‘কিন্তু খালাম্মা, আপনারা এসব কী বলেন?’ মরিয়ম আপত্তি জানায়, ‘ও আমার ছোট ভাইয়ের মতো!’
‘ভাই হোক আর যা হোক, নিজের মায়ের পেডের ভাই তো না, মা তুই রাজি হইয়্যা যা। এ ছেলে মুখে যা বলে, তা কইরা ছাড়ে।’
ঘণ্টা খানেক পর মামা গোলাম মোস্তফা এসে হাজির। গত মাসে স্ট্রোক করে শরীরের বাঁ পাশ অবশ। লাঠি ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন। ‘কি ভাগনি, তুমি নাকি লিভ-টুগেদার করতাছ? নাউজুবিল্লাহ্ নাউজুবিল্লাহ, আসতাগফিরুল্লাহ। তোমার মামি আসতাছে শাড়ি নিয়া। বাদ জোহর বিয়ে পড়ানো হবে।’
বিয়ে পড়াতে গিয়ে আরেক বিপত্তি। দেবাশিস যে হিন্দু, মরিয়ম ছাড়া কেউ জানত না। যে মৌলবিকে পাথর মারার জন্য আনা হয়েছিল, তিনি অজু করে দেবাশিসকে মুসলমান বানাতে বসে গেলেন। এ বয়সে খতনা করানোর ঝুঁকি আছে। টিটেনাস হয়ে যেতে পারে। গোলাম মোস্তফা বললেন, ‘পাঁচ কলমাই সই।’ কলেমা তৈয়ব পড়া শুরু হতে দেবাশিস ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। ভিড়ের ভেতর তখন হাসির হুল্লোড় আর কটুক্তি, ‘ফাউ শুতে পারছো শালা মালু, এহন কান্দন আহে কলমা পড়তে?’ কাঁদতে কাঁদতে হুজুরের সঙ্গে সঙ্গে দেবাশিস বলে চলে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ্।’ মুখ খারাপ করা লোকগুলো বিনা কুলকুচিতে, বিনা-অজুতে হুজুরের সঙ্গে মোনাজাত ধরে। একটা পুণ্যের কাজ করতে এসে আরেকটা পুণ্য হয়ে গেল। মালাউনকে মুসলমান করার সওয়াবের ভাগিদার তারাও। সাত পুরুষের জন্য বেহেশত বুকড হয়ে গেছে। দেবাশিসের বুক পকেটে তখনো মায়ের সেই চিঠি—‘মেয়েকে অবশ্য অবশ্য হিন্দু কায়স্থ হতে হবে।’
মুসলমান হওয়ার পর দেবাশিস নামটা আর চলছে না। একটা মুসলমান নাম দেওয়া দরকার। স্ট্রোক করে গোলাম মোস্তফার মাথাটা গেছে। নিজের ছেলেদের নামও আজকাল মনে থাকছে না। তিনি অন্দরমহলের উদ্দেশে হাঁক দেন, ‘ভাগনি, তুমি তো স্বাধীন জেনানা, একটা নাম দেও দেখি তোমার স্বামীর।’
কয়েক মুখ ঘুরে পাশের ঘর থেকে একটা নাম আসে–আবেদ ইশতিয়াক।
দেবাশিসের জানার উপায় নেই যে, নামটা এসেছে মরিয়মের কাছ থেকে। আবেদ এবং ইশতিয়াক দুটি নামই তার পরিচিত। মরিয়মের মুখ থেকে শোনা। তবে তা দুজনের। এখন একসঙ্গে উচ্চারিত হতে শুনেও চমকে ওঠা বা ভয় পাওয়ার মতো মনের অবস্থা তার নেই। শুধু মনে হচ্ছে, এখন যা ঘটছে, গত রাতের দুঃস্বপ্নের চেয়েও ভয়ংকর। তবে তাদের যে মেরে ফেলা হচ্ছে না, এই যথেষ্ট।
মরিয়মের আরেকটা ফাড়া কাটল। মৃত্যুর মুখ থেকে বারবার ফিরে আসা তার নিয়তি। মামি জ্বলেখা বিবি বললেন, ‘মরিয়ম, খোদার কাছে শোকর করো, এ বয়সে তোমার বিয়ে হইছে। তোমার আব্বা বেঁচে থাকলে খুব খুশি হইতেন।’ তেলাপোকা কাটা কাতান শাড়ি মরিয়মকে তিনি পরিয়ে দেন। শাড়িটা ন্যাফথালিনের ভুরভুর গন্ধ ছাড়ছে। তাড়াহুড়োয় শাড়ি-গয়না কিনতে বাজারে যাওয়া হয়নি। জ্বলেখা বিবি নিজের সম্বল যা ছিল, তা দিয়ে কনে সাজালেন। দৌড়ঝাঁপ করে রান্নার জোগাড়যন্ত্র করে ঠিকাঝি। কুটনামি করে আজ সে সার্থক। হাজির ব্যাটা পুণ্যের কাজ করেছে। সে তো বেশ্যাপাড়ায় কাজ করে না যে, রোজ সকালে মাগিলোকের নোংরামি দেখতে হবে! আগামীকাল থেকে ঠিকাঝির এ বাড়ির কর্তাগিন্নি বিবাহিত স্বামী-স্ত্রী।
বিয়ে পড়ানোর পর স্বামী-স্ত্রীকে বারান্দার বেঞ্চিতে শতরঞ্জি পেতে বসানো হয়েছে, যেখানে দর্জিগিরি করার সময় মরিয়মের কাস্টমাররা পা ঝুলিয়ে বসে থাকত। দেবাশিসের পরনে শেরওয়ানি, মাথায় পাগড়ি। কলেমা পড়ে একবেলায় তার চেহারার যে পরিবর্তন এসেছে তাতে মনে হয়, সর্বান্তকরণে সে বিশ্বাস করে–আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মাবুদ নাই এবং মুহাম্মদ আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ। মিষ্টিমুখ করার সময় গোটা রসগোল্লা সে একবারে গিলে ফেলে। গতরাতের পর কিছু খাওয়া হয়নি, খিদা পেয়েছে নিশ্চয়। বর-কনের মুখ দেখার জন্য যে আয়নাটা সামনে ধরা হয়েছে, সেটি দেবাশিসের খেউরি করার বাথরুমের আয়না। আকারে ছোট। একবারে মুখের আধখানা শুধু দৃশ্যমান হয়। মরিয়মকে সেখানে সে দেখতে পায় না। তবু নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে আয়নাটার দিকে। পাড়াপড়শি বিয়ে নিয়ে নাচলেও মরিয়ম কেবল জানে, দেবাশিস অপেক্ষা করছে যার, সে কোনোভাবে নারী নয়–একজন জলজ্যান্ত পুরুষ। রাত নেমে আসছে। খানাপিনার পর গোলাম মোস্তফা সস্ত্রীক ফিরে যাবেন। পাড়ার লোকজন ইহকালের বাহাদুরির মজা লুটে, পরকালের বেহেশতের সার্টিফিকেট নিয়ে যে যার মতো চলে যাবে। দেবাশিস আর মরিয়ম তখন একা। একটা অবাস্তব বিয়ের ভার তারা বহন করবে কীভাবে?
২৮. আরেকটা গণ-আদালত, না হয় মুক্তিযুদ্ধ
মরিয়মের দ্বিতীয় বিয়ের দশ বছর পর মুক্তি যখন ঠিকানা খুঁজে খুঁজে রায়েরবাজারের বাসায় হাজির হয়, দেবাশিস তখন আর ওখানে নেই। তাকে দরজা খুলে দেয় টুকি। বারান্দায় বেঞ্চিতে বসে মুক্তি অপেক্ষা করে একজন বীরাঙ্গনার, বেবির লেখা কেসহিস্ট্রিতে যার বয়স বাইশ। পুনর্বাসনকেন্দ্রের চিকিৎসার পর বয়সটা আরো কম দেখাত–গর্ব করে তাকে বলেছিল বেবি। যদিও বারবার জিগ্যেস করেও জবাব পায়নি, মেয়েটা একা একা হাসত যখন, তখন চুলের ফাঁক দিয়ে তার গালে টোল পড়তে দেখেছে বেবিরা। তারপর তো মরিয়মের মানসিক রোগ ধরা পড়ে। ভাগ্য ভালো যে, ঠিক সময়ে গার্জিয়ান এসে মেয়েটাকে বাড়ি নিয়ে গেছে। তা না হলে, বিদেশি ডাক্তাররা চলে যাওয়ার পর তাকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে চালান দেওয়া হতো। যারা একবার ওখানে গেছে, তারা আর বাইরের আলো দেখেনি। ওখানকার। পাগলেরাই হয়েছিল তাদের আপনজন। সবশেষে বেবি পত্রিকার হারানো বিজ্ঞাপনের ভাষায় মুক্তিকে বলে, মেয়েটির বাম গালে একটা গোলাপি আঁচিল আছে আর মুখাকৃতি চাঁদের মতো গোলাকার। মুক্তিকে পরে নতুনগাঁওয়ের জৈতুন বিবিও মরিয়মের কথা বলতে যেয়ে চাঁদপানা মুখের উল্লেখ করেছিল।