বয়স বাইশ বছর এবং মুখাকৃতি গোলাকার, চেনার এ দুটি লক্ষণ মাথায় নিয়ে মুক্তি বারান্দার নড়বড়ে বেঞ্চিতে বসে থাকে। টুকি সামনে দিয়ে এমনভাবে আসা যাওয়া করে, যেন সে-ই এ বাড়ির ঘরনি। উঠোনের দড়ি থেকে কাপড় তোলে টুকি। পোষা মুরগিগুলোকে কক কক শব্দ করে ডেকে নিয়ে যায় রান্নাঘরের পেছনে। তাকে মুক্তি মরিয়ম ভাবে না, শুধু এ কারণে যে, তার বয়স বাইশ নয়, আর মুখাকৃতিও গোলাকার নয়। তারপর মরিয়ম সামনে এসে দাঁড়ালে সে সালাম দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। নিজের পরিচয় দিয়ে বলে যে, সে মরিয়ম বেগমের একজন সাক্ষাৎপ্রার্থী, অনেকক্ষণ হয় এসেছে, তাড়াতাড়ি ভদ্রমহিলার দেখা পেলে ভালো হয়, কারণ সে থাকে মিরপুর, রাত হয়ে আসছে, তাকে বাসে করে বাসায় ফিরতে হবে। মরিয়ম তার দীর্ঘ বাক্যটি শুনতে শুনতে ঘরে ঢুকে বাতি জ্বালায়। তার দিকে একটি বেতের চেয়ার এগিয়ে দিয়ে নিজে মোড়া টেনে বসে বলে, ‘আমার নাম মরিয়ম বেগম।’
মুক্তির মুখ থেকে কথা সরে না। মাঝখানে আটাশটা বছর যে পালিয়ে গেছে, তা তার ধীরে ধীরে মনে আসে। তাহলেও ভদ্রমহিলার বয়স মাত্র পঞ্চাশ এখন। একজন বীরাঙ্গনা এত অর্ডিনারি হয় দেখতে! রাধারানী তো এরকম নয়। মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপান। সত্ত্বেও ওর জেল্লা আছে চেহারায়। এদিকে মরিয়মের গোলাকার মুখের চন্দ্রিমাভা বয়সের রাহুগ্রাসে হারিয়ে গেছে। কিন্তু তার চেহারা তো হওয়ার কথা নাটক-সিনেমার সেসব মা-খালাদের মতো, মেকআপ দিয়ে যাদের বয়স বাড়ানো হয়েছে, আসলে তারা বয়স্ক নয়।
নিজের চেহারা অন্য আরেকজনের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা মরিয়মের পছন্দ হয় না। সে কি নতুন বউ যে বাইরের মানুষ এসে তার মুখ দেখবে! মুক্তিকে সে জিগ্যেস করে, বেবি তার সম্পর্কে কী বলেছে। কিন্তু উত্তর শোনায় মনে হলো, তার বিশেষ আগ্রহ বা ধৈর্য নেই, দুম করে বলে বসে, ‘হে তো একটা মাথা পাতলা মহিলা।’ তারপর তার একপ্রস্থ গালাগাল শুনতে শুনতে মুক্তির চোখের সামনে থেকে অর্ডিনারি চেহারাটা অন্তর্হিত হয়ে মরিয়মের গালের গোলাপি আঁচিলটা জ্বলজ্বল করতে থাকে। বীরাঙ্গনার রাগ না-থাকাটাই অস্বাভাবিক। আগে যা ছিল অভিমান, এখন তা হয়তো ক্ষোভ-তবে কার বিরুদ্ধে বোঝা যায় না। সে যা-ই হোক, কথাবার্তা শুরুর আগে ভদ্রমহিলার কঠিন দিল ভিজিয়ে খানিকটা নরম করা দরকার।
‘আপনাদের আত্মত্যাগ ছাড়া তো দেশ স্বাধীন হইত না। আপনারা বিশেষ কিছু… মানে।’ কথার মাঝখানে তোতলাতে থাকে মুক্তি। এদিকে মনে হয় জেঁকের মুখে নুন পড়েছে। মরিয়ম মোড়া ছেড়ে পাশের চেয়ারে গা এলিয়ে বসে। চোখ সিলিংয়ের দিকে। আজ কত বছর পর একজন তার বাড়ি খুঁজে খুঁজে এসেছে। অনুরাধা তাহলে মিথ্যা বলেনি। মানুষের কষ্ট-নির্যাতনেরও দাম আছে। কিন্তু তারা যে। বিশেষ কিছু–সেটা কী? তা কি মাপা যায়-সম্মান, মর্যাদা, ভালোবাসা বা শ্রদ্ধা দিয়ে?
দুটি বিয়ের পর, অল্প দিনের জন্য হলেও মরিয়মের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা বেড়ে গিয়েছিল। এর সঙ্গে যদিও একাত্তরের ধর্ষণের সরাসরি সম্পর্ক নেই। বিশেষত, দ্বিতীয় বিয়ের বহু আগে বীরাঙ্গনার লেবাস মরিয়মের গা থেকে এমনিই খসে পড়েছিল। এটি ছিল অস্বাভাবিক বিয়ে, যার মধ্যস্থতাকারী মহল্লার লোকজন। তাদের অজুহাত ছিল, দুর্নামের হাত থেকে মহল্লার মান-ইজ্জত রক্ষা করা, প্রকারান্তরে একজন বীরাঙ্গনার পায়ে শিকল পরানো, যে তাদের অগোচরে পরপুরুষ সংসর্গ করছে।
বিয়ের দ্বিতীয় দিনে হাজির ছেলে বর-কনেকে দাওয়াত করে খাওয়ায়। হাজি সাহেবের বিধবা স্ত্রী মরিয়মকে উপহার দেন একটা হাফ সিল্ক জামদানি শাড়ি। দেবাশিসের জন্য কিনে আনেন সিল্কের টুপিসহ তসরের পাঞ্জাবি। আশপাশের বাড়ির ছেলেপেলেরা রাস্তায় দেখা হলে বর-কনেকে সালাম দিত। বিয়ের খবরে টলেননি শুধু মনোয়ারা বেগম। ‘ধুর ধুর, এইডা একটা বিয়া অইলো! ছন্দা তোরও মাথা খারাপ–বইনের বিয়ার কথা শুইন্যা নাচতাছস। তোর বাপও একদিন নাচছিল, হে যখন মমতাজরে শাদি করে।’ তিনি তো ঢাকা এলেনই না, ছন্দাকেও ভিড়তে দেননি এদিকে। পরে যখন স্কুলমাস্টার কলিগের সঙ্গে ছন্দার বিয়ে হয়, তখনো মরিয়ম আর দেবাশিস দাওয়াত পায়নি। মনোয়ারা বেগম ছাড়া মেরির বিয়েতে নাখোশ ছিল আরেকজন–স্বয়ং দেবাশিস। মরিয়মের সঙ্গে তার স্বাভাবিক বন্ধুত্বের সম্পর্কটা বিয়ের পর নষ্ট হয়ে যায়। কোথাও যাবার জায়গা না থাকায় আরো দুটি বছর সে এ বাড়িতে ছিল। তখন ঘুমাত পাশের ঘরে। নৌকাডুবির দুঃস্বপ্নটা মাঝরাতে মরিয়মের ঘরে তাকে আর ফিরিয়ে আনতে পারেনি। ঠিকা ঝির তো আক্কেলগুড়ুম। স্বামী-স্ত্রী একঘরে থাকে না, এক বিছানায় শোয় না–এ কেমন! দেশের বাড়ি থেকে স্বামী-বশীকরণের তাবিজ আর পানিপড়া এনে মরিয়মকে দিয়েছিল ঠিকা ঝি। সেসব কাজে না দিলে চাকরি ছেড়ে চলে যায় সে।
ঠিকা ঝি তো চাকরি ছেড়ে খালাস। একটা ব্যর্থ বিয়ে দিনে দিনে মরিয়মের মনে ক্রোধের জন্ম দেয়। বয়স তখন তার চল্লিশ। সন্তানের মা হতে কোনো বাধা নেই। পাশের ঘরে স্বামী রয়েছে, অথচ সে তার সঙ্গে শোয় না। পাড়ার লোকেরা তাকে বিয়ে দিয়ে তিলে তিলে যে শাস্তি দিচ্ছে, এর চেয়ে পাথর মারা অনেক ভালো ছিল। একবারেই সব শেষ হয়ে যেত। মরিয়ম মাঝরাতে বিছানা ছেড়ে উঠে দেবাশিসের ঘরের কড়া নাড়ে। ভেতর থেকে সাড়া আসে না। বারান্দার বেঞ্চিতে বসে তার মনে আকাশসমান ঘৃণা জন্মায় দেবাশিসের প্রতি। সে কি দরজা খুলে বেরিয়ে আসতে পারে না একবার! মরিয়ম শারীরিক সম্পর্ক চায় না, সন্তান চায় না, দেবাশিস শুধু তার মাথায় হাত রাখুক, সে শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়বে। পরদিন কথাটা শোনার পর দেবাশিস মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়াতে এসেছিল। যে পুরুষটি নির্ভেজাল পুরুষ-আসক্ত, তার ছোঁয়া পাওয়া মাত্র মরিয়মের শরীরের গ্রন্থি আলগা হতে শুরু করে। কোল থেকে মাথা নামিয়ে উঠে পড়ে দেবাশিস। সব জানার পর ভগবান জানেন, মেরি কেন তাকে বিছানায় চায়। সারা রাত কামার্ত বাঘিনির মতো বারান্দার এমাথা-ওমাথা পায়চারি করেছে মরিয়ম। এ তামাশা দেখার লোক ছিল না। হাজির বাড়ির দোতলাটা অন্ধকার। সবাই যার যার বিছানায় ঘুমাচ্ছে। মেরি-দেবাশিস স্বামী-স্ত্রীলোকজন বিয়ে দিয়েই দায়মুক্ত, তাদের রাত কীভাবে কাটে, এ নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। গলা ফাটিয়ে মরিয়মের চাচাতে ইচ্ছা করে–যে পুরুষ কিছু করতে পারে না, সে মাথায় হাত বোলাতে আসে কেন?