাইন। সে কি পাগল হয়ে যাচ্ছে? আবেদ জাহাঙ্গীর, মেজর ইশতিয়াককেও তার আর মনে ধরে না। এই রাতে দেবাশিসকেই তার চাই–যে তার শরীর চায় না।
‘তুমি অসুস্থ অসুস্থ, আমি বলছি, মেরি,’ দেবাশিস দিনের বেলা চাচায়, ‘তুমি ডাক্তার দেখাও।’ মরিয়ম অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল। ‘দূর হ হারামজাদা,’ বলে দেবাশিসের গায়ে পায়ের স্যান্ডেল ছুঁড়ে মারে সে। ভেবেছিল, লজ্জা থাকলে ছেলেটা আর এ মুখো হবে না। দু’দিন পর ঠিকই ফিরে আসে। সঙ্গে আরেকটা কমবয়সি ছেলে। দেবাশিস পরিচয় করিয়ে দেয়, এর নাম অনুপম সিকদার। জগন্নাথ কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। বাড়িটা যে মরিয়মের, এ নিয়ে দুজনের কারো মাথাব্যথা নেই। তাকে অবশ করে দিয়ে তারা ঘরে ঢুকে দরজার খিল তুলে দেয়। পরিস্থিতি মরিয়মকে বোবা করে দিয়েছে। এবার নিজের বাড়িতেও সে পরবাসী। প্রতিবাদ করতে গেলে ফের যদি একা হয়ে যায়! বাইরের অবস্থাও তখন উত্তপ্ত। এরশাদ পতনের আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। আজ প্রতিরোধ, কাল হরতাল। একদিন অফিসে গেলে দু’দিন ঘরে থাকতে হয়। ছেলে দুটি সারা দিনে একবারও বাইরে বেরোনোর নাম করে না। ঘরের ভেতর জেঁকে বসেছে। জোরে জোরে রেডিও শোনে। ফাঁকে ফাঁকে উঠে গিয়ে খিচুড়ি পাকায় আর ডিম ভাজা করে নিজেরা খায়, মরিয়মকে খেতে দেয়।
এ ব্যবস্থায় মনোয়ারা বেগম মহা খুশি। তিনি ঢাকা এসেছেন ডাক্তার দেখাতে। রায়ের বাজারের দিকে না এসে বাসস্ট্যান্ড থেকে সরাসরি চলে যান মগবাজার, গোলাম মোস্তফার বাসায়। পরদিন আসেন মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে। ‘মরিয়ম তুই খুব ভালো স্বামী পাইছস। ছেলেডা কিউট!’ মেরির গোমড়া মুখ দেখে তিনি চটে যান, ‘কী বেআক্কেলে মাইয়্যা তুই! বুড়া বয়সে বিয়া অইছে। কই স্বামীর সেবাযত্ন করবি, তা না, ঠ্যাংয়ের ওপর ঠ্যাং তুইল্যা খাইতাছস।’
মায়েরা নাকি মেয়ের দুঃখ বোঝে। মা তো উল্টা বুঝলেন। মার কাছে আসল ঘটনা ভেঙে বলতে মরিয়মের ইচ্ছা করে। দুনিয়ায় অন্তত একজন মানুষ জানুক, কী নরকের মধ্যে সে দিন গোজার করে। কিন্তু মনোয়ারা বেগমকে দেখে মনে হচ্ছে, এমন বাজে কাজে নষ্ট করার মতো সময় তার নেই। দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। বাড়িটা আগাছায় ছেয়ে গেছে। হাস্নাহেনার ঝোঁপের আর দরকার কী। জোড়া সাপের বদলে, বাড়ি পাহারা দিতে একজোড়া পুরুষই তো আছে। তিনি দা-কুড়াল হাতে দিয়ে দেবাশিস আর অনুপমকে গাছ কাটায় লাগিয়ে দেন। মহা উদ্যমে তারা গাছ কাটে। মনোয়ারা বেগম দুপুরের কাঠফাটা রোদে দাঁড়িয়ে তদারক করেন, হাতে হাতে গাছের ডালপালা সরান। মরিয়মের অস্থির লাগে। মা মনে হয় দিন দিন খুকি হচ্ছেন! এ বয়সে এতটা পরিশ্রম সহ্য হবে? হার্টের অবস্থা খারাপ, ডায়াবেটিসেও ধরেছে। মনোয়ারা বেগম মেয়ের কোনো কথাই কানে তোলেন না। বাড়িটাকে ন্যাড়া বানিয়ে, মরিয়মকে হতাশার অতলে ফেলে, সন্ধ্যা নামার আগে আগে ভাইয়ের বাসায় ফিরে যান। তার কোনো পিছুটান নেই। ’৭৪-৭৫ সালে যে মায়ের ধ্যানজ্ঞান ছিল মেয়ে, মেয়ের পুনর্বাসনের জন্য যিনি পাগল হয়ে উঠেছিলেন, নব্বইয়ে তার এ পরিবর্তন!
বছরটাও নানা আলামতের মধ্য দিয়ে শেষ হচ্ছে। বাবরি মসজিদ আক্রান্তের উড়ো খবরে দাঙ্গা বেধে গেল পুরান ঢাকায়। মরিয়ম ও অনুপম দুজনেই দেবাশিসের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন। সরকার সারা দিন হিন্দুর দোকানপাট, ঘরবাড়ি অবাধে লুটপাট, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করতে দিয়ে সন্ধ্যায় কারফিউ জারি করে। অনুপম বাইরে থেকে ঘুরে এসে বলে, ‘এইডা এরশাদশাহির কাণ্ড। সরকারবিরোধী আন্দোলন বিভ্রান্ত করতে শালা দাঙ্গা বাধাই দিছে।’ দেবাশিস কিছু বলে না। সারা দিন ঘরে বসে পায়ে তার ঝি-ঝি ধরে গেছে। সে বাইরে বেরোতে চাইলে অনুপম স্বামীভক্ত পত্নীর মতো তার শার্ট টেনে ধরে। ‘দেবাশিস খাড়াও, এ বিপদের মধ্যে বাইরে যাবা না কইলাম! মরিয়মকে বারান্দায় দেখে দেবাশিস অপ্রস্তুত হাসে, আহ্ ছাড়ো বলছি! আমি দেবাশিস না, আবেদ ইশতিয়াক।’ তাই তো! দেবাশিস যে কলমা-পড়া মুসলমান–মরিয়মের মনেই ছিল না। ‘তুমি আবেদ ইশতিয়াকই হও আর যে হও, অনুপম গোঁ ধরে, এখন বাইরে গেলে আমার লাশের ওপর দিয়ে যাইবা।’
দেবাশিস বাইরে যায় না ঠিকই, কিন্তু অনুপম গাল ফুলিয়ে বসে থাকে। মরিয়মের দিকে দেবাশিসের নরম চোখে তাকানো, মিষ্টি স্বরে কথা বলা–এসব তার ভালো ঠেকছে না। সে জাতকুল ছাড়ার মতো হোস্টেল ছেড়ে চলে এসেছে। বন্ধুরা বুঝুক না বুঝুক তাকে নিয়ে ঠাট্টা করে। তাদের সন্দেহ মরিয়মকে নিয়ে। মহিলা একাত্তরের বীরাঙ্গনা, বহুগমনে অভ্যস্ত, এক স্বামীতে চলছে না, তাই অনুপমকে ভাড়া খাটাতে স্বামীকে পাঠিয়ে হোস্টেল থেকে তুলে নিয়েছে। দেবাশিসকে তারা মনে করে কাপুরুষ, পুরুষ জাতির কলঙ্ক।
অনুপমের মুখে এসব অভিযোগ শুনতে শুনতে দেবাশিস মরিয়মকে ডাকে, ‘মেরি শুনছ, অনু কী বলে, মজার ব্যাপার শুনে যাও।’ মরিয়ম দরজা পর্যন্ত এসে থমকে দাঁড়ায়। অনুপম মুখ চেপে ধরেছে দেবাশিসের আর ‘ওগো শুনছো ওগো শুনছো’ বলে ভেংচি কাটছে। অর্ধেক বয়সের ছেলে বাড়ি তুলেছে দেবাশিস, দিনে দিনে মজা আরো টের পাবে। দরজা থেকে সরে আসছিল মরিয়ম, মুখ থেকে অনুপমের হাত সরিয়ে দেবাশিস এবার চাচায়, ‘মেরি, জগন্নাথ কলেজের ছাত্ররা আমারে কয়…’